You dont have javascript enabled! Please enable it! সিরাজ শাহজাদপুরের ত্রাস কোরবান আলী নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছিল মিনি ক্যান্টনমেন্ট - সংগ্রামের নোটবুক

সিরাজ শাহজাদপুরের ত্রাস কোরবান আলী নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছিল মিনি ক্যান্টনমেন্ট

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ অন্তর আলােকিত না হলে একজন মানুষ উচ্চশিক্ষা সত্ত্বেও স্বভাবে যে হিংস্র পশুই থেকে যায় একাত্তরের নৃশংস ঘাতক ব্যারিস্টার মুহাম্মদ কোরবান আলী তার একটি দৃষ্টান্ত। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ভীতি ও আতঙ্কের আরেক নাম এই কোরবান আলী। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বরেও মুক্তিযােদ্ধার পিতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে সহােদরসহ এই ঘাতক। এর দু’দিন পর দেশ স্বাধীন হলে রাতের অন্ধকারে স্বাধীনতার এই শক্রটি বােরখা পরে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কোনমতে পাড়ি দেয় মধ্যপ্রাচ্যে। ঘূণিত কর্মকাণ্ডের জন্য এই স্বাধীনতাবিরােধীর নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল বাংলাদেশ সরকার। জাতির দুর্ভাগ্য, লাখাে শহীদের আত্মদানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর বাংলাদেশের মাটিতে শুধু ফিরেই আসেনি এই ঘৃণ্য লােকটি, সামাজিকভাবে পুনর্বাসিতও হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টে আইন ব্যবসা করছে সে বহাল তবিয়তে। একাত্তরের জামায়াতে ইসলামীর এই ব্যারিস্টার নেতা এখন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা। সুপ্রীমকোর্টে এ আইনজীবীর একটি কক্ষও রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে তার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম তার বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযােগগুলাে সম্পর্কে তার বক্তব্য কি জানতে। জানা গেল, কোর্টে আসেনি। তবে বিকালে পুরানা পল্টনে বাসা-কাম চেম্বারে তাকে পাওয়া যাবে। কক্ষটি দেখিয়ে এক তরুণ আইনজীবী বললেন, যখন এখানে এদের দেখি, দুঃখ হয়। স্বাধীনতা অর্জনে আত্মত্যাগকারী শহীদদের জন্য। বিকালে যাই তার বাসায় যাওয়ার আগে ফোন করি। দেখা করার উদ্দেশ্য কি জানালে তার এক পুত্র জানায়, আব্বা অসুস্থ দেখা করতে পারবেন না’। একান্ত পীড়াপীড়ি করলে তিনি বলেন, ‘আসুন’ । কিন্তু গিয়েও কাজ হয়নি, কোরবান আলী দেখা করেনি, দেখা করার সৎ সাহস ছিল না হয়ত।

তবে তার পুত্র হাসান আবদুল্লাহ বলেছে, ‘আমার আব্বা কখনই স্বাধীনতার বিরােধিতা করেননি। একাত্তরে তিনি ছিলেন একজন প্রগতিশীল শ্রমিক নেতা।’ কেন তার নাগরিকত্ব গিয়েছিল? কেন দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল? প্রশ্নের কোন জবাব দেয়নি ব্যারিস্টারপুত্র। রাজধানী ঢাকার আইনজীবী মহল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের স্বাধীনতা বিরােধী এই ব্যারিস্টারের নির্মম-নৃশংস কর্মকাণ্ডের খবর সম্পর্কে সামান্যই জানে। আমাদের সংবাদদাতারা সরেজমিনে অনুসন্ধান চালিয়ে যে তথ্যগুলাে সংগ্রহ করেছেন। তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেয়া হলােএকাত্তরে এই ব্যারিস্টার ছিল পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক ও পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির এক ভাইস চেয়ারম্যান। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানী হানাদারদের সমর্থনে নিজ অঞ্চলে গড়ে তােলে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। শাহজাদপুরে, বিশেষ করে তার গ্রাম চরকৈজুরিতে নিজ বাড়িতে সে গড়ে তুলেছিল। মিনি ক্যান্টনমেন্ট। পাকি সেনা ক্যাম্পও ছিল এই বাড়িটি। ব্যারিস্টার ছিল তার এলাকায় তখন সবচেয়ে পরাক্রমশালী ব্যক্তি। রাজাকার-আলবদরদের কাছে তার পরিচয় ছিল “উনি সাহেব” । এই বাড়ি থেকেই হত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগের তাণ্ডব চালাত এই ব্যারিস্টার ও তার সহােদর ছগিরউদ্দিন ওরফে ছগির মাস্টার। এলাকায় তার সহযােগী হিসাবে আতা, ভােলা, মানিক, আনােয়ার, আবদুর রব ও আব্দুল খালেকসহ কয়েকজনের নাম পাওয়া যায়। আবদুল খালেক এখন শাহজাদপুর জামায়াতের আমীর (এই ঘাতকের নৃশংসতাও ভয়াবহ)। শুধু শাহজাদপুর নয়, আশপাশের চরাঞ্চল এবং টাঙ্গাইলের কিছু এলাকায়ও ব্যারিস্টার ও তার ঘাতক বাহিনীর তৎপরতা বিস্তৃত ছিল। শত শত ঘরবাড়ি কোরবানরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

একাত্তরে যমুনা তীরে ও নদীতে ব্যারিস্টারের রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত বহুজনের লাশ ভাসতে দেখেছেন অনেকে। যে গ্রামগুলােতে রাজাকার-আলবদর ও পাকি মিলিটারি নিয়ে ব্যারিস্টার ঘৃণ্য তাণ্ডবলীলা চালায় তার মধ্যে রয়েছে- কৈজুরি, বেলতৈল, খুকনী, জালালপুর, সােনাতনী। ব্যারিস্টার একজন বাদে তার গ্রামের সবাইকে রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখাতে বাধ্য করেছিল। এই গ্রামে আব্দুস সামাদ নামে এক তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে পেরেছিল । কোন পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে জানতে পারলে ব্যারিস্টারের রাজাকাররা সে পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ ও মা-বােনদের ইজ্জতের হানি করত। হানাদার বাহিনীর সহায়তা করেনি বলে ব্যারিষ্টার তার নিজের ভগ্নিপতির। বাড়িতেও অগ্নিসংযােগ করেছে। উল্টোডাব গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা গােলাম মওলা জনকণ্ঠের সংবাদদাতাকে জানান, ব্যারিস্টার ও তার ভাই ছগির মাস্টারের নেতৃত্বে রাজাকাররা একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তার পিতা মুন্সী আব্দুল কাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার অপরাধ ছিল তার পুত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়েছে। তিনি জানান, ব্যারিস্টার ও তার ভাই ছগিরের নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদর ও পাক হানাদারদের ঘৃণিত তাণ্ডবলীলা চলেছে। শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া। হয়েছে। লুটতরাজ করা হয়েছে। অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যুবতীদের ধরে এনে তাদের প্রভু পাকিস্তানীদের ভােগের জন্য তুলে দেয়া হয়েছে। ১৯৭০, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে ব্যারিস্টার চৌহালী-শাহজাদপুর নির্বাচনী এলাকায়। জামায়াত ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। প্রতিবারই সে পরাজিত হয়েছে লজ্জাজনকভাবে। ‘৯১ ও ‘৯৬-এর নির্বাচনে জনগণ। তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। সর্বশেষ নির্বাচনে সে পেয়েছে মাত্র তিন শ’ ভােট! এলাকাবাসীরা জানান, এ লােক এলাকায় আসে শুধু নির্বাচনের সময়।

খুকনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিতেন্দ্র চন্দ্র চন্দকে নির্মমভাবে ব্যারিস্টার ও তার। সহযােগীরা হত্যা করেছে বলে তাঁর বিধবা পত্নী অপর্ণা চন্দ অভিযােগ করেছেন। করুণ কাহিনীটি তিনি বললেন এভাবে, “তারিখটি ছিল ১ সেপ্টেম্বর। বাড়ির চারদিকে থৈ থৈ পানি। রাত তিনটায় বাড়ির চারদিক ঘিরে ফেলে সশস্ত্র রাজাকাররা। গুলি ছুড়তে ছুড়তে এসে তারা ঘরের দরজা ভেঙ্গে ফেলে এবং বলে, উনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। জরুরী মিটিং আছে।” এই উনি’ হচ্ছে ব্যারিস্টার কোরবান আলী । জোর করে হিতেন। মাস্টারকে রাজাকাররা নৌকায় তুলে নিয়ে যায়। সকালে খবর আসে হিতেন মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করে হয়েছে। অপর্ণার এই কাহিনী ছাপা হয়েছে ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত “স্মৃতি ঃ ১৯৭১” গ্রন্থে। কিন্তু স্বাধীনতার ৩০ বছরেও অপর্ণা স্বামী হত্যার বিচার পাননি। গ্রামে গ্রামে অভিযােগ পাওয়া গেছে, হত্যাকারীরা দুর্দান্ত দাপটের সাথে এখনও জনসমক্ষে শুধু ঘুরেই বেড়ায় না, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলােকে ভয়ভীতিও দেখায়। শিক্ষক হিতেন্দ্রের মতাে এমনিভাবে খুন হয়েছিলেন পােরজনা গ্রামের মনীন্দ্রনাথ ঘােষ, বাচড়া গ্রামের পখী ঘােষ ও বেলতৈল গ্রামের বটেশ্বর ঘােষের দু’ ছেলে মণি ও সুশীল । শাহজাদপুর সরকারী কলেজের প্রভাষক মুক্তিযােদ্ধা আজাদ রহমান, যিনি একাত্তরে। ব্যারিস্টারের রাজাকার বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, বলেছেন, একাত্তরে এই ব্যারিস্টার কোরবান আলীর নেতৃত্বে শুধু রাজাকার বাহিনীই গঠিত হয়নি, হত্যা, লুঠ, অগ্নিসংযােগ, ধর্ষণও চলেছে। মুক্তিযােদ্ধা সাংবাদিক আবুল বাশার বললেন, ব্যারিস্টার ছিল শাহজাদপুরের কয়েকটি এলাকার দায়িত্বে। শাহজাদপুর মুক্ত হওয়ার পর তার বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। ব্যারিস্টার-তনয় হাসান আবদুল্লাহ সগর্বে বলেছে, তার পিতা যদি স্বাধীনতাবিরােধী কার্যকলাপই করল, তাহলে তার বিরুদ্ধে কেন কোন মামলা হয়নি স্বাধীনতার পর? কোন্ সালে তার পিতার নাগরিকত্ব বহাল হয়েছে? প্রশ্নের জবাবে সে বলল, তার পিতা বাংলাদেশের পাসপাের্টধারী এক বৈধ নাগরিক।

জনকণ্ঠ ॥ ০১-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন