You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.01 | ডিসেম্বরেও নিজ নিরাপত্তায় হুমকি দেখেনি চীন - সংগ্রামের নোটবুক

ডিসেম্বরেও নিজ নিরাপত্তায় হুমকি দেখেনি চীন

১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল গ্রুপের বৈঠকে কিসিঞ্জার প্রশ্ন রাখেন আমি কি এটা ধরে নেব যে, পাকিস্তান উদ্যোগী না হলে আমরা জাতিসংঘে যাব না? ডিপালমা পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আমাদের বলেছেন, এই সময় যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া তিনি আর কাউকে অনুরােধ করবেন না। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের জন্যও তার কোনাে আগ্রহ নেই। কিন্তু তিনি মনে করেন, তার সরকার হয়তাে এটা চাইবে । ভুট্টোর জন্য তাকে একটি ভাষণের খসড়া লিখতে বলা হয়েছে। তার অনুমান তারা শুক্রবার ৩ ডিসেম্বর বা সােমবারে বৈঠকের জন্য আহ্বান জানাবে। যে কোনাে প্রস্তাবে সৈন্য। প্রত্যাহারের, যুদ্ধবিরতির এবং সম্ভবত উভয়পক্ষে পর্যবেক্ষক নিয়ােগের কথা উল্লেখ । থাকবে। পাকিস্তানিরা চীনাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা ইঙ্গিত দিয়েছে, পাকিস্তানের কাছে অগ্রহণযােগ্য যে কোনাে প্রস্তাবে তারা ভেটো দেবে। তার ধারণা। ভারতের কাছে অগ্রহণযােগ্য কোনাে প্রস্তাবে সােভিয়েতের কাছ থেকে ভেটো আসবে।

কিসিঞ্জার জাতিসংঘে এরকমের উদ্যোগে কেউ ভরসা পাবে বলে মনে হয় না। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদই যেখানে একটি অনিবার্য সামরিক পরিস্থিতিতে বৈঠকে বসতে ভীত।

ডিপালমা এটা বিগ বয়দের দ্বারা সম্পাদন করতে হবে।

কিসিঞ্জার অর্থনৈতিক সহায়তার কথাই বলা যাক। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক। সহায়তা বন্ধের কোনাে পরিকল্পনা নেই । প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা পিএল-৪৮০ এর অর্থ এবং পরবর্তী ঋণদান থেকে বিরত থাকব। আমরা এটা। প্রশাসনিকভাবে বিলম্বিত করতে পারি এবং এ ধরনের বিলম্বের জন্য আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতাকে দায়ী করতে পারি। অন্য কথায় তিনি আরাে অগ্রসর হতে চাইলে আমাদের পক্ষে আর কি করা সম্ভব?

ম্যাকডােনাল্ড তিনটি ক্যাটাগরি রয়েছে। দেড়শ’ থেকে দু’শ’ মিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন ঋণ এবং ৭২ মিলিয়ন ডলার রয়েছে পিএল-৪৮০ খাতে। কিসিঞ্জার আমার এটা ভাবার কারণ নেই যে, প্রেসিডেন্ট তাড়াতাড়ি করতে চাইছেন। তিনি ৯৯ মিলিয়ন ডলারের বিষয়টি সামনে আনতে পারেন। যা হােক। ভারতীয়রা ঢাকায় পৌছালে আমরা যদি কঠোর পদক্ষেপ নিই তাহলে এটা হবে এক

ইচ্ছার প্রতিযােগিতা। আমরা যদি তাদের সংকেত দিতে চাই তাহলে আমাদের তা দিতে হবে এক্ষুণি। কিন্তু আমরা কোনাে বড় সময়ের চাপে নেই। পিএল-৪৮০ ব্যাপারে কতদূর? ম্যাকডােনাল্ড আমাদের বাধ্যবাধকতাপূর্ণ চুক্তি রয়েছে। কিন্তু আমরা এ নিয়ে বসেও থাকতে পারি। আমাদের একটি বিশেষ সমস্যা রয়েছে। আমাদের ১৮ মিলিয়ন ডলারের ভেজিটেবল অয়েল রয়েছে। মার্কিন বাজার স্থিতিশীল করতে কৃষি বিভাগ এই তেল ভারতে পাঠাতে চাইছে। এটা অভ্যন্তরীণ বিষয়। যদিও আমাদের ভারতের জন্য ১২ মিলিয়ন ডলারের ৫০ হাজার বেল তুলা রয়েছে।

কিসিঞ্জার আমরা তাে মিসেস গান্ধীর কাছ থেকে এখনাে জবাব পাইনি?

সিসকো না। কোসিমিনের কাছ থেকেও কিছু নয়। আমরা বিষয়টি সােভিয়েত পররাষ্ট্র দফতরের আমেরিকান ডেস্ক প্রধানের গােচরে নিয়েছি। তিনি বলেছেন, তিনি মনে করেন শিগগিরই আমরা জবাব পেয়ে যাব।

কিসিঞ্জার যদি কোনাে বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে আমরা একত্রে হয়তাে। জবাব পাব । অন্তত ফোনে হলেও।

আরউইন বাড়তি পদক্ষেপের লক্ষ্য কি হতে পারে?

কিসিঞ্জার পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার পরে আমরা কিছু করতে কম উৎসাহিত থাকব। তার চেয়ে বরং এটাই উত্তম প্রকাশ্যে এটা দেখানাে যে, তারা কাজ করেনি।

সিসকো আমরা সামরিক দিক থেকে একটা দৃশ্যপট তৈরি করব।

প্যাকার্ড কিন্তু এসব কিছু করলেও দাতাদের সামরিক সামর্থ্যে কোনাে প্রভাব। ফেলবে না।

আরউইন কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যদি কোনাে ফলই না পাওয়া যায়, তাহলে এ ধরনের পদক্ষেপ আমরা আর কতটা নেব?

প্যাকার্ড কিন্তু আমরা যদি একটি বার্তা পাঠাতে চাই তাহলে একটি ভালাে বার্তাই পাঠানাে উচিত। সিসকো আপনি কি মনে করেন যে, রাষ্ট্রদূত বুশের পক্ষে পাকিস্তানি স্থায়ী প্রতিনিধি শাহীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে? এটা একটা সংবেদনশীল পরিস্থিতি এবং এ নিয়ে আমার রয়েছে দুটো মন। আমার মনে হয়, পাকিস্তানিদের আমার এটা জানিয়ে দেয়া উচিত যে, জাতিসংঘে গেলে তার সুবিধা-অসুবিধা দু-ই আছে।

কিসিঞ্জার এ নিয়ে আমার কোনাে আপত্তি নেই। কারণ, আমরা তাে আর তাদেরকে কোনাে দিকে যেতে বলছি না।

সিসকো যথেষ্ট ভালাে। আমি বুশকে ডাকছি এবং তাকে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলাপের প্লাস-মাইনাস বুঝিয়ে দিচ্ছি।

কিসিঞ্জার ওকে।

২ ডিসেম্বর, ১৯৭১

কিসিঞ্জার নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকে উল্লেখ করেন, সর্বশেষ রিপাের্ট থেকে ধারণা। মিলছে যে, ভারতীয় এবং মুক্তিযােদ্ধারা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তজুড়ে আক্রমণাত্মক অভিযান তীব্র করেছে। জনশক্তি ও সরবরাহের দিক থেকে ঘাটতি থাকার মাসুল দিচ্ছে পাক বাহিনী এবং তারা কথিত মতে একাধিক প্রতিযােগিতাপূর্ণ অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এসব এলাকায় অব্যাহতভাবে আশপাশের উল্লেখযােগ্য প্রাদেশিক শহরগুলাে থেকে চাপ বাড়ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা গ্রামাঞ্চলে অধিকতর প্রকাশ্যে তৎপরতায় মেতে উঠেছে। সে কারণেই অধিকাংশ পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার করে। এখন সীমান্ত সামলাতে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। ঢাকার ১৭ মাইল দূরবর্তী বেশ কিছু শহর পাকসেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে সমর্পণ করেছেন এবং এমন খবর মিলছে যে, প্রত্যন্ত এলাকার শহরগুলােতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। ভারতীয়রা তাদের নিজেদের সৈন্য দিয়ে একটি মুক্তিবাহিনী নেভি’ গঠন করেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে জাহাজের আগমন প্রতিহত করা। জাতিসংঘে এই মুহূর্তে পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে অপেক্ষাকৃত স্থিতি অবস্থা বিরাজ করছে। জাপানি ও বেলজীয়রা নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানে তাদের উদ্যোগ স্থগিত করেছেন। কারণ, স্থায়ী প্রতিনিধিদের কাছ থেকে তারা কোনাে উৎসাহ পাননি। এই মুহূর্তে সােভিয়েত ও ভারতীয়রা নিষ্ক্রিয় রয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘে পাক রাষ্ট্রদূত ভাবছেন, তিনি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানে শুক্রবারের মধ্যে ইসলামাবাদের কাছ থেকে নির্দেশ পেতে পারেন।

তিনি রিপাের্ট দিয়েছেন যে, পাকিস্তানিরা চাইলে চীন তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগ করবে। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের জন্য সােভিয়েতরাও একই ভূমিকা পালন করবেন। হংকংয়ে আমাদের চীনা পর্যবেক্ষকরা রিপাের্ট দিয়েছেন যে, গত ১০ দিনে চীনা গণমাধ্যমে পাক-ভারতের সংকট হঠাৎ করেই ব্যাপকতা পেয়েছে। ভারতের তৎপরতাকে চীনা গণমাধ্যম আগ্রাসন’ হিসেবে বর্ণনা করছে এবং সামরিক ব্যবস্থাকে উস্কানি’ আখ্যা দেয়া হচ্ছে। একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার বরাতে সশস্ত্র আগ্রাসন’ কথাটিও ছাপা হয়েছে। সােভিয়েত সম্পৃক্ততার বিষয়টি উল্লেখযােগ্যভাবে কভারেজ পাচ্ছে। কিন্তু একই সময়ে চীনারা তাদের নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি কোনাে হুমকি হিসেবে পাক-ভারতের সংকটকে মূল্যায়ন করতে যায়নি। চীনা জনগণের সমর্থনের বিষয়টি সাধারণ প্রবণতা হিসেবেই রয়ে গেছে এবং অন্তত একবার তারা পরােক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, পাকিস্তানিদের সহায়তার প্রয়ােজন নেই। তারা অবশ্য একই সঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলােচনার আহ্বান জানাচ্ছে। আমরা আমাদের সামরিক সাহায্য বন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। পররাষ্ট্র সচিব কাউল। ভারতে আমাদের নতুন সামরিক সহায়তা নীতি তুলনামূলকভাবে ভালােভাবেই নিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যা ভালাে মনে করে তেমন পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার তার রয়েছে। তিনি খুব বন্ধুপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রদূত কিটিংকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, কোনাে দেশেরই ভাবা উচিত নয়, কোনাে ধরনের চাপজনিত কৌশল। প্রয়ােগ করে ভারতকে তার পদ থেকে সরানাে যাবে। কাউল আশা প্রকাশ করেন যে, উভয় দেশ অভিন্ন মূল্যবােধ ও আদর্শ অনুসরণ করছে। এটা যেন যুক্তরাষ্ট্র ভুলে না যায়।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন