দিনাজপুর
দিনাজপুরে অসংখ্য হত্যার নায়ক আবুল কাশেমের ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ
সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর থেকে ॥ অনেক কাকুতি-মিনতির পরও নিষ্ঠুর, নিদয় লােকটার মন গলল না। নর্দমার কীটের দিকে আমরা যে রকম ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাই, তার চেয়েও বেশি ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে লােকটি স্রেফ আমাকে জানিয়ে দিল, “তাের বাপের জন্য আমার কাছে কিছুই করার নাই। তাের বাপ মুক্তিযােদ্ধা, হিন্দুস্তানের এজেন্ট। তার কথাগুলাে আমার কাছে পিতার মৃত্যুবার্তা বলে মনে হলাে ‘“আমি কেঁদে গড়িয়ে পড়লাম তার পায়ে, রক্ষা করুন, আমার পিতাকে বাঁচান। এ ঘটনায় হয়ত নিষ্ঠুর হালাকু খানেরও দয়া হতাে। কিন্তু পাষাণ লােকটির কোন ভাবােদয় হলাে এক লাথিতে আমাকে ছিটকে ফেলে দিল সেই মানুষরূপী জানােয়ার। তারপর ভয়ঙ্কর গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “যা ভাগ, নইলে জবাই হয়ে যাবি।” প্রায় জ্ঞানশূন্য অবস্থায় বাড়ি ফিরে এলাম। পরদিন শুনলাম আমার বাবাসহ দু’জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কথাগুলাে বলছিলেন দিনাজপুর সদর থানার ৩নং ইউনিয়নের ঝানঝিরা গ্রাম নিবাসী শহীদ মুক্তিযােদ্ধা ডাক্তার গফুরের পুত্র আব্দুল হামিদ। সে সময়ের পিস কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডভােকেট আবুল কাশেম সম্পর্কে কথা বলছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দিনাজপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় ডাঃ বাহারের দোতলায় আস্তানা গেড়ে বসেছিল রাজাকারশ্রেষ্ঠ আবুল কাশেম। সেখানেই পিস কমিটির অফিস খােলা। হয়েছিল। এই অফিসেই সংঘটিত হয়েছে বহু হত্যাকাণ্ড। বহু রমণীকে শিকার হতে। হয়েছে ধর্ষণের। একটা চিঠি, হ্যা স্রেফ একটা চিঠি যেত এই অফিস থেকে কখনও শুধু মৌখিক নির্দেশনামা । টাকা-কড়ি, অলঙ্কার বা নারী পাঠানাের আদেশসংবলিত সেই নির্দেশনামা অমান্য করার সাহস হতাে না কারও। আবুল কাশেমের নেতৃত্বাধীন পিস কমিটির নৃশংসতাকে তুলনা করা হতাে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর সাথে। শােনা যায়, নারীর শরীর নিয়ে ক্রীড়ারত অবস্থায় আর্মি হেডকোয়ার্টারের জন্য চিঠির ডিকটেশন দেয়া হচ্ছিল। স্বভাবতই ডিকটেশন নিতে ভুল হচ্ছিল তার। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। লাশ ছুড়ে ফেলা হয় দোতলা হতে নিচে। এই অবাঙালী যুবকের নিবাস ছিল শহরের হঠাৎপাড়ায়।
সে সময়ে যারা দিনাজপুর শহরে ছিলেন, তাদের কাছ থেকেই শােনা যায় আবুল কাশেমের দোর্দণ্ড প্রতাপের কথা। শােনা যায়, আবুল কাশেমের অফিস আগমন-নির্গমনের বারতা ঘােষিত হতাে গুলির শব্দ দিয়ে । আকাশ লক্ষ্য করে দু’রাউন্ড গুলি করে সে তার আগমনী ঘােষণা করত। একইভাবে ঘােষণা করত নির্গমনের বার্তা। এই জেলা শহরে বহু হত্যাকাণ্ড তার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ মদদে সংঘটিত হয়েছে বলে অভিযােগ রয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম হলাে ঝানঝিরা হত্যাকাণ্ড। সীমান্তবর্তী এই গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের আনাগােনা ছিল অনেক বেশি। ২৮ অক্টোবর ‘৭১ রােজ বুধবার একটি সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা দল একটা অপারেশনের লক্ষ্য সামনে রেখে ঝানঝিরা গ্রামে এসে পৌছে। এ খবর পায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। তার কাছে খবর পেয়ে এদিন রাত একটায় মেজর নাসের খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র পাকি বাহিনী ত্রিমুখী ব্যুহ রচনা করে। শুরু হয় পাক বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ । গােলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। হানাদার বাহিনী দ্রত অগ্রসর হয়ে দু’জন মুক্তিযােদ্ধাসহ ১৪ গ্রামবাসীকে আটক করে। এদের মধ্যে ১২ জনকে সেখানেই গুলি করে এবং আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
সেদিন ঝনঝিরায় যাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তারা। হলে- জাফিরন বিবি, স্বামী মৃত আফাজ উদ্দীন মােল্লা, নজি মােহাম্মদ, পিতা বেশার শাহ, মােঃ হালিম উদ্দীন, পিতা মৃত মেজার উদ্দীন মণ্ডল, শুকু মােহাম্মদ, পিতা নিঝল শহ, আব্দুল মজিদ, পিতা ফরিদ শাহ, আসির উদ্দীন, পিতা গােফারু, কশির উদ্দীন পিতা চান্দু, গিয়াস, পিতা ইজিবুল, দ্বারাজ, পিতা সাহাব উদ্দীন শাহ, মুক্তিযােদ্ধা মােস্তফা, সামসুদ্দীন, পিতা খেরাজ মণ্ডল এবং দীনবন্ধু পিতা ধনেশ্বর। এঁদের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয় জাফিরন বিবি, নজি মােহাম্মদ, শুকু মােহাম্মদকে। অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তকালীন আনসারের প্লাটুন কমান্ডার ডাঃ আব্দুল গফুর, পিতা। মৃত সেরাজ উদ্দীন, পেতাব উদ্দীন শাহ, পিতা মৃত তকি মােহাম্মদ শাহ এবং শুকু মােহাম্মদ, পিতা নিঝাল শাহকে। এরা তিনজনই ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা। ঝনঝিরা অপারেশনের পর স্থানীয় কয়েকজন সিদ্ধান্ত নেয়, পিস কমিটির চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের সাথে দেখা করার। এঁদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ আঃ গফুরের পুত্র আব্দুল হামিদ। তারা একটি গণস্বাক্ষরিত দরখাস্ত নিয়ে যান। আবুল কাশেম ঐ দরখাস্ত ছিড়ে ফেলে দেয়। পিতার মুক্তির জন্য কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন হামিদ।
কিন্তু তাতেও মন গলেনি পাষাণহৃদয় আবুল কাশেমের। শেষ পর্যন্ত পায়ে পড়ে যান হামিদ। কিন্তু পিশাচ আবুল কাশেম তাতেও এতটুকু নরম হয়নি। লাথি মেরে ফেলে দেয় তাকে। দুমকি দেয় সরে না গেলে গুলি করে হত্যা করা হবে তাদের। বুকের কান্না বুকে চেপে রেখে গ্রামে ফিরে আসেন তাঁরা। ৩১-১০-৭১ তারিখ সকালে গুলি করে হত্যা করা হয়। আঃ গফুর, পেতাব উদ্দীন এবং শুকু মােহাম্মদকে। নির্বাপিত হয় তিন মুক্তিযােদ্ধার জীবনপ্রদীপ। হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল রাজাকার আবুল কাশেম । দেশ স্বাধীন। হবার পর তাকে হত্যাকাণ্ডের মূল আসামী করে শহীদ মুক্তিযােদ্ধা আঃ গফুরের পুত্র আব্দুল হামিদসহ কয়েকজন আদালতে রুজু করে একটি মামলা। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার সুযােগ নিয়ে তার অপব্যাখ্যা করে নিষ্কৃতি পেয়ে যায় আবুল কাশেম। শহীদ ডাঃ আঃ গফুরের পুত্র হামিদ জানান, রাজাকার আবুল কাশেম অসংখ্য নরহত্যার নায়ক। এসব হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তারই প্রণয়ন করা নীলনক্সা মােতাবেক। কোন কোন হত্যাকাণ্ডে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথাও শােনা যায়। শহীদ তনয় আক্ষেপের সুরে বলেন, সেদিনের রাজাকার আবুল কাশেম আজ জেলার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। জমি-জায়গা, বাড়িঘর, ব্যাংক ব্যালান্সে সে একজন ফুলে-ফেঁপে ওঠা মানুষ। জেলার প্রতিষ্ঠিত এক আইন ব্যবসায়ী। জামায়াতে ইসলামী দিনাজপুর জেলা শাখার সাবেক আমির সে।
জনকণ্ঠ ॥ ১১-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন