You dont have javascript enabled! Please enable it! পশতুন সীমান্তেও আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক

পশতুন সীমান্তেও আক্রমণ!

আজ ১৫ ডিসেম্বর। জেনারেল মানেকশ নিয়াজিকে দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংয়ের মাধ্যমে নিয়াজির কাছে পৌছে দিলেন ‘আত্মসমর্পণের ৬ শর্ত। এটা মানা হলে ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় সকাল ৯টায় সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে কোনাে বিকল্প থাকবে না। এই বার্তায় দুপক্ষের মধ্যে সরাসরি সংলাপের জন্য আজই রেডিও লিংক চালু করার কথা বলা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে যখন আত্মসমর্পণের এ প্রক্রিয়া চলছে, ওয়াশিংটনে তখন নিক্সন ও কিসিঞ্জার উদ্বেগের সঙ্গে সর্বশেষ পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। ওভাল অফিসে নিক্সন কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখা করেন। সােভিয়েতরা নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর হামলা হবে না। নিক্সন প্রশ্ন রাখেন, যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েতের এই প্রকাশ্য সমঝােতায় চীনের প্রতিক্রিয়া কি? জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, যদি পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায়, তাহলে চীনারা তাে আহাদে আটখানা হবে। কিসিঞ্জার নিক্সনকে এটাও জানান যে, আমি ভরােনৎসভকে বলেছি, দেখ আমার সঙ্গে আইনি প্যাচ খেলবে না। নির্দিষ্ট করে বলতে হবে, কোনাে বিরােধপূর্ণ ভূখণ্ড অর্থাৎ আজাদ কাশ্মীর গ্রাস করা যাবে না। আগের সীমান্ত রেখাই অপরিবর্তিত রাখতে হবে। ভরােনৎসভ নিশ্চয়তা দিয়েছেন। হ্যা, তারই রক্ষাকবচ দিচ্ছি।

দুই নেতার সংলাপ বৃত্তান্তে এটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে যে, এদিন তারা পূর্ব পাকিস্তান হারানাে নিয়ে কোনাে বেদনা নয়; বরং আজাদ কাশ্মীরসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারায় নিজেদের ধন্য মনে করেছেন। কিসিঞ্জার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট, এটা একটা নিরঙ্কুশ অলৌকিক ঘটনা। আমি এ পর্যন্ত যত গােয়েন্দা রিপাের্ট পড়েছি, তাতে সন্দেহাতীতভাবে এই উপসংহারই টানা হয় যে, ভারতের কৌশল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করা। কিসিঞ্জার আজ নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকে গােপন সূত্রের বরাতে উল্লেখ করেন, কাশ্মীরে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। অন্যদিকে ঢাকার কয়েক মাইলের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যরা পৌঁছে গেছে। লক্ষণীয়, এদিন এক গােপন সূত্রের (ডিক্লাসিফাই করা হয়নি) বরাতে কিসিঞ্জার জানাচ্ছেন, চীন পশ্চিম পাকিস্তানকে সম্ভবত কিছু মিগ-১৯ দিচ্ছে। জাতিসংঘে পাকিস্ত নি প্রতিনিধি বলেছেন, ‘১৫ ডিসেম্বর চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক পদক্ষেপ নেবে।’ কিন্তু আমাদের সূত্র বলেছে, এর কোনাে লক্ষণ নেই। কিসিঞ্জারের ভাষ্যে দেখা যাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা কোনাে মুসলিম দেশ থেকেই পাকিস্তান সামরিক সাহায্য পায়নি।

নভেম্বরের শেষাশেষি থেকে বহু রিপাের্ট মিলেছে যে, এসব দেশ পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে তুরস্ক, জর্ডান, সৌদি আরব, লিবিয়া ও মিসর। কিন্তু কোনাে রিপাের্ট থেকেই এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, খুচরা যন্ত্রাংশ বলুন। কিংবা যুদ্ধ বিমান-কেউ কিছু আদৌ দিয়েছে। আমাদের সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করছে এবং তা ১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় বঙ্গোসাগরের কাছাকাছি পৌছবে। গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে, পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিটিং জানিয়েছেন, এসব খবরে ভারতে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে মার্কিন স্থাপনা ও নাগরিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। কিসিঞ্জারের বর্ণনা অনুযায়ী ব্রিটেনও ওই এলাকায় কিছু রণতরী মােতায়েনে উদ্যোগী হয়েছে। তাদের একটি কমান্ডাে ক্যারিয়ার ও একটি ফ্রিগেট শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ উপকূলে রয়েছে। সােভিয়েত টাস্ক ফোর্স (একটি গাইডেড মিসাইল ক্রুজার, একটি অয়েল ট্যাঙ্কার ও একটি ডিজেলচালিত সাবমেরিন সমম্বয়ে গঠিত।) দক্ষিণ চীন সমুদ্র থেকে ক্রমেই ভারত মহাসাগরের দিকে ধেয়ে আসছে। তাদের বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে ওই এলাকায় তারা তিন দিনের মধ্যে পৌছবে। অবশ্য ভারত মহাসাগরে আগে থেকেই ১২টি সােভিয়েত জাহাজ রয়েছে। তবে তাদের কোনােটিই পাক-ভারত সংঘাতে নিজেদের জড়াতে কোনাে ইঙ্গিত দিচ্ছে না।

কিসিঞ্জার আজ ওয়াশিংটনে বেলা সাড়ে ১১টায় কোসিগিনকে লেখা যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত একটি খসড়া চিঠি ভরােনৎসভকে হস্তান্তর করেন। কিসিঞ্জার এ সময় যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘে ব্রিটিশ প্রস্তাব সমর্থনে আগ্রহ ব্যক্ত করলে ভরােনৎসভ বলেন, না, আমরা কিন্তু পােলিশ প্রস্তাবের পক্ষে। অন্যান্য দলিল থেকে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান জাতিসংঘে প্রস্তাবের সম্ভাব্য বাক্য গঠন নিয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীলতা দেখায়। তাদের ভীতি ছিল একটাই—এ ধরনের প্রস্তাব থেকে কোনােভাবে যেন আজাদ কাশ্মীরসহ পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিষয়ে কোনাে গলদ সৃষ্টি না হয়। ভরােনৎসভ তাই এদিন মরিয়া হয়ে বলেন, তারা কাশ্মীরসহ পশ্চিম পাকিস্তানের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তারা এটা বলছেন না এই বিবেচনায় যে, ভারত ব্ৰিত হবে। ভরােনৎসভের কথায় ভারত তাে আমাদের তাবেদার রাষ্ট্র নয়।’ নিক্সন কোসিগিনকে লেখা চিঠির শুরুতেই বলেন, পূর্ব পাকিস্তান এক পরিণতি পাচ্ছে। এখন আমাদের পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ থামাতে হবে। কেউ যাতে কারাে ভূখণ্ড দখল করতে না পারে, পরাশক্তি হিসেবে তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

ফারল্যান্ড এক ব্যাক চ্যানেল বার্তায় কিসিঞ্জারকে জানান, পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খান আজ আমাকে ডেকে বললেন, পাকিস্তানি গােয়েন্দারা খবর দিয়েছেন যে, ভারতীয়রা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রবল লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আফগান সীমান্ত (সম্ভবত পশতুন সীমান্ত এলাকা) থেকে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাতে উসকানি দিচ্ছে। এখন পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি জাতি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হলে অবিলম্বে অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান দিতে হবে। বর্তমানে আমাদের যে মিগ-১৯ ও এফ১০৪ রয়েছে, তা দিয়ে সম্ভাব্য ভারতীয় হামলা প্রতিরােধ করা যাবে না। নিক্সনকে লেখা ইন্দিরা গান্ধীর একটি চিঠি রাষ্ট্রদূত ঝা আজ স্টেট ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে দেন। আবেগ দিয়ে লেখা এ চিঠিতে ইন্দিরা প্রশ্ন রাখেন, মি, প্রেসিডেন্ট, আমি আমার সর্বতাে বিশ্বস্ততা দিয়ে এই প্রশ্ন রাখছি যে, একমাত্র ব্যক্তি শেখ মুজিবের মুক্তি অথবা তার সঙ্গে গােপন সমঝােতা নিশ্চিত করা কি একটি যুদ্ধ পরিচালনার চেয়ে অধিকতর বিপর্যয়কর বলে গণ্য হতাে? “২৪ বছর ধরে ভারতের বিরুদ্ধে পরিচালিত পাকিস্তানের সর্বাত্মক ‘হেট ক্যাম্পেন’ থেকে পাকিস্তানকে নিবৃত্ত হতে হবে। আমার পিতা এবং আমি ২৪ বছর ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে অ-আগ্রাসন চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই তারা নাকচ করে দিয়েছে।” | আজ বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের মধ্যে শেষ দফা (প্রাপ্ত দলিল অনুযায়ী) টেলিসংলাপ চলে। এবং বিস্ময়কর হলাে, এত কিছুর পরও তাদের মন থেকে এই দ্বন্দ্ব ঘােচেনি যে, রুশ-ভারত অক্ষ শক্তি পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখবে। কিসিঞ্জার বলেন, ভারতকে বিশ্বাস করা যায় না।

তারা এখন চাইছে। বাংলাদেশের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা জাতিসংঘকে দিয়ে অনুমােদন করতে। এর অর্থ হচ্ছে, আগ্রাসনে জাতিসংঘকে পার্টি করা। সােভিয়েতরা একটু আগে বলেছে, তারা ব্রিটিশ প্রস্তাবে ভেটো দেবে। লক্ষণীয়, ব্রিটেন বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকলেও শেষ পর্যায়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের মন রক্ষার একটা চেষ্টা চালায়। পাকিস্তানের জাতিসংঘ স্থায়ী প্রতিনিধি ইকবাল আখুন্দ লিখেছেন, ১৫ ডিসেম্বর পােলিশ প্রস্তাব যখন টেবিলে এল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। নিরাপত্তা পরিষদের লাউঞ্জে মার্কিন প্রতিনিধি দলের চার্লি নাস আমাকে বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষাই এখন সমস্যা। পাক পররাষ্ট্রসচিব সুলতান খান লিখেছেন, ১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে দুবার ফারল্যান্ড আমার সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রথমবার তিনি নিয়াজি ও ফরমান আলীর। স্বাক্ষরিত চিঠির সত্যতা যাচাই এবং পরে নিয়াজিকে লেখা ভারতীয় সেনাপ্রধানের বার্তা নিয়ে হাজির হন। এ বার্তায় তিনি বাংলাদেশে আমার কাছে। আত্মসমর্পণকারীদের নিরাপত্তাদানে অঙ্গীকার করেন। সুলতানের মতে, নিয়াজি আসলে একটি যুদ্ধবিরতি ও তার সৈন্যদের ‘রিগ্রুপিং’ এর প্রস্তাব দেন। কিন্তু ভারতীয় সেনাপ্রধান একে নিরঙ্কুশ আত্মসমর্পণে পরিণত করেন। এর মধ্য দিয়ে ভারত শুধু সামরিক বিজয় অর্জন করেনি, ব্রিটিশদের ভারতে পৌছার আগে যে মুসলমানরা শত শত বছর ধরে উপমহাদেশ শাসন করেছে, সেই মুসলমানদের বিরুদ্ধেও ভারত নিশ্চিত করতে পারল এক মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। তার কথায়, “পাকিস্তানের জন্য এই বৃহত্তম ট্রাজেডি নিশ্চিত হয় পূর্ব পাকিস্তানকে ২৪ বছর ধরে বঞ্চনা ও দুঃশাসনের ধারাবাহিকতায়। মনে রাখতে হবে, ভারতের তৎপরতা ছিল এক নগ্ন আগ্রাসন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাজি না থাকলে এটা করার সাহস তারা পেত না। ভারত ১৫ ডিসেম্বর রাত ৮টায় পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধবিরতির ঘােষণা দেয়।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন