ময়মনসিংহের কুখ্যাত রাজাকার হান্নান এখন ঢাকার প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি
বাবুল হােসেন, ময়মনসিংহ থেকে ॥ একাত্তরে স্বামী হত্যার বিবরণ দেয়ার সময় এখনও শাড়ির আঁচলে চোখ মােছেন রায়হানা ওরফে রেণু (৪৫)। একমাত্র শিশু রাখিকে দেখতে এসে ধরা পড়েছিলেন রেণুর স্বামী মুক্তিযােদ্ধা আতা। রাখির নতুন জামাকাপড়ও পৌছাতে পারেননি আতা। রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে আসে ময়মনসিংহ শহরে। তারপর প্রথমে আতার দুটি হাত ও পরে দু’টি পা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় রাজাকাররা তাদের টর্চার সেলে। এরপর মুক্তিযােদ্ধা আতার চোখ উপড়ে ফেলা হয়। রাজাকাররা। পরে আতাকে গুলি করে হত্যার পর লাশ ফেলে দেয় ব্রহ্মপুত্রের চরে’। আতার পরিবার সে লাশের সন্ধান পায়নি। রাখির বয়স তখন মাত্র ৪০ দিন। এখন বিবাহিত। রায়হানা। টানা ১৫ বছর অপেক্ষা করেছেন আতা আসবেন বলে। একাত্তরের সেই নরঘাতকদের একজন এখন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত কোটিপতি শিল্পপতিদের একজন। তার নাম আবদুল হান্নান। ময়মনসিংহ সদরের বাসিন্দা ও ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এই কুখ্যাত রাজাকার এখন জাতীয় পার্টির নেতাও বটে। গত ‘৯৬-এর নির্বাচনে এই রাজাকার ময়মনসিংহের ত্রিশাল আসনে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি প্রার্থী হয়েছিল।
এবারও তার সেরকম খায়েশ রয়েছে। তবে দলবদল করে, বিএনপি থেকে। ময়মনসিংহের স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা সূত্রগুলাে জানিয়েছে, আবদুল হান্নান একাত্তরে সশস্ত্র রাজাকার ছিল। প্রকাশ্যে অস্ত্র কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত শহরময়। তার সহযােগী ছিল। এ্যাডভােকেট শামছউদ্দিন ওরফে সুরুজ উকিল, খাদেম-ই-মােমেনশাহী, আলবদর। মেহেদী খান, খােরশেদ তালুকদার, রজব আলী ফকির, তাহের, নজর আব্বাস। আবদুল হান্নানের নতুনবাজারের বাসাটি ছিল তখন রাজাকারদের আস্তানা ও টর্চার সেল । ময়মনসিংহের বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছিল হান্নানের ঘনিষ্ঠজন। পাকিদের নারী সরবরাহ করত এই শিক্ষিকা। একাত্তরে রাজাকারদের গঠন ও আলবদরদের মদদ দিত এই কুখ্যাত রাজাকার হান্নান। নবজাতককে দেখতে এসে সে সময়ই হান্নান ও তার সহযােগীদের হাতে ধরা পড়েছিলেন মুক্তিযােদ্ধা আতা। নরঘাতকরা আতাকে সদর উপজেলার মাইজবাড়ি গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে আসে। আতার স্ত্রী রায়হানা এখনও ঘাতকদের নাম উচ্চারণ করার আগে চারপাশে তাকিয়ে নেন একবার। বঙ্গবন্ধুর আমলে একবার এই শহীদ স্ত্রী ১৫০০ টাকা পেয়েছিলেন। এরপর আর কেউ পরিবারটির খোঁজ নেয়নি। স্বাধীনতার দীর্ঘ ২৯ বছর পর স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে এই প্রতিবেদকের সামনে হাউমাউ করে কেঁদেছেন রায়হানা। রায়হানা বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী ঘাতকদের বিচার দেখে যেতে পারলে মরেও শান্তি পাবেন। সে সময়কার তুখােড় ছাত্রনেতা ও ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযােদ্ধা হামিদও ময়মনসিংহ এসে এই রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। পরে এই ছাত্রনেতা কৌশলে স্থানীয় বড় মসজিদ থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। ময়মনসিংহের একাধিক মুক্তিযােদ্ধা সূত্র জানিয়েছে, একাত্তরে এই রাজাকার আবদুল হান্নান ও তার সহযােগীরা বহু মুক্তিযােদ্ধা ও বাঙালীকে। ধরে এনে নতুনবাজারের বাসায় টর্চারের পর তাদের হত্যা করেছে।
পরে এসব লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের চরে। অভিযােগ রয়েছে, এই রাজাকাররা একাত্তরে শহরের বহু বাসাবাড়ি লুট করে তাতে অগ্নিসংযােগ করেছে। অনেক যুবতীকে ধরে এনে তুলে দিয়েছে পাকি সেনাদের হাতে। দেশ স্বাধীন হলে গ্রেফতার হয় রাজাকার হান্নান। পরে সাধারণ ক্ষমায় বেরিয়ে এসে বেশ কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকে। অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলে ‘৭৫-এর পর এই রাজাকাররা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্ত হয় জাপার রাজনীতির সঙ্গে। ‘৯৬-এর নির্বাচনে ত্রিশাল আসনে জাতীয় পার্টির হয়ে এমপি প্রার্থী। হয়। কিন্তু জনপ্রতিনিধি হওয়ার খায়েশ পূরণ হয়নি হান্নানের। গণধিকৃত হয়েছে। এবারও চেষ্টা করছে বলে শােনা যাচ্ছে। তবে দলবদল করে। ‘৭১-এ যুদ্ধকালীন একবার নাকি টাঙ্গাইলের এক আসন থেকে এমপি হয়েছিল রাজাকার আবদুল হান্নান। একাত্তরের সেই রাজাকার এখন প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক। ঢাকায় গার্মেন্টস, ফ্লাউয়ার মিলসহ বহু শিল্পকারখানার মালিক। প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিদের একজন। এই যুদ্ধাপরাধীরও বিচারের দাবি উঠেছে ময়মনসিংহ মুক্তিযােদ্ধা ও স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির পক্ষ থেকে।
জনকণ্ঠ ॥ ৩১-১২-২০০০