পাক দূতাবাসগুলিতে শয়তানের অনুচর
পাকিস্তানের সমরনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়ার তখত তাউস টলটল করে উঠেছে। তাই তার মেজাজ সবসময় চড়ে থাকে। এক বৃটিশ সংবাদদাতার মতে গত তিন মাস ধরে তিনি নাকি ভয়ঙ্কর রকম চটে আছেন। এ সময়ের মধ্যে একবারও নাকি শান্ত অবস্থায় তাঁকে দেখা যায়নি। এই মনােবিকলনটা তাদের বাঙালী বিদ্বেষ হিসেবে ভারী উদ্ধত এবং অশােভনভাবে মার্চের পঁচিশ তারিখের পর থেকে প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছে। প্রতিটি নাজী যেমন হিটলার বলে মনে করতাে নিজেকে, তেমনি ইয়াহিয়ার প্রতিটি অনুচরও নিজেকে ইয়াহিয়া বলে ভাবতে শুরু করেছে। তাদের ভাবভঙ্গী, আচার-আচরণ সবকিছুই জেনারেল ইয়াহিয়ার মতাে। নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা দিল্লীর পাকিস্তান হাই কমিশনের জনৈক ব্রিগেডিয়ার গােলাম হাসানের কাহিনী প্রকাশ করেছেন। এই গােলাম হাসান লােকটির নামের আগে ব্রিগেডিয়ার দেখে যে কেউ তাকে সামরিক বাহিনীর লােক মনে করতে পারে।
আসলে সে হচ্ছে পাকিস্তান হাই কমিশনের এ্যাটাচি। কয়েক সপ্তাহ আগে দিল্লীর পাকিস্তানী হাই কমিশনের বাঙালী কর্মচারীরা। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে বেরিয়ে আসার সময়। হাইকমিশনের পাকিস্তানী কর্মচারীরা তাদের সামনে নানা বাধার সৃষ্টি করে এবং প্রলােভনমুগ্ধ করতে চেষ্টা করে। তা সত্ত্বেও বাঙালী কর্মচারীরা খুনী ইয়াহিয়া সরকারের কাজ করবেন না বলে দূতাবাস ছেড়ে চলে আসেন। প্রকাশ তখন এই হামানই বাঙালী কর্মচারীদের বলেছিলাে, মনে রাখবে আমি পাঠান, দরকার হলে তােমাদের গুলী করে মারবাে। বাঙালী জনাব হােসেন আলীকে পাকিস্তান হাইকমিশনে গুম করে। দেয়া হয়েছে। তার মুক্তির জন্য বারবার আবেদন নিবেদন করেও কোনাে ফল পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান। হাই কমিশন এই আবেদন নিবেদন এবং বিক্ষোভে কোনােরকম কর্ণপাত করেননি বললেই চলে। পিতার। মুক্তির জন্য জনাব হােসেন আলীর দুই শিশু পুত্রের প্রার্থনাও বৃথা গেছে। বস্তুত: বাঙালী কর্মচারী হােসেন আলী পাকিস্তান হাই কমিশনের জিন্দানখানায় বন্দী। তাকে মুক্ত করা এখনাে সম্ভব হয়নি।
বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘােষণার পর থেকে প্রতিটি দূতাবাসের বাঙালী কর্মচারীবৃন্দ একে একে দূতাবাস ছেড়ে চলে এসেছেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদান। করেছেন। জনাব হােসেন আলীর ভাগ্য এবং হাসানের পাশবিক কীর্তির কথা প্রকাশ হওয়ার পরে, কারাে। অনুমান করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, দূতাবাসগুলােতেও পাকিস্তান ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। যে সকল বাঙালী বাঙলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদান করতে ব্যগ্রভাবে ইচ্ছুক, তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রে জোর করে আটক রাখা হয়েছে। নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশনের ঘটনাই তার প্রমাণ।
নয়াদিল্লী পাক হাই কমিশনের এই নব্যনায়ক গােলাম হাসান কেমন মানুষ তার চাকুরী জীবনের। নথিপত্র ঘাঁটলেই তার বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে প্রকাশ। বাঙালী বিদ্বেষই ছিল তার পদোন্নতির মুখ্য সােপান। ১৯৬৯ সালের জঙ্গীলাট আয়ুবের আমালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পর্দার অন্তরাল থেকে যারা কলকাঠি নেড়েছিলাে এই গােলাম হাসান তাদের একজন। আগরতলা মিথ্যে মামলার ঠেলায় আয়ুব খানকে সিংহাসন ছাড়তে হয়। কিন্তু গােলাম হাসান ইয়াহিয়ার সুনজরে পড়ে যায়। এই গােলাম হাসান এবং তার মতাে মানুষেরা কতােদূর কাপুরুষ একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই তা পরিষ্কার হবে। গত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সহ। বিজয় অর্জন করেছিলেন এবং ইয়াহিয়া ঘােষণা করেছিল, তিনিই দেশের ‘ভাৰী’ প্রধানমন্ত্রী, তখন গােলাম হাসান তার কাছে করজোড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘স্যার আমি একজন সরকারের নগন্য নওকর মাত্র।’ পাকিস্তানের দূতাবাসগুলিতে বাঙালী কর্মচারী গােলাম হাসান শ্রেণীর লােকদের হাতে এতকাল। কিভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য।
অভিযান ॥ ১; ২ ২৫ নভেম্বর ১৯৭১।
পাক বাহিনীর বর্বরতা
নবাবগঞ্জ হতে পলায়নরত পাকবাহিনীর বিরাট দলটি গতকাল পথিমধ্যে বিভিন্নস্থানে বাধা পেলে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরে পশু সেনারা জাইল, বেনুখালী ও খারশুলের বহু নিরীহ জনগণের বাড়িঘরে । আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে বহু মেহনতি জনগণ পথের ভিখারীতে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ (৪) ॥ ১ : ৪ ॥ ২৬ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪