১৯৭১ সালের বাংলা আষাঢ় মাসের ২০/২৫ তারিখে ৫০/৬০ জন রাজাকার পুলিশ বিহারী ও পাক মিলিটারী মিলে আমার বাসায় যায় এবং বাসা ঘেরাও করে এবং আমাকে বাসা হতে ধরে ফেলে। বাসার বাইরে নিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তোমার চার নাতী মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে যদি তুমি এনে না দাও তাহলে আমরা তোমাকে গুলি করে হত্যা করব। তার প্রতি উত্তরে আমি জবাব দেই তারা কোথায় গিয়েছে তা আমি বলতে পারবো না, আর আপনারা যদি তাদেরকে কোথাও খুঁজে পান তা হলে তাদেরকে আপনারা গুলি করে মেরে ফেলবেন আমার কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু আমার নাতিরা কোথায় গিয়েছে তার জন্য তো আমি দায়ী হতে পারি না। কারন তারা এখন বড় হয়েছে নিজ নিজ স্বাধীনতা নিয়ে তারা যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। আমি এখন বৃদ্ধ হয়েছি আর কি তাদের খোঁজখবর আমার পক্ষে রাখা সম্ভব। তারপর পাক হানাদার বাহিনীরা আমাকে চোখ বেঁধে পাঁচবিবি রেল লাইনের উপর নিয়ে আসে। এনেই স্থানীয় বিহারীদের নেতারা আলাপ-আলোচনা করার পর চোখ বাঁধা অবস্থায় আমাকে রেল লাইনের উপর ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আমি বাড়ী চলে যাই।
ঐ ঘটনা ঘটার ৭/৮ দিন পর আয়ুবের নির্দেশে ২০/২৫ জন রাজাকার বিহারী ও পাক সেনা মিলে আবার আমার গ্রামের বাসায় গিয়ে ঘেরাও করে আমাকে ধরে পাঁচবিবি নিয়ে আসে। এসেই সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, আমি আমার জবাবে একই কথা বলি। তারপর সেদিনও পাক হানাদার বাহিনী কুখ্যাত বিহারী নেতার সাথে আলাপ আলোচনা করে আমার চোখ বেঁধে সি,ও, অফিসের নিকট নিয়ে ছেড়ে দেয়। আমি বাড়ী চলে যাই। তারপর আমি আমার পরিবার পরিজনের সবাইকে নিয়ে ভারতে চলে যাই। সেখানে আমার পরিবারের সকলকে রেখে ৮/১০ দিন পর আমি বাংলাদেশে চলে আসি। এর মধ্যে দালাল বিহারী নেতা আমার গদিঘর দখল করে নিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে সেখানে বসবাস করছিল।
আষাঢ় মাসের শেষের দিকে পাক হানাদার বাহিনী পাঁচবিবি হতে কান্দি যাবার পথে কান্দিয়া ব্রীজে ৪/৫ টা চীনা মাইন ব্রীজ হতে উদ্ধার করে। এবং মাইন কারা পুঁতে রাখে তাদের খোঁজ করতে থাকে। কুখ্যাত আয়ুব পাক হানাদার বাহিনীকে জানিয়ে দেয় যে, উক্ত মাইন পাতার মূলে রয়েছে ছমির উদ্দিন মণ্ডল ও মামুদ মন্ডল।
শ্রাবন মাসের তিন তারিখে ৪০/৫০ জন পাক সেনা রাজাকার ও বিহারী মিলে আমাদের বাসায় যায় এবং বাসা ঘেরাও করে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই ছমির উদ্দিন মণ্ডলকে ধরে দুই ভাই- এর হাত একত্র করে বেধেঁ কোমরে দড়ি দিয়ে বেধেঁ পাঁচবিবি থানায় নিয়ে যায় এবং বলে ব্রীজে তোমরা মাইন পুঁতেছিলে, তোমরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। তোমার চার নাতি মুক্তিযোদ্ধা তাদেরকে এনে দাও। নতুবা তোমাদের দুই ভাই কে গুলি করে হত্যা করবো। তারপর আমরা দুই ভাই মেজরকে বলি আমরা মাইন কেমন দেখা যায় চিনি না এবং মাইন পাতা সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারবো না। আর আমার নাতীদের খোঁজখবর আমরা কিছুই বলতে পারবো না। তারপর আমাদের দুই ভাইকে মেজর পাঁচবিবি থানায় চালান দিয়ে যায়। পাঁচবিবি থানায় সেই সময় পাঞ্জাবী পুলিশেরা থাকতো এবং বিহারীরা থাকতো। আমাদের দুই ভাইকে থানার হাজতে রাখে। আমরা হাজতের মধ্যে ঢুকে দেখতে পাই মুজাফফর ন্যাপের একজন কর্মী নাম বছির মিয়া (বাড়ী আটুয়া পাঁচবিবি থানা) আধা মৃত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। তাকে একজন পাঞ্জাবী পুলিশ এমন প্রহার করেছে যে, প্রহারের দরুণ তার সমস্ত শরীর হতে রক্তপাত হচ্ছে। আমি জেলে ঢুকেই তাকে দেখে বললাম বছির মিয়া তুমি এখানে। বছির আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। আমি তাকে সান্ত্বনা বাণী শুনিয়ে বলি আল্লাহ আল্লাহ করো।
আল্লাহ ছাড়া আর কোন গতি নাই। তারপর আমরা দুই ভাই জেলের মধ্যে থেকে যাই। সেই দিন রাত ৮ টার পর একটা পাক হানাদার বাহিনীর গাড়ি গিয়ে থানায় উপস্থিত হয় এবং একজন পাঞ্জাবী জেলের দরজায় গিয়ে বছিরকে ডাক দেয়। বছির নড়তে-চড়তে পারে না, দুই তিনজন বিহারী ও একজন পুলিশ বছিরকে হাজত হতে বের করে গাড়ীতে তুলে দেয়, গাড়ী চলে যায়। তার আধ ঘন্টা পরেই আমরা সি, ও, অফিসের সম্মুখে একটা ফায়ারের শব্দ শুনতে পাই। আমরা মনে করলাম বছির হয়তো বাংলাদেশের মাটিতে হানাদার বাহিনীর গুলিতে মিশে গেল। আমরা দুই ভাই আল্লাহর নাম স্মরণ করতে থাকি। এবং মনে মনে বলতে থাকি এরপর মনে হয় আমাদের পালা। কোন মতে রাত্রি কেটে যায়।
তার ৫/৭ দিন পর মেজর আবার আমদের সাথে জেলে দেখা করে এবং বলে শালা বাঙ্গালীকা জাত, বড় হারামীহায়। শালা মাইন পোঁতে হাম লোককে মারতে চায়। এবং আমাকে আরও বলে তোম লোককা দুনিয়াছে নেকাল করদেগা, আজ রাতমে তোম বিদায় নিয়ে গা। তারপর জয়পুরহাট চলে যায়।
এর মধ্যে আমি জেলের একজন বাঙ্গালী পুলিশের মারফত শুনতে পাই যে, আমাদের দুই ভাই- এর জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে সি, ও, অফিসের পার্শ্বে। এটা শোনার সাথে সাথে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে থাকি। কিন্তু আয়ুব বিহারীর নির্দেশে জেলের মধ্যে আমার উপর কোন শারিরীক ও মানসিক অত্যাচার করা হয় না।
মেজর চলে যাওয়ার ৮/১০ দিন পর একজন বেলুচ মেজর পাঁচবিবি আসে। এসেই জেলে গিয়ে আমাদেরকে দেখতে পায়। তারপর কাগজপত্র দেখে ও,সি, কে নির্দেশ দেয় যে, এখনই আমাদেরকে বগুড়া সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুই ভাইকে গাড়ীতে করে বগুড়া সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। আমরা জেলে ঢুকে দেখতে পাই জেলের মধ্যে ৮০/৯০ জন বাঙ্গালী পড়ে আছে। তাদের কারোর শরীরের শত শত লাঠির আঘাতের চিহ্ন। আবার কারুর শরীরে শত শত বেয়োনেটের খোঁচার চিহ্ন। কারোর শরীর হতে অঝোরে রক্ত ঝরছে। দ্রুত সব দৃশ্যাবলী দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জেলের দারোয়ান আমাকে বলতে থাকে বুড্ডা তুম আর নেহি বাচেগা। তারপর আমরা জেলে ঢুকার মধ্যে ঢোকার আধ ঘন্টা পর একজন পাঞ্জাবী লাঠি হাতে করে জেলের মধ্যে ঢোকে। সকলেই তাকে দেখে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে সড়ো চুপচাপ হয়ে বসে। তারপর পাঞ্জাবীটা ঘরের মধ্যে ঢুকেই কোন কথা না বলে এক এক করে সবার পিঠে একটা করে লাঠির আঘাত করে। তারপর আমার নিকট গিয়ে থমকে দাঁড়ায় এবং আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বুড্ডু তুম কাহাছে আয়া। আমি জবাব দিই আমি পাঁচবিবি হতে এসেছি। আমার কোন দোষ নেই আমাকে বিহারীরা ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর মিনিট পাঁচেক চুপ করে থাকে এবং আমাকে বলে বুড্ডা তোমার কোন ভয় নেহি। তারপর আমার ভাই এর নিকট গেলে আমি বলি আমার ছোট ভাই। তারপর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে জেল হতে বেরিয়ে চলে যায়। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলে ৪/৫ জন লোককে জেল হতে বের করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। তাদেরকে আর জেলে ফিরে নিয়ে আসে না। এইভাবে প্রতি দিন ৪/৫ জন করে জেল হতে বের করে নিয়ে হত্যা করতো। কয়েকদিন পর বগুড়া শহরে আমার আত্নীয়ের তদ্বীরের দরুন মুক্তি পাই।
স্বাক্ষর/-
ফকির মামুদ মন্ডল
গ্রাম-দানেজপুর
ডাকঘর- পাঁচবিবি
থানা- পাঁচবিবি
জেলা- বগুড়া
৭/১১/৭৩