বঙ্গ রঙ্গভূমির দর্শক
বৃহৎ শক্তিগুলাের আচরণ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে নিষ্ঠুর পরিহাস। প্রায় খালি হাতে ইয়াহিয়ার হিংস্র জানােয়ারদের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করছেন। দূর থেকে সবাই তাদের বাহবা দিচ্ছেন। এসব মহামান্যের অবস্থা কতকটা প্রাচীন রােমের অভিজাত সম্প্রদায়ের মত। সেকালে রঙ্গভূমির গ্যালারীতে বসে থাকতেন কেউকেটার দল। নীচে মল্লরা লড়াই করতেন বাঘ-সিংহের সঙ্গে। অপূর্ব শিহরণ জাগত দর্শকদের মনে। ভাগ্যবান মল্ল যদি প্রতিদ্বন্দ্বী জানােয়ারকে মেরে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারতেন তবে অবশ্যই মিলত সামান্য উপঢৌকর। মরলে আপশােষ থাকত না কারও। প্রাচীন রােমের মল্লরা ছিল ক্রীতদাস। ওদের জানের দাম দিত না কেউ। বাংলাদেশটা এখন বিরাট রঙ্গভূমি। ইয়াহিয়ার জানােয়ার এবং মুক্তিযােদ্ধারা জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত। দেড় মাস ধরে লড়াই দেখছে বৃহৎ শক্তিগুলাে। কেউ এগিয়ে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে দিচ্ছে না অস্ত্রশস্ত্র। এ লড়াইটা নাকি পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। তাতে নাক গলানাে নাকি আন্তর্জাতিক শাস্ত্র বিরুদ্ধ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ে আসবে মুক্তিযােদ্ধাদের করমর্দনের জন্য। শুরু হবে দলে টানার প্রতিযােগিতা। গণতন্ত্রের জয়লাভে তারা করবে উদ্দাম নৃত্য। যদি মুক্তিযােদ্ধারা হাবে তবে তাদের জন্য চোখের জল ফেলবে না কেউ। ইয়াহিয়াকে ঘিরে বৃহৎ শক্তিগুলাের চলবে সখিনাচ। ক্ষুদ্র শক্তি ইরান তুরস্ক এবং সৌদী আরব। ওরা প্রকাশ্যেই নিয়েছে ইয়াহিয়ার পক্ষ। ইরান তাকে দিচ্ছে বিমান এবং সৌদী আরব জোগাচ্ছে টাকা। আর একটি বৃহৎ শক্তি চীন। সে ঢাকঢােল পিটিয়ে অস্ত্র পাঠাচ্ছে পাকিস্তান। এগুলাে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশের গণহত্যায়। পিকিং-এর নেতারা কার্যতঃ এখন ইয়াহিয়া খানের বডিগার্ড। আন্তর্জাতিক আইনের চটকদার ভাষ্যকার উজার করছেন স্বৈরাচারী ইসলামাবাদ। ওরা তার নিন্দা করবে না। এ মারামারিটা নাকি পাকিস্তানের দাম্পত্য কলহ-নিছক ঘরােয়া অশান্তি। দাম্পত্য কলহে পত্নী খুন হলে পুলিশ আসে। এখানে গণহত্যা থামাতে কেউ আসছে না। এমনি তাদের বিবেক। ইয়াহিয়ার সমর্থনে চীন যা করছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রীদের সমর্থনে তা করতে পারছে না অন্যান্য বৃহৎ শক্তি। এরা সবাই পারমানবিক বােমার অধিকারী এবং দুনিয়ার শান্তিরক্ষার দাবীদার। পাক-ভারত সম্পর্কের ক্রমাবনতিতে ওদের চোখে ঘুম নেই। আসল সমস্যা এড়াবার চমৎকার কূটকৌশল। মানবতাবােধ বৃহৎ শক্তিগুলাের নেই—এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেবা মিশন ঘুরছেন। শরণার্থীদের শিবিরে। বৃটেন আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়া আর্তত্রাণে উৎসুক। কিন্তু ভারত সীমান্তে আসার পথ তারা খুঁজে পাচ্ছে না। যেদিন পাবে সেদিন কোন কিছুর অভাব থাকবে না। খাদ্য, ওষুধ, ব্যান্ডেজ—সব পৌছে যাবে। ওপারে ইয়াহিয়ার ঘাতকরা নিরস্ত্র মানুষগুলােকে ভােলাই দেবে। কোনমতে জান নিয়ে এপানে এলেই ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধবে মানবসেবীরা। ওপারে গিয়ে ঘাতকদের অস্ত্র কেউ কেড়ে নেবে না। যারা তার চেষ্টা করছেন তাদের হাতও কেউ জোরদার করবে না। দিনের পর দিন চলবে নিষ্ঠুর তামাসা। এই হতভাগ্য মানুষগুলাে কিভাবে আবার স্বদেশে ফিরবেন—এপ্রশ্নের জবাব কারও কাছেই মিলবে না। বছর খানেকের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে মানবতার উৎস। শরণার্থীরা হবেন সবার গলার কাঁটা। ওদের অবস্থাটা হবে আধুনিক যুগের ত্ৰিশংকু। আপনভূমি বলতে তাদের কিছু থাকবে না। ওরা মরবে এবং সহমরণে যাবে ভারত। বৃহৎ শক্তিগুলাে তখন অন্য কোন বৃহত্তম সমস্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া গড়বেন বাংলাদেশ জয়ের কীর্তিস্তম্ভ। টাকাটা অবশ্যই জোগাবেন বৃহৎ শক্তিগুলাে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ মে ১৯৭১