প্রতিধ্বনি
দুর্বাসা
“বাঙলাদেশ সরকার ন্যাপের সাবেক নেতা রংপুরের মসিউর রহমানকে খুঁজছেন। মসিউর রহমান পাকিস্তানি সৈন্যদের গােয়েন্দা এজেন্ট হিসাবে পশ্চিম বাঙলায় গিয়ে কাজ করেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে তার বিচার করা হবে বলে বাঙলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
এই সংবাদটি বের হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর তারিখের ‘যুগান্তর পত্রিকায়, খবর দিয়েছে ঢাকা থেকে ঐ পত্রিকারই স্টাফ রিপাের্টার ।
এখানে একটা কথা গােড়াতেই বলে রাখা দরকার, মসিউর রহমান ছিলেন যাকে বলে ভাসানীপন্থী ন্যাপ তার সম্পাদক।
খবরটা কজনের চোখে পড়েছে জানি না, আমার পড়েছে আর আমি অন্তত এতে বিস্মিত হইনি। মসিউর রহমান কেমন ধরনের লােক তা আমাদের জানা ছিল। এবং তার সামান্য কিছু পরিচয় আমরা সপ্তাহর পাতাতেই দিয়েছি। তেভাগা আন্দোলনের সময় এই কুখ্যাত ভদ্রলােক তার নিজের জোতের প্রজাদের উপর কিভাবে নিজহাতে বন্দুক চালিয়েছিলেন তাও আমরা আমাদের সেই লেখাতে দেখিয়েছি। মসিউর তদুপরি ছিলেন কুখ্যাত চোরাকারবারি এবং অত্যন্ত সন্দেহজনক চরিত্রের লােক।
২৫ মার্চের পর এই ভদ্রলােক যখন কলকাতা এসে আস্তানা গাড়েন শিয়ালদহ এলাকার টাওয়ার লজে তখনও তার সন্দেহজনক গতিবিধি অনেকেরই দৃষ্টিআকর্ষণ করে। কলকাতায় অনেকেই তার সঙ্গ বর্জন করে চলতে আরম্ভ করে। এমনকি মৌলানা ভাসানীও তার সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন এবং ক্রমে ক্রমে মসিউরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করাও বন্ধ করে দেন।
কিন্তু মৌলানা সাহেবের আস্থা হারালে কী হবে, মসিউর আস্থা অর্জন করেন সি পি এমের। সি পি এমের বেশ কিছু নেতাকে টাওয়ার লজে মসিউরের ঘরে প্রায়ই দেখা যেতে থাকে। শুধু তাই নয়, সি পি এম পলিটব্যুরােতেও কৃষক-হত্যাকারী মসিউরের ডাক পড়ে বাঙলাদেশের পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলার জন্যে। সি পি এম আহূত একাধিক সভায় তিনি বক্তৃতাও করেন। গণশক্তি’র পাতা উলটালেই তার বিবরণ চোখে পড়বে।
মসিউরের সঙ্গে মাখামাখি কিন্তু এই পর্যায়েই শেষ হয় না। এই সময় মসিউর একদিন ভাসানী সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যান। মৌলানা সাহেব দেখা করেন না। মসিউর ফিরে এসে রটিয়ে দেন মৌলানাকে নাকি ভারত সরকার অন্তরীণ করে রেখেছে। সি পি এম পদাশ্রিত একটি বাঙলা সাপ্তাহিকে খবরটা ফলাও করে ছাপা হয়। বিধানসভায় হরেকৃষ্ণ কোঙার এ-নিয়ে কোলাহলও কম করেন না। কিন্তু পরদিনই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় খবরটা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণােদিত প্রচারণা মাত্র। কিন্তু তাতেও সি পি এমের মসিউর প্রেমে ফাটল ধরে না। মসিউরের সহায়তায় কিছু দলছুট ব্যক্তিকে নিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে এক সভা করে তারা এক তথাকথিত ‘সমন্বয় কমিটির সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই বলে স্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেন। কিন্তু তাতে সিপিএম এতটুকুও দমে না। মসিউরের ভরসায় কাগুজে কমিটিটি জীইয়ে রাখেন এবং ভাসানী সাহেবের নাম যথারীতি ব্যবহার করতে থাকেন। এই অল্প কিছু দিন আগেও এই কমিটির নামে তারা কাগজে একটি বিবৃতি ঝেড়েছেন।
ইতিমধ্যে মসিউরের কার্যকলাপ ক্রমশ ফাঁস হয়ে যেতে শুরু করে। তখন তিনি আকস্মাৎ একদিন হাওয়া হয়ে যান। বলা হয় তিনি নাকি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন করতে বাংলাদেশ গেছেন। রংপুরে তিনি গ্রেপ্তার হন, এমন একটা খবরও রটানাে হয়।
কিন্তু পরে কাগজেই বের হয় তিনি আসলে গেছেন করাচী এবং ভাসানীকে ছেড়ে ভুট্টোর দলে যােগ দিয়েছেন।
তারপর এখন ঢাকা থেকে এই খবর।
এখন প্রশ্ন, সি পি এম নেতারা কি সব জেনেশুনেই মসিউরের সঙ্গে এতকাল দহরম-মহরম করেছেন? যদি তাই হয়, তাহলে কী ছিল তাদের উদ্দেশ্য? এসব প্রশ্নের সদুত্তর না পেলে তাদের সততা সম্পর্ক স্বভাবতই সন্দেহ জাগবে।
সূত্র: সপ্তাহ, ৭ জানুয়ারি ১৯৭২