মুক্তিযােদ্ধা জনতার রাজাকারবিরােধী স্লোগানের মুখে কুষ্টিয়ায় জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে মামলা
এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ কড়া পুলিশ প্রহরায় এবং মুক্তিযােদ্ধা, আইনজীবী-জনতার। তীব্র ক্ষোভ, উত্তেজনা, প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের মুখে অবশেষে রবিবার কুষ্টিয়া আদালতে দৈনিক জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। স্পর্শকাতর এ মামলার বাদী একাত্তরে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার পিস কমিটির চেয়ারম্যান ও আলােচিত সেই রাজাকার এ্যাডভােকেট সাদ। আহমদ। উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে বৃহস্পতিবারের মতাে রবিবারও আদালতের কার্যক্রমে দেখা দেয় অচলাবস্থা। অন্যদিকে রাজাকার সাদ আহমদ বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তার হলফী জবানবন্দী প্রদানকালে আদালত চতুর ছিল উত্তপ্ত। এ উপলক্ষে আয়ােজিত প্রতিবাদ সমাবেশে মুক্তিযােদ্ধা, আইনজীবী-জনতা সাদবিরােধী মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকে এবং কুখ্যাত রাজাকারদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানাের আহ্বান জানায়। প্রসঙ্গত, একাত্তরের গণহত্যা ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্মের কথা তুলে ধরে গত ৭ জানুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠের ‘সেই রাজাকার কলামে কুষ্টিয়ার সাদ আহমদের জেল হয়েছিল ৩১ বছর, এখনও সে পাকির স্বপ্নে বিভাের’ শিরােনামে একটি রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ্যাডভােকেট সাদ আহমদ দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক মােহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তােয়াব খান ও নির্বাহী সম্পাদক বােরহান আহমেদকে বিবাদী করে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ৫০০/৫০১/৫০২ ধারায় কুষ্টিয়া ২নং আমলী। আদালতে একটি নালিশী দরখাস্ত দাখিল করে।
গত বৃহস্পতিবার ফৌজদারী কার্যবিধির ২০০ ধারায় বাদী সাদ আহমদের হলফী জবানবন্দী রেকর্ডকালে আইনজীবী দু’পক্ষের। মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা ও হট্টগােল বাধে। সাদ আহমদ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে। আপত্তিকর ও অসত্য বক্তব্য দেয়া শুরু করলে উপস্থিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এতে তারা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। সে। সময় বাদী পক্ষের বেশ কিছু আইনজীবী মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে এজলাসে দু’পক্ষের মধ্যে হট্টগােল বেঁধে যায়। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সুশান্ত কুমার কুণ্ডু এ পরিস্থিতিতে শুনানি গ্রহণ রবিবার পর্যন্ত মুলতবি রাখেন। রাজাকার কর্তৃক জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের- এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় রবিবার আদালত চত্বরে কড়া পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা নেয়া হয়। এএসপি সার্কেল (সদর) মতিউর রহমানের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন সশস্ত্র পুলিশ মােতায়েন করা হয়। এদিকে রবিবার পূর্ব ঘােষিত প্রতিবাদ সমাবেশে যােগ দিতে আদালত চত্বরে মুক্তিযােদ্ধা ও স্বাধীনতার সপক্ষের আইনজীবী, ছাত্র-জনতা সমবেত হয়।
বেলা ১২টার দিকে এজলাস প্রাঙ্গণের সম্মুখে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় । মুক্তিযােদ্ধা আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক ও মুক্তিযােদ্ধা সংহতি পরিষদের কেন্দ্রীয় আইন সচিব যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা এ্যাডভােকেট শামসুল হুদার সভাপতিত্বে এ সমাবেশে বক্তৃতা করেন মুক্তিযােদ্ধা সংহতি পরিষদের জেলা সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার আলী আরজু, বঙ্গবন্ধু পরিষদের জেলা সভাপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির জেলা আহ্বায়ক মতিউর রহমান। লা, কুষ্টিয়া রেড ক্রিসেন্টের সাধারণ সম্পাদক আজগার আলী, যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা এপিপি এ্যাডভােকেট শহীদুল ইসলাম, এ্যাডভােকেট আব্দুল্লাহেল বাকী, এ্যাডভােকেট আবুল হাশেম, এ্যাডভােকেট নিজামুল হক চুন্ন, এ্যাডভােকেট তােফাজ্জেল হােসেন, এ্যাডভােকেট শামসুজ্জামান মনি ও এপিপি এ্যাডভােকেট আমান উল্লাহ নান্টু। এদিকে এ প্রতিবাদ সমাবেশ চলাকালে কড়া পুলিশ প্রহরায় বাদী এ্যাডভােকেট সাদ আহমদ আদালতের এজলাস কক্ষে উপস্থিত হয়। এরপর আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সুশান্ত কুমার কুণ্ডু বাদীকে তার অসমাপ্ত জবানবন্দী প্রদানের আদেশ দেন। বাদী এ সময় প্রায় ৪০ মিনিট তার হলফী জবানবন্দী প্রদান করে। তার জবানবন্দী শেষ হবার সাথে সাথে দৈনিক জনকণ্ঠের পক্ষ সমর্থন করে বৃহত্তর কুষ্টিয়ার সাবেক চীফ। স্পেশাল পিপি ও প্রবীণ আইনজীবী হাজী আমজাদ হােসেন, এ্যাডভােকেট ইব্রাহীম হােসেন ও স্পেশাল পিপি এ্যাডভােকেট আবু জাফর সিদ্দিকসহ অন্য আইনজীবীরা একযােগে দাঁড়িয়ে আদালতের কাছে মিথ্যা ওই মামলাটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তাধীনে গ্রহণের আবেদন জানান।
এ সময় এজলাস কক্ষে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ পরে দেবেন জানিয়ে আদালত মুলতবি ঘােষণা করে এজলাস ত্যাগ করেন। বিকালে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ওই নালিশী দরখাস্তটি মিস মামলা হিসাবে গ্রহণ করে এর বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আজম খানের ওপর দায়িত্ব দিয়ে আদেশ দেন। যার নং মিস ১৭/২০০১। মামলার পরবর্তী দিন ধার্য হয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি। অপরদিকে আদালতের কার্যক্রম মুলতবি হবার পরপরই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের আইনজীবীরা একযােগে এজলাস কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষমাণ মুক্তিযােদ্ধা-জনতার সাথে যােগ দেন এবং রাজাকার সাদের বিরুদ্ধে মুহুর্মুহু স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় তাৎক্ষণিক এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ অবস্থায় সাদ আহমদ প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা এজলাস কক্ষে অবরুদ্ধ হয়ে থাকে। জুলফিকার আলী আরজুর সভাপতিত্বে ওই সমাবেশে বক্তৃতা করেন বৃহত্তর কুষ্টিয়ার সাবেক চীফ স্পেশাল পিপি এ্যাডভােকেট হাজী আমজাদ হােসেন, যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা আবদুল মােমেন ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইকবাল মাহমুদ। বক্তারা রাজাকার এবং স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে জনকণ্ঠের সাহসী ভূমিকার জন্য প্রশংসা করে রাজাকার সাদ কর্তৃক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। একই সাথে মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এদিকে পরে পুলিশ প্রহরায় সাদ আহমদকে বাড়ি পৌছে দেয়া হয়। প্রসঙ্গত, একাত্তরের স্বাধীনতাবিরােধী ওই রাজাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রক্তাক্ত জনপদ কুষ্টিয়া ও যশােরে সংঘটিত স্পর্শকাতর। দুটি হত্যাকাণ্ডের আসামী পক্ষের অন্যতম প্রধান আইনজীবী। ওই দুটি হত্যাকাণ্ডের একটিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কাজী আরেফ আহমেদসহ পাঁচ জাসদ নেতা নিহত হন। অপরদিকে উদীচী হত্যাকাণ্ডে ১০ জন নিহত ও প্রায় দু’শ’ জন আহত হয়।
জনকণ্ঠ ॥ ২৯-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন