You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার নেপথ্যে - সংগ্রামের নোটবুক
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার নেপথ্যে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা সিআইএ’র অন্তত দুটো রিপাের্টে বিশেষভাবে মূল্যায়িত হয়েছে। দুটো রিপাের্টই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে দুর্বল করার দিকটি ছাড়াও আওয়ামী লীগের পরিবর্তে চীন ঘেঁষা কোনাে চরমপন্থি গােষ্ঠীর উত্থানের সম্ভাবনাকেও তাদের সমর্থনদানের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল সিআইএ’র ১৫ পৃষ্ঠার একটি রিপাের্টে বলা হয়, বহু বছরের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার বাঙালিরা ‘৭০ এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে চুড়ান্ত রায় দিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক নেতৃবৃন্দ এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পরিবর্তে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে, আর সে। কারণে অখণ্ড পাকিস্তান দেখার স্বাদ বাঙালিদের মন থেকে ইতিমধ্যে প্রায় মুছে গেছে। এখন কথা হলাে পাকিস্তানি আর্মি অসহযােগ কিংবা অব্যাহত সক্রিয় প্রতিরােধ কতটা ব্যাপকতার সঙ্গে মােকাবেলা করবে তা নির্ভর করবে ভারত তাদের কতটা সাহায্য করে তার ওপর। মাত্র কয়েক মাইল বাদে পূর্ব বাংলার স্থল সীমান্ত ভারতের সঙ্গে। এই সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও গেরিলাদের চলাচল প্রতিরােধযােগ্য নয়। ইতােমধ্যেই এমন প্রমাণ মিলেছে যে, কিছু অস্ত্রের চালান ভারত সীমান্ত দিয়ে পূর্ব বাংলায় পৌছে গেছে (রিপাের্টের এই অংশের একটি স্থান কালি দিয়ে লেপটে দেওয়া হয়েছে)। বাঙালিদের জন্য ভারত সরকারের সমর্থনের কারণ মিশ্র হতে বাধ্য।
প্রথমত, অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয় চাপ- যা খুবই শক্তিশালী এবং ভারতের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের মূল্যায়ন থেকে। ভারতীয় পার্লামেন্ট ও সংবাদপত্রের সমর্থনও ইতােমধ্যেই জোরালাে। পশ্চিম পাকিস্তান ও তার সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের মুখ্য শত্রু। একটি সফল বাঙালি বিদ্রোহ পশ্চিম পাকিস্তানকে দুর্বল ও অপদস্থ করবে। পূর্বাংশ প্রকৃতপক্ষে কাশ্মীর বিরােধ প্রশ্নে অনাগ্রহী। তারা কখনােই উল্লেখযােগ্য পাকভারত যুদ্ধে সম্পৃক্ত হতে চায়নি। তারা নয়াদিল্লির কাছে হুমকি হিসেবেও বিবেচ্য নয়। বরং পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে আওয়ামী লীগের মুজিবুর রহমান ভারতের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের প্রবক্তা। সুতরাং আমাদের অনুমান, ভারত বাঙালিদের ক্রমবর্ধমান ও অব্যাহতভাবে অস্ত্র সহায়তা দেবে, যা দ্বারা বাঙালিরা বিদ্রোহের ন্যূনতম শক্তি সঞ্চার করতে পারবে এবং তা পাক আর্মি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে পারবে না। এটা করতে গিয়ে অবশ্য ভারত এই ঝুঁকি মেনে নিচ্ছে যে, তার প্রদত্ত কিছু অস্ত্র চরমপন্থিদের হাতে চলে যেতে পারে। ইতিমধ্যে বাঙালিরা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সমান্তরাল শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য সেনা উপস্থিতি যেখানে শক্তিশালী সেখানকার কথা আলাদা। রিপাের্টে এ পর্যায়ে বলা হয়, নয়াদিল্লি বিলম্বের চেয়ে কেন অপেক্ষাকৃত আগেই বাঙালিদের পাশে দাঁড়াবে তার অন্য কারণও বিদ্যমান রয়েছে। আর তা হলাে ভারত সম্ভবত এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হবে যে, একটা দীর্ঘ সময় যদি বিদ্রোহ চলতে থাকে তাহলে তুলনামূলক উদারপন্থি আওয়ামী লীগের বিপরীতে কোনাে নতুন চরমপন্থি নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে পারে, যারা তখন নতুন দেশটির নেতৃত্ব দেবে।
পূর্ব বাংলায় কোনাে উগ্র রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান ভারতের জন্য বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এটা বিশেষ করে পূর্ব বাংলার প্রতিবেশী ভারতীয় প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের জন্য বেশি সত্য। পশ্চিমবঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকেন্দ্র এবং তাকে নিয়ে ঝামেলাও কম নয়। একাধিক চরমপন্থি কমিউনিস্ট গ্রুপ সেখানে উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক দল। রাজধানী কলকাতার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা ব্যতিক্রমীরূপে ভালাে নয়। এখানকার নাগরিকরা সেক্ষেত্রে পূর্ববাংলার রেডিক্যাল রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা প্রভাবিত এবং এমনকি বিচ্ছিন্ন হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারেন। সুতরাং এই পটভূমিতে ভারতীয়রা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই কাজ করবে না; তারা এটাও নিশ্চিত হতে চাইবে যে, সেখানে যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটি হবে তার কাছে সন্তোষজনক। রিপাের্টের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে বলা হয়- ভারত বাঙালিদের কমবেশি গােপনীয়তার সঙ্গেই সহায়তাদানে অগ্রাধিকার দেবে, পরামর্শ, অস্ত্র ও আশ্রয় সবটারই একটা আড়াল থাকবে। দিল্লি অবশ্য পাকিস্তানের সীমান্ত অভিমুখে সৈন্য চলাচল করে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যদি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে কিংবা ভারত যদি দেখে কোনাে রেডিক্যাল নেতৃত্বের উথান সম্ভাবনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তাহলে সে সম্ভবত তখন আরাে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন দেবে। এসব পদক্ষেপের ফলে ভারতীয় সম্পৃক্ততা গভীর থেকে গভীরতর হতে পারে এবং তারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষেও রূপ নিতে পারে। এমনকি প্রকাশ্য সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারতের অন্য সীমান্ত থেকে সৈন্য সমাবেশ না ঘটিয়েও পূর্ব বাংলায় তাদের যে সৈন্য রয়েছে তা দিয়েই তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম। 
সিআইএ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পর ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ৩৩ পৃষ্ঠার আরেকটি রিপাের্ট প্রস্তুত করে। এতে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের দৃষ্টিভঙ্গি শীর্ষক পরিচ্ছেদে বলা হয়, ভারতীয়রা বলছেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলায় সামরিক শক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যান্ডেটকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে; কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। তারা সম্ভবত দেখছে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরােধের মাত্রা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে, যা আর উপেক্ষা করা যায় না। যে কোনাে বিচারেই হােক তারা মনে করছে বিরাট ঝুঁকি সত্ত্বেও বাঙালিদের। সমর্থন দেওয়াটা তাদের তরফে একধরনের নৈতিক বাধ্যবাধকতা। তারা হিসাব। করছে, ভারত সমর্থিত মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম- পাকিস্তানিদের খরচ ও অব্যাহত ব্যর্থতা দুটোই এতটা বৃদ্ধি করছে যে, যার পরিণামে তারা হয় পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন মেনে নেবে অথবা পুরােপুরি মায়া ত্যাগে বাধ্য হবে। ভারতীয়রা ধরে নিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্য শিগগিরই অর্জিত হতে পারে এবং তা একটি পূর্ণাঙ্গ পাক-ভারত যুদ্ধ। ছাড়াই। বিদ্রোহে সহায়তাদান ছাড়াও ভারত বহু বেসামরিক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকেও তারা যথেষ্ট সহায়তা দিয়ে চলেছে। তবে এসব নেতৃবৃন্দের অনেকেরই ব্যক্তিগত ইমেজ বা জনপ্রিয়তা। বলতে তেমন কিছুই নেই। সত্যি বলতে কী, মুজিবুর রহমান ছাড়া বাঙালিদের পক্ষে কথা বলার দাবি অন্য আর কেউ করতে পারেন না। মিসেস গান্ধী এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতিদানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ প্রতিহত  করে আসছেন।
৭ জুলাই, ১৯৭১
স্থান নয়াদিল্লিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের কক্ষ। (কিসিঞ্জার এসেছেন ভারত সফরে। তাদের আলােচনার বিবরণ থেকেও ভারতের অবস্থানটি অনুমান করা চলে।
কিসিঞ্জার আপনি কিভাবে চীনের কমিউনিস্ট মিলিটারির হুমকির মূল্যায়ন করেন?
| জগজীবন : আমি দুদেশের সামরিক ভারসাম্যে কোনাে পরিবর্তন দেখি না। কিছু। স্থানে তারা সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে। ভারতও একইভাবে প্রস্তুতি অব্যাহত রেখেছে। চীনা কমিউনিস্টরা উত্তর-পূর্ব সীমান্তে জঙ্গি তৎপরতার জন্য পূর্ব বাংলায় মিজদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। সংখ্যায় সম্ভবত এরা হবে ১ হাজার থেকে ১২শ’ । তবে চীনাদের দিক থেকে বর্তমানে যে, হুমকি তা সাধারণ পর্যায়ের। পূর্ব পাকিস্তানের সংঘাতকে। কেন্দ্র করে তার সৈন্য বৃদ্ধি করেনি। এ সময় ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব যােগ করেন। যে, চীনারা ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে শুরু করেছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে এখন প্রায় ১ লাখ সৈন্য রয়েছে।
কিসিঞ্জার পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা তিনি জানেন। পশ্চিম পাকিস্তানে কী ঘটছে। তা-ই বলুন। | জগজীবন পশ্চিম সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। যে কোনাে নতুন অস্ত্র। সরবরাহ ভারতের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশকে দেখা উচিত শান্তি ও স্থিতিশীলতার এক ব্যাপকতর ভিত্তিতে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার করা উচিত যে, পাকিস্তান। বাংলাদেশকে ধরে রাখতে পারবে কি না। পাকিস্তানের সঙ্গে তারা একত্রে থাকলেই
 
কি তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূল হবে?
কিসিঞ্জার : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রশ্ন খতিয়ে দেখছে, যুক্তরাষ্ট্র কী করতে পারে ।
জগজীবন যুক্তরাষ্ট্র অনেক কিছুই করতে পারে। গােটা পাকিস্তানটাই টিকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের অনুকপায়। আপনি কি একমত নন?
কিসিঞ্জার অংশত।
জগজীবন ভেবে দেখুন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বৃদ্ধিতে আপনাদের সমর্থন কতটুকু? উদ্বাস্তু সমস্যা একটি অব্যবহিত সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য যথেষ্ট । মানুষ যদি ভাবে তারা ভারতে থাকার জন্য আসছে, তাহলে তা একটা বিরাট সামাজিক উদ্বেগের জন্ম দিতে পারে। কিন্তু সেটা যদি উপেক্ষাও করা হয়, তাহলেও কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে পেতেই হবে। পাকিস্তানের আর একটি নির্বাচন দরকার হবে। আমি সে ক্ষেত্রে কিছুই মনে করব না। কারণ দেশভাগের দিনগুলাে থেকেই। বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দকে আমার জানা আছে। পাকিস্তান যদি বাইরে থেকে বিপুল সাহায্য না পায় তাহলে তাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
কিসিঞ্জার পাকিস্তান বর্তমানে বিপুল সাহায্য পাচ্ছে না। জগজীবন পাকিস্তান কিন্তু সে ধরনের সাহায্য লাভের আশায় দিন গুনছে।
কিসিঞ্জার : যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্নতার পক্ষে নয়। আমরা একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে। আমরা ভারতকে মিসলিড করতে চাই না। আমরা এমন একটা পরিস্থিতি চাই যাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে পারে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, এই সমস্যা সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে স্থির দৃষ্টিভঙ্গি নেই।  জগজীবন তিনি পূর্ববাংলার পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের সমান গুরুত্ব দিতে নারাজ। পাঞ্জাবি শাসকরা বাঙালিদের বিশ্বাস করে না। এখন পূর্ব পাকিস্তানে এমনকি তাদের পুলিশি শক্তিও নেই। মুজিবুর রহমান কখনাে বিচ্ছিন্নতা চাননি। তাদের ছিল উদারনৈতিক প্রভাব। ভারতের সমস্যা হলাে বর্তমানে প্রায় ৭০ লাখ উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে। একটা সমাধান ছাড়া আমাদের আশঙ্কা হলাে ভারত যে মৌলিক নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা-ই হুমকিগ্রস্ত হবে।  কিসিঞ্জার সমাধান কিভাবে আসতে পারে? মন্ত্রী হয়তাে ভাবছেন, যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফর্মুলা দেওয়া উচিত। যেন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের আর কোনাে সমস্যা নেই! | জগজীবন যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলতে পারে, তাকে এমন একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটে।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন