You dont have javascript enabled! Please enable it! চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার সেলিম হায়দার এখন শিল্পপতি যুবলীগের নেতা - সংগ্রামের নোটবুক

চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার সেলিম হায়দার এখন শিল্পপতি যুবলীগের নেতা

কামাল পারভেজ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ শহীদজায়া বেগম মুশতারি শফি বিশ্বাস করতে পারেন না তার বাড়ি দখল-লুণ্ঠনের নায়ক আলবদর কমান্ডার সেলিম উদ্দিন হায়দার এখন। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সংগঠন যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য! শুধু তাই নয়, স্বাধীনতাবিরােধী। এই ব্যক্তি নানা সময়ে ক্ষমতার আস্বাদ পেয়ে এখন দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি, সমাজসেবক। রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় তার আলিশান অফিস। কত শানশওকত! অথচ এসব দেখেশুনে মুশতারি শফি এবং সেলিম বাহিনীর দুবৃত্তদের হাতে নির্যাতিত মুক্তিযােদ্ধাদের কষ্টের শেষ থাকে না। মুক্তিযােদ্ধা পত্নী, একাত্তরের ঘাতক দালালবিরােধী আন্দোলনের নেত্রী বেগম মুশতারি শফি জনকণ্ঠের সাথে আলাপচারিতায় বলেছেন তার কষ্ট, ক্ষোভের কথা। তিনি জানান, একাত্তরে উত্তাল দিনগুলােতে তার বাড়িটি (মুশতারি লজ, ৫৬৪ বাটালি রােড) ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পরিকল্পনার সূতিকাগার। সে কারণে মুক্তিযােদ্ধা, সংগঠকদের এ বাড়িতে আনাগােনা, আড্ডা ছিল নিয়মিত। তা ছাড়া তার স্বামী, প্রখ্যাত ডেন্টাল সার্জন ডাঃ শফি ছিলেন নিজেও একজন সংগঠক।

মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তাঁর দরজা ছিল সর্বদাই উন্মুক্ত। অবাঙালী, পাকিস্তানীদের চিকিৎসা, তিনি করতেন না। এসব কারণে মুশতারি লজ নামের এ বাড়িটি হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী অপশক্তির চক্ষুশূল। নানাভাবে হুমকি আসতে থাকে পরিবারটির ওপর। কিন্তু ডাঃ শফি ছিলেন দেশপ্রেমে অনড়। সে জন্য তাঁকে মাসুলও দিতে হয়। ৭ এপ্রিল রাজাকার পাকিস্তানী হায়নারা মিলে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এ কারণে ভয়ে পুরাে বাড়িটিই হয়ে পড়ে শূন্য। যাও বা ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন বেগম শফি, পারেননি। রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করতে। তিনিও কপর্দকশূন্য অবস্থায় ৭ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। আর সে সুযােগটিই গ্রহণ করে আলবদর কমান্ডার সেলিম উদ্দিন হায়দার, যার সর্বাধিক পরিচিতি এসইউ হায়দার হিসাবে। এই আলবদর ১৫/২০ জনের সশস্ত্র বাহিনী। নিয়ে দখল করে নেয় মুশতারি লজ। তার পর সেটিকে বানায় ক্যাম্প। যে ক্যাম্পে প্রতিদিন চলত মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর নারকীয় নির্যাতন। আশপাশের লােকজন এবং বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বেগম শফি জানালেন, সেলিম বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি ঘুরে বেড়াত শহর জুড়ে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে তারা ধরে আনত মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লােকজনকে। এনে এ ঘরে বন্দী করে দিনের পর দিন চালানাে হতাে নির্মম-নৃশংস নির্যাতন। প্রতিদিন রাত হলে সেই অভিশপ্তপুরী থেকে ভেসে আসত মানুষের আর্তচিঙ্কার। যে চিৎকার পাষাণ হৃদয় টলাত, কিন্তু টলেনি সেলিম হায়দার ও তার দুবৃত্ত দলের মন।

এ ক্যাম্পে ধরে আনাদের অনেকেরই খোঁজ মেলেনি আর। দীর্ঘ ৮ মাস (এপ্রিল-ডিসেম্বর) আলবদর ক্যাম্পটি বহাল ছিল। এর মাঝে ধূর্ত সেলিম চালিয়েছে আরেক ঘৃণ্য অপপ্রয়াস। সে নানাভাবে ডাঃ শফির মূল্যবান বাড়ি, সম্পত্তি দখলের চেষ্টা চালায়। তার এ অপকর্মের কথা লেখা আছে শব্দসৈনিক বেলাল মােহাম্মদ রচিত ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ বইটির ২৬৯ পৃষ্ঠায়। সেখানে লেখা আছে‘এক পর্যায়ে নিজেকে সে ডাঃ মােহাম্মদ শফির একমাত্র ওয়ারিশ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল। মকবুল আহমদ সওদাগরের (মহল্লার বাসিন্দা) কাছ থেকে জরিপের দাগ নম্বর জেনে নিয়েছিল। বাড়িটি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করার উদ্যোগ নিয়েছিল। বিজয় অর্জনের পর ১৬ ডিসেম্বর সে পালিয়ে যায়। পরে যােগদান করে যুবলীগে। বলা প্রয়ােজন, বেলাল। মােহাম্মদের ‘সাকিন সন্দীপ’ উপন্যাসটিও সেলিমের দুবৃত্তায়ন ছায়া অবলম্বনে রচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে এ রকম বহু অপকর্ম করে বেড়ায় সেলিম হায়দার। তার বাড়ি সন্দ্বীপের হারামিয়ায়। উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে- এই আলবদর কমান্ডারের বড় ভাই হচ্ছেন একজন মুক্তিযােদ্ধা। তিনি আবার বেগম মুশতারি শফির রাজনৈতিক জীবনের একজন সহকর্মী। কিন্তু সেলিম সেই মুশতারি শফিকেই মেরেছে ছছাবল। যুদ্ধ শেষে পালিয়ে যাবার সময় সেলিম ও তার বাহিনীর সদস্যরা মুশতারি লজের দেয়াল ছাড়া অবশিষ্ট কিছুই রেখে। যায়নি। বাড়িটির সব কিছুই লুটেপুটে নিয়েছে। এর অনেকটাই সেলিম তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে রেখেছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর মুশতারি শফি ফেরার পর শূন্য বাড়িটি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। কারণ সেলিম এমনই লুটপাট চালিয়েছে, যা পেশাদার চোরডাকাতের পক্ষেও সম্ভব নয়। সেই সেলিম হায়দার দেশ স্বাধীন হবার পর পুরােদস্তুর মুক্তিযােদ্ধা সেজে যােগ দেয় যুবলীগে।

এক পর্যায়ে এয়ারফোর্সে ঢুকে জার্মানি যায়। এসব তাড়াহুড়ার উদ্দেশ্য ছিল তার তাজা অপপরিচয়টি ঢাকা। এতে সে অনেকখানিই সফল হয়। ‘৭৫-এ পটপরিবর্তনের পর দেশে ফিরে এয়ারফোর্স ছেড়ে নেমে যায় ব্যবসায়। তার পর শুরু হয় তার অন্য উপাখ্যান। নামে যুবলীগের আশ্রয়ে থাকলেও ক্ষমতাসীন সরকারের অনুগ্রহ পেয়ে বাড়তে থাকে তার বিত্তের পরিধি। সেলিম হয় যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য, আসল পরিচয়টি লুকিয়ে। এখনও তাই আছে। এলাকার সমাজসেবার মাত্রাটি তার বেড়েছে। বেড়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড কানেকশন। সেলিম হায়দার এখন কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধার কষ্ট জড়ানাে নাম সেলিম হায়দারের এসব জীবনবৃত্তান্ত, বাড়বাড়ন্ত দেখে কষ্ট বাড়ে বেগম মুশতারি শফির। তার সামনে সুশীল সমাজ, সৎ রাজনীতি এবং আইনের ধারাবাহিকতা নিয়েও সৃষ্টি হয় অসংখ্য প্রশ্ন।

জনকণ্ঠ ॥ ২৪-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন