আমজাদ কায়েম আলীরা যশােরে হত্যা করেছে অগণিত মানুষ
ফখরে আলম ॥ যশােরের বাঘারপাড়া থানার প্রেমচারায় আমজাদ মােল্লা, কায়েম আলী গােষ্ঠীসমেত রাজাকারে নাম লিখিয়ে একাত্তরে এলাকায় যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা হিটলারের নাৎসী বাহিনীকেও হার মানায়। আমজাদ-কায়েম আলী গং চানপুরের মুক্তিযােদ্ধা নওশেরের বৃদ্ধ মা-বাবাকে উলঙ্গ করে গুলি করে হত্যা করেছে। সাত মুক্তিযােদ্ধাকে চামড়া ছিলে হত্যা করে কুয়ার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পুত্র খােকনকে হত্যা। করে লাশ ভেলায় ভাসিয়ে দিলে প্রিয় সন্তানের শােকে সেই লাশ আনতে গেলে বাবা আব্দুল মালেককেও হাত-পা বেঁধে পানিতে ছুড়ে হত্যা করা হয়। এই হায়ওয়ানরা একাত্তরে এলাকায় অগণিত হত্যা ও ধর্ষণ করে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তা স্মরণ করে এলাকার সব বয়সের মানুষের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সেই রাজাকার জল্লাদ আমজাদ এখন মামলা-মােকদ্দমার দালালী করে। কায়েম আলী মারা গেলেও তার দোসররা বুক ফুলিয়ে এলাকায় ঘােরাফেরা করে। যশাের শহর থেকে ৩০ কিঃমিঃ উত্তরের গ্রাম চিত্রা নদীর পাড়ে বাঘারপাড়ার প্রেমচারার রাজাকার ক্যাম্পের সেই ভয়াল স্মৃতির গ্রাম ঘুরে এই রাজাকার সম্পর্কে যে তথ্য জানা গেছে, তা মনে হলেই শরীর কেঁপে ওঠে। ঘৃণার আগুন উস্কে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে প্রেমচারার নায়েব কায়েম আলী তার বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করে রাজাকার ক্যাম্প। ক্যাম্পের কমান্ডার ছিল তারই জ্ঞাতী আমজাদ হােসেন মােল্লা।
আর কায়েম আলীর দুই ভাই নওশের, ইদ্রিস, চাচাতাে ভাই সবুর বিশ্বাস, চাচা দলিলউদ্দিন, মােজাহার বিশ্বাস, জামাই আহমদ আলী, ভাইয়ের ছেলে মতিয়ার, দাউদ, গফুর, সােবাহান, নওশের ও লিয়াকতকে নিয়ে এক বিশাল রাজাকার বাহিনী গড়ে তােলে। এই খুনী বাহিনীতে আরও ছিল খুড়দার আজিবর সর্দার, ছিদ্দিক হােসেন, প্রেমচারার মজিদ (কমান্ডার), আনসার, খুড়দার মাহাতাব, জবেদ, কসিয়ার, গফুর। শহীদ পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে জানা যায়, কায়েম ও আমজাদের নেতৃত্বে এই রাজাকার বাহিনী স্থানীয় বন্দবিলা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এলাকার বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম ও প্রগতিশীল ছাত্র সাখাওয়াতকে তাদের বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। এরপর প্রেমচারার আফসার, রুহম ও আবুল মণ্ডলকে একইভাবে হত্যা করা হয়। চানপুর গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা নওশেরের বাবা-মাকে ক্যাম্পে ধরে আনে।
এরপর তাদেরকে উলঙ্গ করে নিম্নাঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। গাইঘাটার মুক্তিযােদ্ধা সুরত আলী, চাদপুরের আয়নাল, মুক্তারসহ ফরিদপুরের ৭ মুক্তিযােদ্ধাকে ধরে বিভূতি রায়ের বাড়িতে চামড়া ছিলে গােবিন্দ মেম্বারের কুয়ার মধ্যে লাশ ফেলে দেয়। এই রাজাকার গং সিমাখালির নজিবর ও খােকনকে হত্যা করে লাশ চিত্রা নদীতে ভেলায় করে ভাসিয়ে দিলে খােকনের বাবা আব্দুল মালেক লাশের সৎকাজের জন্য ভেলা নিয়ে বাড়ি আসছিলেন। কিন্তু এই রাজাকারের দল খােকনের বাবা আব্দুল মালেককে হাত-পা বেঁধে চিত্রায় ছুড়ে ফেলে। পরে মালেকের লাশ ভেসে উঠলেও ভয়ে সে লাশ কেউ ডাঙ্গায় তােলেনি। স্থানীয়ভাবে খবর নিয়ে আরও জানা যায়, এরা গাইদঘাটার সুরত আলী, মুক্তার আলী, পিয়ারপুরের রজব, চাঁদ আলী, তার স্ত্রী, আড়ােকান্দির মান্নান, উত্তর চাদপুরের আয়নাল, নিমটার তারাপদের স্ত্রীসহ বহু মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগের ঘটনার কোন হিসাব-নিকাশ নেই। কায়েম আলী কয়েক বছর আগে মারা গেছে। মজিদ কমান্ডারকে স্বাধীনতার পর জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলে। আর রাজাকারের সেই কমান্ডার আমজাদ দু’বছর জেল খেটে বেরিয়ে আসে। এখন সে গ্রামেই বসবাস করছে। পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে। দালালীকে। এই নৃশংসতা সম্পর্কে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা ওহিদুর রহমান, লুৎফর, কালাম মােল্লা বললেন, আমাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ, স্বজন হত্যা করেও ওরা পার পেয়ে গেছে। আর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেও আমরা জুলুম-নিপীড়নের শিকার হচ্ছি। আশ্চর্য এই দেশ!
জনকণ্ঠ ॥ ২৩-১২-২০০০
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন