ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৈরতলা কুরুলিয়া, দাতিয়ারা ও দাতাই বধ্যভূমি সৃষ্টির নায়ক হাবিবুর রহমান।
রিয়াজ উদ্দিন জামি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ॥ একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলােতে রাহ্মণবাড়িয়া শহরকে কলঙ্কিত করেছে স্বল্পসংখ্যক স্বাধীনতাবিরােধী চিহ্নিত ঘাতক রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতা। পাক সেনাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে এই অপশক্তি নারকীয় ধ্বংস, গণহত্যা ও লুটপাটের মহােৎসব চালায়। তখনকার মহকুমা শহরকে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত করে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এখনও মুক্তিযােদ্ধারা ঘৃণাভরে উচ্চারণ করেন। রাজাকারদের প্রধান সেনাপতি হাবিবুর রহমানের নাম। প্রচলিত আছে, পাকি সেনাদের বুলেট থেকে বেচেছে, এমন নজির আছে, কিন্তু হাবিবুর রহমানের থাবা থেকে রক্ষা পেয়েছে, এমন নজির নেই। হাবিবুর রহমানের নাম শুনলে আজও সন্ত্রস্ত হয় মানুষ। বাঙালী নিধনকারী এ রাজাকার ও তার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাড়ায় পাড়ায় শান্তি কমিটির নামে অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে দেয়। মুক্তিযােদ্ধা দেশপ্রেমিক মানুষদের রক্তের সন্ধানে একাত্তরের নয়টি মাস চষে বেড়িয়েছে সর্বত্র। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে তাকে ক্ষমা করত না, তুলে দিত পাকি ঘাতকদের হাতে। নিয়ে যেত টর্চার সেলে। টর্চার সেলের সে ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এসব হত্যা, নির্যাতন আর লুটপাটের কোন হিসাবও নেই । পৈরতলা বধ্যভূমি, কুরুলিয়া বধ্যভূমি, দাতিয়ারা (ওয়াপদা) বধ্যভূমি ও নাটাই বধ্যভূমি তার হাতেরই সৃষ্টি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী কলেজের অধ্যাপক লুৎফুর রহমান, ঢাকা মােহাম্মদপুর থানার ওসি শিরু মিয়া ও তার কিশাের পুত্র ঢাকা ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলের ছাত্র আনােয়ার কামাল, বাজিতপুর কলেজ ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান, তেলেরাম কলেজ ছাত্র আবু সাইয়িদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ ছাত্র শামসুল হক, হারিস মিয়া, ভৈরবের আশুরান দেসহ কত লােককে যে হত্যা করা হয় কোন দিন তার কোন হিসাব কেউ দিতে পারবে।
। আশ্চর্যজনক বিষয় যে, পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের দিনেও গণহত্যা চালাতে কুণ্ঠাবােধ করেনি ঘাতকচক্র। সেদিন ছিল ২০ নবেম্বর। তামাম দুনিয়ার মুসলমানগণ বছরের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব পালনে ব্যস্ত। ঠিক সে দিনই পাক ঘাতকদের বিশ্বস্ত বন্ধু রাজাকার হাবিবুর রহমান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সহায়তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়। পৈরতলা (দারিয়াপুর) রেলওয়ে ব্রিজ, কুরুলিয়া নদীর তীরে (বর্তমান সার্কিট হাউস। এলাকা) কয়েক শ’ লােককে হত্যা কৰা হয়। নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় সেই। দামাল সন্তানদের। মুক্তিযুদ্ধে যাবার অভিযােগে ও সন্দেহবশত আক্রোশমূলকভাবে। এদের বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা হয়। বেশির ভাগ লােককে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয়। যুদ্ধে অংশ নিয়েছে অথবা নিতে যাচ্ছে সে সব অভিযােগে রাজাকার, আলবদর ও তথাকথিত শান্তি কমিটির নেতাদের নির্দেশে বিপুলসংখ্যক লােককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানাে হয়। পরে সে সব বন্দীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা মুক্তিযােদ্ধাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাক ঘাতকদের বিশ্বস্ত সহচর ছিল শহরের কাজীপাড়ার ঝানু খান। আরেকজন আতিকুল ইসলাম খােকন, আলী আজহার পেয়ারা মিয়া, আব্দুর রহমান খান, আব্দুর রহমান মােল্লা, আলী আতহার খুশু মিয়া, সৈয়দ মােহাম্মদ আহাম্মদ (নাবালক মিয়া)। পাক সেনাদের সঙ্গে এ দেশের ঘাতকরা নয়টি মাস ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সন্ত্রস্ত্র জনপদে পরিণত করে রাখে। চিহ্নিত রাজাকাররা সে বিভীষিকাময় দিনগুলােতে জ্বালাওপােড়াও, লুটপাট আর ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা চালায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই রাজাকার। শিক্ষক হাবিবুর রহমান এখনও বহাল রয়েছে। সে এখন একটি মৌলবাদী সংগঠনের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য। এ ঘাতক কুমিল্লায় অবস্থান করছে। দেশ স্বাধীন হবার পর। সে আত্মগােপন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। শহরতলির সুহিলপুর তালুকদার পাড়ায় তার।
বাড়ি। একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামায়াতের আমির ছিল। সে ছিল এ অঞ্চলের তথাকথিত শান্তি কমিটির সভাপতি। তার তত্ত্বাবধানেই শহরে পাড়ায় পাড়ায় ও গ্রামে গ্রামে রাজাকার ও শান্তি কমিটি গড়ে উঠেছিল। একাত্তরে অন্নদা হাই স্কুলের শিক্ষক ছিল। এ ঘাতক। যুদ্ধের পূর্বেই বিদ্যালয়ের ছাত্রদের জামায়াতী কর্মকাণ্ডে মদদ দেয়। চাঙ্গা করে তােলে সংগঠন। শহরের মৌলভীপাড়াস্থ বর্তমান খালেক মঞ্জিলে সে ভাড়া থাকত। এখানকার সকল হত্যা, লুটপাট, ধ্বংস তার নির্দেশেই হতাে। সে যাকে বলত তাকেই হত্যা আর যাকে বলত তাকে ছেড়ে দেয়া হতাে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড তার নীলনক্সায় হতাে। তার অঙ্গুলি হেলন ছাড়া পাকি বাহিনী এককদমও এগুত না। লােকে বলে, শিক্ষক হলেও যদি তার কোন ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে ধরা পড়ত তবে শত আকুতিমিনতি করেও পাষণ্ড হাবিবুরের মন টলাতে পারত না। নির্যাতনের পর হত্যাই। ছিল হাবিবুরের কাছ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ। কোথায় কোথায় কারা মুক্তিযুদ্ধে যায়, কে কোথায় অবস্থান করছে, কাকে ধরতে হবে, মারতে হবে- সব কিছুতেই তার ভূমিকা। ছিল প্রধান। ভারতগামী ৯ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে হত্যা করা হয় তার নির্দেশে। ঢাকা থেকে আশুগঞ্জ আসার পর তাদের ধরা হয়। মুক্তির ট্রেনিং নিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। তারা আগরতলায় যাচ্ছিল। বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেয়া হয় তাদের। তালশহর রাজাকার কমান্ডার হাবিবুর রহমানের কাছে একটি চিঠি দেয়। সাত পৃষ্ঠার চিঠিতে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান, হত্যার নীলনক্সা সংবলিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি ছিল সেই চিঠিতে। সদর উপজেলার মজলিশপুর গ্রাম থেকে চার নিরীহ লােককে ধরে আনা হয়। বর্তমান কালীবাড়ীতে তাদের রাখা হয়। পরে তাদের হত্যা করা হয়। ভাটপাড়া গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা সেই দিনের লােমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আজও কেঁদে ওঠেন। ঝানু খানের অত্যাচারের কাহিনী বলতে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধা হােসেন মিয়া আঁতকে ওঠেন।
সে পৈরতলার মুক্তিযােদ্ধা হারুন-অর-রশীদ দুলালের বাড়িতে চড়াও হয়, লুটে নিয়ে আসে। দোকানের মালপত্র। হুমকি দেয় হারুনকে হাজির করানাের জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসব রাজাকার-ঘাতকরা ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ, হত্যা, লুণ্ঠন প্রভৃতি। জঘন্য কর্মকাণ্ড চালিয়েছে । ৬ মে ‘৭১ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শান্তি কমিটির উদ্যোগে মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে বর্তমান জাতীয় বীর আব্দুল কুদ্দুস মাখন মঞ্চে (লােকনাথ দিঘীর পাড়) সমাবেশ হয়। পাকি মেজর বােখারীর উপস্থিতিতে বক্তৃতা করেন মুসলীম লীগ নেতা রাজাকার আব্দুর রহমান মােল্লা, আব্দুর রহমান খান, আলি আজহার পেয়ারা মিয়া, শান্তি কমিটির আহ্বায়ক রাজাকার হাবিবুর রহমান। সেই সভায় মহল্লায় মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠন করে রাজাকারদের ভাষায় দুষ্কৃতকারীদের দমন করার আহ্বান জানানাে হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মােড়ে একটি হিন্দু বাড়ি দখল করে শান্তি কমিটির অফিস স্থাপন করা হয়। বাড়ির নাম দেয়া হয় শান্তি ভবন। শান্তির নামে এখান থেকেই। অশান্তি, সন্ত্রাস আর সহিংসতার আগুন ছড়িয়ে দেয়া হয়। পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়ি লিজ দেয়ার নামে শান্তি কমিটি ৮ আনা করে দরখাস্তের ফরম বিক্রি করে। বেশির ভাগ। রাজাকার শান্তি কমিটির তথাকথিত নেতারা তা দখল করে নেয়।
জনকণ্ঠ ॥ ২৯-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন