বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্ম
ডিমাপুরের সেই ইতিহাস
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবাহিনী। ‘৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতীয় রাজ্য নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে ক্ষুদ্র আকারে জন্ম নিয়েছিল এ বাহিনী। একটা অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার, একটি ডিসি-৩ ও একটি অটার বিমান এবং মাত্র নয়জন অফিসার ও ৪৭ জন বিমানসেনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল আজকের গৌরবময় বিমানবাহিনী। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজয়ের পর আত্মসমর্পণের আগ মুহূর্তে পাকিস্তানিরা সব যন্ত্রপাতি ও উড়ােজাহাজ অকেজো করে দিয়েছিল। ফলে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী শুরু করেছিল একেবারে শূন্য থেকে। কর্নেল ওসমানী ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার (যথাক্রমে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও পরে জেনারেল এবং মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান ও পরে এয়ার ভাইস মার্শাল) ভারতীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিমানবাহিনী গঠন নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা করেন এবং ১৯৭১-এর ১৪ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক সে আলােচনা সমাপ্ত হয়। প্রস্তাবিত সশস্ত্র বিমানবাহিনী গঠনে ভারত তিনটি কমব্যাট বিমান জোগাতে রাজি হলাে। এ বিমানগুলাে ছিল : একটি ডিসি-৩, একটি অটার এবং একটি অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার। এ ধরনের বিমান নির্বাচনের পক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল যে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে অনুরূপ বা একই ধরনের বিমান ব্যবহার করছিল। ফলে এ ধরনের কোনাে বিমানকে পাকিস্তানিরা গুলি করে ভূপাতিত করলেও তার মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন জাগতাে। শুরুটা ছিল অত্যন্ত রােমাঞ্চকর। নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গভীর জঙ্গলে পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত একটি পরিত্যক্ত বিমান উড্ডয়ন ক্ষেত্র বিমানবাহিনী গড়ার জন্মভূমি নির্বাচিত হলাে। কারণ এই ডিমাপুরে প্রায় পাঁচ হাজার ফুট লম্বা রানওয়ে ও একটি ছােট কাঠের তৈরি এটিসি ভবন ছিল। বিমান ঘাঁটি থেকে বেশ কিছু দূরে ছিল ডিমাপুর শহর। কিছু পাহাড়ি আদিবাসী ছাড়া পরিত্যক্ত বিমান ঘাঁটির ধারেকাছে তেমন কেউ বাস করতাে না।
তাই স্বাধীনতা যােদ্ধাদের জন্য গােপনীয়। সশস্ত্র বিমান কেন্দ্র গড়ে তােলার ক্ষেত্রে এ স্থানটি ছিল সবদিক থেকে উত্তম। সশস্ত্র বিমানবাহিনী গঠনে গােপনীয়তা রক্ষার্থে গুপ্ত নাম ব্যবহৃত হলাে ‘ কিলাে ফ্লাইট’। ‘কিলাে ফ্লাইট’ অতি গােপনীয় পরিচালনা হিসেবে পরিগণিত হলাে এবং এর অস্তিত্ব বিডিএফ (বাংলাদেশ ফোর্সেস) ও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছাড়া আর কেউ জানতেন না। কিলাে ফ্লাইটের জন্য প্রয়ােজনীয়সংখ্যক বিমানসেনা সংগ্রহের লক্ষ্যে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ বিডিএফ সদর দপ্তর থেকে কিছু প্রতিনিধি বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানাে হয়। তারা যশাের ও আগরতলার কাছের সেক্টরসমূহ থেকে যতদূর সম্ভব বিমানসেনা সংগ্রহ করতেন। চূড়ান্তভাবে ৫৮ জন বিমানসেনাকে ডিমাপুরে নেওয়া হয়। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ চট্টগ্রামে মদুনাঘাট বিদ্যুৎ সাব স্টেশন আক্রমণের সময় তখন বুলেটে আহত অবস্থায় ১ নং সেক্টরে ছিলেন। তিনিই ‘কিলাে ফ্লাইট’-এর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হন এবং সে অনুযায়ী নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য তিনি ডিমাপুরে যান।
সুলতান মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর ডিমাপুরে ছােট বিমানবন্দরের এটিসি কুঁড়েটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। উৎসাহী বিমানসেনারা ভবনের নিচতলায় ও কাছাকাছি খাটানাে তাঁবুতে অস্থায়ী ছাউনি নির্মাণ করেন। পরে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম পাঁচজন বেসামরিক পাইলট নিয়ে এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ যােগ দেন। উৎসাহী সদস্যরা মাত্র তিনটি বিমানের (একটি ডিসি-৩, একটা অটার ও একটা অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার) সমন্বয়ে গঠিত তাদের স্বপ্নের বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরুর দিন ধার্য করলেন ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। বিমানগুলােকে বিমানবাহিনীর প্রতীক ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সজ্জিত করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার, ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পিসি লাল ডিমাপুরে উপস্থিত হন। অনাড়ম্বর একটা গার্ড অব অনারের আয়ােজন করা হয় এবং উপস্থিত অতিথিদের সংক্ষিপ্ত ভাষণের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। ইতিমধ্যে ফ্লাইট টেস্টের সময় দেখা গেলাে যে বােমা নিক্ষেপ করে সরে আসার সময় ডিসি-৩-এর নিঃসৃত আগুন শত্রুদের টার্গেট হিসেবে সুষ্ঠুভাবে প্রস্ফুটিত করবে। তাই ঐ জাহাজটি কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তবে পরবর্তী সময়ে বিমানটি বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রে অধিনায়কদের বহন করার জন্য ব্যবহৃত হতাে। অটার এবং অ্যালুয়েট নৈশ চলাচল ও টার্গেট অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকলাে। পাইলটদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় ‘৭১-এর অক্টোবর থেকে। তিনটি প্রাপ্ত বিমানে যথাযথ অপারেশন প্রশিক্ষণের জন্য পাইলটদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম এবং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন আকরাম অটার বিমানে এবং ক্যাপ্টেন খালেক, মুকিত ও সাত্তার ডিসি-৩ বিমানে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন।
যদ্ধে ব্যবহারের অন্য তিনটি বিমানকেই পরিবর্তন করে জঙ্গি বােমারু হিসেবে রূপায়ণ করা হয়। ডিসি-৩ বিমানের লেজের অংশটি তিনটি বম্ব র্যাকের স্থান সংকুলানার্থে কেটে বাদ দেওয়া হয়। অটার-এ প্রতিটিতে সাতখানা রকেটের সংকুলান সম্ভব, এমন দুটি রকেট পড, কার্গোদ্বারের কাছে ঘূর্ণায়মান হাতলসহ একটি ৩০৩ ব্রাউনি মেশিনগান এবং লেজের অংশে তিনটি ব্যাক স্থাপন করা হয়। অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারে প্রতিটিতে সাতখানা রকেটের সংকুলান সব এমন দুটি রকেট পড়, একটি ঘূর্ণায়মান ৩০৩ ব্রাউনি মেশিনগান স্থাপন করা হয় ও ২৫ পাউন্ডের বােমা হাত দিয়ে ছােড়ার জন্য ভেতরে রাখার র্যাক বানানাে হয়। কোনাে জাহাজেরই ক্যামেরা বা সাইট ছিল না। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পাইলটের সামনের আয়নায় একটা রেডক্রস আঁকা হলাে এবং তাই দিয়ে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারিত হতাে। প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে গাছের উচ্চতায় ফ্লাইং করে তেলের ডিপােগুলাের ওপর আক্রমণ করা হবে। এ জন্য প্রয়ােজন ছিল উচ্চমানের ফ্লাইং ও ফায়ারিং প্রশিক্ষণ। রাতের ঘন অন্ধকারে বিভিন্ন অজানা ধরনের টার্গেটকে অনুমান করে, বিভিন্ন পথ দিয়ে টার্গেট এলাকায় পৌছানাে ও (যদি ভাগ্যবান হয়) মাত্র দুটি আক্রমণ করার পর দ্রুত প্রস্থান। এরপর প্রশিক্ষণ শুরু হলাে তেলের ডিপােকে সিমুলেট করার।
এবং ধীরে চলা জাহাজ নিয়ে শত্রুর বিমানবিধ্বংসী কামান ও মেশিনগান ফায়ারিং এড়িয়ে চলা। টার্গেট হিসেবে ঘন জঙ্গল কেটে টিলার মাথায় সাদা একটি প্যারাসুট বিছানাে হয়েছিল। শুরুতে ২৫ মাইল দূরে অরণ্যের মাঝে ছােট্ট টিলায় প্যারাসুট খুঁজে পাওয়াটাই ছিল দুরূহ। আর হালকা হাওয়াতেই হেলিকপ্টার আর অটারটি যেন নেচে উঠতাে। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান যেন সার্কাস। ট্রনারের মতাে সারা দিনরাত লেগে থাকতেন। সারা রাত ফ্লাইংয়ের পর ফজরের নামাজ পড়েই আবার শুরু হতাে ভােরের শরীরচর্চা। তারপর রানওয়ের এক মাথা থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তিন মাইল দৌড়। একই এক্সারসাইজে যােগ দিতেন স্বয়ং কন্টিনজেন্ট অধিনায়ক – যদিও যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন তিনি (‘কিলাে ফ্লাইট’-এ একটা লাঠিতে ভর করে চলতেন)। প্রশিক্ষণে বিশেষ জোর দেওয়া হয় গাছের শীর্ষ বরাবর নৈশ অপারেশনের ওপর। সাধারণত ফ্লাইং শুরু হতাে রাত ১২টার পর। তাই রাতে ডিমাপুরে পাহাড়গুলাে রকেট ও বন্দুকের গােলায় প্রতিধ্বনিত হতাে। টার্গেট নিরীক্ষার মাঝে প্রমাণিত হলাে, ডিসি-৩ বিমানের আক্রমণে। গােপনীয়তা ও আকস্মিকতা রক্ষা করা সব হচ্ছে না। তাই সেটাকে কলকাতায় পরিবহনের কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। পাকিস্তান বাহিনীকে আক্রমণের জন্য প্রথমে দিন ঠিক হয়েছিল নভেম্বর মাসে। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ডিমাপুর থেকে কৈলা শহর পর্যন্ত যাওয়ার পর অজানা কারণে তাদের ফেরত যেতে হয় আবার ডিমাপুর। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যখন কলকাতায় ঘােষণা করলেন, ভারতের ওপর পাকিস্তানিদের আক্রমণের জবাব দেওয়া ছাড়া উপায় নেই, তখন আবার ২৯ নভেম্বর কৈলা শহর এয়ারফিন্ডে যেতে হয়।
একাত্তরের যুদ্ধ এবং বিমানবাহিনীর প্রাথমিক দিনগুলাে ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর বা বিমানবাহিনীর পাইলটরা যখন বাংলাদেশে অবস্থানরত শত্রুদের অবস্থানসমূহে আঘাতের জন্য ভারতীয় বিমান ঘাঁটি ত্যাগ করে, তখন সবাই এই অভিযানের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করলেন। অ্যালুয়েটের জন্য প্রথম টার্গেট নির্ধারিত হলাে নারায়ণগঞ্জের কাছে গােদনাইল জ্বালানি সংরক্ষণাগার আর অটারের জন্য চিটাগাং বন্দরের কাছে তেল ডিপাে। সীমান্তের কাছে আসার জন্য ২৯ নভেম্বর ১৯৭১-এ পাইলট কুসহ দল দুটি তাদের বিমান নিয়ে ডিমাপুর ত্যাগ করে কৈলা শহরে অবস্থান নেয়। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে সশস্ত্র অভিযান শুরু করে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পরিচালকরা নির্দিষ্ট টার্গেটসমূহের ওপর মধ্যরাতে বিমান আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। রাত ৯টায় চট্টগ্রামে তেল ডিপােতে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ‘অটার’ কৈলা শহর ত্যাগ করে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম উক্ত বিমানটির ক্যাপ্টেন ছিলেন এবং সহকারী। পাইলট ছিলেন জনাব আকরাম। অভিযানে দুজন এয়ার গানারও অংশ নেন। পথিমধ্যে তেলিয়ামােড়ার ঠিক ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় অটারের সঠিক দিকনির্দেশনার জন্য মাটিতে একটা সবুজ সংকেত দেখানাে হয় একটা কার্টিজ ফুটিয়ে। যথাযথ পথপ্রদর্শনের বন্দোবস্ত না থাকায়, তাদের চলাচলের পথনির্দেশের জন্য আদিম ব্যবস্থারই সাহায্য নিতে হয়েছিল। আকাশে চাঁদ থাকা সত্ত্বেও হালকা মেঘপুঞ্জ ও কুয়াশা ভূপৃষ্ঠকে অস্পষ্ট করে রেখেছিল। সমুদ্র তটরেখা এবং বন্দরের বাইরে নােঙরকৃত জাহাজগুলাের আলাে কয়েক মুহূর্ত পরেই ‘অটার থেকে দুটো রকেট বেরিয়ে তৈলাগারে একটা ছােট্ট আলাে জ্বালিয়ে দিলাে। অটার-এর ক্যাপ্টেন সেই ছােট্ট আগুন দেখেই তার লক্ষ্য সম্পর্কে পুনর্বার নিশ্চিত হলেন। বৃত্তাকারে ঘুরে তিনি বিপরীত দিক থেকে পুনরায় আরাে দুটো রকেট নিক্ষেপ করলেন। মুহুর্তেই আগুন তৈলাধারগুলাে গ্রাস করলাে।
একই সঙ্গে সেই স্থানে প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত এন্টি-এয়ার ক্রাফট গানগুলাে ‘অটার’-এর প্রতি গােলা নিক্ষেপ শুরু করলাে। তার পরও ‘অটার’ দু-দুবার গােটা আকাশ চক্কর দেয় এবং সম্পূর্ণ এলাকা আগুনের লেলিহান শিখায় গ্রাস না হওয়া পর্যন্ত আরাে রকেট নিক্ষেপ করতে থাকে। উড্ডয়নের সাত ঘণ্টা পরে প্রথম অভিযানের সাফল্য নিয়ে বিজয় উল্লাসে কৈলা শহর বিমানবন্দরে প্রত্যাবর্তন করেন অটার কুরা। চট্টগ্রামের পথে ‘অটার যখন তেলিয়ামােড়ার আকাশে উড়ছিল, তখন পর্যন্ত ‘অ্যালুয়েট সেখানকার হেলিপ্যাডেই অপেক্ষা করছিল। ‘অ্যালুয়েটের ক্রুরা নারায়ণগঞ্জের গােদনাইলে আঘাত হানার জন্য তাদের মিশন প্ল্যানটা ভালাে করে শেষবার মুখস্থ করে নিচ্ছিলেন। চাদনি আলাে আর ঘন কুয়াশা পরিবেশকে স্বপ্নপুরীতে পরিণত করেছিল। ভাসমান বিস্তৃত জমির ওপরে ভীতিজনক অসুত সে রাতে আকাশে উড্ডয়ন এক রকম অসম্ভব ছিল, কোনাে জটিল এবং বিপজ্জনক অপারেশন পরিচালনা তাে দূরের কথা। তবু হেলিকপ্টার ক্রুরা নিজস্ব দেশ ও জমিকে ঠিকই চিনতেন বলেই মিশন সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। অ্যালুয়েটে’ স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ক্যাপ্টেন এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম সহকারী পাইলট ছিলেন। পথের নিশ্চয়তার জন্য তারা খুব নিচু দিয়েই উড়ে যেতে মনস্থির করলেন। অ্যালুয়েট উড্ডয়ন করেছিল, আগরতলার পূর্বে, মাইল পঁচিশেক দূরে, তেলিয়ামােড়া পাহাড়ি এলাকার একটা টিলার ওপর থেকে। সেই মধ্যরাতে জঙ্গল ঘেরা ছােট্ট পাহাড়ের চূড়া থেকে ভরা তেল আর এমুনিশন নিয়ে টেক অব করাটাও ছিল অতি বিপজ্জনক। দিন দশেক আগে ভারতীয় বাহিনীর সীমান্তে হামলার ফলে আখউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় পরস্পর মুখােমুখি ছিল মিত্র ও পাকিস্তান বাহিনী।
পুরাে এলাকায় পাকিস্তানিরা ছিল ‘রেড এলার্ট অবস্থায়। আলাে-আঁধারে কুয়াশাময় পাহাড় ছেড়ে সমতল এলাকার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এয়ার গানার সার্জেন্ট শহীদুল্লাহ বীর প্রতীক-এর ভাষায়, প্রিয় বাংলাদেশকে তখন ‘স্বপ্নের প্রশান্ত বাংলা’ বলে মনে হচ্ছিল। রেললাইন ক্রস করতেই যেন হঠাৎ খই ফোটা শুরু হলাে। কোন দিক থেকে ফায়ারিং হচ্ছিল তা বােঝা যাচ্ছিল না। ট্রেসার উড়ছিল চারদিকে। গােপনীয়তা রক্ষার্থে এ মিশন সম্পর্কে নিজ বাহিনীকেও কিছু জানানাে নিষেধ ছিল। সাধারণত শান্ত প্রকৃতির ব্যক্তি, কো-পাইলট আলম প্রায় চিৎকার করেই বললেন, ‘স্যার কোথায় নিয়ে এলেন? আপনি না বলেছিলেন টার্গেটে পৌছানাে পর্যন্ত JUST SIT BACK & RELAX, KEEP YOUR EYES OPEN & NAVIGATE.’ কিছুই বলার ছিল না, তাই একবার তার। দিকে তাকিয়েই স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান আবারও মনােযােগ দিলেন সামনে তার ছিল শুধু এক দৃষ্টি, এক চিন্তা টার্গেট। অন্য সব কিছু তার ভাবনা-চিন্তার বাইরে ছিল। কয়েক সেকেন্ড পর জাহাজ ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে চলে গেলে আস্তে আস্তে নিচ থেকে ফায়ারিংয়ের আওয়াজ পেছনে পড়ে গেল। নিচে ছিল ঘন কুয়াশা। তাই ফ্লাইং করতে হচ্ছিল সময় আর হেডিংয়ের ওপরে, কিছুটা ইনস্ট্রমেন্টের ভরসায় আর বাকিটা যতখানি চোখে দেখা যায়। সময়মতােই তারা ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে ইলিয়টগঞ্জের ছােট একটা ডাইভারশন রােডের পাশে যুদ্ধের শুরুতে ভেঙে যাওয়া ব্রিজের ওপর পৌছেন। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতায় টার্ন নিয়ে আঁকাবাঁকা সড়ক ধরে তারা এগােতে লাগলেন নারায়ণগঞ্জের দিকে। সামনে দৃষ্টি ঘন কুয়াশায় আটকে যাচ্ছিল, তাই প্রায় গাছের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যেতে হচ্ছিল। মনে মনে সবাই প্রার্থনা করছিলেন যেন, টেলিফোন আর বৈদ্যুতিক খাম্বার সঙ্গে ধাক্কা থেকে বেঁচে যান। শুধু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় দাউদকান্দির কাছে মাইক্রোওয়েভ পােল থেকে এবং তারপর দুটো নদী ক্রস করা উঁচু বৈদ্যুতিক খাদ্ধার সঙ্গে ধাক্কা থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। কুয়াশা আর রাডার ডিটেকশনের ভয়ে তারা ওপরে উঠতে পারছিলেন না।
এভাবেই তারা ডেমরার ক্রসিংয়ের কাছাকাছি পৌছলেন। শীতলক্ষ্যায় পৌছেই। দক্ষিণমুখী টার্ন নিয়ে নদীর ওপর দিয়ে চলার কথা। আর যেই সেই টার্ন করলেন, সার্জেন্ট শহীদুল্লাহ এবার প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, ওপরের দিকে তাকিয়ে (তার দরজা ছিল খােলা) সৌভাগ্যবশত এবারও তারা (পানির সামান্য ওপর দিয়ে উড়ার সময়) অদেখা বৈদ্যুতিক তারের নিচ দিয়ে পেরিয়ে গেছেন। যা হয়নি, তা নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিল না। এবার একটু দৃঢ়স্বরে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান সবাইকে হালকাভাবে শাসালেন ‘শুধু সামনে দেখাে, অযথা কথা নয়। আর পাঁচ সেকেন্ড, আমরা টার্গেট এলাকায় পৌছে গেছি, এয়ার। গানার-রেডি? রকেট সিলেক্টর সিঙ্গেল’ হঠাৎই যেন তাদের কপাল খুলে গেলাে। চাঁদের আলােয় সবাই স্পষ্টই দেখলেন সামনে তেলের ট্যাংকগুলােকে। একটা সার্প-পুল করে অত্যন্ত ঝুঁকিবহুল টার্ন নিয়েই সােজা ড্রাইভ দিলেন ট্যাংকমুখী। মনে হচ্ছিল, হয় রকেট খুঁজবে টার্গেট, না হয় জাহাজসুদ্ধ টার্গেটে। প্রথমবারের মতাে দুটো সিঙ্গেল রকেট ছুড়লেন। মুহূর্তেই আগুনের লেলিহান শিখা প্রায় জাহাজটাকে ঘিরে ফেললাে, তারা টার্গেটের আগুনেই ধরা পড়ছিলেন প্রায়। আবার ঘুরে এলেন দ্বিতীয় আক্রমণের জন্য। আবার লক্ষ্যভেদ হলাে আরাে একটা ট্যাংক। জ্বলে উঠলাে সমগ্র এলাকা।
গানার অন্যান্য টার্গেটে ঘন ঘন তাক করলেন। প্রজ্বলিত অগ্নিপ্রভার সঙ্গে নিচ থেকে এলাে মেশিনগানের খই ফোটা আওয়াজের রিসেপশন। সমগ্র টার্গেট জ্বলে উঠলাে। স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে শেষবারের মতাে একটা সেলভাে মেরে, মােড় ঘুরলেন ঘাঁটি অভিমুখে। এই শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার মাঝে গানার তার দ্বিতীয় কাজ- এ ব্যান্ডেল পেটে (PROPAGANDA PAMPHLET), রশির বাঁধন না খুলেই ফেলে দিলেন, বােধ হয় শীতলক্ষ্যার শান্ত শীতল জলে। ফেরার পথে আখাউড়া এলাকা পার হওয়ার কালে আবারও পেলেন হালকা রিসেপশন। সাফল্যের আনন্দে নিচের আওয়াজ তাদের আর এবার বিচলিত করতে পারেনি। ফেরার পথে তাদের নেভিগেশন করতে হয়েছিল অতি সঠিকভাবে। আর নেভিগেশন সঠিক রাখা ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা মিশনের পর আর মাত্র ১২ থেকে ১৫ মিনিটের তেল অবশিষ্ট ছিল। অরণ্যঘেরা পাহাড়ি চূড়ায় কোনাে নেভিগেশন যন্ত্র ছাড়া ঘাটি খুঁজে বের করা ছিল। ভীষণ কষ্টসাধ্য। এর জন্য কতখানি উঁচু মানের পেশাগত দক্ষতার প্রয়ােজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটু ভুল হলে বা ঠিক সময়ে হেলিপ্যাড খুঁজে না পেলে তেল ফুরিয়ে যেতাে ঘাের অরণ্যের মাঝে সব কিছুই যেন ঘড়ির কাঁটার মতাে সমাপ্ত হয়েছিল।
মুক্তিবাহিনীর ‘বিমানবাহিনীর সদস্যদের অদম্য দেশপ্রেম আর সুউচ্চ পেশাগত জ্ঞান ও একনিষ্ঠতায়ই সম্ভব হয়েছিল এমন ঝুঁকিবহুল অপারেশনগুলাে সম্পন্ন করা। এ দুটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণের সাফল্যের পরপরই বেজে উঠেছিল মিত্রবাহিনীর রণ-দামামা : পরদিন ভাের থেকে। এভাবে ১৯৭১-এর ৪ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি যুদ্ধদানবদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর আত্মত্যাগী, তেজোদ্দীপ্ত ও নির্ভীক পাইলটদের প্রথম সফল অগ্রাভিযান সমাপ্ত হলাে। মধ্যরাতে অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সার্থকভাবেই পরিচালিত এ দুটো বিমান হামলা পরবর্তী মাত্র ১২ দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত বিজয় অর্জনকে ত্বরান্বিত করেছিল। এবার দিনের মধ্যে ‘অ্যালুয়েট’ এবং ‘অটার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বহু মিশন পরিচালিত করেছিল। এ মিশনগুলাে কুমিল্লা ও সিলেট এলাকায় পলায়নমুখী পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষতি করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঢাকা অভিমুখে পশ্চাৎপসরণ করার পরিপ্রেক্ষিতে ‘অ্যালুয়েটের তুরা কৈলা শহর থেকে আগরতলায় তাদের ঘাঁটি সরিয়ে নিয়েছিলেন। আগরতলা থেকে তারা কুমিল্লা, নরসিংদী, দাউদকান্দি এবং অন্য সর্বত্রই পশ্চাৎপসরণকালে পাকিস্তানিদের ওপর বহু আক্রমণ পরিচালনা করেন। অভিযানগুলাে পরিচালনার সময় হেলিকপ্টার শত্রুর বুলেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর অনেকগুলােই ছিল মূল রােটর ব্লেডে। অলৌকিকভাবেই হেলিকপ্টার ও অটার ক্রুরা সে সব বিপজ্জনক আঘাতগুলাে থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
একাত্তরের যুদ্ধে ঢাকায় পাকিস্তানি বিমানবাহিনী
পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের কোনাে প্রয়ােজন অনুভব করেনি। তাদের ধারণা ছিল পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা করলেই পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা হবে। কারণ ভারত কখনাে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। ফলে একাত্তরের যুদ্ধকালে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একটি মাত্র স্কোয়াড্রনই (নং ১৪ স্কোয়াড্রন, ঢাকা) অবস্থান করছিল। জানা তথ্য মােতাবেক তাতে সংযুক্ত ছিল : এফ-৮৬ স্যার উড়োজাহাজ-১৬টি, তার সঙ্গে কয়েকটি টি-৩৩, একটি পরিবহন বিমান ইত্যাদি। এদের সংখ্যা সঠিক জানা নেই। এ ছাড়া ঢাকায় বিমানবাহিনী ইস্টার্ন কমান্ডের কয়েকটি দপ্তর, একটি মােবাইল অবজারভার ইউনিট ও সিকিউরিটি ইউনিট ছাড়া বিমানবাহিনীর আর কিছুই ছিল না। এরই মাঝে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ভারতীয় উন্নততর জঙ্গি জাহাজ মিগ-২১, এসইউ-৭, হান্টার ও ন্যাট জাহাজের দশটি শক্তিশালী স্কোয়াড্রনের বিরুদ্ধে সেই ডজন খানেক উড়ােজাহাজের একটি মাত্র পাকিস্তানি ইউনিট নং ১৪ স্কোয়াড্রনকে লড়তে হয়েছিল। ভারতীয়রা প্রথমে ন্যাট জাহাজ দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রথম ঘটনা ঘটে ২১ নভেম্বর ১৯৭১ সালে যখন ১০টি ন্যাট জাহাজের অতর্কিত আক্রমণের মুখােমুখি হয় তিনটি পাকিস্তানি স্যার এফ-৮৬ জেট। এ অভিযানে একটি ভারতীয় ন্যাট এবং দুটো পাকিস্তানি স্যাবর খােয়া যায়। ভারতীয়রা পুনঃ আক্রমণ পরিচালনা করে এসইউ-৭ এবং হান্টার উড়ােজাহাজের সাহায্যে। এতে পরিসংখ্যান অনুযায়ী দুটো হান্টার, একটি এসইউ-৭ এ এলাকায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সময় দীর্ঘায়িত হচ্ছে দেখে ভারতীয়রা পাকিস্তান বিমানবাহিনী ঘাঁটি ঢাকার ওপর এবার মিগ-২১ বিমানের আক্রমণ চালিয়ে সমগ্র রানওয়েকে সম্পূর্ণ অকেজো করে ফেলে।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানিদের সর্বমােট প্রায় ১০টি স্যার জেট আকাশে ও ভূমিতে বিনষ্ট হয়। একটি পরিবহন বিমান এবং দুটো হালকা বিমান ঘাঁটিতে ক্ষতি হয়। ভারতীয়দের পক্ষে অবশ্য আরাে একটি হেলিকপ্টার পূর্বাঞ্চলের অপারেশনে বিধ্বস্ত হয়েছিল। উল্লেখ্য, পাকিস্তানিরা সব ঘাঁটি ইউনিট থেকে পালিয়ে যাওয়ার ফলে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে, ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের পূর্ব পর্যন্ত সব সামরিক যন্ত্রপাতি ধ্বংস করে দিয়ে যায় বা মেরামতের অযােগ্যভাবে অকেজো করে রাখে। লক্ষ করা গেছে, বিমানবাহিনী ঘাঁটি ঢাকার এইচএফ যােগাযােগ কেন্দ্রে যন্ত্রপাতিসমূহ হাতুড়ি পিটিয়ে সম্পূর্ণ অকেজো করে রেখে যায় । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার লগ্নে অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের ক্রান্তিলগ্নে বিমানবাহিনীর ভাগ্যে জুটেছিল বিধ্বস্ত/ব্যবহার অনুপযােগী রানওয়েসমূহ, বিধ্বস্ত এবং মেরামত অযােগ্য যন্ত্রপাতি, ছয়টি অকেজো স্যার জেট এফ-৮৬ ও একটি টি-৩৩ বিমান, বিমানবাহিনীর কুর্মিটোলা, ঢাকা এলাকায় কয়েকটি অফিস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিত্যক্ত কয়েকটি রানওয়ে, মুষ্টিমেয় কয়েকজন যুদ্ধক্লান্ত বিমানসেনা (অবশ্য পাকিস্তানে আটক ছিলেন আনুমানিক তিন হাজার বিমানবাহিনীর সদস্য) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজকীয় বিমানবাহিনীর কিছু রক্ষণাবেক্ষণ ঘাঁটি।
বিজয় দিবসের পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, আত্মসমর্পণের কিছুদিন আগে থেকে বিমানবাহিনীর চারজন অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার হাবিবুর রহমান, স্কোয়াড্রন লিডার শামসুর রহমান ও স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক, লেফটেন্যান্ট নূরুল ইসলামকে ঢাকা সেনানিবাসের বন্দিদশা থেকে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মুক্তি দেয়। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিমানবাহিনীর সদস্যদের বিমানবাহিনী ঘাঁটি ঢাকায় একত্র হওয়ার আহ্বান জানানাের জন্য তারা সিদ্ধান্ত নেন। বেতারে আহ্বান প্রচারের পর উৎসাহব্যঞ্জক সাড়াও পাওয়া যায়। ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে কয়েকজন অফিসার ও বেশ কিছু বিমানসেনা সেনানিবাসের তেজগাঁও ফটক, সাধারণত যা থার্ড গেট নামে পরিচিত, সেখানে সমবেত হন। সে সময় শুধু স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান আর দুজন অফিসার ছাড়া বিমানবাহিনীর তদারকির কোনাে অফিসার ছিলেন না। এর ভেতর স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ তার সেক্টর থেকে ঢাকায় আসেন। তখন অফিসার মেসসহ বেশির ভাগ এলাকাই ভারতীয় বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এয়ার কমােডর কিংলি ভারতের তরফ থেকে আঞ্চলিক বিমানের অধিনায়কত্বের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। তিনি বেস হেডকোয়ার্টার্সে তার দপ্তর বসান। পাশের টিনের ঘরগুলােতে বিমানবাহিনীর কিছু অফিস শুরু করেন। তেজগাঁও বেস-এর মেইন গার্ডরুম ও তার ভেতরকার সমগ্র এলাকায় তখন একত্র ছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সদস্যরা। এমআই রুম (হাসপাতাল)-এর মেটারনিটি ওয়ার্ডে থাকতেন পিএনএফ-এর এয়ার অফিসার কমান্ডিং এয়ার কমােডর এনাম ও তার অফিসাররা। আর বেশির ভাগ বিমানসেনা থাকতাে শাহীন স্কুলের ক্লাসরুমগুলােতে। বিমানবাহিনীর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মতাে সে সময় কোনাে রকম সাংগঠনিক বা প্রশাসনিক অবয়ব ছিল না।
হাতেগােনা মাত্র কজন অফিসারকে বিমানবাহিনী পরিচালনা করতে হয়েছিল। তাদের মধ্যে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান, স্কোয়াড্রন লিডার ওয়াহিদুর রহমান, স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিন, স্কোয়াড্রন লিডার হাবিবুর রহমান, স্কোয়াড্রন লিডার শামসুর রহমান, স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক, স্কোয়াড্রন লিডার হাসানুজ্জামান এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের ছিলেন অন্যতম। সাধারণ আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবাহিনীর যত সদস্য তখন উপস্থিত ছিলেন, তাদের আহার ও বাসস্থানের সংকুলান করাই তাদের সামনে তখন মুখ্য দায়িত্ব হিসেবে প্রতিপন্ন হলাে। প্রকট বাসস্থান সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবাহিনীর সদস্যদের সাময়িক কিছু সময়ের জন্য স্বীয় উদ্যোগেই আবাসিক সংকুলান করতে বলা হলাে। যারা বাসস্থান সংকুলানে ব্যর্থ হলেন তাদের তেজগাঁও বিমানসেনা মেসে সংকুলান করা হলাে। এরপর খাদ্য সরবরাহ ছিল পরবর্তী জরুরি সমস্যা। ক্যাটারিং গুদামে মজুদ যে খাদ্য ছিল তাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণের পর বিষ মিশিয়ে রেখেছে গুজবের ফলে কেউ সে খাবারে হাত দিতে সাহস করেনি।
অসংখ্য অসুবিধার ভেতরেই রন্ধন উপকরণ সরঞ্জাম ও বাসনপত্র কেনার জন্য সামান্য অর্থ সংকুলান সম্ভব হলাে। কেন্দ্রীয় রেশন ভাণ্ডার থেকে সামান্য পরিমাণ খাদ্য সামগ্রীও সগ্রহ হলাে। ১৮ ডিসেম্বর স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) খলিলের সাহায্যে খাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন জনা পঞ্চাশেক এক বেস-থাকা বিমানসেনার জন্য। তারা তখন থাকতেন পুরােনাে সংসদ-এর পাশে বিমানবাহিনীর চারটি টি-কোয়ার্টারে। তারপর সদরঘাট এলাকার একজন রেস্তোরার মালিক খাওয়ালেন আরাে দুদিন। এই করে গড়েছিল বিমানবাহিনীর অঙ্কুর। অল্প কিছু দেশপ্রেমিক ত্যাগী সদস্যই সেদিনের বিমানবাহিনীকে এগিয়ে নিয়েছিলেন ধীরে ধীরে। এক-এক করে নিজ হাত দিয়ে রানওয়ে আর ঘাটি এলাকাকে বােমা, মাইন আর ধ্বংসস্তৃপ থেকে পরিষ্কার করেন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক নেতাদের প্রবাস থেকে দেশের মাটিতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। সপ্তাহ খানেকের ভেতর বিন্নি সেক্টর ও এলাকা থেকে অনেক সদস্যই এসে সমবেত হন। তাদের জন্য বাসস্থান ও খাদ্য সংকুলান করা একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আত্মসমর্পণের আগেই পাকিস্তানিরা সব যুদ্ধবিমান ও সরঞ্জামাদি হয় ধ্বংস নতুবা অকেজো করে রেখে গিয়েছিল। ব্যবহার অনুপযুক্ত বিমান ও সরঞ্জামগুলােকে একত্রে ধূপীকৃত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার বিমানবাহিনী ঘাঁটি ঢাকায় এলেন কলকাতা থেকে। অনুষ্ঠান শেষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন ও এয়ার কমােডর কিংলি ইন্ডিয়ান বিমানবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে প্রয়ােজনীয় আলােচনায় মিলিত হন। মিত্র সেনারা ভারতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত এয়ার কমােডর কিংলিকে ঘাটি সদর দপ্তরে অবস্থান করার অনুমতি দেওয়া হয়। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পরিত্যক্ত অপারেশন কক্ষ, হাে চি মিন রাস্তার। পাশে ও নং ১৪ স্কোয়াড্রনে ক্ষুদ্রাকার বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর ও ফ্লাইং উইং স্থাপন করা হলাে। যুদ্ধ থেকে ফিরে কিছুসংখ্যক অফিসার ঢাকা ঘাঁটিতে উপস্থিত হলেন। তাদের আগমনে তিনটি ফ্লাইং স্কোয়াড্রন এবং একটি ফ্লাইং উইং গঠিত হলাে। স্কোয়াড্রন লিডার মরুল হক ফ্লাইং উইংয়ের অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন।
স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক ফ্লাইং উইংয়ের অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে নং ৫০১ হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন অধিনায়ক, স্কোয়াড্রন লিডার ওয়াহিদুর রহমানকে নং ৫০৩ পরিবহন স্কোয়াড্রনের এবং স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দিনকে নং ৫০৭ ফাইটার স্কোয়াড্রনের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হলাে। পুরােনাে নং ১৪ স্কোয়াড্রনের টিনের বিল্ডিং হলাে কিছুদিনের জন্য সব স্কোয়াড্রনের স্থান। সেনানিবাস সড়কের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত হ্যাঙ্গারে তিনটি হেলিকপ্টারের সমন্বয়ে গঠিত হলাে নং ৫০১ হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন। এ হ্যাঙ্গারটিতে পাকিস্তানিরা হেলিকপ্টার অপারেশন করতাে। পরবর্তীকালে এর নাম রাখা হয় চপার্সডেন’। হ্যাঙ্গারটির মালিকানা নিয়ে সেনা ও বিমানবাহিনীর মধ্যে মতবিরােধ ছিল। বিষয়টির যুক্তিসঙ্গত মীমাংসার জন্য বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং হস্তক্ষেপ করেন এবং পরে ‘চপার্সডেন’ বিমানবাহিনীকে দেওয়া হয়। নং ৫০৩ স্কোয়াড্রন থেকে গেলাে পুরােনাে নং ১৪ স্কোয়াড্রন বিল্ডিংয়ে এবং নং ৫০৭ স্কোয়াড্রন স্থাপন হলাে এ ও ডির উল্টো দিকে একটি বিল্ডিংয়ে, যেটা পরে ওসি মেইনটেন্যান্স-এর অফিস হলাে। নিকটস্থ জঙ্গল ও পুকুরগুলােতে অসংখ্য ভগ্নাংশ, ভূমি সরঞ্জাম, ক্ষুদ্রান্ত্র এবং যন্ত্রপাতিতে পরিপূর্ণ ছিল। এ পরিত্যক্ত স্থানসমূহে পাকিস্তানিরা পলায়নের পূর্বে মূল্যবান সামগ্রীগুলাে ছুড়ে ফেলে যায়। এ স্থানগুলােকে তারা ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতির খনিতে রূপান্তরিত করেছিল। যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে দক্ষ কর্মীরা এ স্থানগুলাে থেকে অসংখ্য খুচরা যন্ত্রপাতি, ভূমি সরঞ্জাম ও যন্ত্রাংশসহ দুটো অরেভা ইঞ্জিন উদ্ধার করলেন। কতিপয় প্রয়ােজনীয় সরঞ্জাম-যন্ত্রপাতি স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করা হলাে। ঐ পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ ও সরঞ্জামাদি নিয়েই যান্ত্রিক কর্মীরাধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানগুলাে মেরামতের প্রত্যয়ে ব্রতী হলেন।
তারা এই অল্প সংখ্যক বিমানকে কর্মক্ষম করার প্রচেষ্টায় রাত-দিন বিরামহীনভাবে কাজ করলেন। তাদের বিরামহীন প্রচেষ্টা ও ত্যাগের ফলে মাত্র এক মাসের মধ্যেই একটি টি-৩৩ এবং তিনটি এফ-৮৬ বিমানকে বিভিন্ন বিমানের সরঞ্জাম মিলিয়ে কর্মক্ষম করে তােলা সম্ভব হলাে। প্রথম বিমানটি একটি টি-৩৩, ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি সর্বপ্রথম বাংলার আকাশে উড়লাে। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার সর্বপ্রথম বিমানটিতে আকাশে ওড়েন। বিমানবাহিনীর ইতিহাসে সে দিনটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এর মধ্যে সেনানিবাসের মধ্য থেকে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান একদিন একটি অ্যালুয়েট পেলেন, বিডিএফ হেডকোয়ার্টার্সের পেছনে গাছতলা থেকে। তাকে টেনে আনা হলাে তেজগাঁও। অল্প কিছু কাজের পর তাকে উড্ডয়নযােগ্য করা হলাে। কিছুদিনের ভেতর একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠলাে। জেনারেল ওসমানী দেশে ফেরার পর প্রথমে বেইলি রােডের একটি বাড়িতে ও তারপর সিএমএইচ-এর পাশে বিমানবাহিনী হেডকোয়ার্টার্স হলাে বাংলাদেশ ফোর্সের সদর দপ্তর। সেখানে কিছুদিন পর গ্রুপ ক্যাপ্টেন | তােয়াব বিদেশ থেকে ফেরার পর, তাকে অপারেশনস ও প্লানস-এর ডাইরেক্টর নিয়ােগ করা হলাে। বিমানবাহিনী সদর দপ্তর স্থাপন হলাে প্রথমে তেজগাঁও বেস, হাে চি মিন রাস্তার ধারে, | কিলার কন্ট্রোলের নিচে, অপারেশন রুমের ভেতর। এরপর বেস সদরে ওসি এডমিন বসলেন। পরে সেখানে ওসি এডমিন অফিস হলাে। সরকারিভাবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার বিমানবাহিনী প্রধান ছিলেন।
কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ঘাঁটি কার্যক্রমেও সমম্বয় করতেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাটি প্রথম নিত্যক্রম আদেশ ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। সে সময় তার সঙ্গে কাজ করার জন্য মাত্র একজন স্টাফ | অফিসারই ছিলেন। তিনি ছিলেন আবহাওয়া ব্রাঞ্চের উইং কমান্ডার কামাল উদ্দিন। কতিপয় অপ্রীতিকর কিছু বিষয় সে সময় বিমানসেনাদের ব্যতিব্যস্ত করে তােলে। সীমান্ত রণাঙ্গনে যেসব সদস্য যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের উচ্চতর পদ প্রদানের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সে অনুসারে ঘাঁটিতে পদার্পণ করেই তারা সেসব সুযােগ-সুবিধার দাবি উত্থাপন করে বসেন। সম্পদ ও | সঙ্গতির স্বল্পতাহেতু সেসব দবির তাৎক্ষণিক পূরণ সম্ভব ছিল না। তবু এসব অসুবিধা ক্রমান্বয়ে | কাটিয়ে উঠতে হলাে এ নবীন বিমানবাহিনীকে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে রানওয়েগুলাের, এমনকি ট্যাক্সি ট্রাকগুলাের সাংঘাতিক ক্ষতিসাধিত হয় এবং অপারেশনের সম্পূর্ণ অনুপযােগী হয়ে পড়ে। যত শিগগির সব রানওয়ের জরুরি ব্যবহারের জন্য মেরামতের কাজ তড়িঘড়ি করে হাতে নেওয়া হয়। এতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে এত তাড়াহুড়াের মাঝে কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং মেরামতের কাজ সঠিকভাবে না হওয়ায়, বম্ব ক্রেটারগুলাে মাঝেমধ্যে ধসে পড়ে। শুধু রানওয়ে নয়, ট্যাক্সিওয়ে ও এপ্রােনগুলােও বেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। তেজগাঁও রানওয়েতে অনেকগুলাে গর্ত থাকায় এখানে শুধু হেলিকপ্টার | অপারেশন করা যেতাে। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতানের প্রথম দল প্রথমে ট্যাক্সিওয়েটাকে সংস্কার ও মাইনমুক্ত করে। প্রায় সবাই মিলে অন্যান্য কাজের ফাঁকে নিজ হাতে সব ইটপাটকেল সরাতে হয়েছিল। ১৮ ডিসেম্বরে ট্যাক্সিওয়ে পরিষ্কার করে, প্রথমে অটার জাহাজটিকে ল্যান্ড করানাে হয়, হেলিকপ্টারের রেডিওকে চলমান টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তারপর এটিসির যন্ত্রপাতিকে ব্যবহারযােগ্য করা হয়। তার দরজা-জানালা সব ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল।
আর অকেজো ছিল সব যন্ত্রপাতি। শূন্য থেকে শুরু হয়েছিল সিভিল এভিয়েশনকে গড়া। প্রথম ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়ােজিত হলেন উইং কমান্ডার মির্জা (অব.)। যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও ভারতীয় বেসামরিক বিমান চলাচল বিভাগের সাহায্যে গড়ে উঠলাে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল। শিগগিরই ঢাকা সেনানিবাসে বিমানবাহিনী সদর দপ্তর বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হলাে। জেনারেল এম এ জি ওসমানী সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ছিলেন। তখন তিনি ধারণা করতেন বাংলাদেশের একটিই মাত্র সশস্ত্র বাহিনী থাকবে এবং স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনী অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিচিত হবে। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার, উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান, স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ ও বিমানবাহিনীর অফিসারবৃন্দ তিনটি সার্বভৌম বাহিনী গড়ে তােলার জন্য তাদের মতামত প্রকাশ ও প্রত্যয় ঘােষণা করলেন। স্থলবাহিনীর অনেক জ্যেষ্ঠ অফিসার একীভূত সশস্ত্র বাহিনী গঠনে জেনারেল ওসমানীর ধারণাকে সমর্থন দিচ্ছিলেন। বহু আলাপ-আলােচনা ও বিতর্কের পর চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হলাে যে দেশে তিনটি সার্বভৌম বাহিনী হবে এবং প্রত্যেকটি সংগঠনের প্রধান, বাহিনী প্রধান নামে অভিহিত হবেন এবং সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি। বিমানবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য যুদ্ধকালীন বন্ধু দেশগুলাে এগিয়ে এলাে। এ সময়ের মধ্যে আরাে কিছু অফিসার ও বিমানসেনা যারা গ্রামগঞ্জে ছিলেন বিমানবাহিনীর সদরে রিপাের্ট করলেন। সেই প্রাথমিক সময়ে সবাই কাজ করছিলেন নিবেদিতপ্রাণ হয়ে। তবে কিছুসংখ্যক বিমানসেনার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযােগ্য। যেমন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সার্জেন্ট রহমান (এন সিও আই সি/এফ-৮৬), সার্জেন্ট ইসমাইল (প্রভােস্ট), কর্পোরাল হাসমত ও ফ্লা: সা: আলাউদ্দিন (৫০১ স্কোয়াড্রন), ফ্লা: সা: আসগর ( কিলাে ফ্লাইট) এবং ফ্লা: সা: রােস্তম (৫০৩ স্কোয়াড্রন)। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে জেনারেল সিজোফের (CEJOPH) নেতৃত্বে সােভিয়েত ইউনিয়নের একটি দল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে বিমান, এয়ার ডিফেন্স রাডার ও সরঞ্জাম প্রদানের প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আসে।
সে সময় একমাত্র সােভিয়েত ইউনিয়নই বাংলাদেশে বিশাল আকারে সামরিক সহায়তা দানে এগিয়ে আসে। বিমানবাহিনী প্রাথমিকভাবে একটি ফাইটার স্কোয়াড্রন, একটি হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন, ছােট আকারের পরিবহন বিমানের ইউনিট এবং বিমান প্রতিরক্ষা রাডার ব্যবস্থা সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করে। ব্যাপক পর্যবেক্ষণের পর, সােভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক দল ১০টি মিগ-২১ বিমান, পাঁচটি এমআই-৮ হেলিকপ্টার, তিনটি পরিবহন বিমান (একটি ভিআইপি ব্যক্তিবর্গ বহনকারী এ এন ২৪ বিমান এবং দুটি এ এন-২৬ বিমান), শক্তিশালী দুটি রাডার, দুটি নিচুতে দেখা রাডার এবং এতদসংক্রান্ত ভূমি সরঞ্জামাদি প্রদানে সম্মত হয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্য ২০০ জন উপদেষ্টা প্রদানেও সােভিয়েত রাশিয়ার সামরিক দল আগ্রহ প্রকাশ করে। বিমান সদর চারটি দল এবং প্রতি দলে সর্বাধিক সংখ্যায় ১০ জন বিশেষজ্ঞ গ্রহণে সম্মত হলাে। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অফিসার ও বিমানসেনাদের যুদ্ধসামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানে যথেষ্ট সহায়তা দেয়। এর মধ্যে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অফিসার ও বিমানসেনাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের প্রস্তাব আসে। যদিও বিমানবাহিনীতে বেশ কিছুসংখ্যক বিমান পরিচালনা হতাে, তথাপিও তার প্রয়ােজনীয়সংখ্যক যান্ত্রিক কারিগরের অভাব ছিল তখন প্রকট। ভারত তিনটি অ্যালুয়েট-III, একটি অটার বিমান দেয়। এর কিছু পরেই যুক্তরাজ্যও দুটি ওয়েসেক্স (WESSEX) হেলিকপ্টার প্রদান করে প্রধানমন্ত্রীকে।
এ সময় পরিবহন সমস্যাই দেখা দেয় মারাত্মক আকারে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তখন বিমান টেনে নেওয়ার জন্য মাত্র দুটো ট্রাক্টরই সম্বল ছিল। আর যেখানে যা পাওয়া গেলাে তা দিয়েই তখন সদস্যদের কাজ করতে হলাে। ট্রাক্টর দুটো তখন কর্মচারী এবং সরঞ্জাম বহনে ব্যবহার করা হতাে। উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক চুকিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যােগ দেন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে উত্তর সীমান্তে ৩ টনি যে ট্রাকগুলাে তিনি ব্যবহার করতেন, সেগুলাে বিমানবাহিনীর জন্য নিয়ে আসেন। কিছুদিনের দৈন্যতার পর বিমানবাহিনী ভারত থেকে বেশ কটি মহেন্দ্র জিপ গাড়ি ক্রয় করে এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েকটি জিপ স্টার এবং একটনি ট্রাক সাহায্য হিসেবে পায়। এ দিয়ে শুরু হয় যানবাহনের বহর। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে আরাে কয়েকজন অফিসার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যােগ দেন। তার মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এবং কজন পাকিস্তানের বন্দিশিবির থেকেও পালিয়ে আসেন। তাই প্রাথমিক স্তরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠনে যারা আত্মনিয়ােগ করলেন তারা হলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, গ্রুপ ক্যাপ্টেন কে এম আমিনুল ইসলাম, উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার, উইং কমান্ডার কামাল উদ্দিন, স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক, ওয়াহিদুর রহমান, শামসুর রহমান, সদরুদ্দিন, সুলতান মাহমুদ, হামিদুল্লাহ, হাবিবুর রহমান, বদিউর রহমান, হাসানুজ্জামান, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ফজলুর রহমান, কামালউদ্দিন, লিয়াকত, বদরুল আলম, শামছুল আলম, কাদের, ইসলাম, ইরফান, আয়ুব, আশরাফ ও রউফ, ফ্লাইং অফিসার ফজলুর রহমান, সাখাওয়াত, কামাল, মির্জা ও ইকবাল রশিদ এবং পাইলট অফিসার খলিল প্রমুখ বরেণ্য অফিসার।
আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকিস্তানি সৈন্যরা মিরপুরেব প্লেসি রাডার কেন্দ্রটি ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। কতিপয় অফিসার ও বিমানসেনার সহযােগিতায় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কামাল উদ্দিন রাডার কেন্দ্রটি সংস্কার সাধন করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়েও ঢাকার ব্রিটিশ কূটনৈতিক মিশন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে কারিগরি সামগ্রী প্রদানের সাহায্য বর্ধিত করে। শিগগিরই আকাশ প্রতিরক্ষা পরিচালনা কেন্দ্র তার কার্যক্রম শুরু করে এবং ১৯৭২-এর ১২ মার্চের মধ্যে মিরপুর রাডার ইউনিট তার কাজ শুরু করতে সক্ষম হয়। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী একটা হােট অথচ মনােজ্ঞ ফ্লাই পাস্ট প্রদর্শন করে সবাইকে বিস্ময়াভিভূত করে। কয়েকটি বিমানের ঝাক সুন্দর (FORMATION) উড়ে যায় নীল আকাশের বুক চিরে। তার মধ্যে ছিল দুটি এফ-৮৬, একটি টি-৩৩, তিনটি অ্যালুয়েট ও একটি অটার বিমান। রমনা মাঠে সেদিন ছিল বাঙালির গর্বভরা বুক, উন্নত শির ও স্বাধীনতার স্বাদ। দিন পেরােনাের সঙ্গে সঙ্গে বিমানবাহিনী সদর দপ্তরেও ব্যস্ততা বাড়লাে । তেজগাঁও বিমান ঘাঁটি পরিচালনা ও দায়িত্বে নিয়ােজিত হলেন উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার। অন্য অফিসাররা এগিয়ে এলেন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে। কিছুদিন পর বিমান ও যন্ত্রাংশ আনয়ন ও প্রশিক্ষণার্থে বেশ কিছু অফিসার ও বিমানসেনা যখন সােভিয়েত ইউনিয়নে যান, তখন বিমানবাহিনী পুনরায় জনশক্তিস্বল্পতার তীব্রতর সমস্যায় পতিত হলাে। এ সমস্যাসংকুল অবস্থা ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে অফিসার ও বিমানসেনাদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন অবধি বিরাজ করছিল। এ সময় বিমানবাহিনীর অগ্রযাত্রা ছিল কিছু মন্থর। (১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রকাশ করা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস’ শীর্ষক বই থেকে)
সূত্র : রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি – জায়েদুল আহসান