নারী ধর্ষণের ঋণ
বাঙলাদেশের নারীধর্ষণের ব্যাপারটা বিস্ময়কর। কিন্তু হুকুমদার “ইয়াহু”র জীবনকাহিনী এর চাইতে কম বিস্ময়কর নয়। জানা গেছে, অবিভক্ত ভারতের সামরিক বাহিনীর জুনিয়ার অফিসার থাকাকালে ইয়াহিয়া একবার নারী ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এমন ঘাের বিপদের দিনে এই ‘ইয়াহু’টিকে যিনি রক্ষা করেছিলেন, তিনি শের আলী খান পরবর্তীকালে যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হয়েছিলেন। অতি সম্প্রতি ইয়াহিয়া এই শের আলীকে একজন মন্ত্রী বানিয়ে তাঁর পূর্ব ঋণ শােধ করেছেন।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৫ ॥ ১৮ নভেম্বর ১৯৭১
মানুষ নিয়ে খেলা হাজার মাইলেইয়ের দেশ
বাঙলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের জীবন নিয়ে দানবেরা যে-নৃশংস নারকীয় খেলায় মেতে উঠেছে, বিশ্ববিবেক সেখানে নির্বাক। দশলক্ষ লােক যেখানে নিহত, এককোটি। মানুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতবর্ষে আশ্রিত, প্রায় চারকোটি লােক যেখানে ছিন্নমূল হয়ে স্রোতের শ্যাওলার। মত ভেসে বেড়াচ্ছে মানবতা যেখানে অবমাননা নিয়ে গুমরে গুমরে কেঁদে ফিরছে বিশ্ব সেখানে নিরুত্তর ছবি। কারাে কিছু ভাবার নেই, বলার নেই, করারও কিছু নেই যেন। বিশ্ব বিচারালয়ের বন্ধ দরজায় মাথা কুটে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ হায়রে মানবতা! হায়রে বিশ্ববিচারালয়! কালের অমােঘ চক্রে এই স্তব্ধতা খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে। ভবিষ্যতের কাছে যখন আজকের এই নীরবতার জন্য জবাবদিহি হতে হবে—তখন আর নীরব থাকলেও রেহাই নেই। অন্যায় করার পাপে না হােক, অন্যায় সহ্যের অপরাধের জন্য হলেও সত্তর দশকের পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ ইতিহাসের পাতায় আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে।
বিশ্বমানবতা, মানবাধিকার, মানব কল্যাণের মহান ব্রতের লেবেল এঁটে এখনাে যে-সব প্রতিষ্ঠান চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসে আছেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন—বাঙলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের জীবন নিয়ে কাপালিকপালের এই পৈশাচিক খেলার শেষ কোথায়? শক্রর গুলিতে, বােমার আঘাতে মৃতের স্তুপে বাঙলাদেশ আজ শ্মশান। হানাদারদের ‘পােড়ামাটি নীতি’তে দাউ দাউ করে জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম হাহাকার, কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে বাঙলার আকাশ বাতাস। দুর্ভিক্ষ আর মহামারীর করাল কবলে প্রাণ দিচ্ছে অসংখ্য মানুষ। সব হারিয়ে এককোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে শিশুরা ঢলে পড়ছে চিরনিদ্রায়। বাঙলাদেশের এইসব ভাগ্যহতদের জন্য কেউ কি ভাবেন? অন্ধ মহাশক্তির অনুকরণ করে বৃহৎ শক্তিগুলিও কি নিজেদের চোখ বন্ধ করে সেই নির্মম খেলায় মেতে উঠবেন? এটাই আজ নিরুত্তর। পৃথিবীর কাছে একমাত্র প্রশ্ন।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১ : ৫ ॥ ১৮ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪