নজির নেই এমন হত্যাযজ্ঞের
এ, গফুর (নূপুর) আমরা সদ্য স্বাধীনতা লাভ করেছি প্রায় ২০ লক্ষ ভাইবােনদের রক্ত, ত্যাগ আর তিতীক্ষার বিনিময়ে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, মুক্ত, কিন্তু রূপসী বাঙলার পাতায়-পাতায়, আকাশে বাতাসে, সােনার বাংলার হাটে, মাঠে-ঘাটে দেখেছি লাখাে শহীদের তাজা রক্তের দাগ আর লাখাে কণ্ঠে শুনছি আর্ত কান্নার আওয়াজ। তবু আমরা স্বাধীনতার উষালগ্নে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আনন্দ-সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছি। আমরা আবার আমাদের আত্মীয়-স্বজন-প্রিয়জনকে হারিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে আজো ভগ্নবীনায় সুর, সাধূছি। প্রত্যেকেরই হৃদয় আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত; কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর আমাদের, তবু ঈস্পিত: কাঙ্খিত স্বাধীনতার সােনালী সূর্য বাংলার বুকে উদিত হয়েছে বলে প্রত্যেকেই যেন গাইছি ‘হৃদয় আমার নাচেরে। আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে” কিন্তু হায়! এ নৃত্য বিহবল, পুলক-অনুভব, শিহরণ ঘন মহােৎসব মুহূর্তে একি কথা শুনি আজি? শুনছি বাংলাদেশের যুদ্ধ অবসানের মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে ইয়াহিয়া নিয়াজীর সামরিক বাহিনী এবং তাদের সৃষ্টি আল-বদর ও রাজাকার বাহিনী ঢাকার গৃহে গৃহে হানা দিয়ে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বাংলার অন্যতম সাহিত্যিক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপিকা নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক আনােয়ার পাশা, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সােনার বাংলার প্রথিতযশা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হােসেন, আবুল কালাম আজাদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, গােলাম মােস্তফা, নিজামউদ্দিন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাক্তার বদরুদ্দোজা, ডাক্তার ফজলে রাব্বি, ডাক্তার আলিম চৌধুরী প্রমুখ ১৫০ জনকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছে।
ইতিমধ্যেই কারাে কারাে মৃতদেহ সনাক্ত করা হয়েছে। তাদের একমাত্র অপরাধ, বাংলাদেশকে তারা ভালবাসতেন। তাই তাদের বুকে রক্তের ঢল নেমেছে। তাই এ মুহুর্তেই খুনীদের খুঁজে বের করে সমুচিত শাস্তি প্রদান করা প্রয়ােজন। অধুনা ধৃত, হৃত ও মৃত ব্যক্তিগণ ছিলেন আমাদের সমাজের কণ্ঠস্বর । তাই সমাজের এই কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল খান সেনা ও কুচক্রী মহল। জাতীয় জীবনের এহেন দুর্যোগ লগ্নে তথা আমাদের। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জগতে এখনও লাখাে মেঘের ঘনঘটা। আজ আমরা হাসব না, রঙ্গ রসে মাতবােনা। শুধু কাজ করে যাব, জাতিকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলবাে, জীবিত বন্দীদের মুক্ত করবাে, বিংশ শতাব্দীর গণহত্যার নায়ক বা শতাব্দীর বৃহত্তম ট্রাজেডির নায়ক ইয়াহিয়া, ভুট্টো, টিক্কা, নিয়াজির আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে বিচারের আবেদন জানাব।
বাংলাদেশ (৪) ১: ৯ ॥ ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪