হামার দেশের ঐ ছাওয়াগুল্যা— ভেটগাণ দিয়া গড়িয়া ফাইট দিতেছে
স্বদেশ চক্রবর্তী বাঙলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মুক্ত এলাকা দিয়ে পথ চলতে চলতে গিয়ে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালাম। কানে ভেসে আসল এক অশতিপর বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর। একটু এগুতেই চোখে পড়ল একদল নানান বয়সের লােক আক্ষেপ করছেন বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক ও অগ্রগতি নিয়ে। প্রশ্ন করলাম ওদের মাঝে প্রােঢ় বেশী… ওদের একটু কাছে যেতেই ওরা ওদের আলােচনা বন্ধ করলেন। আর আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যে আমি রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। শুরু হল জেরা। কোথায় নিবাস, কোথায় বাস, কেন যাব ইত্যাদি থেকে শুরু করে চৌদ্ধ পুরুষের নাম দাম পর্যন্ত। আমার তখনকার অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? ‘খবরের কাগজের লােক’-এই বলে সাক্ষী প্রমানপত্রের পর ওদের কাছে জানলাম ওরা। আত্মঘাতী, স্বার্থবাদী (বাঙলাদেশের) লােকদের প্রতি সদা সচেতন সন্দিহান। প্রশ্ন করলাম মুক্তি যুদ্ধের। বিভিন্ন প্রসঙ্গে। সেই অশীতিপর বৃদ্ধ তার আঞ্চলিক ভাষাতে বললেন-“ মাকে হামরা হনু মাশুক্লা নােন ন্যাকা পড়া শিখিও নাই। হামরা উয়ার কি বােঝ তবে হয়, আইত হাবার সাতে সাতে এই যে গুড়ুম-গুড়ুম আর ট্যার ট্যার আওয়াজ শুনির পাওয়া যায় উয়াত হামার বুকখান আরও ফুলি ওঠে আর মনে হয় হামার ছাওয়াল রাইম আর গােপাল খুনীর ব্যাটা কমলের যত হাজার হাজার ছাওয়াল হামার দ্যাশের মুক্তি বাহিনীত নাম ন্যাকেয়া ঐ বেইমান শত্রুদের শ্যাস করিয়া ধুরচে?
আরেক প্রশ্নের উত্তরে ঐ অশীতিপর বৃদ্ধ জনৈক মুক্তিবাহিনীর যুবকের সাথে তার সাম্প্রতিক আলােচনার কথা উল্লেখ করে বললেন-“তােমার দ্যাশের এই ছাওয়ালগুলান ভ্যাটাগান ধরি গড়িয়া। ফাইট দিতাছে আর ঐ খানের পােষা গুন্ডাগুলাক একটার পর একটাক খতম করি চলছে।” বৃদ্ধের একমাত্র নয়নমণি মহিম’ স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি যা বললেন তা তার নিজের বক্তব্যেই উল্লেখ করছি-“মার্চ মাসের শ্যাষ দিকত হামার ছাওয়ালটা আসি কইল যে নিমকহারামরা হামার দ্যাশােক শাসন করিবার নামােত বেকসুর আদম সন্তানগুলেক গুলি করি মারি ফ্যালতােছে। মুই আর সবাই এর সাতে এক হয়া দ্যাশেক রক্ষা করিম। মুই কনু এমতােন হবার কতা নাই। ভােট দিনু। শেখ মুজিবরকে, নােকায় ভােট দিছে। ঐ খান সাহেবও একদিন কইলেন। তামান দুনিয়াত এখন ঠান্ডা আর ভাল করি ভােট ন্যাওয়া হয় নাই। তারপর উয়ায় যেগুলান কাম কোচচে তা হামরা এডিয়ােতে শুনছত। ব্যাটাক (রহিমা) কনু বুঝানু তুই ব্যাটা হাল-গৃহস্থি করেক। না যাস ঐ ঝামেলাত । হঠাৎ এক দিন পরিষ্কার করি কইল আব্বা লাশ আজ তাফান্ত।
দ্যাশক রক্ষা করির লাগবে। দ্যাশ হামাক ডাকাইতেছে ছাওয়া চলি গেল। আমার এক রহিম নােয়ায় হাজারে হাজারেলাগে লাগে রহিম আজ দাশের কাজে নিজেদের যান কোরবান করি পরমান কারিতেছে-বাঙালী আর নাই হােউক বেইমান নাসাব।” (পরিশেষে যখন বিদায় নিয়ে আসছিলাম তখন বৃদ্ধ আমার অনেকটা দূর এগিয়ে দিয়ে গেলেন আর প্রশ্ন রেখে গেলেন অনেকগুলাে। ওরা শিক্ষার আলাে পাননি ঠিকই তবে দেশ মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে ওরাও অংশীদার হতে চায় কারণ তার-আমরা আপনারা সবাই বাঙালী। এ দেশ আমাদের। শাসনভার থেকে শুরু করে সব কিছুই আমাদের। আমাদের দাবীয়ে রাখা যাবে না। বন্দুকের নল, রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস-সন্দেহ নেই। তবে আমাদের এই মুক্তি সম্রামের পেছনে গােটা বাঙালী জাতি একতাবদ্ধ। তাই আমাদের জয় সুনিশ্চিত-এই কথা নিশ্চয়ই অবান্তর নয়। পথ চলতে চলতে শুধু কানে ভেসে আসছিল সেই বৃদ্ধের করুণ আবেদন–বাবায়ে হামাকও একটা। ভ্যাটাগান দাও মুইও সবার সাথে এক হয়া যুদ্ধ করির যাইম, আর তামান করিম বাঙালী আর যাইহােক বেইমান নােয়ায়।”
রণাঙ্গন (২) [ ২ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪