মানবতার ক্রন্দনরােলে কাঁপছে আল্লাহর আরশ
কিন্তু কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাংবে কবে? থােক থােক রক্তের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রীক বাঙলাদেশ। এই শিশু ও নবগঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, নির্মূল করার জন্য নরঘাতক জঙ্গী ইয়াহিয়া লেলিয়ে দিয়েছে তার হায়নাদের সবুজ বাঙলার শ্যামল প্রান্তরে। চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী। কোন ভেদাভেদ নেই। অবলিলায় ধ্বংস করছে সভ্যতার পীঠস্থান শিক্ষাঙ্গণকে, মাড়িয়ে খুঁড়িয়ে দিচ্ছে মসজিদ-মন্দির, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ, শিল্প-কারখানা, বিপনীকেন্দ্র আর এই বর্বর নাৎসি হামলার মর্মম্মদ ঘটনাকে চাপা দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবি এবং সাংবাদিকদের করছে নিধন, ভস্ম করে দিয়েছে স্বাধীন সংবাদপত্র অফিসগুলাে। সারা বাঙলাদেশ আজ রণক্ষেত্র। বাঙলার মাঠে জ্বলছে আগুন বাতাসে তার রূঢ়তা, আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর চারদিকে ভীত, বিহ্বল ও আতঙ্কগ্রস্থ অসহায় মানুষের চিৎকারে বাঙলাদেশ হয়ে পড়েছে প্রেতপুরি। মানবতার এহেন অবমাননায় আল্লাহর আরশ হয়তাে থর-থর করে কাঁপছে কিন্তু বিশ্বামানবতার এবং শান্তির সােল এজেন্ট জাতিসংঘের বৃহত্রাষ্ট্রবর্গের ঘুম ভাঙছে না, বিবেক দংশিত হচ্ছে না। উথান্ট সাহেব কি জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদের কথা ভুলে গিয়েছেন? না শুধু বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ জড়িত না থাকলে তার কণ্ঠে শান্তির ললিতবাণী বেরােতে বাধে? শুধু বিনয়ের সাথে উ-থান্ট সাহেবকে জানাতে চাই বাঙলাদেশে যে মানবনিধন যজ্ঞ চলছে তা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। এ যুদ্ধ একটি স্বাধীন জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ—তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন, সিদ্ধান্ত নিন। যাতে জাতিসঘের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে না ফেলে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি আমেরিকা আজ নীরব।
নীরব নিক্সনের কণ্ঠ। কিন্তু কেন? তিনিও কি ভাবেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়, তাই নাক গলানাের প্রয়ােজন নেই? কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় নাক গলাতে তাে তারা কোন পাত্রাপাত্র, স্থান, কাল বিচার করে না। তবে এখানে কেন এত চিন্তা—এত ভাবনা। ফুব্রাইট এবং এডওয়ার্ড কেনেডির মত প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ যখন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের দাবী জানিয়েছেন, তখনও নিক্সন কেন কোন ব্যবস্থা করছেন না? আমেরিকার পত্র-পত্রিকাও মানবতার এই ক্রন্দন বেদনা ভারাক্রান্ত, বিহ্বল। কিন্তু নিক্সন সাহেব কি বাঙলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে নিজের এবং তাঁর সরকারের দায়িত্ব এড়াতে পারেন? তার জানা উচিত বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তাতে তিনি মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন না । নিক্সন সরকারের পক্ষ থেকে হয়তাে বলা যেতে পারে যে, ইয়াহিয়া জঙ্গীচক্র কমিউনিষ্ট চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রদত্ত মার্কিন অস্ত্র-শস্ত্র তাদের অনুমতি ব্যতিরেকেই বাঙলাদেশে নরমেধযজ্ঞে ব্যবহার করছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কি তাদের কিছু করণীয় ছিলবা নেই? তারা কি চুক্তিভঙ্গের অজুহাতে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন না? আসল কথা হলাে ক্ষমতাসীন মার্কিন সরকারের গণতন্ত্র ফাকি। দেশে দেশে একনায়কত্ববাদীদের পােষণের যে নীতি মার্কিন সরকার অনুসরণ করে আসছে পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
কেন না, মার্কিন সরকারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য না পেলে পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাঙলাদেশে এক দিনও যুদ্ধ চালাতে পারে তা আমাদের বিশ্বাস হয় না। মার্কিন সরকারের জেনে রাখা উচিত, বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের অস্তিত্ব রাখার প্রয়ােজনেই আজ মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ যুদ্ধে তাদের জয়লাভ করতেই হবে। জয় তাদের অবশ্যম্ভাবী। মাঝখানে মার্কিন সরকার বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষ অবলম্বন না করে চিরকালের জন্য তাদের বন্ধুত্ব হারালে-এই আমাদের দুঃখ। বৃটেনও একই পথের পথিক। বৃটেন বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিলাে মানবিক মূল্যের কথা। পাকিস্তান আজও কমনওয়েলথের অন্যতম সদস্য। বৃটেনের কাছ থেকে সে পাচ্ছে নানারকম সাহায্য ও সহযােগিতা। সুতরাং বৃটেন সরকার ইচ্ছে করলে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতাে কিন্তু তারা তা করেনি। কারণ পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকচক্রের সাথে বৃটিশ সরকারের বাণিজ্যিক ও অন্যবিধ সম্পর্ক জড়িত। বৃটিশ শ্রমিক দলের পীড়াপীড়ি সত্বেও প্রধানমন্ত্রী হাথ পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং ঘােষণা করেছেন যে পাকিস্তানে বৃটিশ সাহায্য অব্যাহত থাকবে। পশ্চিমা শক্তিবর্গ ভাবছেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বাঙলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদী। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও টিক্কা চক্রের বক্তব্যও এই। ভাবখানা এই—বায়াফ্রা, নাগা ও মিজোদের মত বাঙলাদেশও একই পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু যুক্তির ধাপে তা কি টিকে? একটু আলােচনা করে দেখা যাক । বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার একটি ক্ষুদে অংশ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধনের দিক থেকে নাইজেরিয়ার অন্য এলাকার সাথে কোন পার্থক্য নেই। নাগা ও মিজোল্যান্ত ভারতের বিরাট অংশের দুইটি ক্ষুদ্র এলাকা।
তাদের দাবীর সংগে বাঙলাদেশের বক্তব্যকে এক করে দেখার অর্থ—জেগে। ঘুমােনাের মত। কারণ, পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ছাপ্পান্ন জনের বাস বাঙলাদেশে। ভৌগােলিক দিক থেকে বাঙলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব বারশত মাইল। মধ্যবর্তী স্থানে ভারত অবস্থিত। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সামাজিক বন্ধন এবং আচার অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এবং তথাকথিত পাকিস্তান সংহতির নামে বিগত তেইশ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙলাদেশকে শােষণ করেছে, গণতন্ত্রের গলাটিপে হত্যা করে রাজনৈতিক অধিকারটুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে। ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূমিকে তারা তাদের বাজারে পরিণত করে। অতএব অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ ও মানবিক মূল্যায়নের এই সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করা যায় না বাঙলাদেশ যখন ইয়াহিয়ার হায়নাদের ছােবলে ক্ষত-বিক্ষত তখন রেডক্রস এগিয়ে এসেছিলাে। আর্তের সেবায়, কিন্তু সামরিক জান্তা যেহেতু বাঙলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেননি সেহেতু তারা। মানবতার সেবা করতে নিরস্ত রয়েছেন। তা নিরস্ত রয়েছেন বলে জঙ্গীচক্রের মানব নিধন যজ্ঞ বন্ধ। হয়নি, বন্ধ হয়নি মানবতার ক্রন্দন। প্রশ্ন রয়ে যায় রেডক্রসের দায়িত্ব কি শেষ হয়ে গিয়েছে? বিশ্ব জনমতের কাছে তারা এই নগ্নতার বর্বরতার বীভৎস করুণ চিত্র তুলে ধরে বৃহৎ শক্তিবর্গের উপর আশু চাপ সৃষ্টির দাবী করতে পারেন না? আমরা আশা করবাে, তারা আর মুখ ফিরিয়ে থাকবেন না। আমরা এতদিন শুনে এসেছি চীন এশিয়ার গৌরব, নির্যাতীত নিপীড়িত সংগ্রামী জনতার আশা-আকাক্ষার মূর্ত প্রতিক। বিশ্ববাসী জানতাে, বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষও জানতাে বিশ্বের যেখানেই শােষণ, বঞ্চনা আর অত্যাচার সেখানেই আছে মহাচীনের শীতল স্পর্শ।
সেখানেই মহাচীন নিপীড়িত মানুষের দুঃখ মােচনের চেষ্টায় সচেষ্ট। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার দখলদার বাহিনীর বর্বরােচিত আক্রমণে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জীবন যখন আজ বিপন্ন, অর্থনৈতিক জীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন চীন আক্রমণকারী হানাদারদের পক্ষ অবলম্বন করছে এটা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। বলা যেতে পারে যে চীনের রাষ্ট্রনায়কগণ বাঙলাদেশের গণমানুষের সত্যিকার পরিচয় না জেনেই জঙ্গী শাসকদের সমর্থন যােগাচ্ছেন। কিন্তু তাও বা আমরা কিভাবে বিশ্বাস করবাে? কারণ চীন বিশ্বের নাড়ী-নক্ষত্রের খবর রাখেন তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তিসংগ্রামের প্রকৃতি ও পরিচয় জানবেন তা কোনমতেই বিশ্বাস করা যায় না। অবাক বিস্ময়ে তাকাতে হয় আরব জাহানের দিকে। ইসলামের শিক্ষা যেখানে অন্যায়, যেখানে জামিলের জুলুম তাকেই প্রতিহত করতে হবে, যে কোন মূল্যের বিনিময়ে মজলুমকে দিতে হবে ছায়া কিন্তু তারতাে কোন নমুনা বিশ্ববাসী দেখছেন না। আরব জাহানের মানবতা ও বিবেক জাগ্রত হােক, ইসলামের মূলমন্ত্র সাম্য স্বাধীনতা সৌভাতৃত্বের পরশে স্নাত হােক বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই কথাই বিশ্ববাসীর চোখে-মুখে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
আরব জাহানের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা উচিত যে, কেবলমাত্র ধর্মীয় বন্ধনের জোরেই বিভিন্ন মানবগােষ্ঠী এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে না। যদি তাই হতাে, তাহলে একই ভাষা, একই ভূগােল, একই ধর্ম ও একই সংস্কৃতির অধিকারী আরব জনগণ আজ এতগুলাে রাষ্ট্রে বিভক্ত কেন? মানবতার এই অবমাননা ও বৃহৎ শক্তিবর্গের এই ন্যাক্কারজনক পলায়নী মনােভাবের মধ্যেও সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র নিরন্ন মানুষের যন্ত্রণা চিৎকারে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করে যারা নজির স্থাপন করেছেন, তাঁরা হলেন বুদ্ধ, গান্ধী, নেহেরু রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মানব প্রেমিকতার আশীষে পুষ্ট মহামানবের মিলন ক্ষেত্র ভারতবর্ষ আর মহামতী লেনিনের আদর্শে পরিচালিত সােভিয়েট রাশিয়া। বিশ্বমানব-প্রেমিকরা এ দুটি রাষ্ট্রকে জানাচ্ছে প্রীতিসিক্ত সালাম।
জয়বাংলা (১) ! ১: ২ ॥ ১৯ মে ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪