কসবার মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম
জাহাঙ্গীর আলম ‘শুকুর আলহামদুলিল্লাহ! হাত মাস পরে একটু শান্তিতে নামাজ পরবার পাল্লাম।’ কথাটা একজন বৃদ্ধ কৃষকের। বাড়ী বিয়ারা, কসবা। মাত্র সেদিনই বাংলার বীর মুক্তিযােদ্ধারা হানাদার পশুদের তাড়িয়ে দিয়ে দখল করে নিয়েছিল কসবা এলাকা। অনেকটা কৌতুহল হতেই দেখতে গেলাম সদ্য-মুক্ত এলাকাটি। বুকে একটা চাপা উত্তেজনা! কসবা-কুটি রােড ধরে হাঁটছিলাম। সর্ব প্রথমই চোখে পড়ল একটা মিছিলের প্রতি। এগিয়ে আসছে সামনের দিকেই। আনন্দ মিছিল। এতে অংশ নিয়েছে গ্রামের ছােট ছােট ছেলে-মেয়েরা। কণ্ঠে তাদের নিরলস শ্লোগান, ‘জয় বঙ্গবন্ধু-জয় বাংলা।’ মিছিলটি চলে গেল পাশ কেটে। আমি তখনাে ওদিকেই তাকিয়ে। মনে পড়ে গেল কয়েক মাস আগের কথা। গত ডিসেম্বর মাসে এ পথেই দেখেছি এমনি কতাে মিছিল। কণ্ঠে ওদের একই শ্লোগান ছিল ‘জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা।
আজকের এই মিছিলে হয়তােবা ওদের অনেকেই নেই! আবার পথ চলতে শুরু করলাম। পথের দু’পাশে মাঠ আমন ধান কাটার প্রায় সময় হয়ে এসেছে। বড় খলাস (এক প্রকার আগাছা) হয়েছে এবার সদ্য ফোটা খলাসের ফুলে সাদা সারাটা মাঠ। এতােদিন শত্রু ভয়ে মাঠে কাজ করতে পারেনি কৃষক। তাই এতাে আগাছা কিন্তু আর কয়দিন পরেই পেকে যাবে খলাস। ফুটে ঝরে পড়বে জমিতে। পরবর্তী বছরে এ জমি চাষ করতে বড় কষ্ট হবে কৃষকের। তাই অনেকদিন পর সুযােগ পেয়ে আর ঘরে বসে নেই তারা। সবাই মাঠে নেমে গেছে। পরিস্কার করছে। ক্ষেতের খলাস। মনে তাদের উৎসাহ। দূরে থেকে ভেসে আসছিল গানের দু’টো কলি—ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গাে, আমার দাইমা দাইমা গাে।’ আর কতদূর এগিয়ে গেলে সামনে পড়লাে বিয়ারার মসজিদ। সেখানে একটা গাছের নীচে বসে আছে। একদল মুক্তিযােদ্ধা। ওরা একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। চারিদিকে ভীড় জমিয়েছে গ্রামের অসংখ্য জনসাধারণ কেউ পানি নিয়ে আসছে, কেউ তামাক, কেউবা আবার পাত্রে করে খাবার নিয়েও এগিয়ে আসছে তাদের জন্য সবার মুখেই হাসি। শুধু কথার উপর কথা। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এর যেন আর শেষ নেই। দুপুর অনেকটা গড়িয়ে পড়েছে। জোহরের নামাজ পড়া শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সবে মাত্র মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছেন একজন বৃদ্ধ। বার্ধক্যের ভারে একেবারে নুয়ে পড়েছেন তিনি। লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এসে থেমে যান। মুখে তার মৃদু হাসি। উপরের দিকে মুখ করে কাকে উদ্দেশ্য করে যেন বলে ওঠেন “শুকুর আলহামদুলিল্লাহ! হাত পাস পরে একটু শান্তিতে নামাজ পরবার পাল্লাম।”
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ৩০ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪