বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে কতক্ষণ
সম্প্রতি বাংলাদেশের সদ্যমুক্ত কালীগঞ্জ অঞ্চল ঘুরে এসে জনৈক সাংবাদিক একটি প্রভাবশালী বিদেশী পত্রিকায় তার রিপাের্ট প্রকাশ করেন। নিরপেক্ষ সাংবাদিক আমাদের বীর মুক্তি সেনাদের প্রাক্ত নেতৃবৃন্দের এবং জনগণের দৃঢ় মনােবলের ভূয়সী প্রশংসা করেন। মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থার দ্রুত অগ্রগতি এবং বিভিন্ন ত্বরিত-প্রকল্পের বাস্তবায়নে সরকারী কর্মচারীদের আগ্রহ ও নৈপুণ্য এবং জনগণের সর্বাত্মক সহযােগিতার কথা উল্লেখ করা হয়। ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থরাি মুক্তাঞ্চলে দলে দলে ফিরে যাচ্ছেন বলে রিপাের্টে দাবী করা হয়। তিনি লিখেছেন যে শহরকে রক্ষা। করার জন্য পাক ফেীজ ১৬০টি বড় বড় বিবরঘাটি তৈরী করেছিল, যে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য পাক কর্তৃপক্ষ খান সেনা এবং আনসার মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশ’ লােক জড় করেছিল, সেই শহর। কালীগঞ্জ এখন মুক্ত।’
রণবিধ্বস্ত কালীগঞ্জে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুহেনা মােহাম্মদ কামরুজ্জামান, জন নেতা শ্রী ফণী মজুমদার, ছাত্রনেতা জনাব তােফায়েল আহমেদ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যে অর্থ সেক্রেটারী জনাব কে, এ জামান ও আই জি পুলিশ জনাব এম, এ খালেক শত সহস্র স্বাধীন বাঙ্গালীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে যখন ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছিলেন, সেই আনন্দঘন আবেগময় মুহূর্তে নিরপেক্ষ সাংবাদিক ও শ্লোগান দিয়েছিলেন ‘জয়বাংলা’। তিনি বলেন, ‘ইছামতীর তীরে মুক্ত বাংলাদেশের শত শত স্বাধীন বাঙ্গালীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘জয়বাংলা’ বলে এলাম।’ কিছুদিন পূর্বেও দক্ষিণ বাংলাদেশের এই বিশিষ্ট বাণিজ্যকেন্দ্রে জয়বাংলা’ শব্দটি উচ্চারণ করলে মৃত্যুদন্ড অবধারিত ছিল। কালীগঞ্জ ছিল পাক সেনাদের অধিকারে। প্রায় পঁচিশ হাজার অধিবাসী। অধ্যুষিত শহর একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। সাত মাস পরে সেই জনশূন্য কালীগঞ্জে আবার জীবনের জোয়ার অনুভূত হচ্ছে। তিনি লিখেছেন যারা দূর দূরান্তে গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যারা বেশ কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে এবং ইছামতী ও কালিন্দী নদী পেরিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন তারা এখন দ্রুত ছেড়ে আসা শহরে ফিরে যাচ্ছেন। ফিরে আসছেন মুসলমানরা, ফিরে আসছেন হিন্দুরাও।
কিন্তু যে কালীগঞ্জ তারা ছেড়ে গিয়েছিলেন এ সেই কালীগঞ্জ নয়। তিনি বলেন এ এক অন্য কালীগঞ্জ। একটি বর্ধিষ্ণু থানা শহরের ধ্বংসাবশেষ মাত্র। গােটা শহরের খুব কম বাড়ী গােটা রয়েছে। পাক সেনারা ও রাজাকারেরা সব দরজা জানালা খুলে নিয়ে গেছে। বাড়ীর ভিতরে যা পেয়েছে তা তাে লুঠ করে নিয়েছেই। দখল করার সময় পাক সেনারা যাদের হাতের কাছে পেয়েছিল তাদেরই খুন করে গিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ঈদের সকালে কালীগঞ্জ মুক্ত হয়। সাত মাস ছিল পাক সেনাবাহিনীর দখলে। গােটা শহরের সর্বত্র তারা শক্ত বিবরর্ঘাটি তৈরী করেছিল। প্রত্যেকটি ঘাঁটিতে, প্রত্যেকটি সেনা শিবিরে, প্রত্যেকটি মােড়ে। এমনকি মসজিদেও তারা বিবরঘাঁটি তৈরী করেছিল। নাজিমগঞ্জের দিকে মসজিদের উপরও তারা শক্ত ঘাঁটি তৈরী করেছিল, প্রস্রাবাগার সহ।
কিন্তু ১৯শে নভেম্বর যখন আমাদের বীর মুক্তি সেনারা উখসার দিক থেকে আক্রমণ শুরু করেন, তখন কাপুরুষ পাক সেনাদের বীরত্বের পরিচয় পাওয়া গেল। উক্ত সাংবাদিক লিখেছেন, ‘নাজিমগঞ্জের দিকটা ছেড়ে তারা সরে এল সেই দিনই । চলে এল ইছামতীর পূর্ব পারে। সেখানের বাঙ্কারগুলিতে আশ্রয় নিয়ে শুরু করল প্রচন্ড গােলা বর্ষণ। সারারাত লড়াই চলল। শনিবার বেলা বারােটা নাগাদ পাক। সেনাবাহিনী এবং তাদের সহকারী রাজাকারও শান্তি কমিটির সদস্যরা কালীগঞ্জ ছেড়ে পালাল। সে কী। পলায়ন। ট্রাকে এবং বাসে বােঝাই হয়ে বীর সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ। এত দ্রুত পালাতে হল যে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পের অধ্যক্ষ এবং বালুচ অফিসারকে ছেড়েই পালাতে হল। বেচারা এখন মুক্তি বাহিনীর বন্দী।’ সাংবাদিক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন অবরুদ্ধ কালীগঞ্জের। তাঁর ভাষায় রেকর্ড? বহু লােক নিহত। বহু নারী ধর্ষিতা। বহু শূন্য গৃহ লুষ্ঠিত। আমরা যখন কালীগঞ্জ পৌছলাম অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এলেন। পাক সেনাদের সেই অত্যাচারের বর্ণনা দিতে। মুক্ত হয়ে যাবার কালীগঞ্জে কী পরিমাণ লােক ফিরে এসেছেন জানতে চাইলে তাকে কালীগঞ্জের। অন্যতম ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জনাব মােহাম্মদ ইসমাইল গাজী বলেন যারা গ্রামে পালিয়ে গিয়েছেন তাদের শতকরা পঞ্চাশজন, যারা ইন্ডিয়ায় চলে গিয়েছিলেন তাঁদের সিকি ভাগ ফিরে এসেছেন।
তিনি লিখেছেন ‘শুধু কি মুসলমানরাই ফিরেছেন? পাশ থেকে এগিয়ে এলেন বিষ্ণুকুমার দাস। না আমরাও ফিরেছি। জয়বাংলা হিন্দু মুসলমানের সব্বাইয়েরই জয়বাংলা। এখানে কারােরই ভয় নেই। আমরা সবাই বাঙ্গালী। তিনি বলেন, এই বিধ্বস্ত মুক্ত অঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তনের ব্যবস্থা করতেই এসেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান। সঙ্গে এসেছিলেন অন্যান্য নেতৃবর্গ এবং উচ্চপদস্থ অফিসাররা। একটা। জনসভা হল কামরুজ্জামান সাহেবের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে। লােক এসেছে পিল পিল করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিলেন ‘সব রকম ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। ‘পাশে বসে কথা বলছিলাম বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব জনাব জামানের সঙ্গে। বললেন, এখন বিরাট দায়িত্ব আমাদের। ত্রানের ব্যবস্থা চাই, বাজারে নিয়মিত ভাল তেল, নুন সরবরাহের বন্দোবস্ত করতে হবে। ব্যবসা বাণিজ্য আবার চালু করতে চাই, চাষবাস অবিলম্বে শুরু করে দিতে হবে। বিরাট দায়িত্ব। ফণীবাবু এবং তােফায়েল কথা বলছিলেন ছাত্র ও যুব নেতাদের সঙ্গে। যাতে তারাই নতুন বাংলা গড়ার কাজে প্রত্যেকটি অঞ্চলে নেতৃত্ব দেন। সত্তর বছরের বৃদ্ধ এবং ত্রিশ বছরের ছাত্রনেতা একসঙ্গে যুব শক্তিকে সংগঠিত করার কাজে লেগেছেন। উক্ত সাংবাদিক আশা প্রকাশ করেছেন এভাবে এই সম্মেলনের কথাই ভাবছিলাম কালিন্দী আর ইছামতীর সঙ্গমস্থলে। লঞ্চ থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ওদের একটা বড় বাংকার। একশ ষাটটার একটা। মনে হচ্ছিল যদি নবীন ও প্রবীন নেতৃত্ব বাংলাদেশের যুবশক্তিকে ঠিক পথে চালাতে পারেন তাহলে একশ ষাট হাজার বাংকার গড়েও পৃথিবীর কোন শক্তি ওদেশকে পরাধীন রাখতে পারবে না।
জয়বাংলা (১) ॥ ১ : ৩২ ॥ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪