ফেব্রুয়ারিতে মুজিব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১০০ কোটি ডলার চান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের উন্নয়নে ১০০ কোটি ডলারের সহায়তা চেয়েছিলেন। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে মুজিব বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাকে এক বিলিয়ন ডলার দেয় তাহলে আমি বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের জন্য একটি দুর্গে পরিণত করব।’
২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১, সকাল ৯টা। ঢাকার কনসাল জেনারেল অরচার্ড ব্লাড মুজিব-ফারল্যান্ড বৈঠকের বিবরণ জানিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠান। এতে ফারল্যান্ডের জবানিতে মুজিবের সঙ্গে তার বৈঠকের চিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয়। ‘আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ঢাকার বাসভবনে দেখা করি। তিনি আমাকে আন্তরিক উষ্ণতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাকে অবশ্য কিছুটা নার্ভাস মনে হচ্ছিল। আমার সঙ্গে আলােচনার মােড় কোনদিকে যায় তা নিয়েও তিনি হয়তাে কিছুটা উদ্বেগ অনুভব করে থাকবেন।’ দু-চারটা সাধারণ কথাবার্তার পরেই মুজিব শুরু করেন এভাবে আমাদের এই বৈঠক প্রত্যক্ষ করছেন পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ।’ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন আমাকে, পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি কি ভাবছি, বললাম, একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষক হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক অচল অবস্থায় আমি উদ্বিগ্ন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে তিনি এ বিষয়ে উত্তম পর্যবেক্ষণ দিতে সক্ষম।’ মুজিব তখন বলেন, পাকিস্তানে আজ যে সংকট উপস্থিত তা শুধু ভুট্টোর সৃষ্ট নয়, এটা এমন এক পরিস্থিতি যা ‘আইয়ুবের সমর্থনকারী গােষ্ঠী’ ডেকে এনেছে।’ তিনি বলেন, ভুট্টো সম্ভবত নিজের বিবেচনায় চালিত হচ্ছেন না। কারণ, তার তেমন কোনাে সংগঠিত রাজনৈতিক দল নেই। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তাদের একাংশের সমর্থন ও সহায়তা ছাড়া ভুট্টোর অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়বে। ভুট্টোর অবস্থান সামরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অত্যধিক ব্যয়ের অনুকূলে।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ভুট্টো কি ন্যাশনাল এসেম্বতে যােগ দেবে বলে আপনি মনে করেন? জবাবে তিনি বলেন, তিনি এখন তেমনটা মনে করেন। কারণ, আওয়ামী লীগ তাকে ভেতরে আসতে বাধ্য করছে। সুতরাং ভুট্টোর দেখা মিলতে পারে বৈ কি। তিনি রসিকতা করে বলেন, হাবা গরু শেষ পর্যন্ত তার এমএনএদের নিয়ে প্রবেশ করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের দিকেই যাত্রা করবে। আর এরকম একটি মুহূর্তে বাংলাদেশের জীবন সংগ্রাম শুরু হবে। আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা বলুন তাে পিপিপি এবং আওয়ামী লীগ যে অবস্থান নিয়েছে তা কতটা কাছাকাছি? তিনি বলেন, এই অবস্থানে এতটাই ব্যবধান যে, তিনি অনুমান করেন, কোনাে সমঝােতায় পৌছানাের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ অথবা শূন্যের কোঠায় বললেও চলে। নির্দিষ্টভাবে তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ এবং তিনি দলের পছন্দের নেতা হিসেবে ছয় দফার সঙ্গে কোনাে আপােসে যেতেও পারেন না এবং তিনি তা করবেনও না। তার কথায় তিনি ছয় দফাকে পূর্ব পাকিস্তানের জীবনের অংশে পরিণত করেছেন। তিনি বলেন, ভুট্টোই চেয়েছিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে মুজিব ভুট্টোর পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে বলেন, আমি তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করি। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, কমিউনিস্ট চীনের প্রতি তার ভালােবাসা আবার ভারতের প্রতি তার আচরণ ভীষণরকম একপেশে। শেখ এক পর্যায় তার কমিউনিস্টবিরােধী দৃষ্টিভঙ্গির এবং এই অঞ্চলে চীনের ভূমিকার বিপদ। সম্পর্কে বর্ণনা দেন। ভারত সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশ তার সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং এই এলাকার ঐতিহাসিক বাণিজ্য রুটগুলাে পুনরায় চালু করবে। তিনি অভিমত দেন যে, এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভুট্টোর যে মতভিন্নতা তা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। ব্লডের টেলিগ্রাম থেকে দেখা যাচ্ছে, এই পর্যায়ে মুজিব কিছুটা আকস্মিকভাবেই রাজনৈতিক সুরে ঝাড়া দশ মিনিট বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি তার দেশ ও তার জনগণ তারই পেছনে রয়েছে এবং কট্টরপন্থী কমিউনিস্টদের একটি ছােট্ট দল তার বিরােধিতা করছে বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, কমিউনিস্টরা তার দলের তিন নেতাকে হত্যা করেছে। এসময় তিনি এমনকি ইতােমধ্যেই কয়েকজন কমিউনিস্টকে আওয়ামী লীগ কর্তৃক পাল্টা হত্যা করার প্রতিও ইঙ্গিত দেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে তিনি কিভাবে কারাবরণ করেছেন, তার একটা বৃত্তান্ত দিয়ে বললেন, যদি ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতি মােকাবেলায় তিনি বুলেটের মুখােমুখি হতে ভীত হবেন না। তিনি এ সময় নাটকীয়ভাবে দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, তাকে কারাগারেই পাঠানাে হােক কিংবা ‘কেটে খণ্ড খণ্ড করা হােক’- কিছুতেই তার যায় আসে না। এবং অবশ্যই তিনি কোনাে অবস্থাতেই তার জনগণের কাছ থেকে যে ম্যান্ডেট তিনি পেয়েছেন তা থেকে বিচ্যুত হবেন না। মুজিব এ সময় ধরা গলায় স্বগতােক্তি করেন, তিনি বিচ্ছিন্নতার পরিবর্তে একটি কনফেডারেশন চান। যার আওতায় বাংলাদেশের জনগণ বৈদেশিক সাহায্যের ন্যায্য ও উপযুক্ত হিস্যা লাভ করবেন। তারা তখন আর বিশ শতাংশের ভাগীদার থাকবে না। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার ষাট শতাংশের যােগানদাতা হচ্ছে ‘আমার দেশ’। ইসলামাবাদ তাহলে কোন যুক্তিতে আমাদের দিকে পাটকেল ছুড়ে দেয়? বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, পাকিস্তান বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকট মােকাবেলা করছে। তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কার্যত প্রায় নিঃশেষিত। তিনি এ সময় বলেন, সত্যি বলতে কি, এই যে সংকট তা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। তার দলকে বশংবদ বানাতে পশ্চিম পাকিস্তানের আর আর্থিক ক্ষমতা নেই। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান এই মুহূর্তে জাপানের কাছ থেকে বিরাট সাহায্যের আশায় হাত পেতেছে এবং যদি তারা এটা বাগাতে পারে তখন ‘আমাদের পর্যুদস্ত করবে’। মুজিব এ পর্যায়ে নির্দিষ্টভাবে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কনসাের্টিয়াম কি বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সমর্থন দেবে?
আমি তাকে বললাম, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার এই সত্য উপলব্ধি করা উচিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপমহাদেশের অর্থনৈতিক কল্যাণ কামনায় অতীতের মতােই তার সহায়তা অব্যাহত রাখতে উন্মুখ থাকবে। আমি নির্দিষ্টভাবে তাকে বললাম, কনসাের্টিয়াম ও আমাদের অর্থনৈতিক সাহায্যের ক্ষেত্রে দুটো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, আগের চেয়ে বর্তমানে অর্থনৈতিক সহায়তার সহজপ্রাপ্য নয়। দ্বিতীয়ত, সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প গ্রহণে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা হয়ে থাকে। প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন হবে সেজন্য পর্যাপ্ত জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ লােকবল দরকার। আমি আমার উদ্বেগ প্রকাশ করে বললাম, পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ উন্নয়নে যে সম্পদ এখন সহজলভ্য তারও সঠিক ব্যবহার কিন্তু অনিশ্চিত। দক্ষ জনশক্তির ঘাটতির কথাও আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। শেখ তখন কেন তার দেশ একটি ভায়াবেল এলাকায় পরিণত হবে তার রূপরেখা দেন। তিনি বলেন, আমাদের রয়েছে গ্যাস সম্পদের বিপুল রিজার্ভ। এটা শুধু স্থানীয় চাহিদাই পূরণ করবে না, এটা ভারতে রফতানিও করা সম্ভব হবে। তার নেতৃত্বে দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হবে। বােরাে শস্যের প্রতি তাই তার বিশেষ আগ্রহ। আমি তখন তাকে পূর্ব পাকিস্তানের অভাবনীয় জন্মহারের কথা স্মরণ করিয়ে দেই। শেখ বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণে তিনি সফল হবেন। জনগণকে তিনি বুঝিয়েশুনিয়ে ছােট পরিবারে মনােযােগী করবেন। মুজিব এ সময় ব্লাডের বর্ণনায় একটা সিরিয়াস মুড’ নিয়ে বললেন, আমি আপনাকে এ কথাটা বলতে যদিও একটু দ্বিধান্বিত, তবু বলতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রের কিন্তু এমন সুনাম রয়েছে যে, যখন একমত হওয়া যায় না এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, তখন সে তার বন্ধু পরিত্যাগেও কুণ্ঠিত হয় না।
তিনি বলেন, ঠিক তেমনই বিশ্বের এই ভূখণ্ডে একমত হওয়া যায় না’- বিভিন্ন ধরনের সমস্যার উদ্ভব ঘটতে চলেছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রকে এটা আবারাে এক পরীক্ষার সম্মুখীন করবে। আমি বললাম, আমেরিকার বন্ধুদের প্রতি তার ভূমিকার বিষয় নিয়ে অন্য সময়ে কথা বলতে তিনি আগ্রহী। আমি আরাে যােগ করি, এটা কিন্তু সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিব তখন বললেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আমাকে এক বিলিয়ন ডলার দেয় আমি সেক্ষেত্রে এমন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলব যা হবে গণতন্ত্রের জন্য এক দুর্গ। এসব কথাবার্তার পরে মুজিব আমাকে মৌলিক প্রশ্নটি করলেন, পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নীতি কি? আমি সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে আমাদের উদ্বেগ চেপে যাই। বললাম, বৈদেশিক সাহায্য বিশ্বের সব ক্ষত নিরাময়ের জন্য কিন্তু উপযুক্ত দাওয়াই নয়। ঠিক প্রশ্নের ঢঙে নয়, মুজিব আমাকে বললেন, আমি বাংলাদেশের বন্ধুদের কাছে এই আবেদন রাখব যে, ঔপনিবেশিক মর্যাদায় যারা আমার জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্রের শক্তি প্রয়ােগ করবে’, তাদের ব্যাপারে তারা যেন তাদের সর্বোচ্চ প্রভাব বিস্তার করেন।
মুজিব বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন ছাত্র হিসেবে তিনি বহু আগেই জেনেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দাতা দেশগুলাে যদি চায় তা হলে তারা এমন পরিস্থিতিতে তাদের বিরাট প্রভাব কাজে লাগাতে পারে। ব্লাড লিখেছেন, প্রশ্নটি যদিও করা হয়নি কিন্তু তার একটি উত্তর অবশ্যই প্রস্তুত করা উচিত। আমরা যা ভাবছি তার চেয়ে দ্রুততম সময়ে এটা দরকার হবে। আমি অবশ্য অনুমান করেছিলাম যে, মুজিব যখন এই বিষয়টি নিয়ে আদ্যোপান্ত এত কথাই বললেন, তখন তিনি হয়তাে স্বীকৃতির বিষয়টিও তুলতে পারেন। যাই হােক তিনি তা করলেন না। আমাদের এই আলােচনা এক ঘণ্টার বেশি সময় স্থায়ী হয়। বিদায় নেয়ার আগে মুজিব বললেন, আমি শুধু নিজের তরফ থেকেই আপনাকে আশ্বস্ত করছি না, একই সঙ্গে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জন্য বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে বাড়িয়ে দিলাম বন্ধুত্বের হাত।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন