You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.31 | জকিগঞ্জ : পাকিস্তানি অত্যাচারের কাহিনি | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

জকিগঞ্জ : পাকিস্তানি অত্যাচারের কাহিনি
(সংবাদদাতা)

নভেম্বর ২১ তারিখ সীমান্ত শহর করিমগঞ্জবাসীর নিকট এক লােমহর্ষক দিন ছিল। মুক্তিফৌজের গেরিলাবাহিনী সিলেট জিলার সীমান্তবর্তী করিমগঞ্জের ওপারে জকিগঞ্জ শহর সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় আকস্মিক ভাবে আক্রমণ চালালে পর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী করিমগঞ্জ শহর পার্শ্ববর্তী এলাকার উপর প্রায় ৩০ মিনিট কাল প্রচণ্ডভাবে গুলিবর্ষণ ও শেলিং করতে থাকে। করিমগঞ্জের শ্রীমতী গুলু বেগম, শ্রীমতী পূর্ণলক্ষ্মী পাল, শ্ৰীমতী আরতি রানী পাল, শ্রীরূপচঁাদ পাল ও শ্রীদেবাশীষ দাস (৩ বৎসর) পাক গুলিতে নিহত হয়। এক সাক্ষাৎকারে শ্রীমতী পূর্ণলক্ষ্মী ও আরতিরানী পালের মাতা বলেন যে বাঙলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার দুই কন্যার শােক তিনি সহ্য করবেন। মুক্তিবাহিনীর যুবকেরা হানাদারদের উপর তিনদিক দিয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বলে অভিহিত জকিগঞ্জ শহর দখল করে এক অনাড়ম্বর ভাবগম্ভীর পরিবেশে গণ-প্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। আওয়ামী লীগের কর্মী শ্রী ইসমত আহমদ চৌধুরী ও ন্যাপের কর্মী শ্ৰী আবদুল সুইদ চৌধুরী, ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর জাতীয় সংগীত ‘আমার সােনার বাঙলা’ পরিবেশিত হয়। গ্রাম ও শহর থেকে জনসাধারণ ছুটে এসে ‘জয় বাঙলা’ বলে উল্লাসে মেতে ওঠে। ঘরে ঘরে বাঙলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। এখানে পাক বাহিনীর ২৭ জন জল্লাদ সৈন্য নিহত হয়। শতাধিক পাক সেনা আহত হয় এবং একজন ক্যাপ্টেন সহ ৬২ জন পাকিসেনা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। জকিগঞ্জ শহরেই পাকিবাহিনীর শােচনীয় পরাজয়ের পর আমরা কজন প্রথম সুযােগেই করিমগঞ্জে থেকে জকিগঞ্জ নৌকা নিয়ে এসে পড়লাম। গণ-প্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে হিজিবিজি ভেবে যাচ্ছিলাম। মাত্র কয়েকদিন আগে জকিগঞ্জ পূর্ব রণাঙ্গনে পাকি বাহিনীর অন্যতম দুর্ভেদ্য ঘাঁটি বলে পরিচিত ছিল—আজ এখানে উড়ছে বাঙলাদেশের পতাকা। বাঙলাদেশ মুক্তিবাহিনীর বীর যুবকদের উদ্দেশে মনে মনে প্রণাম জানিয়ে জকিগঞ্জ শহরটায় একটা চক্কর দেবার জন্য সামনে এগিয়ে এগিয়ে গেলাম। মাত্র গজ কয়েক দূরেই ছিল পাকিবাহিনীর শিবির। শিবির ঢুকতেই চমকে উঠলাম। জল্লাদ বাহিনীর অত্যাচার, ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটতরাজের বিভীষিকা, বাঙলাদেশের গত ৮ মাসের ইতিহাস যেন এখানে কথা বলে উঠল। স্তম্ভিত বিস্ময়ে আমি চেয়ে দেখছিলাম বাঙলাদেশের এই করুণ ও বীভৎস ইতিহাস। গােরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি থেকে শুরু করে গৃহস্থের কলার কাঁদিগুলাে পর্যন্ত শিবিরে এনে পাকার করে রাখা হয়েছে। কাপড়চোপড়, চাল, ডাল, ঘি, সিগারেট এবং নগদ টাকার পাহাড় জমে রয়েছে। এই পাহাড়-স্তুপের মধ্যে বাঙলাদেশের ইতিহাস চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ আমার চোখে পড়ল দুখানা পরিত্যক্ত ছিন্নপ্রায় ব্লাউজ। ইয়াহিয়াশাহীর নরপশুর দল বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারীর উপর কী জঘন্য ও বর্বরােচিত পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে সেই ভয়াল ইতিহাসের স্মৃতিবাহী ব্লাউজ দুটির সামনে আমি নিথর নিস্পন্দ হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। জানি না ওই ব্লাউজ দুটি কাদের। বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ মা বােনের ওপর জঙ্গীশাহীর হিংস্র পশুবল মানবিক ন্যায়নীতির সীমারেখা লঙ্ঘন করে কালিমা লেপন করে পাশব লালসা চরিতার্থের জন্য যে উন্মত্ততা ও পৈশাচিকতা লেপন করেছে তার সামনে শুধু মূকই হওয়া যায়।
কিন্তু বাঙলাদেশের এই ইতিহাস মূক নয়, শতমূখে, লক্ষকণ্ঠে সাড়ে সাত কোটি মানুষের গলায় গলায় নবজীবনের নবযাত্রার উদ্বোধনী গেয়ে এই ইতিহাসের নবযাত্রা শুরু হয়েছে। ইয়াহিয়ার খুনী সেনাবাহিনী কেন, পৃথিবীর কোন শক্তিই নেই এই দুর্বার অগ্রযাত্রা রােধ করতে পারবে না ভেবে সম্মুখের দিকে চললাম। থানায় এসে দেখলাম নির্জন থানায় ৭ জন ব্যক্তি সেলে আবদ্ধ। জিজ্ঞেস করে জানলাম ভারতীয় চর বলে এদেরকে পাকচমূরা এই সেলে ৮ দিন থেকে বন্দি রেখেছে। এমনকি ঈদের দিন পর্যন্ত তাদের জল ছাড়া আর কিছু খাবার দেয়নি। বেঙ্গল রেজিমেন্টের কজন যুবক এসে তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে খাবার দিলেন। বাজারে দোকানপাট অধিকাংশই বন্ধ। আওয়ামী লীগ ও মুজাফফর ন্যাপ সমর্থকদের দোকান লুঠতরাজ করে জিনিসপত্র সব নিয়ে গেছে। বহু হিন্দু ও মুসলমান আন্দোলন, সমর্থকদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের টিন দিয়ে বাঙ্কার বানিয়েছে। কোথাও কোথাও মসজিদ বানিয়ে ইসলামের নামে প্রহসন দেখিয়েছে। ঐ শহরের আবদুল লতিফ এম পি এ, শ্ৰী বলু মিঞা, শ্ৰী আবদুল আজিজ প্রভৃতির বাড়ির কোন চিহ্ন রাখেনি। হাঁটতে হাঁটতে ইবন মৌলভী সাহেবের সাথে পরিচয় হলাে। তিনি বললেন, গতকাল আমরা ঈদ পালন করিনি কারণ গঙ্গাজলের মসজিদের মধ্যে পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনীর জনৈক বর্বর ক্যাপ্টেন অপহৃতা জনৈকা নারীকে নিয়ে অপকর্মে লিপ্ত ছিল। এ ইলামবিরােধী কার্য দ্বারা ইসলামের তথাকথিত মুরুব্বি ইয়াহিয়া খানের জল্লাদবাহিনী মসজিদ অপবিত্র করেছে। গঙ্গাজলবাসী সেই মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
চলতে চলতে ধানক্ষেতের পাশে এসে পড়লাম। সেই ক্ষেত দেখে মনে পড়ে গেল কবির লেখা কয়েকটি লাইন :
আজি কী তােমার মধুর মুর
হেরিনু শারদ প্রভাতে,
হে মাত: বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ
ঝলিছে অমল শােভাতে।
আটগ্রাম এলাম। ছেলে-বুড়াে সকলেই ‘জয় বাঙলা’ বলে অভিনন্দন জানাল। বাংকার ও ট্রেঞ্চগুলাে খুব মজবুত করে তৈরি ছিল। কোথাও কোথাও ১৫ ইঞ্চি ঢালাই সিমেন্টের তৈরি বাংকার। বিরাট ড্রেন ছিল। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলাে সিমেন্ট ভারত থেকে পাচার করা হয়েছে বলে রেজাকারের নিকট থেকে জানা গেল। ভারত সীমান্তে নাশকতা মূলক কাজ বন্ধ হয়ে গেছে সেদিন থেকে, যেদিন মুক্তিফৌজ জকিগঞ্জ অঞ্চল দখল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী শ্রীমতী জাহানারা বেগম ও শ্রীমতী আনােয়ারা খাতুনকে

সূত্র: সপ্তাহ, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১