বগুড়া আনিছারের নৃশংসতার সাক্ষ্য দিচ্ছে বগুড়ার বাবুরপুকুর ট্র্যাজেডি
সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার মুক্তিযুদ্ধের সেই বাবুরপুকুর ট্র্যাজেডির কথা গত ২৯ বছরেও মুছে যায়নি সাধারণ মানুষের মন থেকে। বরং বর্তমান প্রজন্মও জেনে যাচ্ছে সেই রাজাকারের। কথা। দেশ স্বাধীনতা লাভের পর বিজয় অর্জনের মাত্র ৩৫ দিন আগে বগুড়ার সেই রাজাকার কমান্ডার ও তার চ্যালাচামুন্ডারা যে নির্মমতা চালায় তা শুনলে এখনও গা শিউরে ওঠে। ঘৃণা-ধিক্কার জানাতে মানুষ সামান্যতম কুণ্ঠিত হয় না। কিন্তু বিচার হয়নি সেই রাজাকারের। রাজাকারের চ্যালাচামুন্ডারা ভােল পাল্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখনও জনশ্রুতি আছে- রাজাকার কমান্ডারের ছেলেরাও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালীদের বাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করেছিল। করেছিল নির্যাতন। পরে সে সবেরও তদন্ত হয়নি। সেই রাজাকার পরিবারের লােকজন আজও সেদিনের কৃতকর্মের কোন অনুশােচনা না করে ঘুরে বেড়ায় বীরদর্পে। সুযােগ পেলেই যে লুকিয়ে রাখা ‘পাকি বিষদাঁত দিয়ে ফের দংশন করবে আচার-আচরণে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় এখনও। বগুড়ায় মুক্তিযুদ্ধের সেই কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডারের নাম আনিছার। সে যে রাজাকার ছিল ও বাবুরপুকুর হত্যা ঘটনায় সে যে নেতৃত্ব দিয়েছিল তা সবার জানা। হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হেন অপকর্ম নেই, যা সে। করেনি। হানাদার পাকি সেনার কনভয়ে চড়ে বাঙালী নিধনযজ্ঞে সে মেতে উঠেছিল।
‘৭১ সালে বগুড়া শহরে মুক্তিযােদ্ধারা মাঝেমধ্যেই চালাত অভিযান। কাবু করে। ফেলেছিল হানাদার পাকি সেনাদের। খুব গােপনে মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা পদ্ধতিতে প্রবেশ করত শহরে। হানাদার পাকি অফিসার ও জওয়ানদের যখন একেবারে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন পাকিস্তানী সেনারা লেলিয়ে দেয় রাজাকারদের। সেদিন ছিল ‘৭১ সালের ১০ নবেম্বর। দিনভর রাজাকাররা চষে বেড়ায় শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। ‘৭১ সালের ওই সময়টায় ছিল পবিত্র রমজান মাস। মুক্তিযােদ্ধারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে যুদ্ধ। করত কৌশলে। শহরের ঠনঠনিয়া এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল তারা। রমজান মাসে রাত শেষের দিকে সেহরী খাওয়ার সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ঘুম থেকে উঠে বাতি। জ্বালিয়ে সেহরী খাওয়া শুরু করে। ঠিক সেই সময়ই রাজাকার কমান্ডার আনিছার ও চ্যালারা পাকি সেনাদের নিয়ে ঠনঠনিয়া এলাকায় বাড়ি বাড়ি হানা দেয়া শুরু করে। দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢােকে। মুক্তিযােদ্ধারা ভেবেছিল এই সেহরী খাওয়ার সময়টায় অন্তত মুসলমান বলে দাবিদার পাকি সেনা ও দোসর রাজাকাররা হামলা করবে না। মুক্তিযােদ্ধাদের সে ভাবনা বৃথা হয়ে যায়। রাজাকার কমান্ডার আনিছার রহমান বােরখা পরে বাড়ি বাড়ি ঢুকে দেখিয়ে দেয় মুক্তিযােদ্ধা বাঙালী তরুণদের। সে সময় মুক্তিযােদ্ধারা সেহরী খাচ্ছিল। সেহরী খাওয়ারত অবস্থায় আনিছার রাজাকার তাদের খাবার লাথি দিয়ে ফেলে নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের এক এক ধরে এনে তুলে দেয় পাকি সেনাদের হাতে। এভাবে ১৪ মুক্তিযােদ্ধা (যাদের একজন ছিল মহিলা) ধরে হাত চোখ বেঁধে সেনা কনভয়ে তুলে নিয়ে যায় শহর থেকে প্রায় ২০ কিলােমিটার
দূরে নন্দীগ্রামের বাবুরপুকুরে। তখন কেবল সুবেহ সাদেক। রাস্তা থেকে সামান্য দূরে এক সারিতে দাঁড় করানাে হয় মুক্তিযােদ্ধাদের। খুলে দেয়া হয় চোখের বাধন। মুক্তিযােদ্ধারা আরেকবার দেখে নেয় হানাদার পাকি বাহিনীর বােরখা পরিহিত রাজাকার কমান্ডার আনিছারকে। তখন শুরু হয় ফজরের আজান। হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের ব্রাশ ফায়ারের বুলেটে বিদ্ধ হতে থাকে মুক্তিযােদ্ধাদের বুক। ঢলে পড়ে রক্তের মধ্যে ১৪ মুক্তিযােদ্ধার দেহ। এর পরও নৃশংসতা বন্ধ হয়নি সেই রাজাকার আনিছারের। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে দেয় মুক্তিযােদ্ধাদের দেহ। বগুড়ার বাবুরপুকুরে মুক্তিযােদ্ধাদের কবরে বিজয় অর্জনের পর বগুড়া প্রেসক্লাবের উদ্যোগে নামফলক বসানাে হয়। আর সেই রাজাকার কমান্ডার আনিছার গত ২৯ বছরে শেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা করে সম্পদ গড়ে তুলে। কিছুদিন আগে সে মারা গেছে। রাজাকার আনিছার মারা গেলেও তার সেই নির্মমতার কথা, মুক্তিযুদ্ধে তার ঘৃণ্য অপকর্ম আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে বাবুরপুকুরের সেই সমাধিস্থলটি। আজকের প্রজন্ম জানছে সেই রাজাকারের কথা।
জনকণ্ঠ ॥ ১১-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন