ফুলপুরে একাত্তরের মূর্তিমান আতঙ্ক বশির মেকার এখন কোটিপতি
বাবুল হােসেন, ময়মনসিংহ থেকে ॥ কোনাপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ যামিনী পাল শিশুপুত্র স্বপন পালের প্রাণভিক্ষা চেয়ে পায়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন রাজাকার কমান্ডার বশির মেকারের। বাঁচিয়ে রাখার বিনিময়ে যামিনী শিশুপুত্রকে দাস হিসাবেও তুলে দিতে চেয়েছিলেন রাজাকারদের হাতে। কিন্তু কোন আকুতি-মিনতি পাষণ্ড রাজাকার কমান্ডার বশিরের মন গলাতে পারেনি। ফুলপুর উপজেলার হরিয়ানাই খালের ওপর এক লাইনে দাঁড় করিয়ে সেদিন এই পিতাপুত্রের সঙ্গে শশাঙ্ক সেনগুপ্তকে হত্যা করা হয় ঠিক ভরদুপুরে গুলি করে। গুলি করার আগমুহূর্তে চতুর শশাঙ্ক লাফ দিয়ে উঠেছিল। গুলি লেগেছিল তার কোমরে। মরার ভান করে পড়ে ছিল পানিতে। রাজাকার দল চলে যাওয়ার সময় যন্ত্রণায় কাতর শশাঙ্ক পানির ওপর মাথা তুলে দম নিতে চাচ্ছিল। বশির ফিরে এসে পুনরায় গুলি চালায় শশাঙ্কের মাথা লক্ষ্য করে। এলাকার শত শত মানুষ আজও এই ঘটনার বিবরণ দেয় মুখস্থের মতাে। বালিয়া, পয়ার, ভালকি, বাখাই, মাখুয়াইসহ ফুলপুরে একাত্তরে শত শত মানুষের খুনী, বহু লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ও পাকিদের দোসর রাজাকার কমান্ডার বশির মেকার ফুলপুরে প্রতিষ্ঠিত কোটিপতি ও তাবলীগ জামায়াতের সক্রিয় নেতা। একাত্তরে পাকি স্বপ্নে বিভাের এই কুখ্যাত রাজাকার এলাকায় এখনও মূর্তিমান আতঙ্ক! ফুলপুর উপজেলার ভালকি গ্রামের গদধর (৩৫) জানান, একাত্তরে বশির মেকার তার দাদা বিপিন চন্দ্র সেনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ভনভনিয়া বড়ইকান্দি ক্যাম্পে গুলি করে হত্যা করে।
এই কাহিনী গদাধর তাঁর বাবার মুখ থেকে শুনেছেন। একই গ্রামের নুরল। ইসলাম (৫০) জানান, এই কুখ্যাত বশির বালিয়া বাজারে ঘড়ি মেরামতের কাজ করত। একাত্তরে সে ভালকি গ্রামের উন্দুরিয়াকে একদিন ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সে ডাঃ গণপতি আদিত্য, এ্যাডভােকেট আবুল হাশেমের বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। লালমােহন দাস, দীনেশ চন্দ্র সেন ও মণ্ডলবাড়ি এলাকার বহু হিন্দুর বাড়ি লুট করে। এলাকার বহু হিন্দু পরিবারকে জোরপূর্বক ভয় দেখিয়ে মুসলমান বানায় সে। ব্যাংকার মােখলেছুজ্জামান তালুকদার (৪০) জানান, একাত্তরে তখন তার বয়স ১০ বছর। বাবা ইসহাক উদ্দিন তালুকদার গরু চরাচ্ছিলেন মাঠে। বশির মেকার এসে তার বাবাকে তুলে নিয়ে যায় ও বালিয়া টর্চার সেলে নির্যাতন চালায়। এ সময় টাঙ্গাইলের মাহমুদ নামে এক রাজাকার তার সঙ্গে ছিল। সেদিন পানি খাওয়ার ছল করে পালিয়ে এসে জীবন রক্ষা করেন ইসহাক। একাত্তরে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার পিস কমিটির সভাপতি ছিল রজব আলী ফকির (মৃত)। সেক্রেটারি ছিল জলিল খান (মৃত)/ময়ছর উদ্দিন তালুকদার। এদের সহযােগী ছিল বশির মেকার, স্পেশাল রাজাকার কমান্ডার সুরুজ (মৃত), হাফিজ বিএসসি, হাফিজুল ইসলাম চেয়ারম্যান, হক চেয়ারম্যান, আমজত চেয়ারম্যান, জোনাব। আলী চেয়ারম্যান, জৈমত চেয়ারম্যান, সালেহ খান, কাকনির আনসার, মােতালেব, দাদরার মােতালেব, জবেদ ফকির, মনু মিয়া, জলিল খান, আজিজ সরকার, আইয়ুব আলী, আলমগীর, চান মিয়া, আফতাব চেয়ারম্যান, মাওঃ এরশাদ উল্লাহ, আবুল। কাশেম, ওমর আলী খা, অধ্যক্ষ রফিক উদ্দিন।
এদের মধ্যে কুখ্যাত বশির মেকার ছিল। বালিয়া ক্যাম্প ইনচার্জ। মুক্তিযােদ্ধা বিমল পাল (৫০) জানান, ময়মনসিংহের একমাত্র ফুলপুর উপজেলাতেই একাত্তরে রাজাকার-আলবদরদের সশস্ত্র ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। ফুলপুর উপজেলা (সাবেক সিও) অফিস প্রাঙ্গণে দুই ব্যাচে ৬শ’ ৫০ রাজাকার-আলবদর ট্রেনিং নিয়েছিল। ফুলপুর জলিল খানের বাসা, বালিয়া মাদ্রাসা, গােয়াতলা বাজার, তারাকান্দা বাজার, খিচা, ভনভনিয়া বড়ইকান্দি ও সরচাপুর ঘাটে ছিল এসব রাজাকারের ক্যাম্প। রাজাকাররা এসব ক্যাম্প থেকেই অপারেশনের নেতৃত্ব দিত। ফুলপুর বালিয়া, সরচাপুর ঘাট, পয়ার, বাখাই, মাখুয়াই, ভালকি, ভাইটকান্দি গ্রামে এই রাজাকাররা শত শত। বাঙালী নর-নারীকে হত্যা, নির্যাতন চালিয়েছে। বালিয়া ও সরচাপুর ঘাটের ক্যাম্পে বহু। নারীকে ধরে এনে তুলে দেয়া হতাে পাকিদের হাতে। সরচাপুর ঘাটে শত শত বাঙালীকে গুলি করে হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দেয়া হতাে খরস্রোতা কংশ। নদীতে। পয়ার চৌধুরী বাড়ির গণহত্যার কথা শুনলে আজও মানুষের গা শিউরে ওঠে। এখানকার তিনআনি ও আটানি বাড়ির ৮ জনকে একদিনে হত্যা করা হয়েছিল ব্রাশফায়ারে। এই দুই জমিদার চৌধুরী বাড়ির নারীদের একদিনে একসঙ্গে বাঁশঝাড়ে লাইন করিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। পয়ার গ্রামের আবুল মনসুর সরকার (৫০)। জানালেন, সেদিন গুলিবিদ্ধ তিনআনি বাড়ির নওর স্ত্রী আজও বেঁচে আছেন কলকাতায়। ফুলপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রবীণ নেতা ডাঃ মনােরঞ্জন দত্ত (৭২) জানালেন, একাত্তরে পয়ার চৌধুরী বাড়ির ১৫ জনকে হাত বেঁধে ট্রাকে তুলে সরচাপুর। ঘাটে এনে একদিনে হত্যা করা হয়েছিল গুলি করে। খরস্রোতা কংশ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সেদিন প্রাণে রক্ষা পেয়েছিলেন স্কুল মাস্টার সত্যেন্দ্র। ফুলপুরের এস রফিকুল ইসলাম মতি মিয়াকে (৭০) রাজাকাররা ধরে নিয়েছিল ফুলপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। তাকে ফুলপুর থানায়, সরচাপুর ক্যাম্পে, হালুয়াঘাট ক্যাম্পে, কৃষি ভার্সিটি ক্যাম্পে ও ময়মনসিংহ জেলা কারাগারে ৩ মাস ২৩ দিন আটকে নির্যাতন চালানাে হয়।
মুসলিম লীগের এক নেতার সহায়তায় পরে তিনি ছাড়া পান। ছাড়া পাবার পর একরাতে বাসায়। দাবা খেলছিলেন প্রতিবেশী লাবলুর সঙ্গে। সে রাতেই আবার রাজাকাররা হানা দেয়। তার বাড়িতে। পিছনের দরজা দিয়ে পালাবার পথে সশস্ত্র রাজাকারদের সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লুঙ্গি ফেলেই দৌড়ে প্রাণ বাঁচান মতি। রাত কাটান এক গাছে। সে রাতেই ফুলপুর সদরে গুলি করে হত্যা করা হয় ডাঃ আবু তাহের ও কাজী উসমান গনিকে। ফুলপুর ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ কাজী আবদুস সাত্তার (৬০) জানান, তার বড় ভাই উসমান গনিকে রাতে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পােস্ট অফিসের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। শহীদ ডাঃ তাহেরের স্ত্রী মাের্শেদা বেগম (৫৭) জানান, সেদিন ছিল সােমবার, হাটবার। রাত ১১টার দিকে বাসায় ফিরলে তাহেরকে অস্থির দেখাচ্ছিল। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছিল। ভাত খেয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে শুতে যাওয়ার পরই বাড়ির গেটে শব্দ। টর্চের আলাে। থানার বড় সাহেব ডাকছে বলে তাহেরকে ডেকে তােলা হয়। ঘরের সামনের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। না পেরে পিছনের দরজা ভাঙ্গে। মুখােশপরা একজন তাহেরের কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি চালায়। মাথার মগজ ছিটকে যায় সারা ঘর ও মাের্শেদার মুখমণ্ডলে। সেদিন রাতে ৭ বছরের বড় মেয়েটি প্রতিবেশীদের। ডেকেছিল। ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে মাের্শেদা আজও ডুকরে কাদেন। বাখাই গ্রামের চিত্তরঞ্জন দাস বিমল (৬০) জানান, শ্রাবণ মাসের একরাতে তার বাড়ির ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল তার চোখের সামনেই। গুলি লেগেছিল তাঁর গায়েও। ভাইটকান্দি বাহাদুরপুরের বহু নারীকে পাকিদের ক্যাম্পে।
ভােগের বস্তু হতে হয়েছিল। একাত্তরের পর সরচাপুর ও বালিয়া ক্যাম্পে নির্যাতিত নারীদের অনেক বস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। যুদ্ধের পর এসব রাজাকারের সঙ্গে বশির মেকারও গ্রেফতার হয়েছিল। সে পলাতক ছিল অনেকদিন। তার বিরুদ্ধে দু’টি হত্যা মামলাও রুজু হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর সে আবার এলাকায় আত্মপ্রকাশ করে ও পুরনাে মড়ি মেরামতের পেশা ধরে। যুক্ত হয় তবলিগ জামাতের সঙ্গে। তার এক ছেলেকে শিবিরের লেবেল এঁটে পাঠায় সৌদিতে। অন্য পুত্ররাও ফুলপুর সদরে প্রতিষ্ঠিত। প্রচার আছে, সেই রাজাকার বশির মেকার এখন কোটিপতি। কিন্তু সমাজে তার অবস্থান। একজন ঘৃণিত ব্যক্তি হিসাবে। ফুলপুরে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে এই রাজাকার তার। সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে সক্রিয় ছিল। রাজাকার বশির মেকারের বক্তব্য বশির মেকার একাত্তর প্রসঙ্গে জানায়, লােকজন তাকে রাজাকার বলত, কিন্তু সে রাজাকার ছিল না। তবে স্বাধীনতাবিরােধী ও পাকিদের পক্ষে কাজ করার কথা সে। স্বীকার করেছে। স্বীকার করেছে পৃথক ৬ জন ও ৩ জন হত্যাকাণ্ডে ২টি মামলার কথা। একাত্তরে বহু হত্যাকাণ্ড, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযােগের কথা স্বীকার করেনি। বশির। তবে হাজী বশির একাত্তরের জন্য অনুতপ্ত বলে জানিয়েছে। এখন সে কোটিপতি। কি-না প্রশ্নের জবাবে মুচকি হেসে জানায়, “এ সব কিছুই ওপরওয়ালার”।
জনকণ্ঠ। ২১-০৪-২০০০
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন