You dont have javascript enabled! Please enable it! টাঙ্গাইলের জল্লাদ তালেব আনছারী যুদ্ধের শেষ দিকে মানুষ খুন করতে না পেরে স্বস্তিতে ঘুমাতে পারত না - সংগ্রামের নোটবুক

টাঙ্গাইলের জল্লাদ তালেব আনছারী যুদ্ধের শেষ দিকে মানুষ খুন করতে না পেরে স্বস্তিতে ঘুমাতে পারত না

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ খুন, ধর্ষণ আর লুটপাটের হােতা, কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার, এ্যাডভােকেট মােঃ আবু তালেব আনছারী ওরফে নান্ন আনছারী এখন টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম টাঙ্গাইল জেলা শাখারও সহসভাপতি এই আবু তালেব আনছারী। কালিহাতী থানার বল্লা গ্রামে রাজাকার তালেব আনছারীর বাড়ি। ‘৭১-এ তালেবের গােটা পরিবারই রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিয়েছিল। তালেব আনছারীর আপন বড় দুই ভাই রাজ্জাক আনছারী এবং কাশেম আনছারী কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার ছিল। তালেব আনছারীর বড় দুই ভাইও আজ সামাজিকভাবে।  প্রতিষ্ঠিত। ‘৭১-এর নরঘাতক তালেব আনছারী সবচেয়ে বেশি নির্দয়-নির্মম ছিল। গুলি করে হত্যা করার পরও তালেব মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ধারালাে ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে চোখ তুলত, বুকে পেটে ছুরি মারত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানুষ খুনের জল্লাদ হিসাবে তালেব আনছারীর পাকি আর্মিদের কাছেও বেশ সুনাম ছিল। খুনের জন্য পুরস্কারও পেয়েছে সে। যুদ্ধ শেষের দিকে রাজাকার জল্লাদ তালেব আনছারী মানুষ খুন করতে না পারলে স্বস্তিতে ঘুমাতে পারত না বলে জানা গেছে। পাকি আর্মিদের হাতে এ দেশের অসংখ্য মা-বােনকে ধরে এনে তুলে দিয়েছে তালেব। নিজেও বহু নারী নির্যাতন করে। হত্যা করেছে। টাঙ্গাইলের রাজাকারশীর্ষ ক্যাপ্টেন ডাক্তার আব্দুল বাছেতের বাড়ি কালিহাতীর সােমজানি আর তালেব আনছারীর বাড়ি কালিহাতীর বল্লায়। পাশাপাশি গ্রামের দুই কুখ্যাত রাজাকার। ক্যাপ্টেন বাছেতের নেতৃত্বে কালিহাতী থানার ঘােনাবাড়ি গ্রামে হিন্দু নিধন অভিযান চালানাে হয় । সময়টা ‘৭১-এর এপ্রিল মাস। রাজাকার বাছেত আর তালেব এখানে কসাইয়ের ভূমিকায় ছিল। মুরগি জবাই করার মতাে করে এখানে মানুষ জবাই করা হত।

এক দিনে ২৫ হিন্দুকে খুন করে। যে ২৫ জনকে সেদিন খুন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন-শহীদ নিরদ চন্দ্র সাহা, সুরেশ চন্দ্র সাহা, উত্তম কুমার সাহা, শিবনাথ পাল, রামনাথ পাল, মােহন চন্দ্র পাল, কানাই লাল পাল, হরিপদ সরকার, বিরেন্দ্র সাহা ও রাম মােহন দাস। এই হত্যাযজ্ঞের পর এখান থেকে টাকা-পয়সা, সােনা-রুপা লুট করে নিয়ে আসে রাজাকার বাছেত আর তালেব আনছারী । তদানীন্তন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের সহযােগী অধ্যাপক ডাক্তার উপেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িও লুট করা হয়। বাড়িতে স্থায়ীভাবে ক্যাপ্টেন বাছেতের চাচাতাে ভাই রাজাকার দুলাল মিয়াকে বসানাে হয়। এখন পর্যন্ত ঐ বাড়িটি দুলাল রাজাকারের দখলেই রয়েছে। ডাক্তার উপেন্দ্রনাথের ছেলে, প্রখ্যাত ডাক্তার একে সরকার তাঁর পিতার নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েও বাড়িটির দখল নিতে পারেননি। বিষয়টি বিস্তারিতভাবে টাঙ্গাইল পুলিশকে জানানাে হলেও পুলিশ কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। জানা গেছে, ডাক্তার একে সরকারকে ঘােনাবাড়ি গ্রামেই ঢুকতে দেয় না রাজাকার দুলাল। টেলিফোনে জনৈক ব্রিগেডিয়ার (অব) ফজলুল হক নামের এক ব্যক্তি জনকণ্ঠকে এসব তথ্য জানান। তিনি আরও জানান, সেই সময় রাজাকার বাছেত কত শত নারীকে যে ধর্ষণ করেছে তার কোন হিসাব নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বাছেতের ঐ চরিত্র বদলায়নি বলেই সে এ পর্যন্ত ৭/৮টি বিয়ে করেছে। এখনও তার ৪টি বউ রয়েছে। রাজাকার বাছেতের যােগ্য শিষ্য তালেব আনছারী খুন, ধর্ষণ আর লুটপাটে যেমন ওস্তাদ ছিল-যুদ্ধ ক্ষেত্রেও সে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পাথরঘাটায় কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে তালেব যুদ্ধ করে।

এ যুদ্ধের সময় কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরােত্তম রচিত ‘স্বাধীনতা ৭১’ গ্রন্থের ৫৮৫, ৫৮৬, ৫৮৭ এবং ৫৮৯ পৃষ্ঠায় রাজাকার আবু তালেব আনছারী ওরফে নান্ন। আনছারীর নাম উল্লেখ রয়েছে। কুখ্যাত এই রাজাকার তালেব আনছারী এতই বড় রাজাকার ছিল যে, তার নাম কাদের সিদ্দিকী চারবার লিখতে প্রয়ােজন মনে করেছেন। তালেবের বড় ভাই রাজ্জাক আনছারীর নাম রয়েছে ৫৮৪, ৫৮৬ এবং ৫৮৮ পৃষ্ঠায় আর কাশেম আনছারীর নাম রয়েছে ৫৮৭ পৃষ্ঠায় ।। সেদিনের তালেব আনছারীর অত্যাচার নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেছেন টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কমান্ডার ফজলুল হক বীর প্রতীক এবং ডেপুটি কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম। সেই ঘৃণিত রাজাকার বর্তমানে জেলা বিএনপির নেতা এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সহসভাপতি। ‘৭১ সালে নিজের হাতে সে যে বধ্যভূমি গড়ে তুলেছিল সেই বধ্যভূমির পাশেই জজকোর্ট আর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। এ দু’টি কোর্ট তার কর্মস্থল। এখানে দাঁড়িয়েই প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতে দ্বিধা করে না তালেব আনছারী। যদিও ওকালতিতে তালেব আনছারীর ততটা প্রসার ঘটেনি, তবে স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার হিসাবে তার প্রসার ঘটেছে ব্যাপক। কোর্ট এলাকায় তালেব আনছারীকে রাজাকার হিসাবেই ডাকা হয়।

তালেব আনছারীর নামের আগে-পরে ‘রাজাকার’ না ব্যবহার করলে পরিচয় প্রাপ্তি কষ্টসাধ্য। রাজাকার তালেব অথবা তালেব রাজাকার বললে অনেকেই চিনিয়ে দিতে পারে। এমন রাজাকার স্বাধীনতার পর বছরতিনেক গা-ঢাকা। দিয়ে ছিল। ‘৭৫-এর পরে রাজাকার তালেব বের হয়ে আসে লােকচক্ষুর সামনে। ধীরে। ধীরে বিএনপি দলের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। এক পর্যায়ে বিএনপির নেতা হয়ে যায় । পায় সামাজিক প্রতিষ্ঠা। রাজাকার তালেবের সবচেয়ে বেশি উত্থান ঘটে খালেদা জিয়ার শাসনামল থেকে। জেলা বিএনপির মুক্তিযােদ্ধা অংশ তালেব রাজাকারকে ঘৃণার চোখেই দেখে। তালেব বিএনপি নেতা এ নিয়ে এই অংশের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। খােদ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আরফান আলী মােল্লা তালেব আনছারীর নামের আগে। রাজাকার উপাধি ব্যবহার করলেন। আরফান আলী মােল্লাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তালেব আনছারী কি ধরনের রাজাকার ছিল? জবাবে তিনি জানান, ‘কুখ্যাত’। তিনি আরও বলেন- “আমি কেন, সবাই জানে আবু তালেব আনছারী ওরফে নান্ন আনছারী কুখ্যাত রাজাকার ছিল। স্বাধীনতাবিরােধী এই রাজাকার নিয়ে আমরা ঘৃণাবােধ করি।”

তালেব আনছারীর বক্তব্য

‘৭১ সালে এ্যাডভােকেট আবু তালেব আনছারী ওরফে নান্ন আনছারীর কী ভূমিকা ছিল জানতে চাইলে সে জানায়, “আমাকে পাকিস্তানী মিলিটারিরা তিনবার ধরে নিয়ে গেছে হিন্দুদের সহযােগিতা করার অপরাধে।” বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরােত্তম রচিত। ‘স্বাধীনতা ‘৭১’ গ্রন্থে তার নাম রাজাকার হিসাবে কয়েকবার লেখা হয়েছে কেন?- এ প্রশ্ন করা হলে সে জানায়, “আমরা পারিবারিকভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার বড় ভাই। ‘৭০ সালে (আব্দুর রাজ্জাক) প্রাদেশিক পরিষদের মই মার্কায় নির্বাচন করায় আমরা স্থানীয় ষড়যন্ত্রে পড়ি। এ ছাড়া বহু আগে থেকেই আমরা ছিলাম সফল ব্যবসায়ী এবং প্রভাবশালী। ফলে আমাদের শসংখ্যাও ছিল বেশি। এজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। আমাদের চক্রান্ত করে রাজাকার বানানাে হয়েছে। কাদের সিদ্দিকীর ঐ বইয়ের সব কথাই ঠিক নয়।” তা হলে প্রতিবাদ করা হয়নি কেন? এ প্রশ্ন করলে এ্যাডভােকেট তালেব বলে, “নানা কারণেই প্রতিবাদ করা হয়ে ওঠেনি। “আমি ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ১১ দফা, ‘৬৬ সালে ৬ দফা, ‘৬৯ সালে। গণআন্দোলনসহ দেশের প্রায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছি। ‘৬৯ সালে আমি মহকুমা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সহসভাপতি ছিলাম। আমি ১৯৭১ সালে ইনকাম ট্যাক্স উকিল হিসাবে ময়মনসিংহে যােগদান করি। পরে ‘৮২ সালে টাঙ্গাইল বারে এ্যাডভােকেট হিসাবে যােগদান করেছি। হেঁটে হেঁটে ফাতেমা জিন্নাহর হারিকেন মার্কার নির্বাচনও করেছি। ‘৭১ সালে আমি কোন দেশদ্রোহী কাজ করিনি।”

জনকণ্ঠ ॥ ০১-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন