শিরোনামঃ মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মনোভাব ও ভূমিকার প্রতিবাদে দল থেকে পদত্যাগের প্রশ্নে লিয়াকত আলী খানকে লিখিত ফজলুল হকের চিঠি
সুত্রঃ দৈনিক স্টেটসম্যান সূত্রঃ অমলেন্দু দে পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক। পৃঃ ১০৫ও শীলা সেন, “মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল”
তারিখঃ ৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪১
ফজলুল হক লিয়াকত আলির নিকট লিখিত পত্রে যে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলোঃ
“শেষ করার আগে আমি কিছু বিষয়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে চাই। আমার এই প্রতিবাদ কিছু প্রদেশের সেই সমস্ত মুসলিম নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে যাদের কর্মকান্ডের জন্য বাঙলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের স্বার্থ হুমকির মুখে। এই সমস্ত নেতৃবৃন্দ যেসব অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করছেন তাতে মুসলমানরা অত্যন্ত সংখ্যালঘু, এমনকি মুসলমানদের মাঝেও তা ভারতের সংখ্যালঘু প্রদেশ নামে পরিচিত। একমাত্র বাঙলা ও পাঞ্জাবেই রয়েছে প্রায় ৫ কোটি মুসলমান, যা ভারতের সর্বমোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। বাকি ৫ কোটি মুসলমান সমগ্র উপমহাদেশে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে বিভিন্ন প্রদেশে এর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সেই প্রদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪ থেকে ৫ ভাগ মাত্র। উনাদের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে-ক্ষমতায় আসা তো দূরের কথা, প্রশাসনে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আশা করাও উনাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং এটা সহজেই অনুমেয় যে, বাঙলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানেরা প্রশাসনে কর্তৃত্বপূর্ণ পদসমূহে থাকার কারণে যেসব সুবিধাসমূহ ভোগ করছে তা এই ভাইয়েরা কখনো উপলব্ধি করতে পারবেন না। এ সমস্ত অঞ্চলে একজন মুসলিম প্রশাসকের কি পরিমাণ দায়িত্ব সেটাও বোঝা সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। তারা মনে করেন, বাঙলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের ভবিষ্যতও তাদের ভবিষ্যতের মতই অন্ধকার। স্বভাবতই যখন সমগ্র ভারতের মুসলমানদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয় তখন সেই সিদ্ধান্তের প্রভাব বাঙলা ও পাঞ্জাবের মুসলমানদের রাজনীতির উপর কি হতে পারে সেই বিষয়ে তাদের কোন পরোয়া থাকে না। আমি এই সংখ্যালঘু প্রদেশের মুসলিম নেতৃবৃন্দের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, তারা যদি মুসলমান সংখ্যাধিক্য অঞ্চলসমূহের রাজনীতি নিয়ে অযথা হস্তক্ষেপ করেন, তাতে কিন্তু সমগ্র ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থই হুমকির মুখে পড়ে যাবে। অন্তত আমি কখনোই ৩ কোটি ত্রিশ লাখ মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব বাইরের কোন শক্তির নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেব না, তা সে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন।
“আমার ধারণা, বর্তমানে আমাদের প্রদেশের বাইরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনায় বাঙলার তেমন কোন গুরুত্ব নেই, যদিও সমগ্র ভারতের সর্বমোট মুসলিম জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই বাঙলায় বসবাস করে। তারপরও, সংখ্যালঘু প্রদেশগুলোর নেতৃবৃন্দ কখনোই আমার দায়িত্বকে এবং প্রতিনিয়ত যে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি তাকে কোন গুরুত্ব দেননি। উপরন্তু, তারা তাদের স্বার্থ রক্ষা করে এমন সব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক হতাশা প্রকাশকারী অর্থহীন সব স্লোগান দিয়ে চলেছেন আমার বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য, আমার কথা যাতে কারো কাছে না পৌঁছায় সে জন্য। অথচ তাদের এসব বিষয়সমূহের সাথে আমার প্রদেশের কোন অবস্থার কোন সম্পর্ক নেই। আমি আমার বক্তব্য রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরার পূর্বেই আমাকে থামিয়ে দেওয়া হয়।
জুলাই এর প্রথমদিকে আমার গভর্ণরের মাধ্যমে ভাইসরয় আমাকে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে বাঙলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উক্ত প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করার আহ্বান জানান। আমি আমার কর্তব্যবোধ থেকে প্রস্তাবে সম্মতি জানাই। আমি জানতাম আমাকে নির্বাচন করা হয়েছে সরকারি আদেশে, কারন আমি ছিলাম প্রধানমন্ত্রী। তাই কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের নাম ঘোষণার পর লীগ সভাপতির বক্তব্য শুনে আমি বিস্মিত হই। তিনি বলেছেন, তিনি আমার এবং লীগের অন্যান্য সদস্যদের কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ এবং আমাদের কার্যক্রমে আপত্তি জানিয়ে পরবর্তী কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সেই বিষয়ে চিন্তা করছেন। আমি আমার অবস্থান জানিয়ে একটি বক্তব্য পেশ করি। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে প্রধানমন্ত্রীদের সরকারি আদেশের মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয়েছে, যা প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়। আমি ভেবেছিলাম আমার অবস্থান আমি পরিষ্কার করতে পেরেছি এবং সভাপতির বক্তব্যে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ৩০ তারিখে সভাপতির বক্তব্যে পড়ে আমি আবারও বিস্মিত হই। সেখানে বলা ছিল, আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বক্তব্যের ভাষার মাঝে কোন অস্পষ্টতা ছিল না এবং সেটা পড়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে এই ব্যাপারে ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়া হয়েছে। আমার মতামত, সভাপতির এই আচরণ চরম অসাংবিধানিক। মাদ্রাজ প্রস্তাব থাকার পরও আমাদের বক্তব্য শোনার আগে কোন ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়া তার উচিৎ হয় নি। আমি আরও বলতে চাই, উক্ত বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কার্যকরী কমিটির কাছে বিষয়টি হস্তান্তর করাও সম্পূর্ণ অর্থহীন। কার্যকরী কমিটির সামনেও সভাপতির কার্যক্রমকে বৈধতা দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। কেননা সভাপতির কার্যক্রমে অসম্মতি জানানো মানে সভাপতির উপর অনাস্থা জ্ঞাপন করা, যার ফলে এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যা মোকাবেলা করার মত ইচ্ছা কার্যকরী কমিটির নেই। যার ফলশ্রুতিতে কমিটি আমাকে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ থেকে নিঃশর্তভাবে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে।
২. পরবর্তিতে দেখা যায়, নিরাপত্তা পরিষদে থেকে প্রধানমন্ত্রীরা কিছু নির্দিষ্ট ক্ষমতাবলে কাজ করবেন- এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তা ২১ জুলাই ভাইসরয়ের নিকট হতে বোম্বের গভর্নরের মাধ্যমে সভাপতি মহোদয় আগেই জেনেছিলেন। আমরা প্রধানমন্ত্রী অথবা সাধারণ প্রতিনিধি যে হিসেবেই নির্বাচিত হয়ে থাকি না কেন, সভাপতি আমাদের নির্বাচনের খবর নাম প্রকাশের অন্তত এক দিন আগে থেকেই জানতেন। উনার অসম্মতি থাকলে আমাদের টেলিগ্রাম অথবা টেলিফোন করে তা আগে থেকেই জানানো স্পষ্টতই তাঁর দায়িত্বের মাঝে পড়ে। তিনি আমাদেরকে এ ও বলতে পারতেন যে তিনি চান আমরা যেন নিরাপত্তা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করি। এমনকি তিনি আমাদের আকারে ইঙ্গিতেও বোঝাতে পারতেন যে আমরা যদি পদত্যাগ না করি তাহলে উনি আমাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু তিনি নাম প্রকাশ হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, এবং তার পর পরই আমাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে দিলেন। এরকম একটি ঘোষণা দেওয়ার আগে সতর্ক করে দেওয়ার মত যে সাধারণ সৌজন্যতাবোধ সেটাও তিনি দেখাননি। তাঁর কার্যক্রম আমাদেরকে অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। উনি আমাদের ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ দিয়ে অসতর্ক অবস্থায় আমাদের এরকম পরিস্থিতিতে ফেলে দেন। তাঁর কার্যক্রমে মনে হচ্ছিল উনি জনসম্মুখে তাঁর ক্ষমতা দেখানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
৩. আমার সুদৃঢ় মতামত, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে আমি লীগের কোন মূলনীতির বরখেলাপ করিনি। ভাইসরয় গত বছর একটি প্রস্তাব রাখেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটি বৃহদাকার যুদ্ধ বিষয়ক পরিষদ গঠন করার। লীগ তা প্রত্যাখ্যান করে, যদিও নিরাপত্তা পরিষদ বিভিন্ন রাজ্য ও বিভিন্ন প্রদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত। এই ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দেখা যায় যে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে লীগের কোন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয় না। যদিও সভাপতি বারবার বলে যাচ্ছেন আমরা মুসলিম প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি, আমি তারপরও দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, আমরা নির্বাচিত হয়েছি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে। যদি এইভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা যায় তাহলে বোঝা যায়, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে লীগের কোন ধারা বা মূলনীতির বরখেলাপ করা হয় নাই। উপরন্তু, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি যুদ্ধ বিষয়ক আমাদের কার্যক্রম তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে যুদ্ধের পক্ষে বাঙলার মানুষের থেকে জনসমর্থন আদায়ের জন্য চেষ্টা করে চলেছি। তখন কিন্তু সভাপতি আমার কোন কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করেন নি। এমনকি, তিনি সারা ভারত জুড়ে বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে এভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতেও কোন বাধা দেননি।
৪. বিভিন্ন প্রদেশে যুদ্ধ বিষয়ক কার্যক্রমে আমার যে সংশ্লিষ্টতা ছিল তা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ প্রাপ্তির ঘটনাটা একদমই গুরুত্বহীন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে অসহযোগিতা করার অনুরোধ করাটাও একদম অযৌক্তিক। আমি মনে করি, কার্যকরি কমিটিকে দিয়ে তাঁর যে কার্যক্রমগুলো অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন তা ভিত্তিহীন। আমি বিশ্বাস করি না আমার নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণের ব্যাপারে বাঙলার বা সমগ্র ভারতের মুসলমানদের কোন আপত্তি আছে। এমনকি বাইরের প্রদেশেও অনেকের মতামতই আমার পক্ষে। সভাপতির আচরণ প্রথম থেকেই ছিল পক্ষপাতদুষ্ট ও অসাংবিধানিক, যদিও মুসলমানদের স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কিছুই আমি করিনি। আমি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে বিভক্তির সৃষ্টি করবে- সভাপতির এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তাই, সভাপতি এবং কার্যকরি কমিটি যাই ভাবুক না কেন, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোন কারণ দেখি না।
৫. কিন্তু এখানে অন্যান্য কিছু বিষয় বিবেচনা করা প্রয়োজন। সভাপতির অদূরদর্শীতা এবং তাড়াহুড়ো করে দেওয়া ঘোষণা মুসলমানদের মাঝে এক ধরণের দ্বিধার জন্ম দিয়েছে। তাঁরা ভাবছেন আমরা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য অথবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মন রক্ষার স্বার্থে। এই ধরণের ধারণা পোষণ করা মারাত্মক ক্ষতিকর। বর্তমান প্রজন্মের খুব কম মুসলিম নেতাই জানেন লীগ অথবা মুসলমান সমাজের জন্য আমি কি করেছি। নিজের বড়াই না করেই বলতে চাই, ইসলাম এবং ভারতীয় মুসলমানদের জন্য আমি যা যা করেছি তা নিয়ে আমার লজ্জিত হওয়ার কোন কারণ নেই। আমি জোর গলায় জানাতে চাই, কোন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা আমার নিজের ইচ্ছানুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে কোনভাবেই আমাকে বিরত রাখছেন না। তা সত্ত্বেও বর্তমানে আমি এক অপ্রীতিকর সিদ্ধান্তহীনতার সম্মুখীন। আমি মনে করি আমার নিরাপত্তা পরিষদে যোগদান করা উচিৎ। কিন্তু আমি যদি তা করতে চাই তাহলে তা ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে এক ধরণের দ্বিধার সৃষ্টি করবে, কেননা অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীদের অনেকেই তাঁর পদ ছেড়ে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তার জন্য আমাকেই দায়ী করা হবে। এমনকি এই অবস্থার জন্য অন্যদেরও দোষারোপ করা হতে পারে যাদের এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই কিন্তু তাদের এসব বিষয় থেকে নিজেদের দূরে থাকার খবর জনসাধারণের জানা নেই।
৬. উপরোক্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় আমার মনে হয় না নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হয়ে আমি কোন কাজে আসতে পারবো। তাই আমি আমার গভর্ণরের মাধ্যমে ভাইসরয় এর কাছে পদত্যাগের অনুমতি চাইতে যাচ্ছি। আমি এই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুধুমাত্র মুসলিম লীগ এবং ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে বিভেদ এড়ানোর জন্য। আমার পদত্যাগের কারন স্যার সিকান্দারের পদত্যাগের কারণ হতে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী তিনি পদত্যাগ করেছেন কারণ তিনি মনে করেন সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার সময় কিছু তথ্য নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল তারপরও আমি পদত্যাগ করছি কারণ আমি পদত্যাগ না করলে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থের জন্য ভবিষ্যতে তা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। স্যার সিকান্দার মনে করেন তিনি ভুল ছিলেন এবং পদত্যাগের মাধ্যমে তিনি সেই ভুল সংশোধন করেছেন। আমি মনে করি আমি ঠিক ছিলাম কিন্তু তারপরও আমি পদত্যাগ করছি ভবিষ্যতে এর প্রভাব কি হতে পারে সেই কথা ভেবে। আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি সম্পূর্ণই আমার বিবেচনার বিপরীতে, শুধুমাত্র বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে। যা ভবিষ্যতে আমাদের মাঝে বড় কোন সংঘাত এড়াতে সাহায্য করবে এবং সবাইকে একত্র হয়ে মুসলিম সম্প্রদায় এবং দেশের স্বার্থে কাজ করার জন্য সুযোগ করে দেবে।
৭. “সংখ্যালঘু অঞ্চল” এর মুসলিম নেতৃবৃন্দের দ্বারা যেভাবে প্রতিনিয়ত বাঙলা এবং পাঞ্জাবের মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে চলেছে আমি তাঁর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। সংখ্যালঘু অঞ্চলের মুসলিম ভাইদের একটা ব্যাপার বোঝা উচিৎ, তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসা তো দূরের কথা, প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারও সম্ভব নয়। বাঙলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানেরা প্রশাসনে কর্তৃত্বপূর্ণ পদসমূহে থাকার কারণে যেসব সুবিধাসমূহ ভোগ করছে তা এই ভাইয়েরা কখনো উপলব্ধি করতে পারবেন না। এ সমস্ত অঞ্চলে একজন মুসলিম প্রশাসকের কি পরিমাণ দায়িত্ব সেটাও বোঝা সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। স্বভাবতই যখন সমগ্র ভারতের মুসলমানদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয় তখন সেই সিদ্ধান্তের প্রভাব বাঙলা ও পাঞ্জাবের মুসলমানদের রাজনীতির উপর কি হতে পারে সেই বিষয়ে তাদের কোন পরোয়া থাকে না। যেসব অঞ্চলে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব অঞ্চলের রাজনীতিতে তাদের বেশি হস্তক্ষেপ করা উচিৎ নয়। আমার ধারণা, বর্তমানে আমাদের প্রদেশের বাইরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আলোচনায় বাঙলার তেমন কোন গুরুত্ব নেই, যদিও সমগ্র ভারতের সর্বমোট মুসলিম জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই বাঙলায় বসবাস করে। আমার সমালোচকরা ঘটনার গভীরে না যেয়েই আমার নিন্দা করেন এবং আমাকে দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তারা কিন্তু ভুলে গেছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতিতে আমার সারা জীবনের অবদান। আমি দৃঢ়বিশ্বাসী, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আরও দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন এবং এমন কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন না যা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় নিজের বিবেকের কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া।
৮. আমি আরও জানাতে চাই, আমার পক্ষে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে আর থাকা সম্ভব নয়। সভাপতির আয়ত্বে থাকা অবাধ এবং বিধিবহির্ভূত ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমার এই পদত্যাগ। আমি এমন প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়ে থাকতে পারি না যারা প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দের প্রতি ন্যূনতম শিষ্টাচার প্রদর্শনে অক্ষম এবং অন্যায়ভাবে এমন সব পদক্ষেপ নিয়ে থাকে যা একজন প্রাদেশিক কর্মকর্তার নেয়ার কথা। উপরোক্ত বিষয়টির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সভাপতির উচিৎ ছিল তা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের হাতে ছেড়ে দেওয়া। তিনি দাপ্তরিক কার্যক্রম সাংবিধানিক এবং যৌক্তিক উপায়ে সম্পন্ন করতে দৃষ্টিকটু রকমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এই পদত্যাগের মাধ্যমে আমি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলতে চাই, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্বশাসনের মূলনীতি ধীরে ধীরে গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে, যার লক্ষ্যই হচ্ছে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে শাসন করা, এমনকি বাঙলার ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষকেও, যারা ভারতীয় মুসলমানদের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।