মুক্তিযােদ্ধাদের দু’টি লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়ার নায়ক সুন্দরবনের সােহরাব এখন জনপ্রতিনিধি
মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে ॥ মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এমএ জলিলসহ ১১ জন অফিসারকে হত্যার জন্য বাড়িতে আটকে রাখা ও পাকিদের সহযােগিতায় সুন্দরবনে দু’টি অস্ত্রবােঝাই লঞ্চ ডুবিয়ে দেয়ার নেতৃত্ব দানকারী পিস কমিটির প্রধান হাজী সােহরাব এখন জনপ্রতিনিধি। স্বাধীনতাযুদ্ধে সুন্দরবন এলাকায় একচ্ছত্রভাবে রাজাকার সৃষ্টি করা ও মুক্তিযােদ্ধাদের পাকিদের হাতে তুলে দেয়াই ছিল তার কাজ। পাকিস্তানের সংহতি ও ইসলামের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের ধরে পাকিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য সে সময়ে এলাকায় সে ফতােয়া জারি করে। বর্তমানে সাতক্ষীরা, খুলনা, কয়রা, গাবুরায় ৮ থেকে ১০টি বিশাল বাড়ির মালিকসহ বিস্তর বিত্তবৈভবের মালিক সে। স্বাধীনতাবিরােধী অবস্থানের কারণে মুক্তিযােদ্ধারা তার গাবুরার একটি বাড়ি উড়িয়ে দিলেও সে খুলনায় পাকিদের ক্যাম্পে থেকে নিজেকে রক্ষা করে। ‘৭১ সালের ৬ মে। ভারতের রায়মঙ্গল হতে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে গােলাবারুদ ভরা। দুটি লঞ্চ নিয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল। তার সাথে ছিলেন ক্যাপ্টেন রহমান, মেজর নুরুল ইসলাম মঞ্জু, লেফটেন্যান্ট মইনুল ইসলাম, লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আলম বেগ, ক্যাপ্টেন বাসার, ক্যাপ্টেন তােফাজ্জেলসহ প্রায় পঞ্চাশ জন মুক্তিযােদ্ধা। সুন্দরবনের গাবুরা ইউনিয়নের হাজী সােহরাব আলী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এলাকায় পিস কমিটিপ্রধান হিসাবে রাজাকার বাহিনী তৈরিসহ পাকিদের সহযােগিতা ও এলাকায় ডেকে এনে মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করাই ছিল তার কাজ। মুক্তিযােদ্ধাদের লঞ্চ দু’টি আসার খবর সােহরাব আলীর কানে পৌছামাত্র সে চলে যায় খুলনায় পাকি বাহিনীর ঘাটিতে। পাকিদের সাথে করে নিয়ে আসে দু’টি গানবােটসহ।
পাকিদের নিয়ে এসে ৬ মে রাতে তার বাড়ির পাশে নদীতে অবস্থান নেয়। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভাের রাতে পাকি বাহিনী ও সােহরাব হাজীর সহযােগীরা হামলা চালায় অস্ত্র ও গােলাবারুদ ভর্তি মুক্তিযােদ্ধাদের লঞ্চ দুটিতে। গান বােটের উপর্যুপরি আক্রমণে আগুন ধরে যায় অস্ত্রভর্তি লঞ্চ দু’টিতে। লঞ্চ ‘ ডােবার মুখে মেজর জলিলসহ অন্য মুক্তিযােদ্ধারা নেমে পড়েন সুন্দরবনে। একসময়। এ্যামুনেশন ফুরিয়ে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা আত্মগােপন করে এলাকা ত্যাগের সিদ্ধান্ত। নিলেও হাজী সােহরাব ও তার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন মেজর জলিলসহ ১১ বীর মুক্তিযােদ্ধা। নিরাপদ আশ্রয় দেবার নাম করে তাদের ডেকে এনে সােহরাব তার বাড়িতে আটকে রেখে চলে যায় বাকি মুক্তিযােদ্ধাদের ধরতে। সােহরাবের সহযােগী অন্য। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে ১১ মুক্তিযােদ্ধা। রাজাকার অজেদ জোয়ার্দার এই ১১
মুক্তিযােদ্ধাকে তার বাড়িতে আটকে রেখে সােহরাব আলীর নেতৃত্বে এদের পাঠানাে হয়। কয়রার পাকি বাহিনীর ক্যাম্পে। এদিকে মেজর জলিলসহ তার সহযােগীরা সােহরাবের বাড়িতে আটক অবস্থায় থেকে কৌশলে ঘরের দরজা খুলে চলে যান নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কয়রায় পাকিদের কাছে পাঠানাে অপর ১১ বীর মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। চরম বিশ্বাসঘাতকতাসহ স্বাধীনতার শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় পরবর্তীতে বীর মুক্তিযােদ্ধারা লেফটেন্যান্ট মাহফুজ আলম বেগের নেতৃত্বে প্রায় ৩৬ জনের একটি দল ডিনামাইট চার্জ করে উড়িয়ে দেয় হাজী সােহরাব আলীর বাড়ির একটি অংশ মধ্য অক্টোবরে। বর্তমানে এই হাজী সােহরাব জনপ্রতিনিধি। গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সে বিশাল অর্থ ও বৈভবের মালিক হয়ে সে সুন্দরবনের গাবুরাসহ সাতক্ষীরা শহরের চালতেতলায় বাড়ি করেছে। খুলনায় মিউনিসিপ্যাল রােডে তার পাঁচতলা আলীশান বাড়ি। এ ছাড়া খুলনার কয়রা উপজেলা সদরেও রয়েছে তার কয়েকটি বাড়ি। সুন্দরবন এলাকায় কোন সরকারী কর্মকর্তা ভ্রমণে গেলেই গিয়ে ওঠেন এই পিস কমিটিপ্রধান হাজী সােহরাবের বাড়িতে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সুন্দরবনের বন কর্মকর্তাদের প্রায় সকলেই নানা কারণে সুন্দরবন এলাকায় গেলে তারা নানাভাবে আপ্যায়িত হন এই পিস কমিটিপ্রধানের হাতে। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরও এই স্বাধীনতাবিরােধী সােহরাব সুন্দরবন এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তির মধ্যে জনপ্রতিনিধি সেজে সমাজের কেউকেটা হিসাবে দাড়িয়ে আছে।
জনকণ্ঠ ৷ ১৭-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন