আমার দেখা অন্যতম নিষ্ঠুর অপারেশন কিসিঞ্জার
১১ নভেম্বর, ১৯৭১ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স একটি টেলিগ্রাম পাঠান দিল্লি, মক্সো, কলকাতা, ঢাকা ও ইসলামাবাদে এতে উল্লেখ করা হয়, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকো ১০ নভেম্বর পাকিস্তান ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান/ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অব্যাহত সংঘর্ষের খবরে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ সময় উল্লেখ করা হয় যে, আমরা খবর পেয়েছি কামালপুরে ভারতীয় গােলাবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং পাকিস্তান এখন পাল্টা আক্রমণ করতে পারে। সিসকো পাক রাষ্ট্রদূত রাজাকে বলেছেন, ইয়াহিয়া আমাদের জানিয়েছিলেন, উত্তেজনা প্রশমনে তিনি সৈন্য প্রত্যাহারের একতরফা সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা এটা বাস্তবে দেখতে আগ্রহী আমরা একই সঙ্গে বৈরিতা প্রতিরােধে জাতিসংঘকে যে কোনাে সহযােগিতা দেয়া। হলে, আমরা তাকে স্বাগত জানাব। সিসকো স্মরণ করিয়ে দেন, পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করবে না মর্মে ইয়াহিয়া তাদের আশ্বস্ত করেছেন। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, কামালপুরের ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আর সে কারণেই দুদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আমরা জানিয়ে দিয়েছি, কোনাে ধরনের উস্কানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উভয় পক্ষের কাছ থেকে সংযম প্রত্যাশিত। সিসকো বলেছেন, আমরা আশা করব যে, পাকিস্তান অব্যাহতভাবে এই সচেতনতা প্রদর্শন করে চলবে যে, তাদের তরফে যে কোনাে সামরিক অথবা পাল্টা ব্যবস্থা ভারতীয়রা বড় ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করবে। রাজা উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তান সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই সজাগ; এবং যাতে যুদ্ধ শুরু না হয়, সে ব্যাপারে তাদের সর্বাত্মক সতর্কতা রয়েছে। কিন্তু ভারতের কৌশল পরিষ্কার। তারা ওত পেতে আছে, আমাদের যে কোনাে তৎপরতাকে অজুহাত হিসেবে লুফে নেবে।
তিনি মনে করেন, পাকিস্তান সরকার ধৈর্যশীল থাকবে। কিন্তু এটাও সত্য যে, ধৈর্যেরও তাে একটা সীমা থাকবে। টেলিগ্রামে উল্লেখ করা হয়, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝা এসেছিলেন, রাসগােত্র ও ভার্মাকে সঙ্গে নিয়ে। সিসকো আলােচনার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র সফর সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। সিসকো উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা শান্তি রক্ষায় যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তাতে তিনি মুগ্ধ। ইন্দিরা যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছেন। সিসকো বলেন, আমরা একে বাস্তবে দেখতে চাই। তিনি একই সঙ্গে উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক সমঝােতার বিষয়টিও সমান্তরাল। একে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত যে, ওয়াশিংটন শুধুই সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নেবে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ফ্রন্টেও চেষ্টা চালাবে সিসকো এ পর্যায়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরে আমরা এমন খবর পেয়ে উদ্বেগ অনুভব করছি, ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছে। আমরা উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, এ ধরনের অনুপ্রবেশ পাকিস্তানকে পাল্টা আক্রমণ পরিচালনায় উস্কে দিতে পারে। এবং সে কারণেই আমরা আশা করি যে, এই পরিস্থিতির অবসানে ভারত কিছু পদক্ষেপ নেবে সিসকো ঝাকে এ কথাও অবহিত করেন যে, পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা যে উদ্বিগ্ন সে কথা আমরা পাকিস্তানকে অবহিত করেছি।
আমরা আপনার কাছেও এই আশাবাদ পুনর্ব্যক্ত করতে চাই যে, যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সমঝােতায় যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে নস্যাৎ করে দিতে কোনাে পক্ষই কোনাে পদক্ষেপ নেবে না। আমরা এ কথাই জানি যে, রাজনৈতিক সংলাপের ব্যাপারে ভারত সরকারের সতর্ক স্বার্থ রয়েছে। ঝা এ সময় প্রশ্ন করেন যে, কামালপুরের কাছে সংঘটিত যে ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, সে ব্যাপারে তার কাছে নিরপেক্ষ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য রয়েছে কি না? জবাবে সিসকো বলেন, আমরা যে রিপাের্ট পেয়েছি তাতে প্রয়ােজনীয় বস্তুনিষ্ঠতা রয়েছে। ভ্যান হােলেন এ সময় বলেন, গত সপ্তাহে ভারতের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী কিছু মাত্রায় সীমান্ত অতিক্রম করেছে। রাসগােত্র বলেন, এ সংক্রান্ত যে তথ্য সংবাদপত্রে বেরিয়েছে ভারত সরকারের মুখপাত্র ইতােমধ্যেই তা দু’দফায় নাকচ করে দিয়েছে। কিন্তু দুতাবাসের কাছে এ ব্যাপারে আর কোনাে তথ্য জানা নেই । ১২ নভেম্বর, ১৯৭১ হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক। এই বৈঠকে সিআইএর প্রতিনিধি লে. জেনারেল রবার্ট ই, কুশম্যান তথ্য দেন যে, আমাদের কাছে খবর রয়েছে ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে বিপুলসংখ্যক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখন সামান্য হুঁশিয়ারিতেই যে কোনাে মুহূর্তে বড় ধরনের সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি বাহিনী গেরিলারা ক্রমবর্ধমানভাবে সক্রিয় কার্যকর হয়ে উঠেছে। কুশম্যান ধারণা দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের ৩০ ভাগ পর্যন্ত এলাকার ইতােমধ্যেই মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা টগবগিয়ে ফুটছে। কারণ ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ও ভারতের নিয়মিত সৈন্য যৌথভাবে পাক সেনা ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ে সীমান্ত সন্নিহিত অঞ্চলে যােগ দিয়েছে। কুশম্যান উল্লেখ করেন, এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তের উভয় দিকে দুদেশের সৈন্যরা যুদ্ধকালীন সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে সিআইএর মূল্যায়ন হচ্ছে, সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে নিবৃত্ত করতে এখনাে হাল ছেড়ে দেয়নি। তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া যুদ্ধ শুরু হলে চীন খুব সক্রিয়ভাবে। পাকিস্তানকে যে সাহায্য করবে তা মনে হয় না। কিসিঞ্জার প্রশ্ন রাখেন, মি, কুশম্যান। আপনি যখন বলছেন যে, পাক সেনাদের নিহতের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে তখন আমরা ঠিক কী বুঝব? কুশম্যান এখন দিনে পাঁচ বা ছয় জন সৈন্য নিহত হচ্ছে। অক্টবরের আগে দৈনিক মৃতের সংখ্যা ছিল তিন। কিসিঞ্জার : আপনি পাকিস্তান নৌবাহিনীর কথা বলছিলেন, তারা এখন কোথায়? কুশম্যান তারা অতটা সামর্থ্যবান নয়। কিন্তু চট্টগ্রামে তাদের কিছু জাহাজ রয়েছে। কিসিঞ্জার পররাষ্ট্র দপ্তরের কী চিন্তা?
সিসকো আমি দুটো দিক নিয়ে কথা বলব। এক, আমরা যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে তখনই নিশ্চিত হব যখন মিসেস গান্ধী দেশে ফিরবেন। এবং আমরা দেখতে চাই, তিনি কিভাবে তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে ব্যবহার করেন। সােমবার ১৫ নভেম্বর পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হবে। আমরা দেখতে চাই, ইন্দিরা বিদ্যমান পরিস্থিতিকে তিনি পার্লামেন্টে কিভাবে খেলেন। দুই, আমাদের এটা খতিয়ে দেখা উচিত, সােমবারের আগে ইন্দিরাকে উৎসাহিত করতে আমরা আর কোনােভাবেই কোনাে দিক থেকে কিছু করতে পারি কি না? প্রয়ােজনে তিনি যদি অনুকূল পদক্ষেপ নেন, তাহলে তাে তার হাত আমাদের শক্তিশালী করতে হবে। কিসিঞ্জার কিন্তু তিনি কি তেমন কোনাে পদক্ষেপ নেবেন? সিসকো আমি একমত। সেটাই প্রকৃত প্রশ্ন। তবে তিনি যাতে সে ধরনের পদক্ষেপ নেন সে লক্ষ্যে কিন্তু আমরা তাকে যথেষ্ট মালমশলা দিয়েছি। আমরা জানি, তিনি তা পছন্দ করবেন কি না। কিন্তু আমি মনে করি পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় পরিস্থিতির জন্য সহায়ক আর কোনাে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া যায় কি না তা আমরা আলােচনা করতে পারি । কিসিঞ্জার আপনি কি মনে করেন যে, সােমবার পার্লামেন্টে যদি তিনি ভুল বার্তাটিই আকড়ে ধরেন, তাহলে যুদ্ধ এসে যাবে খুব তাড়াতাড়ি।
সিসকো ইন্দিরা যদি ইয়াহিয়ার ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে চান, তাহলে আমার বিবেচনায় তা বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তেজনা বাড়াবে। ভারতের কৌশল হচ্ছে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। এবং সামরিকভাবে পাকিস্তানকে শুষে নেয়া। এক্ষেত্রে নীতি হচ্ছে, যুদ্ধ শুরু করার দোষটা যাতে পাকিস্তানের কাঁধেই পড়ে। কোনাে একটি মাত্র দুর্ঘটনা যাতে পাকিস্তান পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে তা সৃষ্টি করবে একটি ‘কজাজ বেলি’। পাকিস্তানিরা এটা জানে। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের কথা শুনে মনে হলাে, ভারত তাদের ফাঁদে ফেলতে চাইছে। কিসিঞ্জার ভারত দাবি করেছে, এটা পাকিস্তানি সমস্যা। কিন্তু তারা পরিকল্পিতভাবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যাতে কোনাে সুরাহা না ঘটে। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে নিষ্ঠুর অপারেশনগুলাের এটি অন্যতম।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন