স্বাধীনতার নেতৃত্ব হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পর প্রস্তুত রিপাের্টে সিআইএ বলেছে, মুক্তিবাহিনীর সত্যিকার সামর্থ্য সম্পর্কে খুব অল্পই জানা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে এক দীর্ঘ সমীক্ষায় উল্লেখ করেছে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দিন দিন আরাে উত্তেজনাকর ও ঘােলাটে হয়ে পড়ছে। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর সংখ্যা এখন প্রায় ৮০ হাজার হবে। তারা অন্তত দিনেরবেলা বিভিন্ন শহর এবং গ্রামের কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে। সমীক্ষায় বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তান কিংবা ভারতে যেখানেই থাকুক, রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে তাদের পরিচয় মুক্তিবাহিনী বা লিবারেশন ফাইটার। ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে প্রতিরােধ শক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই, যদি অধিকাংশ না-ও হয়ে থাকে, এদের একটি বড় অংশ একাত্তর-পূর্বকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীতে ছিল। সংখ্যায় তারা সম্ভবত ১৫ হাজার হবে। তারা সময়ে সময়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং গেরিলা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। একটি বৃহত্তম গ্রুপ, যারা এখন ভারতে অবস্থান করছে, তারা সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে ভূখণ্ড দখল করে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্রতিরােধ মােকাবেলা করে তারা চাইছে পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখযােগ্য অংশ দখল করে নিতে।
এই ভূখণ্ডে তারা নিজেদের স্বাধীন বাংলাদেশের কার্যক্রম চালাতে আগ্রহী। এটি এমন এক পদক্ষেপ, যা খুবই উস্কানিমূলক এবং এর ফলাফলও অনিশ্চিত। মুক্তিবাহিনীর অবস্থা অনেকটা তিউনিসিয়ায় অবস্থানরত আলজেরীয় সেনাবাহিনীর মতাে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তারা অবস্থান করেছিল। তিউনিসিয়ায় তাদের মতােই মুক্তিবাহিনী অনতিবিলম্বে দেশ দখল করতে চায় না। অপেক্ষা করতে চায়, কখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা দেশ ছেড়ে চলে যায়। তারপর তারা দেশ দখল করে নেবে। তবে এক্ষেত্রে আরেকটা সম্ভাবনা আমাদের মনে রাখতে হবে। এমনও হতে পারে, দেশ দখলে নেয়ার সিদ্ধান্ত এখনাে তারা পায়নি। যা-ই ঘটুক না। কেন, তারা ইদানীং কিছু প্রকাশ্য তৎপরতা প্রদর্শন করছে। এর উদ্দেশ্য হতে পারে, কলকাতার প্রবাসী সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য নিশ্চিত করা। তবে যেসব গেরিলা সক্রিয়, তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, তাদের প্রকৃত সংখ্যা, কমান্ড কাঠামাে ইত্যাদি সাধারণভাবে অজ্ঞাত। কিন্তু বাঙালিরা ব্যক্তিতান্ত্রিক এবং এমনকি চারিত্রিকভাবে নৈরাজ্যবাদী। বিদ্রোহী গ্রুপগুলাের মধ্যে সম্ভবত সামঞ্জস্য নেই। এমনও হতে পারে, গ্রুপগুলাে পরস্পরের প্রতি বৈরী। তাই তারা একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে বিদ্রোহ তৎপরতায় নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। তবে যারা আওয়ামী লীগের প্রতি অনুগত তারাই সংখ্যায় বেশি হবে। কিন্তু বিদ্রোহীদের অন্তত একটি অংশ। কট্টরপন্থি এদের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শহুরে গেরিলাদের মিল রয়েছে।
মুক্তিবাহিনী ক্রমেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে পরিশীলিতভাবে ও কার্যকর প্রতিরােধ নিশ্চিত করতে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে, জাহাজ ও নৌকায় নাশকতা চালিয়ে, সড়কে মাইন পুঁতে, ট্রেন লাইনচ্যুত করে, এলাকাসমূহের পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেছে। তারা শান্তি কমিটির অনেক সদস্য হত্যা করেছে। পাট শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই খাতই পাকিস্তানের প্রধান রফতানিমুখী পণ্য। মুক্তিবাহিনীর নাশকতা ও প্রতিরােধের ফলে পাটের উৎপাদন স্বাভাবিক পর্যায়ের চেয়ে ইতােমধ্যে এক-চতুর্থাংশে নেমে এসেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনেকে হতাহত হয়েছে। কিন্তু সংখ্যাটা যে ঠিক কত, সে ব্যাপারে আমাদের কাছে নির্ভরযােগ্য কোনাে তথ্য নেই। আমাদের ঢাকা কনস্যুলেট অফিস শহরে একাধিক বিস্ফোরণের খবর পাঠিয়েছে। এক বা তার চেয়ে অধিকবার বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হােটেলের লবি একটি বােমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোটায় । শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনাে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইসলামাবাদ অবশ্য অব্যাহতভাবে দাবি করে চলেছে, পরিস্থিতি তাদের হাতের মুঠোয়। সিআইএ লিখেছে, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক এখনাে রয়ে গেছে একটি বিতর্কিত বিষয়ে। ইসলামাবাদ দাবি করছে, শুধু ভারতের সক্রিয় পৃষ্ঠপােষকতা ও সহযােগিতার কারণেই দুবৃত্তরা তৎপরতা চালাতে সক্ষম হচ্ছে। একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা ও উদ্বাস্তুদের স্রোত বন্ধ করার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতাে, যদি ভারত তার সীমান্ত বন্ধ করে দিত এবং যদি তারা ভারতে পলায়নরত বিদ্রোহীদের নিরস্ত্র ও তাদের তৎপরতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। নয়াদিল্লি অবশ্য এ ধরনের সহযােগিতার কথা অস্বীকার করে চলেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত হচ্ছে আড়াই হাজার মাইল দীর্ঘ।
এটা এতই বন্ধুর যে, এখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা খুবই জটিল। নয়াদিল্লির আরাে দাবি, এটা কারাে পক্ষে বলা সম্ভব নয়, ভারতে অবস্থানরত বাঙালিরা কোথা থেকে এসেছে? তারা পূর্ব না পশ্চিমবঙ্গের এটা ঠাহর করা কঠিন। উপরন্তু পূর্ববাংলায় বিদ্রোহ এক বিরাট জনপ্রিয় বিষয়। সুতরাং এটা থামানাে দূরের কথা, তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করাও সম্ভব নয়। ভারতের সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকেই মুক্তিবাহিনী সাহায্য পাচ্ছে।’ এ পর্যায়ে সিআইএ’র মন্তব্য হচ্ছে, উভয় পক্ষের দাবির অনুকূলে কিছু সত্যতা রয়েছে। কিন্তু নয়াদিল্লি প্রকাশ্যে যতটা স্বীকার করছে, তার চেয়ে বাস্তবে মুক্তিবাহিনীর প্রতি তাদের সমর্থন অনেক ব্যাপক। (একটি অংশ কালি দিয়ে লেপটে দেয়া হয়েছে) রিপাের্ট এবং পশ্চিমা সাংবাদিকদের মতাে বহিরাগতদের পর্যবেক্ষণ থেকে ইঙ্গিত মিলছে, ভারতীয় সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী উল্লেখযােগ্য সংখ্যক বাঙালিকে অস্ত্র সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দিচ্ছে। দুদেশের সীমান্তে নিয়মিত ভারতীয় ও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মধ্যে গুলিবিনিময় ও সংঘর্ষের ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে, ভারত সরাসরি বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে। এটা অবশ্য ঠিক, ভারতীয়দের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদ্রোহীদের সহায়তাদানের কিছু নজির রয়েছে। কিন্তু তা এমন নয় যে, তেমন সহায়তার মধ্যে অস্ত্র কিংবা গােলাবারুদ রয়েছে। মুক্তিবাহিনী প্রকৃতপক্ষেই ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। নয়াদিল্লি কেন এই নীতি গ্রহণ করেছে– এর পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান। মুক্তিবাহিনী যে কারণে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে, তার প্রতি ভারতীয় জনগণের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন ভারত সরকার যদি এটা জবরদস্তিমূলক দমন করতে উদ্যোগী হয়, তাহলে তা বড় ধরনের রাজনৈতিক ব্যাকল্যাশ সৃষ্টি করতে পারে। রিয়েল পলিটিক’ এর দিক থেকে ভারত এটাও বিবেচনা করছে, তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কোনাে অনিষ্ট সাধন তার স্বার্থের অনুকূল।
এছাড়া ভারতীয়রা এমনও ভাবতে পারে যে, ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর বিরােধিতা আগে যা মনে হয়েছিল তার চেয়ে ব্যাপক এবং সম্ভবত তারা পূর্ববাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্রকৃত সামর্থ্যকে খাটো করে দেখার প্রয়াস পেয়েছিল। সে কারণেই প্রত্যেক পর্যায়ে তারা বিপুলসংখ্যক গেরিলাদের সশস্ত্র করতে। উৎসাহিত হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রমকেও তারা সাধুবাদ জানিয়েছে এই আশায় যে, এটা শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাবি সামরিক শাসকদের উৎখাত নিশ্চিত করবে। বিদ্রোহীদের সহায়তার মাধ্যমে নয়াদিল্লি অবশ্য মুক্তিবাহিনীর ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখারও চেষ্টা করছে। কারণ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বিশ্বের রাজনৈতিক চরমপন্থিদের উল্লেখযােগ্য আবাসভূমি হিসেবে স্বীকৃত। ওই চরমপন্থিরা পশ্চিমবঙ্গের (এবং ভারতের) শহর এলাকার শিল্পনির্ভর অর্থনীতির বিরাট ক্ষতি বয়ে আনতে পেরেছে। এই চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে প্রবল নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার কারণে তাদের বাগে রাখা সম্ভব হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা একই বিচারে ভারত সরকারের কাছে সন্দেহভাজন। তারা ধরে নিয়েছে যদি এ ধরনের চরমপন্থিরা কখনাে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, তাহলে তারা ভারতীয় নিরাপত্তার প্রতি সৃষ্টি করবে এক অপ্রতিরােধ্য হুমকি। উপরন্তু পশ্চিমবঙ্গের ওপর বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়েও তারা এখনই উদ্বেগ অনুভব করছে। নয়াদিল্লি সম্ভবত বাঙালিদের শুধু বন্ধু ভেবেই সমর্থন দিচ্ছে না; তারা চরমপন্থিদের সম্ভাব্য উথান। প্রতিরােধেরও চেষ্টা করছে।
সিআইএ’র চোখে মুজািহিনীর ভূমিকা
২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ভারতের মার্কিন দূতাবাস স্টেট ডিপার্টমেন্টে আজ একটি টেলিগ্রাম পাঠায়। এতে উল্লেখ করা হয়, জে, জে. সিং ৪ আগস্ট টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক চিঠিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মেকিয়াভেলির নীতি অনুসরণ করছে। তারা মুক্তিবাহিনীকে বিশ্বের চোখে খাটো করতে চায়। ১৯৭১ সালের ৭ অক্টোবর ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে সিআইএ পরিচালক হেলমস তথ্য দেন যে, আমার কাছে একটি তরতাজা রিপাের্ট রয়েছে। এটা এখন আমি আপনাদের পড়ে শুনাতে চাই। পশ্চিম ফ্রন্টে দুদেশ সীমান্তের কাছাকাছি প্রায় ২ লাখ করে সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে। তারা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের অনেকেই অগ্রবর্তী অবস্থান নিচ্ছে। পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতের রয়েছে দুটি পদাতিক ও একটি ট্যাংক ডিভিশন। অবশ্য এই তিনটি ডিভিশনই বর্তমানে সীমান্ত থেকে কয়েকশ’ মাইল দূরে অবস্থান করছে। পাকিস্তানিরাও একইভাবে দুটি পদাতিক ও একটি ট্যাংক ডিভিশন নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। পূর্ব পাকিস্তান ফ্রন্টে ভারতের রয়েছে ১ লাখের বেশি, আর পাকিস্তানের ৭০ হাজার সৈন্য। আক্রমণ শুরুর আগে ভারতীয়রা সম্ভবত আরাে এক ডিভিশন সৈন্য পূর্ব ফ্রন্টে নিয়ে আসবে। এটা অবশ্য পাকিস্তানিদের দাবি। আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। পাকিস্তানিরা সর্বতােভাবেই গেরিলাদের নিয়ে ব্যস্ত। তারা উল্লেখযােগ্য কোনাে অভিযান চালানাের প্রস্তুতি নিতে পারেনি। যুদ্ধ সম্ভবত ঘনিয়ে আসছে; যেমনটা অনেক ভ্রান্তিপূর্ণ মূল্যায়নের ধারায় সংঘটিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। কিন্তু এখন আমরা যে কোনাে পক্ষের কাছ থেকে একটি পরিকল্পিত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সম্ভাবনা উড়িতে দিতে পারি না। উদ্বাস্তু আগমনের স্রোত বন্ধ করতে মিসেস গান্ধী পূর্ব পাকিস্তানে আগ্রাসন চালানাের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
প্রতিদিন ৩০ হাজারের বেশি উদ্বাস্তু ঢুকছে। তাদের মােট সংখ্যা ৯০ লাখ অতিক্রম করেছে।’ কিসিঞ্জার এ সময়ে প্রশ্ন করেন, ৯০ লাখের সংখ্যাটি কি সঠিক বলে আপনি মনে করেন? জবাবে হেলমস বলেন, ‘এটা যথার্থ না-ও হতে পারে। কিন্তু সংখ্যাটি যদি ৭০ লাখও হয় তাহলেও তা বিশাল এবং সত্য হচ্ছে প্রতিদিনই উদ্বাস্তুরা ভারতে ঢুকছে; কেউ ফিরছে না। যে কোনাে বিচারেই মধ্য নভেম্বর নাগাদ মিসেস গান্ধী সামরিক পদক্ষেপ নিতে চাপের সম্মুখীন হবেন। পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকা হবে এবং অনেক সদস্যই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলবেন। উর্ধ্বতন পাকিস্তানি কর্মকর্তারা এ মর্মে নিশ্চিত যে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইয়াহিয়া একটি প্রি-অ্যাম্পটিভ’ আক্রমণ পরিচালনা করবেন। ইয়াহিয়া নিজেই ব্রিটিশদের কাছে এমন ধারণা ব্যক্ত করেছেন। তিনি অবশ্য আমাদের ডেপুটি চিফ অব মিশনকে নিশ্চিত করেছেন যে, এমন কাজ তিনি করবেন না। তিনি সম্ভবত ভারতের ওপর পশ্চিমা চাপ বৃদ্ধির চেষ্টা চালাবেন। অথবা তিনি এমনাে ভাবতে পারেন যে, একটা আক্রমণ পরিচালনা করলে তখন উভয়পক্ষের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে সহায়ক হবে।’ সিআইএ পরিচালক আরাে বলেন, বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানে অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ভারতীয়রা উভয়ই। চাইছে, সমাধান দ্রুত হােক। এমনকি যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। তাদের অভিন্ন। আশঙ্কা হচ্ছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব যেন কোনাে অবস্থাতেই উগ্র। বামপন্থিদের হাতে চলে না যায়। আমরা এমন রিপাের্ট পেয়েছি যে, ভারতে প্রশিক্ষিত ১ লাখ গেরিলা আগামী দুমাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করবে। এই বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর পূর্বাংশের একটি এলাকায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে, এই এলাকা থেকে অস্থায়ী সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা। সেক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে সক্ষম হবে। আর এ রকমের একটি অবস্থা প্রায় নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানিদের যুদ্ধে ঠেলে দেবে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইউ, এলেক্স জনসন এ সময় উল্লেখ করেন, আমাদের কাছে একটি পৃথক রিপাের্ট রয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে, ১৫ অক্টোবরের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার গেরিলা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়বে (ফুটনােট : ৩ অক্টোবর কাজী জহিরুল কাইউম কলকাতায় মার্কিন পলিটিক্যাল অফিসারকে বলেছেন, অক্টোবরের শেষ নাগাদ মুক্তিবাহিনী ৪০ থেকে ৬০ হাজার লােককে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণের পরিকল্পনা। করেছে। ১৫ অক্টোবরের মধ্যে ৪০ হাজার এবং অবশিষ্ট ২০ হাজার মাসের শেষ। নাগাদ প্রবেশ করবে)। সিআইএ’র পরিচালক হেলমস বলেন, এসব পরিসংখ্যান নিয়ে বড় ঝামেলায়। আছি। আবহাওয়া যখন শুষ্ক হবে, তখনই গেরিলারা দলে দলে ঢুকতে শুরু করবে। তখন তাদের সংখ্যা ৪০ হাজার অথবা ১ লাখ অথবা সংখ্যাটি এর মাঝামাঝি কিছু একটা হবে কী হবে না তা বড় কথা নয়। এটুকু ভালােই বুঝতে পারছি, সংখ্যায় তারা অনেক বেশি হবে। ভারতীয়রা বিশ্বাস করে যে, উত্তরের তুষার এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া পাকিস্তানিদের কাশ্মীর দখল থেকে নিবৃত্ত রাখবে। তখন চীনের পক্ষেও পাকিস্তানিদের সাহায্য করা কঠিন হবে। আর সেই সুযােগে পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলারা সাফল্যের মুখ দেখবে। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা মােকাবেলা করতে পারবে না। আর কিছু এলাকায় গেরিলারা ইতােমধ্যেই নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠা করেছে। পাকিস্তানি সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মন জয় করার কোনাে সুযােগই পাবে না। মুক্তিবাহিনীর প্রতি জনগণের সমর্থন দৃশ্যত ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন