জামালগঞ্জের লাল মিয়া যুবতী মেয়েদের ধরে পাকি সেনাদের বাঙ্কারে সরবরাহ করত
মহিবুর রহমান চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে ॥ একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালীকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা ও মা-বােনকে পাকি সেনাদের হাতে তুলে দেয়াই ছিল জামালগঞ্জ থানা পিস কমিটির সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ ওরফে নাক কাটা লাল মিয়ার কাজ। সে সময়ে পাকি বাহিনীর সহযােগিতায় এ রাজাকার ও তার সঙ্গীরা জামালগঞ্জ, তাহিরপুর ও ধরমপাশা থানার বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এলাকার ক্ষুব্ধ লােকজন তাকে ‘লাল বান্দর’ বলে ডাকত। লাল মিয়ার বাড়ি জামালগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপুরে। পাকিস্তান আমলে লাঠিয়াল বাহিনীর শক্তি দেখিয়ে প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছিল। এ কারণে সে জুলুমবাজ ও লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার হিসাবে চিহ্নিত। তখন সে পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক পার্টি করত। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে কিছুদিন সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তৎপরতা চালায়। কিন্তু গােপনে গােপনে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। একাত্তরের মে মাসের শেষ দিকে মুক্তিযােদ্ধা খলিলুর রহমান ও আসাদ উল্লাহ সরকারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা ধরমপাশা উপজেলার ধানকোনিয়া হাওরের ওয়াপদা বিল্ডিং-এ হামলা করে পাকি সেনার দু’টি রাইফেল ছিনিয়ে আনে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ লাল মিয়া রাইফেল দু’টি কেড়ে নেয়ার ফন্দি আঁটে। সে একটি লঞ্চযােগে ১৫/১৬ জনের অস্ত্রধারী একদল লাঠিয়াল নিয়ে বৌলাই নদীর পারের দুধারকান্দা গ্রামে ওঁৎ পেতে থাকে।
সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের থামিয়ে রাইফেলগুলাে দেখার ছলে হাতে নেয়। পরবর্তীতে আর ফিরিয়ে না দিয়ে নিজের কৃতিত্ব জাহির করার জন্য পাকি সেনাদের হাতে রাইফেল দুটি জমা করে দেয়। ঘটনাটি জানাজানি হলে মুক্তিযােদ্ধারা এসে তার বাড়ি ঘেরাও করে তাকে আটক করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা আসার আগেই সে সপরিবারে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মীরজাফরী চরিত্রের এ কৃতিত্বস্বরূপ পাকি বাহিনী তাকে জামালগঞ্জ থানা পিস কমিটির সভাপতি হিসাবে ঘােষণা করে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির অন্যতম সদস্যরা হচ্ছে আব্দুল গনি, মাওঃ সিরাজুল। ইসলাম, সােনা মিয়া, সৈয়দ আকবর আলী, আফতাব উদ্দিন, আব্দুল নূর, সিদ্দিক আলী, আব্দুল খালিক, ডাঃ এ সাত্তার ও শাহনুর। এরপর থেকেই পিস কমিটির সভাপতির লেবাস পরে সে আনুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধবিরােধী কর্মকাণ্ড শুরু করে। তার লােমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় নির্যাতিত পরিবার ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এবং মুক্তিযােদ্ধা ইউসুফ আল আজাদ জানান, মুক্তিযুদ্ধকালে এ কুখ্যাত রাজাকার লাল মিয়া পাকি সেনাদের যুদ্ধ পােশাক ও আধুনিক অস্ত্রসহ বুকেপিঠে গুলির বেল্ট লাগিয়ে ১৫/১৬ জন সহযােগী রাজাকার নিয়ে সেনাপতি ভাব। দেখিয়ে চলাফেরা করত। ‘৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে সে তার বডিগার্ড আহাদুল্লা, শাহেব আলী, আজমান, আনিস, করিম, আফতাব উদ্দিন, সহযােগী রাজাকার সুন্দর আলী, হিরণ মিয়া ও আব্দুল ওয়াহিদকে নিয়ে নিজস্ব প্রমােদতরী “ঝুনু এক্সপ্রেস” নামে একটি লঞ্চে চড়ে কাজিরগাঁওয়ে যায় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অজুহাতে হামলা এবং ব্যাপক লুটপাট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পুরাে গ্রাম। নিরীহ নারী পুরুষের ওপর চালায় অবর্ণনীয় নির্যাতন। মহিলাদেরও তারা ধর্ষণ।করে।
৮ মুক্তিযােদ্ধাকে ধরে সুনামগঞ্জের পিটিআই নির্যাতন সেলে এনে পাকি বাহিনীর সহযােগিতায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। তার নেতৃত্বে শতাধিক। সদস্যের এক বিশাল কিলার গ্রুপ গ্রামে ঘুরে ঘুরে যুবতী মেয়েদের সংগ্রহ করে বিভিন্ন পাকি সেনা বাঙ্কারে সরবরাহের কাজে ব্যস্ত থাকত। তারা লঞ্চ ও স্পীড বােটযােগে হালিব হাওর এলাকায় টহল দেয়ার সময় কিশােরগঞ্জ থেকে আসা একটি নৌকাভর্তি শরণার্থীদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। সুরমা নদীর কালিপুরের ঢালার কাছে ৫ জন হিন্দু শরণার্থীকে একসঙ্গে নৌকা থেকে আটক করে হাত-পা বেঁধে পানিতে। ডুবিয়ে হত্যা করে। সে সময় জামালগঞ্জ হাই স্কুল ও লক্ষ্মীপুরের তার নিজ বাড়ি ছিল নির্যাতন সেল। নির্যাতন সেলে কি পরিমাণ নারী-পুরুষ ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। তার কোন হিসাব নেই। মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণের সংবাদ পেয়ে সাচনা বাজারে অবাধে লুটপাট চালিয়ে পাকি সেনা ও তাদের দোসররা কাজী সাদউল্লাহ, আনসার কমান্ডার আব্দুল জব্বার, মুবাশ্বির আলী ও নির্মলেন্দু ঘােষ চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায়। এর মধ্যে ভাগ্যক্রমে মুবাশ্বির আলী ও নির্মলেন্দু ছাড়া পেলেও বাকি ২ জন আর ফিরে আসেনি। আটক সাদউল্লাই ও কমান্ডার জব্বারকে পিটিআই নির্যাতন। সেলে হত্যা করা হয়। একাত্তরের ১১ আগস্ট লাল মিয়া ও তার সহযােগীরা পাকি বাহিনীর সহযােগিতায় আবারও সাচনা বাজারে অবাধে লুটতরাজ চালায়।
তারা হত্যা করে তেলিয়া গ্রামের কানু মিয়া, করিম মিয়া ও তাদের বাড়ির এক কর্মচারী এবং জহুর আলী তালুকদারের ছেলে আক্তার আলীকে। এছাড়া হত্যা করে কামলাবাজ গ্রামের কালা মুন্সী, আয়াত আলী, জজ মিয়া ও শামছু মিয়াকে। এসব অভিযানকালে অসংখ্য যুবতী মেয়ে ধরে “ঝুনু” নামের প্রমােদতরীতে বােঝাই করে জামালগঞ্জের ১০/১২টি এবং সুনামগঞ্জের বিভিন্ন বাঙ্কারে সরবরাহ করত এদের। মধ্যে অধিকাংশকেই নির্যাতন শেষে হত্যা করে সুরমা নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হতাে। তাহিরপুরের রাজাকার আহমদ মল্লিক, সরুজ আলী, চান্দ মিয়া ও হাফিজ সিরাজুল ইসলামের সহযােগিতায় ৩ জন মুক্তিযােদ্ধাকে ধরে এনে নির্যাতন করে তিলে তিলে হত্যা করে। এসব অত্যাচার ও নির্যাতনে ক্ষুব্ধ মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্মীপুরের লাল মিয়ার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে জামালগঞ্জ থেকে প্রমােদতরী ঝুনু’তে করে। নিজ বাড়িতে আসার পথে মফিজনগরের মুক্তিযােদ্ধা নানুকে গুলি করে হত্যা করে। এভাবে সে মুক্তিযােদ্ধাসহ অর্ধশতাধিক লােককে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণভয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়। তার বিরুদ্ধে দালাল আইনে ৩২টি মামলা হয় কিন্তু সাধারণ ক্ষমার বদৌলতে সে বেঁচে যায়। পরবর্তীতে সুনামগঞ্জে এসে সে জলমহাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে “ওয়াটার লর্ড” হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ধূর্ত এ লাল মিয়া এরশাদ আমলে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হয়। এ সুবাদে কিছু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিভিন্ন সংগঠনকে ফরকারী ও বেসরকারী অনুদান এবং সাহায্য দিয়ে তার অতীতের বিভিন্ন অপকর্ম কিতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালায়। বর্তমানে তার তিন স্ত্রী, ৪ ছেলে, ৭ কন্যা রয়েছে। লাল মিয়ার পাকিমনা রাজনৈতিক দর্শনের কোন পরিবর্তন এখনও ঘটেনি বরং পুরনাে স্বপ্নে সে বিভাের। এলাকার মুক্তিযােদ্ধাসহ সচেতন মানুষ এ ঘাতক লাল মিয়াকে সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে অতীত কুকর্মের ঘটনার জন্য বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
লাল মিয়ার বক্তব্য
একাত্তরের তার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযােগের অভিযােগ সে অস্বীকার করেছে। সে বলে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জামালগঞ্জের মানুষকে অরক্ষিত রেখে পাকি বাহিনীর ভয়ে স্থানীয় অনেক নেতা ভারতে চলে গেলেও এলাকার লােকজনের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে সে দেশ ত্যাগ করেনি। সে আরও বলেছে যে, পাকি বাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে মুক্তিযােদ্ধাসহ শরণাথেিদর নিরাপদে দেশ ত্যাগ এবং তাদের বাড়িঘর রক্ষায় বিশে।
জনকণ্ঠ ॥ ১৩-০৪-২০০০