পাকিস্তানে নয় বাঙলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরবেন
(ভাষ্যকার) নির্বিচার গণহত্যায় যাদের হাত রক্তাক্ত হয়েছে তারা যদি মিথ্যের বেসাতি করেন-অপপ্রচারের আত্মতৃপ্তি নিয়ে তারা তৃপ্ত হতে পারেন, আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত সাড়ে সাত কোটি বাঙালী তাতে মােটেও বিভ্রান্ত হইনা। ওরাও জানে এরা বিভ্রান্ত হবে না। হতে পারে না-তবুও অপপ্রচার চলছেই। এটাও নাকি নিয়ম খুনীর কণ্ঠ থেকেই নির্গত হয় সুন্দর শব্দ আর নিরাপদ আশ্রয়ের প্রলােভন। আজ আর বিশ্বের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হয় না একথাগুলাে তার বর্বরতাকে নিন্দা করে উচ্চারিত হচ্ছে-ইতিহাসের সবচাইতে ঘৃণ্যতম খুনী ইয়াহিয়ার রক্তপিপাসু মুখাবয়ব আজ প্রতিটি ঘৃণিত শবদের পেছন থেকেই উঁকি দিয়ে ওঠে। সেই সব রক্তপিপাসু পাক বাহিনীর হাতে নিয়ন্ত্রিত ঢাকা বেতার থেকে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন যে অপপ্রচারের অনুষ্ঠানই চলবে-এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া রেডিও পাকিস্তান একথা তাে বারবারই স্বীকার করেছেন যে অবস্থা স্বাভাবিক। দীর্ঘ ছয় মাস। ধরেই স্বাভাবিক কথাটি বারবার শুনতে শুনতে মনে হয়েছে, যেন পাকিস্তান গত ২৫শে মার্চের পর থেকেই কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে, এর আগেই যেন অস্বাভাবিক ছিল। যে অস্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে আমাদের আজন্ম সংগ্রাম।
মাঝে মধ্যে যদি কখনও পাকিস্তান বেতারের অনুষ্ঠান শুনেন তাহলে লক্ষ্য করবেন রেডিও পাকিস্তান কিছুটা খেই যেন হারিয়ে ফেলেছে আজকাল। তাদের মতে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সতর্ক চোখকে ফাকি দিয়ে, নির্যাতীত শরণার্থীরা নদী পাহাড়-পর্বতের দুর্গম পথ অতিক্রম করে পাকিস্তানে ফিরে যাচ্ছেন। প্রত্যেক দিনই হাজার হাজার নির্যাতীত শরণার্থী ইয়াহিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফিরে যাচ্ছেন পাকিস্তানে। বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে যে ভারতে শরণার্থী হয়েছেন—রেডিও পাকিস্তান সেটা স্বীকার না করলেও আপাতত: অনেক শরণার্থী ফিরে গেছেন বলে পাকিস্তান রেডিও দাবী করেছে। যেহেতু রাষ্ট্রসংঘের মহাসচীব উ’থান্ট তার সাম্প্রতিক ভাষণেও বলেছেন যে জেনারেল ইয়াহিয়ার আহ্বানে শরণার্থীরা কেউ ফিরে যায়নি। সুতরাং সাম্প্রতিক কালে ফিরে যাবার সংখ্যা রেডিও পাকিস্তানের কল্যাণে ফুলে ফেপে দিনকে দিন বাড়ছেই। ফিরতে ফিরতে এতাে বেশী ফিরে যাচ্ছে যে ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত নব্বই লক্ষ সংখ্যাকেও অতিক্রম করে যাচ্ছে। প্রশ্ন আসে, এতাে তাে আসেনি, এতাে ফিরছে। কি করে?
দুদিন আগেও পাকিস্তান বেতার থেকে স্বীকার করা হয়েছিল বাঙালীদের দেশত্যাগের কথা-তারপর কিছুটা স্বীকার করে নিয়ে বলা হয়েছিল সামান্য কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতকারী ভারতে পালিয়ে গেছে-কিন্তু একদিকে বিশ্বচাপ আর অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে একটা রাজনৈতিক সমাধানের। আশা নিয়েই হয়ত পাকশাহী স্বীকার করে নিলেন শরণার্থী সমস্যা। এমনকি খুনী তার কণ্ঠস্বর পাল্টিয়ে সাদর আহ্বানও জানালেন-কিন্তু দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তেই থাকলাে। ফলে অপপ্রচার ছাড়া পাকশাহীর আর কিছুই থাকলাে না। তারপর এলেন অসামরিক গভর্ণর ডা: মালিক। তিনি ব্যাপক দেশত্যাগের কথা স্বীকার করলেন-দেশত্যাগীদের দেশে ফিরে গেলে জমি ঘর ফিরিয়ে দেবারও প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু কেউ ফিরলাে না। সম্প্রতি পাক বেতার থেকে ঘােষণা করা হচ্ছে অন্যরকম-শরণার্থীদের মধ্যে ভারত-বিদ্বেষ ছড়ানাে। তাদের মতে-শরণার্থীরা দলে দলে ফিরছেন ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর চোখ ফাকি দিয়ে । সীমান্তে যারা ধরা পড়েছেন গুলি করে নাকি তাদের হত্যা করা হচ্ছে। অপপ্রচার শুনে শুনে এক একবার মনে হয় ওরা সত্যিই বলছে। মানুষ তার নিজের দেশে ফিরে যাবে নিজের ঘরে, নিজের ভিটে এই তাে স্বাভাবিক।
কিন্তু কিছুদিন পরের জন্যে যা সত্য এই মুহূর্তের জন্যে তাই আমাদের স্বপ্ন। ফলে সত্য যা তা হলাে এ রকম যে দলে দলে শরণার্থীরা একদিন ফিরে যাবেই। তবে পাকিস্তানে নয় বাংলাদেশে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। আর ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী কেন, পৃথিবীর কোন বাহিনীর চোখকেই ফাকি দিয়ে নয়। ওরা বলেছেন, শরণার্থীরা দুর্গম পথ অতিক্রম করে তাদের জন্মভূমিতে ফিরে আসছে। ইয়াহিয়া সাহেব আপনি বলুনতাে পৃথিবীর কোন দেশের স্বাধীনতার পথ এতাে সুগম হয়েছিল? স্বাধীনতার সব পথই দুর্গম। এই পথই অতিক্রম করেই আমাদের ফিরতে হবে স্বাধীন বাংলার সােপানে। জেনারেল সাহেব, আজ বাঙালীদের কাছে সব চাইতে নির্মম ও ভয়াবহ যে শব্দ সেই শরণার্থী শব্দটির আপনিই তাে নির্মাতা। ভারত শুধু বন্ধুর মতাে এই একান্ত অনাথ শব্দটিকে আশ্রয় দিয়েছেন-ধর্ষিত, লুষ্ঠিত নিপীড়িত নব্বই লক্ষ মানুষ আপনার বর্বর সেনাবাহিনীর লােককে ফাকি দিয়ে ভারতে এসেও রক্ষা পায়নি, সীমান্তের ওপার থেকেও আপনার বাহিনীই শরণার্থী শিবিরগুলােকে লক্ষ্য। করে নির্বিচারে গুলী চালিয়েছে। উদ্দেশ্য ভারতের সংগে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বিশ্বের চোখ পাক-ভারত যুদ্ধের দিকে ফিরিয়ে মুক্তি সংগ্রামকে বিভ্রান্ত করা। এই তাে সেদিনও মেঘালয় সীমান্তবর্তী এক ক্যাম্প থেকে আমার নিজের ভাই চিঠি লিখে আপনার
সেনাবাহিনীর কি নিষ্ঠুর হামলার বিবরণ পাঠিয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে শরণার্থী শিবির লক্ষ্য করে ছােড়া মেশিনগানের গুলীতে নিহত হয়েছে আট জন। এদের মধ্যে দুধের শিশু, উদ্দাম যুবক–আপনার বর্বরতার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল যারা আপনার বর্বরতা সেই অসীম সীমান্তকেও অতিক্রম করে তাদের হত্যা করতে উদ্যত ‘ এই দোষ ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাধে চাপিয়ে আমাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। আজ আমরা যুদ্ধের মধ্যে বধ্যভূমিতে একটা সত্যের চূড়ান্ত মীমাংসায় লিপ্ত—আপনি তাে নিশ্চয়ই জানেন অপপ্রচারে কিছুদিন মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়-এক একজনের খুনের অপরাধ সাময়িকভাবে চাপানাে চলে অন্যের কাঁধেও কিন্তু চূড়ান্তজয়ের জন্য চাই সত্য, সে সত্য। আপনার নেই। আপনিই বলুন সৈনিকের গুলীগুলাে নিরপেক্ষ না হয়ে যদি কোন কথা বলতে পারতাে? ২৫শে মার্চের পর থেকে আজ অব্দি নিহত দশলক্ষাধিক মানুষের অমর আত্মার মধ্যে যদি খুনীর নাম। লেখা থাকতাে তাহলে আপনিই জেনারেল ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক, আপনি কোথায় মুখ লুকাতে
দাবানল ॥ ১: ২ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪