You dont have javascript enabled! Please enable it! কুষ্টিয়ার খােকসায় আব্দুল হাই বাহিনীর দাপটে এলাকাবাসী ছিল তটস্থ - সংগ্রামের নোটবুক

কুষ্টিয়ার খােকসায় আব্দুল হাই বাহিনীর দাপটে এলাকাবাসী ছিল তটস্থ

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ একাত্তরে দেড় শতাধিক রাজাকারসহ মুজিব বাহিনীর। কাছে আত্মসমর্পণকারী কুষ্টিয়ার খােকসা ইউনিয়ন এলাকার রাজাকার কমান্ডার আব্দুল হাই (৬০) এখন ধর্মীয় শিক্ষক। খােকসার বনগ্রাম হাইস্কুলের হেড মওলানা সে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী। ‘৭১-এ তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পাকি সেনাদের দোসর এই রাজাকার বাহিনীর দাপটে এলাকাবাসী ছিল তটস্থ। তারা পুরাে খােকসা ইউনিয়ন এলাকায় কায়েম করেছিল এক ত্রাসের রাজত্ব। এ সময় স্বাধীনতাকামী ও নিরীহ মানুষের ওপর চালানাে হয় অত্যাচার-নির্যাতন। লুটপাটও চালিয়েছে তারা দেদার। আতঙ্কিত সে সব দিনের কথা স্মরণ করে এলাকাবাসী আজও শিউরে ওঠে আর ধিক্কার জানায় সেই রাজাকারদের প্রতি। এলাকায় সরেজমিন খােজখবর নিয়ে জানা গেছে, একাত্তরে টাইটেল পাস খােকসা উপজেলার মুকশিদপুরের আব্দুল হাই গ্রামে এসেই রাজাকারের খাতায় নাম লেখায়। এ সময় বিভিন্ন অপারেশনে তার অংশগ্রহণ এবং সফলতায় স্বাধীনতাবিরােধী শিবিরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার নাম-ডাক। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই সে এলাকায় রাজাকারদের কমান্ডার বনে যায়। প্রথমদিকে তার কমান্ডে ২০/২৫ জনের একদল সশস্ত্র রাজাকার থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এসে তার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দু’শ’। কমান্ডার আব্দুল হাইয়ের কাছে ছিল একটি থ্রী-নট-থ্রী রাইফেল। যেটি নিয়ে সে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিত। তারা খােকসা থানার (পুলিশ স্টেশন) পার্শ্ববর্তী জানিপুর হাইস্কুলে প্রতিষ্ঠা করে রাজাকার ক্যাম্প।

এ ক্যাম্প থেকেই পরিচালিত হতাে স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান। এ সময় রাজাকাররা পুরাে খােকসা ইউনিয়ন এলাকায় কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। তারা এলাকায় লুটপাটসহ বিভিন্ন অপকর্মে মেতে ওঠে। স্বাধীনতাবিরােধীদের এই অপতৎপরতায় গ্রামবাসীরা থাকত তটস্থ। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্তে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল হাই এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার দলবলসহ (১৬০ জন) খােকসা থানা এলাকার মুজিব বাহিনীর লিডার সাইদুর রহমান মন্টুর কাছে। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে আব্দুল হাই খােকসার প্রত্যন্ত এলাকা বনগ্রাম হাই স্কুলের হেড মওলানা । আত্মস্বীকৃত এই রাজাকার কমান্ডার ছােটবেলা থেকেই ছিল। দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। তাই রাজাকারের খাতায় নাম লেখানোর পরপাকি হানাদারদের নজরালে কাড়তে তাকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে সে খােকসা ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার বনে যায়। তার নির্দেশে খােকসা ও আশপাশের এলাকায় নিরীহ জনগণের ওপর চালানাে হয় জুলুম-নির্যাতন। জ্বালিয়ে দেয়া হয় বহু ঘরবাড়ি। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে লুটপাট। খােকসার পার্শ্ববর্তী পাংশার লক্ষ্মীপুর গ্রামের কুমুদ রঞ্জন বিশ্বাসের বাড়ির মালামাল লুটে নেয় ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় রাজাকাররা। জানিপুর ইউপির ঈশ্বরদী গ্রামটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। অভিযােগ রয়েছে, একাত্তরে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল হাই বনগ্রাম, মুকশিদপুর, ভবানীপুর প্রভৃতি গ্রামের হিন্দুদের ওপর চালায় নির্যাতন এবং তাদের মালামাল লুটে নেয়। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের আগে তার আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকলেও স্বাধীনতার পর পরই সে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়। এ ছাড়া রাজাকাররা বনগ্রামের মুক্তিযােদ্ধা মঈনউদ্দিন বিশ্বাসের বসতভিটাটিও জ্বালিয়ে দেয়। এ দিকে দেশ স্বাধীনের পর পরই রাজাকার কমান্ডার আব্দুল হাই হয়ে পড়ে বনগ্রাম হাই স্কুলের একজন ধর্মীয় শিক্ষক।

|আব্দুল হাইয়ের বক্তব্য। ৫ এপ্রিল খােকসা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার বনগ্রাম হাইস্কুলে কথা হয় একাত্তরের রাজাকার কমান্ডার ও বর্তমানে ওই স্কুলের হেড মওলানা আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে। এ সময় সে নিজেকে রাজাকার বলে স্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলে, ওই সময় পরিস্থিতির চাপে পড়ে তাকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখাতে হয়েছিল। তবে সে স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল না। এলাকার মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও লুটপাটের সঙ্গেও তার কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এ ছাড়া যুদ্ধকালে পরােক্ষভাবে সে মুক্তিযােদ্ধাদেরই সহযােগিতা করেছে বলে দাবি করে। রাজাকার হাই আরও বলে, তার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মঈনউদ্দিন বিশ্বাস ও প্রধান শিক্ষক রওশন আলী দু’জনই বীর মুক্তিযােদ্ধা। তাই পাপীনতাবিরােধী কোন কার্যকলাপ চালালে তাকে এই স্কুলে রাখা হতাে না। ১৯৭২ সালের প্রথম থেকেই সুনামের সাথে সে বনগ্রাম হাইস্কুলে ধর্মীয় শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসছে বলে দাবি করে। রাজাকার আব্দুল হাই একাত্তরে জানিপুর ক্যাম্পে মুজিব বাহিনীর প্রধান সাইদুর রহমান মন্টুর কাছে ১৬০ জন রাজাকার নিয়ে আত্মসমর্পণ করার কথাও স্বীকার করে।

জনকণ্ঠ : ২০-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন