ঢাকায় ত্রাসের রাজত্ব
পাক হানাদাররা পুনরায় গণহত্যায় লিপ্ত গত ১৭ই নভেম্বর বুধবার দিন পাকিস্তানী সামরিক জান্তার ঘাতকরা সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারী করে বাড়ীতে বাড়ীতে ঢুকে ব্যাপক গণহত্যা, লুঠতরাজ ও নারীর শ্লীলতাহানী করে। ঢাকা নগরীতে জল্লাদদের এই তান্ডবলীলা ২৫শে মার্চের বীভৎসতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু পাক দস্যুদের এই উন্মত্ত তান্ডবলীলা সত্ত্বেও ২৫শে মার্চ ও ১৭ই নভেম্বরের ঘটনাবলীর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। পাকিস্তানী ঘাতকরা এই দিন ২৫শে মার্চের মত অবাধে একতরফা হত্যাকান্ড চালাতে পারেনি। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মহল্লায় আমাদের মুক্তি বাহিনীর দেশপ্রেমিক গেরিলাযােদ্ধারা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে অসীম সাহসের সঙ্গে হানাদারদের মােকাবিলা করে এবং একমাত্র ঢাকা শহরেই মােট ১০০ জন দালাল রাজাকার , পাকিস্তানী সৈন্য ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে হত্যা করে।
ইয়াহিয়ার ‘গাধা” ডাক্তার মালিককে দখলীকৃত বাংলাদেশের গভর্ণর নিযুক্ত করে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা নিজেদের বিষাক্ত নখর দন্তকে আড়ালে ঢেকে রাখতে চেয়েছিল। তারা দুনিয়াকে দেখাতে চেয়েছিল যে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে। এসেছে এবং হানাদার বাহিনীর জুলুম ও নির্যাতন বলে কোন বস্তুর অস্তিত্ব নাই। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে, এখন খােদ ঢাকা শহরেও মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক ও সফল অভিযানে বিভ্রান্ত সামরিক জান্তা অসামরিক শাসন ও ভালমানুষীর মুখােষ ছুড়ে ফেলে দিয়ে পুনরায় বাঙালীদের হত্যা করতে শুরু করেছে। মুক্তিযােদ্ধারা বাধ্য করেছে ডাক্তার মালিকের তথাকথিত অসামরিক সরকারের তুচ্ছতা ও অর্থহীনতাকে ফাস করে দিতে এবং হানাদারদের স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে। সমগ্র ঢাকা শহরকে তারা এখন একটি অবরুদ্ধ নগরীতে পরিণত করেছে। শহরের পাঁচটি থানা ৫ জন ব্রিগেডিয়ারের কর্তৃত্বে ট্রাক বােঝাই হানাদার সৈন্যরা বাড়ী বাড়ী হানা দিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে তরুণ বাঙালীদের হয় হত্যা করেছে নয়তাে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অকথ্য নির্যাতন করেছে।
মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হানাদাররা এতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে যে, কারফিউ জারীর কথা পূর্বাহ্নে জানিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে তারা সতর্ক পর্যন্ত করেনি। কারফু শুরু হবার প্রায় তিন ঘণ্টা পরে ঢাকার জনসাধারণকে কারফুর কথা জানানাে হয়। প্রথম পর্যায়ে একটানা প্রায় ১৫ ঘণ্টা পর কারফু কাগজে কলমে তুলে নেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে হানাদারদের আচার আচরণে কারফু অব্যাহত রাখা হয়েছে। কারফু-এর প্রথম পর্যায়ে এমনকি ডাক্তার, সাংবাদিক ও রেডিওর গাড়ীকেও পথে বের হতে দেয়া হয়নি। এখানে প্রাপ্ত এক খবরে প্রকাশ, পাক হানাদাররা এই দিন প্রায় এক হাজার নিরীহ অসামরিক অধিবাসীদের হত্যা করেছে। শহরে হানাদাররা নতুন করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করায় পুনরায় দলে দলে লােক নিরাপদ এলাকার সন্ধানে শহর ত্যাগ করতে শুরু করেছে।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ৩০ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪