কুমিল্লায় মুক্তিযােদ্ধা-জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ, সেই রাজাকার, আদম শফিউল্লার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার না হলে গণআদালতে বিচার করা হবে।
আবুল কাশেম হৃদয়, কুমিল্লা থেকে ॥ সেই রাজাকার আদম শফিউল্লা ওরফে মুহাম্মদ জাকারিয়ার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবিতে শত শত মুক্তিযােদ্ধা-জনতা শনিবার কুমিল্লায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। বিক্ষুব্ধ মুক্তিযােদ্ধা-জনতার মুহুর্মুহু স্লোগানে এ সময় রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বিক্ষোভ সমাবেশে এই কুখ্যাত রাজাকারের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার না হলে গণআদালতের মাধ্যমে বিচারের ঘােষণা দেয়া হয়। সেই সাথে তার সম্পাদিত ‘দৈনিক বাংলাদেশ সংবাদ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল, অবৈধ সম্পদের উৎস তদন্ত এবং লিজ দেয়া সরকারী সম্পত্তি ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানাে হয়। গতকাল সকাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শত শত মুক্তিযােদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের জনতা শহরের গােয়ালপট্টিস্থ জেলা। মুক্তিযােদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সমবেত হয়। সকাল ১১টায় শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল। ‘রাজাকার জাকারিয়ার বিচার চাই- করতে হবে’, ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক। আরেক বার’, ‘রাজাকারের গালে গালে জুতা মারাে তালে তালে’ ইত্যাদি স্লোগানসহ জাকারিয়াবিরােধী মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে দিতে বিক্ষোভ মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহরের প্রাণকেন্দ্রের পুবালী চত্বরে এক বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
জেলা মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কমান্ডার শফিউল আহাম্মেদ বাবুলের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা মফিজুর রহমান বাবুল, বাংলাদেশ কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন ন্যাপ সিপিবির যৌথ গেরিলাবাহিনীর ২য় ব্যাচের কমান্ডার আলহাজ ওমর ফারুক, ন্যাপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক জাকির হােসেন, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এ্যাডভােকেট রুস্তম। আলী, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ভিপি নাজমুল হাসান পাখী, মুক্তিযুদ্ধকালীন কোতােয়ালি থানা কমান্ডার আবদুল মতিন, বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আবুল কাশেম, ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা আহ্বায়ক এ্যাডভােকেট মাহবুবুর রহমান, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর মাের্শেদ, জেলা মুক্তিযােদ্ধা যুব। কমান্ডের সভাপতি মহিউদ্দিন ফারুকী মহি প্রমুখ। বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘৭১ সালে এই নরঘাতক, নরজল্লাদ অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধা হত্যা করেছে, পাকসেনাদের নারী সরবরাহ করেছে, মানুষের বাড়িঘর লুটপাট করেছে। সেই নরঘাতক ত্রিশ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বােনের ইজ্জতের। বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে বিশিষ্ট শিল্পপতি। সেই রাজাকার মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট, পত্রিকার সম্পাদক এবং সরকারী সম্পত্তি লিজ নিয়ে। অবৈধ বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে।’ বক্তারা বলেন, এই রাজাকার চাকরি না করে। আনসার-ভিডিপির বেতন ও রেশন নিচ্ছে অথচ মুক্তিযােদ্ধারা অসহায়-চাকরি পায় না, থাকার জায়গা পায় না। তাই অবিলম্বে এই কুখ্যাত রাজাকার, নরঘাতককে দেয়া। সরকারী সম্পত্তি ফিরিয়ে নিতে হবে। তার দৈনিক বাংলাদেশ সংবাদ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করতে হবে।
অবৈধ সম্পত্তির উৎস তদন্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে এই রাজাকারকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। নয়ত মুক্তিযােদ্ধা-জনতা মিলে গণআদালতের মাধ্যমে জাকারিয়ার বিচার করা হবে। সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, “আমাদের কাছে খবর আছে, অসহায় চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে নামমাত্র বেতনে চাকরি দেয়া হয় মেঘনা গ্রুপে। কিছু বললে সাদা কাগজের ধমক দেয়া হয়। কুমিল্লা হাউজিং এস্টেটে অবৈধভাবে এই রাজাকার দু’টি বাড়ি করেছে। এ সম্পর্কে প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে হবে। মুক্তিযােদ্ধা সংসদ আয়ােজিত এ সমাবেশে বক্তারা দৈনিক জনকণ্ঠ রাজাকারদের কুকীর্তি জনসম্মুখে তুলে ধরার যে উদ্যোগ নিয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, যতদিন রাজাকার চিহ্নিত করা শেষ না হবে ততদিন সেই রাজাকার প্রতিবেদন অব্যাহত রাখুন। কুমিল্লায় যত রাজাকার আল বদর আছে তাদের চিহ্নিত করুন। কুমিল্লাবাসী তাদের বিচার করবেই।’ বক্তারা জাকারিয়ার নৃশংসতা তুলে ধরায় জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ ও প্রতিবেদককে ধন্যবাদ জানান। সমাবেশে ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ কুখ্যাত আদম শফিউল্যার। কুশপুত্তলিকা দাহ করে। বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশে মুক্তিযােদ্ধা ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, জেলা ন্যাপ, জেলা ছাত্র সমিতি, জেলা মুক্তিযােদ্ধা যুবকমান্ড, ছাত্র কমান্ড, মহিলা কমান্ড, জাসদ, আহলে সুন্নতে ওয়াল জামাত, ছাত্র যুব ঐক্যপরিষদ, ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, অগ্রসর কুমিল্লা, পথিকৃত সমাজ কল্যাণ সংস্থা, সেজুতি, কুমিল্লা লেখক পরিষদের নেতৃবৃন্দও অংশ নেন। উল্লেখ্য, গত ২৫ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠের সেই রাজাকার’ কলামে ‘লাকসামের মুক্তিযােদ্ধা হত্যাকারী আদম শফিউল্লা এখন বিশিষ্ট শিল্পপতি’ শিরােনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
আদম শফিউল্লা ওরফে মুহাম্মদ জাকারিয়ার ‘৭১-এর নৃশংসতা, বর্বরতা ও লুটপাটের। কাহিনী তুলে ধরা হয়। এর পর কুমিল্লায় তাকে অবাঞ্ছিত ঘােষণা করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার দাবি করা হয়। গােয়েন্দাদের তৎপরতা কুখ্যাত রাজাকার আদম শফিউল্লার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশকে ঘিরে কুমিল্লায় ডিজিএফআইসহ পুলিশের গােয়েন্দাদের বেশ তৎপর থাকতে দেখা যায় । শুক্রবার পুলিশের গােয়েন্দা সদস্যরা রাজাকারের খোঁজখবর ও তার পরিবারের অবস্থান জানতে রামঘাটস্থ দৈনিক বাংলাদেশ সংবাদ অফিসসহ তার বাড়িতে যায়। তাছাড়া বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের সময় গােয়েন্দাদের তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। থানায় জিডি, নিরাপত্তার আবেদন জনরােষ থেকে বাঁচতে বর্তমানে জার্মানিতে অবস্থানরত কুখ্যাত রাজাকার আদম। শফিউল্লার পক্ষে কোতােয়ালি থানায় একটি জিডি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জিডিটি করেছেন জনৈক শামসুল আলম মজুমদার মােহন। এ ছাড়া তার অফিসের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মােতায়েনের জন্য পুলিশ সুপার বরাবরে আবেদন করা হয়েছে। শুক্রবার রাত ৮টার দিকে আদম শফিউল্লা জার্মানি থেকে ফোনে কুমিল্লার পরিস্থিতির খোঁজখবর নিয়েছেন বলে গােপন সূত্রে জানা গেছে। তার সঙ্গে কথা বলেছে মাজহারুল ইসলাম নামে এক কর্মচারী।
জনকণ্ঠ ॥ ০৪-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন