ইতিহাসের ধূসর পর্বে আলাে
সম্প্রতি প্রকাশিত আমেরিকার গােপন দলিল ইতিহাসের কিছু ধূসর অধ্যায়ে নতুন করে আলাে ফেলেছে। গত ৬১ পর্বে যেসব বিষয় আমাদের কাছে কৌতূহলােদ্দীপক মনে হয়েছে, তা হলাে যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকা। একটা দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সাধারণভাবে ঘােরতর শত্রু হিসেবেই চিত্রিত হয়েছে। তবে এটা বলা হয়েছে, নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের বিরােধিতা করলেও সে দেশের জনগণ ও সংবাদ মাধ্যম সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু এবারে বেশ কিছু দলিল ও নথিপত্রের মূল কপি অবলােকনের সুযােগ অন্তদৃষ্টি দিয়ে ‘৭১ এর অফিসিয়াল ওয়াশিংটনের অন্দরমহলের দৃশ্যপট উপলব্ধি করা অন্তত কিছুটা হলেও আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ইতিহাস সম্ভবত এমনই, নাড়া দিলেই নতুন হয়ে ওঠে। দ্যুতি ছড়ায় নতুন করে। এসব মূল দলিল থেকে বাংলাদেশ ও বাঙালির অনেক কিছুই গ্রহণের সুযােগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় সত্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এ দেশের মাটি ও মানুষের আবেগ এবং অনুভূতির মধ্য দিয়ে নিবিড়ভাবে বিকশিত হয়েছে। এর শুরুটা কবে কোথায় কিভাবে হয়েছিল তা হলফ করে কারাে পক্ষে বলা কঠিন। বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় কোনাে অর্থেই দুর্ঘটনা কিংবা কোনাে নাটকীয় সিদ্ধান্তের পর্ব ছিল ।
কারাে মনে এমন ধারণা হয়তাে এখনাে প্রবল যে, ভারত তার জাতীয় স্বার্থে খণ্ডিত পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছে। কারাে মতে ১৯৪৭ থেকে, কেউ বলেন, ষাটের দশকে ভারতীয়রা নানা কূটকৌশলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে শানিত করতে নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এমন বিশ্বাস পােক্ত হতে পারে, তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, অবমুক্তকৃত যুক্তরাষ্ট্রের আলােচ্য গােপন দলিলে । বরং ১৯৬৯ থেকে একাত্তরের মার্চের আগ পর্যন্ত সিআইএ কিংবা স্টেট ডিপার্টমেন্টের মূল্যায়ন বা সমীক্ষাধর্মী রিপাের্টে অভিন্ন বক্তব্য এসেছে যে, অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব দিল্লি ও ওয়াশিংটনের স্বার্থের পরিপূরক। আবার এ কথাও ঠিক যে, ভারত একাত্তরে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলােচনা করতে গিয়ে তারা কোনাে পর্যায়ে এমন ধারণা স্পষ্ট করেনি যে, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা ভারতীয় স্বার্থের জন্য জরুরি। ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতা কেন চেয়েছে, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিভিন্নভাবে এসেছে। তবে তা কখনাে সিআইএ রিপাের্টে, কখনাে কিসিঞ্জারের জবানিতে। আমেরিকার গােপন দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও মূল্যায়ন, আমাকে যেসব কারণে আন্দোলিত করেছে তা সংক্ষেপে এ রকম।
১. যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, সােভিয়েত ইউনিয়ন- প্রত্যেকে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ। সুরক্ষা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। বাংলাদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান তৈরিতে উল্লেখযােগ্য কোনাে নীতিগত বা আদর্শিক কারণ অনুপস্থিত ছিল।
২. ওয়াটার গেট-খ্যাত সিআইএ’র তৎকালীন পরিচালক রিচার্ড হেলমস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সময় ২৬ মার্চ মধ্যরাতের একটু পরে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তথ্য প্রকাশ করেন যে, গােপন বেতারে প্রচারিত হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন।
৩, নিক্সন প্রশাসন বলতে যা বুঝায় তা ছিল দারুণভাবে বিভক্ত। বিশেষ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একটি বড় অংশ পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনে নারাজ ছিল। পাক সেনাদের বর্বরতার নিন্দা জানাতে নিক্সন-কিসিঞ্জার ব্যর্থ হলেও ঢাকার মার্কিন মিশন রীতিমতাে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরােধী শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে চিহ্নিত করা দুরূহ। বরং নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটিকে দায়ী করাই সঙ্গত। তবে চমকপ্রদ এই তথ্য মনে রাখতে হবে যে, নিক্সন ও কিসিঞ্জার কিন্তু কখনাে কখনাে দোদুল্যমান ছিলেন। মুজিব যথাসম্ভব সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থাকবেন, একান্ত না পারলে স্বাধীনতার দিকে যাবেন, আর সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না, এমন একটা বোেঝাপড়ায় মুজিব, নিক্সন ও কিসিঞ্জারের আগাম আপােসের তথ্য লক্ষণীয়।
৪. মুজিব যদি তথাকথিত প্রাে-আমেরিকান হিসেবে গণ্য না হতেন বা অন্য কথায়, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শক্তি যদি চীনকেন্দ্রিক হতাে, তাহলে সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধিতা সম্ভবত ছিল অনিবার্য। | ৫. বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধশালী ও স্থিতিশীল দেশে পরিণত হবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী মার্কিন মহল থেকে একেবারেই উচ্চারিত হয়নি। নিক্সন, কিসিঞ্জার, তকালীন অর্থমন্ত্রী কোনালি, পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড- এই চরিত্রগুলাের কাছ থেকে নেতিবাচক মন্তব্যই এসেছে।
৬. স্নায়ুযুদ্ধের পটভূমি এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ইয়াহিয়ার ভূমিকার প্রতি কৃতজ্ঞতাজনিত কারণও নিক্সন-কিসিঞ্জার অনেকটা ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছেন। তারা দুজনেই গােড়া থেকে জানতেন, দক্ষিণ এশিয়া সংকটের পরিণতি যা-ই ঘটুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়ানাে সম্ভব হবে না। কিন্তু তারা কেউ এই দুর্বলতা প্রকাশ করেননি। সত্যিকার অর্থেই, সাজানাে যুদ্ধের মহড়া দিয়েছেন।
৭, বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানাের প্রধান লক্ষ্য ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানকে বাচানাে । নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সন্দেহ ছিল, ভারত সুযােগ পেলে অন্তত পাকঅধিকৃত কাশ্মীর দখল করে নেবে। গােয়েন্দা সূত্রে ভারতের কোনাে এক নেতৃস্থানীয়
ব্যক্তির মন্তব্য ছিল, সুযােগ পেলে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে বিরােধিতার ইস্যুটি চিরকালের জন্য ফয়সালা করে নেবেন। সে কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ার পরে নিক্সন, কিসিঞ্জার কিংবা ভুট্টো ঘরােয়াভাবে হতাশাব্যঞ্জক মন্তব্য করেননি। তারা বরং পরস্পরকে মােবারকবাদ জানিয়েছেন। ভারতের যুদ্ধবিরতি ঘােষণার আগ পর্যন্ত নিক্সন ও কিসিঞ্জারের রুদ্ধশ্বাস সংলাপগুলাে এই সাক্ষ্য বহন করে যে, ঢাকার পতন নিয়ে নয়, পশ্চিম পাকিস্তান বাঁচানাে ছিল তাদের পরম আকাক্ষা।
৮. বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুল আলােচিত মৈত্রী চুক্তির মডেল তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসেই । আগস্ট মাসে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সইয়ের পর ভারত চেয়েছে বাংলাদেশও এমন একটি চুক্তি সই করুক। সম্ভবত সে কারণেই স্বাধীনতার স্বীকৃতি শর্তে সােভিয়েতকে বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির পরামর্শ দেয় ভারত।
৯, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান সুরক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করেছে- কমবেশি এমন ধারণার বিপরীতে বরং এই সত্য উদ্ভাসিত যে, তারা কার্যত কেউ যথাসময়ে পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহের ঝুকি নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও কিন্তু কংগ্রেসের কারণে কার্যকর অর্থে সরবরাহ দিতে পারেনি।
১০. পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রশ্নে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, নিক্সনকিসিঞ্জারসহ তাদের প্রশাসনের সব মহল থেকে এই ইস্যুতে অভিন্ন উদ্বেগ ছিল । বিশ্ব জনমতের চাপ থাকার পাশাপাশি তার অন্যতম কারণ, নিক্সন ও ইয়াহিয়া শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এমন আশায় হাল ছাড়েননি যে, একটা রাজনৈতিক আপােস হবে। আর সেক্ষেত্রে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মুজিবই তুরুপের তাস।
১১. বাংলাদেশ যাতে কোনােভাবেই বামপন্থিদের প্রভাব বাড়তে না পারে, সে। লক্ষে দিল্লি-ওয়াশিংটনের সংবেদনশীলতা লক্ষণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রলম্বিত যাতে না হয়, সে ব্যাপারে ভারতের গরজ ও তাড়না ছিল সবচেয়ে বেশি। এমনটা বলা সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের কোনাে এক পর্যায়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব কার্যকরভাবে আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে গেলে, ভারতের অবস্থান নাটকীয়ভাবে বদলে যাওয়া সম্ভব ছিল । দিল্লি অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে সম্ভাব্য এ ধরনের পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে হাত মেলানাের পথ যেন খােলা রেখেছিল।
১২. খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও মাহবুব আলম চাষীর কলকাতার মার্কিন মিশনের সঙ্গে গােপন যােগাযােগ এবং তারা শুধুই কনফেডারেশন চেয়েছিলেন মর্মে যে ধারণা সাধারণভাবে প্রচলিত রয়েছে, তা প্রকাশিত দলিল কিন্তু সন্দেহাতীত করেনি। এছাড়া এই যােগাযােগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ছিল বলেও মনে হয় না। এমনকি ইয়াহিয়াও এই প্রক্রিয়ার সাফল্য নিয়ে খুব বেশি উদগ্রীব ছিলেন বলেও প্রমাণ মিলছে না। বরং বলা চলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মােশতাকই ছিলেন এর উদ্যোক্তা। তিনি
তার এই গােপন মিশন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভায় অনুমােদন করে নেননি। তবে তিনি স্বশরীরে নন, কাজী আবদুল কাইউমকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত রাখেন। আবার এও সত্য যে, এই সংলাপের প্রতিটি পর্বের অভিন্ন অবস্থান হচ্ছে, রাজনৈতিক আপােস হতে পারে তবে মুজিবকে বাদ দিয়ে নয়।
১৩. হিন্দুদের ওপর বাড়তি বর্বরতার অন্যতম কারণ শুধু যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একটা সাধারণ ভারতবিরােধী মনােভাবের ধারাবাহিকতা তাই নয়। সম্ভবত এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল এই কারণ যে, পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েনকৃত সৈন্যদের। উল্লেখযোেগ্য অংশ ছিল পাঞ্জাবি। আর পাঞ্জাবিরা ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুবিদ্বেষী।’
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন