গাইবান্ধা
হত্যা ধর্ষণ লুটতরাজের হােতা গাইবান্ধার ঘােড়ামারা আজিজ এখন জামায়াতের আমির
শামীম রেজা, গাইবান্ধা থেকে ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযােদ্ধাদের যে পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করত-এমনকি মুক্তিযােদ্ধা ভেবে ঘােড়াকে গুলি করে হত্যা করায় ঘােড়ামারা আজিজ নামে যে ব্যাপক পরিচিত, সেই রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আজিজ বর্তমানে জামায়াতের গাইবান্ধা জেলা আমির। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গাইবান্ধা জেলায় পাকি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসাবে রাজাকাররা যে অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা, নারীধর্ষণ ও লুটতরাজ চালিয়েছিল এলাকার | লােকজন সে কথা ভেবে আজও শিউরে ওঠে। সেদিনের সে রাজাকারদের একজন আব্দুল আজিজ এখন গাইবান্ধা জেলা জামায়াতের আমির। হত্যা, নারী ধর্ষণ আর হিন্দুদের বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযােগের মাধ্যমে এলাকায় সে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল । সরেজমিনে গাইবান্ধার চণ্ডিপুর, মাঠেরহাট, দারিয়াপুর, পাচপীর এলাকার মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষ জানায়, হিন্দু ও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক মুসলমানদের বাড়িঘর লুটপাট, জ্বালানাে, মা-বােনের ইজ্জত হরণ, নৃশংসভাবে খুনের ঘটনার নেতৃত্বদানকারী গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার তারাপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলার রাজাকার কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে মুক্তিযােদ্ধা হত্যা আর লুটপাট, অগ্নিসংযােগের মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এই রাজাকার কমান্ডার তাদের সহযােগীদের মারফত গ্রামের মধ্যে কে মুক্তিযােদ্ধা, কারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক খোজ নিয়ে নির্বিচারে তাদের ওপর অত্যাচার চালাত। এলাকার হিন্দুদের জোরপূর্বক ধরে এনে হত্যা অথবা পঙ্গু করে দিত। এছাড়া অনেক হিন্দুকে ধরে জোরপূর্বক মুসলমান বানাত।
তাদের হিন্দু নাম বাদ দিয়ে মুসলমান নাম রাখত এবং নিয়মিত মসজিদে জোরপূর্বক নামাজে নিয়ে যেত। কেউ এর অবাধ্য হলে তাকে দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে বেয়ােনেট চার্জ করে অথবা গুলি করে হত্যা করত। রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আজিজ ও তার সহযােগীরা একদিন সুন্দরগঞ্জ শহীদ মিনার এলাকার বধ্যভূমিতে ১৭ জন মুক্তিযােদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। সেদিনের সেই গুলির শব্দে আশপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল। আরেকদিন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া একই পরিবারের ৭ জনকে ধরে ব্রহ্মপুত্রপাড়ে দাঁড় করিয়ে বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। বেয়ােনেটের আঘাতে সেদিন ঐ ৭ জনের আর্তচিত্ত্বারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। এরকম শত মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক, হিন্দুদের ধরে এনে সে বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে অথবা গুলি করে হত্যা করেছে। আব্দুল আজিজ মুক্তিযােদ্ধাদের ত্রাস ছিল। সে মুক্তিযােদ্ধাদের পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করত। এ কারণে পাকি বাহিনী এই রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আজিজকে পুরস্কার হিসাবে একটি পিস্তল দিয়েছিল। এই পিস্তল দিয়ে সে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। একদিন সন্ধ্যার দিকে মাঠেরহাটের পাশে কমান্ডার আব্দুল আজিজ কয়েকজন রাজাকারকে নিয়ে একটি ব্রিজ পাহারা দিচ্ছিল। কারণ এই ব্রিজটি ভাঙ্গার পরিকল্পনা করেছিল মুক্তিযােদ্ধারা। হঠাৎ কিছু দূরে খটখট শব্দ ও কিছু একটা এগিয়ে আসতে দেখতে পায় ওরা। সঙ্গে সঙ্গে রাজাকারদের পজিশন নিতে নির্দেশ দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে এবং রাজাকারদেরও গুলির নির্দেশ দেয়। কিছুক্ষণ পর ঐ অদৃশ্য বস্তুটিকে দেখতে গিয়ে সে দেখতে পায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একটি ঘােড়া মারা গেছে। সেই থেকে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল আজিজ ঘােড়ামারা আজিজ নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
এই ঘােড়ামারা আজিজ তার রাজাকার বাহিনী নিয়ে কোন গ্রামে ঢুকলে সে গ্রাম মানুষশূন্য হয়ে পড়ত। যে যেদিকে যেখানে পারে লুকিয়ে পড়ত। বৃদ্ধ, শিশু, নারী কেউই তার। হাত থেকে রেহাই পেত না। সন্দেহ হলেই তাকে রাজাকার দিয়ে পিঠমােড়া করে বেঁধে। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে নিয়ে গিয়ে বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করত। আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে নারীধর্ষণের বিভিন্ন অভিযােগ করেছে এলাকাবাসী। সে নিজে এবং তার রাজাকাররা বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং বহু নারীকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে ভােগের জন্য। এলাকাবাসী জানায়, বছর দেড় দু’য়েক আগে এই আব্দুল আজিজ তার বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাকে গর্ভবতী। করে। এ নিয়ে অনেক দেন-দরবার এবং গ্রামে সালিশ বৈঠকও হয়েছে বলে তারা জানায়। এই ঘটনা এবং পার্টির অর্থ ও মােটর সাইকেল আত্মসাতের দায়ে সে আমিরী। পদ থেকে কিছুদিনের জন্য বরখাস্তও হয়েছিল। বর্তমানে আবার সে জামায়াতের জেলা আমির পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে।
জনকণ্ঠ। ১৬-০২-২০০১ নওগাঁ
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন