চাঁদপুর
হাজীগঞ্জ ও চাঁদপুরে শতাধিক হত্যাযজ্ঞের হােতা লােকমান বা অনুতপ্ত নয়
চাঁদপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকি হানাদার বাহিনীর দোসর হাজীগঞ্জের সেই কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ও শতাধিক হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্বদানকারী লােকমান হােসেন বাচ্চু আজও তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নয়। উল্টা সে নিজেকে একজন খাটি মুক্তিযােদ্ধা বলে দাবি করে। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে জেলার হাজীগঞ্জের রঘুনাথপুরে ও চাঁদপুরের ছােটসুন্দর বাজারে সে গণহত্যায় নেতৃত্বদান করেছে বলে অভিযােগ রয়েছে। রাজাকার কমান্ডার বাছুর সাথে কথােপকথন, আশপাশের লােকজন ও ব্যাপক অনুসন্ধান করে জানা গেছে, একাত্তর সালে বাচ্চু তকালীন পাকি বাহিনীর একজন নিয়মিত সৈনিক ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে লুটপাটের চিন্তা মাথায় নিয়ে সে গ্রামের বাড়ি হাজীগঞ্জের টোরাগড়ে চলে আসে। সুযােগ বুঝে ঢুকে পড়ে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু তার মতলব পরিষ্কার হয়ে গেলে তার সতীর্থ মুক্তিযােদ্ধারা মতলববাজ বাছুকে হাত, পা ও চোখ বেঁধে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দেয়। পরে সে নিজেকে রক্ষা করে ফিরে যায় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তার পূর্ব কর্মস্থলে। সেখান থেকে সে স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে (একাত্তরের জুনে) পুনরায় আসে হাজীগঞ্জে। পাকি বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ড হতে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ নিয়ে বর্বরতায় মেতে ওঠে মুক্তিকামী বাঙালী হত্যাযজ্ঞে । আবির্ভূত হয় প্রবল ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী রাজাকার কমান্ডার বাচ্চু পরিচয়ে একাত্তরে তার নেতৃত্বে নৃশংস হত্যালীলা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা মনে পড়লে আজও মানুষের শরীর শিউরে ওঠে। লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণ ও গণহত্যাসহ এমন হেন (জঘন্য) কাজ নেই যা সে করেনি।
তার নেতৃত্বে হাজীগঞ্জসহ জেলার প্রায় ৬/৭শ’ রাজাকার ছিল। রাজাকার কমান্ডার বাচ্চুর নেতৃত্বে অসংখ্য হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে শুধুমাত্র । চাঁদপুর সদর উপজেলার ছােটসুন্দর ও হাজীগঞ্জের রঘুনাথপুর বাজারের দু’টি বর্বরােচিত ঘটনাতেই মুক্তিযােদ্ধাসহ শতাধিক লােককে হত্যা, কয়েক শতাধিক বাড়িঘর, দোকানপাটে অগ্নিসংযােগ ও লাখ লাখ টাকার মালামাল লুট করা হয়। অসংখ্য হিন্দু ও মুসলিম যুবতী ধর্ষিত হয়। ছােটসুন্দর বাজারে গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী আলাউদ্দিন ছৈয়াল (৬৫) ও নৌকার মাঝি আব্দুল করিম (৭০) জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধিকে লােমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে জানান, একাত্তরের ১০ আগস্ট মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ন’টার সময় রাজাকার কমান্ডার বাছুর নেতৃত্বে ৩০/৩৫ জনের রাজাকার দল ৫/৬টি ছইওয়ালা নৌকায় এসে বাজারের চতুর্দিক ঘিরে ফেলে। অস্ত্রধারী রাজাকারদের দেখা মাত্রই বাজার ও আশপাশের লােকজন জীবন রক্ষার্থে নদীতে ও বিলের অথৈ পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে। এ অবস্থায় কমান্ডার বাচ্চুর নেতৃত্বে রাজাকাররা বাজারের দোকানগুলাের টাকা ও মালামাল লুট ও পরে অগ্নিসংযােগ করে।
এরপর সন্দেহভাজন লােকদের রামপুর ও ছােটসুন্দর গ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে ছােটসুন্দর বাজারের দোচালা মসজিদের পাশে জড়াে করে রাখে। সেখান থেকে এক এক করে বাজারের পূর্বপাশের কাঠের পুলের (সকো) ওপর দিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়। কাঠের পুলের ওপরে ওঠা মাত্রই গুলি করা হয়। এভাবেই রাজাকার কমান্ডার বাছুর নেতৃত্বে রাজাকারদের হামলায় ছােটসুন্দর বাজারের দোকানদার আব্দুল ওহাব, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছােটসুন্দর গ্রামের শামছুল হক তালুকদার, প্রকৌশলী আনােয়ার হােসেন তালুকদার, আবুল বাশার, আব্দুল খালেক, আসলাম, আব্দুল ওয়াদুদ, নজরুল ইসলাম, সর্দার সেকান্দর, বেনুলাল শীল, সুনীল শীল, বতুমিজি, আবুল খায়ের, সহােদর হানু, মফিজ পাটওয়ারী ও লালমােহনসহ অজ্ঞাত প্রায় ৪০ মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করা হয়। বাদুর নেতৃত্বে রাজাকাররা অপর লােমহর্ষক ঘটনা ঘটায় হাজীগঞ্জ থেকে ১০ কিলােমিটার উত্তরে রঘুনাথপুর বাজারে। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল নিরিবিলি হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদ ভেবে এ বাজারে আসা-যাওয়া করত । মন্তা নামের এক রাজাকার পাট ব্যবসায়ী বাজারে মুক্তিবাহিনীর আনাগােনা দেখে হাজীগঞ্জে রাজাকার কমান্ডার। বাচ্চুকে জানায়। বাচ্চু জল্লাদ রাজাকার উজির আলীসহ ৬/৭টি ছইওয়ালা নৌকায় ৫০/৬০ রাজাকার নিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর (ভরা বর্ষায়) বুধবার বিকাল ৩টায় বাজারের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক দিয়ে বাজারে প্রবেশ করে। এ সময় বাজারের উত্তর দিকে বগিরমার বাড়ির পাশের একটি নৌকাতে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মতিন রাজাকারদের দেখে গুলি করতে উদ্যত হলে তার সহযােগীরা বাজারে হাজার হাজার লােকের জানমালের ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কায় তাকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখে। এ সুযােগে রাজাকাররা প্রথমেই মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল মতিনকে গুলি করে হত্যা করে আনন্দ| উল্লাসে মেতে ওঠে।
পরে তার লাশ হাজীগঞ্জের জুনাব আলী ময়দানে এনে রাখা হয় এবং তার লাশের ওপর কমান্ডার বাচ্চু পা রেখে দম্ভ করে বলে- ‘এখন কই তাের শেখ মুজিব বাবা- মুখে বল জয়বাংলা !!’ এর পর মুক্তিযােদ্ধা মতিনের লাশ টেনেহিচড়ে | হাজীগঞ্জ বাজারের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নিয়ে পরে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রঘুনাথপুর বাজারে রাজাকারদের অতর্কিত হামলা ও তাণ্ডবলীলায় মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল মতিন, পিতা ও পুত্র ওয়াজউদ্দিন ও শামছুল হক, জুনাব আলী, মােয়াজ্জম আলী, নজরুল ইসলাম ভূইয়া (এমএ), প্রাণবল্লভ শীল, আব্দুল – আউয়াল চৌধুরী, গিরীশচন্দ্র সরকার, মােখলেছুর রহমান, জংশর আলী, আব্দুর রব, আব্দুর রশিদ ও জাহানারা বেগমসহ অর্ধশতাধিক লােক শহীদ হন। এভাবেই রাজাকার কমান্ডার বাচ্চু ও তার ৬/৭শ’ দোসর রাজাকার হাজীগঞ্জসহ জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট ও নৃশংস তাণ্ডবলীলা চালায়। রাজাকার কমান্ডার বাচ্চু হাজীগঞ্জ হানাদার মুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে (৮ ডিসেম্বর) পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে ঢাকা হয়ে রংপুরে চলে যায়। সেখানে দীর্ঘ ৩ বছর ফেরারি জীবন শেষে ১৯৭৪ সালে জুন মাসে হাজীগঞ্জে চলে আসে। টোরাগড় তালুকদার বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনগণ বাচ্চুকে ধরে (১৫ জুন) পুলিশে সােপর্দ করে। এর পর দীর্ঘ পৌনে ছ’বছর কারাবরণ করার পর ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে বাচ্চু মুক্তি পায়। পরবর্তীতে হাজীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের ইঞ্জিনিয়ার নূরুদ্দিনকে হত্যার অভিযােগে বাচ্চু জেলে যায়। জেলে থাকা অবস্থায় ১৯৮৩ সালে বাচ্চু হাজীগঞ্জ ৬ নং ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বর নির্বাচিত হয়। এর পর ‘৮৭ সালে উক্ত ওয়ার্ডের পৌর কমিশনার নির্বাচিত হয়। ১৯৯৭ সালের পৌর নির্বাচনে বাঙ্গু হেরে যায় । জনকণ্ঠ প্রতিনিধির মুখােমুখি হলে রাজাকার কমান্ডার বাচ্চু নিজেকে এখনও একজন মুক্তিযােদ্ধা ও সমাজসেবক হিসাবে দাবি করে। সে মুক্তিযুদ্ধকালীন হাজীগঞ্জের রান্ধুনীমুড়ার জনৈক মায়ের একমাত্র ছেলেকে হত্যা করায় তার জন্য আফসােস হয় বলে জানায়।
জনকণ্ঠ। ২৮-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন