You dont have javascript enabled! Please enable it! বাগেরহাটের রজব আলী মুরগির  মতাে জবাই করত মানুষ - সংগ্রামের নোটবুক

বাগেরহাট

বাগেরহাটের রজব আলী মুরগির  মতাে জবাই করত মানুষ

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকারবাহিনীর নৃশংসতার কথা আমাদের কমবেশি সবারই জানা। অনেক রাজাকার নেতাই আজ রাজনীতিক, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বা সমাজের কোন হােমরাচোমরা।কিছু রাজাকার নিহত হয়েছে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। স্বাধীন বাংলাদেশে টিকতে পারবে না বলে কেউবা করেছে আত্মহত্যা। এমন একজন নৃশংস রাজাকার বাগেরহাটের রজব আলী ফকির। সেকি আত্মহত্যা করেছিল, না। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রাণ দিয়েছিল- এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য কেউ জানাতে না পারলেও রজব আলীর নাম শুনে বাগেরহাটের বয়সী মানুষেরা আজও আঁতকে ওঠেন। অনেকেই চোখের পাতা এক করতে পারেন না। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলে। মুক্তিযুদ্ধকালে বাগেরহাট ছিল খুলনা জেলার একটি মহকুমা। যােগাযােগ ব্যবস্থা আজকের মতাে সহজ ছিল না। জানা যায়, ২৪ এপ্রিল পাকিসেনারা কাড়াপাড়ার পথ ধরে বাগেরহাট সদরে প্রবেশ করে। সেখানেই হানাদারদের হাতে এক শ’র বেশি মানুষ নিহত হয়। হত্যা করতে করতে হানাদারবাহিনী নাগের বাজার, তেলপট্টি এলাকা দিয়ে এগুতে থাকে। সংখ্যালঘু প্রধান এই এলাকায় হত্যার সঙ্গে যােগ হয় লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ। মে মাসে বাগেরহাটে শান্তি কমিটি, পাশাপাশি রাজাকারবাহিনী গঠিত হয়। এর প্রধান। হয় রজব আলী ফকির। সেই সময় থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত দুর্ধর্ষ হায়েনা রজব আলীর নেতৃত্বে চলে দুঃস্বপ্নের কাল। প্রথমে লুটপাট, অগ্নিসংযােগ তারপর নির্বিচার, হত্যা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর যেহেতু নিপীড়নের মাত্রা ছিল বেশি, সে কারণে তারা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছে।

যারা পারেনি, শহরে থেকে গিয়েছিল তাদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছে। এর পর শহর ছেড়ে গ্রামের হিন্দুদের মুসলমান করা হয়েছে। মুসলমান হয়েও অনেকে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। স্রেফ সন্দেহ হলেই রজব রাজাকারের লােকেরা তাদের মুরগির মতাে জবাই করেছে। রজব রাজাকার সেই সময় বলরাম সাহা নামের এক ব্যবসায়ীর গদিঘরে বসত । সেখানকার একটি ঘরে লােকদের জবাই করে হত্যা করা হতাে। প্রচলিত রয়েছে যে, রজব রাজাকারের নির্দেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এমন দশজনকে প্রতিদিন ধরে এনে এখানে জবাই করা হতাে। আর একটি ঘর ছিল যেখানে মেয়েদের এনে। পাশবিক অত্যাচার চালানাে হতাে। রাজাকাররা রাধাবল্লভ গ্রামের মেয়েদের ধরে এনে সারা রাত পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে দিনের আলােয় তাদের অনেককে পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করেছিল- এ কথা এখনও অনেকে বলেন আর চোখের জল ফেলেন। মানুষ জবাই করার আর একটি জায়গা ছিল সেই সময়ের ‘ওয়াপদা রেস্ট হাউসের একটি ঘর। এছাড়া ডাক বাংলাে ঘাটে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

রাজাকারদের আর একটি কাজ ছিল মেয়েদের ধরে পাকি নরপশুদের হাতে তুলে দেয়া। এ কারণে এরা গ্রামের পর গ্রাম চষে ফিরেছে। হিন্দু মুসলিম যে কোন পরিবারের মেয়ে এরা তুলে দিয়েছে পাকিদের হাতে বাগেরহাট থানার মীর্জাপুর গ্রামের অনেক মেয়ে অপমানিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে বিষপানে অথবা গলায় দড়ি দিয়ে। বাগেরহাট সদর থানাধীন হাড়িখালি গ্রামের এ রকম একটি নৃশংস ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তাহমিনা বেগম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্রঃ অষ্টম খণ্ডে বর্ণিত ঐ সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, “বিষ্ণু মহাশয়কে তার স্ত্রীর সামনেই গুলি করে হত্যা করে। সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। একটি মেয়েকে ধরে প্রকাশ্যে অত্যাচার চালিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।’ দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযােদ্ধারা হন্যে হয়ে রজব রাজাকারকে খুঁজেছিল। একটি বাঁশঝাড়ের মধ্যে তার লাশ পাওয়া যায়। তবে জানা যায়নি তাকে হত্যা করা হয়েছিল। নাকি অপমানে সে আত্মহত্যা করেছিল।

জনকণ্ঠ ॥ ০৩-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন