You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.12 | কমপক্ষে ৪৪ জন গ্রামবাসী হত্যা- বাড়ী-ঘরে অগ্নিসংযােগ - বাংলাদেশের বধ্যভূমিতে কি দেখেছি - সংগ্রামের নোটবুক

কমপক্ষে ৪৪ জন গ্রামবাসী হত্যা, বাড়ী-ঘরে অগ্নিসংযােগ- পাক সেনারা শ্রীরামসী গ্রাম ধ্বংস করে দিয়েছে

(স্টাফ রিপাের্টার) সিলেট, ১৫ই অক্টোবর—সম্প্রতি জগন্নাথগঞ্জ থানার শ্রীরামসী (শিরামিসি) গ্রামের কমপক্ষে ৪৪ ব্যক্তিকে পাক সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে এবং গ্রামখানি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে ।  ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, বেশ কিছুদিন আগে সকাল দশটার দিকে ৫ জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে ২৯ জন পাক সেনার একটি দল শ্রীরামসী গ্রামের বাজারে আসে ‘শান্তি কমিটি গঠনের অজুহাত দেখিয়ে। এরপর কমিটি গঠনের উদ্দেশ্যে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক, তহসিলদার, পােস্টমাস্টার, পিয়ন, দোকানদার এবং জনসাধারণকে জনৈক রইসুল্লাহর ঘরে একত্রিত করে এবং রাজাকারদের সহায়তায় উপস্থিত সকলের হাত-পা বেঁধে ফেলে। উপস্থিত ব্যক্তিদের আর এই অপূর্ব সমাদরের পরিণতি বুঝতে বাকী রইল না। এরপর পাক-সেনারা দু’টি নৌকায় করে নিরীহ গ্রামবাসীদের রইসুল্লাহর বাড়ীর নিকট একটি বাগানের (বাজারের উত্তর পশ্চিমে) কাছে নিয়ে আসে এবং এক নৌকার সমস্ত লােককে গুলী করে হত্যা করে। অপর নৌকাটিকে বর্বর পাক সেনারা বাজার সংলগ্ন জনৈক নজির মিয়ার বাড়ীর পাশের একটি জলাশয়ে ডুবিয়ে দেয়। হাত-পা বাঁধা নিরপরাধ লােকগুলি অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যায়।  যাবার সময় পাকসেনারা গ্রামবাসীদেরকে এই মর্মে নির্দেশ দিয়ে যায়—যেন নিহতদের দাফন অথবা সৎকার করা না হয়।

পরদিন হানাদাররা আবার ঠিক একই সময়ে এই শিরামিসিতে হানা দেয় কিন্তু লােকজন ইতিপূর্বেই অন্যত্র চলে যায়। ফলে লােকজন না পেয়ে পশ্চিমা দস্যুরা পার্শ্ববর্তী রসুলপুর, দীঘির পাড়, কচড়াকেলি এবং ছিক্কা এলাকার সমস্ত বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়। ঐদিন এখানে যারা বর্বর দস্যুদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন। মি: সাদুজ্জামান (সহকারী প্রধান শিক্ষক, শিরামিসি হাইস্কুল), একলাস মিয়া (লন্ডনে বসবাসকারী), আবদুল বারী (লন্ডনে বসবাসকারী), মসন্দর আলী (লন্ডনে বসবাসকারী), আসাব মিয়া (লন্ডনে বসবাসকারী), নজীর মিয়া, আবদুর রউফ, গেদা মিয়া, মজিদুল, আব্দুল, ছমির আলি, রুসমত আলী, স্থানীয় পােস্ট মাস্টার ও পিয়ন, তহসিলদার ও তার পুত্র, মডেল স্কুলের জনৈক হিন্দু শিক্ষক এবং জনৈক ডাক্তার। এছাড়া এখানে শ্বশুরবাড়ী বেড়াতে এসে বিশ্বনাথ থানার বাউশী মৌজার (চক নামে পরিচিত) জনৈক লন্ডনে বসবাসকারী ও পাক জল্লাদের হাতে নিহত হন।

সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১ : ৪৪ ১১ নভেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের বধ্যভূমিতে কি দেখেছি

নরমুন্ডের গেন্ডুয়া খেলা বা নর রক্তের হােলি খেলার নজীর বিশ্বের ইতিহাসে বিরল নয়। এ খেলা খেলেছিল চেঙ্গিস, হালাকু খানরা। আর সমসাময়িক ইতিহাসে খেলেছে হিটলার। লাখাে লাখাে দেশবাসীকে গ্যাস চেম্বারে পুরে হত্যা করতে তার বিবেকে বাঁধেনি। মুসলমানদের ইতিহাসেও এর নজীর আছে। কারবালার প্রান্তরে মুসলমান নামধারী জল্লাদ ইয়াজিদের সেনাবাহিনী তার নজীর রেখে গেছে। নজীর রেখে গেছে সীমার। কারবালার প্রান্তরে এই মুসলমান নামধারী নর পিশাচরা তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি যে নির্দয় আচরণ করেছিল তা চিরকাল মানবেতিহাসের কলঙ্ক হয়ে থাকবে। প্রতি পক্ষের লােকদের, এমন কি নিরীহ নিরস্ত্র নারী ও শিশুদেরও তারা রেহাই দেয় নি সেদিন। পানির বদলে শিশুদের দিয়েছিল তীরের তীক্ষ আঘাত। শুধু তাই নয়, হােসেনের মুন্ড বর্শার মাথায় গেঁথে পাষন্ড সীমার পৈশাচিক আনন্দ করতে করতে দামেস্কে তার প্রভুর কাছে নিয়েছিল। তেমনি পৈশাচিক আচরণ করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান নামধারী ব্যক্তিরা ইয়াহিয়ার, টিক্কার সেনাবাহিনী। গত ২৫শে মার্চের পর তারা পাখি শিকারের মত খােস মেজাজে বাঙ্গালীদের হত্যা করেছে। তারা হত্যা করেছে নারী, শিশু নির্বিশেষে সকলকে।

শুধু বাঙ্গালীদের হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। মৃত লাশের উপর বসে আনন্দ করেছে। সন্ধ্যার পর সামরিক ছাউনীতে বসে বসে সারাদিনে কে কতটা বাঙ্গালী মেরেছে, কতজন বাঙ্গালী মা-বােনের ইজ্জত নষ্ট করেছে তা নিয়ে পৈশাচিক আনন্দ প্রকাশ করেছে। কথাগুলাে বলেছেন, বিলাতের ‘সানডে টাইমসূ’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ও পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট্রের কাগজ মর্নিং নিউজের ভূতপূর্ব সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস। কিছুদিন আগে তিনি বাঙলাদেশ পরিদর্শন করতে আসেন সাংবাদিক হিসাবে। বাঙলাদেশে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের যে চেহারা তিনি দেখেন তাতে তিনি নিদারুণ ভাবে মর্মাহত হন। তিনি তার স্ত্রী ও পুত্র নিয়ে করাচী থেকে পালিয়ে বিলাতে যান সে দেশের পত্রিকা মারফত এই পাক বর্বরতার কথা সারা বিশ্বকে জানাতে। ম্যাসকারেনহাস ভারতের গােয়াতে জন্মান। ধর্মে তিনি খৃস্টান। করাচীতে তিনি স্থায়ীবসতি স্থাপন করেন। নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসাবে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। বিলাতের প্রভাবশালী পত্রিকা সানডে টাইমস এ প্রকাশিত তার লেখাগুলাে সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি করে। সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সেনা বাহিনীর বর্বরতার উপর একটি বই লিখেছেন। বইটি সম্প্রতি লন্ডনে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম দিয়েছেন তিনি “দি রেপ অব বাংলাদেশ।” | তাতে তিনি লিখেছেন, অভিধানে জেনােসাইডের (গণহত্যা) যে সঙ্গা সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঠিক তাই করেছে।

তিনি লিখেছেন : “কি নিখুঁত ও সুচারুরূপে বাংলাদেশে এই গণহত্যার পরিকল্পনা তৈরী ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল কুমিল্লায় ১৪শ ডিভিশনের সদর দফতর সফরকালে তা আমি জানতে পারি।” মিঃ ম্যাসকারেনহাস মন্তব্য করেছেন হিটলারের পর এমন পৈশাচিক কান্ড কারবার আর কোথাও হয়নি। তিনি লিখেছেন “বাংলাদেশে অবস্থানকালে আমাকে স্বচক্ষে ‘হত্যা ও জ্বালান-পােড়ান’ অভিযান। দেখতে হয়েছে। সে সময় গ্রামে গ্রামে ও বাড়ীতে বাড়ীতে তল্লাসী করে হিন্দু ও অন্যান্য শ্রেণীর দুষমনদের হত্যা করা হচ্ছিল।” তিনি আরাে লিখেছেন : “আমি গ্রামের পর গ্রাম নির্মূল করতে দেখেছি এবং সামরিক প্রশাসকদের হাঁসতে হাঁসতে মানুষকে মৃত্যুদন্ড দিতে দেখেছি। বাইরে থেকে দেখলে যাদের ভাল ছেলে বলে মনে হবে এমন আর্মী অফিসারদের আমি এক জায়গায় জট পাকিয়ে বসে প্রত্যেকের শিকারের সংখ্যা সম্পর্কে গালগল্প করতে দেখেছি এবং সর্বাধিক সংখ্যা বাঙ্গালী হত্যাকারীকে গর্ববােধ করতে দেখেছি।”

জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৭ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪