বহু হত্যাকাণ্ডের হােত কুমিল্লার খালেক আড়তদার এখন গণ্যমান্য ব্যক্তি আবুল কাশেম হৃদয়
কুমিল্লা থেকে পাকি বাহিনীর যে দোসর ও রাজাকার একাত্তরে। কুমিল্লার চান্দিনার কাশিমপুর, দেবিদ্বারের রামপুর গ্রামকে বানিয়েছিল বধ্যভূমি- সেই রাজাকার এম,এ. খালেক এখন বিএনপি নেতা এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। রাজাকার খালেক আড়তদার ঐতিহ্যবাহী মাধাইয়া বাজার ছাদিম স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, এতিমখানা ও মসজিদের কর্ণধার। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই খালেক আড়তদারের ইশারায় তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী মহিচাইল ইউনিয়ন ও আশপাশ এলাকাকে বানিয়েছিল বধ্যভূমি। কাশিমপুরের ৮ জন এবং রামপুরের ৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার হােতা খালেক আড়তদার এবং মহিচাইল ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মিরগঞ্জের আলতাফ হােসেন ভূঞা, একই ইউনিয়নের ‘৭১-এর চেয়ারম্যান দুধ মিয়া ভূঞা মহিচাইল ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে (বাের্ড অফিস) বসে হত্যাযজ্ঞ ও নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা করত। তারপর চলত। অপারেশন। মাধাইয়া ও আশপাশ এলাকায় ঘুরে জানা গেছে খালেক আড়তদারদের অনেক লােমহর্ষক বর্বরতার কাহিনী। জানা গেছে কিভাবে তারা লােককে পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করত, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিত, ধার্মিক ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের হত্যা করা হতাে। তার কাহিনী। চান্দিনার মহিচাইল ইউনিয়নের কাশিমপুর গিয়ে শহীদ পরিবার, তাদের আত্মীয়-স্বজন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ গ্রামের সর্বজনশ্রদ্ধেয় জগবন্ধু মাস্টারসহ ৮ জনকে একই দিন গুলি করে হত্যা করা এবং এ গ্রামের ১৫টি বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়ার নির্মম কাহিনী।
আষাঢ় মাসের ২১ তারিখ শনিবার। মধ্যরাতে সংঘটিত সে কাহিনী শুনলেই শরীর শিউরে ওঠে। এদিন খালেক আড়তদার, আলতাফ ও দুধ মিয়ার নেতৃত্বাধীন কালাগাজীর ছেলে রাজাকার কমান্ডার খালেক, দোতলার সােবহান, যােরপুরার রহমান একদল পাকি সেনাসহ হাজির হয় কাশিমপুর গ্রামে। গ্রামের সবাই যখন মধ্যরাতের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখনই শুরু হয় অপারেশন। হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামটিতে প্রতিটি ঘরে যে পুরুষ লােককে পায় তাকেই ধরে আনা হয়। বাইরে। তাদের সামনেই পােড়ানাে হয় তাদের সােনার সংসার। নিজ ঘরেই ছিলেন জগবন্ধু মাস্টার ও তার ছেলে সুধীর দেব। তাদের গুলি করা হয় সেখানেই। গুলিতে জগবন্ধু মাস্টারের নাড়িভুড়ি বের হয়ে যায়। পাকি সেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। জগবন্ধু মাস্টারের ছেলে সুধীরকে গুলি করা হয় পিছন থেকে। গুলি তার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক ছিন্ন করে হাড়মাংসসহ বেরিয়ে আসে। তারপর একে একে ধরে আনা হয় অমূল্য চন্দ্র দাস, চিত্তরঞ্জন সরকার, শিশু, যােগেষ, শান্তি শীল চেতন সরকারকে। কাশিমপুরের একটি দোকানের সামনে তাদের গুলি করা হয়।
জ্বালিয়ে দেয়া হয় ১৫টি বাড়ি। এই খালেক আড়তদারের রাজাকার বাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতার হাত থেকে ধার্মিক লােকরাও রক্ষা পায়নি। লায়লাতুল কদরের দিন শুক্রবার গ্রামের মৌলভী আবদুর রহিম, তার বড় ভাই আবদুল ওহাব খলিফা, আবদুল গফুর এবং আবদুল ওহাবের ছেলে আবদুল জব্বার খলিফা যখন অজু করে নামাজ পড়তে যাবেন তখনই গর্জে ওঠে পাকি অস্ত্র । ধরে ফেলে মৌলভী রহিম এবং তার বড় ভাই আবদুল ওহাব খলিফাকে। পাশের ঘর থেকে ধরে আনে আবদুল গফুর এবং আবদুল ওহাবের বড় ছেলে আবদুল জব্বারকে। বাড়িঘরে জ্বালিয়ে দেয় আগুনে। পার্শ্ববর্তী বাড়ির মহব্বত আলীকেও ধরে। আনা হয়। তারপর চলে গুলি। গুলিতে আবদুল গফুরের মাথার খুলি উড়ে যায়। পাকিরা। জ্বালিয়ে দেয় পুরাে গ্রামটি। মৌলভী রহিমের বাড়ির পরের বাড়ির শশী ভূষণ সরকার ও হরিণী বালা সরকারকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। চান্দিনা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আইউব আলী জানান, এই খালেক আড়তদারের অত্যাচারে এসব অঞ্চলের মানুষ তটস্থ ছিল। তার নাম শুনলেই মানুষ।
আতকে উঠত। স্বাধীনতার পর মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকার রহমানকে হত্যা করে, অন্যরা পালিয়ে যায়। ধূর্ত খালেক আড়তদার মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে লাঞ্ছিত হলেও বেঁচে যায় বিভিন্ন কৌশল। অবলম্বন করে। নারায়ণগঞ্জ থেকে পাটের ব্যবসা গুটিয়ে রাজাকারীতে নেতৃত্ব দেয়া সেই জাকার খালেক আড়তদার গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করে। তারপর আবার যােগ দেয় বিএনপিতে। এখন সে বিএনপির স্থানীয় নেতা, থানা বিএনপির সদস্য। মাধাইয়া বাজার ছাদিম স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি। মাধাইয়া রদওয়ান আহমেদ আদর্শ কলেজের পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি, মাধাইয়া বাজারে অবস্থিত এতিমখানা, মসজিদের কর্ণধার ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। IIখালেক আড়তদারের বক্তব্য। এম এ খালেক আড়তদারের মাধাইয়ায় তার মালিকানাধীন দোতলা মার্কেটে এ তিনিধিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন- ‘৭১-এর সময় তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। ‘৭১-এর তার ঘৃণিত তৎপরতার অভিযােগের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে দেন। মালতাফ হােসেন ভূঞা, দুধ মিয়া ভূঞা ও তিনি স্বয়ং কাশিমপুরে ৮ জন ও রামপুরে ৭ জন হত্যা প্রসঙ্গে বলেন- “তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এখানে (এলাকায়) ছিলেন। না। নারায়ণগঞ্জে আড়তদারী করতেন। তিনি বলেন, “আমার নাম খালেক আড়তদার। ঐ এখান থেকেই তারা (আলতাফ হােসেন ভূঞা, দুধ মিয়া ভূঞা) জড়িত থাকতে পারে। আমি ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
জনকণ্ঠ ॥ ২৩-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন