গণফাসি রস্যের উৎসমুখে
একজন রিপাের্টার হিসেবে যেকোনাে ঘটনার ভেতরে ঢুকে যাওয়ার ইচ্ছা সব সময়ই আমার মাঝে কাজ করে। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার আগে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়টায় একের পর এক ঘটনাগুলাে ঘটছিল। রাষ্ট্র ও সরকারে বড় হয়ে উঠলাে সামরিক বাহিনী ও সামরিক সরকার। প্রায়ই সেনাবাহিনীর মধ্যকার অন্ধকার অধ্যায়গুলাে সম্পর্কে বিশদভাবে জানার আগ্রহ আমার মাঝে উঁকি দিতাে। বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকা, বই-প্রবন্ধ ও নানা গবেষকের লেখায় ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বরে খালেদ মােশাররফের বিদ্রোহ, ৭ নভেম্বরে পাল্টা বিদ্রোহ, ‘৮১ সালের ৩০ মে জিয়া হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কম-বেশি জানতে পেরেছি, যেন একটির পিঠে আরেকটি। শুধু জেনারেল জিয়ার আমলে ছােট-বড় ২১টি অ্যুত্থান ঘটেছে বলে গবেষক ও বিশ্লেষকদের লেখায় তথ্যটি পেলেও বিশদ কিছুই জানতে পারিনি। রিপাের্টার হিসেবে যখন বিভিন্নজনের কাছে গিয়েছি তখনই একদিন জানতে পারি ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমানবাহিনীর কিছু সদস্যের অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা সম্পর্কে। ঐ ২১টি অ্যুত্থানের আরাে কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানালেও ২ অক্টোবরের অভ্যুত্থানটি আমাকে নাড়া দেয় মারাত্মকভাবে। ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বরের অ্যুত্থান বা ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়া হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও ‘৭৭-এর সেই অ্যুত্থানে অন্তত ক্ষমতাকেন্দ্রে এমন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু অ্যুত্থানচেষ্টার কারণে বিমান ও সেনাবাহিনীর শত শত সৈনিককে গণফাসিতে ঝােলানাে হয়েছিল, যা কিনা কখনই প্রকাশ হয়নি- গােপন বিচারে একরকম। একতরফাভাবেই ফাঁসির রায় ধার্য ও কার্যকর করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আমি ইতিহাসের এই অন্ধকার দিকটির রহস্য উন্মোচনের কাজে লেগে পড়ি। কী ঘটেছিল ‘৭৭-এর ২ অক্টোবর, কেন ঘটেছিল, কারা ঘটিয়েছিল, কেন গণাসি? লাশগুলাে পর্যন্ত দেওয়া হলাে না স্বজনদের কাছে, কতজনকেই বা ফাসি দেওয়া হয়েছিল- সরকারিভাবে জানানাে হয়নি কিছুই। এতসব প্রশ্নের জবাব শুনতে গিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সন্ধান পাই ‘৭৭-এ গণফাসির একটি তালিকা। সেই তালিকার সূত্র ধরেই কুমিল্লা ও বগুড়া কারাগার থেকে সংগ্রহ করি সেখানে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের নাম-পরিচয়।
শুরু হয় অনুসন্ধানের পালা। সাবেক সেনা ও বিমানবাহিনী কর্মকর্তা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের স্বজন, কারাদণ্ডিতদের সাক্ষাৎকার, কারা কর্মকর্তা, সামরিক ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং ঘটনার সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্তদের অনেকের কাছেই যাই। এভাবে প্রায় বছর দুয়েক অনুসন্ধানের পর ১৯৯৭ সালের ২ অক্টোবর থেকে ভােরের কাগজে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হতে থাকে আমার রিপাের্ট- ৭৭-এর রহস্যময় অ্যুত্থান ও সৈনিকদের গণফাঁসি। রিপাের্টগুলাে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন উৎস থেকে আরাে কিছু তথ্য পেতে শুরু করি, গণফাঁসির শিকার পরিবারগুলাে কেউ চিঠি দিয়ে, কেউ অফিসে এসে দেখা করতে থাকে। তারা আমার রিপাের্টের মাধ্যমেই জানতে পারে কারাে পিতাকে, কারাে ভাইকে, কারাে স্বামীকে কবে কোথায় কিভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। জানতে পারে কোথায় তাদের লাশ দাফন করা হয়েছে। কিন্তু এসব তথ্য জানতে ইতােমধ্যে তাদের ২০টি বছর পার করে দিতে হয়েছে। আমি তাদের এই কষ্ট ও ক্ষোভের জায়গাটা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করি। সেই স্বজনহারাদের একজন আলেয়া, যিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। তখন তার কোলে একটি ছেলে, আর একজন অনাগত। সেই আলেয়ার ২০টি বছর কিভাবে কেটেছে! একসময় মুখােমুখি হয়েছিলাম তার, হৃদয়কে নাড়া দেয় তার কাহিনী। আলেয়ার সেই দুঃসহ যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েই তাই শুরু করেছি এই মলাটবদ্ধ ইতিহাস। সেই ফাঁসির পর
তখন হেমন্তকাল। ধূসর পেঁচার মতাে ডানা মেলে সন্ধ্যা নামে ঢাকার বুকে। হালকা কুয়াশা। মিরপুর সেনানিবাসে স্টাফ কোয়ার্টারের পশ্চিমের দেয়ালজুড়ে কমলা আভা ক্রমে কালাে হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলেয়ার মুখেও আঁধার ঘনিয়ে আসে। কারণ আকবর এখনাে ফেরেননি। ছােট-বড় দুর্ঘটনার কাহিনী কানে আসে প্রায়ই। সেসব ভাবনায় মনটা অস্থির হয়ে ওঠে আলেয়ার। বুঝতে পারছেন না কী করবেন। আশপাশের ফ্ল্যাটগুলােতে খোঁজ নিয়েছেন। বিকেলেই। কেউ কিছু বলতে পারে না। শুধু একটা চাপা গুঞ্জন সেনা ছাউনিতে গােলমাল হয়েছে। ব্যস, এ পর্যন্তই। আর কোনাে খবর নেই। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ান আলেয়া। ভাঙা কাচের টুকরাের মতাে অজস্র তারা আকাশে। কত দিন হলাে তাদের বিয়ে হয়েছে ! হ্যা, তিন বছর। দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে সময় চলে যায় ! মনির হয়েছে তাও দুই বছর পুরাে হতে চললাে। কদিনের মধ্যে আরাে একজন আসছে। কী হবে কে জানে। আকবর যেমন চান একটা মেয়ে, আলেয়ারও তাই। জানালাটা বন্ধ করে বিছানায় ফিরে আসেন আলেয়া। চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। চারদিক নিঝুম হয়ে আসে। রাত বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে অস্থিরতা। বাইরে কোথাও একটা কুকুর কেঁদে ওঠে। মরা কান্না শুনে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে আলেয়ার। গলাটা শুকিয়ে আসে। সুরা-কালাম পড়ে ফু দেন বুকে। হাত বুলিয়ে দেন মনিরের গায়ে। তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুয়ে থাকেন বিছানায়। এ রকম থাকতে থাকতে একসময় ডুবে যান তন্দ্রায়। আচ্ছন্ন তন্দ্রার মাঝে অস্পষ্ট দুঃস্বপ্ন দেখে থেকে থেকে ভেঙে যায় ঘুম। এলােমেলাে ছেড়াখোঁড়া স্বপ্নটা আর কিছুতেই মনে করতে পারেন না। আবার তন্দ্রায় তলিয়ে যেতে যেতে একসময় রাত পেরিয়ে যায়। কাকড়ােরেই ঝটকা। দিয়ে ভেঙে যায় ঘুম। সম্পূর্ণ চোখ মেলে আলেয়া প্রথমেই ভাবলেন- আকবর কাল ফেরেননি। তখনাে আলেয়া জানেন না, আকবর আর কোনােদিন ফিরবেন না।
আলেয়া ভাবতে চান, ঢাকার বুকে এই ধূসর পেঁচার মতাে অন্ধকারটা হঠাৎ করেই খুব ঘন ঘন যেন নেমে আসছে। মনে পড়ে, ১৫ আগস্টেই একঝাক অন্ধকার মার্চপাস্ট করে ঢুকে গিয়েছিল এ দেশের রাজনীতিতে। শুরু হয়েছিল অন্য ইতিহাস। খুনের রাজনীতির হাত ধরে খুন, হিংসা, লােভ, ক্ষমতা দিনে দিনে ভয়ঙ্কর অন্ধকার সৃষ্টি করেছিল এ দেশে। বাইরে তেমন টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু সেনা ছাউনিতে তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন ছাউনিতে অ্যুত্থানের চেষ্টা আর তা দমন- বারবার রক্তাপুত করছিল সামরিক বাহিনীকে এভাবেই। এ রকমই এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ঘটেছিল ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর। কে বা কারা এই অ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিল তা আজও রহস্য। তবে আকবর নিশ্চয়ই নন। তিনি সামান্য। কর্পোরাল মাত্র। বসদের হুকুমবরদার। বসরা যা করতে বলবেন তাই করবেন। তা ছাড়া ভাের রাতে যখন অ্যুত্থান ঘটে, তখন তিনি স্টাফ কোয়ার্টারে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে একই। শয্যায় ঘুমে অচেতন। অভ্যুত্থান কাহিনীর বিন্দুবিসর্গও তিনি জানতেন না। তাই অফিসে এসেই অ্যুত্থানের দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে ভ্যাবাচেকাই খেয়ে গেলেন তিনি। তার মতাে। আরাে শ শ বন্দি হলাে। সহকর্মীদের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যায় আলেয়ার কানে। আকবর বন্দি। একপলক অবিশ্বাস, কিন্তু তারপরই অচেতন হয়ে ঢলে পড়েন আলেয়া। দুই দিন কেটে যায় এভাবে।
তৃতীয় দিনে তার শূন্য শীতল কোলজুড়ে আসে শরীফউল্লাহ। সন্তান কোলে অপেক্ষা করেন আলেয়া। হয়তাে এর মধ্যে ছাড়া পেয়ে যাবেন। কিন্তু না, আকবর ফেরেন না। কোনাে খোঁজখবরও নেই তার। কোথায় রাখা হয়েছে, কী তার অপরাধ কিছুই জানেন না আলেয়া। একে ধরেন, ওকে ধরেন, যাকে পান তাকেই শুধান। কোলে দুটি শিশুপুত্রকে নিয়ে ছুটে যান সেনানিবাসে। বিমানবাহিনীর সদর দপ্তরে! এ দপ্তর থেকে ও দপ্তর। এ টেবিল থেকে ও টেবিল। কেঁদেকেটে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকেন। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। সবার মুখে কুলুপ আঁটা। সামান্য সহানুভূতিটুকুও দেখায় না কেউ। এভাবে এক সপ্তাহ গেলাে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও ফুরিয়ে আসে। এর মধ্যে অফিস থেকে লােকজন এসে বললাে, কোয়ার্টার ছেড়ে দিতে হবে। অকূল পাথারে পড়েন আলেয়া। স্বামী নেই, উপার্জন নেই, ঢাকায় থাকার মতাে কোনাে জায়গাও নেই, যেখানে থেকে আকবরের খোঁজ করবেন। অগত্যা আলেয়া কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যান মেহেন্দীগঞ্জে। কিন্তু অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। মেহেন্দীগঞ্জে পা দেওয়ার পরপরই মারা যান আলেয়ার বাবা। সাত দিনের শরীফ আর মনিরকে নিয়ে আলেয়া আসেন শ্বশুরবাড়িতে। সেখানেও সান্ত্বনা নেই। শ্বশুরবাড়ির লােকজন তাকে মােটেই পছন্দ করে। কিন্তু আলেয়া নিরুপায়। লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেও পড়ে থাকেন স্বামীর ভিটায়।
শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে যান প্রাণপণে। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে নির্জনে অনেকক্ষণ বসে কাঁদেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাবেন- ফিরে আসবেন আকবর, নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন। জেল হলেও কত দিন আর! তারপর আবার নতুন করে সংসার সাজাবেন। তারা। কিন্তু আকবর ফেরেন না। ঠাঠা রৌদ্রের একদিন যেন বজ্রপাত নেমে আসে আলেয়ার মাথায়। ভগ্নদূতের মতাে ডাকপিয়ন এসে দাঁড়ায় বাহির দরজায়। হাতে আকবরের কাপড়চোপড়, ১২টি টাকা আর বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর থেকে পাঠানাে একটি চিঠি। চিঠির বক্তব্য খুবই সংক্ষিপ্ত- ২ অক্টোবরের অ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালে আকবরের মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হয়েছে।’ ব্যস, এ পর্যন্তই। কবে, কখন, কোথায়, কিছুই আর লেখা নেই। কান্নার রােল ওঠে ভেতঘরে। চিঠি হাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতাে দাঁড়িয়ে থাকেন আলেয়া। বিশ্বাস হয় না। আকবরের ফাসি হবে কেন? ফাসি হওয়ার মতাে কাজ তিনি করতেই পারেন না! নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে। আকবরের সহকর্মীদের কাছে আলেয়া চিঠি পাঠান সেদিনই। লােক পাঠান। কিন্তু কেউ কোনাে খবর দিতে পারে না। ছুটে যান আলেয়া নিজেই। বিমানবাহিনী, তারপর সেনাবাহিনী থেকে নৌবাহিনী। অফিস থেকে অফিসে। উদ্ভ্রান্তের মতাে ছােটাছুটি করেন। ‘ভাই, আমার স্বামীর লাশটা কোথায়? লাশটা অন্তত দেন।’ আহাজারি করে লুটিয়ে পড়েন আলেয়া। কোনাে জবাব মেলে না। মেঝেতে বুটের আওয়াজ তুলে অফিসাররা হেঁটে যান ভ্রুক্ষেপহীন। পাথরে খােদাই করা মুখ। ভাবলেশহীন। স্বামীহারা একটি অসহায় নারীর আহাজারি তাদের বিচলিত করতে পারে না বিন্দুমাত্র ।
ফিরে আসেন আলেয়া। দিন যায়- মরা স্রোতের মতাে বয়ে যেতে থাকে। নিজের অজান্তেই একদিন শরীরে বিধবার পােশাক তুলে নেন আলেয়া। এমনিতেই এ দেশে বিধবার ‘ডান চাইতে ডান নাই/ বাও চাইতে বাও নাই।’ আকবর আছেন- জানার পরও যে গঞ্জনা সইতে হয়েছে তাকে, এবার মৃত্যুদণ্ডের খবর পেয়ে তার মাত্রা চড়ে গেলাে। বউয়েরে সেবিলে পুতেরে পাই’। সেই পুতই যখন নাই, তখন আর এই বউকে খামােখা রেখে লাভ কী? আলেয়ার শত অনুনয় কান্নাকাটি উপেক্ষা করে শ্বশুর-শাশুড়ি জোর করেই বের করে দিলেন তাকে ঘর থেকে। কিন্তু রেখে দিলেন তার নাড়িছেড়া ধন ছেলে দুটিকে। দুর্ভাগা ছেলে দুটি-বাপের ছায়া তাে পায়নি কোনাে দিনই, এবার মাকেও হারালাে। আলেয়ার দুর্ভাগ্য কিন্তু এখানেই শেষ নয়। শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে উঠলেন এসে বাপের বাড়ি। কিন্তু সেখানেও ঠাই মেলেনি। বাবা তাে নেই, ছিল ভাইয়েরা। কথায় বলে, মিত্রের সেবা আপন ভাই/তার ওপর শত্রুও নাই। সত্যিই তাই। আলেয়ার
ভাইয়েরাও একদিন সাফ সাফ জানিয়ে দিলাে, আলেয়াকে তারা রাখতে পারবে না। সে যেন রাস্তা দেখে। উপায়ন্তর না দেখে পাশের এক বাড়িতে ঠাই নিলেন আলেয়া। কাজ নিলেন মক্তবে। কাজ মানে ছাত্রছাত্রীদের কুরআন পড়ানাে। বিনিময়ে এবেলা এর বাড়িতে, ওবেলা অন্য বাড়িতে গিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি। নিত্যভিক্ষা তনুরক্ষা’র মতাে অবস্থা। আর সে যে কী লজ্জার! প্রথম প্রথম গলা দিয়ে নামতে চাইতাে না ভাতের দলা। সহানুভূতির সঙ্গেই ডেকে বসিয়ে খাওয়াত সবাই। কিন্তু এক-একটা লােকমা মুখে তােলার সময়ই চোখ ভিজে উঠতাে আলেয়ার- এ যে বড় করুণার, বুঝতে পারতেন ঠিকই কিন্তু কিছুই করার ছিল। না। মাস শেষে হাতে বেতনের গােনা টাকা নিয়ে আলেয়া ছুটে যেতেন শরীফ আর মনিরের কাছে। এটা-সেটা কিনে দিতেন। মাকে দেখেই ছুটে আসতাে ওরা। কলকলিয়ে কত কথা তখন মা-ছেলেতে। কিন্তু আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। বিদায়ের সােকে আরাে মলিন হয়ে। উঠতাে সেদিনের সন্ধ্যাবেলা। আবার একটা মাস কাটতাে ঐ একটি দিনের অপেক্ষায়। কিন্তু দিন যায় । দিন থাকে না। মনির, শরীফও বড় হয়। স্কুলে যায়। ভালাে রেজাল্টও করে। এর মধ্যে আলেয়ার শ্বশুর মারা যান। শরীফ, মনির একদিন জোর করে নিয়ে। আসে তাদের মাকে। দুই ছেলের মাঝে এবার নিরাপত্তায়, স্বস্তিতে দিন কাটে আলেয়ার। ভুলে যান অতীতের শত লাঞ্ছনা আর কষ্টের কথা। দুচোখে স্বপ্ন ফের ডানা মেলে।… দেখতে দেখতে গড়িয়ে যায় ২০টি বছর। আবারও ফিরে আসে সেই ২ অক্টোবর ১৯৯৭।
মেহেন্দীগঞ্জে রতন চৌধুরী নিয়মিত ভােরের কাগজ পড়েন। ২ অক্টোবর পত্রিকা পাওয়ার পর দ্রুত তার চোখ চলে যায় ডান পাশে। ‘৭৭-এর সেই ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। ধারাবাহিক প্রতিবেদন। দ্রুত খবর দেন তিনি শরীফদের বাড়িতে। পত্রিকা নিয়ে যান। নিজেই। ছুটে আসেন আলেয়া। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন উদগ্রীব হয়ে। ২০ বছরের কৌতূহল ছাপিয়ে ওঠে দুই চোখে। মৃত্যুদণ্ড কি হয়েছিল আকবরের? কবে, কখন? পরপর দুই দিন পত্রিকা ঘেঁটেও হদিস মেলে না। কৌতুহল তীব্র হয়ে ওঠে আলেয়ার। ছােট ছেলে শরীফকে তিনি ঢাকায় পাঠান- যা তাে বাবা, ঢাকায় গিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে। আয় তাে। শরীফের ব্যাকুলতা মায়ের চেয়ে কম নয়। জন্মের পর একবারও দেখেনি। বাবাকে। ঢাকায় ছুটে আসে সে পরদিনই বড় ভাই মনিরের কাছে। মনির খালার বাসায়। থেকেই ভাওয়াল কলেজে অনার্স পড়ে। সেও পত্রিকা দেখছে প্রতিদিন। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না বাবাকে। শরীফ আসার পর দুভাই মিলে ২২ অক্টোবর রাতে ভােরের কাগজ অফিসে চলে আসে। খুঁজে বের করে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে। মলিন মুখে জানতে চায় আপনাদের কাগজে নাকি ফাসির তালিকা ছাপা হচ্ছে? আমার বাবার নাম কি আছে? বড়
করুণ এই প্রশ্নে হেমন্তের রাত যেন সেদিন আরাে মলিন হয়ে ওঠে। শুকনাে মুখে রিপাের্টার উঠে গিয়ে পুরােনাে ফাইল খুঁজে দেখান তাদের। উদগ্রীব হয়ে দুভাই ব্যাজ নম্বর মিলিয়ে দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে এক জায়গায় থমকে যায় | চোখ। নিঃশব্দে চোখের কোল ভরে ওঠে জলে। হ্যা, তাদের বাবাকে ১৯৭৭ সালে ২৬ অক্টোবর ফাঁসি দেওয়া হয়েছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। কবর দেওয়া হয়েছে। আজিমপুর গােরস্থানে। নামের তালিকায় বাবার নামটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দুভাই। নীরবে নিঃশব্দে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে শরীফ আর মনিরের। তুমুল তােলপাড় করে বুকের ভেতরটা। এই একটু সংবাদের জন্যই তাে কত দেন-দরবার, কত কাকুতি-মিনতি করেছে ওরা, ওদের মা। অথচ জানতে পারেনি। এইটুকুর জন্যই তাে স্কুল-কলেজে ভর্তির সময় পিতার নামের ঘরে মরহুম লিখতে গিয়ে বারবার কেঁপে গেছে ওদের হাত। কেউ যখন জিজ্ঞেস করেছে কবে মারা গেছে তােমার বাবা? বলতে পারেনি ওরা। বােবার মতাে চেয়ে থেকেছে। দাদা মারা যাওয়ার পর সবার সঙ্গে কবর জিয়ারত করতে গিয়ে মনে পড়েছে বাবার কথা। বাবার কবর কোথায়? কবর হয়েছে তাে? সব প্রশ্নের অবসান হলাে ২০ বছর পর। চোখ তুলে বাইরে তাকায় শরীফ। অন্ধকার চারদিকে। লােডশেডিং চলছে। তার মধ্যে রাস্তাঘাটে গাড়িগুলাে আলাে জ্বালিয়ে অস্থিরভাবে এদিক-সেদিক ছােটাছুটি করছে। ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে ওরা পত্রিকা অফিস থেকে। সেই রাতেই চিঠি পাঠিয়ে দেয় মনির তার মায়ের কাছে আর চারদিন পর বাবার মৃত্যুদিবস। মিলাদ ও কুরআনখানির ব্যবস্থা করাে। আমরা আসছি। দুদিন পরই লঞ্চে ওঠে। সন্ধ্যার দিকে ভেঁপু বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দেয় বরিশালের উদ্দেশ্যে। বাইরে তখন গভীর রাত। ধু-ধু অন্ধকার। তার মধ্যে একটানা ঘড় ঘড় আওয়াজ করে পানি কেটে চলে যায় লঞ্চ। কান পাতলে ঢেউয়ের শব্দ টের পাওয়া যায়। চুপচাপ বসে থাকে ওরা ডেকে, এককোণে। দৃষ্টি বাইরে নদীর বুকে। নদীতে ঢেউ আছে কিন্তু এই অন্ধকারে তা দেখা যায় না।
আলেয়ার এ কাহিনী কোথায় যেন সবাইকে মােহাবিষ্ট করে ফেলে! ট্র্যাজেডির করুণ রস কেন এ দেশে ইতিহাসের পরতে পরতে? সে কারণেই কি আলেয়ারা বারবার চরিত্র হয়ে ওঠে গল্প, উপন্যাস, নাটক বা চলচ্চিত্রে? তবে এ সবই যদি জীবন-ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি হয়, তাহলে তার অন্তর্নিহিত রূঢ় বর্ণনাটি কী? আলেয়া-আকবরের | ধূসর পাণ্ডুলিপি সেখানে কি নয় আরাে | সাদামাটা বাস্তব! আকবর যে রাতে আর ফিরছিলেন না, সে রাতে সেনা ছাউনিতে | গােলমালের খবরটি পােকমুখে আলেয়ার কানে ঠিকই এসেছিল। অস্থির আলেয়া তখন তার কিনারা করতে পারেননি। ২০ বছর পর স্বামী হারানাের দিনক্ষণ প্রকাশ হলে জানতে পারেন কী এক অন্যায় আকবরের জীবন কেড়ে নেয়। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সামরিক বাহিনীতে রহস্যময় রক্তাক্ত অভ্যুত্থান চেষ্টার পর বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে গােপন বিচারে শত শত সৈনিক ও নন-কমিশন্ড অফিসারের ফাঁসি হয়, বিভিন্ন মেয়াদে হয় দণ্ড। ফায়ারিং স্কোয়াডেও বিনা বিচারে সেনা ও বিমানবাহিনীর বহু সদস্য প্রাণ হারান। আকবর তাদেরই একজন।
ছিনতাই করা বিমান ঢাকায় ও ব্যর্থ অভ্যুত্থান
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় সামরিক বাহিনীর একটি অংশের অ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগে তৎকালীন সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের কথিত বিচারে সেনা ও বিমানবাহিনীর যেসব সদস্যকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে ১৯৩ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায় । ঐ ঘটনায় পূর্বাপর মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এটা স্পষ্ট যে বিচারের আওতার বাইরেও অনেককে মরতে হয়েছে। অ্যুত্থান-পরবর্তী দুই মাস এক হাজার একশ থেকে এক হাজার চারশ সৈনিককে ফাসিতে ঝুলিয়ে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছিল। ঐ সময় শুধু ঢাকা ও কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈনিকদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ঢাকায় ১২১ জন আর কুমিল্লায় ৭২ জনের ফাঁসি হয়। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগে পাঁচ শতাধিক সৈনিককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ১৯৮৭ সালে বিমানবাহিনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস’ পুস্তিকার একটি অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ঐ ঘটনার পর প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ৫৬১ জন বিমান সেনাকে হারাতে হয়েছিল । আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাত দিয়ে ১৯৭৭ সালে ৩ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমসে 100 Reported killed in Dacca Coup Attempt’ শিরােনামে অ্যু ত্থান সম্পর্কিত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৭৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন পােস্টে ‘Bangladesh Executions : A Discrepancy’ শীর্ষক রিপাের্টে বলা হয় : ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে একটি গােপনীয় তারবার্তায় ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জানান, তার পাওয়া তথ্য অনুসারে ২১৭ জন মিলিটারি সদস্যকে কু প্রচেষ্টার পরবর্তীকালে হত্যা করা হয়। ‘আমাদের মনে হয় মিলিটারি কোর্ট স্থাপনের আগেই সম্ভবত এদের ৩০-৩৪ জনকে হত্যা করা হয়’- বলেন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আলফ্রেড ই বার্গেনসেন। এই উদ্ধৃতির পরই রিপাের্টার লুইস এম সিমন্স বলেন, চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের এই বক্তব্য
ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের রিপাের্টকেই সমর্থন করে। তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার অনুগত সৈনিকরা কোর্ট মার্শালে বিচারের জন্য নেওয়ার আগেই অনেক বিদ্রোহীকে হত্যা করে। লন্ডন টাইমসের ১৯৭৮ সালের ৫ মার্চ সংখ্যায় এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথােপকথনের বরাত দিয়ে বলা হয়, ঐ ঘটনায় সামরিক বাহিনীর আট শতাধিক সদস্যের সাজা হয় এবং প্রায় ৬০০ জনকে ফাঁসির মাধ্যমে কিংবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়, যাদের অধিকাংশই বিমানবাহিনীতে ছিলেন। অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ রচিত ‘মিলিটারি রােল অ্যান্ড দ্য মিথ অব ডেমােক্রেসি’ গ্রন্থে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর লেখা ‘Democracy and the Challenge of Development: A Study of Politics and Military Interventions in Bangladesh গ্রন্থে ২ অক্টোবরের অ্যুত্থানে ১৭ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের দায়ে সেনাবাহিনীর ৪৮৮ জন সদস্যের হয় ফাসি নয়তাে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার তথ্য তিনি উল্লেখ করেন। যেসব সেনা ও বিমান সৈনিককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তাদের আত্মীয়-স্বজনকে না জানিয়ে, অতি গােপনে রাতের আঁধারে আজিমপুর কবরস্থানে তাদের ১২১ জন ও অপর ৭২ জনকে কুমিল্লায় দাফনের নামে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ফাঁসির আসামিরা জানতে পারেননি কী ছিল তাদের অপরাধ! মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শুধু তাদের সামনে রায় পড়ে শােনানাে হতাে। ফাসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনরা অনেকে এখনাে জানেন না লাশ কোথায় দাফন করা হয়েছে। অক্টোবরের সে অভ্যুত্থান কী কারণে, কাদের পরিকল্পনায় সংঘটিত হয়েছিল তা আজও অজ্ঞাত রয়েছে। তকালীন সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকদের বৃহৎ অংশ পরবর্তীকালে অভ্যুত্থানের কথা শুনলেও বিস্তারিত কিছুই জানতেন না। দেশবাসীর মতাে তারাও অন্ধকারে ছিলেন। অক্টোবরের ১ তারিখ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২ তারিখ ভােরে কর্নেল তাহেরের অনুসারী সেনা ও বিমান জওয়ানরা এক অভ্যুত্থানে অংশ নেয়, যা সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপক রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে তকালীন সামরিক সরকার-সমর্থক সৈনিকরা ব্যর্থ করে দেয়। ঐ সময়ে পুরােনাে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জাপান এয়ারলাইন্সের একটি ডিসি-৮ বিমান জাপানি সন্ত্রাসী গােষ্ঠী ‘রেড আর্মি’ কর্তৃক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৫৬ জন যাত্রীসহ বিমানটি বােম্বে (মুম্বাই) থেকে ব্যাংকক যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীরা তেল নেওয়ার অজুহাতে বিমানটিকে ঢাকায় অবতরণ করায়। তারা জাপান সরকারের কাছে ৯ জন সহযােগী বন্দির মুক্তি ও ৬০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবি করে। জাপান সরকার ও ছিনতাইকারীদের মাঝে সমঝােতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর তৎকালীন
প্রধান এ জি মাহমুদ ছিনতাইকারীদের সঙ্গে অবিরাম ৮৬ ঘন্টা আলােচনা করে একটি সমঝােতায় আসতে সক্ষম হন। ১ অক্টোবর জাপান সরকার ছয়জন (তিনজন বন্দি। আসতে অস্বীকৃতি জানায়) বন্দি ও ৬০ লাখ ডলার দিয়ে একটি বিশেষ বিমান পাঠায়। ২ অক্টোবর রাত ৯টা ১০ মিনিটে ছিনতাইকারীরা মুক্তিপণ নিয়ে বিমানসহ ঢাকা ত্যাগ করে। সঙ্গে নিয়ে যায় ২৪ জন যাত্রী। এ সমঝােতার পুরাে ঘটনাটি বাংলাদেশ। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। অপরদিকে ১ অক্টোবর দিবাগত রাতে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অত্যুত্থানে অংশ নেওয়া সৈনিকরা ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবাহিনীর অফিসার্স মেস, বিমানবন্দর ও রেডিও স্টেশনে সশস্ত্র হামলা চালায়। তারা অস্ত্রাগারে লুটতরাজ চালায়। কিন্তু সেখানে কোনাে গােলাবারুদ ছিল না। সেগুলাে আগেই জয়দেবপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অ্যান্থনি। মাসকারেনহাস লিখিত এ লিগেসি অব ব্লাড গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, সিগন্যালম্যান শেখ আব্দুল লতিফ (সেন্ট্রির দায়িত্বে ছিলেন) প্রথম রাইফেলের ১ রাউন্ড গুলি ছােড়েন। গুলির শব্দ শুনে ব্যারাক থেকে সৈন্যরা বের হয়ে আসে। ঐ দিন শেষ রাতে ইউনিফরম ও সিভিল ড্রেসে সৈনিকরা ট্রাক ও জিপ নিয়ে এসে হ্যান্ডমাইকে ঘােষণা করে যে বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে, সবাই অংশ নিন। তারা ঘুমন্ত সৈনিকদেরও জোর করে ব্যারাক থেকে বের করে আনে।
এ সময় পুরাে এলাকায় বিদ্যুৎ সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। অভ্যুত্থানকারী। একদল সৈনিক পুরােনাে বিমানবন্দরের টাওয়ার ভবনের ওপর দিকে হ্যাঙ্গারের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে বিমানবাহিনীর সাতজন অফিসারকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। আরাে চারজন অফিসারকে বিমানবন্দর এলাকায় হত্যা করা হয়। সরকারি হিসাবে ঐ দিন বিমানের ১১ জন অফিসার ও অপর এক অফিসারের পুত্র এবং আরাে ১০ জন সেনা সদস্য নিহত হয়। আহত হয় ৪০ জন। বিমানবন্দর এলাকায় বিদ্রোহীরা হামলা চালানাের আগে রাতে ১২টা-১টার দিকে জেনারেল জিয়ার আবাসস্থলে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু জেনারেল জিয়া ঘটনা আগে থেকেই বুঝতে পেরে তার বাসভবনের চারদিকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছিলেন। বিদ্রোহীরা জিয়ার নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের প্রতিরােধে টিকতে পারেনি। পরে সেখান থেকে এসে বিভিন্ন স্থানে তারা এলােপাতাড়ি হামলা চালায়। জিয়ার বাসভবনের আশপাশেও দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রচুরসংখ্যক সৈনিক প্রাণ হারিয়েছে। অ্যুত্থান প্রচেষ্টায় অংশ নেওয়া সৈনিকদের একটি অংশ সকালে শাহবাগ রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। একজন সার্জেন্ট নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে ভাষণ দেন। তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বলে ঘােষণা দেন এবং বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হবে, যার প্রধান হবেন তিনি নিজেই। তিনি সবাইকে সিপাহি বিপ্লবে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান, কি নবম ডিভিশনের সদর দপ্তরের নির্দেশে সাভার ট্রান্সমিশন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ায় দেশবাসী ঐ ভাষণ পুরােটা শুনতে পারেনি। নবম ডিভিশনের তৎকালীন জিওসি জেনারেল মীর শওকত আলী মেজর আবেদিনকে রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ দেন। মেজর আবেদিন শেরাটন হােটেলের কাছে অ্যাম্বুশ করে
রেডিও স্টেশন থেকে সৈনিকদের বের হয়ে আসার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই। রেডিও স্টেশনে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে বিমানবন্দর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেসব সৈনিক বিদ্রোহে অংশ নেয়, তারা কুর্মিটোলায় বিমান সেনা ছাউনি থেকে বিমানবন্দরের দিকে ফিরে যাওয়ার পথে মহাখালীতে বাধা পায়। এখানে প্রচুর গােলাগুলি হয়, যাতে বহুসংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়। অন্যদিকে আরেকদল সৈনিক আগারগাঁও দিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে অগ্রসর হয়। তারাও সেখানে মুহূর্তের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বিদ্রোহী সৈনিকদের আটক করা হয়। এভাবেই অ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। ঐ দিনই প্রায় ২০০ সৈনিক নিহত হয়েছিল। যদিও এদের সবার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিছু লাশ তাদের পরিবারের কাছে পৌছে দেওয়া হয়েছিল। বাকি লাশ গুম করা হয়। সে সময় বিমান ছিনতাই ঘটনায় সমঝােতার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন জাপানের তল্কালীন ট্রান্সপাের্ট অ্যান্ড সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রী হাজিমি ইশি। পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিমানবন্দরে অবস্থানকালে স্বচক্ষে ৫০টিরও বেশি লাশ দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। ঐ অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর সার্ভিস সেক্টরের কতিপয় সৈনিক (যেমন সিগন্যাল কোর, সাপ্লাই ইএমই, ইঞ্জিনিয়ার, অর্ডন্যান্স ও মেডিকেল কোর) এবং বিমানবাহিনীর কতিপয় সৈনিক সম্মিলিতভাবে অংশ নিয়েছিল। এর নেতৃত্বে ছিল মূলত সিগন্যাল কোরের সদস্যরা। বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে সার্জেন্ট আফসার ও সিগন্যাল কোরের হাবিলদার মুজিবর রহমান এ বিদ্রোহের সূচনা ঘটান।
আগে ফাঁসি, পরে কমিটি-কমিশন
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ব্যর্থ অ্যুত্থানের পরে তাতে জড়িত থাকার অভিযােগে চলতে থাকে ধরপাকড় ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। তথাকথিত বিচারের নামে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর জুনিয়র কমিশন্ড ও নন কমিশন্ড শত শত অফিসার ও সাধারণ সৈনিকরা এ হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়। দ্রুত গঠিত বেআইনি সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তাদের অনেকের ফাঁসি কার্যকর হয়। এ সম্পর্কে দেশবাসীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়। সব কিছুই হয় অতি গােপনে। মাঝেমধ্যে আইএসপিআর-এর বিজ্ঞপ্তি ও জেনারেল জিয়া তার ভাষণের মাধ্যমে জনগণকে অতি আংশিক ধারণা দেন। পত্রপত্রিকায় এ-সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন নিষিদ্ধ করা হয়। বিদেশি বেতারসমূহে অভ্যুত্থানের খবর ও সামরিক অফিসারদের সম্পর্কে মন্তব্য করা হলে কড়া প্রতিবাদ জানানাে হতাে। এ অ্যুথানের খবর ৮ অক্টোবর রাতে প্রথম বিবিসির মাধ্যমে দেশবাসী কিছুটা জানতে পারে। ঐ রাতে রয়টার্সের সংবাদদাতা বারনার্ড মিলনাস্কির উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি রেডিও একটি প্রতিবেদন প্রচার করে। মিলনাস্কি অক্টোবরের ২ তারিখ ঢাকায় ছিলেন, পরে দিল্লি চলে যান। সেখান থেকে তিনি বিবিসিতে প্রতিবেদন পাঠান। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের জিম্মি মুক্তিদানের আলােচনা যখন চূড়ান্ত, তখন সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহীরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায়। বিদ্রোহীদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত কতিপয় ব্যক্তিও ছিল। আপাতত মনে হয় যে অ্যুত্থান ঘটানাের জন্য তারা বেশ উপযুক্ত সময় বেছে নিয়েছে। বিমানবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন জাপানি বিমান ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আলােচনায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় তারা ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানবন্দরে হামলা চালায়।
এ ব্যর্থ অ্যুত্থানে সেনা ও বিমানবাহিনীর অন্তত ১০০ জন জওয়ান অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুগত সৈন্যরা তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। কিন্তু তার আগেই বিদ্রোহীরা বিমানবাহিনীর কয়েকজন অফিসারকে হত্যা করে।’ ‘বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস’ ( বিমানবাহিনী থেকে প্রকাশিত, ১৯৮৭) বইতে ঐ অভ্যুত্থানের দিনকে ‘কালাে দিন হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, বিদ্রোহ বেশিদূর এগােতে পারেনি, কেননা বিদ্রোহের নায়করা অন্যান্য ইউনিট থেকে সৈন্যদের তাদের দলে টেনে আনতে ব্যর্থ হয়। তবে এ বইতে সরকার নির্দেশিত বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারে ও পরে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মােট ৫৬১ জন বিমানসেনা হারানাের ঘটনা ক্ষুদ্র বিমানবাহিনীর জন্য অতি অপূরণীয় ক্ষতি’ বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে ঢাকায় অ্যুত্থানের ঠিক আগের রাতে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে একটি ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। তাদের হাতে লেফটেন্যান্ট মােহাম্মদ হাফিজ ও সেনাবাহিনীর অপর একজন অফিসার নিহত হন। ঐ বিদ্রোহের প্রভাবও ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ দুটি অ্যুত্থানের কোনাে খবর এবং জড়িতদের বিচারের জন্য যে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, তার কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তঙ্কালীন সামরিক সরকার জনগণকে অবহিত করেনি। যদিও ১১ অক্টোবর জেনারেল জিয়া ৬০ জন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে বৈঠকে ঘােষণা করেন, বগুড়া ও ঢাকার ঘটনাবলির উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করা হবে এবং জনগণকে ঘটনাবলির প্রকৃত সত্য জানানাে হবে (সূত্র : ১২ অক্টোবর ৭৭, দৈনিক সংবাদ)। ৯ অক্টোবর সরকার আইএসপিআর-এর (আন্তঃবাহিনী জনসংযােগ পরিদপ্তর) মাধ্যমে প্রথমবারের মতাে জানায় যে বগুড়া ও ঢাকায় বাইরের শক্তির প্ররােচনায় সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে যে মিউটিনি হয় তার জন্য দায়ী সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিচারের উদ্দেশ্যে সরকার সামরিক আইন-বিধির অধীনে কয়েকটি মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায় থেকে নেওয়া পাঁচজন সদস্যের সমম্বয়ে প্রতিটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার শুরু করেছে (দৈনিক সংবাদ ১০ অক্টোবর ‘৭৭)। সরকার যে রাতে ঐ বক্তব্য প্রচার করে সে রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অভিযুক্তদের ফাঁসি কার্যকর শুরু হয়ে যায়। অবশ্য জেনারেল জিয়া ১৪ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এর ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ডসহ ট্রাইব্যুনালের সব রায় কার্যকর হচ্ছে। একই ভাষণে তিনি জাসদ, ডেমােক্রেটিক লীগ ও মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন সিপিবি- এই তিনটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ঘােষণা দেন। এদিকে ঢাকা ও বগুড়ার অ্যুত্থানের বিষয়ে সরকার ১৭ অক্টোবর বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে। ১৮ অক্টোবর আইএসপিআর-এর মাধ্যমে সরকার জানায়, ঢাকায় বিদ্রোহীদের। মধ্যে স্থল ও বিমানবাহিনীর ৪৬০ জন ব্যক্তির বিচার হয়েছে। ৩৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। ২০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, ৬৩ জন খালাস পেয়েছে, বিচার চলছে।’ অপর ৩৪০ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানানাে হয়নি। অপরদিকে ২৬ অক্টোবর সরকার ইতিপূর্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বাতিল করে দিয়ে বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি এ টি এম মাসুদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। ঐসব কমিটি-কমিশন মূলত আন্তর্জাতিক চাপে করা হয়েছিল। ঐ কমিশন একটি
রিপাের্টও দেয়, কিন্তু জেনারেল জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। ঐ কমিশন গঠনের আগেই তথাকথিত বিচারের মাধ্যমে অভিযুক্তদের ফাঁসি কার্যকর প্রায় শেষ হয়ে যায়। অ্যুত্থানের পরেই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া নিজের নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর ওপরতলায় দ্রুত রদবদল ঘটান। পাশাপাশি তিনি তার ক্ষমতার ভিত্তি সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতার বাইরে রাজনৈতিকভাবে সম্প্রসারণে মনােযােগী হন। এ পর্যায়ে জেনারেল জিয়া তার ঢাকা নিরাপদ করাে’ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে অক্টোবর মাসেই ডিজিএফআই প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলামকে অবসর দিয়ে ব্রিগেডিয়ার মহব্বত জান চৌধুরীকে ঐ পদে নিয়ােগ দেন। জেনারেল শওকতকে যশাের ৫৫ ডিভিশনের জিওসি এবং জেনারেল মঞ্জুরকে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি করে চট্টগ্রামে বদলি করেন। ঐ সময়ে এ দুই জেনারেলের মাঝেও বিরােধ চরমে পৌঁছেছিল। আবার দুজনেই অ্যুত্থান ও পরবর্তী ঘটনার জন্য জেনারেল জিয়াকে দায়ী করেছিলেন। এ ছাড়া ব্রিগেডিয়ার এম নূরউদ্দীনকে কুমিল্লা ব্রিগেডে এবং জেনারেল এইচ এম এরশাদকে ঢাকা ডিভিশনের জিওসি নিযুক্ত করেন। ৪৬ ব্রিগেডকে নবম ডিভিশনের অধীন করা হয়। বগুড়ায় অবস্থানরত ২২ বেঙ্গল বিলুপ্ত করা হয়। বিমানবাহিনীর প্রধান এ জি মাহমুদের গতিবিধিও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দিন তার ‘মিলিটারি রুল অ্যান্ড দ্য মিথ অব ডেমােক্রেসি’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেছেন, অক্টোবরের অ্যুত্থানের পরপর জেনারেল জিয়া ঢাকা নিরাপদ করাে’ পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক শক্তিগুলােয় তার ক্ষমতার ভিত্তি দৃঢ় করার উদ্যোগ নেন। সে ধারাবাহিকতায়ই তিনি পরে বিএনপি গঠন করেন। টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গণফাঁসি, কাফ্টর মধ্যে দাফন
‘৭৭-এর ২ অক্টোবর অ্যুত্থান দমনের পর থেকেই সশস্ত্র বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্যকে। কোনাে কিছু না জানিয়ে কর্তব্যরত অবস্থায় আটক করা হয়। এদের প্রায় সবাইকে পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হয়। কারাগারে ঠাই না পাওয়াদের রাখা হয় সেনানিবাসের ভেতরে বিভিন্ন নির্যাতন সেলে। তাদের হাত-পা-চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলতাে অকথ্য নির্যাতন। সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ছােট্ট একটি কক্ষে ৫০-৬০ জনকে একই সঙ্গে রাখা হতাে। অপরদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের ৭ অক্টোবর থেকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য শুরু হয়। বন্দিদের এই বিচার চলে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত। ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দেওয়ার জন্য প্রতিদিন কারাগার থেকে বাস ভর্তি করে সশস্ত্র প্রহরায় তাদের সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া এবং ফিরিয়ে আনা হতাে। সামরিক আদালতের রায় প্রতিদিন রাত ৯টার মধ্যে বন্দি সামরিক ব্যক্তিদের জানানাে হতাে। যাদের ফাঁসির আদেশ হতাে তাদের সঙ্গে সঙ্গে ‘কনডেমড সেলে পাঠানাে হতাে। রায় জানানাের রাতেই কিংবা পরের রাতে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হতাে। অভিযুক্তদের রায় শােনানাের সঙ্গে সঙ্গেই আর্তচিৎকার শােনা যেতাে, ‘হে আল্লাহ, তুমি ! সাক্ষী থেকো আমি কোনাে অপরাধ করিনি। যে জালেম আমার ফাঁসি দিচ্ছে তারও যেন এমন মৃত্যু হয় ইত্যাদি। ফাঁসির পর লাশ ড্রপ করার শব্দ শুনেই পার্শ্ববর্তী সেলের বন্দিদের মাঝে কান্নার রােল পড়ে যেতাে। ‘৭৭-এর অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কারাগারগুলােতে যখন সন্ধ্যা নেমে আসতাে তখন প্রতিটি কক্ষ থেকে ভেসে আসতাে গগনবিদারী কান্নার রােল। সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে কারা কর্তৃপক্ষ এতই তড়িঘড়ি করে ফাসি দিচ্ছিল যে একই নামের একজনকে ফেলে অন্যজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিচ্ছিল। পশুপাখির মতাে, জোর করে টেনেহিচড়ে নিয়ে গলায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হতাে। প্রাণ যাওয়ার আগেই হাত-পায়ের রগ কেটে ফেলা হতাে। কারাগারের ড্রেনগুলাে সৈনিকদের রক্তে ভরপুর। হয়ে যেতাে। ৯ অক্টোবর থেকে প্রতি রাতেই তিন বা চার ড্রপে (প্রতি ড্রপে দুজন করে) ফাঁসি দেওয়া হতাে। রাত ১২টার পর থেকে ৩টা পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর হতাে। প্রতি রাতে যে কজনের
ফাসি হবে তার সংখ্যা সূত্রাপুর ও লালবাগ থানার ওসিকে জানিয়ে রাখা হতাে। সূত্রাপুর থানার ওসি কাফনের ব্যবস্থা করতেন আর লালবাগ থানার ওসির দায়িত্ব ছিল দাফনের ব্যবস্থা করা। রাত সাড়ে ৩টায় একটি ট্রাক কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে আসতাে। ট্রাকে করে লাশ আজিমপুর কবরস্থানে পাঠানাে হতাে। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা সংখ্যা অনুযায়ী কয়েকজন শ্রমিক কবর খুঁড়ে রাখতাে। কোনাে সময় জানাজা হতাে আবার কোনাে সময় জানাজা ছাড়াই লাশ দাফন হতাে। ভাের হওয়ার আগে অত্যন্ত গােপনীয়তার সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরায় লাশ দাফনের কাজ শেষ করা হতাে। দাফনকৃতদের মধ্যে দুজন হিন্দুর লাশও ছিল। অবশ্য এর আগে জেল ডাক্তার নামকাওয়াস্তে লাশের ময়নাতদন্ত করতেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোনাে অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসি দেওয়া হয় । কিন্তু এদের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। অনেক অসুস্থ, অর্ধমৃত ব্যক্তিকেও ফাসিতে ঝােলানাে হয়েছিল। যাদের কবর খোড়ার কাজ দেওয়া হয়েছিল, তাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছিল, কেউ যেন এ খবর জানতে না পারে। কবর খোঁড়ার সময় শ্রমিকরাও আহাজারি করতেন, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতেন- এত লাশ আসে কোথেকে। ৯ অক্টোবর থেকে শুরু করে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাসি আর আজিমপুরে দাফন চলতে থাকে। ঐ সময় ঢাকায় রাত ১০টা থেকে ভাের ৫টা পর্যন্ত কার্য্য বলবৎ ছিল। এই কদিনের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১২১ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। তাদের সবাইকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে ফাঁসির আসামির সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি দিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পারায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হয়। সেখানে ২৯ অক্টোবর ‘৭৭ থেকে ২৭ জানুয়ারি ‘৭৮-এর মধ্যে ৭২ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করতে গিয়ে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকেও ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার নজির আছে। যেমন কর্পোরাল আফতাব নামের এক ব্যক্তির ফাঁসির আদেশ হয়, কিন্তু একই নামে অপর এক কর্পোরালকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে গেলে তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন তার ফাঁসির আদেশ হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাজ নম্বর মিলিয়ে দেখার পর তিনি বেঁচে যান। এদের কী কারণে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে কিংবা তারা কোথায় আছেন এ ধরনের কোনাে সংবাদ তাদের আত্মীয়-পরিজনকে জানানাে হয়নি। ফঁসি হওয়ার বছর খানেক পরেও অনেকের আত্মীয়-স্বজন নিহতদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছিলেন। সিপাহি নিজামউদ্দিনের (ব্যাজ নং-৬৮৬৪৩৩) ভাইয়ের ছেলে নাসিরউদ্দিন তার চাচার ফাসি হওয়ার পর তাদের বাড়িতে এ রকম ওয়ারেন্ট পান, যাতে
বলা হয়, নিজামউদ্দিন অস্ত্রসহ পালিয়ে গেছে। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় কর্পোরাল খিরাজের বাসায় চিঠি পাঠানাে হয় যে, খিরাজ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মারা গেছেন। কর্পোরাল খিরাজের পুত্র মনিরুজ্জামান মল্লিক তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছে এ কথা। মনিরুজ্জামানের বয়স ছিল তখন মাত্র তিন-চার মাস। সার্জেন্ট তােফাজ্জল হােসেনের (বিডি ৭৭০৪৫) স্ত্রীকে বিমানবাহিনীর রেকর্ড অফিস থেকে ২৮ ডিসেম্বর ‘৭৭ তারিখে স্কোয়াড্রন লিডার এম জামসেদ আলী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানাে হয়, তােফাজ্জল হােসেন অক্টোবরের ১ ও ২ তারিখের ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালে তার সাজা হয়েছে। সাজার পর তাকে কারাগারে পাঠানাে হয়েছে। পরবর্তী খবর যথাসময়ে জানানাে হবে।’ অথচ ১০ অক্টোবর ‘৭৭ তারিখেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তােফাজ্জল হােসেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফ্লাইট সার্জেন্ট আব্দুর রশীদের (ব্যাজ নং-৭২৯৮০) স্ত্রী মাহফুজা রশীদ ২ অক্টোবরের পরবর্তী ছয় মাস জানতেন না তার স্বামী কোথায়। অনেক পরে শুনেছেন ফাসি হয়েছে। কিন্তু কবে? নানা দপ্তরে যােগাযােগ করেও জানতে পারেননি। এই লেখকের কাছে তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘মৃত্যু দিবসটাও পালন করতে পারি না।’
অতি দ্রুত ফাসির জন্যই সামরিক ট্রাইব্যুনাল
অ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়া বিদ্রোহী সৈনিকদের বিচার করার জন্য যে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন তা ছিল মূলত দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করার জন্যই। কারণ, বাংলাদেশে আর্মি ও এয়ারফোর্স অ্যাক্ট অনুযায়ী শুধু জেনারেল কোর্ট মার্শাল মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। এ রকম কোর্ট মার্শালে বিচারক হিসেবে কমপক্ষে পাঁচজন অফিসার থাকতে হবে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন কোর্ট মার্শালে বিচারকদের একজন অন্তত লে. কর্নেল থাকবেন এবং বাকি চারজনের কেউ ক্যাপ্টেন র্যাংকের নিচে হতে পারবেন না। এবং ক্যাপ্টেনদেরও প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি কমপক্ষে তিন বছর হতে হবে। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যাপ্ত সুযােগ দিতে হবে। কিন্তু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া এ ধরনের নিয়মমাফিক কোর্ট গঠনের জন্য যতটুকু সময় প্রয়ােজন, তাও দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। সশস্ত্র বাহিনীর আইনও এড়িয়ে যাওয়ার জন্য তিনি মার্শাল ল’ অর্ডারে রাতারাতি মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ঐসব ট্রাইব্যুনালে। নন-কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিকদেরও বিচারক হিসেবে রাখা হয়। বিচারের নামে তারা আসলে হুকুম তামিল করেন মাত্র। ৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল গঠন হয় আর ৯ অক্টোবরই ফাঁসি কার্যকর শুরু হয়। এক দিনের ব্যবধানে বিচারপৰ্ব ও ফাঁসি কার্যকর করার মধ্যেই বােঝা যায়, দ্রুত ফাঁসি দেওয়াটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। মাত্র দুই দিনে অর্ধ শতাধিক সৈনিকের বিচারপৰ্ব ও ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বিন্নি মেয়াদে শাস্তিপ্রাপ্ত সৈনিকদের কাছে এ সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার নিতান্তই প্রহসন। এর সত্যতা পাওয়া যায় সার্জেন্ট কবীরের ফাঁসির ঘটনায়। সার্জেন্ট কবীর আহমেদ (ব্যাজ নং-৭৩৩০১) ২ অক্টোবর স্কাই মিলিটারি ডিউটি শেষ করে বিমানবন্দরে আসেন। এসেই পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সিওডিতে যান অস্ত্র জমা দিতে। কিন্তু গিয়ে দেখেন অস্ত্রাগার লুট হয়ে গেছে। তাই তিনি অস্ত্র জমা না দিয়ে তা নিজের কাছেই রেখে দেন। এই অভিযােগে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ২১ নভেম্বর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। জেনারেল জিয়ার ঘােষণা অনুযায়ী ৭ অক্টোবর থেকে ট্রাইব্যুনাল গঠন শুরু হয়। ১৮টি
সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালই সামরিক অফিসার ও সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়। অভিযুক্তদের মাঝে ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে যেহেতু সব অভিযুক্তই নন-কমিশন্ড অফিসার, তাই তাদের সুবিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালে সাধারণ সৈনিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তরা যেন বলতে না পারেন, বিচার। একতরফাভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এমনই একটি সামরিক ট্রাইব্যুনালের উদাহরণ হলাে- মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনাল নং-১৮, ঢাকা কেস নং-১/১৯৭৭, তাং ৮ অক্টোবর ১৯৭৭। জজ : (১) লে. কর্নেল কাজী সলিমুদ্দিন মাে. শাহরিয়ার (২) সুবেদার মাে. আব্দুল হালিম (৩) নায়েক সুবেদার আব্দুল হাকিম (৪) হাবিলদার আনােয়ার হােসেন (৫) হাবিলদার এন এফ আহমেদ। অভিযুক্তরা হলেন- (১) ৬২৭৪০২৮ নায়েক এনামুল হক (২) ৬২৮৪৫৪ সিগন্যালম্যান কাজী সাইদ হােসেন (৩) ৬২৮১১৮৬ নায়েক আব্দুল মান্নান (৪) ৬২৮৪৭৩৬ সিগন্যালম্যান এস কে জাবেদ আলী। বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল এই চারজনকেই ফাঁসির আদেশ দেয়। ৯ অক্টোবর জেনারেল জিয়া ঐ আদেশের অনুমােদন দেন। ১৬ অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের ফাসি হয়। অ্যুথানে জড়িত থাকার অভিযােগে আট বছরের সাজা হয়েছিল কর্পোরাল আনােয়ার ঠাকুরের। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, কুর্মিটোলা ব্যারাক থেকে সেনা সদস্যরা তাকে প্রথমে তকালীন নবম ডিভিশনের সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫-২০ দিন অমানুষিক নির্যাতন চলে তার ওপর। তিনি বলেন, নবম ডিভিশনে তার বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ না পাওয়ায় তুলে দেওয়া হয় বিমানবাহিনীর হাতে। তখন আবারও তাকে আটক করে তারা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ড্রাম ফ্যাক্টরির পাশে এয়ার সিকিউরিটি অফিসে নিয়ে আসা হয়। এখানে গােপন বিচার চলে। বিচারে হাজিরা দেওয়ার পর হাত-পা-চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে মদ্যপ অবস্থায় কতিপয় লােক তার ওপর নির্মম নির্যাতন। চালায়। চোখ বাঁধা অবস্থায় নির্যাতন কেন্দ্রের সবার কাছ থেকে সই নেওয়া হয় ।
কিছুদিন পর অভিযােগ গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালে হাজিরার সময় নির্যাতিতদের চাদর দিয়ে জড়িয়ে রাখা হতাে যেন নির্যাতনের চিহ্ন দেখা না যায়। বিচারকরা আনােয়ার ঠাকুরের চেহারা ও ব্যাজ নম্বর দেখে বললেন, তােমার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এই পরােয়ানা নিয়েই তিনি কারাগারে যান। মাসখানেক পর জানতে পারেন তার সাজা হয়েছে আট বছর। তিনি আরাে জানান, মােট ১২ জনকে ঐ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছিল। এর মধ্যে আটজনেরই ফাসি হয়। কর্পোরাল নূরুল ইসলাম জানান, তার সাজা হয়েছিল চার বছর। ২ অক্টোবর অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানাে হয়। সেখান থেকে সংসদ ভবনসংলগ্ন নবম ডিভিশনের সদর দপ্তরে নিয়ে আসা হয় ১০ অক্টোবর। ট্রাইব্যুনালের প্রধান ছিলেন মেজর খালেক। তবে কোনাে অভিযােগ না পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে ১৬ অক্টোবর আবারও গ্রেপ্তার হন তিনি। চোখ বাঁধা অবস্থায় বন্দি থাকেন চার দিন। ২০ অক্টোবর আবারাে সামরিক ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। উইং কমান্ডার সাবিরউদ্দিন আহমেদ ট্রাইব্যুনালের প্রধান ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে কর্পোরাল গাজীকে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়। গাজীর ভাষ্যমতে, তিনি ভেবেছিলেন, নূরুল ইসলামের ফাসি হয়ে গেছে, তাই তার নাম বলে নিজে নির্যাতন থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে নূরুল ইসলামকে দেখার পর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং তার জবানবন্দি প্রত্যাহার করতে চান। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল তাতে রাজি হয়নি। অবশেষে দুজনেরই চার বছর সাজা হয়। কর্পোরাল কুতুবর রহমান বলেন, কী কারণে যে আমার ২০ বছর সাজা হয়েছিল তা আজও জানতে পারিনি। কতজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। তাজুল, কবির এরা কত ভালাে লােক ছিল! তাজুলের বাবা তাে পরে পাগল হয়েই মারা গেলেন। এভাবেই ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার চলতে থাকে। এই ২০ দিনে দুই সহস্রাধিক সৈনিকের বিচার সম্পন্ন করা হয়। ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের করার কিছুই ছিল না, যেভাবে নির্দেশ আসতাে সেভাবেই রায় ঘােষণা করতে হতাে। একটি ট্রাইব্যুনালের প্রধান ছিলেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বলেন, “যে অন্যায় ও অবিচারের রায় দিয়েছি, তার জন্য এখনাে দুঃসহ যন্ত্রণা ভােগ করে চলেছি। বিমানবাহিনীর একজন সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সুবিচার হওয়া তাে দূরের কথা, সেটাকে কোনাে রকম বিচারই বলা যায় না। যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তারা যে সবাই দোষী তা ঠিক নয়। ঐ ঘটনায় যাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডিত করা হয়েছিল তারা পর্যায়ক্রমে ১৯৮৪ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি পান। ‘৯৭ সালে ২ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযােগ করেন, জেনারেল জিয়াউর রহমান ঘােষিত মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালগুলােতে বিচার প্রহসনের সময় এক-একজন সৈনিকের জীবন-মরণের সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে এক মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিলেন তৎকালীন ট্রাইব্যুনাল প্রধানরা।’ এদিকে ঐ ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে কতজন প্রাণ হারিয়েছিল তার সঠিক হিসাব এখনাে জানা যায়নি। কারাগারে ফাঁসি দেওয়া ছাড়াও ফায়ারিং স্কোয়াড বা অন্য কোনােভাবে যে অনেকের প্রাণহানি ঘটানাে হয়েছিল তা বােঝা যায় বগুড়া অভ্যুত্থানে জড়িতদের বিচারের মাধ্যমে। ২৬ অক্টোবর ‘৭৭ আইএসপিআর-এর বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, ঐ অ্যুথানে জড়িত ৫৫ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। অথচ বগুড়া কারাগারে ফাসি হয়েছে ১৬ জনের। অপর ৩৯ জনকে কোথায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি কোনাে সূত্র থেকেই। অন্য কারাগারগুলােতে এর কোনাে নথিপত্রও পাওয়া যায়নি। ঠিক কী কারণে ঐ অ্যুত্থান হয়েছিল তার সঠিক ব্যাখ্যা এখনাে পাওয়া যায়নি। তৎকালীন সেনা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেছেন, কর্নেল তাহেরের সমর্থকরা জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে ঐ অ্যুথান করেছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, জেনারেল জিয়া সশস্ত্র বাহিনীতে তার শত্রুদের চিহ্নিত করার জন্য অ্যুথানের নাটক সাজিয়েছিলেন।
২ অক্টোবর ‘৭৭-এর অত্যুথানের শিকার হলেন আকবর। ভুক্তভােগী আলেয়া। আকবরের প্রাণপাত ঘটেছিল
জান্তা শাসকদের অবিমৃষ্যকারিতার কারণে। আলেয়ার সাদা কাপড়, শরীফ মনিরের হাহাকার এর আরেক দিক। কিন্তু আরাে শিকার যারা : সেই শরীফ, রুহুল আমিন, আনােয়ার, নুরুল ইসলাম- যাদের আকবরের মতাে জীবনপাত না ঘটলেও নির্যাতন, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুতি তাদের করেছে হতভাগ্য। তাই তাদের হাহাকারেও প্রতিধ্বনিত হয় আলেয়ার ট্র্যাজেডির সুর। ২০ বছর পরে যখন মুখােমুখি হই তখন তাদের একটাই কথা- সেই বিভীষিকাময় দিনগুলােকে তারা আর কখনাে স্মরণ করতে চান না। মনে হয় নিরপরাধ বিদেহী আত্মারা পি করছে। যেন তারা বলছে- আর কত নিজের সঙ্গে প্রতারণা? সত্যকে আর কত দিন চাপা দিয়ে রাখা?
১ মিনিটেই জীবনের ফয়সালা করে দিলাে ট্রাইব্যুনাল -কর্পোরাল আনােয়ার ঠাকুর
১৯৭৭-এর ২ অক্টোবর, ভাের তখন প্রায় ৪টা হবে। হঠাৎ গােলাগুলি আর হইচইয়ের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলাে। চারদিকে তাকিয়ে দেখি ব্যারাকে কেউ নেই। সবাই এদিক-সেদিক ছােটাছুটি করছিল। ব্যারাকের ভেতর থেকে গুলির আওয়াজের সঙ্গে হুঁশিয়ারি ভেসে আসছিল- ‘যাদের ব্যারাকের ভেতর পাওয়া যাবে তাদের কুকুরের মতাে। গুলি করে মারা হবে।’ ব্যাপারটা কী তা আঁচ করতে পারছিলাম না। আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিলাম। কারণ পেটের ব্যথাটা আবার তীব্রতা লাভ করছিল। এমন সময় কালাে পােশাকে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত কে একজন তার ভারী বুটের লাথি দিয়ে আমাকে খাট থেকে ফেলে দিলাে। মাটিতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি ‘ছদ্মবেশী’র কাঁধে ঝােলানাে স্টেনটা ততক্ষণে আমার দিকে তাক করে রেখেছে, আয় অশ্লীল উর্দুমিশ্রিত বাংলায় গালি দিতে দিতে হত্যার হুমকি দিয়ে আমাকে ইউনিফরম পরতে বলছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কোনাে প্রকারে ইউনিফরম পরে ‘ছদ্মবেশী’র হুকুম তামিল করলাম। বাইরে দণ্ডায়মান বাসগুলােতে একটিতে উঠে বসলাম। বাস ছাড়লাে কুর্মিটোলা বিমানবাহিনী ক্যাম্প থেকে। সিওডি হয়ে সােজা বিমানবাহিনীর তেজগাঁও গার্ডরুমে এসে বাস থামলাে।
ইতােমধ্যে ভাের হয়ে গেছে। দিনের আলােতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল আমি আর এয়ার ফোর্সের ছেলেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক-ওদিক ছােটাছুটি করছিল। শুনতে পেলাম বিমানবন্দরে কয়েকজন অফিসারকে কারা যেন গুলি করে মেরে ফেলেছে। ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। কারণ বিমানবাহিনীর অফিসার মারার মতাে এমন কোনাে পরিস্থিতি বিমানবাহিনীতে কখনাে হয়নি। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলাম বিমানবাহিনীর খ্যাতনামা পাইলট সাইফুল আজম (গ্রুপ ক্যাপ্টেন)সহ আরাে কয়েকজন অফিসারকে বিমানসেনা তেজগাঁও ক্যান্টিনের পেছন দিকে নিয়ে গেলাে। তাদের নেতৃত্বে তখন সার্জেন্ট আফসারকে দেখেছিলাম বলে মনে পড়ে। আমি তখন পেটের ব্যথায় আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। তাই ক্যান্টিনের সামনেই মাটিতে বসে পড়েছিলাম ও সুযােগ খুঁজছিলাম কিভাবে ক্যাম্পে ফিরে যাওয়া যায়। এভাবে ১৫-২০ মিনিট সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলাে, হঠাৎ একটি ট্রাক এলাে, তাতে সামনে কয়েকজন অফিসারকে বসে থাকতে দেখলাম। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না ট্রাকটি কুর্মিটোলা ক্যাম্পেই যাবে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে উঠে পড়লাম এবং কুর্মিটোলা নেমে মেসে গিয়ে নাশতা খেয়ে ব্যারাকে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি। সংক্ষেপে এই ছিল ১৯৭৭-এর ২ অক্টোবরের সাজানাে অ্যুত্থান নাটকে আমার ভূমিকা।
তারপর শুরু হলাে অপরাপর দৃশ্য। তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ (অব.) কুর্মিটোলা ফুটবল মাঠে সব বিমানসেনাকে জড়াে করে অনেক কথা বললেন। মাথার ওপর তখন অঝােরে বৃষ্টি ঝরছিল। তাঁর অভিযােগ- বিমানসেনারা তার ভগ্নিপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাস মাসুদকে কেন মারলাে! তিনি একথা কোনােভাবে অনুধাবন করতে চাইলেন না যে ঐ ১১টি মূল্যবান প্রাণের জন্য বিমানবাহিনীর গুটিকয়েক দুষ্কৃতকারী ছাড়া আর সবাই মর্মাহত এবং সবাই একবাক্যে ঐ হত্যার বিচার চেয়েছিল। তিনি দীর্ঘ এক ঘণ্টা লম্ফঝম্ফ দিয়ে যাওয়ার সময় হুঁশিয়ার করে গেলেন যে কেউ যেন ক্যাম্প ত্যাগ করার চেষ্টা না করে। কেননা সমগ্র ক্যাম্পকে আমি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। যেকোনাে মুহূর্তে ভারী কামানের গােলার আঘাতে আমাদের ক্যাম্প উড়ে যেতে পারে। ততক্ষণে আর বুঝতে বাকি থাকলাে না যে বিমানবাহিনী ধ্বংস হতে আর বাকি নেই। আমরা ব্যারাকে ফিরে গিয়ে আর্মি আক্রমণের অপেক্ষায় থাকলাম। পরিষ্কার দেখতে পারছিলাম, আমি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ধীরে ধীরে চারদিক থেকে ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এভাবে দুই দিন পর তারা আমাদের ক্যাম্পের ভেতর প্রবেশ করে প্রত্যেকের লকার, বাক্সপেটরা, জামাকাপড় তল্লাশি করে দারুণভাবে হতাশ হলাে। কারণ কোথাও একটি বুলেটও তারা পায়নি। পাবে কী করে? যারা বন্দুক নিয়েছিল তারা তাে তা গার্ডরুমেই জমা দিয়ে এসেছে। তা ছাড়া সবাই তাে বন্দুক নেয়নি। তখন থেকেই সমগ্র বিমানবাহিনী চলে গেলাে আর্মির একটি ডিভিশনের অধীনে। নায়েক সুবেদার নূরের কমান্ডে চলে এলাম আমরা সব বিমানবাহিনীর সদস্য। শুরু হলাে সকাল থেকে সন্ধ্যা মানসিক নির্যাতন। নানা ধরনের দুর্ব্যবহার। কথায় কথায় বুটের লাথি। এভাবে আরাে তিন দিন গত হলাে। ৫ অক্টোবর দুপুর বেলা সুবেদার নূর তার ইচ্ছেমতাে নাম ধরে ডাকতে আরম্ভ করলাে। যেমন- ইসলাম। যত ইসলাম ওখানে উপস্থিত ছিল সবাইকে একদিকে নিয়ে গেলাে। এভাবে একই নামের যত বিমানসেনা আছে, তাদের সবাইকে একদিকে নিয়ে গেলাে। তারপর আরাে কিছু লােককে সুবেদার নূর তার ইচ্ছেমতাে বের করলাে। এভাবে প্রায় ১৫০-২০০ জনের একটা দলকে কয়েকটি ট্রাকে তুলে নিয়ে এলাে বর্তমান সংসদ ভবনের পাশে তৎকালীন নবম ডিভিশনের সদর দপ্তরে। এখানে এনে আমাদের ছােট ছােট তিনটি কক্ষে ঠেসে দেওয়া হলাে। তারপর শুরু হলাে শারীরিক নির্যাতন। ওদের নির্যাতনের কৌশল ছিল অত্যন্ত নির্মম। তাদের লঙ্গরখানা থেকে দুটি করে রুটি এবং কিছু ডাল আমাদের হাতে হাতে দেওয়া হতাে এবং ঐ সময়েই ওপরের জিজ্ঞাসাবাদের নামে শুরু হতাে কতগুলাে অসহায় বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনী। সদস্যের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনের করুণ আর্তনাদে অপর সব বন্দি সৈনিকের হাত থেকে রুটি মাটিতে পড়ে যেতাে। বুক ফেটে কান্না আসতাে। এভাবে ১৫-২০ দিন অতিবাহিত হলাে, ইতােমধ্যে অনেককে হারিয়ে ফেলেছি। অক্টোবরের ২৫-২৬ তারিখ হবে। হঠাৎ বাইরে দেখি বিমানবাহিনীর কয়েকটি বাস দণ্ডায়মান। মনে মনে খুবই আশান্বিত হলাম। কিছুক্ষণ পর একজন আর্মি সদস্য এসে আমাদের নাম ডাকলাে। আমাকেসহ প্রায় শখানেক লােককে একদিকে করে বাকিদের দরজা বন্ধ করে দিলাে। কিছুক্ষণ পর তাদের কমান্ডার (যতদূর মনে পড়ে কর্নেল মুজিব)
এসে একটি লম্বা উপদেশমূলক বক্তৃতা দেন (যার মূল অর্থ : তােমরা নির্দোষ, নির্দোষ। হইলে কী অইবাে! অহনাে সময় আছে- ভালাে অইয়া যাও)। বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে জানাতে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। বিমানবাহিনীতে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরুর স্বপ্নও দেখলাম। কিন্তু বিধি বাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলাে নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন প্রভােস্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি ইউনিটে। সেখানে সারা দিন আটকে রেখে সন্ধ্যায় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। জেলে ৪ খাতায় (৪ নং ভবনের) দ্বিতীয় তলায় গিয়ে উঠলাম আর সেখানে দেখলাম শত শত বিমানসেনার ক্ষতবিক্ষত দেহ মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। বিমানবাহিনীর ফিল্ড ইউনিট জিজ্ঞাসাবাদের নামে এদের সম্পূর্ণরূপে পঙ্গু করে দিয়েছে। তারপর এদের ৩১ নং বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করে ফাসির দণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কর্পোরাল আজিমের শরীর পচে গন্ধ বের হয়েছে। কারাগারে কোনাে চিকিৎসার ব্যবস্থা তখন ছিল না। সে এমনিতেই মারা যায়। অথচ তার সাজা হয়েছিল ৫০ বছর কারাদণ্ড। রাত গভীর হতেই আমাদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যেতাে। কারণ কারাগারের জাদরা একটি তালিকা হাতে আমাদের লৌহকপাটে এসে যখন হতভাগ্যদের নাম ধরে ডাকতাে তখন মনে হতাে স্বয়ং আজরাইল উপস্থিত হয়েছে। এভাবে প্রতি রাতেই ২০-২৫ জন করে লােক নিয়ে যায়, আর তারা ফিরে আসে না। বুঝতে আর বাকি থাকে না যে আমারও এমনি করে একদিন ডাক আসবে। কিন্তু আমি তাে আর্মি কর্তৃক বেকসুর খালাস। তবু প্রস্তুত হতে থাকি।
দিবারাত্রি কেবল আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় রত শত শত অসহায় সেনা ও বিমান সদস্য। এভাবে আরাে কত দিন যে গেলাে মনে নেই। প্রায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর একদিন আমার ডাক এলাে। তবে রাতে নয়, দিনে। কারাগার থেকে বের করে নিয়ে সেই প্রভােস্ট ইউনিটে। আমার সঙ্গে আরাে প্রায় ২০-২২ জন বিমানসেনা ছিল। সেখানে প্রায় তিন-চার ঘণ্টা একটি প্রকোষ্ঠে বন্দি থাকার পর আমাদের হাত আর চোখ বেঁধে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে কোনাে এক অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হলাে। তারপর শুরু হলাে বেদম মারধর। এভাবে কত দিন অতিক্রান্ত হয়েছে বুঝতে পারিনি। কারণ চোখের বাঁধন এত শক্ত ছিল যে প্রায় অন্ধই হয়ে গিয়েছিলাম। সমস্ত পােশাক খুলে ফেলা হয়েছিল। শুধু একটি অন্তর্বাস পরা অবস্থায় হাত, পা ও চোখ বেঁধে নির্যাতন চালানাে হতাে অসহায় মানব সন্তানদের ওপর। নির্যাতনকারীরা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নানাপ্রকার পরিহাস করতাে। জানতে চাইতাে ৭ নভেম্বর সম্পর্কে আমার অভিমত কী? কাল মার্কস কে ছিল? সমাজতন্ত্র কী? মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলাম? এভাবে প্রায় পাঁচ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন এনে উপস্থিত করলাে ৩১ নং বিশেষ সামরিক আদালতের বিচারক উইং কমান্ডার সদরউদ্দিন আহমদের সামনে। হাত ও চোখ বাঁধা, সমস্ত শরীর একটি চাদর জাতীয় কাপড় দিয়ে ঢাকা। বিচারক চোখ খুলে দেওয়ার আদেশ দিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে রায় ঘােষণা করলেন, তােমার শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। আমি বললাম, এটা অন্যায়, জুলুম। আমি কোনাে অপরাধ করিনি। বিচারক বললেন- তােমার কোনাে সাক্ষী আছে? আমি বললাম, একমাত্র আল্লাহই আমার সাক্ষী।
তিনি সব দেখেছেন। বিচারক বললেন, তবে তার বিচারের অপেক্ষায় থাকো। এই বলে কী যেন লিখলেন এবং ১ মিনিটেই আমার জীবনের ফয়সালা করে তিনি আসন ত্যাগ করলেন। আমার কোনাে কথাই তিনি শুনলেন না। তারপর আবার তড়িঘড়ি করে চোখ বেঁধে, হাতে রশি ও পায়ে দড়ি বেঁধে আরাে আট-নয়জনসহ ঐ সাদা অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আমার যতদূর মনে পড়ে ঐ গ্রুপের মধ্যে আমরা দুই জনই বেঁচে ছিলাম। আমাকে যখন বিচারকের সামনে নেওয়া হয়েছিল তখন বারবার চেষ্টা করেও আমি কোনাে সুযােগ পাইনি এই কথাটা বলতে যে আমার চোখ বাঁধা অবস্থায়ই নির্যাতনকারীরা কোনাে একটি কাগজে আমার স্বাক্ষর নিয়েছিল। কারাগারে বসে মৃত্যুর দিন গুনছিলাম। আমার আশপাশের সবাইকে ডেকে নিয়ে শেষ করে দিয়েছে। অবশিষ্ট শুধু আমি। যেকোনাে মুহূর্তে আমারও ডাক আসতে পারে। এভাবে যখন প্রায় এক মাস গত হলাে, তখন মনে একটু আশা পেলাম যে হয়তাে বেঁচে যাবাে। কারণ তখন জেলখানায় বহু গুজব শােনা যাচ্ছিল। যেমন, ফাসি বন্ধ হয়ে গেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আবেদন করেছে ইত্যাদি। যাই হােক, প্রায় তিন মাস পর সেই বিচারক সদরউদ্দিন আহমদ কারাগারের দপ্তরে স্বয়ং এসে যারা জীবিত তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা শুনিয়ে চলে গেলেন। তখন বুঝতে পারলাম আমার আট বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। কারাগারে ফাঁসির দড়িতে মৃত্যু অবধারিত জেনে আমি অনেকটা বেপরােয়া হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার মাথায় প্রতিনিয়ত প্রশ্ন জাগছিল, ২ অক্টোবর কী ঘটেছিল? সমগ্র ব্যাপারটি জানতে প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছিল। তাই কারা প্রহরীর (মিঞা সাহেব) মাধ্যমে সংবাদ নিতে শুরু করলাম কে কোথায় আছে। জানতে পারলাম কনডেমড সেলে মৃত্যুর দিন গুনছেন সার্জেন্ট আফসার, কর্পোরাল আবু বক্কর সিদ্দিকসহ আরাে অনেকে। ইতােমধ্যে কয়েকশ বিমানসেনা ও সেনাবাহিনীর সিগন্যালস ও সাপ্লাই কোরের সদস্যকে খালাস করে দেওয়া হয়েছে। একদিন এক মিঞা সাহেবকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে বললাম, সে যেন সার্জেন্ট আফসারের কাছ থেকে জেনে আসে যে আমাদের জন্য তার কোননা বক্তব্য আছে কিনা। পরদিন ঐ মিঞা সাহেব এসে আমাকে যা বলেছিল তা শােনার পর বােবা হয়ে গিয়েছিলাম। সার্জেন্ট আফসার মিঞা সাহেবের মাধ্যমে সংবাদ পাঠিয়েছে, আমরা সম্পূর্ণ নির্দোষ, ঐ ঘটনার জন্য আমরা কেউ দায়ী নই, আমরা যেন তাকে ক্ষমা করে দিই। তখন চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সৈনিকদের যখন ডেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন কেন তারা করুণ আর্তনাদে বলেছিল, আমাদের পরিবার-পরিজনকে বলবে আমরা কোনাে অপরাধ করিনি, আমরা নির্দোষ।’ তারপর একে একে দিন যেতে লাগলাে। কারা যন্ত্রণা সইতে শিখলাম। মৃত্যু যখন প্রত্যাখ্যান করলাে, নতুন করে বাঁচতে চাইলাম। এমন সময় এক সকালে শুনি জিয়াউর রহমান নিহত। আবার আতঙ্কিত হলাম। আবার না জানি কত শত মায়ের বুক খালি হয়, কত নারীকে বৈধব্য বরণ করতে হয়। অবশেষে হলােও তাই। প্রেসিডেন্ট হত্যাকে এড়িয়ে সেনা বিদ্রোহের অপরাধের নামে এক ডজন উজ্জ্বল অফিসারকে অকালে প্রাণ দিতে হলাে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত ক্ষমতাকে রক্ষার জন্য আরাে অন্যায় করে যেতে হয়। এই অন্যায়ই একসময় সে ক্ষমতাধরকে নিক্ষেপ করে ইতিহাসের অতীতে।।
চোখ-হাত-মুখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় -কর্পোরাল শাহ মুনীর শরীফ অভিশপ্ত ২ অক্টোবর, ১৯৭৭। আজও জানতে পারিনি। আসলে ঐ দিন কী ঘটেছিল, কারা ছিল নাটের গুরু, নেপথ্যের হােতা এবং কী ছিল আমার অপরাধ! ১৯৭৭ সালে আমি বিমানবাহিনী সদর দপ্তরে নিয়ন্ত্রণাধীন সাজ-সরঞ্জাম ডিপাের প্রশাসনিক শাখায় একজন এনসিও হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ১ অক্টোবর বেতন পেয়ে আমি ছয় দিনের সাময়িক ছুটি মঞ্জুর করিয়ে পরদিন ২ অক্টোবর থেকে ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। বিকেলে আমার এক সহকর্মী সার্জেন্ট মালেকসহ গুলিস্তানে এসে কিছু কেনাকাটা করি। ঐ সময় আমি সাত মাসের এক কন্যাসন্তানের জনক। রাতে বিমানসেনা মেসে খাওয়া-দাওয়ার পর দোতলায় টিভি দেখার জন্য যাই। এ সময় জাপানি এয়ারলাইন্সের বিমান হাইজ্যাকিং ঘটনাবলি তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল। জাপানি রেড আর্মির সঙ্গে জিম্মি বিনিময়ের দৃশ্যাবলি সবাই বেশ আগ্রহ ভরে উপভােগ করছিল। এমন সময় রাত এক দেড়টার। দিকে কুর্মিটোলা বিমানসেনা ছাউনিতে সব বাতি কে বা কারা নিভিয়ে দেয় এবং প্রচণ্ড শব্দে এলােপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গেই কিছু আর্মির গাড়ি দেখা যায়। এবং গাড়ির আরােহীরা মাইকে সব বিমানসেনাকে তাদের সঙ্গে ‘বিপ্লবে’ যােগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে থাকে। যারা তাদের আহ্বানে সাড়া দেবে না তাদের গুলি করা হবে। বলে ঘােষণা দেয়। আরাে নানারকম হইচই, চিকার ও দৌড়াদৌড়িতে কুর্মিটোলা বিমানসেনা ছাউনিতে নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কী করা উচিত- এ ধরনের পরামর্শ। দেওয়ার মতাে কেউ ছিল না। যে যার বুদ্ধি ও সুযােগমতাে বিভিন্ন জায়গায় সরে পড়ার চেষ্টা করে। আমি গাড়ির আরােহীরা বিমানসেনাদের আবাসস্থল ব্যারাকগুলাে অবরােধ করে বেশ কিছু বিমানসেনাকে তাদের সঙ্গে যেতে বাধ্য করে। আমি বিমানসেনা মেসের দোতলায় টিভি রুমে ছিলাম। এয়ারম্যান ব্যারাকের দিকে না । গিয়ে আমরা বেশ কয়েকজন দোতলা থেকে নেমে মেসের পেছনে জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে আত্মগােপন করি। পরিস্থিতির আরাে অবনতি হলে আমরা বর্তমান ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে, যেটা সে সময় অর্ধনির্মিত জঙ্গলাকীর্ণ একটি পরিত্যক্ত বিশাল
জনমানবহীন প্রান্তর ছিল সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিই। রাতের বাকি সময়টুকু ওখানেই পালিয়ে থাকি। সকালে ব্যারাকে ফিরে এসে চিন্তা করি যে ছুটিতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হব কিনা। কোনাে কিছু ঠিক করতে না পেরে আমি আমার সেকশন ইনচার্জ ওয়ারেন্ট অফিসার সায়েদুল হকের কাছে যাই। তিনি আমাকে জানান, পরিস্থিতি ভালাে নয়। কাজেই এ অবস্থায় স্টেশন ত্যাগ না করাই ভালাে। তার পরামর্শ অনুযায়ী আমি ব্যারাকেই অবস্থান করতে থাকি। ৫ অক্টোবর আর্মি বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসে পুরাে কুর্মিটোলা বিমানসেনা ছাউনি ঘেরাও করে এবং ব্যারাকে অবস্থানরত সব বিমানসেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। যেহেতু আমি ঘটনার সময় কোথাও যাইনি, তাই আমাকে আমার ইউনিটে যথারীতি ডিউটি প্রদান করা হয় এবং আমিও ছুটিতে না গিয়ে রীতিমতাে ডিউটি করতে থাকি। আমার ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন উইং কমান্ডার খায়রুজ্জামান এবং অফিসার ইনচার্জ ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম এ খালেক ও ফ্লাইং অফিসার শাহজাহান। আমার এক রুমমেট কর্পোরাল গাজীউর রহমান (বাড়ি নরসিংদী, রায়পুর) জানি না কিভাবে ধরা পড়েছে। ঘটনাস্থল থেকে, নাকি অন্য কোথাও থেকে। তাকে দীর্ঘ নির্যাতন করে শুধু বলা হয়েছিল, অন্তত পাঁচ জনের নাম বলাে, ছেড়ে দেবাে। নির্যাতনে অচেতন অবস্থায় সে আমার আরেক রুমমেট কর্পোরাল নূরুল ইসলাম ও আমার নাম বলে।
১৯ অক্টোবর আমাদের চোখ-হাত-মুখ বেঁধে এক অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে নির্যাতনে আহত করে। আমাদেরও বলা হয়, অন্তত পাঁচজনের নাম বলাে, ছেড়ে দেবাে। কিন্তু আমরা কারাে নাম বলতে না পারায় অমানুষিক নির্যাতনের মাত্রা আরাে বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে প্রহসনমূলক সাজানাে বিচারে চার বছর করে কারাদণ্ডের শাস্তি প্রদান করা হয়। অবশ্য কর্পোরাল গাজী পরে তার জবানবন্দি প্রত্যাহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে আর সেই সুযােগ দেওয়া হয়নি। আমার বিশ্বাস, কর্পোরাল গাজী এখনাে জীবিত আছেন। কাজেই সত্যাসত্য প্রমাণের সুযােগ এখনাে আছে। জীবিত আছেন তথাকথিত ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান উইং কমান্ডার সাবের উদ্দিন এবং আরাে জীবিত আছেন নির্যাতনকারী গ্রুপের অনেকে। এ ধরনের চিহ্নিত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারলে অনেক রহস্যের কূলকিনারা পাওয়া যেতাে বলে আমার বিশ্বাস। গণহারে সৈনিক হত্যার সঙ্গে সে সময় যারা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে জড়িত ছিল, তাদের খুঁজে বের করলেই সব কিছু উন্মােচিত হতাে। আমার সার্ভিস ফাইল নিশ্চয়ই এখনাে বিমানবাহিনীতে সংরক্ষিত আছে। সেখানে খোঁজ করলেই দেখা যাবে আমার চাকরি জীবনে নিষ্কলুষ রেকর্ড। কিন্তু বিনিময়ে কী পেলাম! নির্যাতন, চাকরিচ্যুতি, শান্তি এবং জীবনের সােনালি সময়ের অনাকাক্ষিত অপচয়। পরবর্তীকালে জীবনসংগ্রামে এক অমানবিক কষ্টকর অভিজ্ঞতা, যা এখনাে শেষ হয়নি। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, বর্তমান নৈরাশ্যজনক, অতীত এক মরীচিকা। কে দায়ী আমার এই বিড়ম্বিত জীবনের জন্য? এক সামরিক আদালতে ছাড়া পেলেও আরেক আদালতে কারাদণ্ড -কর্পোরাল নুরুল ইসলাম
১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর। তখনাে কর্পোরাল পদে হেলিকপ্টার এমআই-৮-এর মেইনটেনেন্স শাখায় কর্মরত ছিলাম। অক্টোবরের ৯ তারিখেই সার্জেন্ট পদে পদোন্নতি পেয়ে আমার ভিন্ন ব্যারাক ও ভিন্ন মেসে চলে যাওয়ার কথা। বিকেলে বেরিয়ে চলে গেলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রিলিমিনারি ক্লাসে। রাতে আর কুর্মিটোলা বালুরঘাটের সেই ১৭৬ নং ব্যারাকে ফিরলাম না। চলে গেলাম গেণ্ডারিয়ায় বােনের বাসায়। কারণ পরের দিনটি ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কিন্তু আগের রাতে সেনানিবাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিন্দুমাত্র টের পেলাম না। পরের দিন অর্থাৎ ২ অক্টোবর সকালের নাশতা শেষে রওনা দিলাম বালুরঘাটের উদ্দেশ্যে। সকাল সাড়ে নয়টায় গুলিস্তানে এসে লােকমুখে সেনানিবাসে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার কথা প্রথমে শুনতে পেলাম। ঘটনার গভীরতা একেবারেই উপলব্ধি করতে না পেরে ফার্মগেট থেকে রিকশায় সেনানিবাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পুরােনাে সংসদ ভবন এবং পুরােনাে বিমানবন্দরের মাঝামাঝি জায়গা থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলাে বিমানবন্দরের ভেতর। সেখানেই কাপ্টেন সাদেককে বলি, ‘স্যার, আমি এর কিছুই জানি , আমি বাইরে থেকে এলাম, আমাকে কেন এখানে নিয়ে আসা হলাে?’ তিনি শুধু বললেন, ‘you shut up and sit down with others’. আমাকে কোনাে কথাই বলতে দিলেন না। কিছু শুনতেও চাইলেন না। ভেতরে গিয়ে দেখলাম আরাে ৬০ জনের মতাে বিভিন্ন ব্যাংকের বিমানসেনা। কারাে মুখেই কোনাে কথা নেই। সারা দিন না খাইয়ে রেখে বেলা আনুমানিক ৪টায় আমাদের পরনের কাপড়চোপড়, ইউনিফরম, হাতঘড়ি, মানিব্যাগ সবই নিয়ে নেওয়া হয় তদানীন্তন মেজর একরামের নির্দেশে। আমাদের পরনে আন্ডারঅয়্যার ছাড়া কিছুই ছিল না। আমার পাশে একজন ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাে, কী হবে আমাদের? আমি শুধু আওড়ালাম ‘maximum firing squad’. সন্ধ্যায় প্রিজন ভ্যানে করে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলাে নাজিম উদ্দিন রােডের কেন্দ্রীয় কারাগারে। সংখ্যায় আমরা সম্ভবত ৬৫ জন ছিলাম (এদিকে বাইরে কুর্মিটোলায় বা বালুরঘাটে কী হলাে কিছুই জানলাম না)। ৫ তারিখ থেকে ১০ জন করে প্রতিদিনই নিয়ে যাওয়া হতে লাগলাে ইন্টারােগেশনের নামে টর্চার সেলে। যে একবার যেতাে তার আর
দেখা পেতাম না। আমার সঙ্গের দলটিকে চোখ, হাত-পা-কোমর বেঁধে ১০ অক্টোবর কারাগার থেকে অন্যত্র নিয়ে একটা ছােট্ট বদ্ধ কামরায় রাখা হলাে। অনেক পরে আমরা জেনেছি সেটি ছিল শেরে বাংলা নগরের এমপি হােস্টেল। ১২ তারিখে একজন-একজন করে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলাে। কোনাে ডিফেন্ডিং অফিসার দেওয়া হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনাে সুযােগ ছিল না। আমাদের ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন। মেজর খালেক। ঐ কোর্টের অন্যান্য মেম্বার ছিলেন ক্যাপ্টেন সাদেক ও দু-তিনজন সুবেদার পদমর্যাদার এনসিও। ঐ প্রহসনের ট্রাইব্যুনালে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়ে ছাড়া। পাই। পরর্তীকালে জেনেছি যে ঐ ৬৫ জনের মধ্য থেকে আমরা পাঁচ-ছয়জন মাত্র বেঁচে আছি। বাকি সবাইকে কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ডিউটি পালনরত অবস্থায় বিমানবন্দরে ধরা পড়ে এবং এরা ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। বিমানবন্দর অপারেশনে আর্মির যে ইউনিট কাজ করছিল সেটা ছিল ২৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট। সম্ভবত ১৭ অক্টোবর আমাকে বালুরঘাটে আমার ব্যারাকে দিয়ে এলাে ঐ ২৯ বেঙ্গল। ১৯ তারিখেই আবার এয়ার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট হাত-চোখ বেঁধে টর্চার সেলে নিয়ে গেলাে। সারা রাত চললল অকথ্য নির্যাতন। রাতভর শুধু শুনলাম পিটুনির শব্দ, আর্তচিৎকার ও গােঙানির আওয়াজ। সবার কাছ থেকে জোর করে স্বীকারােক্তি আদায় এবং না দেখে তাতে সই আদায় করে নেওয়া। কারণ বাঁধা চোখ এক মুহূর্তের জন্যও খােলার উপায় ছিল না। পরের দিন আবার চোখ বাঁধা অবস্থায় উইং কমান্ডার সাবের উদ্দিনের কোর্টে হাজির। তখনাে বুঝতে পারিনি আমার একই বিচার দ্বিতীয়বার কী করে হতে পারে। পরবর্তী সময় জেনেছি, স্বীকারােক্তি আদায়ের নামে অন্য একজনকে আমার নাম বলতে বাধ্য করা হয়েছিল টর্চার করে। যে কর্পোরাল গাজী আমার নাম বলেছিল, সে জেনেছিল আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে আমি আল্লাহর অশেষ রহমতে ওখান থেকে প্রাণে বেঁচে যাই। গাজী তাে আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে এবং না জেনে নাম বলার জন্য আল্লাহর কাছে এবং আমার কাছে মাফ চাইতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণ সব শেষ। ট্রাইব্যুনাল অসহায়ত্ব প্রকাশ করে কিন্তু তার পরও আমাকে চার বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। চলে এলাম, আবারও কেন্দ্রীয় কারাগারে ৪ নং খাতায়। তখন প্রতিরাতেই চলছে ফাসির পালা, জোড়ায় জোড়ায় ফাসি। প্রতি রাতই যেন ভয়ার্ত বিভীষিকাময় আর্তচিৎকারের পালা। কখন কার ডাক আসবে ফাঁসির কাষ্ঠে। যাওয়ার, কেউ জানে না। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত। মুখে শুধু আল্লাহর নাম। সত্যিকারের কতজনের ফাঁসি দেওয়া হয় তা শুধু চিফ মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর জিয়াউর রহমান বলতে পারতেন! ঐ পৈশাচিক ঘটনার দুটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও করা হয়েছিল। কিন্তু তা আজও আলাের মুখ দেখতে পায়নি।
বিমানবাহিনী প্রধানকে বাঁচানাের বিনিময়ে চার বছরের জেল -কর্পোরাল মাে. রুহুল আমিন ১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে শুরু করে পরের দিন (২ অক্টোবর) সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত তঙ্কালীন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে এস্কট ডিউটিতে ছিলাম। আমরা যখন তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে জাপানি বিমান ছিনতাইকারীদের নিয়ে ব্যস্ত, তখন রাত প্রায় একটা কিংবা দেড়টার দিকে কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটির গার্ডরুম থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরের টাওয়ার কন্ট্রোলরুমে টেলিফোন আসে যে একদল অপরিচিত অস্ত্রধারী লােক গােলাগুলি করে, মাইকিং করে, ঘুমন্ত বিমানসেনাদের জাগিয়ে তােলে এবং ব্যারাকে ঢুকে জোর করে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। এই পরিস্থিতিতে বিমানসেনারা কী করবে তা মনস্থির করতে না পেরে বিমানবাহিনী প্রধানের পরামর্শ ও নির্দেশ চায়। বিমানবাহিনী প্রধান এ জি মাহমুদ সাহেবকে এ সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে জানানাে হয়। সবাই তখন তার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। বিমানসেনাদের টেনশন বাড়তেই থাকে। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বারবার টাওয়ার কন্ট্রোল রুম ও অফিসার্স মেসে ফোন করতেই থাকে। কিন্তু কোনাে লাভ হয় না। এহেন পরিস্থিতিতে বিমানসেনারা কমান্ডারবিহীন, পথপ্রদর্শকবিহীন, নিরাপত্তাহীন, অরক্ষিতভাবে বহিরাগত আক্রমণকারীদের ফাঁদে জড়িয়ে গেলাে। সু-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশের সম্পদ ১১ জন অফিসারসহ শত শত বিমানসেনাকে অকালে ঝরে যেতে হলাে। একটি শক্তিশালী বিমানবাহিনীকে পঙ্গু হয়ে যেতে হলাে। সেদিন যারা বিচারকের আসনে বসে অসহায় সৈনিকদের সঙ্গে তামাশা করছিলেন, তাদের খুঁজে বের করা হােক এবং আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সত্য উদ্ঘাটন করা হােক। ২ অক্টোবর রাত কেটে গিয়ে ভাের হলাে। থমথমে পরিবেশ। বিমান ছিনতাই ঘটনার অবসান হওয়ায় ভাের হতে না হতেই সাধারণ লােকজন সব চলে যায়। অল্পসংখ্যক বিমানবাহিনী সদস্য ও বন্দর কর্তৃপক্ষ টাওয়ার বিল্ডিংয়ে উপস্থিত ছিল। সকাল ৬-১০ মিনিটে টাওয়ার বিল্ডিংয়ের উত্তর দিকে হ্যাঙ্গারের সামনে চার-পাঁচজন ইউনিফরম পরিহিত লােককে একদল আক্রমণকারী লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে। এ দৃশ্য দেখামাত্র দৌড়ে এ জি মাহমুদ সাহেবের কামরায় গিয়ে তাকে সব বলি। (পরে জানতে পারি যে যাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয় তারা সবাই বিমানবাহিনীর অফিসার ছিলেন)।
এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবাহিনীর অফিসাররা যারা ঐ বিল্ডিংয়ে ছিলেন তারা যে যেখানে নিরাপদ মনে। করেছেন সেখানেই লুকিয়ে পড়েন। আমি, প্রভােস্ট কর্পোরাল সাইফুল আমিন, এ জি মাহমুদ সাহেব এবং সিভিল এভিয়েশনের জনৈক কর্মকর্তা- এই চারজন মিলে ওপরেই এক রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রাখি। রুমের ভেতরে একটি বড় স্টিলের আলমিরা ছিল। ওটাকে টেনে একদিকে ফাঁকা করে সেই আড়ালে এ জি মাহমুদ সাহেব এবং সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাকে রেখে মাে. সাইফুল আমিন ও আমি রুমের দরজার দুই পাশে দাড়িয়ে থাকি। আমার কাছে ছয়টি গুলি ভর্তি একটি রিভলবার ও মাে, সাইফুল আমিনের কাছে একটি ম্যাগজিন ভর্তি গুলিসহ একটি স্টেনগান ছিল। আমরা মনস্থির করে ফেলি, দরজা ভেঙে কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে আমরা ফায়ার ওপেন করবাে। তারপর যা হওয়ার তাই হবে। ততক্ষণে থেমে থেমে গুলির শব্দ ও সেই হইচই ও আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। যতই সময় যেতে থাকে গুলির শব্দ ও হইচই ততই স্পষ্টতর হতে থাকে। মাঝেমধ্যে আমাদের চারজনের মধ্যে করণীয় বিষয় নিয়ে আলােচনা হতাে। একপর্যায়ে সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তা আমাদের উদ্দেশে বলেন, আক্রমণকারীরা দরজা ভেঙে ঢুকলেও আপনারা কোনাে গুলি করবেন না। তা করতে গেলে ওরা ব্রাশ করে সবাইকে এক সঙ্গে মেরে। ফেলবে। উক্ত কর্মকর্তার কথা শুনে এ জি মাহমুদের দিকে তাকালে উনি বলেন, হ্যা, তাই করুন এবং আপনারা আল্লাহকে ডাকুন, উনি আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতেও পারেন। সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাটি আবার বললেন, ‘এখন এই একটি কাজ করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। আল্লাহকে ডাকতে থাকি। একপর্যায়ে মাে. সাইফুল আমিন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকেন। তিনি। এমনিভাবে বেশ কিছুক্ষণ কাটলাে। ওদিকে আক্রমণকারীরা আমাদের রুমের প্রথম দরজার সামনে এসে হাজির হয়ে চিৎকার করে দরজা খুলতে বললে মাে. সাইফুল আমিন হঠাৎ করে স্টেনগান হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ান এবং জানালা খুলে লাফিয়ে নিচে নেমে পড়েন। রয়ে গেলাম আমরা তিনজন। মৃত্যু অবধারিত জেনেও এ জি মাহমুদ সাহেবকে একা ফেলে রেখে পালাতে পারলাম না। একবার ভেবে নিলাম, যদি মরতে হয় একসঙ্গে মরবাে। যদি বাঁচি একসঙ্গে বাঁচবাে। ওরা (আক্রমণকারীরা) দ্বিতীয় দরজা ভেঙে গালাগাল করতে করতে রুমের ভেতর ঢুকেই চিৎকার করতে লাগলাে, কোথায় এ জি মাহমুদ… কোথায় এ জি মাহমুদ। একপর্যায়ে স্টিলের আলমিরার আড়ালে থেকে দুজনকে বের করে অস্ত্রের মুখে আমাদের তিনজনকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিয়ে যায়। এ জি মাহমুদ সাহেব ওদের বারবার বলতে থাকেন, তােমরা আমার কথা শােনাে… আমার কথা শােননা। কিন্তু কোনাে লাভ হলাে না। তার কোনাে কথাই তারা শুনতে নারাজ। আক্রমণকারীর মধ্যে আমি একজনকে চিনতে পেরেছিলাম। আমি সুযােগ খুঁজছিলাম তার সঙ্গে আলাপ করতে, একটা শেষ চেষ্টা মাত্র। আক্রমণকারীরা এ জি মাহমুদকে মারার আগে নিজেদের মধ্যে কিছু শলাপরামর্শ করতে একত্র হয়।
এ সুযােগে ওদের নেতা সার্জেন্ট আফসারকে দুহাত ধরে অনুরােধ করে বলি, আফসার ভাই, দয়া করে আমাদের চিফ অব স্টাফকে মারবেন না। তাকে মারলে এই মুহুর্তে এয়ারফোর্সকে কমান্ড করবে কে? সার্জেন্ট আফসার এবং তার দলের অন্যদের সঙ্গে অনেক যুক্তিতর্কের পর আমার প্রস্তাবে রাজি হয় তারা। আল্লাহর অশেষ রহমতে ওয়ারেন্ট অফিসার রহমান, জনৈক সার্জেন্ট ও কর্পোরাল (সম্ভবত ওরা জিসি উইং-এর হবে) এসে আমার পক্ষে যােগ দেয়। তারাও এ জি মাহমুদকে না মারার পক্ষে বক্তব্য দেয়। তখন সার্জেন্ট আফসার বলেন, ‘যান আপনাকে ছেড়ে দিলাম। কাল যে আপনি আমাকে ‘হ্যাং’ করবেন তা আমি জানি। আমাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এরা যদি এত অনুরােধ না। করতাে তাহলে আপনাকে রেহাই দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এরপর সার্জেন্ট আফসার তার সঙ্গীদের নিয়ে বিমানবন্দর ছেড়ে চলে যায়। ওরা চলে গেলে এ জি মাহমুদকে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় এ বিষয়ে আলােচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। এ জি মাহমুদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আপনি কোথায় যাবেন? উত্তরে তিনি বললেন, দেখাে, এই মুহূর্তে আমার এয়ার হাউস অথবা নিজের বাড়ি কোথাও যাওয়া নিরাপদ নয়। বরং আমি তােমাদের কারাে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। তার ইচ্ছেমতাে লােক খুঁজে পাওয়া গেলাে। একজন বললাে, আমার বাসা ফার্মগেটে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আমি আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে যাবাে। সে এ জি মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে থেকে গেলাে। তাদের দুজনকে নিচতলায় একটি নির্দিষ্ট কামরায় রেখে বাইরের দিক থেকে তালা লাগিয়ে রাখা হবে। বাইরে একজনের কাছে চাবি থাকবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে তালা খুলে দেবে এবং তারা বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবেন। এতখানি নিশ্চিত হওয়ার পরই আমি বিমানবন্দর ত্যাগ করি। তারপর কী ঘটে তা আমি জানি না। বিমানবন্দর ত্যাগের পর আমি কুর্মিটোলায় আমার ইউনিটে যাই। ইউনিটে গার্ডরুমে আমার গুলিসহ রিভলবারটি জমা দিই। তারপর এক দিন অফ ডের পর ৪ থেকে ১৩ অক্টোবর ‘৭৭ পর্যন্ত আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বুকটান করে ডিউটি করতে থাকি। এ জি মাহমুদ সাহেব আমাদের অভয় দিয়ে বলেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে, ও নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। এখন মন দিয়ে। ডিউটি করে যান।’ লজ্জা বা সংকোচ আমার ছিল না। যারা তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল তাদের লজ্জা হওয়ার কথা।
আমি তাে ভেবেছিলাম, আমার নিষ্ঠার সঙ্গে ডিউটি করার জন্য চিফ অব স্টাফ আমাকে যেকোনাে একটি রিওয়ার্ড দেবেন। আক্রমণকারীদের হাত থেকে তাকে যেভাবে কৌশলে বাঁচিয়েছি, তাতে এ জি মাহমুদ সাহেবের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ১৪ অক্টোবর আমাকে গােয়েন্দা বিভাগ থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানাে হলাে। আমি শাহীন অডিটরিয়ামে গেলাম। আমাকে অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন করা হলাে। আপনি ফায়ার ওপেন করলেন না কেন? উত্তরে বললাম, ফায়ার ওপেনের বিষয়ে নিষেধ ছিল। আর তা করলে আমাদের সবাইকে এলএমজি দিয়ে ব্রাশফায়ার করে তুলাের মতাে উড়িয়ে দিতাে। কী অবিশ্বাস্য ঘটনা। আমি বন্দি হলাম। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণায় আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছিল। সত্য পথে চলার এই কি প্রতিদান। ভাবলাম, আদালতে আমার বিরুদ্ধে কোনাে অভিযােগ প্রমাণিত হবে না। আমি অবশ্যই ছাড়া পেয়ে যাবাে। আমার ১ নং সাক্ষী তাে চিফ অব স্টাফ নিজেই। অতএব আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে কে? ২০ বছর আগে তথাকথিত মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছিলাম, আমার বিশ্বাস আমার সেদিনের বক্তব্য আর আজকের মূল বক্তব্যের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য হবে। সরকার ইচ্ছে করলে মিলিয়ে দেখতে পারে। আমি আজও হিসাব মেলাতে পারছি না। আমাকে কোন দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হলাে। যারা কর্তব্য কাজে অবহেলা করে পালিয়ে গেলাে তারা বেঁচে গেলাে, আর আমি আমার কর্তব্য কাজ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে, সত্যকে সত্য বলে ফেঁসে গেলাম। মিথ্যা মামলায় আমাকে জড়িয়ে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে ওদের কী লাভ হলাে? আমার বেলায় কেন এমন হলাে? কে দেবে আমার এসব প্রশ্নের জবাব? ২ অক্টোবর ‘৭৭-এর অত্যুথানে দৃশ্যতসার্জেন্ট আফসার ও তার অনুগত বা সমর্থক দলবল কিংবা জোরপূর্বক বাধ্য করা আরাে কয়েকজন অথবা তর্কের খাতিরে আকবর, শরীফ, রুহুল, আনােয়ার ও নূরুল ইসলামরা যদি একটা পক্ষ হয়ে থাকেন, তবে তার বিপক্ষ হবেন জিয়াউর রহমান, এ জি মাহমুদ, মীর শওকত আলী প্রমুখ। এখানে তারা ছিলেন রাষ্ট্র বা সরকার পক্ষ অথবা আরাে ডেভে বললে এতে জড়িয়েছিলেন সেনা বা বিমানবাহিনীর পক্ষ হয়ে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হবে জাসদ, গণবাহিনী বা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা যাই-ই বলি না কেন, তাদের একজন হাসানুল হক ইনু। আরেক দৃষ্টিতে যে ঘটনাকে উপলক্ষ করে বা সামনে রেখে অপ্রস্তুত অবস্থায় সুযােগ নিয়ে ঐ অভ্যুত্থান ঘটে, সেই জাপানি বিমান ছিনতাই ঘটনার সময় উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষদশী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় | ঠাই নিয়েছে জাপানি মন্ত্রী হাজিমি ইশি। এই ট্র্যাজেডি সম্পর্কে যার যার প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে পাওয়া গেছে এ রকম বর্ণনা।
হাজিমি ইশি ১৯৭৭ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর জাপান এয়ারলাইন্সের বিমানটি যখন ছিনতাই হয় তখন। হাজিমি ইশি ছিলেন জাপানের ট্রান্সপাের্ট ও সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রী। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকিও ফুকুদা ছিনতাই সংকট অবসানে আলাপ-আলােচনা করার জন্য তাকে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকায় পাঠান।
তেজগাঁও বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারে বসে বিমান ছিনতাই ঘটনার অবসানে তিনি
এবং তৎকালীন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এ জি মাহমুদ গেরিলাদের সঙ্গে বেতারে সমঝােতা আলােচনা চালিয়েছিলেন। বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আলােচনাকালে তিনি সে সময়ে বিমানবন্দরে সংঘটিত ঘটনার বিবরণ দেন।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে।
দেখি আমার চারপাশে রসে বন্যা
জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকিও ফুকুদার বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে শতাধিক সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকা পৌঁছেছিলেন হাজিমি ইশি। তার ভাষ্য অনুযায়ী, রাত ১২টার দিকে হঠাৎ করে বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের চারপাশে প্রচণ্ড গােলাগুলি শুরু হয়। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিছু লােক কন্ট্রোল টাওয়ারের ভেতরে ঢুকেও গুলিবর্ষণ শুরু করে। তিনি এ সময় হাত তুলে ‘উই আর জাপানি’ বলে চিৎকার শুরু করেন। কারণ কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন অসংখ্য জাপানি নাগরিক অবস্থান করছিল। তিনি এবং বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার সমঝােতা প্রচেষ্টায় থাকা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ আত্মরক্ষায় একপর্যায়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়েন। । তিনি বলেন, ভাের রাতে গােলাগুলি থেমে যাওয়ার পর উঠে দেখি আমার চারপাশে রক্তের বন্যা। আলােচনায় আমাদের সহযােগিতাকারী বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাস মাসুদ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসারীর গুলিবিদ্ধ লাশ আমার পাশেই পড়ে থাকে। সেই ছােপ ছােপ রক্তের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে হেঁটেই আমি আর ঢাকায় জাপানের
রাষ্ট্রদূত ইচিরাে ইওশিওকা কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে নেমে আসি। নিচে নেমে দেখি। কন্ট্রোল টাওয়ারের চারপাশও রক্তে ভেসে গেছে। বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় ৫০টি লাশ পড়ে আছে। অধিকাংশ বিমানবাহিনীর সদস্যের। সেনাবাহিনী সদস্যদের কিছু লাশও পড়েছিল। পরে শুনেছি এই অ্যুথানে সেনা ও বিমানবাহিনীর ২০০ সৈন্য নিহত হয়েছে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া পরে সামরিক আদালতে বিচার করে আরাে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
মীর শওকত আলী
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবরের ঐ অভ্যুত্থান দমন করার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। নবম ডিভিশনের তত্ত্বালীন জিওসি মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী। ব্যাপক রক্তক্ষয় ঘটলেও অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে ঐ বিদ্রোহ দমন করা হয়। অভ্যুত্থানকালীন ও পরবর্তী। ঘটনাবলি নিয়ে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, বিদ্রোহীদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যার নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে জেনারেল শওকতের সঙ্গে তার গুলশানের বাড়িতে ‘৭৭-এর। অভুথান নিয়ে আমার দীর্ঘ আলােচনা হয়। অভ্যুত্থানের পূর্বাপর বিস্তারিত তিনি জানান। জেনারেল শওকতের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ২ অক্টোবরের ঘটনাটি আসলেই কোনাে অভ্যুত্থান ছিল কিনা। কারণ অনেক সেনা কর্মকর্তাই আমাকে বলেছেন, সেদিন আসলে জেনারেল জিয়া পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র বাহিনীতে তার শত্রুদের চিহ্নিত করে শেষ করে। দেওয়ার ফাঁদ পেতেছিলেন। সামরিক গােয়েন্দাদের দিয়ে অভ্যুত্থানের এই ফাদ পাতার খবর কতটা সত্যি তা নিয়ে জেনারেল শওকত কোনাে মন্তব্য করতে চাননি। তার কাছেও বিষয়টি। রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে। তিনি জানান, জেনারেল জিয়াউর রহমান অক্টোবরের বিদ্রোহের আগাম খবর পেয়েছিলেন মিসরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আনােয়ার সাদাতের কাছ থেকে। ১৯৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিন দিনের সফরে জেনারেল জিয়া মিসর যান।
২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবসে তার প্রধান অতিথি থাকার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তিনি উপস্থিত থাকবেন না বলে জানিয়ে দেন। ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবসে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জিয়াসহ সব সিনিয়র অফিসারকে হত্যা করা হবে বলে আনােয়ার সাদাত তার নিজস্ব গােয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন। জেনারেল শওকত জানান, এই তথ্যটি দিয়ে আনােয়ার সাদাত জিয়াকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি জানান, অভ্যুত্থান দমনে রেডিও স্টেশন, বিমানবন্দর, জিয়ার বাসভবনের আশপাশে এবং ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন গেটে সৈনিকদের প্রাণহানি ঘটেছে। তার ধারণা এই সংখ্যা এক শর বেশি না। পরবর্তী সময়ে বিচারের মাধ্যমে ১১৩০ জনের মৃত্যুর খবর তিনি শুনেছেন, তবে নিশ্চিত নন বলে জানান। অভ্যুত্থান-পরবর্তী গ্রেপ্তার ও বিচারের বিয়য়ে জেনারেল শওকত জানান, নবম ডিভিশন রেডিও স্টেশন থেকে প্রায় ৪০ ও বিমানবন্দর থেকে ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাকিদের কারা গ্রেপ্তার করেছে এবং কী প্রক্রিয়ায় বিচার হয়েছে তা নিয়ে। তিনি মুখ খুলতে চাননি। সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে গণফাসির ব্যাপারে তকালীন সিনিয়র অফিসারদের ভূমিকা। কেমন ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘তখন সৈনিকরা অফিসারদের হত্যা করছিল। বলে তারা সিনিয়রদের কাছ থেকে কোনাে সহানুভূতি পাননি। আপনিই বা কেন এত নির্মম হয়েছিলেন? জবাবে জেনারেল শওকত বলেন, “বিদ্রোহী বা দুষ্কৃতকারীদের যেকোনাে উপায়ে ঠাণ্ডা মাথায় দমন করাই একজন প্রকৃত সৈনিকের কাজ।’
মেজর জেনারেল মীর শওকত আলী পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হয়ে সেনাবাহিনী। থেকে অবসর নেন। রাজনীতিতে জড়িয়ে যােগ দেন বিএনপিতে। পরে বিএনপি ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সঙ্গে। তার ভাষায়
বিদ্রোহ দমনের বর্ণনা।
শুট, শুট টু কিল
১ অক্টোবর। মধ্যরাত নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে আমি আমার স্টাডিরুমে টেলিভিশনে প্লেন ছিনতাই ঘটনার সরাসরি সম্প্রচার দেখছিলাম। ছিনতাই করা প্লেন, রানওয়ে এবং আশপাশের ভবনগুলােই ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে ঘুম পাচ্ছিল। প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ঠিক সেই মুহুর্তেই লাল টেলিফোনটি বেজে উঠলাে। রিসিভার তুললাম। অন্য প্রান্তে চিফ অব স্টাফ জিয়া। জিজ্ঞেস করলেন, ‘মীর, তুমি কি গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছাে?” জানালাম, ‘আমি এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে, স্যার। বাইরে কোনাে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আপনি একটু ধরুন, আমি চেক করে আসছি। বারান্দায় গিয়ে আমাকে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলাে না। দূরে কোথাও গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলাে এলএমজি। গার্ডকে জিজ্ঞেস করলে সেও নিশ্চিত করলাে থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে জিয়াকে নিশ্চিত করলাম গুলির খবর। ‘তােমার কী মনে হয়… কী ব্যাপার? আমি বললাম, ‘আমি ধারণা করতে পারছি না। ব্যাপারটা নিশ্চিত নই। আমি তাকে বললাম, আমার হেডকোয়ার্টারে যাওয়াটাই ভালাে হবে। আমি ওখান থেকে তাকে সব কনফার্ম করবাে। ফোন রেখে দেওয়ার আগেও বললাম যে আমি তার গার্ডকে আমার বাসার এবং জেনারেল ইসলাম সাহেবের বাসার গার্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করতে বলে দেবাে। আইডিয়াটা তার পছন্দ হলাে। রিসিভার রাখা মাত্রই আবার বেজে উঠলাে। এবার আমার জিএসও-১ লে. কর্নেল আনাম। সে ক্যান্টনমেন্টের গুলির খবর জানাতে ফোন করেছে। আমি তাকে সব অফিসারকে ডেকে স্ট্যান্ডিং অর্ডার মাফিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদেশ দিতে বললাম। আমার স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুলে ব্যাপারটি অবহিত করে হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। একটি জিপে ওঠার পরপরই সেটি একটি ট্রাকের পেছন পেছন যেতে লাগলাে। সব সময় উল্টোটা হয়, এসকর্ট ট্রাক থাকে পেছনে। কোননারকম ঘটনা ছাড়াই আমরা মেইন গেটের এমপি চেকপোেস্ট অতিক্রম করলাম এবং ফার্মগেট হয়ে শেরে বাংলা নগরে হেডকোয়ার্টারে পৌছালাম।
হেডকোয়ার্টারের সব লাইট জ্বালানাে এবং রক্ষীরা তাদের এলার্ট পােস্টে ডিউটি করছে। জিএসও-১ আমাকে রিসিভ করলাে। আমি আমার অফিসে ঢুকে সব অফিসারকে সেখানে ডাকলাম। জিএসও-১ পুরাে পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাকে জানালাে। এরপর থেকে আমি পুরাে অপারেশনের দায়িত্ব নিলাম। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় ২টা। অনেক পরে আমি শুনতে পেলাম ভাগ্যগুণে আমি একটুর জন্য মেইন গেটে বিদ্রোহীদের দ্বারা আটকে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছি। এর কারণ এমপি গেটে ওরা ভাবতেই পারেনি। ট্রাকের পেছনে আমার জিপ থাকবে। ওরা যখন ভুল বুঝতে পারলাে ততক্ষণে আমি গেট পার হয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছি। আমি যা বুঝলাম তা হলাে, রাত আনুমানিক ১টার দিকে প্রথম গুলির আওয়াজ শােনা যায় ক্যান্টনমেন্টের সিগন্যাল রেজিমেন্টের দিক থেকে। ওদিকে মেজর মঞ্জুর তার ডিভিশনের ফিল্ড গােয়েন্দা ইউনিটের কাছ থেকে খবর পান রাত দেড়টা নাগাদ। তিনি তখনই জিএসও-১কে ফোনে জানালে জিএসও-১ সব অফিসারকে ফোন করে তাদের নিজ নিজ অফিসে রিপাের্ট করতে বলে। মূলত এর পরই জিএসও-১ আমার সঙ্গে কথা বলে, জিয়ার সঙ্গে আমার কথােপকথনের একটু পরই। ২টার মধ্যেই সব অফিসার অফিসে পৌছে যায় এবং সবাই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। এমনকি তাদের জিওসি উপস্থিত না থাকলেও। আমি অনেকটা গর্ববােধ করি তাদের দ্রুত কার্যকলাপ দেখে। কারণ এদের আমি নিজেই গড়ে তুলেছি… ট্রেনিং দিয়েছি। অফিসাররা তাদের ইউনিটগুলােকে করণীয় সম্পর্কে বুঝিয়ে দিলাে এবং যেখানে যেখানে প্রয়ােজন প্রতিরােধ ব্যুহ গড়ে তােলার আদেশ দিয়ে বললাে, অপরিচিত কেউ যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে। কোনাে অনুপ্রবেশকারীকে প্রয়ােজনে গুলির আদেশ ওরা পেয়েছিল আমার কাছ থেকে। আমি আমার হেডকোয়ার্টারে পৌছে জিয়াকে আমার লােকেশন রিপাের্ট দিয়েছিলাম। এখন যেহেতু নবম পদাতিক বাহিনীতে সব প্রস্তুতি শেষ, তাই ভাবলাম তাকে ফোন করে সব জানাই। তিনি ইতােমধ্যে অন্যান্য সাের্স থেকে মােটামুটি সব খবর পেয়েই গিয়েছিলেন কোথায় কী হচ্ছে। আমি তাকে জানালাম, নবম পদাতিক ডিভিশনে কোনাে সমস্যা নেই এবং এটি যেকোনাে আদেশের জন্য প্রস্তুত। জিয়া আমাকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়ে বললেন, তিনিও কিছু অস্ত্র ইউনিটে গুলির খবর পেয়েছেন, কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে পুরােপুরি পরিষ্কার নন। তিনি যখন বললেন বেঙ্গল রেজিমেন্টে কোনাে গুলির খবর পাননি, তখন আমি তাকে বললাম, ঢাকা ব্রিগেডের তিনটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে। তার এলাকায় এবং তিনি প্রয়ােজনে তাদের ডাকতে পারেন সরাসরি। আর কোনাে খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু জানা গেলাে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর একটা বিদ্রোহ চলছে, যাতে কিনা আর্মি সিগন্যাল রেজিমেন্ট, এমপি ইউনিট, এএসসি সেন্টার এবং স্কুল ও লগ এরিয়া কমান্ড এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারের কিছু ছােট ইউনিটের অন্য
লােকজন জড়িত। সমস্যা হলাে এসব আউটফিটের সবাই বিদ্রোহে জড়িত ছিল না। কিছু কিছু ছিল। এসব তথাকথিত বিদ্রোহী অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে ফেলে এবং ক্যান্টনমেন্টের ভেতর তাদের নিজস্ব ইউনিটগুলাে থেকে আনা গাড়িতে করে ঘােরাঘুরি করতে থাকে। ওরা বিনা কারণে আকাশের দিকে গুলি ছুড়তে থাকে। এরপর তারা বালুরঘাট এয়ারফোর্স কমপ্লেক্সের দিকে গিয়ে ওখানকার লােকজনকে বিদ্রোহে শামিল হতে উসকানি দিতে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত এয়ারফোর্স মেসের লােকজন তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। তারা গাড়ির একটি বহর নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্ডন্যান্স ডিপপার দিকে যায় এবং পরে ক্যান্টনমেন্টের মূল রাস্তা দিয়ে শহরের দিকে রওনা দেয়। আমি আরাে খবর পেলাম, ওরা যাওয়ার সময় অন্যদের বিদ্রোহে যােগ দেওয়ার উসকানি দেয়। কিন্তু আমরা বিমানবাহিনীকে সময়মতাে আদেশ দেওয়ার ফলে এবং পুরাে পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালােভাবে ব্রিফ করে রাখার ফলে তাদের টলানাে যায়নি। এদিকে আমি অফিসে পৌঁছার পর থেকে চেষ্টা করছিলাম এই অপারেশনের জন্য দায়ী। ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে যােগাযােগ করার। কিন্তু তাকে অফিসে বা বাসা কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি তখন জিএসও-১কে আদেশ দিলাম ওই ব্রিগেডের। ইউনিটগুলাের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগের প্রয়ােজনীয় আদেশ দিতে। এদিকে সাভার ব্রিগেড কমান্ডার সামাদ তার ব্রিগেডে যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলাে প্রয়ােজনীয় আদেশের জন্য। তখন রাত ২টা ১০ মিনিট। তাকে আমার সঙ্গে থাকতে বললাম এবং অয়্যারলেসের মাধ্যমে তার ব্রিগেডের সঙ্গে যােগাযােগ। রাখতে বসলাম। ব্রিগেডিয়ার সামাদ তার ব্রিগেড কমান্ডার সাইদুল আনামের সঙ্গে কথা বললাে ফোনে এবং আমিও সাইদুলকে বলে দিলাম, সামাদ আমার সঙ্গে আছে। আর্মি হেডকোয়ার্টারের কাছে থাকায় ঢাকা ব্রিগেডে সমস্যা সব সময় লেগেই ছিল। এটা সব সময় কোনাে বড় অফিসার দ্বারা প্রভাবিত হতাে এবং কোনাে কোনাে সময় একেবারে পােষ মানা হয়ে যেতাে কারাে। আমি এর মধ্যে মির্জাপুরে ফোন করে ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে কথা বললাম এবং সব কিছু জানলাম। যখন সে জানতে চাইলাে আমার ঢাকায় কোনাে সাহায্য লাগবে কিনা, আমি তখন ব্রিগেডিয়ার মুস্তাদিরকে তার এলাকায় নজর রাখতে বলেছিলাম। সাভার ব্রিগেডে নিরাপত্তা জোরদার করা হলাে। রেডিও ট্রান্সমিশন সেন্টারে নিরাপত্তা বাড়িয়ে যাতে সব অনাকাক্ষিত মেসেজ বন্ধ করা যায় তার ব্যবস্থা নেওয়া হলাে। এদিকে মির্জাপুর ব্রিগেড, যেটা কিনা টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সেখানে সব কিছু ভালােই ছিল। শুধু টেলিফোন এক্সচেঞ্জ গুজব ছড়ানাের চেষ্টা করলে এক্সচেঞ্জের সবাইকে অ্যারেস্ট করা হয়। ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চিফ অব স্টাফ জিয়ার বাসার নিরাপত্তায় নিয়ােজিত করা হলাে। অন্য দুই ব্যাটালিয়নকে বাইরে নিরাপত্তা ব্যহতে রাখা হলাে। জিয়া ৮
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে তার নিরাপত্তায় পেয়ে ভালােই বােধ করছিলেন। এই ব্যাটালিয়ন নিয়েই জিয়া ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিলেন। যেহেতু বিষয়গুলাে আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না কেন, কিভাবে, কারা এই বিদ্রোহ করছে, তাই আমি কিছু নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে গড়ে তােলা স্পেশাল ব্যাটালিয়নকে পুরােপুরি সজাগ থাকতে আদেশ দেওয়া হলাে এবং হেডকোয়ার্টারে একজনকে পাঠাতে বলা হলাে। লে. কর্নেল ইমতিয়াজকে অয়্যারলেসসহ তার কমান্ড জিপ নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে বললাম। তিনি এলেন এক কোম্পানি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ট্রপস নিয়ে। আমি আর সামাদ চা খাচ্ছিলাম অফিসে। এমন সময় জিএসও-১ খায়রুল আনাম এলাে পুরাে পরিস্থিতির রিপাের্ট দিতে। জানা গেলাে রাত ২টার কিছু পর বিদ্রোহীরা আকাশের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এবং স্লোগান দিতে দিতে সাপাের্ট ও পরিবহন ব্যাটালিয়নের দিকে এগােচ্ছিল। তারা আমাদের টুপসকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল কিন্তু কমান্ডিং অফিসারের পরিষ্কার নির্দেশ ছিল ওরা ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করলে গুলি করার। যা হােক ওরা ইউনিটের ভেতর ঢুকলাে না, কিন্তু শাসিয়ে গেলে এর ফল ভালাে হবে না। জানা গেলাে জিএসও-১ ঢাকা ব্রিগেডের কাছ থেকে প্রয়ােজনীয় সহযােগিতা পায়নি। সরবরাহ ও পরিবহন ব্যাটালিয়নে সমস্যা শুরুর পর সে যখন ব্রিগেড কমান্ডারকে কিছু ট্রপস পাঠাতে বললাে, কমান্ডার তখন টুপসের অভাবের অজুহাতে অনুরােধ ফিরিয়ে দেয়। একজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের অনুমতির পরিপ্রেক্ষিতেই সে তা করবে। কিন্তু ততক্ষণে সেই টুপসের আর প্রয়ােজন ছিল না। কারণ সমস্যা মিটে গিয়েছিল। যা হােক বিদ্রোহীরা চলে যাওয়ার পর ব্রিগেড কমান্ডার এক প্লাটুনটুপস পাঠালাে সাপাের্ট ও পরিবহন ব্যাটালিয়নে এবং রিপাের্ট দিলাে ওখানে কোনাে বিদ্রোহী দেখা যায়নি। আমি ধীরেসুস্থে আনামের বর্ণনা শুনলাম এবং তাকে ঢাকা রেডিও স্টেশনের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়ে বললাম, বিদ্রোহীরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরের দিকে গেছে। | রেডিও স্টেশনে ডিউটিরত অফিসারকে ইতােমধ্যে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়ে অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্য বলা হলাে। তাকে এও বলা হয়েছে যে স্টেশনের দিকে ঢােকার কোনাে সন্দেহজনক চেষ্টা করা হলে যেন গুলি করা হয়। তাকে এও বলা হলাে পরিস্থিতি যেহেতু |[আমাকে জিএসও-১ রিপাের্ট করলাে রেডিও স্টেশনে সব কিছু ঠিক আছে এবং তার সঙ্গে ডিউটি অফিসারের সরাসরি যােগাযােগ রয়েছে। আনুমানিক রাত আড়াইটার দিকে ইমতিয়াজকে বলা হলাে মিরপুর ১০ ও ১২ নং সেকশনে চেকপােস্ট এবং রােডব্লক বসানাের জন্য, যাতে মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে আসার চেষ্টা করলে বিদ্রোহীদের থামানাে যায়। মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের গেটে মর্টার। রেজিমেন্টকে বলা হলাে আরেকটি রােডব্লক বসানাের জন্য। কিন্তু তা করার আগেই পাঁচ-ছয়জন বিদ্রোহী ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ঢুকে পড়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। কিন্তু নবম পদাতিক ডিভিশনের কাউকে প্ররােচিত করতে না পেরে ওরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।
মনে হলাে লগ এরিয়া এবং আর্মি হেডকোয়ার্টারের কিছু ট্রপস এসব এলােপাতাড়ি গুলি করেছে। কিন্তু নবম পদাতিক বাহিনীর কেউ তাতে যােগ দিলাে না। বিদ্রোহীরা এ রকম এলােপাতাড়ি গুলি করতে করতে এবং শ্লোগান দিতে দিতে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ঘুরছিল। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য তাতে হাসিল হচ্ছিল না। এ পর্যায়ে ইমতিয়াজকে তার বিশেষ ব্যাটালিয়ন নিয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ গােল চত্বর, আসাদ গেট, গণভবন ক্রসিং এবং ফার্মগেটে রােডব্লক তৈরি করতে আদেশ দেওয়া হলাে। আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে একটি এমপি জিপের নেতৃত্বে পাঁচ-ছয়টি গাড়ির একটি বহর আকাশে গুলি করতে করতে রেডিও স্টেশনের দিকে এগােলাে। রেডিও স্টেশন অতিক্রম করে চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পর ওরা ফিরে এলাে। গেটের সামনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ওরা মেইন গেটে স্লোগান দিতে দিতে চার্জ করলাে। গেটের সেন্ট্রিরা গেট খুললাে না। ৪০ জন গার্ড যারা দায়িত্বে, তারা বিদ্রোহীদের দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলাে না। কিন্তু যখন বিদ্রোহীরা বললাে পুরাে আর্মি বিদ্রোহ করেছে, ওরা তখন দ্বিধায় পড়ে যায়। আর এই সুযােগে বিদ্রোহীরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওদের কেউ কেউ শিফট ইঞ্জিনিয়ারের রুমে ঢুকে তাকে তাদের তৈরি করা একটি বক্তব্য প্রচারের জন্য বলে। কিন্তু শিফট ইঞ্জিনিয়ার তা প্রচার করতে অস্বীকৃতি জানালে ওরা তাকে বন্দুকের মুখে ওই বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করে। এই সময়ে লাল ফোনে জিয়ার ফোন এলাে। ‘রেডিও স্টেশন কার দখলে?” ‘অবশ্যই আমাদের হাতে, স্যার। ‘রেডিও শােনাে’, জিয়া বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন। জিয়া তখনাে টেলিফোন লাইনে। জিএসও-১ এবং জিএসও-২ আমার রুমে এলাে। হাতে একটি রেডিও। আমি রেডিতে শুনলাম- “প্রিয় দেশবাসী, দয়া করে একটু অনুগ্রহ করুন। আমাদের নেতা শিগগিরই আপনাদের উদ্দেশ্যে কথা বলবেন।’ আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। খায়রুল আনামের দিকে তাকালাম। ও দশ মিনিট আগেই আমাকে জানিয়েছিল রেডিও স্টেশনে সব কিছু ঠিকঠাক আছে। ও নিজেও হতভম্ব। এ সময় সামাদ তার ব্রিগেডের সঙ্গে অয়্যারলেসে কথা বলে আমাকে জানালাে সাভার থেকে ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়েছে।
এদিকে জিএসও-২ আমার রুম থেকে অনবরত চেষ্টা করছিল ঢাকা রেডিও স্টেশনের ডিউটি অফিসারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে। সে যখন ডিউটি অফিসারকে পেলাে তখনাে ডিউটি অফিসার বলে যাচ্ছিল যে সব কিছু ঠিক আছে। আমি মঞ্জুরের কাছ থেকে ফোন নিয়ে নিজেই অফিসারের সঙ্গে কথা বললাম। বুঝলাম সে এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে। ঘুমাচ্ছিল এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে তার কোনাে ধারণাই ছিল না। আমি তাকে স্টুডিওতে গিয়ে দেখে রিপাের্ট করতে বললাম এবং আরাে বললাম যে তাকে কোর্ট মার্শালের মুখােমুখি হতে হবে। এদিকে জিয়া তখনাে লাইনে থাকায় আমাদের সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন এবং বুঝতে পারছিলেন এখানে কী চলছে। আমি তার কাছ থেকে ১৫ মিনিট সময় চেয়ে বললাম প্রয়ােজনে আমার লাশের বদলে রেডিও স্টেশন পুনর্দখল করা হবে। উনি আশ্বস্ত হয়ে ফোন রেখে দিলেন। ইমতিয়াজের স্পেশাল ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি ট্রপস ততক্ষণে পৌছে গেছে ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে। ইমতিয়াজকে এক প্লাটুন ট্রপস পাঠাতে বললাম রেডিও স্টেশনের দখল নিতে। ক্যাপ্টেন আবেদিনের নেতৃত্বে ওরা রওনা হলাে। জিপ ও পিকআপ ওদের বাহন হওয়ায় এবং রাস্তায় গাড়ি-ঘােড়া একরকম না থাকায় ওরা দ্রুত রেডিও স্টেশনে পৌছে গেলাে।
যেতে যেতে আবেদিন তার কমান্ডিং অফিসারকে প্রােগ্রেস রিপাের্ট দিচ্ছিল এবং আমি আর সামাদ ওদের দুজনের কথােপকথন শুনছিলাম। একপর্যায়ে আবেদিনকে বলতে শুনলাম, ‘আমরা রেডিও স্টেশন দেখতে পাচ্ছি।’ একটু পর সে বললাে, আমি কয়েকজন দুষ্কৃতকারীকে দেখতে পাচ্ছি।’ ইমতিয়াজ আমার দিকে তাকালাে আদেশের জন্য। ‘শুট, শুট টু কিল- আমি বললাম। ‘শুট, শুট টু কিল’- ইমতিয়াজ আবেদিনকে রিপিট করলাে আমার আদেশ। ‘ফায়ার’, অয়্যারলেস অন থাকায় আমরা আবেদিনের আদেশ শুনতে পেলাম সবাই। মুহুর্তের মধ্যে একটি অটোমেটিক থেকে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আবেদিন আবার অয়্যারলেসে এলাে এবং বললাে, “দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে যাচ্ছে।’ ইমজিয়াজ আবার আমার দিকে তাকালাে। কিন্তু এবার আর কিছু বললাম না। দেখতে চাচ্ছিলাম ও নিজে কী সিদ্ধান্ত নেয়। একমুহূর্ত বিরতি নিয়ে ইমতিয়াজ বললাে, ‘ওদের যেতে দাও… রেডিও স্টেশন দখল করাে এবং আমাকে রিপাের্ট করাে।’ সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও। আমার আদেশেও ছিল রেডিও স্টেশন দখলের। হত্যাকাণ্ডের প্রয়ােজন ছিল না। অপারেশন মােটামুটি সফল বুঝতে পেরে আমি সামাদকে বললাম, ‘চলাে চা খাই। আমার অফিসে ঢুকতেই আমার সিভিল ফোনটি বেজে উঠলাে। রিসিভার তুললাম। অন্যপ্রান্তে আবেদিন। ‘স্যার, আমি স্টুডিওতে, এভরিথিং ইজ আন্ডার কন্ট্রোল। এ সময় ইমতিয়াজ আমার রুমে ঢুকলাে একই জিনিস রিপাের্ট করতে। আবেদিন তখনাে লাইনে। ওকে বললাম, “গুড শাে অ্যান্ড ওয়েল ডান। এবার তােমার কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলাে।’ ইমতিয়াজকে বলে দিলাম ওকে রেডিও স্টেশনের নিরাপত্তার ভার নিয়ে নিতে। আলাপ শেষে ইমতিয়াজ জানালাে, তিনজন দুষ্কৃতকারী স্টুডিওতে ধরা পড়েছে এবং ওদের হেডকোয়ার্টারে আনা হচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। জিয়ার সঙ্গে শেষ কথা বলার পর মাত্র ১২ মিনিট পার হয়েছে। জিয়াকে ফোন করলাম। শান্তভাবে বললাম, ‘স্যার, রেডিও স্টেশন আমাদের দখলে, আপনি কিছু বলবেন? উনি একই রকম শান্ত গলায় বললেন, “তােমাকে ধন্যবাদ, হয়তাে পরে।’ আমরা যখন রেডিও স্টেশন অপারেশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তখন জিএসও-১ তার অফিসে অন্য একটি পরিস্থিতি সামলাচ্ছিল। ভাের ৫টা ৫০ মিনিটে মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টর আনামকে জানায়, বিদ্রোহীরা বিমানবাহিনী চিফ, ডিজিএফআই, ডিজি এনএসআই এবং অন্য অফিসাররা যারা কিনা ব্যস্ত ছিলেন প্লেন হাইজ্যাক নেগােশিয়েশনে, তাদের বন্দি করেছে। এয়ারপাের্টের কন্ট্রোল টাওয়ারে বিদ্রোহীরা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এয়ারফোর্স অফিসার্স মেস ঘিরে রেখেছে, মুহুর্মুহু গুলি করছে ও অফিসারদের হত্যা করছে। ডিএমও আনামকে এও জানালাে যে তার কাছে আনকনফার্মড রিপাের্ট আছে যে উপরাষ্ট্রপতিও আটকা পড়েছেন কন্ট্রোল টাওয়ারে।
হেডকোয়ার্টারে দুই প্লাটুন স্পেশাল ব্যাটালিয়নের ফোর্স ছিল। আমি ইমতিয়াজকে আদেশ দিলাম এক প্লাটুন ফোর্সকে এয়ারপাের্টের দেয়াল টপকে পাঠাতে। বলে দিলাম ওরা যেন সােজা কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে গিয়ে অফিসারদের উদ্ধার করে। অন্য প্লাটুনকে ক্যান্টনমেন্টের পাশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে এয়ারপাের্ট বিল্ডিং দখল করতে আদেশ দিলাম। আরাে কিছু টুপসকেও এতে অংশগ্রহণ করার কথা বললাম। মেজর মােস্তফা, ক্যাপ্টেন সাদেক, ক্যাপ্টেন হােসেন এবং ক্যাপ্টেন তাহেরের নেতৃত্বে ফোর্স এগােতে থাকলাে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের দিকে। বিদ্রোহীদের এনকাউন্টার করতে করতে ওরা ১৫ মিনিটেই পৌছে গেলাে ওখানে। প্রচণ্ড গােলাগুলি হলাে দুপক্ষেই। কিছু বিদ্রোহী মারা পড়লাে টারমাকে। কিছু পালিয়ে বাঁচলাে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। ওরা এর মধ্যেই ১১ জন এয়ারফোর্স অফিসারকে হত্যা করেছে। ৬০ জন বিদ্রোহীকে টার্মিনাল ভবন থেকে পাকড়াও করা হলাে এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হলাে। জিএসও-১ ঢাকা ব্রিগেডকে আবার টুপসের জন্য অনুরােধ করলাে। এ সময় কি। আবারও তার অনুরােধ প্রত্যাখ্যাত হলাে এই অজুহাতে যে একরকম গােলাগুলির মধ্যে। ট্রপস পাঠানাে কঠিন। এয়ারপাের্ট বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করা হলাে উপরাষ্ট্রপতি, বিমানবাহিনী প্রধান, পররাষ্ট্র সচিব এবং অন্য অফিসারদের। উপরাষ্ট্রপতি সােজা বাসায় গেলেন এবং বিমানবাহিনী। প্রধান ও পররাষ্ট্র সচিব আমার অফিসে চা খেয়ে একটু বিশ্রাম করে তারপর বাসায় গেলেন। এদিকে আনুমানিক সাড়ে ৬টা থেকে ৬টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ২০০ জন বিদ্রোহীকে।
ক্যাপ্টেন তাহেরের নেতৃত্বে স্পেশাল ব্যাটালিয়নের এক প্লাটুন ফোর্স ফার্মগেটে থামিয়ে দেয়। ওদের ধরার জন্য তার প্রয়ােজন ছিল অতিরিক্ত ফোর্সের। জিএসও-১ অনুরােধ করলাে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডারকে। কিন্তু সে বললাে, তার কাছে দেওয়ার মতাে ট্রপস নেই। এর ফলে বিদ্রোহীরা পালিয়ে যেতে সফল হলাে। যেহেতু রাস্তায় ইতােমধ্যেই। গাড়ি-ঘােড় চলাচল শুরু করেছে এবং বাসাবাড়ির দরজা-জানালা দিয়ে উৎসুক জনতা। বিষয়টি দেখছিল, তাই গুলি করার চিন্তা বাদ দেওয়া হলাে। দিনের আলাে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রেডিও স্টেশন এবং এয়ারপাের্ট দখলের পাশাপাশি শহীদ বাশার রােড, বনানী রেলক্রসিং, মহাখালী এবং তৃতীয় এমপি গেটে চেকপােস্ট বসানাের কাজ সম্পন্ন হলাে। নবম পদাতিক ডিভিশন পুরাে এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করলাে এবং সকাল ৮টার মধ্যে সব বিদ্রোহীকে ধরে ফেললাে। এভাবে বিদ্রোহ দমনের বিস্তারিত তুলে ধরে জেনারেল শওকত জানান, সব কিছু শেষ হলে। অনেক তদন্ত হলাে। কিন্তু আজ অবধি কিছু জিনিস যা কিনা আর্মির শৃঙ্খলা এবং মূলনীতির বিরুদ্ধে তা তার কাছে স্পষ্ট নয়। প্রথমত, সমস্যা শুরুর আগেই কেন বাইরের কিছু অফিসার ৮ম ইস্টবেঙ্গলে গেলাে? তারা কি এমন কিছু জানতাে যা নবম ডিভিশন। জানতাে না? দ্বিতীয়ত, কেন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সমস্যা শুরুর আগেই ৮ম ইস্টবেঙ্গলে তার বিছানাপত্র সরিয়ে নিলাে? তৃতীয়ত, কেন সিজিএস তার পরিবারকে অক্টোবরের ১ তারিখ ১২:০০টায় শহরে সরিয়ে নিলাে? চতুর্থত, স্ট্যাটিক সিগন্যাল-এর কমান্ডিং অফিসার রাত ৯টায় ইউনিটের ভেতর এবং আশপাশে সন্দেহজনক গতিবিধি সম্পর্কে জানায় আর্মি ইন্টেলিজেন্সকে। কেন আর্মি ইন্টেলিজেন্স তথ্যটা নবম ডিভিশনকে জানালাে । যদিও বােঝা যায় কোন কোন রাজনৈতিক দল ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রশ্ন হলাে কে বিষয়টির পরিকল্পনা করছিল, কার জন্য এবং কী উদ্দেশ্যে? উল্লেখ্য, জেনারেল শওকত তৎকালীন বিচার বিভাগীয় কমিশনে দেওয়া জবানবন্দিতে অনেক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে জওয়ানরা কেন বিদ্রোহ করলাে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেনআমি এই বিশেষ বিদ্রোহের সঠিক কারণটি বলতে পারবাে না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা।
জিএসও-১ ঢাকা ব্রিগেডকে আবার টুপসের জন্য অনুরােধ করলাে। এ সময় কি। আবারও তার অনুরােধ প্রত্যাখ্যাত হলাে এই অজুহাতে যে একরকম গােলাগুলির মধ্যে। ট্রপস পাঠানাে কঠিন। এয়ারপাের্ট বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করা হলাে উপরাষ্ট্রপতি, বিমানবাহিনী প্রধান, পররাষ্ট্র সচিব এবং অন্য অফিসারদের। উপরাষ্ট্রপতি সােজা বাসায় গেলেন এবং বিমানবাহিনী। প্রধান ও পররাষ্ট্র সচিব আমার অফিসে চা খেয়ে একটু বিশ্রাম করে তারপর বাসায় গেলেন। এদিকে আনুমানিক সাড়ে ৬টা থেকে ৬টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ২০০ জন বিদ্রোহীকে। ক্যাপ্টেন তাহেরের নেতৃত্বে স্পেশাল ব্যাটালিয়নের এক প্লাটুন ফোর্স ফার্মগেটে থামিয়ে দেয়। ওদের ধরার জন্য তার প্রয়ােজন ছিল অতিরিক্ত ফোর্সের। জিএসও-১ অনুরােধ করলাে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডারকে। কিন্তু সে বললাে, তার কাছে দেওয়ার মতাে ট্রপস নেই। এর ফলে বিদ্রোহীরা পালিয়ে যেতে সফল হলাে। যেহেতু রাস্তায় ইতােমধ্যেই। গাড়ি-ঘােড় চলাচল শুরু করেছে এবং বাসাবাড়ির দরজা-জানালা দিয়ে উৎসুক জনতা। বিষয়টি দেখছিল, তাই গুলি করার চিন্তা বাদ দেওয়া হলাে। দিনের আলাে ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রেডিও স্টেশন এবং এয়ারপাের্ট দখলের পাশাপাশি শহীদ বাশার রােড, বনানী রেলক্রসিং, মহাখালী এবং তৃতীয় এমপি গেটে চেকপােস্ট বসানাের কাজ সম্পন্ন হলাে। নবম পদাতিক ডিভিশন পুরাে এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করলাে এবং সকাল ৮টার মধ্যে সব বিদ্রোহীকে ধরে ফেললাে। এভাবে বিদ্রোহ দমনের বিস্তারিত তুলে ধরে জেনারেল শওকত জানান, সব কিছু শেষ হলে। অনেক তদন্ত হলাে। কিন্তু আজ অবধি কিছু জিনিস যা কিনা আর্মির শৃঙ্খলা এবং মূলনীতির বিরুদ্ধে তা তার কাছে স্পষ্ট নয়। প্রথমত, সমস্যা শুরুর আগেই কেন বাইরের কিছু অফিসার ৮ম ইস্টবেঙ্গলে গেলাে? তারা কি এমন কিছু জানতাে যা নবম ডিভিশন। জানতাে না? দ্বিতীয়ত, কেন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার সমস্যা শুরুর আগেই ৮ম ইস্টবেঙ্গলে তার বিছানাপত্র সরিয়ে নিলাে? তৃতীয়ত, কেন সিজিএস তার পরিবারকে অক্টোবরের ১ তারিখ ১২:০০টায় শহরে সরিয়ে নিলাে? চতুর্থত, স্ট্যাটিক সিগন্যাল-এর কমান্ডিং অফিসার রাত ৯টায় ইউনিটের ভেতর এবং আশপাশে সন্দেহজনক গতিবিধি সম্পর্কে জানায় আর্মি ইন্টেলিজেন্সকে। কেন আর্মি ইন্টেলিজেন্স তথ্যটা নবম ডিভিশনকে জানালাে । যদিও বােঝা যায় কোন কোন রাজনৈতিক দল ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রশ্ন হলাে কে বিষয়টির পরিকল্পনা করছিল, কার জন্য এবং কী উদ্দেশ্যে? উল্লেখ্য, জেনারেল শওকত তৎকালীন বিচার বিভাগীয় কমিশনে দেওয়া জবানবন্দিতে অনেক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে জওয়ানরা কেন বিদ্রোহ করলাে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেনআমি এই বিশেষ বিদ্রোহের সঠিক কারণটি বলতে পারবাে না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা।
থেকে দেখেছি যে কারণগুলাে এরকম ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়, এর মধ্যে রয়েছে :
১. স্বাধীনতার পর অনেক লােককে চরিত্র বিশ্লেষণ ছাড়াই আর্মিতে নেওয়া হয়। পরে দেখা যায় এদের মধ্যে অনেক ডাকাতও রয়েছে। আর রয়েছে সেসব লােক, যাদের বিরুদ্ধে এখনাে কোর্টে কেস আছে। যদিও কিছু ভেরিফিকেশন করা হয় তার পরও
আমরা দেখেছি পুলিশ তাদের কাজ ঠিকমতাে করেনি।
২. আমরা খুব দ্রুত বেড়ে ওঠার ফলে আর্মিতে ব্যাংক এবং কমান্ড স্ট্রাকচারে প্রয়ােজনীয় অভিজ্ঞতা ও ট্রেনিংয়ের অভাব রয়েছে।
৩. কিছু লােককে ভিন্নপথে চালানাের জন্য রাজনীতিকরা সম্ভবত কিছু দুর্নীতিমূলক পন্থা অবলম্বন করেছেন।
৪, সামরিক আইন ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দায়িত্বে লম্বা সময় জড়িত থাকায় আর্মিতে
ট্রেনিংয়ের সময় কমে যায়, যা কিনা ট্রপসদের ডিসিপ্লিনের অভাবের জন্য দায়ী।
৫. একটি বিপথগামী মহলের প্রভাবের ফলে উচ্চাশা। যেমন একজন এলএলবি পাস এয়ারফোর্স সার্জেন্ট মনে করতাে তার অফিসাররা যেহেতু ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট
অথবা গ্রাজুয়েট পাস, তাই সে কোনাে অফিসারের মর্যাদা পাবে না।
৬. কিছু রাষ্ট্রবিরােধী রাজনৈতিক দল এবং আগ্রহী অন্য রাষ্ট্র।
৭. রাজনৈতিক মতাদর্শে মােটিভেটেড লােকজনদের সার্ভিসে অনেকদিন ধরে অবস্থান। | এদের চিহ্নিত করে সার্ভিস থেকে বের করে দেওয়া উচিত ছিল। অফিসারদের হাতে জওয়ানদের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি কমিশনকে জানান, না, সে রকম তিনি কিছু দেখননি। আর্মিতে সব শাস্তি কারেকশনের জন্য দেওয়া হয়, শাস্তি হিসেবে নয়। বগুড়া ও ঢাকার ঘটনা একই রকম কিনা এবং সংগঠকরাও একই ব্যক্তি কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনাে মন্তব্য করেননি। বলেন, হতে পারে আলাদা ঘটনা অথবা যোগাযোগ থাকতেও পারে।
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশীদ। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। এরপর সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন। দিয়ে ৯ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন পাকিস্তানে।। সেনাবাহিনীতে তিনি পাকিস্তানপন্থী হিসেবেই চিহ্নিত ছিলেন। হয়েছিলেন জেনারেল জিয়ার ঘনিষ্ঠ। ‘৭৭-এর অভ্যুত্থানের পর তিনি ছিলেন জিয়ার ডেপুটি। অভ্যুত্থান ও পরবর্তী বিচারপ্রক্রিয়া সব কিছুই ঘটেছে তার সামনে। তাই তার অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ।
জিয়া ক্যাঙ্গারু কোর্টে ৫০০ সিপাহিকে ফাঁসি দিয়েছেন
‘৭৭-এর অ্যুত্থানের সময় সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এইচ এম এরশাদ ছিলেন জেনারেল জিয়ার ডেপুটি। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধাবিরােধী হিসেবে তার অবস্থান স্পষ্ট ছিল। তার অনেক আদেশ সরাসরি মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গেছে। জেনারেল জিয়া তাকে সেনাপ্রধানও করেছিলেন। জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর এরশাদের নির্দেশেই জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছিল এমন অভিযােগ আছে। আবার জেনারেল জিয়া হত্যায় এরশাদের হাত রয়েছে বলে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে অভিযােগ করেছেন। ১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুর্নীতির মামলায় তিনি কারাবন্দি হন। ১৯৯৫ সালে তার বিরুদ্ধে জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের হয়। ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর তাকে বারবার অনুরােধ করা সত্ত্বেও ‘৭৭-এর অ্যুথান নিয়ে কোনাে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বারবারই বলেছেন, ওই সব বিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই ভালাে। কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি চিঠির মাধ্যমে তার দল জাতীয় পার্টিকে নানা নির্দেশনা দিতেন, বলা যায় চিঠি দিয়েই তিনি দল চালাতেন। তিনিই ছিলেন দলের চেয়ারম্যান। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের সঙ্গেই তার মুক্তির ব্যাপারে দরকষাকষি হয়। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার মতৈক্য হয়। এ কারণে ক্ষমতাসীন বিএনপি তার বিরুদ্ধে নানা প্রচারণা চালায়। ওই সময় বিএনপির মুখপত্র দৈনিক দিনকালে তার বিরুদ্ধে নানারকম সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে। সে সময় অবশ্য জেনারেল মঞ্জুর হত্যার বিচারকার্যক্রম চলছিল। জেনারেল এরশাদ ওই মামলার প্রধান আসামি। মধুর হত্যায় জড়িত এমন অভিযােগে এরশাদকে নিয়ে বেশ কিছু
প্রতিবেদন দিনকালসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এমনই একসময় দলের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে চিঠি লিখেন জেনারেল এরশাদ। চিঠিতে বিএনপির বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারণার কৌশল বাতলে দেন। চিঠির এক জায়গায় তিনি লিখেন ‘৭৭-এর ঘটনায় ক্যাঙ্গারু কোর্টে জেনারেল জিয়া ৫০০ সিপাহিকে ফাঁসি দিয়েছেন। এক-একটা বিচারকাজ সম্পন্ন করতে মাত্র ৫ মিনিট সময় লেগেছে। এরশাদের বিরুদ্ধে বিএনপির সমালােচনার জবাবে এসব বিষয় যেন সংবাদপত্রে প্রকাশ পায় সে ব্যবস্থা নিতে এরশাদ দলের নেতাদের নির্দেশ দেন। এবং নিহত সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের দিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করানাের পরামর্শও দেন এরশাদ। সবশেষে তিনি এই চিঠির বিষয় খুবই গােপন রাখতে বলেন। চিঠি থেকে উদ্ধার করা অংশ :Dear Presidium Members, Nothing to worry, they cannot frame me. Emdad was forward but did not mention my name. He said about Aziz and Latif. Aziz is died and Latif has not said anything. He cannot, because I had no communication with him in those days. দৈনিক দিনকাল লিখেছে আমি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছি। এটা মিথ্যা এটা তারা বলতে পারে না। আপনারা অনেকেই lawyer, একটা defamation suit করা উচিত। অন্যরা। সাবধান হবে। আর হারাবার কিছু নেই। BNP desperate ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলতে হবে। গুলি শুধু KZ-এর ওপরেই নয় আপনাদের ওপরেও হবে। ভয় করলে আমরা হারিয়ে যাবাে। সংবাদে মেজর রফিকের রূপকথার কাহিনী পড়ছি। আপনারা protestও করেন না। president থাকতে আমি CAS কিভাবে সদরুদ্দিনকে Radio station Bomb করতে বলতে পারি। গাঁজাখুরির একটা সীমা আছে। ৫০০ জন সিপাহিকে জিয়া ফাসি দিয়েছে। আমি CAs হই 1st December 1978. তার আগে জিয়া president ও CAS দুই পদেই বহাল ছিল। আমার CAS হবার আগেই জিয়া অত ফাঁসি কার্যকর করে। আমি মাত্র নামকাওয়াস্তে DCAS তখন। how can I be this involved। এই ফাসির কাগজগুলাে জিয়ার দস্তখত সমেত একজনকে দেখতে বলুন। এক-একটা ফাসির, বিচার হয়েছে ৫ মিনিটে। জনগণ জানুক। ভাের ৪.৩০ মিনিটে MSP জেনারেল সাদেক আমাকে president হত্যার খবর দেয়। VP তখন হাসপাতালে (CMH)। আমি cabinet secretary কেরামত আলীকে telephone করে ওনাকে নিয়ে CMH এ সাত্তারকে president ঘােষণা করি। তৎকালীন DIG শাহজাহান আমাকে খবর দেয় নাই। মেজর রফিকের ভাষ্য let us put the plan in action is a lie. তিন জজের enquiry report প্রকাশ করতে বলুন, court martial-এ মেজর এমদাদের statement আমাদের একজনের কাছে আছে। paper-এ ছাপাতে বলুন। পুরা court martial proceeding জনগণের জন্য প্রকাশ করতে বলুন। দেখবেন এর মধ্যে জে: শওকত জড়িত ছিল। statementগুলাে বই আকারে একজন সাংবাদিকের কাছে দেওয়া আছে। KZ তাকে চেনে। এটা ছাপিয়ে চুপে চুপে সবার মধ্যে বিলি করলে অনেকের involvement ধরা পড়বে। চুপ করে বসে থাকবেন না। বিএনপি এখন ফাটা বাঁশে আটকা পড়েছে। তাহেরের বিচারের file চান ও মিসেস তাহেরকে দিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে কেস করান। কোন কোন সিপাহিদের kangaroo court করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাদের পরিবারদের প্রত্যেককে কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে কেস করতে বলুন। Allah is great. He has given us a golden opportunity don’t miss it. Tell all workers we want to go to power by the grace of Allah… nobody wants to vote for 3rd party, iron out your difference be together and… this God given opportunities save my life and also save… Your HM Ps: please maintain complete secrecy about this. I don’t want to see this printed in the newspaper. It will be dangerous for me… [KZ – কাজী জাফর। CAS . চিফ অব আর্মি স্টাফ DCAS – ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ MSP – মিলিটারি সেক্রেটারি টু দ্য প্রেসিডেন্ট VP • ভাইস প্রেসিডেন্ট CMH – কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল (অনেক পুরােনাে চিঠি এবং হাতের লেখা অস্পষ্ট হওয়ায় বেশ কিছু শব্দ উদ্ধার করা যায়নি, পরিশিষ্ট ৪-এ জেনারেল এরশাদের নিজ হাতে লেখা চিঠিটি হুবহু দেওয়া আছে)]
এ জি মাহমুদ। ১৯৭৭ সালের অ্যুত্থান সম্পর্কে প্রতিবেদনগুলাে প্রকাশের আগে অভ্যুত্থানকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যােগাযােগ করা হয়। ‘৯৬-৯৭ সালে বহুবার অনুরােধ করা সত্ত্বেও তিনি এ বিষয়ে কোনাে কথা বলবেন। না বলে জানান। তিনি মনে করেন জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানতেন কিন্তু তারা কেউ বেঁচে নেই। ঘটনাগুলাে ভালাে করে জানার মধ্যে একমাত্র তিনি। বেঁচে আছেন। তাই মিডিয়ায় এ সম্পর্কে কিছু বললে প্রতিরক্ষা বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে। তার আশঙ্কা। যদিও ‘৭৭ সালের অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সামরিক ট্রাইব্যুনালের নামে গণফাসি থেকে তার সৈনিকদের রক্ষা না করার অভিযােগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ সময় বিদ্রোহ দমন । করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এমন একজন সেনা কর্মকর্তা মনে করেন এ জি মাহমুদ আসলে আন্তর্জাতিকভাবে হিরো হওয়ার জন্য জাপানি বিমান ছিনতাই ঘটনার সমঝোতায়। ব্যস্ত ছিলেন। তাই তার সৈন্যদের রক্ষা কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কোনাে চিন্তা করেননি। পরবর্তী সময়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেওয়া তার বক্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ।
ভােরের কাগজে ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলাে প্রকাশ হওয়ার ১০ বছর পর এ জি মাহমুদ মুখ খুললেও বিস্তারিত জানাতে অস্বীকার করেন। বিভিন্ন সময় তার কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘৭৭-এর অভ্যুত্থান ছিল জিয়া-তাহেরের রেষারেষির ফল। তিনি বিমানবাহিনীর প্রধান হয়ে নিরপরাধ বিমানসেনাদের বাঁচাতে কেন উদ্যোগ নেননি, এমন প্রশ্নে বলেন- সে সময় তিনি নিজেও নিরাপদ ছিলেন না। এয়ার হাউসেও তিনি
থাকতে পারতেন না।
জিয়া-তাহেরের রেষারেষির চূড়ান্ত পরিণতি
এ জি মাহমুদ মনে করেন, সেদিনের ঘটনা (‘৭৭-এর অ্যুত্থান) ছিল একটি মিলিটারি পলিটিকো (রাজনৈতিক-সামরিক) সংঘাত। এই ঘটনার সঙ্গে সেনানিবাসের বাইরের রাজনৈতিক শক্তিও জড়িত ছিল। এটি ছিল মূলত জিয়া ও কর্নেল তাহেরের সমর্থকদের মধ্যকার রেষারেষির চূড়ান্ত পরিণতি। তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হলেও দেশে বিভিন্ন সেনানিবাসে তার অসংখ্য সমর্থক রয়ে যায়। তাহেরের ফাসির কারণে তারা আরাে ফুসে ওঠে। তিনি বলেন, সেদিন শুধু বিমানবন্দরেই সংঘর্ষ হয়নি। ঢাকার বিভিন্ন স্থানেও সংঘর্ষ
হয়েছিল। কর্নেল তাহেরের অনুগতরা ঢাকা বেতারকেন্দ্র দখল করে সেখান থেকে বিপ্লবী প্রচারণা চালায়। তবে জিয়ার সমর্থকরা অল্প সময়ের মধ্যেই কর্নেল তাহেরের সমর্থকদের দমন করে ফেলে। বিমানবাহিনীর সদস্যরাই সেদিনের ঘটনার বেশি শিকার হয়। কারণ ছিনতাইকৃত বিমানটিকে কর্ডন করে রাখতে সেদিন তারা সেখানে হাতিয়ারসহ পাহারায় ছিল। ঘটনার পর যাদেরই হাতিয়ারসহ প্রকাশ্যে পাওয়া গেছে। তাদেরই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে তাদের অনেকেরই আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিমানবাহিনী প্রধান হিসেবে আপনি আপনার সৈন্যদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, আমার কিছুই করার ছিল না। সামরিক আইন জারি থাকার কারণে ক্ষমতা ছিল একজনের হাতে। সামরিক আইন না থাকলে বিমানবাহিনীর সদস্যদের কোনাে অন্যায় হলে আমিই বিচার করতাম। এ ছাড়া জিয়ার জায়গায় আমি থাকলে হয়তাে অন্যভাবে পরিস্থিতি মােকাবেলা করতাম। ফলে হয়তাে এত লােকক্ষয় হতাে না। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত বেপরােয়াভাবে পরিস্থিতি মােকাবেলা করেছেন। ঘটনার সময় ছিনতাইকৃত বিমানটিকে কর্ডন করে রেখেছিল বিমানবাহিনীর সদস্যরা। আর বিমানবন্দরের দায়িত্বে ছিল পুলিশ। তাহলে সেনাবাহিনী এলাে কোথা থেকে এ প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, হামলার পূর্ব মুহূর্তে রহস্যজনকভাবে দায়িত্ব থেকে পুলিশকে সরিয়ে ফেলা হয়। এ জি মাহমুদ ঐ অভ্যুত্থানে অনেক কিছুই জানতে পারেননি বলে দাবি করেন। বলেন, ‘প্রকাশ্যে বিচার হলে, সব তদন্ত রিপাের্ট প্রকাশ পেলে ‘৭৭-এর ঐ ঘটনা রহস্য হয়ে থাকতাে না, আমার কাছে আজও ঐ ঘটনা রহস্যই হয়ে আছে।’
হাসানুল হক ইনু
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর বর্তমান সভাপতি হাসানুল হক ইনু ছিলেন তকালীন জাসদের গােপন সশস্ত্র শাখা বিপ্লবী গণবাহিনীর উপ-প্রধান। কর্নেল তাহের। ছিলেন এর প্রধান। তাহেরের উদ্যোগেই গণবাহিনীর শাখা সংগঠন হিসেবে সেনা সদস্য, জেসিও, এনসিও ও জওয়ানদের নিয়ে সেনাবাহিনীর ল্যান্সার, আর্টিলারি, সিগন্যাল ও ইনফেন্ট্রি ইউনিট এবং বিমানবাহিনীতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠিত হয়। এই দুই সংগঠন তখনকার ঘটনা প্রবাহে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়া। সামরিক আদালতে বিচারের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেন এবং ইনুসহ জাসদ ও গণবাহিনীর শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে কারাবন্দি করেন। ইনু গ্রেপ্তার হন ’৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর। বিচারে তার ১০ বছর সাজা হয়। ৫ বছর পর ১৯৮০ সালে ১৩ জুন তিনি মুক্তি পান। সেই অভ্যুত্থানের ব্যাখ্যা তার কাছে ভিন্নরকম।
হাসানুল হক ইনু ২ অক্টোবরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানে তাহের অনুসারীদের যােগসাজশের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। বরং তিনি মনে করেন সশস্ত্র বাহিনীতে নিজের
অবস্থান সুসংহত করতেই জিয়া প্রতিপক্ষ নির্মূল অভিযান চালান।
তাহের অনুসারীরা অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল না
হাসানুল হক ইনু বলেন, বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট আফসারের নেতৃত্বে শতাধিক সৈন্য ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকা বিমানবন্দরে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চালায়। এই আফসার গণবাহিনী অথবা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কেউ ছিল না। সে জাসদের রাজনীতির সঙ্গেও। কখনাে জড়িত ছিল না। ইনু বলেন, সামরিক আদালতে আফসার বলেছে ২ অক্টোবর হত্যাকাণ্ডের জন্য সে নিজেই দায়ী। তার একক নেতৃত্বেই এই ঘটনা ঘটেছে। এর থেকে প্রমাণ হয় তাহের সমর্থকরা অ্যুত্থানে জড়িত ছিল না। তাহের সমর্থকরা জড়িত থাকলে অ্যুত্থান বিক্ষিপ্ত হতাে না; বরং আরাে সংগঠিত হতাে। গণহারে ফাসি দিয়ে সৈনিক হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে তিনি বলেন, জেনারেল জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকা বিমানবন্দরে রক্ত ঝরেছে। নিহত হন বিমানবাহিনীর ১১ জন অফিসারসহ অসংখ্য সৈনিক। ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের কৃপায় বেঁচে গিয়ে জিয়া অফিসার ও সিপাহিদের ১২ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তা ভুলে
যান। ফলে সেনানিবাসগুলােতে অফিসার ও সিপাহিদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা দেয়। | এই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২ অক্টোবর। কর্নেল তাহেরের সমর্থকরা এর সঙ্গে জড়িত ছিল না। কারণ ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বরের পর আমরা গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থার তৎপরতা বন্ধ করে দিই। জিয়া ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও ২ অক্টোবরের অভ্যুত্থানে জাসদ, গণবাহিনী অথবা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সংশ্লিষ্ট থাকার বিষয় প্রমাণ করতে পারেননি। তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীর তিনটি পক্ষ এই অ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক ও রশিদ সমর্থকরা। কারণ জিয়া খন্দকার মােশতাকের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি অনুসরণ করলেও ফারুক-রশিদদের ক্ষমতার ভাগ দেননি। বরং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনার পর তাদের বিদেশ পাঠিয়ে দেন। ইনু জানান, ১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বগুড়া সেনানিবাস থেকেই সংঘর্ষের সূচনা হয়। আর তার | চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ঢাকা বিমানবন্দরে। বগুড়া সেনানিবাসের সংঘর্ষটি ছিল জিয়া এবং কর্নেল ফারুক-রশিদ সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষ। দ্বিতীয়ত, প্রতি ১২ দফা বাস্তবায়ন না করায় সামরিক বাহিনীর একটি বিক্ষুব্ধ অংশও জিয়ার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে জড়িয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, জিয়া সশস্ত্র বাহিনীতে ‘ভাগ করাে-শাসন করাে’ এই নীতি অনুসরণ করে আসছিলেন। তিনি প্রথমে পাকিস্তান ফেরত ও মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের বিভক্ত করে ফেলেন। এ কারণে মুক্তিযােদ্ধা অফিসাররা জিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। লে, কর্নেল দিদারুল আলমের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাটি ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ। ইনু জানান, ক্ষমতায় থাকতে জিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় ১৯টি অ্যুত্থান হয়। এসব অ্যুত্থানকে কাজে লাগিয়ে জিয়া সশস্ত্র বাহিনীতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালান। এতে প্রায় আড়াই হাজার সৈন্য প্রাণ হারান। বিচারের নামে গণহত্যা চালানাে হয়। মেজর জেনারেল মীর শওকত ও মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুরকে ব্যবহার করে জিয়া এসব করেছেন। পরে তাদেরও ছুড়ে ফেলে দেন। শওকতকে যশাের এবং মঞ্জুরকে চট্টগ্রামে বদলি করেন। ইনুর মতে, জিয়ার বিরুদ্ধে সংঘটিত ১৯টি সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে একমাত্র ২ অক্টোবরের অভ্যুত্থানই সাধারণ সৈনিকরা ঘটায়। ২ অক্টোবর বিমানবন্দরে হামলার আগে সাধারণ সৈনিকরা সেনানিবাসে জিয়ার বাসভবনেও হামলা চালিয়েছিল। তিনি অবশ্য আগে থেকেই বাসার চারপাশে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করায় সৈনিকরা সুবিধা করতে পারেনি। | জিয়া সশস্ত্র বাহিনীর ওপর তার বর্বরতা আড়াল করতে জাসদ, ডেমােক্রেটিক লীগ ও সিপিবি নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন দাবি করে ইনু বলেন, জিয়ার সামরিক শাসনামলে একটি ঘটনার সঙ্গে আরেকটির কোনাে যােগসূত্র পাওয়া যেতাে না। যেমন, অ্যুথানের পরিকল্পনা করেছে বলা হচ্ছে একটি গ্রুপ, বাস্তবায়ন করেছে বলা হচ্ছে আরেকটি গ্রুপ। আর গণফাঁসি দেওয়া হচ্ছে অন্য একটি গ্রুপকে।
সাখাওয়াত হােসেন। ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হােসেন স্বাধীনতার পর দুই বছর পাকিস্তানে বন্দিশিবিরে কাটিয়ে ‘৭৩ সালে দেশে ফেরেন এবং ‘৭৫-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডে স্টাফ অফিসার ছিলেন। তিনি ‘৭৯ থেকে ‘৮১ সাল পর্যন্ত সেনা সদরে অপারেশন ডাইরেক্টরেটে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস-এ (বিডিআর) ছিলেন। পােস্টিং ছিল খুলনায় । আর ২ অক্টোবর অভ্যুত্থানের দিন ঢাকায় ছিলেন ছুটিতে।
ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হােসেন এনডিসি, পিএসসি (অব.) তার বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১’ বইতে ১৯৭৭-এর অভ্যুত্থান নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলােকপাত করেন। এ বর্ণনায় জানা যায়, একজন সেনা কর্মকর্তার দৃষ্টিতে সেই ব্যর্থ অভ্যুত্থান কেমন ছিল।
দ্বিতীয় সিপাহি বিপ্লব
একটি বড় ধরনের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয় ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে। এ ব্যর্থ রক্তাক্ত অ্যুত্থানে বিমান ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ১৯৭৫ সালে সিপাহি বিপ্লবের অনুকরণের চেষ্টা করে। এ অ্যুথানেও কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সেনা সংস্থার (বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা) কিছু সদস্যের যােগসাজশ পাওয়া যায়। মনে করা হয় জেএসডি (জাসদ) এ অ্যুত্থানের মাধ্যমে আর একবার ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আর এ প্রচেষ্টায় বিমানবাহিনীর অনেক নিরীহ চৌকস অফিসার প্রাণ হারান। এ অ্যুত্থানের সূত্রপাত হয় ১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে, যখন জাপান এয়ারলাইন্সের ডিসি-৮ বিমান টোকিও থেকে ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ‘হিকাদা কমান্ডাে’ ইউনিট নামে জাপানি সন্ত্রাসবাদী কর্তৃক হাইজ্যাক হয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করানাে হয় (বইতে ভুলবশত তারিখটি ২৮ মে ছাপা হয়)। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম এবং এ ধরনের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মােকাবেলার মতাে অভিজ্ঞতা ও স্পেশাল ফোর্স এবং যন্ত্রপাতি সব কিছুরই অভাব ছিল। জিয়া সরকার বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদকে প্রধান করে বিমানবাহিনীকে মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব দেয়। উল্লেখ্য, এর কয়েক মাস পূর্বে জিয়া আর তওয়াবের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে তওয়াকে বিমানবাহিনী প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে এ জি মাহমুদকে বিমানবাহিনী প্রধান করা হয়েছিল। এ হাইজ্যাকিংয়ের মধ্যস্থতার সঙ্গে ঢাকায় অবস্থানরত অনেক সেনা ও
বিমানবাহিনীর অফিসার জড়িয়ে পড়েন। অনেকেই তেজগাঁও বিমানবন্দরেই অবস্থান নেন। বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে পড়ে। যেহেতু এ হাইজ্যাকিংয়ের মধ্যস্থতার আর ঘটনার বিবরণ টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছিল বলে পুরাে দেশবাসীই টেলিভিশনের পর্দার সামনে ভিড় জমিয়েছিল। যখন সমগ্র দেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে এ নাটক প্রত্যক্ষ করছিল, ঠিক এ সময়ে বগুড়া সেনানিবাস থেকে শুরু হয় আরেক সিপাহি বিপ্লব। প্রথমে বেশ কিছু অফিসার নিহত হন। তাদের একজন লেফটেন্যান্ট হাফিজুর রহমানের লাশ ঢাকায় দাফনের সময় তার বাবা-মা আত্মীয়স্বজনরা উপস্থিত সৈনিকদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলে সেখানেই ছােটখাটো উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যশোের থেকেও সৈনিকদের ভেতরে অসন্তোষ দেখা দেওয়ার খবর আসতে থাকলে ঢাকায় সতর্ক অবস্থা নেওয়া হয়। এত সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও ৩০ সেপ্টেম্বর রাত ২টার পর থেকেই শুরু হয় ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় সিপাহি বিপ্লব’। বিপ্লবী সৈনিকরা, যার মধ্যে বেশির ভাগ ছিল বিমানবাহিনীর সদস্য। তারা বিমানবন্দরে হামলা করে সেখানে কার্যরত ১১ জন বিমানবাহিনী অফিসারকে হত্যা করে। আশ্চর্যজনকভাবে বিমানবাহিনীর প্রধান প্রাণে রক্ষা পান। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই বিপ্লবী সৈনিকরা রেডিও স্টেশন দখল করে বিপ্লবী নেতার দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণের ঘােষণা দেয়। কিন্তু কোনাে অজ্ঞাত কারণে সে নেতার আবির্ভাব হয়নি।
যা হােক, সাভার ট্রান্সমিটার বন্ধ করে দেওয়ার কারণে এ ঘােষণা দেশবাসী পর্যন্ত পৌছেনি। সেদিন এ ঘােষণায় বিমানবাহিনীর জনৈক সার্জেন্ট আফসারকে রাষ্ট্রপ্রধান করা হয়েছিল। এ বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে মীর শওকত আলী ৯ম ডিভিশনকে নিয়ােগ করলে ক্ষিপ্রগতিতে এ অ্যুত্থান প্রচুর রক্তপাতের বিনিময়ে ব্যর্থ করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে ঝরে যায় অনেক রক্ত, লাল হয়ে যায় বিমানবন্দর এলাকা। নিহত হন ১১ জন খ্যাতি ও উদীয়মান বিমানবাহিনীর অফিসার। সকালে জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। অত্যুথানে জড়িত থাকার দায়ে বহু সৈনিককে প্রেপ্তার করে সামরিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত বিচার করে অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়। এখানে তাদের সঠিক সংখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। এ অ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল সেনাবাহিনীর সিগন্যাল ও সাপ্লাই কোরের কিছুসংখ্যক সৈনিক ছাড়া আর কোনাে ইউনিটের সৈনিকরা উল্লেখজনকভাবে যােগদান না করায়। এ ঘটনা জিয়াউর রহমানকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। এ ব্যর্থ অ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবাহিনী প্রধান এ জি মাহমুদকে পরিবর্তন করে এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দিনকে বিমানবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। এ অ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা ও কৃতিত্ব নিয়ে ৯ম ডিভিশনের মীর শওকত আলী এবং সিজিএস মঞ্জুরের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই চরম পর্যায়ে পৌঁছলে জিয়া দুজনকেই ঢাকার বাইরে- মীর শওকত আলীকে যশাের ডিভিশন কমান্ডার, আর মঞ্জুরকে ২৪ পদাতিক ডিভিশন চট্টগ্রামে বদলি করে। ঢাকার ক্ষমতাবলয় থেকে সরিয়ে দেন। মীর শওকত আলী এ বদলির আদেশ গ্রহণ করলেও মঞ্জুর এ ব্যবস্থায় খুশি হতে পারেননি।
লরেন্স লিফশুলজ
প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ ‘৭৭-এর ঘটনার পরপরই এ বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি এখনাে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে নানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘৭৭-এর অভ্যুত্থান নিয়ে ভােরের কাগজে লেখকের প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলাে তিনি সংগ্রহ করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি লেখকের সঙ্গেও দীর্ঘ আলােচনা করেন। ২০১১ সালের ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়ােজিত আলােচনা সভায় তিনি প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেই প্রবন্ধে তিনি ১৯৭৭ সালের সেই ‘বিদ্রোহের সময় আসলেই কী ঘটেছিল, তা নিয়ে বিশদ আলােচনা করে লিখেছেন, আজ ৩০ বছরের বেশি সময়ের পরও সেটা এক জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে আছে। অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত করে বলেন, এটা আদতে কোনাে বিদ্রোহই ছিল না। আসলে এটা ছিল সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে জিয়ার শত্রুদের ‘টোপ দিয়ে বের করে আনার গােয়েন্দা অভিযান।
যেকোনাে স্থানে অবিচার সর্বত্রই ন্যায়বিচারের হমকি
১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। আমি তখন ইংল্যান্ডে থাকি। সাংবাদিকতার চাকরি থেকে স্যাবাটিক্যাল ছুটি নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়তে গেছি। ১৯৭৭ সালের শরতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আমার সঙ্গে যােগাযােগ করলাে। সে সময় অ্যামনেস্টির কাছে বিপুল পরিমাণ গােপন প্রতিবেদন আসছিল, যেগুলােতে এমন। তথ্য ছিল যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে আপাতবিদ্রোহ ঘটার পর গণহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব মার্টিন ইনালস বিশেষ সফরে ঢাকা আসেন। তার আগমনের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সরকারি নেতাদের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে আলােচনা করা। জেনারেল জিয়ার সঙ্গে ইনালস সাক্ষাৎ করেন। জিয়া তাকে আশ্বস্ত করেন যে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে অ্যুত্থানচেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোেগ যাদের বিরুদ্ধে ছিল, তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা বন্ধ। হয়েছে।
কিন্তু ইনালস লন্ডন ফিরে যাওয়ার পর অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জেনারেল জিয়া কর্তৃক এসব আশ্বাস প্রদান করা সত্ত্বেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বাস করার জোরালাে কারণ আছে যে সেনাসদস্যদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা… এখনাে অব্যাহত আছে… ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি এক তারবার্তায় অ্যামনেস্টির মহাসচিব গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এমন খবরে, যেখানে অভিযোেগ করা হয়েছে, ২ অক্টোবরের পর শত শত সেনাসদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা অব্যাহত আছে।’ ১৯৭৮ সালের ৫ মার্চ লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ সেনাসদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এই রক্তগঙ্গা কেবল আংশিকভাবে উন্মােচিত হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গত সপ্তাহের প্রতিবেদনে… বিমানবাহিনীর সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য সানডে টাইমসকে বলেছেন, ৩০ সেপ্টেম্বর বগুড়ায়, আর ২ অক্টোবর ঢাকায় অ্যুত্থানের পর সামরিক ট্রাইব্যুনালে ৮০০-এর অধিক সেনাসদস্যকে দণ্ডিত করা হয়েছে। সামরিক আদালতের সঙ্গে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ক্যাঙ্গারু কোর্টের পার্থক্য খুব বেশি নয়। ঢাকায় প্রায় ৬০০ সেনাসদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ফায়ারিং স্কোয়াডে অথবা ফাসিতে ঝুলিয়ে।’ ১৯৭৮ সালের ২৫ মার্চ মুম্বাইয়ের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও অ্যামনেস্টি শুধু এটুকুই বলতে প্রস্তুত যে কমপক্ষে ১৩০ জন এবং সম্ভবত কয়েক শ’-এর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তবে ঢাকার কিছু ওয়াকিবহাল সূত্রের মতে এ সংখ্যা ৭০০ পর্যন্ত হতে পারে। প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিত করার উপায় নেই। ঢাকায় প্রচারিত টাইপ করা একটি কাগজের বিবরণীতে অভিযােগ করা হয়েছে, সেনা সদর দপ্তর। থেকে টেলিফোনে নির্দেশ পেয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ভবিষ্যতে জবাবদিহি করতে হতে পারে, এ আশঙ্কায় কোনাে নথিপত্র রাখা হচ্ছে না। একটি ঘটনায় ঢাকা। কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি সৈনিকদের গভীর রাতে জাগিয়ে তােলা হয় এবং তাদের গােছগাছ করে নিতে বলা হয়। ‘তাদের বলা হয়, তাদের মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ এসেছে। সেলগুলােতে আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়, জোয়ানরা তাদের মালামাল জড়াে করে। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় জেলের সামনের গেটে। জানা যায়, সেখানে একজন সেনা কর্মকর্তা ও বিশেষ আধাসামরিক বাহিনীর এক সদস্য তাদের বাধা দেন। সেখানে হঠাৎ মৃত্যুদণ্ডের রায় পড়ে শােনানাে হয়। তাদের প্রাণভিক্ষা দেওয়ার জন্য পাগলের মতাে কান্নার রােলের মধ্যে জোয়ানদের নিয়ে যাওয়া হতে থাকে, আর একেক দফায় ১৭-১৮ জনকে ফাসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হতে থাকে। সে রাতে যাদের ফাঁসিতে ঝােলানাে হয়েছে, তাদের তালিকাও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরাে বলা হয়েছে, পুরাে সময়জুড়ে ফাসির জন্য নিয়ে যেতে থাকা সৈনিকদের কান্নাকাটির ভেতরও কর্তৃপক্ষ ছিল শান্ত ও ধীরস্থির।’
ঢাকায় এমন কথাও প্রচারিত হয়েছিল যে ফায়ারিং স্কোয়াডের সদস্যদের গুলি করার নির্দেশ দেওয়ার পরও গুলি না করায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এসবের কোনাে কিছুই কোনাে সংবাদপত্র ছাপার সাহস করেনি। সুতরাং দেশের সংবাদমাধ্যমে প্রামাণিক নিশ্চিতকরণ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।’ ১৯৭৭ সালের সেই ‘বিদ্রোহের সময় আসলেই কী ঘটেছিল, আজ ৩০ বছরের বেশি | সময়ের পরও সেটা এক জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে আছে। অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত করে বলেন, এটা আদতে কোনাে বিদ্রোহই ছিল না। আসলে এটা ছিল সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে জিয়ার শত্রুদের ‘টোপ দিয়ে বের করে আনার গােয়েন্দা অভিযান। আনাড়ি হাতে অনেক ছড়িয়ে জাল পাতা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই, দেশের সামরিক বিচারের বিধিমালার লঙ্ঘন ঘটিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাইরে অজস্র মানুষের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে আমি প্রয়াত মেজর জেনারেল মইনুল হােসেন চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকায় এক নৈশভােজে মিলিত হই। দুজন বিখ্যাত সাংবাদিক ও মইন চৌধুরীর বন্ধু সাবেক এক সেনা কর্মকর্তাও সেখানে ছিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, লন্ডনে (বাংলাদেশ দূতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে থাকার সময় থেকে আমি তাকে চিনি। তখন প্রায়ই আমরা নৈশভােজে বসতাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তার কাজ হলাে আমার ওপর চোখ রাখা। আমিও বললাম যে ব্যাপারটা পারস্পরিক। তা হলেও মূলত তিনি আমার কাছ থেকে রাজনীতি ও ইতিহাস বিষয়ে কী পড়বেন, সে বিষয়ে পরামর্শ চাইতেন। আমার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁকে বই ধার দেওয়া। ২০০৬ সালের ওই সন্ধ্যায় আলােচনা ১৯৭৭ সালের বিদ্রোহের ঘটনাবলি প্রসঙ্গে গড়ালাে। সে সময় জিয়ার অনুরােধে মইন লন্ডন থেকে ফিরে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হয়ে বসলেন। সিদ্ধান্তটা বিচক্ষণােচিত ছিল না। সেই সন্ধ্যায় তিনি আমাদের বলেছিলেন, ২০০ জনের মৃত্যুদণ্ডের অনুমােদন তার হাত দিয়ে হয়েছিল; কিন্তু প্রকৃতভাবে মােট কতজন সেনাকে হত্যা করা হয়েছিল, তা তিনি জানেন না। তার হিসাবমতে, তাদের সংখ্যা শত শত। ওই সব মানুষের কেউই সুষ্ঠু বিচার পাননি বলে সেই সন্ধ্যায় মইন স্বীকার করেছিলেন। সেনাদের আইনি সহায়তা পাওয়ার অধিকার থাকলেও তাদের তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে |আপিল আরজি করার অধিকারও ছিল। সেই অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিল তাদের। এসব ঘটনায় নিজের ভূমিকার জন্য তিনি অনুতাপ প্রকাশ করেন। সেই নৈশভােজের অল্প কিছুদিন পর আমি ঢাকায় তার বাসায় দেখা করতে চেয়ে ফোন করি। আমাদের মধ্যে আরাে বিশদ আলােচনা হয়। নৈশভােজে তিনি যা বলেছিলেন, তা-ই সেদিন আরাে বিস্তারিতভাবে জানান। চলে আসার সময় আমি নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের সেই বিপর্যয়ের সময় সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে কৃতকর্মের জন্য তিনি সত্যি সত্যিই অনুতপ্ত। সুতরাং এখানে আমরা সেনাবাহিনীর সাবেক অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলকে পেলাম। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কিভাবে ফাসিতে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা সব সেনাকে সেনাবাহিনীর বিচারবিধি অনুযায়ী প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ওপর তার কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। হুকুমদাতার ভূমিকায় ছিলেন জেনারেল জিয়া। মইন বলেছেন, জিয়া যা কিছু করেছেন, নিজের ইচ্ছেমাফিক করেছেন। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের ইতিহাসের এই কালাে অধ্যায়ের বিষয়ে সত্য ও ন্যায়বিচার কমিশন গঠন করা হলে জেনারেল মইন স্বেচ্ছায় সেখানে সাক্ষ্য দিতে আসতেন। আমার মতে, তিনি খােলামনে তার ভূমিকার দায়দায়িত্ব স্বীকার করতেন এবং অনুশােচনা প্রকাশ করতেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই অধ্যায়ের বিষয়ে আলােকপাত করেছেন এমন লেখক। হাতে গােনা। আমার জানামতে, আতাউস সামাদই প্রথম এই গণপ্রাণদণ্ডের বিষয়ে লিখেছিলেন। তবে সবচেয়ে বিশদ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিলেন জায়েদুল আহসান। পিন্টু। ঘটনার ২০ বছর পর ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে ভােরের কাগজ-এ তার প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা তিনি আরাে বিস্তৃত করে প্রকাশ করেন তার একটি বই ‘রহস্যময় অভূত্থান ও গণফাসি’-তে।
জায়েদুল আহসান পিন্টু সারা দেশ ঘুরে বিভিন্ন জেলে যাদের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল, সেই সব সেনার তালিকা সগ্রহ করেন। তিনি সে সময় সেনা কমান্ডের সঙ্গে জড়িত অনেক উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারও নেন। কিন্তু এদের কেউ নিহত সেনাদের প্রকৃত সংখ্যাটি বলতে পারেননি। যা ধারণা করা হয়েছিল, সেটাই ঘটেছে। অনেকগুলাে ঘটনা থেকে মনে হয়, উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে এবং সযত্নে সত্য আড়াল করার বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছিল। তাই সরাসরি জড়িত ব্যক্তিদের ভাষ্য ও ঘটনার পরপরই তৈরি করা তালিকার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অসঙ্গতি মিলতে থাকে। যেমন : জায়েদুল আহসানের কাছে কুমিল্লা কারাগারের এক জল্লাদ দাবি করেন, তিনি। ৯৩ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের কাছে কোনাে নথিপত্র নেই। আহসানের মতে, ১৯৭৭ সালের ২৬ অক্টোবর আন্তঃবাহিনী গণসংযােগ বিভাগ (আইএসপিআর) থেকে প্রচারিত বক্তব্যে বগুড়া সেনাবিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ৫৫ জন সেনাকে ফাঁসি দেওয়ার কথা বলা হলেও বগুড়া কারাগারে মাত্র ১৬ জনের নাম। পাওয়া যায়। জায়েদুল আহসানকে বলা হয়েছিল, বাকিদের হত্যা করা হয়েছিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে। কিন্তু রাজশাহী কারাগারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেখানে কোনাে নথিপত্র নেই। জায়েদুল আহসানের ভাষ্যমতে, ১৯৭৭ সালে দুই হাজারেরও বেশি সেনাকে ৭ থেকে ২৬ অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে বিচারের মুখােমুখি করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, বেশির ভাগ বিচার শুরু হয়েছিল ৭ অক্টোবর এবং প্রাণদণ্ড শুরু হয় ৯ অক্টোবর। এ দুই দিনের মধ্যে এসব মানুষকে নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণ করার কথা। আহসান আমাদের আরাে জানান এবং জেনারেল মইনও আমাকে বলেছিলেন, এসব ছাড়াও জেনারেল জিয়া
৭ অক্টোবর নতুন বিধিমালা জারি করেন, যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আত্মপক্ষ সমর্থনে আইনজীবীর সহায়তা নেওয়া কিংবা প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযােগ রহিত করা হয়। সামরিক বাহিনীর জন্য নির্ধারিত বিচারপ্রক্রিয়া লজ্জিত হয় এতেও। অবধারিতভাবে, সে সময় সামরিক বিধিমালার অধীনে যথাযথভাবে গঠিত কোনাে ট্রাইব্যুনাল বাস্তবত ক্রিয়াশীল ছিল না। ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রাণদণ্ডের শিকার হওয়া সেনাদের সংখ্যাটি আহসান জানতে পেরেছিলেন সেই সময়ে ঢাকার নবম ডিভিশনের অধিনায়ক জেনারেল মীর শওকত আলীর কাছ থেকে। নিহত সেনাদের বিষয়ে এটাকেই সর্বনিম্ন মাত্রা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এই সংখ্যাটি হলাে এক হাজার ১৩০। আসল সংখ্যাটি আসলে কত? কেউ জানে না। আহসানের বিশ্বাস, শত শত সেনাসদস্যকে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করা হয়েছিল কোনাে প্রমাণ না রেখে। মীর শওকতের দেওয়া সংখ্যার বাইরেও যেমন অনেকে থেকে যেতে পারেন, আবার সবাই হয়তাে এর অন্তর্ভুক্ত হতেও পারেন।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে ‘বাংলাদেশ : এ লিগ্যাসি অব ব্লাড” বইটি রচনা করেন। তাঁর বইটি বাংলাদেশ ও রক্তের ঋণ’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন মােহাম্মদ শাহজাহান। এই বইয়ে ‘৭৭-এর ২ অক্টোবরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পর্কে মাসকারেনহাসের পর্যবেক্ষণ।
বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈন্যদের হত্যা করা হয়েছিল
১৯৭৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়া মিসরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের সঙ্গে পরবর্তী বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য পদের ব্যাপারে আলােচনা ও সমর্থন আদায়ের জন্য কায়রােতে যান। বাংলাদেশের ঐ পদের জন্য শক্তিশালী জাপানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা। সেই সময় প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবন-মৃত্যুর সমস্যা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিসরীয় প্রেসিডেন্টের অবগতিতে ছিল। সৌভাগ্যক্রমে, মিসরীয় গােয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে বামপন্থী একটা দল ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাবে বলে খবর পেয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবসে আঘাতটি হানার পরিকল্পনা করে। জাসদ ও কমিউনিস্ট পার্টির উসকানিতে ব্যাপারটি পরিচালিত হয় বলে জানা যায়। কায়রাে থেকে জিয়া দেশে ফিরবেন ২৭ সেপ্টেম্বর। পরদিন অর্থাৎ ২৮ তারিখ বিমানবাহিনী দিবস। ঐ দিবসে জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়ার পরপরই ঘটনাটি ঘটানাে হবে বলে পরিকল্পিত তথ্যটি জিয়াকে জানানাে হয়। প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের এই তথ্য শুনে জিয়া ঘাবড়ে যান। এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মিসরীয় গােয়েন্দা সংস্থা জানায়, বিপ্লবী সিপাহিরা এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত জিয়াসহ সব পদস্থ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করবে। মিসরীয় গােয়েন্দা সূত্রটি অবশ্য কোন ইউনিট এই ষড়যন্ত্রে জড়িত তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জিয়া বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদকে হাতে লিখে একটি ছােট নােট পাঠিয়ে দেন। তিনি ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন
বলে নােটে উল্লেখ করেন। এতে কোনাে কারণ তিনি দেখাননি। কিংবা সাদাতের সতর্কবাণীর কথাও উল্লেখ করেননি। সম্ভবত জিয়া বিমানবাহিনী প্রধানের আনুগত্য
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে ‘বাংলাদেশ ! এ লিগ্যাসি অব ব্লাড়” বইটি রচনা করেন। তাঁর বইটি বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন মােহাম্মদ শাহজাহান। এই বইয়ে ‘৭৭-এর ২ অক্টোবরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পর্কে মাসকারেনহাসের পর্যবেক্ষণ।।
বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈন্যদের হত্যা করা হয়েছিল
১৯৭৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়া মিসরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের সঙ্গে পরবর্তী বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য পদের ব্যাপারে আলােচনা ও সমর্থন আদায়ের জন্য কায়রােতে যান। বাংলাদেশের ঐ পদের জন, শক্তিশালী জাপানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা। সেই সময় প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবন-মৃত্যুর সমস্যা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিসরীয় প্রেসিডেন্টের অবগতিতে ছিল সৌভাগ্যক্রমে, মিসরীয় গােয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে বামপন্থী একটা দল ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাবে বলে খবর পেয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবসে আঘাতটি হানার। পরিকল্পনা করে। জাসদ ও কমিউনিস্ট পার্টির উসকানিতে ব্যাপারটি পরিচালিত হয় বলে জানা যায়। কায়রাে থেকে জিয়া দেশে ফিরবেন ২৭ সেপ্টেম্বর। পরদিন অর্থাৎ ২৮ তারিখ বিমানবাহিনী দিবস। ঐ দিবসে জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়ার পরপরই ঘটনাটি ঘটানাে হবে বলে পরিকল্পিত তথ্যটি জিয়াকে জানানাে হয়। প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের এই তথ্য শুনে জিয়া ঘাবড়ে যান। এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মিসরীয় গােয়েন্দা সংস্থা জানায়, বিপ্লবী সিপাহিরা এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত জিয়াসহ সব পদস্থ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করবে। মিসরীয় গােয়েন্দা সূত্রটি অবশ্য কোন ইউনিট এই ষড়যন্ত্রে জড়িত তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জিয়া বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদকে হাতে লিখে একটি ছােট নােট পাঠিয়ে দেন। তিনি ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন বলে নােটে উল্লেখ করেন। এতে কোনাে কারণ তিনি দেখাননি। কিংবা সাদাতের সতর্কবাণীর কথাও উল্লেখ করেননি। সম্ভবত জিয়া বিমানবাহিনী প্রধানের আনুগত্য
সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না বলেই তিনি তাকে সব কিছু খুলে বলেননি। শেষ মুহূর্তে জিয়ার অস্বীকৃতিতে বিমানবাহিনী প্রধান বিপদে পড়েন। পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিল যে প্রেসিডেন্ট কোনাে কারণে মনঃক্ষুন্ন হয়ে এই অনুষ্ঠানে আসতে অসম্মতি জানিয়েছেন। ঐ অবস্থায় মাহমুদ জিয়ার জায়গায় অন্য কাউকে দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপন করবেন, নাকি অনুষ্ঠান বাতিল ঘােষণা করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত এমন কী ঘটনা ঐ দিন ঘটে গেলাে, যার জন্য অনুষ্ঠান আপনা-আপনিই মুলতবি হয়ে গেলাে। জাপান এয়ারলাইন্সের একটি ডিসি-৮ বিমান ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে বােম্বে থেকে উড্ডয়নের পরপরই হাইজ্যাক হয়। জাপানি রেড আর্মির হিদকা কমান্ডাে ইউনিটের পাঁচজন হাইজ্যাকার বিমানটি হাইজ্যাক করে ঢাকায় অবতরণ করতে বাধ্য করে। তারা তাদের দলের ৯ জন কর্মীকে জেল থেকে মুক্তিদানের দাবি এবং যাত্রীদের জিম্মি করে তাদের মুক্তিপণ হিসেবে ৬০ লাখ মার্কিন ডলার দাবি করে। মধ্যরাতের মধ্যে তাদের দাবি মানা না হলে তারা একে একে সব যাত্রীকে খুন করবে বলে হুমকি দেয়। ঢাকায় এই ধরনের আন্তর্জাতিক ঘটনা আর কোনাে দিন ঘটেনি। এই ঘটনায় কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সে জন্য মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকা হয়।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত মতে বিমানবাহিনী প্রধান এ জি মাহমুদ বিচারপতি সাত্তার (ভাইস প্রেসিডেন্ট) এবং দুজন ঊর্ধ্বতন বেসামরিক অফিসার নিয়ে কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে যান। সেখান থেকে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে থাকেন। এভাবেই বিমানবাহিনী দিবস স্থগিত হয়ে যায়। ২৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে যাওয়ার কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের সৈন্যদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারলাে না। দুদিন পর বগুড়ায় ২২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহিরা বিদ্রোহ করে এবং দুজন নবীন লেফটেন্যান্টকে হত্যা করে। কয়েকজন অফিসারকে আটকও করে তারা। পরদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও গােলযোেগ দেখা যায়। যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকেও একই ধরনের উত্তেজনার খবর আসে। জেনারেল জিয়া অবিলম্বে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে অস্ত্রভাণ্ডার ও নিজ নিজ সেনা ইউনিটের প্রতি কড়া নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর জিয়া তার কয়েকজন সঙ্গীসহ শহরের একটি গােপনীয় নিরাপদ স্থানে চলে যান এবং সেখানেই তিনি তার অস্থায়ী। হেডকোয়ার্টার চালু করেন। সম্ভবত এতেই তার জীবন রক্ষা পায়। আর্মি ফিল্ড সিগন্যাল ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা এ বিদ্রোহের আয়ােজন করে। ঢাকার সিগন্যাল কমপ্লেক্স এর নেতৃত্ব দেয়। এদের বিদ্রোহ শুরুর সংকেত ছিল- একটা পটকা বিস্ফোরণ ও পরে একটি রাইফেলের গুলি। সংকেত পাওয়ার পরপরই সৈন্যরা তাদের
ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং তাদের ইউনিটের অস্ত্রভাণ্ডার লুট করে। আকাশে ফাকা গুলি চালাতে চালাতে ওরা ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ নামে স্লোগান দিতে দিতে একত্রে মিলিত হয়। সিগন্যালম্যানদের সঙ্গে নিকটবর্তী কুর্মিটোলা এয়ারবেইস থেকে কয়েক শত এয়ারম্যান এসে যােগ দেয়। রাত পৌনে তিনটার দিকে ৭০০ আর্মি ও ২৫ ট্রাক ভর্তি বিমানবাহিনীর স্টাফ কেন্দ্রীয় অর্ডন্যান্স ডিপাে লুট করে সব অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে যায়। হাজার হাজার লিফলেটে সৈন্যদের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়। এর আগের বিদ্রোহের সময় জিয়া ছিল নায়ক আর এবারের বিদ্রোহে তাকে বিশ্বাসঘাতক’ বলে আখ্যায়িত করে তার অবসান’ চাওয়া হয়। ভাের ৫টায় ৭টি ট্রাকে ভর্তি হয়ে সৈন্য আর এয়ারম্যানরা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। তারা বিপ্লবী সরকারের নামে ঘােষণা দিতে আরম্ভ করে। কিন্তু তাদের নেতার নাম ঘােষণা করার আগেই নবম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে রেডিও ট্রান্সমিশন বন্ধ। করে দেওয়া হয়। ইতােমধ্যে বিদ্রোহ বিমানবন্দরে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৃশংস আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা প্রথমে বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারের সামনে দুজন বিমানবাহিনীর তরুণ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাসুদকে বিমানবাহিনী প্রধানের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিমানবাহিনীর প্রধান অলৌকিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। বিদ্রোহীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে মুহূর্তের মধ্যে বিমানবাহিনীর উড্ডয়ন ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে আসে। এই বিদ্রোহ মূলত সেনাবাহিনীর সিগন্যাল ও বিমানবাহিনীর এয়ারম্যানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কোনাে পদাতিক ইউনিট এতে অংশগ্রহণ করেনি। জেনারেল জিয়া ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেড ও ৯ম ডিভিশনের সাহায্যে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনেন। জেনারেল জিয়াকে বিদ্রোহীরা খুঁজে পায়নি বলে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ২ অক্টোবর সকাল ৮টার দিকে বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে থেমে যায়। কুর্মিটোলা এয়ারবেইস থেকে তিন ট্রাক ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এরই মধ্যে জাপানি সন্ত্রাসীরা হাইজ্যাক করা প্লেনটি নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে ওরা দুই-তৃতীয়াংশ জিম্মিকে মুক্ত করে দিয়ে যায়। সেদিনই এই বিদ্রোহ দমনে সফলতার জন্য মিসরের প্রেসিডেন্ট জিয়াকে অভিনন্দন জানান। প্রেসিডেন্ট জিয়া সহজেই অনুমান করতে পারলেন যে এখন তার কেবল সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করলেই চলবে না। এ জন্য তার বেসামরিক দিক থেকেও সমর্থনের প্রয়ােজন। তিনি প্রথমেই সেনাবাহিনীর মধ্যে কোন্দল এবং বিরােধ সৃষ্টিকারী লােকদের। বাছাই করে অত্যন্ত কঠোর হস্তে তাদের ওপর চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি ডাইরেক্টর জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স, এয়ার ভাইস মার্শাল ইসলামকে বিদ্রোহের। ব্যাপারে তাকে আগে সতর্ক করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে বরখাস্ত করেন। তারপর তিনি
একের পর এক দ্রুতগতিতে বগুড়ার ২২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ঢাকার চারটি সেনা ইউনিটকে বাতিল ঘােষণা করেন। জেনারেল জিয়া বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকেও বাতিল করার চিন্তা করছিলেন। এয়ার ইস মার্শাল মাহমুদ আমাকে জানিয়েছিলেন যে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে বিমানবাহিনীর ভাগ্য দোদুল্যমান অবস্থায় কাটে। জিয়া তখন বিমানবাহিনীকে বাতিল করে দিয়ে এটিকে সেনাবাহিনীর একটি অঙ্গ হিসেবে আর্মি এভিয়েশন উইং নামে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন। তঙ্কালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ, মেজর জেনারেল মধুর জেনারেল জিয়াকে এ ধারণাটি দিয়েছিলেন। ঐ অবস্থায় জিয়া কয়েক সপ্তাহ ধরে বিমানবাহিনীর প্রধান ও তার স্টাফদের ঢাকা বিমানবন্দরে অপারেশনাল এলাকাতেই আসতে দেননি। বিমানবাহিনীর প্রধান ঐ বিদ্রোহের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ায় জেনারেল জিয়া তাকে অবিশ্বাস করতে থাকেন। বিদ্রোহের ওপর বিচার বিভাগীয় কমিশন তদন্ত করে মাহমুদকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও তিনি জিয়ার অধীনে কাজ করা অসম্ভব বলে মনে করেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন। জিয়া এ সুযােগে তার নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কমান্ডে কিছু রদবদল করেন। তিনি জেনারেল মীর শওকত আলীকে যশােরে আর জেনারেল মঞ্জুরকে পাঠিয়ে দেন চট্টগ্রামে। সাড়ে তিন বছর পর সেখানে বসেই জেনারেল মঞ্জুর জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। জেনারেল জিয়া এই অ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সৈনিক আর এয়ারম্যানদের ওপর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য প্রতিশােধ নিয়ে তার মনে প্রজ্বলিত প্রতিহিংসার আগুন নির্বাত্তি করেন। সরকারি হিসাব মতে তিনি ১৯৭৭ সালে … মাত্র দুই মাসের মধ্যে ১১৪৩ (এগারােশত তেতাল্লিশ) জন সৈনিককে ফাঁসির দড়িতে লটকিয়ে হত্যা করেন।
তা ছাড়া বহুশত সৈনিককে তিনি দশ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত সশ্রম কারদণ্ডে দণ্ডিত করে জলে পাঠিয়ে দেন। আইনগত পদ্ধতি আর ন্যায়বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে এ শাস্তির কাজ সমাপন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় পৈশাচিক সাজার আর কোনাে নজির নেই। তিন-চারজনকে একবারে বিচারের জন্য ডেকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হলাে। জেনারেল জিয়া বসে বসে সেগুলাে অনুমেন করতেন এবং তার পরপরই তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হতাে। উল্লিস্তি পদ্ধতির সব কাজই মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা হলাে। তার সহযােগীদের একজন আমাকে জানিয়েছিল, জেনারেল জিয়া, প্রেসিডেন্ট আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বৈত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তার নিজের হাতে লিখে ঐ সব হতভা সৈনিকদের দণ্ডাদেশ অনুমােদন করতেন। বেসামরিক বন্দিরা স্মৃতিচারণা করে বলে,’কয়েক সপ্তাহ ধরে জেলখানার রাতগুলাে সৈনিকদের আর্তচিৎকারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল। তাদের ফাঁসির মঞ্চে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা নির্দোষ বলে বুকফাটা চিৎকারে ভেঙে পড়তাে।’ এইসব হত্যালীলার জন্য বিমানবাহিনী বা সেনাবাহিনীর কোনাে প্রতিষ্ঠিত আইনকানুনকে মেনে চলা হয়নি। বিধি মােতাবেক শাস্তির সময় কেবল জেনারেল কোর্ট মার্শাল মৃত্যুর দণ্ডাদেশ প্রদান করতে পারে। জেনারেল কোর্ট মার্শালের কমপক্ষে পাঁচজন মিলিটারি জজ থাকে। এদের মধ্যে একজনকে অন্ততপক্ষে লে. কর্নেল হতে হবে এবং বাকি চারজনের কেউই ক্যাপ্টেনের নিচে হতে পারবে না এবং কমিশন প্রাপ্তির পর ক্যাপ্টেনদের কমপক্ষে তিন বছর চাকরি সম্পন্ন করতে হবে। অভিযুক্তদের তাদের আত্মপক্ষ অবলম্বনের জন্য পর্যাপ্ত সুযােগ দিতে হবে। জেনারেল জিয়া দেখলেন যে এই সব নিয়মকানুন তার উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিরাট অন্তরায়। সে জন্য একটি মার্শাল ল’ অর্ডার ঘােষণা করলেন। ঐ ঘােষণায় বিশেষ আদালতের নামে এমন কোর্ট তিনি সৃষ্টি করলেন, যেগুলােতে বিচারের জন্য একজন লে. কর্নেলের সঙ্গে হাবিলদার ও তার কাছাকাছি পদমর্যাদার লােকেরা বসতে পারতাে। দ্রুতগতিতে মামলার কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এভাবেই ব্যবস্থা গৃহীত হলাে। এই উপমহাদেশের কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটানাে হয়েছে বলে নজির নেই। এক কলমের খোঁচায় জেনারেল জিয়া রাতারাতি দুই ডজনেরও বেশি এই ধরনের কোর্ট সৃষ্টি করলেন। ন্যায়বিচারের কোনাে প্রশ্নই সেখানে উঠতে পারে না। বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈন্যদের হত্যা করা হয়েছিল মাত্র।
জল্লাদ এরশাদুর রহমান
এরশাদুর রহমান, পেশীয় ছিলেন ডাকাত। দণ্ডিত হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। ‘৭৭-এর অভ্যুত্থানের সময় তিনি ছিলেন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষ তার সাহসিকতার কথা জেনে তাকে জল্লাদ হিসেবে নিয়ােগ দেয়। তার হাতেই ফাঁসি কার্যকর হয় ১৯৩ জন সৈনিকের। জল্লাদ এরশাদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় মাসিক একুশে পত্রিকায়, ২০০৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। পত্রিকাটির সম্পাদক আজাদ রহমান তার সাক্ষাঙ্কারটি গ্রহণ করেন।
রাষ্ট্রীয় আয়ােজনে ফাঁসিতে মারা কী আর কঠিন কাজ
নথিপত্র ঘেঁটে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফাঁসি কার্যকর হওয়া ৭২ জনের পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হলেও ওই কারাগারের তকালীন প্রধান জল্লাদ এরশাদুর রহমান দাবি করেছেন, তার হাতে ‘৭৭-এর অ্যুথানের ঘটনায় ১৩ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এরশাদুর রহমান সত্তরের দশকের শেষ দিকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের জল্লাদ ছিলেন। একটি ডাকাতির মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল তার। গ্রেপ্তার হওয়ার পর কিছুদিন চট্টগ্রাম কারাগারে ছিলেন। এরপর কুমিল্লা কারাগারে পাঠানাে হয় তাকে। কারাগারে প্রথমে নৈশপ্রহরী ও পরে সিওডিতে (কারারক্ষীদের আগমন ও প্রস্থানের সময় দেহ তল্লাশি করা) কাজ পান। বিশ্বস্ততা ও সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করায় তাকে কারা কর্তৃপক্ষ জল্লাদের কাজ করার প্রস্তাব দিলে রাজি হন তিনি। জল্লাদ এরশাদ জানান, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনি ৯৩ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন। ওই সময়গুলােতে এমনও হয়েছে যে এক রাতে ১২ জনের ফাঁসি কার্যকর করতে হয়েছে। তিনি আরাে জানান, রাত ৮টা থেকে ভাের রাত পর্যন্ত তাকে ফাঁসির দড়ি টানতে হয়েছে। জল্লাদ এরশাদ ‘৭৭-এর অভ্যুত্থানের ঘটনায়ই শুধু নয়, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে যে অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করা হয় সেই ঘটনায় সামরিক ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের তিনজনের ফাঁসিও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে তার হাতে কার্যকর হয়েছে। একজন জল্লাদের হাতে ৯৬ জন মানুষের ফাঁসি কার্যকর করার ঘটনা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। আর এই নজিরবিহীন কাজটি করতে তার বিন্দুমাত্র সমস্যা হয়নি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় আয়ােজনে ফাঁসিতে মারা কী আর কঠিন কাজ।’ সুচারুভাবে এই দায়িত্ব পালন করায় কারা কর্তৃপক্ষ তার সাজার মেয়াদ দুই বছর কমিয়ে দেয়। পাঁচ বছর সাজা খাটার পর তিনি মুক্ত হয়ে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি এলাকার ত্রিপুরা সুন্দরী গ্রামে বাস করছেন।
অনেকেই জানতেন না
১৯৭৭-এর অভ্যুত্থান ও গণফাসি সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলাে প্রকাশের পর অগণিত স্বজনহারা ব্যক্তি ভােরের কাগজ ও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখেন। যাদের অনেকেই এর আগ পর্যন্ত তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানতাে না। কারণ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাদের জানানাে হয়েছিল, হয় তারা নিখোঁজ নয়তাে পালিয়ে গেছে। কিংবা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অথবা কারাে জেল হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনগুলাে প্রকাশের। পর তারা নিশ্চিত হয়েছিল তাদের স্বজনদের আসলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কিছু তারিখ উল্লেখ করার পর তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে এরপর থেকে ঐ দিন নিজের স্বজনের মৃত্যুবার্ষিকী পালন শুরু করে। সরকারিভাবে যেটা জানানাে। উচিত ছিল ‘৭৭-এ, সেটা করা হয়নি।
এমনই এক শােকাহত ব্যক্তি মােহাম্মদ জিয়াউল কবির। চাকরি ছিল প্রধান সহকারী, কর
বিভাগ, রেঞ্জ-১, বয়রা, খুলনা ও সভাপতি, বাংলাদেশ ট্যাক্সেস (৩য়) শ্রেণী কর্মচারী ইউনিয়ন, কর অঞ্চল, খুলনা। এক চিঠিতে তিনি তুলে ধরেন তার প্রতিক্রিয়া। তিনি তার ভাইকে হারিয়েছিলেন। ভাষাগত সংশােধনের পর তার চিঠিটির রূপটি দাঁড়ায় এ রকম…।
অকালমৃত্যু হলাে বাবা মায়ের সােকাহত ভাইয়ের চিঠি
‘ডােরের কাগজ’-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘৭৭-এর রহস্যময় সৈনিকদের গণফাসি’ শিরােনামে তথ্যানুসন্ধানী লেখার প্রয়াসকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি। অনেক বছর ধরে সহােদর হারানাের বেদনা; পরিণামে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমার পিতা-মাতার অকালমৃত্যুজনিত শশাকে মুহ্যমান অবস্থার মধ্যে হঠাৎ ভােরের কাগজে লেখা আমাকে চমকিত করেছে, অভিভূত করেছে। যে কথা এত বছর বলতে পারেনি, কেউ শুনতে চায়নি, আজ আপনাদের দৃঢ় প্রত্যয়ে তা প্রকাশের এ উদ্যোগ আমাকে, আমার পরিবারবর্গকে আশান্বিত করেছে। আমার পিতা ছিলেন একজন চাকরিজীবী। সংসারে আমরা ছিলাম নয় ভাই (আমি বড়) এবং এক বােন। পিতার চতুর্থ সন্তান মাে. ইকবাল কবির পিন্টু ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এমওডিসি পদে যােগদান করে, বিডি নং-৫০০৬৪১। ১৯৭৭ সালে অনাকাক্ষিত তথাকথিত সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় সে নিখোঁজ হয়। আমরা আর কোনাে দিন তার খোঁজ পাইনি। আমাদের মাঝে সে আর ফিরে আসেনি। অনেক চেষ্টা করেছি। সঠিক তথ্যানুসন্ধানের। কিভাবে এবং কেন আমার ভাইটি আর কখনাে ফিরে এলাে না
এ কথা জানতে। আমার আব্বা পুত্রের নিখোঁজের কারণ জানার জন্য কত আকুতি করেছেন, কোনাে ফল হয়নি। সঠিক কোনাে তথ্য আমার পরিবারবর্গকে এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেনি। খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শুধু পুত্রশােকে বাকহীন হয়ে আমার আব্বা মারা গেলেন (৪.৬.৭৮)। তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়লাে আমার মায়ের ওপর। তিনিও পুত্র ও স্বামীর অকালমৃত্যুতে আমাদের মায়া ত্যাগ করলেন। আমাদের সহােদর ইকবাল কবির পিন্টু চাকরিরত অবস্থায় নিখোঁজ হওয়ার পর বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে সঠিক কোনাে তথ্য আমাদের সরবরাহ করা হয়নি। তবে ১৯৭৮ সালের ৩ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট কমান্ডিং অফিসারের পক্ষ থেকে একটি চিঠি আব্বাকে লেখা হয়, যার বক্তব্য ছিল ইকবাল কবিরকে সামরিক আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে কয়েদ করা হয়েছে। চিঠিতে আরাে উল্লেখ করা হয় যে এ-সংক্রান্ত পরবর্তী কোনাে অগ্রগতি বা সংবাদ পরে প্রয়ােজনে আমাদের জানানাে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা তদানীন্তন সরকার এ-সংক্রান্ত আর কোনাে সংবাদ আমাদের জানানাের প্রয়ােজন বােধ করেনি। সহােদর ইকবাল কবিরের খোজে তার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমি নিজে দেখা করতে গেলে আমাকে আমার ভাইয়ের পক্ষে একটি কাগজে ১৮-৯-৭৮ ইং তারিখে স্বাক্ষর করিয়ে ২৮২ টাকা, একটি হাতঘড়ি, একটি চাবির ব্যাগ বুঝে পাওয়ার রসিদে সহি সম্পাদন করতে হয়। কি আমার ভাইয়ের কোনাে তথ্যাদি আমাকে জানানাে হয়নি। পরিশেষে আমার আব্বাকে তার পুত্র ইকবাল কবির পিন্টুর ব্যাপারে আর একটি পত্র লেখা হয়, (উক্ত চিঠি পাওয়ার আগেই আমার পিতা মৃত্যুবরণ করেন) যাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইকবাল কবিরের বিভাগীয় দেনা-পাওনা সংক্রান্ত চূড়ান্ত হিসাব চুকানাের বিষয়ে নিয়মনীতি প্রতিপালনের কথা উল্লেখ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আর কোনাে ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। সবশেষে আমার পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের জমাট বাঁধা প্রশ্ন ও ব্যথা আপনার কাছে পেশ করে সান্ত্বনা পেতে চাই। আমার ভাইয়ের মতাে অনেক যুবকের অজানা অপমৃত্যুর খবর এতদিন পর হলেও প্রকাশিত হলাে। জানা গেলাে যে আমার ভাইটির অন্তর্ধানের ফলে আমার আব্বা-আম্মার অকালমৃত্যু হয়েছে। এখন হয়তাে শান্তি পাবে তাদের অতৃপ্ত আত্মা। ব্রিটিশ এ দেশ শাসন করেছে, পাকিস্তানিরাও করেছে। আজ তারা এ দেশ শাসন করে আজ আমরাই আমাদের দেশ শাসন করছি। আমাদেরই সন্তানরা দেশমাতৃকার প্রতিরক্ষার্থে নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভেবে যে মহান পেশায় গিয়ে অনাকাক্ষিতভাবে আত্মাহুতি দিলাে, কাণ্ডজ্ঞানহীন বর্বর কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কে সঠিক সংবাদটুকু পর্যন্ত আমাদের জানালাে না। এ কেমন আচার? এ কেমন রীতি? সবার বিবেকের কাছে, জাতির কাছে এ প্রশ্ন রাখছি।
২৪৭ জনের শাস্তির খবর ছাড়া আর কোনাে তথ্য নেই -বিমান সদর দপ্তর
১৯৯৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে লেখক আনুষ্ঠানিকভাবে বিমানবাহিনীর কাছে ‘৭৭-এর অ্যুত্থান-পরবর্তী বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। প্রতিবার তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনাে দালিলিক তথ্য-প্রমাণ নেই। তবে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বিমানবাহিনীর এমন উচ্চপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে নানা তথ্য দিয়েছেন। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতাে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে ভাসা ভাসা কিছু তথ্য বিমানবাহিনী থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘৭৭-এর অ্যুত্থানের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডসহ ২৪৭ জনকে বিভিন্ন প্রকার শাস্তি দেওয়া ছাড়া আর কোনাে তথ্য বিমান সদর দপ্তরে নেই। যদিও এর আগে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সময় ১৯৮৭ সালে খােদ বিমানবাহিনী থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাস শীর্ষক যে বইটিতে বলা হয়েছে ৫৮১ জন সদস্যকে বিমানবাহিনীকে হারাতে হয়েছে। বইটি নিষিদ্ধ করে সব কপি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল অ্যুথান-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকারের শেষদিকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকগুলােতে ১৯৭৭ সালে সংঘটিত অ্যুত্থান নিয়ে আলােচনা হয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর অসহযােগিতায় সেই আলােচনা বেশিদূর এগােতে পারেনি। তখন স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ। যাকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। ২০০০ সালের ২ অক্টোবর স্থায়ী কমিটির ২৬তম বৈঠকে প্রসঙ্গক্রমে তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছিলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে। সশস্ত্র বাহিনীর ৪০০-৫০০ সদস্যকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ কমিটির ২৭তম বৈঠকে ১৯৭৭ সালে সংঘটিত ঘটনা নিয়ে আলােচনা হয়। ২৭তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের সাংসদ মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ ২ অক্টোবর ‘৭৭ সালের ঘটনার সঙ্গে সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের বিচারকার্যের ওপর আলােচনার আহ্বান জানালে সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান জানান, আলােচ্য সময়ে ঢাকা, বগুড়া ও অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সেনাপ্রধান কর্তৃক কোর্ট অব ইনকোয়ারি করা হয়। ইনকোয়ারির পর একাধিক মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জড়িত ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া কতিপয় দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বৈঠকে বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, যেসব বিমানবাহিনীর সদস্য বিদ্রোহে জড়িত ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে এবং কিছু বিমানবাহিনীর ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছিল।
বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন বিমান সদস্যের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডসহ ২৪৭ জনকে বি িপ্রকার শাস্তি প্রদান করা হয় এবং ৬৯ জনকে ট্রাইব্যুনাল খালাস প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এদের মধ্যে দুজনকে ছাড়া ৬৭ জনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এই তথ্যগুলাে ছাড়া আর কোনাে তথ্য বিমান সদর দপ্তরে নেই। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য আওয়ামী লীগের সাংসদ কর্নেল শওকত আলী জেনারেল আতিক কর্তৃক পরিচালিত বিচারকার্যের মধ্যে বিমানবাহিনী অন্তর্ভুক্ত ছিল কিনা এবং মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনাল, না মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল ছিল জানতে চাইলে বিমানবাহিনীর জাজ অ্যাডভােকেট জেনারেল জানান, এগুলাে মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল ছিল। শুধু ৩১ নম্বর মার্শাল ল’ কোর্ট বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা এবং বিমানসেনাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। বিমানসেনাদের ও এমওডিসিদের দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচার করা হয়েছিল। যেসব বিমানসেনাকে আমি উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাদের বিচার হয়েছে আর্মি মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালে। আর বিমানবাহিনীর তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে তাদের বিচার হয়েছিল বিমানবাহিনী মার্শাল ল ট্রাইব্যুনালে।
কমিটির সদস্য বিএনপির সাংসদ মেজর মাে. আখতারুজ্জামান বৈঠকে প্রশ্ন তুলেন, যখন মার্শাল ল’ কোর্ট কোনাে ব্যক্তিকে নির্দোষ বলে খালাস প্রদান করে তখন তার বিরুদ্ধে পুনরায় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা আইনসঙ্গত হয়েছে কিনা? জবাবে বিমানবাহিনী প্রধান জানান, ট্রাইব্যুনালে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও কর্তৃপক্ষের বিভাগীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার এখতিয়ার আছে। সুতরাং আলােচ্য বিষয়টি আইনসঙ্গত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। বৈঠকে ১৯৭৭ সালে সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের বিচারকার্যের সমুদয় তথ্য দেওয়ার জন্য ১৭ ডিসেম্বর ২০০০ সালের পরবর্তী বৈঠকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকটি হয়েছিল ৭ জানুয়ারি ২০০১ সালে। ওই বৈঠকে এই ইস্যু নিয়ে আলােচনা হয়নি। দশম সংসদেও গত ১৯ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে সরকারি দলের সংসদ সদস্য আ স ম জাহাঙ্গীর হােসেইন জানতে চেয়েছিলেন, জিয়ার আমলে সামরিক বাহিনীতে কয়টি অ্যুথান হয়েছিল ও কতজন নিহত হয়েছিল। জবাবে সংসদে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী লিখিতভাবে জানান, ঐ সময় সরকার বা সংসদ ছিল না। জবাবদিহিতাও ছিল না। এ কারণে যারা ঘটনার শিকার হয়েছেন তাদের সঠিক কোনাে পরিসংখ্যান নেই। অর্থাৎ সরকার প্রকারান্তরে সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে কোনাে তথ্য দিতে রাজি নয়।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর। ইতিহাস। এ বইতে ‘৭৭-এর ২ অক্টোবরের অভ্যুত্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি বর্ণনা রয়েছে। সেই বর্ণনায় ঐ দিনটি অভিহিত হয়েছে কালাে দিন হিসেবে। বইটি প্রকাশ করার পর ‘৭৭-এর অ্যুত্থান নিয়ে কিছু মন্তব্য থাকায় তৎকালীন সামরিক সরকার সেটির সব কপি পুড়িয়ে ফেলে। তার মধ্যেও কিছু কপি থেকে যায়। সেই বইটি সরকারের একমাত্র প্রকাশিত নছি, যাতে বলা হয়েছে ঐ অভ্যুত্থানে ৫৬১ জন
বিমানসেনাকে হারাতে হয়েছে।
বিমানবাহিনীর কালাে দিন ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবসে পুরাতন বিমানবন্দরের কাছাকাছি বিমানবাহিনী অফিসার্স মেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা। সামরিক বাহিনীর সব পদস্থ কর্মকর্তাও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। ২৭ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট জিয়া বিমানবাহিনী প্রধান এভিএম এ জি মাহমুদকে এক চিঠিতে জানালেন যে তার পক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। এ সময় আরাে দুটি ঘটনার ফলে অনুষ্ঠান অজান্তেই বন্ধ হয়ে গেলাে। ২৬ সেপ্টেম্বর একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় স্কোয়াড্রন লিডার ইসলামসহ আরাে দুজন ক্রু মারা গেলেন। জাপানি রেড আর্মির ‘হিদাকা কমান্ডাে ইউনিটের পাঁচ সদস্য ১৫৬ জন যাত্রীসহ জাপান এয়ারলাইন্সের একটি ডিসি-৮ বিমান ব্যাংককের পথে বােম্বে ত্যাগ করার পরপরই হাইজ্যাক করে ঢাকায় অবতরণ করাতে বাধ্য করলাে। ঢাকায় এ নিয়ে ব্যাপক শােরগােল পড়ে গেলাে। বিমানবাহিনী প্রধান এ জি মাহমুদকে বিমান ছিনতাকারীদের সঙ্গে আলােচনার দায়িত্ব প্রদান করা হলাে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা হলাে। অনুষ্ঠান স্থগিত হলে তথাকথিত ২৮ সেপ্টেম্বরের ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেলাে। দুদিন পর বগুড়া সেনানিবাসের একটি রেজিমেন্টের সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘােষণা করে। এতে দুজন কর্মকর্তা প্রাণ হারান। পরদিন ১ অক্টোবর ঢাকা সেনানিবাসেও উত্তেজনা দেখা দিলাে। এখানে একটি ব্যাটালিয়নের কিছু বিপথগামী সৈন্য বিদ্রোহের আয়ােজন করলাে। এদের সঙ্গে কিছু বিমানসেনাও অস্ত্র ভাণ্ডার লুট করে বিদ্রোহে যােগ দিলাে। ১ অক্টোবর দিবাগত রাতে সেনা ও বিমানবাহিনীর বিমানসেনারা ২৫টি ট্রাক ও জিপ নিয়ে সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপােতে হানা দিলাে। ২ অক্টোবর ভাের ৫টায় সাতটি
ট্রাকে সৈন্য ও বিমানসেনারা রেডিও স্টেশন দখল এবং সেখানে তারা সিপাহি বিপ্লবে যােগ দেওয়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে আহ্বান জানালাে। একজন বিমানসেনা (সার্জেন্ট আফসার) নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘােষণা দিয়ে বেতারে বক্তৃতা দিলেন। অবশ্য পুরাে দেশ সে বক্তৃতা শােনার পূর্বেই নবম ডিভিশন হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে সাভারের ট্রান্সমিশন কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হলাে। ইতােমধ্যে বিদ্রোহ নৃশংস আকার ধারণ করলাে। বিদ্রোহীরা বিমানবন্দর হ্যাঙ্গারের সামনে বিমানবাহিনীর দুজন অফিসারকে গুলি করে হত্যা করলাে। বিমানবাহিনী প্রধানের সামনেই গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাস মাসুদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিমানবাহিনী প্রধান কোনােভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেখানে গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার আহমদ চৌধুরী, উইং কমান্ডার আনােয়ার শেখ, স্কোয়াড্রন লিডার এ মতিন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শওকত জাহান চৌধুরী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সালাউদ্দিন, ফ্লাইং অফিসার মাহবুবুল হক, ফ্লাইং অফিসার আখতারুজ্জামান, পাইলট অফিসার এম এইচ আনসার, পাইলট অফিসার নজরুল ইসলাম ও পাইলট অফিসার শরিফুল ইসলামকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীদের গুলিতে স্কোয়াড্রন লিডার সিরাজুল হকের ১৬ বছরের তরুণ ছেলে এনামও নিহত হয়। কিন্তু এ বিদ্রোহ বেশি দূর এগােতে পারেনি। কেননা বিদ্রোহের নায়করা অন্যান্য ইউনিট থেকে সৈন্যদের তাদের দলে টেনে আনতে ব্যর্থ হয়। অবিলম্বে দেশপ্রেমিক অনুগত সৈন্যদের সহায়তায় বিদ্রোহ দমন করা হলাে। কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে দেশের স্বার্থবিরােধী কাজ করার অভিযােগে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হলাে। তখন ধারণা করা হয়েছিল যে জাপানি বিমান হাইজ্যাকের সঙ্গে বিমানবাহিনীর এ বিদ্রোহের যােগসূত্র ছিল। বিদ্রোহের অপরাধে সরকার অপরাধীদের প্রতি কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলাে। সরকার নির্দেশিত বিশেষ সামরিক আদালতে বিচারে এবং পরবর্তী সময়ে রুল ৩১ মােতাবেক যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাতে মােট প্রায় ৫৬১ জন বিমানসেনাকে বিমানবাহিনীকে হারাতে হয়েছিল, যা এ ক্ষুদ্র ও নবীন বিমানবাহিনীর জন্য এক অতি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই বিচারে বেশ কিছুসংখ্যক বিমানবাহিনী এএমও ডিসিও বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত হয়। ঐ দিনের ঘটনা ছিল সারা দেশের, তথা সশস্ত্র বাহিনী ও বিমানবাহিনীর জন্য একটি ‘কালাে দিন। আমরা প্রার্থনা করি এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
শেষের আগে
বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার হত্যাকাণ্ডের বাইরে সামরিক বাহিনীতে ছােট-বড় ২১টি অ্যুত্থানের খবর আমরা বিভিন্ন গবেষক ও সামরিক বিশ্লেষকদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এর মধ্যে ১৯টিই ছিল জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে। জিয়া এসব অ্যুত্থান অত্যন্ত কঠোরভাবে দমন করেন। আর এ কারণে স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সামরিক বাহিনীর অনেক চৌকস-মেধাবী ও মুক্তিযােদ্ধা অফিসার এবং হাজারাে সৈনিককে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে কখনই বিশ্লেষণ করা হয়নি কেন এত বিদ্রোহ। ঘটনার গভীরে যাওয়া হয়নি কেন এত রক্তক্ষয়? আর শেষ পর্যন্ত সেই রক্তস্রোত, যার প্রবাহ জেনারেল জিয়া নিজেই সৃষ্টি করেছিলেন, তাকে নিজের রক্ত দিয়ে সেই স্রোতের গতিরােধ করতে হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকেই সামরিক বাহিনীতে মত ও দর্শনের বিভক্তি ছিল। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা অফিসাররা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আদলেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠনের পক্ষে ছিলেন, অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের আগ্রহ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাহিনীকে গড়ে তােলা; কেউ কেউ উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী গঠনের স্বপ্ন দেখছিলেন। সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা কেমন হবে— একপর্যায়ে এ নিয়ে মতবিরােধ প্রায় প্রকাশ্য হয়ে পড়েছিল। উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী গঠনের পক্ষে নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল তাহের। তিনি গােপনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) যােগ দেন এবং সেনাবাহিনীর ভেতরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামে একটি সংগঠন গড়ে তােলেন। এই দুই পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জের ধরে সেনাবাহিনীতে বেশ কটি অ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া সেনাবাহিনীতে কোনাে এলিট ক্লাস থাকবে না এমনটিও আশা করছিলেন অনেক সিনিয়র অফিসার। তারা সৈনিকদের একটা বড়
অংশকে এ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। শুরুতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যকার এ দ্বন্দ্ব-গ্রুপিং থেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর বিক্ষোভ থেকে ব্যাপক রক্তক্ষয় সেনাবাহিনীকে মােকাবেলা করতে হয়েছিল। অনেক বিশ্লেষক ও গবেষক এ বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আরাে অনেক পেছনে গিয়ে বলেছেন, এই দ্বন্দ্বের উৎপত্তি মূলত ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার সেনাবাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে। ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার জন্য ব্রিটিশরা ইন্ডিয়ায় সেনাবাহিনী গঠন করে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি বাস্তবায়নের জন্য। তারা সেনাবাহিনীকে শিক্ষাই দিতাে এমনভাবে, যাতে জনগণ কখনাে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। রাজনীতিবিদরা দেশের শত্রু, জনগণ মূর্ষ আর সামরিক অফিসাররা এলিট- এ ধারণা তাদের দেওয়া হতাে। পাক-ভারত বিভক্তির পর ভারত সরকার তাদের সেনাবাহিনী গঠনে ব্রিটিশদের ঐ নীতি পরিহার করে এবং সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে ব্যাপক সংস্কার আনে, সেনাবাহিনীতে নিয়ােগের ক্ষেত্রেও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা হয়। তাই এখন পর্যন্ত সেখানে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে কোনাে ভূমিকা রাখেনি। অপরদিকে পাকিস্তান ব্রিটিশদের অনুসৃত নীতিই অনুসরণ করে। তারা পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, এয়ারফোর্স একাডেমি ব্রিটিশ আদলেই গঠন করে, নিয়ােগ ও প্রশিক্ষণনীতি বহাল রাখে- তাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে।
সত্তরের দশকে যেসব সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন, তারা ষাটের দশকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে নিয়ােগ পেয়েছিলেন। এরই মধ্যে ঘটে যায় ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। একটি নিয়মিত বাহিনীর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ােজিত ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ছাত্র-যুবক-কৃষক এবং শ্রমিকদের ট্রেনিং দিয়ে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়। যাদের অনেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নিয়মিত বাহিনীর অংশ হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর এই অংশটি ছিল রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় অনেকটা অগ্রসর। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকার একটি আধুনিক ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী। গঠনের উদ্যোগ নেয়নি। তার সরকার অনেকটা অবহেলাই করেছে সেনাবাহিনীকে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেনাবাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা ভীতি ছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের মুজিব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। বেশির ভাগ সময়ই কারাবন্দি থাকতে হয়েছে। পাক সামরিক জান্তারা তার ও তাঁর দলের ওপর যে অত্যাচার করেছে সেটির পুনরাবৃত্তি যেন না হয় তাই তিনি। শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনে মনোেযােগী হননি। অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের সিনিয়রিটি দেওয়ায় পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা অফিসাররাও তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। অপরদিকে সেনাবাহিনীর যে ক্ষুদ্র অংশটি উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী।
গঠনের পক্ষে ছিল তারাও বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপর নাখােশ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনীর ঐ দুটি গ্রুপই মনে করে তারা নিজ নিজ চিন্তা-চেতনার বাস্তবায়ন করতে পারবে। পাকিস্তান-ফেরত অফিসাররা ভাবেন তারা এলিট হিসেবে সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠার সুযােগ পাবেন। আর উৎপাদনমুখী ও বৈষম্যহীন সেনাবাহিনী যারা গড়তে চেয়েছিলেন অর্থাৎ তাহের ও তার অনুসারীরা ভাবেন জেনারেল জিয়াকে দিয়েই তারা তাদের দাবি-দাওয়া আদায় করে নিতে পারবেন। এই চিন্তা-চেতনা থেকেই কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ৭ নভেম্বর খালেদ মােশাররফের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সহায়তা করে জেনারেল জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আনেন। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জিয়া তাহের ও তার অনুসারী জাসদ নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করেন। পাশাপাশি জিয়া পাকিস্তান-ফেরত অফিসারদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া শুরু করেন। ‘৭৬-এর জুলাইয়ে গােপন সামরিক ট্রাইব্যুনালে ফাঁসিতে তাহেরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকে। গােপন ট্রাইব্যুনালে তাহেরের আইনজীবী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের দেওয়া একটি উক্তি তাদের মনে গেঁথে যায়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “রাজা যদি বিনা অপরাধে প্রজাকে হত্যা করেন, তবে রাজা এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন যে প্রজাও রাজাকে হত্যা করতে পারে।’ ভাগ্যের এই বুঝি নির্মম পরিহাস- যে সিপাহিরা জেনারেল জিয়াকে ৭ নভেম্বর বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল, ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছিল, তারাই পরবর্তী পর্যায়ে বারবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালাতে থাকে। তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জিয়া ক্ষান্ত হননি। তিনি একে একে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের দূরে ঠেলে দিচ্ছিলেন। পাকিস্তান-ফেরত অফিসাররা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন ১৯৭৫ সালে সামরিক বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার। এর মধ্যে ৩০ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনী, ৫ হাজার ৫৫০ সদস্যের বিমানবাহিনী ও ৫৫০ সদস্যের নৌবাহিনী। এই ৩৬ হাজারের মধ্যে ২৮ হাজারই ছিল। পাকিস্তান-ফেরত যার মধ্যে হাজার খানেক ছিলেন অফিসার পদবির। মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের বঙ্গবন্ধু সরকার দুই বছর সিনিয়রিটি দেওয়ায় পাকিস্তান-ফেরত অফিসারদের সঙ্গে রেষারেষি লেগেই ছিল। জিয়া পাকিস্তান-ফেরতদের পক্ষ নেওয়ায় অনেক মুক্তিযােদ্ধা অফিসার অসন্তষ্ট ছিলেন। আর ভেতরে ভেতরে জাসদ সমর্থিতরা তাে জলছিলেনই। অপরদিকে ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আরাে ব্যাপক ক্ষমতা না পাওয়ায় তারাও ক্ষুব্ধ ছিলেন। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান যেটাকে অনেকেই ‘সিপাহি বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেন সেই একই আদলে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু সদস্য জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তাই ১৯৭৭ সালে ২ অক্টোবরের সেই ব্যর্থ অভ্যুত্থানকে অনেক সামরিক বিশ্লেষক ‘দ্বিতীয়
সিপাহি বিপ্লব’ বলে থাকেন। কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব, নিখুঁত পরিকল্পনা ও বাস্তবতা পারঙ্গমে অক্ষমতার কারণে সেই অ্যুত্থান সফল হতে পারেনি। সেদিন কোনাে অফিসার ঐ অ্যুত্থানে যােগ দেননি। সিপাহিরা অফিসার হত্যা শুরু করে। এতে যোগ দেয় মূলত বিমানবাহিনীর সদস্যরা। জেনারেল জিয়া কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে যেভাবে অ্যুথানকারীদের দমন করেছিলেন, একইভাবে অক্টোবরের অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও গণহারে বহুজনকে অভিযুক্ত করে কলমের এক খোঁচায় শত শত সৈনিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। এতে অনেক নিরপরাধ সৈনিককেও প্রাণ হারাতে হয়েছিল। বিমানসেনারা কেন বিদ্রোহ করলাে- এর মূলে তিনি যেতে চাননি। কারণগুলাে খুঁজে বের করে তা সমাধানের চিন্তা না করে মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া ছােষ্ট্র বিমানবাহিনীকেই একসময় বিলুপ্ত করার চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। লে, জে, মীর শওকত আলী আমাকে জানিয়েছেন, জেনারেল জিয়া বিমানবাহিনী বিলুপ্ত করে এর জনবল ও সম্পদ আর্মি এভিয়েশন কোরের অধীনে নিয়ে আসার চিন্তা করেছিলেন। প্রায় দুই মাস তাই বিমানবাহিনীর কোনাে কার্যক্রম ছিল । যদিও শেষ পর্যন্ত জিয়া তার চিন্তা থেকে সরে এসেছিলেন। বিমানবাহিনী বিলুপ্ত না করলেও তার মধ্যে বিমানবাহিনী ভয় ঢুকে গিয়েছিল। আর তাই শত শত বিমানসেনাকে ফাসিতে হত্যা করা হয় কোনােরকম তদন্ত ছাড়াই। তাদের বেদনার কথা শুনতে চাননি তিনি। মৃত্যুদণ্ডকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন প্রতিষেধক হিসেবে। এ কথার প্রমাণ মেলে তথাকথিত ট্রাইব্যুনাল গঠন ও লােক দেখানাে তদন্ত কমিশন গঠনে। আর সেনা সদর দপ্তর যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল তাকে বিমানবাহিনীর সদস্যদের বিদ্রোহ নিয়ে কোনােরকম তদন্ত করার ক্ষমতাই দেওয়া। হয়নি। ঐ কমিটির সদস্য ছিলেন তৎকালীন লে. কর্নেল চৌধুরী খালেকুজ্জামান। তিনি তার সামরিক জীবনের স্মৃতি ১৯৬৪-১৯৮১’ বইতে লিখেছেন, ‘১৯৭৭ সালে একই সঙ্গে বগুড়া ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ঢাকায় তখন কিছু অফিসার হতাহত হয়। … সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টার থেকে এসব ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিকে একটা ব্যবস্থা সুপারিশ করার জন্য বলা হয়। বিমানবাহিনীর বিদ্রোহ নিয়ে তদন্ত করার ক্ষমতা কমিটিকে দেওয়া হয়নি।’ অক্টোবরের এই অভুথান দমনে কেন জেনারেল জিয়া এত হিংস্র হয়ে উঠেছিলেন এই প্রশ্নের সরাসরি কোনাে জবাব পাওয়া না গেলেও ধারণা করা যায়, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এর পরিণতি কী হতে পারে। ৭ নভেম্বর সিপাহি বিপ্লব’-এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় বসা জিয়া বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে বিদ্রোহী সৈনিকরা একে একে সব অফিসারকে হত্যার চেষ্টা চালাবে। তাই তিনি একমুহূর্ত সময় নষ্ট করতে চাননি। অতি দ্রুত বিদ্রোহীদের ফাসিতে বা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যার নির্দেশ দেন। আর এর পেছনে। তাকে সর্বাত্মক সহযােগিতা করেন পাকিস্তান-ফেরত অফিসাররা। জিয়ার মধ্যে এমন
ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে মুক্তিযােদ্ধা অফিসাররা হয়তাে দূর থেকে এ অ্যুথানে ইন্ধন। জুগিয়েছে। অর্থাৎ অক্টোবর অত্যুত্থানের পুরাে ঘটনা জিয়াকে ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। জিয়া সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে বড় ধরনের রদবদল আনেন। সেনাপ্রধানের পদটির স্থাব্য দাবিদার। নবম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীকে যশাের ও সিজিএস। মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে তিনি অতি দ্রুত চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন। বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল দস্তগীরকে অব্যাহতি দিয়ে বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে পাঠিয়ে দেন। ডিজিএফআই প্রধান আমিনুল ইসলামকেও অব্যাহতি দেন। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটিও তিনি বিলুপ্ত করেন। সামরিক বাহিনীতে এই রদবদল থেকে। বােঝা যায় জিয়া নিজ বাহিনীতে নিরাপদ বােধ করছিলেন না। আর তখনই তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তটি ত্বরান্বিত করেন। তিনি অনুধাবন করতে শুরু করেন যে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের মধ্যেই ব্যস্ত রাখতে হবে। নিজেকে জনগণের কাতারে নামাতে হবে। তাই জিয়া সব অফিসারকে নির্দেশ দেন তাকে মেজর জেনারেল জিয়া। হিসেবে সােধন না করে প্রেসিডেন্ট জিয়া হিসেবে সম্বােধন করতে। পাশাপাশি তিনি অতি দ্রুত রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। ‘৭৭-এর ১৬ ডিসেম্বর জিয়া ঘােষণা করেন শিগগিরই তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন, যার ভিত্তি হবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সেই ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় আজকের বিএনপি। সামরিক বাহিনীতেও তার কোনাে বিরুদ্ধাচরণ যেন না থাকে সে কারণেই জিয়া তদন্ত ছাড়াই সৈনিকদের হত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। আর তাই সামরিক আইন বলে যেসব ট্রাইব্যুনাল তিনি করেছিলেন, সেখানে অভিযুক্তদের কোনাে ডিফেন্ডিং অফিসার দেওয়া। যাবে না বলে ফরমান জারি করেন। আপিলের সুযােগ তাে বন্ধই ছিল। একতরফা রায়ে। দুই মিনিটেই একজন সিপাহির মৃত্যুদণ্ড ধার্য হয়ে যায় হারিয়ে যায় শত শত সৈনিক। ফাসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সময় লাগবে বলে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুর ফরমান জারি করা হয়। তাই তাে আজও আকবর-আলেয়ার ছেলে শরীফ বা মনিররা খুঁজে বেড়ায় তাদের বাবাকে। যিনি সব কিছু তুচ্ছজ্ঞান করে যােগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আর ঐ ছেলেটি যে জন্মের পর বাবাকে দেখতেই পায়নি, বাবার ছবি বুকে নিয়ে আজও স্বপ্ন দেখে কোনাে একদিন হয়তাে তার বাবার হত্যার বিচার হবেই। ইতিহাসের অন্ধকার সেই অধ্যায়টি উন্মােচিত হবেই। কিন্তু কবে? আর কত অপেক্ষা? বুকের ভেতর জমাটবাঁধা কান্নার অবসানের অপেক্ষা। এ অপেক্ষার পথ যে অনেক দীর্ঘ …।
ঢাকা, কুমিল্লা ও বড় কারাগারে ২০৯ জনের ফাঁসি হয়
১৯৭৭-এর ২ অক্টোবর অত্যুত্থান প্রচেষ্টা ও তা দমনে সময় এবং পরবর্তী শান্তি প্রক্রিয়ায় সেনা ও বিমানবাহিনীর মােট কতজন সদস্য নিহত হয়েছেন, তার কোনাে হিসাব পাওয়া যায়নি। অ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগে মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা ও তা কারাগারে কার্যকর করা সংক্রান্ত একটি তালিকা পাওয়া গেছে। ঢাকা ও কুমিল্লা ঐ দুটি কারাগারে মােট ১৯৩ জনের ফাঁসি হয়। ঢাকায় ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর ‘৭৭ পর্যন্ত এবং কুমিল্লায় ২৯ অক্টোবর ‘৭৭ থেকে জানুয়ারি ‘৭৮ পর্যন্ত ফাঁসিগুলাে কার্যকর হয়। দেশের অন্য কারাগারগুলােতে ফাসি হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানাে হয়। কিন্তু অন্য কোনাে জেলে অক্টোবরের ঘটনায় অভিযুক্তদের ফাঁসি হওয়া সম্পর্কে কোনাে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ঢাকায় অ্যুত্থান প্রচেষ্টার প্রাক্কালে ৩০ সেপ্টেম্বর ‘৭৭ দিবাগত গভীর রাতে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে একটি রেজিমেন্টের সৈন্যরা বিদ্রোহ করেছিল। পরে বিদ্রোহীদের মার্শাল ল’ ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়। ২৬ অক্টোবর ‘৭৭ আইএসপিআর-এর মাধ্যমে জানা যায়, ঐ ঘটনায় ৫৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। বগুড়া কারাগারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ২১ ও ২২ অক্টোবর দুই রাতে বগুড়া কারাগারে ১৬ জনের ফাঁসি হয়। অপর ৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কোথায় কিভাবে করা হয়েছিল তা জানা যায়নি। তৎকালীন সামরিক সরকারও এসব তথ্য প্রকাশ করেনি।
সূত্র : রহস্যময় অভ্যুত্থান ও গণফাঁসি – জায়েদুল আহসান