নারী নির্যাতন যাকে হার মানায়
(ষ্টাফ রিপাের্টার)। মুজিবনগর, ২৪শে নভেম্বর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দস্যু পাকফৌজ ১০০টি বন্দী শিবিরে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে লক্ষাধিক নরনারীর উপর দিনের পর দিন মাসের পর মাস যে লােমহর্ষক অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তার সামান্য কিছু সংবাদ সম্প্রতি আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। এই সংবাদে প্রকাশ, ঐ সব বন্দী শিবিরে বাঙ্গালী নারী-পুরুষকে সৈন্যদের কড়া প্রহরায় রাখা হয়েছে। তাদের প্রতিজনের দৈনিক খাবার হিসেবে মাত্র দু’খানা আটার রুটি ও একটু ডাল দেয়া হয়। খালি মেঝেতেই তাদের ঘুমাতে হয়। প্রত্যেক দিন তাদের দিয়ে পায়খানা ও নর্দমা সাফ করানাে হয়। তাদের মাটি কাটতে ও মাটি বহন করতেও বাধ্য করা হয়। তাছাড়া তাদের উপর যে শারীরিক নির্যাতন চালানাে হয় তা শুনলে বােধ করি হিংস্র পশুরাও ঘৃণায় ও বিস্ময়ে আঁৎকে উঠবে। আঙ্গুলে সূচ ফোটানাে, নখ উপড়ে ফেলে তাতে আবার ছােট ছােট পেরেক ঠুকে দেয়া, চামড়া কেটে উল্টে নিয়ে তাতে লবণ ছিটিয়ে দেয়া, যৌনাঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে এবং গুহ্যদ্বারে শলাকা বিদ্ধ করে দেয়া, সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে বরফের মধ্যে বসিয়ে রাখা, জলের গামলার মধ্যে মাথা ডুবিয়ে দিয়ে সেই জলে বিদ্যুপ্রবাহ বইয়ে দেয়া, মাংস কেটে কাটা স্থানে জ্বলন্ত দেয়াশেলাইর কাঠি বা সিগারেট লাইটার চেপে ধরা। এ সবই হচ্ছে নরঘাতক বর্বর ইয়াহিয়ার পশু সৈনিকদের বাঙ্গালীদের উপর অমানুষিক অত্যাচারের আংশিক ফটোগ্রাফ। শুধু এতেই তারা তৃপ্ত নয়। জীবন্ত কবর দেয়া, বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে খুঁড়ে তাদের। মেরে ফেলার আরব থেকে আমদানী করা পবিত্র ইসলামী পন্থাও তারা অবলম্বন করে চলেছে। পাক-পশুরা সুন্দরী তরুণীদের যৌবনসুধা আর দেহলাবণ্য দিয়ে অহরহ তাদের পাশবিক পিপাসা পরিতৃপ্ত করে চলেছে, এটাতাে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বলাবাহুল্য এইসব বন্দীশিবিরগুলি সেনাবাহিনীর ঘাঁটিগুলির কাছেই তৈরী করা হয়েছে।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৬
২৫ নভেম্বর ১৯৭১
পাক জঙ্গীচক্রের নির্যাতন শিবির
গত আট মাস ধরে বাঙলাদেশের জনসাধারণের উপর পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনী যে বর্বর অত্যাচার চালিয়েছে তার প্রত্যেকটি ঘটনার খুটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করা কোনদিনই হয়ত সম্ভব হবে না। শত শত অত্যাচারের কাহিনী বিশ্বের গােচরীভূত হয়েছে। কিন্তু হয়নি অমন আরাে হাজার হাজার ঘটনা। পাকিস্তানী দখলদার দস্যুদের হাত থেকে বাঙলাদেশের বীর মুক্তিযােদ্ধারা যে সমস্ত এলাকা পুনরুদ্ধার করেছেন সম্প্রতি সেই সব অঞ্চল থেকে পাকিস্তানী বর্বরতার কয়েকটি লােমহর্ষক বিবরণ আমাদের হাতে এসেছে। মুক্তিবাহিনী গত ১৫ই নভেম্বর রংপুর জেলার ভুরুঙ্গামারী শহরটি উদ্ধার করেছেন এবং হানাদার পাক সেনাবাহনীকে সেখান থেকে উৎখাত করেছেন। মাত্র কয়মাসের ব্যবধানে উত্তরাঞ্চলের এই নিরিবিলি শহরটি পাকিস্তানী অত্যাচারের দাপটে একটি প্রাণহীন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। শহর দখলের আগে মুক্তি বাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহ সহ ২৫ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে এবং লেফট্যানন্ট নিয়াজ সহ মােট ১২ জন শত্রুসৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।
শক্রর মূল ঘাঁটি দখলের পর সেখানে এক তালাবদ্ধ ঘর থেকে ১০/১১ বছরের কিশােরী সহ মােট ২৫ জন মহিলাকে উদ্ধার করা হয় অনাহারে অর্ধাহারে এবং অবিশ্রান্ত পাশবিক অত্যাচারের ফলে বন্দী। মেয়েদের প্রায় সকলেরই মানসিক বিকৃতি দেখা দিয়েছে। অন্য একটি স্কুল ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আরাে কিছু পুরুষ এবং শিশুকে। এদের প্রত্যেকেই পাকিস্তানী নির্যাতনের যে লােমহর্ষক কাহিনী শুনিয়েছে তা মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধাদের বিজয় উল্লাসকে যেন মুহুর্তে নিভিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুল লতিফের তরুণী স্ত্রীর কাহিনী। চল্লিশ বছর বয়স্ক ধর্মপ্রাণ আবদুল লতিফ স্থানীয় বহু সংখ্যক ছেলে মেয়েদের পবিত্র কোরাণ শিক্ষা দিতেন। পাকিস্তানী সেনাধ্যক্ষর লালসা নিবৃত্তির প্রয়ােজনে নিজের স্ত্রীকে সমর্পণ করতে চাননি আবদুল লতিফ ফলে তাঁকে প্রাণ দিতে হলাে।
কিন্তু তাকে বলা হলাে যে মুক্তিবাহিনীর লােকেরা তার স্বামীকে হত্যা করেছে, স্বামীর জন্য শােক প্রকাশের অবকাশ না দিয়েই তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলাে ক্যাপ্টেন আতাউল্লার কামরায় শােকার্তা রমনী দস্যু লালসার ইন্ধন হতে চাইলেন না বলে তার একটি সন্তানকে তার চোখের সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলাে। বাকী দুটি সন্তান কোনক্রমে পালিয়ে চলে গেলাে। তারপর থেকে পরবর্তী পাঁচ মাস তার দেহ নিয়ে ওরা বর্বরতম উপায়ে ছিনিমিনি খেলেছে। ভুরুঙ্গামারী মুক্ত হবার পর মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় তিনি তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন। অপর সন্তানটির খবর এখনাে পাওয়া যায়নি। এগারাে বছরের নিস্পাপ কিশােরী জমিলা খাতুন আর তার মাকে স্থানীয় গ্রাম থেকে পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। একত্রে মা মেয়ের উপর সেই লােমহর্ষক পাকিস্তানী পশ্বাচার । চল্লিশ বৎসর বয়স্কা পূর্ণ গর্ভবতী আমেনা খাতুনকে শারীরিক অসুবিধার জন্যে লালসা মেটানাের প্রয়ােজনে অনুপযুক্ত দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাে জনৈক পাকিস্তানী বর্বর। বিনা দ্বিধায় আমিনা বেগমের পেটে সবুট পদাঘাত করে তাকে ধরাশায়ী করলাে নরপশু। পদাঘাতে গর্ভস্রাবের অসহ্য বেদনায় রক্তাক্ত আমেনা বেগম চেতনা হারিয়ে ফেললেন। তারপর মাত্র একটি দিনের ব্যবধানে তারা অশক্ত নারীদেহ জল্লাদ পাকিস্তানীদের বলকারের লীলাভূমিতে পরিণত হলাে। প্রায় ৫০০ বন্দীর সকলেই পাকিস্তানী নৃশংস নির্যাতনের এক একটি কাহিনী বিবৃত করেছেন এ কাহিনীর যেন শেষ নেই।
অভিযান ॥ ১: ২
২৫ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪