You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.17 | পাকিস্তানী ঘাতকের তান্ডবলীলা সুদীর্ঘ আটমাস - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানী ঘাতকের তান্ডবলীলা সুদীর্ঘ আটমাস

বাঙালীর উপর পাক সৈন্যরা যে অত্যাচার চালিয়েছে তার অবসান আজ দ্বারপ্রান্তে। ইতিমধ্যে বেশ কতকগুলাে এলাকাতেই শত্রুর শেষ ঘাটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশের প্রসাশনও চালু হয়েছে সত্যি, কিন্তু সাথে সাথে অত্যাচারের অনেক নােতুন কাহিনীও আমরা অবগত হচ্ছি। যশাের জেলায় সদ্যমুক্ত বন্দীদের বর্ণিত অত্যাচারের কাহিনী সারা বাঙলা জুড়ে পাকসৈন্যের ব্যাপক অত্যাচারেরই একটি অংশ মাত্র। যশােহর মুক্ত হয়েছে আজ বেশ কদিন হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনও চালু হয়েছে সেখানে। কিন্তু যশােহরের সর্বত্রই চোখে পড়ে পাক দস্যুদের ধ্বংস যজ্ঞের ছাপ। ঝিকরগাছা ওয়াপদা মাঠে এখনাে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে রয়েছে মরা মানুষের স্তুপ। তা থেকে এখনও পচা দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর লােক সন্দেহ করে পাক সৈন্যেরা গ্রামের নিরীহ লােক যাকেই পেয়েছে তাকেই খুন করেছে। আর এদের সাথে সহযােগিতা করেছে বাঙলার কুসন্তান রাজাকারের দল।

মেহেরপুর মুক্ত করে মুক্তিবাহিনী যখন কুষ্টিয়ার দিকে এগিয়ে যান তখন কোর্ট চাঁদপুরে একজায়গায় তারা প্রায় দেড়শত বাঙালীকে কবর দেয়া অবস্থায় দেখতে পান। এই লাশগুলাে এখন গলতে শুরু করেছে। স্থানীয় জনসাধারণ মারফৎ জানা যায় যে পাক সৈন্যরা পায় ৫০০ জন লােককে মেহেরপুরে হত্যা করে। ঝিকরগাছায় পাক সৈন্যদের হাতে নৃশংস ভাবে খুন হয়েছেন ৩০০ জন। যশােহর সদরে দফায় দফায় প্রায় চার হাজার লােককে পাক দস্যুরা হত্যা করে। জনৈক পাদ্রী ডােমদের মারফৎ হিসাব করে এই মৃতের সংখ্যা জানান। পাক সৈন্যরা নির্বিচার হত্যা চালায় নাভর এলাকাতেও। স্থানীয় জনগণ আরাে জানান যে যখনই নরঘাতকদের সন্দেহ হয়েছে তখনই তারা তাজা তাজা তরুণদের গুলি করে হত্যা করেছে।  গ্রামবাসীরা আরাে জানান যে এখন দুর্গন্ধ সে তুলনায় অনেক কম। কিছুদিন আগেও এইসব এলাকায় দুর্গন্ধের দরুণ চলাচল করা সম্ভব ছিল না। শত শত নিরীহ গ্রামবাসীকে ডেকে এনে গর্ত তৈরী করা হতাে। এবং সেই গর্তের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে শেষ বারের মতাে ঐসব গর্তে ফেলে দেয়া হতাে। স্বামীর সামনে তাদের স্ত্রীকে বেইজ্জত করা হয়। কাহিনী বলতে গিয়ে গ্রামবাসীরা সবাই-ই প্রায় কাঁদছিলেন।

গণহত্যা ছাড়া বেশ কিছু সংখ্যক লােককে পাক সৈন্যরা বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দী করে রাখে। এই বন্দীদের দেহ থেকে পাক দস্যুরা জোর করে রক্ত বের করে নিত। তাছাড়া মুক্তিবাহিনী সন্দেহে ধৃত এই সব বন্দীদের ওপর প্রতিদিন চলতাে নানা ধরনের অকথ্য নির্যাতন। গত আট মাসে প্রায় ২৫০ জন লােককে যশােহর কারাগারে আটক রাখা হয়। এই বন্দীদের মধ্যে সরকারী ও বেসরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। তাছাড়া ১৯৬ জন। মুক্তিযােদ্ধা এবং ৪৭ জন পুলিশকেও বন্দী করা হয়। পাক সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে ছয় বছরের কিশাের সাধন এবং ১০ বছরের খােকনকেও পাক সৈন্যরা বন্দী করে রাখে। গত মে মাসে পাক সৈন্যরা খুলনা জেলার জেলা প্রশাসককে গ্রেফতার করে। তাঁকে যখন যশাের ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি সেখানে বহু বাঙালী সামরিক অফিসারকে বন্দী অবস্থায় দেখতে পান। অবাঙালী সৈন্যদের উচ্ছিষ্ট খাদ্য এই সব বন্দীদের জোর করে খাওয়ানাে হতাে। ১৪ই সেপ্টেম্বর তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হয়। কারাগারের বেত্রাঘাত দন্ড এবং ফাঁসির মঞ্চটি তখন নােতুন করে। সারানাে হচ্ছিল। বাঙালী সামরিক অফিসারদের অনেককেই ইতিমধ্যে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি পাক সৈন্যদের কারাগার থেকে সদ্যমুক্ত বন্দীরা সকলেই জানান যে স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্যে পাক ঘাতকরা বন্দীদের আঙুলের ভেতর পেন্সিল ঢুকিয়ে চাপ দিত, পায়ের তলায় বেত মারত এবং বুট জুতা দিয়ে মুখে লাথি মারতাে। ফলে অনেকের দাত ভেঙে গেছে।

অভিযান ॥ ১ : ৪ | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪