স্বাধীন বাংলার গ্রামে গঞ্জে
(বিশেষ প্রতিনিধি) সবে সন্ধ্যা নেমেছে। গ্রামের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া নদীটার বুকে অস্ত যাওয়া সােনালী সূর্যের আভা। খানিকটা যেন রক্ত রাঙ্গা। মাঝি সেই কখন থেকে নৌকা বেয়ে চলেছে। পথে পথে সগ্রামী বাংলার সিংহশাবকদের কাহিনী শুনিয়েছে আমাকে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তার। আলতাফ মিয়া নৌকার সাথে সাথে জীবনের অভিজ্ঞতায় ভরপুর। আমি আনমনে পিছনের ইতিহাস, মাজি আলতাফ মিয়ার কথা, বাংলার সাড়ে সাতকোটি স্বাধীনতা সংগ্রামী নরনারীর কথাই ভাবছিলাম। হঠাৎ মাঝি ডাক দিল, স্যার আইয়া পড়ছি। ওঠবেন না? ডাঙ্গায় উঠতে যাৰ, অমনি বজ্র নির্ঘোষ আওয়াজ এলাে-হল্ট। কে? কে? হাত উঠিয়ে দাড়ান? পাস ওয়ার্ড বললাে। কিন্তু আমার তা জানা নেই। বললাম-আত্মসমর্পন করলাম। দু’হাত উঠিয়ে তার কাছে গেলাম। উদ্ধত তার বলিষ্ঠ হাতের ষ্টেন গান। পরিচয় দেয়ার সাথে সাথে পথ সরে দাঁড়ালাে। পূর্বাহে জানিয়ে রেখেছিলাম ক্যাম্প কমান্ডারকে আপনার এলাকা পরিদর্শনে আসবাে। মুক্তাঞ্চল আপনার। বিশ্ববাসীকে জানাবাে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বীর সেনাদের কীর্তিগাথা, ইতিহাস, তাদের নতুন। জীবন ব্যবস্থা আর তাদের বেদনা জর্জরিত কাহিনীর কথা।
ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছি সেই সকালে। গাঁয়ের আঁকা বাঁকা পথ ধরে সারাদিন হাটতে হয়েছে আমাকে সম্পূর্ণ মুক্তাঞ্চল গ্রাম বাংলার কাঁচা সােনার মানুষগুলাের প্রাণঢালা অন্তরঙ্গ সম্বর্ধনা। তাদের হাজারাে প্রশ্ন হাজারাে জিজ্ঞাসা তারই মাঝে আমার পথ চলা। বিকেলে নৌকায় ওঠে পথ এগুনাে প্রহরারত মুক্তিযােদ্ধা এখন আমার পথ চলার সাথী কিছু দূরেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প। আমাকে এগিয়ে নিয়ে চললেন তিনি। বললেন, জানেনতাে সেদিন কি একটা মাহিরাইনা দিয়েছি খান দস্যুদের সেই কাহিনীই শােনাতে লাগলেন তিনি টুকরাে টুকরাে কথা বীরত্ব ব্যঞ্জনায় ভরা সাহসিকতা, সৌর্য বীর্যের চরম কীর্তি গাথা। পাঁচদোনা পুল। ঢাকা নরসিংদি পাকা রাস্তার বড় একটা পুল। রাজাকার আর খান সেনারা পাহারা দিচ্ছে। রক্ষা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে পুলটার। তারই সাথে অত্যাচার চালাচ্ছিল নীরিহ গ্রাম বাসীদের ওপর। পাশেই ছিল বনেদী হিন্দু এবং মুসলমান কাপড়-সূতাে ব্যবসায়ীদের কারবার সব ভস্মীভূত করলাে জানােয়ারগুলাে। টাকা পয়সা লুটে করলাে-করলাে গুন্ডাদের দিয়ে।
তিনি বললেন, আমাদের কমান্ডার প্রতিজ্ঞা করলেন এই নর পশুদের জীবনের সাধ মেটাতে হবে। যেই প্রতিজ্ঞা-সেই কাজ। রাতের গভীরতা বাড়তে বাড়তে গভীর নিস্তব্ধতা নেমে আসলাে গ্রামের বুকে-পাঁচদোনার বুকে হামাগুড়ি দিয়ে কাজে গিয়ে পজিশন নিলেন মুক্তি যােদ্ধার ইউনিট। বিকট শব্দে গর্জন করে ওঠলাে বীর বঙ্গ শার্দুলদের হাল্কা মেসিন গান রাইফেল, ষ্টেনগান আর এস, এল আর শুরু হলাে খান সেনা আর রাজাকার হত্যা। একের পর একে রাত গেল পর দিন সকাল। বারাে ঘণ্টা যুদ্ধ। মরিয়া হয়ে উঠেছে বঙ্গ যােদ্ধার দল একেবারে বাঙ্কারের কাছাকাছি। কারাে গ্রেনেড চার্জ। নির্দেশ দিলেন কমান্ডার একের পর এক। চারটা পাঁচটা ছটা চার্জ হলাে।ঠান্ডা হলাে দস্যুরা। হাত উঠিয়ে আত্মসমর্পণ করলাে মারা গেল ১২ জন দস্যু কথা শেষ করলেন তিনি। বললেন, এইতাে এসে গেছি।
ক্যাম্প কমান্ডার এগিয়ে এলেন, হাত মিলালেন। বললেন, একটু পরেই বেরিয়ে যাব। একটা অপারেশন আছে। একটু দূরেই। আপনি বিশ্রাম নিন। সকালে কথা বলবাে। কি আর বিশ্রাম নেব। থানা অর্গানাইজার এগিয়ে এলেন। তার সাথে দুটো লােক। পাশের গায়ের। একটু আগে তাঁদের পুরস্কার দিয়েছেন ক্যাম্প কমান্ডার। তাঁদের বীরত্বের জন্যে। শেীর্যের জন্যে। থানা অর্গানাইজারকে সবাই মামা বলে ডাকেন। এই নামেই তিনি পরিচিত ছােট গড়ন। বুলেটের মত গতি। সারাটা থানা সংগঠন করছেন। মুক্তি যােদ্ধাদের থাকা খাওয়া শুশ্রুশার ভার তার হাতে। থানার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন তারই সাথে । হাজারাে অভিযােগ বিচার করে চলেছেন। সেই মামা লােকদুটোকে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সাথে দুই ভাই তাঁরা। বড় ভাই এগিয়ে এলেন। বললেন, তাঁদের বীরত্বের কাহিনী কালিগঞ্জ থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। দুই খান দস্যু উদ্দেশ্য গ্রাম লুট করবে। মা-বােনদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাবে।
গাঁয়ের পথ। সবে সকাল হয়েছে। পথে ষ্টেনগান নিয়ে দুই দস্যু। এক বাড়ীতে ঢুকলাে লুট করলাে এরই মধ্যে জাগ্রত গ্রামবাসী টের পেলেন দস্যু আসছে কেউ পালালেন না। জাগ্রত বীর তারা হাতের কাজে যা পেলেন নিয়ে তৈরী হলেন। ধাওয়া করলেন তাদের ধরে ফেললেন। একজনকে। সাথে সাথে টুকরাে টুকরাে হলাে দস্যুটা। একটা ভেগে গেল সেই পড়লাে তার হাতে এর আগে সে যথেষ্ট বুলেট খরচ করেছে আড়ালে আড়ালে লুকিয়ে জীবন রক্ষা করলেন গ্রাম বাসীরা। তারা এখন সবই জানেন, বুঝেন সব কৌশল। যুদ্ধের সব কায়দা তিনি বললেন, তখন সকাল দশটা সাড়ে দশটা। আমি বাজার সেরে ফিরেছি। বউ বললেন খান। সেনা গ্রামে ডুকেছে দেখােত কি হলাে গােছলটা সেরে নেই তারপর যাব। বললেন তিনি এই বলে গামছা কাপড় হাতে নিয়ে পুকুরের দিকে রওয়ানা হলেন। বটি নিয়ে বউ বাজার থেকে আনা মাংসটা কুটতে বসেছেন। তিনি জানালেন, আমি বুক পানি পর্যন্ত নামলাম এমন সময় দেখি সেই পালানাে দস্যুটা আসছে আমার বাড়ীর দিকে। দূরে গ্রাম বাসীরা তাড়া করছে তার সব বুলেট শেষ কোমরে গামছাটা বেঁধে উঠে পড়লাম একটা কিছু করতেই হবে আগে মিলিটারীতে ছিলাম জানি কি করতে হবে।
বাংলার মুখ ॥ ১:১০ ॥ ২৬ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪