ঝিনাইদহ
ঝিনাইদহের হাতেম ও শৈলকূপার শাহাদত জল্লাদের নৃশংসতার কথা মানুষ ভােলেনি
এম সাইফুল মাবুদ, ঝিনাইদহ থেকে ॥ একাত্তরের ২৬ নবেম্বর ভােররাতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে রাজাকার ও পাকি সেনারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যে ২৭ মুক্তিযােদ্ধাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, সে কথা ঝিনাইদহবাসী আজও ভােলেনি। ভােলেনি ঝিনাইদহের রাজাকার হাতেম জল্লাদ ও শৈলকুপার রাজাকার শাহাদত জল্লাদের নৃশংসতার কথা। দেশ স্বাধীনের পর এসব দুর্ধর্ষ। জল্লাদ মারা গেলেও ঘাপটি মেরে থাকা বেশ কয়েকজন রাজাকার ‘৭৫-এর পর এই স্বাধীন দেশে ঝিনাইদহের মাটিতে জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় ঘাপটি মেরে রয়েছে। ‘৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকি সেনাদের দোসর হিসাবে ঝিনাইদহে রাজাকার কমান্ডার ছিল মরহুম নূরুন্নবী সামদানি। এই রাজাকার কমান্ডারের নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদর সদস্যরা স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযােদ্ধা ও যুবতীদের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে শহরে পাক সেনাদের ঘাটি সরকারী বালক বিদ্যালয় ও ক্যাডেট কলেজে তাদের হাতে তুলে দিত। ওই রাজাকাররা পাক দোসরদের সাথে মিলে প্রকাশ্যে স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযােদ্ধাদের একে একে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করত। তাদের লাশ যেখানে-সেখানে মাটিচাপা দেয়া হতাে। অনেক সময় ভাসিয়ে দেয়া হতাে স্থানীয় নবগঙ্গা নদীতে। সেই রাজাকার কমান্ডার নূরুন্নবী সামদানি ‘৭৫-এর পর ঝিনাইদহ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়, এমনকি জাতীয় সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়। গত বছর সে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায়। জেলায় একাত্তরে রাজাকারদের মধ্যে জল্লাদ হিসাবে পরিচিত ছিল হাতেম আলী।
সেই রাজাকার হাতেম জল্লাদ হাসতে হাসতে মানুষ জবাই করত। সে নাকি পাখির মতাে মানুষের গায়ে গুলি করে হাতের নিশানা ঠিক করত বলে। এলাকায় এখনও জনশ্রুতি রয়েছে। তাই তার সহকর্মী রাজাকার-আলবদররা তাকে। হাতেম জল্লাদ বলে ডাকত। এই হাতেম জল্লাদ পাক দোসরদের সাথে নিয়ে চাপড়ি গ্রামে হানা দেয়, লুটপাট চালায় এবং আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। হত্যা করে সেকেন্দারসহ আটজনকে। তারা হানা দেয় পবহাটীর ঘােষপাড়ায়। ওই গ্রাম থেকে ৭ নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আজও তাদের লাশের সন্ধান মেলেনি। সেই হাতেম জল্লাদকে স্বাধীনতার পর ঝিনাইদহবাসী ধরে এনে শহরের চৌরাস্তার মােড়ে উল্টো করে ঝুলিয়ে দিনভর ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে লবণ দিয়ে রেখে দেয়। পরে সে মারা যায়। ওইদিন হাতেম জল্লাদের মরার দৃশ্য দেখার জন্য শহরের সমস্ত স্কুল, কলেজ ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। ‘৭১ সালে ঝিনাইদহের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল বশীর মজমাদার। তার ছেলে জাহাঙ্গীর মজমাদার পাকিদের দোসর রাজাকার হিসাবে কাজ করত। সেই রাজাকার জাহাঙ্গীর মজমাদার আশির দশকে এই ঝিনাইদহের সদর। উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। অবশ্য পরবর্তীতে জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এখন সে জাকের পাটির লেবাস পরে ঘাপটি মেরে আছে।
ঝিনাইদহ-শৈলকুপার রাজাকারদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা শৈলকূপাবাসী আজও ভােলেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন পাকি সেনা, রাজাকার, আলবদর সদস্যদের ভয়ে স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীরা বাড়িঘর-গ্রাম ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে এ-গ্রাম সে-গ্রাম পালিয়ে বেড়িয়েছেন। শৈলকুপার ওয়াপদা ও কাজী খাদেমুল ইসলাম শিশু মিয়ার বাড়ি ছিল পাকি সেনাদের ঘাঁটি। সে সময় শৈলকুপার পাকি সেনাদের দোসর রাজাকারআলবদরদের কমান্ডার ছিল বিজলীয়া গ্রামের গােলাম কবির মজনু। এর নেতৃত্বে রাজাকার শাহাদত জল্লাদ শৈলকূপার বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযােদ্ধাদের পাকি সেনাদের হাতে তুলে দিত এবং প্রকাশ্যে তাদেরকে নৃশংস ভাবে হত্যা করত। এসব হত্যাযজ্ঞ দেখে রাজাকার কমান্ডার গােলাম কবির মজনু অট্টহাসি দিত। তার অন্যান্য সহযােগী রাজাকার ছিল নওশের, আছালত, মসলেম মােল্লা, নজরুল ইসলাম, শাহাদত, শফি, রাজ্জাক মােল্লা ও আমজাদ। এর মধ্যে নজরুল ইসলাম ও আমজাদ ছাড়া সকলেই মারা গেছে। ‘৭১-এর ২৬ নবেম্বর পাক বাহিনীর হাত থেকে ঝিনাইদহকে দখলমুক্ত করার জন্য ৪২ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল শৈলকুপার কামান্না গ্রামে অবস্থান নেয়। দীর্ঘ পথ হেটে আসার পর ক্লান্ত মুক্তিযােদ্ধা দলটি আশ্রয় নেয় ওই গ্রামের মাধব চন্দ্র আর সালেমা বেগমের বাড়িতে। স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার মজনু, রাজ্জাক মােল্লা ও আমজাদ মুক্তিযােদ্ধাদের এই অবস্থান টের পেয়ে খবরটি পাকি সেনাদের ঘাঁটিতে পৌছে দেয়। তারা পাকি সেনাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসে কামান্না গ্রামে। পাকি সেনা ও রাজাকাররা ঘুমন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে বেপরােয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে পাখির মতাে হত্যা করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একে একে শহীদ হন ২৭ বীর মুক্তিযােদ্ধা।
এই হত্যাযজ্ঞের কথা মনে হলে ঝিনাইদহবাসী আজও কাঁদে। এই প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাতকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শৈলকূপার এক মুক্তিযােদ্ধা জানান, মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পাকি সেনাদের। অবস্থানের খবর ও মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগাযােগ রাখার কারণে কবিরপুরের মনােরঞ্জন ডাক্তার ও বারইপাড়ার আক্কাছ আলীকে চতুরা গ্রামের রাজাকার জল্লাদ। শাহাদত পাকি সেনাদের কাছে ধরে নিয়ে যায় । জল্লাদ শাহাদত জীবন্ত অবস্থায় তাদের দু’জনকে বস্তায় পুরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কুমার নদীতে ফেলে দেয়। শাহাদত জল্লাদের নৃশংসতার কথা শৈলকূপাবাসী আজও ভােলেনি। রাজাকার কমান্ডার মজনু পাকি সেনাদের সাথে নিয়ে কবিরপুর ফটিক বাবুর বাড়ির পাশে গুলি করে হত্যা করে ৫ জনকে। এরা হলাে কবিরপুর গ্রামের হরিদাস সাহা, গৌর গােপাল সাহা, নারায়ণচন্দ্র সাহা, শিশু গােপাল ও নিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এদের লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ওই সময় তাদের বাড়িঘরও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। শাহাদত ঝাউনিয়া গ্রামের ১০ জেলেকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। রাজাকার শাহাদত জল্লাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের গল্প শুনে এখনও অনেকে আঁতকে ওঠে। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে শাহাদত জল্লাদ মারা যায়। বিজলীয়া গ্রামের সেই রাজাকার গােলাম কবির মজনু এখন এলাকা ছেড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আত্মগােপন করে থাকে মাঝেমধ্যে গােপনে শৈলকূপায় এলেও বেশি সময় অবস্থান করে না। তথ্য সংগ্রহকালে যতদূর জানা যায়, ঝিনাইদহের অধিকাংশ দুধর্ষ রাজাকার মারা গেছে। এর মধ্যে এখনও যারা জীবিত আছে তাদের অনেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির সাথে মিশে ঘাপটি মেরে রয়েছে।
জনকণ্ঠ ॥ ১৭-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন