জল্লাদী বর্বরতার এক অকথিত কাহিনী
(নিজস্ব প্রতিনিধি) বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ইসলামাবাদ উপনিবেশবাদ চক্রের নৃশংসতার কোন অন্ত নাই, শেষ নাই। ইসলামাবাদের নরঘাতক জল্লাদ বাহিনীর নরহত্যা ইতিমধ্যেই বিশ্বাসীর নিকট মানব। ইতিহাসের নির্মমতম জঘন্য গণহত্যা বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। এই নরহত্যা এখনও থামে নাই। বর্তমানে নিত্য নুতন কৌশলে নরপিশাচ দস্যুরা বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় গণহত্যা চালাইতেছে। বলিয়া খবর পাওয়া যাইতেছে। দখলীকৃত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচন্ড গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভীরু কাপুরুষ পাক সেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া পােড়া মাটি নীতি অবলম্বন করিয়া নিরীহ নিরস্ত্র বেসামরিক জনসাধারণকে হত্যা করিয়া চলিয়াছে। ময়মনসিংহ জেলার হােসেনপুর হইতে বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, নরঘাতক পাঞ্জাবী সেনারা গত ১৭ই আগষ্ট এক অভিনব কৌশলে প্রায় দুই শত গ্রামবাসীকে নদীর পাড়ে দাঁড় করাইয়া মেসিনগানের সাহায্যে হত্যা করে নদীতে ফেলিয়া দেয়। ব্ৰহ্মপুত্র নদীর তীরে হােসেনপুর একটি বন্ধিষ্ণু পল্লী বন্দর। এখানে হানাদার সেনারা একটি ক্যাম্প স্থাপন করে।
জনৈক মেজরের নেতৃত্বে প্রায় ৫০৬০ জন পাক সেনা এই ক্যাম্পে থাকে। গত ১৭ই আগস্ট মৃত পাকিস্তান দিবস পালন উপলক্ষে খান সেনারা মুসলিম লীগ; জামায়াত ইসলামী এবং স্থানীয় গুন্ডা বদমায়েশদের সাহায্যে একটি উৎসবের আয়ােজন করে। প্রকাশ, খানসেনাদের দালালরা গ্রামে গ্রামে ঢােল পিটাইয়া প্রচার করে যে হােসেনপুর ক্যাম্পের মেজর গণহত্যার প্রতিবাদী। সে জনসাধারণকে রক্ষা করিতে আসিয়াছে। সে চায় জনসাধারণ তাহাদের নিয়মিত কাজকর্ম এবং আমােদ-উৎসব করুক। তাই, ১৪ই আগষ্ট উপলক্ষে হােসেনপুরে যাত্রাগান, নাট্যানুষ্ঠান এবং হিন্দুদের জন্য কীর্তন। অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হইয়াছে বলিয়া প্রচার করা হয় গ্রামে গ্রামে আর হাটে বাজারের। হােসেনপুর এলাকার যাত্রাপাটি এবং কীর্তন পার্টিকে এই উপলক্ষে মােটা অর্থ দিয়া উৎসবে আমদানী করা হয়। এই উপলক্ষে, গ্রামবাসীকে তাহাদের ছেলেমেয়ে লইয়া যাত্রা ও কীর্তন শুনিবার জন্য দালালদের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। কিন্তু তৃতীয় এবং শেষ রজনীতে যাত্রা ও কীর্তন পার্টির শিল্পী ও শ্রোতাদের মধ্য হইতে কিছু সংখ্যক লােক খানসেনা রাখিয়া দেয়। তাহাদের সহিত নাকি ভাল ব্যবহার করে এবং ভাল খাদ্য দেয়। কিন্তু রাতের শেষ ভাগে তাহাদিগকে আকস্মিকভাবে সকল শিল্পী এবং বাছাই করিয়া রাখা লােকগুলিকে লাইনে দাঁড় করিয়া পাশ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে লইয়া যায়। সেখানে নদীর তীরে তাহাদিগকে লাইনে দাঁড় করানাে হয়। অতঃপর জল্লাদ সেনারা পজিশন নেয় এবং মেশিনগানের সাহায্যে এক মুহুর্তের মধ্যে প্রায় দুইশত লােককে হত্যা করে। পরে নরপিশাচরা পায়ে ঠেলিয়া লাশগুলি ব্ৰহ্মপুত্র নদীতে ফেলিয়া দেয় ।
বাংলার বাণী ॥ ৭ সংখ্যা ॥ ১২ অক্টোবর ১৯৭১
বুদ্ধিজীবী কনভেনশনে গণহত্যার নিন্দা
বােম্বাই-এর লেখক, বুদ্ধিজীবী ও মনীষীরা এক কনভেনশনে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানের পরিকল্পিত গণহত্যার নিন্দা করেছেন। সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যার সমালােচনা করা হয়। উক্ত কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত উর্দু লেখক শ্রী কিষাণ চন্দর। তিনি বাংলাদেশ ও মুক্তি বাহিনীর প্রতি একাত্মতার কথা ঘােষণা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবী করেছে। সকল দেশের কাছে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দাবী করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় । কনভেনশনের প্রারম্ভে বাংলাদেশের গায়ক জনাব আবদুল জব্বার দুখানি দেশাত্মবােধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৩ ॥ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪