নােয়াখালী
নােয়াখালীতে খুন ধর্ষণের নায়ক কমান্ডার কালাম এখন সাভারের কোটিপতি ‘মনছুর সাহেব
কামাল উদদীন আহমদ, নােয়াখালী থেকে ॥ ‘৭১-এর নয় মাসে নােয়াখালীতে খুন, ধর্ষণ, লুটসহ বহু কুকাণ্ডের নায়ক রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম বর্তমানে সাভারের মনছুর মার্কেটের মালিক, কোটিপতি ব্যবসায়ী মনছুর সাহেব’। নােয়াখালীর সদর উপজেলার ৭ নম্বর এওজবালিয়া ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামের পাকি সমর্থক আলতাফ মেম্বারের পুত্র আবুল কালাম দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার টঙ্গীতে আত্মগােপন করে জান বাঁচাতে সমর্থ হয়। ‘৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম সাভারে উপস্থিত হয়। প্রকাশ্য বাজারে ব্যবসা করার ফন্দি আঁটে। ‘৭১ সালের নয় মাসে নােয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে এওজবালিয়া, কালাদোরাপ, নােয়ান্নই, দাদপুর- এই চার ইউনিয়নে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকি বাহিনীর সহায়তায় লুণ্ঠিত সম্পদ, সােনাদানা মাটির নিচের লুকানাে স্থান থেকে বের করে গােপনে সাভারে এনে ব্যবসা শুরু করে। এই রাজাকার কমান্ডার কী করেছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাত্তরে? এখানে শুধু একদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন সেই এলাকার দুই মুক্তিযােদ্ধা (১) এওজবালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম করিমপুর গ্রামের মৃত ছায়েদুল হকের পুত্র মােঃ নুরনবী, (২) হুমায়ুন কবির, পিতা বাদলি মিয়া, গ্রাম রামহরির তালুক, ৮ নম্বর কালাদোরাপ ইউনিয়ন, নােয়াখালী সদর। এই দু’জন ‘৭১-এর ১৩ সেপ্টেম্বর ভােরবেলা নৃশংস নির্যাতনের শিকার ও প্রত্যক্ষদশী। এদের হত্যা করার জন্য এই কুখ্যাত রাজাকার এবং তার পাকি সঙ্গীরা গুলি চালায়। অলৌকিকভাবে ভাগ্যবান হুমায়ুন ও নুরনবী প্রাণে বেঁচে যান।
কিন্তু সেই ১৩ সেপ্টেম্বর রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম ও তার পাকি দোসররা হত্যা করে। এদের সঙ্গের নয় জনকে। এরা হলাে মমিন উল্যা, নূরউদ্দিন, সাহাব উদ্দিন, শফি উল্যা, হেনজু মিয়া, জহুরুল হক, আনা মিয়া, মজিবল হক ও রমজান আলী। এদিন রাজাকার। ও পাকি সেনা মিলিয়ে মােট প্রায় ৬০ জন গােটা এলাকা ঘিরে ফেলে। প্রথমে ঘের দেয় ৮ নম্বর কালাদোরাপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিন উল্যার বাড়ি। এখানেই এরা ধরে ফেলে চেয়ারম্যান আমিন উল্যার সহােদর মমিন উল্যাকে । এ দৃশ্য দেখে মমিন উল্যার স্ত্রী মমতাজ বেগম ও তাদের চার সন্তান মনজুর কাদের, জলিল কাদের, সাহেদা আক্তার, রেহানা আক্তার বুকভাঙ্গা আহাজারি করতে থাকে। কিন্তু শত আহাজারিতেও সেই অপারেশনের নায়ক কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আবুল কালামের মন গলেনি। সে। এদের ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। এর পর আটক করে চেয়ারম্যান আমিন উল্যার দুই পুত্র নুরউদ্দিন ও সাহাবউদ্দিনকে। সেই সময় সাহাবউদ্দিন ছিল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। এই দু’জনকেসহ মমিন উল্যা, শফি উল্যা, এনজু মিয়া, জহুরুল হক, আনা মিয়া, রমজান আলী- এই নয়জনকে রশিতে বেঁধে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটাতে পিটাতে নিয়ে আসে স্থানীয় রামহরির তালুক প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। এখানে তাদের নৃশংসভাবে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এই দৃশ্য সহ্য করতে হয়।
এলাকার চেয়ারম্যান আমিন উল্যাকে। চোখের সামনে তার দুই কিশাের পুত্র নূরউদ্দিন। ও সাহাবউদ্দিনকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার সাক্ষী দুই মুক্তিযােদ্ধা নুরনবী ও হুমায়ুন কবির ছাড়াও সেদিন শহীদ হওয়া মমিন উল্যার পুত্র মনজুর কাদের। বর্তমানে মনজুর কাদের ফেনীর মৎস্য সম্পদ কার্যালয়ে কর্মরত। জনকণ্ঠকে তিনি রাজাকার কমান্ডার আবুল কালামের সেই দিনের বহু নির্যাতনের ঘটনাসহ ৫০টি হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অনেক লুটপাটের বর্ণনা দেন। পিতা শহীদ মমিন উল্যার নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন মনজুর কাদের। শিশু মনজুর কাদের মক্তব থেকে ফেরার পথে গুলির শব্দ শুনে ধান ক্ষেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। আর এ অবস্থায় উকি মেরে প্রত্যক্ষ করে রাজাকার আবুল কালাম ও তার পাকি দোসরদের নির্মম হত্যাকাণ্ড। ‘৭১-এর সেই অগ্নিঝরা দিনে নােয়াখালীর কুখ্যাত আঞ্চলিক রাজাকার কমান্ডার পাকিদের সহায়তায় বহু লােককে হত্যা করেছে। নােয়াখালীর এই অঞ্চলে ঘুরলে আর আবুল কালাম নাম উচ্চারণ করলে এখনাে আঁতকে ওঠে এই অঞ্চলের জনগণ। সেই সময় আদমজীতে চাকরি করত এওজবালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম করিমপুরের নছির আহমদের পুত্র আলী আহমদ। তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে এই নরপিশাচরা। আলী। আহমদের এক ভাই মমিন উল্যা। মমিন উল্যা বর্তমানে চাকরি করছে আদমজীতে। সে চাকরি পেয়েছে তার ভাই আলী আহমদ ‘৭১ সালে শহীদ হওয়ার সুবাদে। সম্প্রতি সে। সাভারে দাওয়াত পেয়েছে। শুনেছে, নােয়াখালীর এক কোটিপতি ব্যবসায়ী নাকি সাভারে “মনছুর মার্কেট” করেছে। এই ব্যবসায়ীর নাম মনছুর সাহেব। সুযােগ পেলেই সে দেশের লােকজনের খোজখবর নেয়। এমনকি সাহায্যও করে। এ কথা জানার পর মমিন উল্যা তার এক সাথীকে নিয়ে আদমজী থেকে সাভারে আসে।
দেশের লােক আসছে খবর পেয়ে কোটিপতি ব্যবসায়ী বাসায় নির্দেশ পাঠায় অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে। এক পর্যায়ে দামী খাবার দিয়ে দামী টেবিল সাজানাে হয়। ক্ষুধার্ত মমিন উল্যা ও তার সঙ্গী দুপুরে খাবার খেতে টেবিলে বসে। প্লেট সামনে নিয়ে হাত ধুয়ে খাবার নেবে, তার সামনে সেই সময়ে ঘরে হাজির হয় ব্যবসায়ী মনছুর। মমিন উল্যা মনছুরের চেহারা দেখে নির্বাক হয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে, সেই দিনের তার সহােদর আলী আহমদ হত্যাকারী রাজাকার কমান্ডার আবুল কালাম। যদিও বর্তমানে আবুল কালাম রাজাকার কমান্ডারের নাম হয়েছে ‘মনছুর। কিন্তু ভাইহারা মমিন উল্যার চিনতে এতটুকু ভুল হয়নি। এই তাে সেই খুনী! মুহূর্তে মমিন উল্যার পেটের ক্ষুধা বিলীন হয়ে যায়। এমনি বহু ঘটনা এলাকার লােকজনের মুখে মুখে। এলাকার লােকদের প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা কি এ কুখ্যাত রাজাকারের খুন, নারী নির্যাতন ও লুটের ঘটনার সাক্ষ্য দিতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে অনেকে জোর গলায় বলেন, ‘এক শ’ বার পারি’। কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার, খুনী, লুটেরা ও অসংখ্য নারী নির্যাতনের নায়ক নরপিশাচ আবুল কালাম আজকের “মনছুর সাহেব” স্যুট পরে, গলায় দামী টাই পেঁচিয়ে হাতে মােবাইল নিয়ে দামী গাড়িতে চড়ে আসল পরিচয় গােপন করার জন্য কালাে সানগ্লাসে। চোখ ঢেকে এওজবালিয়া আসা-যাওয়া করে। পছন্দের স্মৃতি সংসদকে দামী টিভি। উপঢৌকন দেয়। পছন্দের ব্যক্তি ও ক্লাবে দেয় মােটা অঙ্কের অনুদান। এমনই কুখ্যাত খুনী সম্পর্কে খোঁজ নিতে এলাকায় গিয়ে মনছুরের বিপুল সম্পদ, সাভার এবং নােয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে ব্যয়বহুল দালানের তথ্যসহ এওজবালিয়া এবং কালাদোরাপ ইউনিয়ন, বিশেষ করে জমিদারহাটের চারদিকে ‘৭১-এর নির্যাতিত বীরাঙ্গনাদের আহাজারি শােনা গেছে। জানা গেছে, পাকি সেনাদের ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তানদের ইতিহাস। এলাকার লােকজন এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেছে, এই কুখ্যাত রাজাকারদের যেন বিচার করা হয়।
জনকণ্ঠ ॥ ০৯-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন