কোন রকম সাহায্য দিয়ে পাকিস্তানের রক্তপিপাসু সামরিক সরকারকে শক্তিশালী না। করার জন্যে বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রশাসনিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ ও পরিপূর্ণ আত্মমর্যাদার মধ্য দিয়ে একটা জাতি হিসাবেই আমরা বাঁচতে চাই— এই অটুট বিশ্বাস ও দৃঢ় মনােবল নিয়েই আমাদের মুক্তিবাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন-পণ লড়ে যাচ্ছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গত ১৩ই জুন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী মানুষের উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে এ কথা বলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীর জওয়ানদের অতুলনীয় সাফল্য বর্ণনা প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র পেলে ইনশাল্লাহ অচিরেই আমাদের মুক্তিবাহিনী দেশ থেকে দু’জন সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধকে অধিকতর সুসংগঠিত ও জোরদার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন দুনিয়ার বৃহৎ শক্তি বর্গের কাছে প্রয়ােজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন। জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান। তিনি বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তি এখানে স্থায়ী হবে। | স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বেতার ভাষণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন বলেন, জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন। সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। | তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম দেশের পুষ্পপত্রের মত এ মাটি থেকে উদ্ভুত। যে অসহনীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে বিপর্যস্ত করেছিল, সেই সম্পর্কের অবসান ঘটাবার জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা। থেকে এর উৎপত্তি। একে ভারতের প্ররােচনা বলে পাকিস্তান যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তা তার সুপরিচিত কৌশল। বাংলাদেশের সকল সম্পর্কেই এইরূপ প্রচারণা হয়েছে; এতে আর কেউ কান দিচ্ছে না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১১ সপ্তাহের দুর্বার সংগ্রামের পর্যালােচনা করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, দখলকারী শত্রুরা এক নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। তাদেরকে লােক ও রসদ আনতে হয় বিমান পথে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে। আমাদের মুক্তিবাহিনী আবার প্রত্যহ আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর সরবরাহ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। | প্রধানমন্ত্রী বলেন, হানাদারদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রলােভন সত্ত্বেও কোথাও এখনও বে-সামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু হবার কোন লক্ষণ নেই, কলকারখানার চাকাও ঘােরেনি। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সুপরিকল্পিত হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে মানুষের শত্রু ও সভ্যতার শত্রুরূপে। তাদের আর জনসাধারণের মাঝে রয়েছে ঘৃণার সমুদ্র সমান ব্যবধান। বৃহৎশক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তারা যেন রক্তপিপাসু সামরিক একনায়কত্ববাদকে আর শক্তিশালী না করে তােলেন। বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিকবাহিনী তুলে না নেওয়া পর্যন্ত ইসলামাবাদ সরকারকে কোন । রকম সাহায্য না দেওয়ার জন্য তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানান। তিনি আরও বলেন, ইসলামাবাদকে কোন রকম সাহায্য দেবার অর্থ পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সে শক্তি বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই শুধু ব্যবহৃত হবে।
মুসলিম বিশ্বের প্রতি আবেদন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশের ইসলামী ন্যায়-নীতির জন্য যুদ্ধ করছে, এরকম ধারণা হয়ে থাকলে তা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, জনসাধারণের ইচ্ছা ও মানবাধিকারকে বর্বরােচিতভাবে দমন করে ইয়াহিয়া। ইসলামের দোহাই পাড়ছে।
তুর্কী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বের মুক্তি সংগ্রামের উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুসলিম তুর্কীদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা মুক্তিসংগ্রাম করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই তারই অনুরূপ। বাংলাদেশের আপামরজনতা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস, বীরত্ব ও দেশপ্রেমের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ। বলেন, ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক সৈন্যবাহিনীকে বীরত্বের সাথে বাধা দিয়ে তারা পৃথিবীর সকল দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের হৃদয়কে সাড়া দিয়েছেন এবং তাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। | গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে লুণ্ঠনের পাশবিক লােভ, অন্যদিকে একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের দুর্বার আকাঙ্খা। এই যুদ্ধে জয় আমাদের হবে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
আমাদের প্রধান সেনাপতি ও জেনারেল ওসমানী
বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানীর নাম আজ বাংলার ঘরে ঘরে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি দৃপ্ত ও বিচক্ষণ। নেতৃত্বের জন্য বাংলার এই চিরকুমার প্রধান সেনাপতি সকলের কাছে সুপরিচিত। আজ তিনি দেশের। স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরােভাগে এসে দাড়িয়েছেন। তার সবল নেতৃত্বে হাজার হাজার বাঙ্গালী এগিয়ে চলেছে জয়যাত্রার পথে । নব জনগণ বাংলার নতুন উষার পথে।
| জাতিগত অধিকার এবং গণস্বার্থ আদায়ের জন্য যে সজাগ দৃষ্টি এবং সংগ্রামী মানসিকতার। প্রয়ােজন, বাঙ্গালীদের মধ্যে সেই উপলব্ধিকে জোরদার করার জন্য জেনারেল ওসমানী অক্লান্ত পরিশ্রম। করে যান তার কর্মজীবনের প্রথম থেকেই।
১৯৫১ সালের শেষের দিকে জেনারেল ওসমানী কর্তৃক ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ। করার পর থেকে রেজিমেন্টের ইতিহাসে এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। বাঙ্গালীদের সামরিক বাহিনীতে না নেওয়ার জন্য বাঙ্গালী বিদ্বেষী স্বার্থ সংশ্লিষ্টমহল বাঙ্গালীরা সামরিক জাতি নয়’ এই মর্মে যে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল সেটাকে প্রতিরােধ করার জন্য তিনি প্রাণমন ঢেলে দেন ইষ্টবেঙ্গল। রেজিমেন্টের সর্বাত্মক উন্নতি সাধন ও মান উন্নয়নের জন্য। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সকল রকমের বিঘ্ন সৃষ্টি করা সত্ত্বেও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই রেজিমেন্টকে একটি সংগ্রামীযােদ্ধদল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। করেন। যার ফলে যুদ্ধ কৌশল এবং বীরত্বের দিক থেকে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানের বেলুচ এবং পাঞ্জাব ইত্যাদি সকল দলের মধ্যে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রতীয়মান করে। এই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট একরকম বলতে গেলে, জেনারেল ওসমানীর নিজের হাতে গড়া। তারই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ বেঙ্গল। রেজিমেন্ট পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। তারই প্রতিফল আমরা দেখি ১৯৬৫ সালের ভারত।
পাকিস্তান যুদ্ধের লাহোের রণাঙ্গনে। সেই যুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়াই করে লাহােরকে রক্ষা করে এই বাঙ্গালীরাই। | বাঙ্গালীদের সম্পর্কে পাঞ্জাবী চক্রের মিথ্যা প্রচারণার অবসান ঘটানাে এবং সেনাবাহিনীতে বাঙ্গালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জেনারেল ওসমানী থাকতেন সকলের পুরােভাগে। এই জন্য। তিনি পাকিস্তান সামরিক চক্রের বিরাগভাজন হন। সামরিক শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার দিক থেকে তার সমকক্ষ সেনাপতি পাকিস্তানে কেউ নেই, তবু তার পদোন্নতি বন্ধ করে দেয়া হয়। | এখানে উল্লেখযােগ্য যে তদানীন্তন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে জেনারেল ওসমানীই সর্বকনিষ্ঠ মেজর হিসাবে নিযুক্ত হন। বাঙ্গালী অফিসারদের সব সময়ই পাকিস্তানে দাবিয়ে রাখা হয়। তিনি নিজের ভবিষ্যত এবং কর্তৃপক্ষ থেকে সম্ভাব্য সকল রকম বিপদ উপেক্ষা করে এই সব বাঙ্গালীদের উন্নতির জন্য লড়াই করে গেছেন। আর বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের হয়ে সংগ্রাম করার কারণে তাঁকে সামরিক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিভিন্নভাবে পর্যুদস্ত হতে
| সাধারণ সৈনিকদের প্রতি তার অকৃত্রিম স্নেহ এবং বাংলার মানুষ তথা বাংলার ভাষার প্রতি তার ভালবাসার প্রমাণ নিম্নোক্ত দুটি ঘটনা থেকেই মেলে। সামরিক বাহিনীতে উদ্ধতন অফিসারদের কাছে সুবেদার মেজরদের দৈনন্দিন একটা রিপাের্ট দেওয়ার রেওয়াজ আছে। পাকিস্তান বাহিনীর নির্দেশ হচ্ছে, এই রিপাের্ট একমাত্র উর্দুতেই দেওয়া চলবে। জেনারেল ওসমানী এই সর্বপ্রথম তার সুবেদার মেজরকে বাংলায় রিপাের্ট দেয়ার অনুমতি দেন। এই জন্য পাকিস্তান সামরিকচক্র তাঁর কাছ থেকে কৈফিয়ৎ দাবী করে, এবং তিনিও তার যথাযােগ্য জওয়াব দেন। | আর একটি ঘটনা হয়ত অনেকেরই জানা নেই। জেনারেল ওসমানী এক দানপত্রে তার সকল সম্পত্তি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি এবং বাঙ্গালী বাহিনীর প্রতি তাঁর আন্তরিক প্রীতির পরিচয় এখানেই পাওয়া যায়।
জেনারেল ওসমানী ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পূর্ব-বাংলার সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ শাহ নিজামউদ্দিন ওসমানী হজরত শাহজালাল সহ গৌরগােবিন্দ সিংহের রাজত্বকালে এদেশে আসেন। তাঁর পিতা মরহুম খান বাহাদুর মুফিজুর রহমান, বি, এ, কে, এইচ, এম সততা, মানবপ্রীতি ও নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমের জন্য খ্যাত ছিলেন।
| জেনারেল ওসমানী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সিলেট গভর্ণমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ইংরেজীতে বিশেষ দখলের জন্য প্রিটোরিয়া প্রাইজ লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলা বিভাগে ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯৩৯ সালে মাষ্টার ডিগ্রীর চূড়ান্ত পরীক্ষার পূর্বেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসাবে যােগদান করেন। ১৯৪০ সালের ৫ই অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী, দেরাদুন থেকে সামরিক শিক্ষা শেষ করে বৃটিশ ইন্ডিয়ান কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর থেকে তার দ্রুত পদোন্নতি হয়—১৯৪১ এর ফেব্রুয়ারীতে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২-এর ফেব্রুয়ারীতে তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন ও মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি যান্ত্রিক পরিবহন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন। | দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বর্মা রণাঙ্গনে যে অল্প কয়েকজন অশ্বেতাঙ্গ অধিনায়ক যুদ্ধ পরিচালনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৬ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে ইষ্টার্ণ কমাণ্ড সিলেকসন কমিটি কর্তৃক তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য মনােনীত হন এবং ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত ফাষ্ট। পােস্টওয়ার ষ্টাফ কলেজ এস্ট্রেন্স পরীক্ষায় বৃটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় উচ্চস্থান লাভ করেন ও ষ্টাফ কলেজে ১৯৪৮ সনের কোর্সে স্থান অর্জন করেন।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে তিনি আই, সি, এস, এ কোয়ালিফাইড হওয়ায় ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্যও ১৯৪৬ সালেই মনােনীত হন কিন্তু সৈনিক জীবন পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। পরে ১৯৪৭ সনের শুরুতে তকালীন ভারতীয় অন্তবর্তী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব জওহরলাল নেহেরু তাকে একটি কূটনৈতিক পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। জেনারেল ওসমানী সে প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন। একই সালে তিনি লেফটন্যান্ট কর্ণেল পদের জন্য মনােনীত হন এবং বৃটিশ ভারতের সিমলাস্থ জেনারেল হেডকোয়াটার্সএ কোয়াটার মাষ্টার জেনারেলের শাখায় সেকেণ্ড গ্রেড ষ্টাফ অফিসার পদে নিযুক্ত হন।
ভারত বিভাগের পর পরই তিনি পাকিস্তানের জন্য অংশ নির্ধারণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বছর সাতই অক্টোবর পাকিস্তানে তাকে লেফটেনান্ট কর্ণেল এর পদে উন্নীত করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে। তিনি কোয়েটা ষ্টাফ কলেজের কোর্সে যােগদান করেন। ১৯৪৯ সনে ষ্টাফ কলেজ থেকে ডিগ্রী লাভ করার পর তাঁকে তদানীন্তন চীফ অফ দি জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল রেজিনাল্ড হাটন এর সহকারী জেনারেল স্টাফ অফিসার পদে নিয়ােগ করা হয়। | এরপর বিভিন্ন পদে সৈন্যবাহিনীতে অধিনায়কত্ব এবং বিশেষ খ্যাতি অর্জনের পর ১৯৫২ সনের দিকে তাকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের ভার দেয়া হয়। ১৯৫৫ সনে তাঁকে ই,পি, রাইফেল্স এর অতিরিক্ত কমাণ্ডান্ট পদে বহাল করা হয়। | ১৯৫৬ সনে তিনি কর্ণেল পদে উন্নীত হন এবং জেনারেল হেড কোয়াটার্স এর জেনারেল ষ্টাফ এ মিলিটারী অপারেশনের ডেপুটী ডাইরেক্টর পদ গ্রহণ করেন। এই সময় থেকে তিনি বহু আন্তর্জাতিক সামরিক ও পরিকল্পনা বৈঠকে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বিদেশী রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়কদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেন।
১৯৬৪ সনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানকার সাঁজোয়া, গােলন্দাজ, পদাতিক এবং বিমানবাহী শত্রু ও অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন।
১৯৬৭ সনে জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
অবশেষে ১৯৭১ সনের এপ্রিল মাসে বাঙ্গালীরা তাঁকে তাঁর উপযুক্ত মৰ্য্যাদা দেয়, এবং বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে তাকে বরণ করে নেয়। একই সঙ্গে প্রজাগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার তাকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন। আজ তারই অধিনায়কত্বে বাংলার সংগ্রামী সেনারা এগিয়ে চলেছে এক নবতর ভবিষ্যতের পানে।
স্বদেশ ১ ২ + ১ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্প্রতি সংগ্রামী বাঙ্গালী জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও আটক সকল গণ-প্রতিনিধিদের অবিলম্বে মুক্তিদান, বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদারবাহিনী ফিরিয়ে নেয়া, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান। এবং পশ্চিম পাকিস্তানী শােষকশ্রেণী কর্তৃক এ যাবৎ বাংলাদেশ থেকে অপহৃত ধনসম্পদ ও গত আড়াই মাসের লড়াইয়ে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের যে ক্ষতি সাধন করেছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার। মাধ্যমে তা নির্ণয় করে লুষ্ঠিত ধন প্রত্যার্পন ও পূর্ণ ক্ষতিপূরণের দ্বারাই কেবল রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে অন্যথা রাজনৈতিক সমাধানের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
| তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রাজনৈতিক সমাধান বা আপােষ মীমাংসা সম্পর্কে যে জল্পনাকল্পনা। চলছে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোন গোঁজামিলের সমাধান গ্রহণ করবে না।
| আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘােষণা করেন, বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনদিন। সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সকল বাঙালী হিন্দুমুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান—এক সাথে লড়েছেন, বুকের তপ্ত লহু ঢেলে দিয়ে বাংলার মাটি সিক্ত করে তারা এটাই প্রমাণ করেছেন এদেশের প্রতিটি প্রাণ ঐক্যবদ্ধ, অভিন্ন। | মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বের প্রশংসা করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সীমিত সামর্থের জন্য আমাদের প্রয়ােজন সর্বক্ষেত্রে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন রণাঙ্গনে আপনারা যে অসীম অটল মনােবলের পরিচয় দিচ্ছেন, তার জন্যে আজ সারা বাঙ্গালী জাতি গর্বিত। দেশমাতৃকার বীর সন্তান আপনারা। এ সংগ্রামে যে সব সাথী শহীদ হয়েছেন যারা পঙ্গু হয়েছেন তাদের পরিবারবর্গের রক্ষণাবেক্ষণের পুরাে দায়িত্ব আমার সরকার ইতিপূর্বেই গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকেরা আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
স্বদেশ ॥ ১২ ॥ ১ জুলাই ১৯৭১
স্বাধীনতার জন্য এ রক্তদান বৃথা যাবে না
— কামরুজ্জামান
গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান মাতৃভূমিকে শত্রুদের কবল হতে উদ্ধার করার জন্য জীবন মরণ পণ করে এগিয়ে আসতে পুনরায় মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল সফরকালে তিনি একটি মুক্তিফৌজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থীদের প্রতি ভাষণদানকালে উপরােক্ত আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাঙ্গালীদের কোন রক্তদান বৃথা যায়নি, স্বাধীনতার জন্য এ রক্তদান বৃথা যাবে না।
| আজকের এই ত্যাগ-তিতিক্ষা বাঙ্গালী জাতিকে বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে জাগরুক করে রাখবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘােষণা করেছেন। যে কোন মূল্যে এই স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন ।
স্বদেশ ॥ ১: ২ ১ জুলাই ১৯৭১
নিক্সনের কাছে তার বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের তীব্র প্রতিবাদ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের খবরে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তীব্র প্রতিবাদ করে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে একটি প্রতিবাদ তারবার্তা প্রেরণ করেছেন।
গত ২৩শে জুন প্রেরিত উক্ত তারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানকে নতুন করে বিমান এবং জাহাজ ভর্তি সামরিক অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার খবরে বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও আহত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন পশ্চিম পাকিস্তান সমর নায়কদের কাছে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে তার খুচরাে যন্ত্রাংশও তারা সরবরাহ করেছে। মার্কিন সরকার অবগত আছেন যে, ইসলামাবাদ এই মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র এমন কি ত্রাণকার্যের জন্য প্রদত্ত নৌকাগুলাে পর্যন্ত ব্যাপক হারে নারী-পুরুষ ও শিশু হত্যার কাজে এবং গ্রাম ধ্বংসে, ক্ষেত্রের ফসল ও শস্যভাণ্ডার নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে।
জয়বাংলা (১) # ১ : ৮ ॥ ২ জুলাই ১৯৭১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে জরুরী তার প্রেরণ করেছেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিশ্ব মুসলিম। সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের কাছে গত ২৫শে জুন মুজিব নগর থেকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন।
জেদ্দায় আসন্ন বিশ্ব-মুসলিম সম্মেলনের প্রাক্কালে এই টেলিগ্রাম পাঠিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শতকরা ৮০ জন মুসলমান। ইয়াহিয়া। সরকার জনগণের নির্বাচনের রায়কে অগ্রাহ্য করে বিশ্বাসঘাতকের মত অন্যায় যুদ্ধ শুরু করেছে বলেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। | অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, দশ লক্ষেরও বেশী লােককে তারা হত্যা করেছে। ৬০ লক্ষের বেশী। লােক গৃহহারা হয়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে এবং এখনাে হাজার হাজার লােক প্রতিদিন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদাররা মসজিদসমূহ ধ্বংস। করেছে, মসজিদের ইমামদের এবং নামাজরত মুসলমানদের গুলী করে হত্যা করেছে। আর তারা এসব করেছে ইসলামের নামেই। | তিনি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুরােধ করেছেন, যেন তারা বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা, রক্ষার জন্য সম্মেলনে তাদের প্রভাব খাটান।
জয়বাংলা (১) [১: ৮ | ২ জুলাই ১৯৭১
ইয়াহিয়ার জবাব রণক্ষেত্রেই দেওয়া হবে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দৃপ্ত ঘােষণা
মুজিবনগর। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন। ইয়াহিয়া যে ভাষণ। দিয়েছে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তা ঘৃণাভরে শুনেছেন। আমরা এখন স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে শক্ৰহননের লড়াই লড়ছি। আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার। দস্যুদের নিশ্চিহ্ন না করে আমরা ক্ষান্ত হবাে না।
তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার ঔদ্ধত্যের জবাব মুক্তিবাহিনী ও বাংলার জনগণ রণাঙ্গনেই দেবে। অস্থায়ী। ইসলাম রাষ্ট্রপ্রধান সয়ুজ-১১ নভােযানের চন্দ্রনটত্রয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগণীর কাছে এক শােকবাণী পাঠিয়েছেন। | বাণীতে তিনি বলেছেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই বীর সৈনিকদের মৃত্যুতে গভীরভাবে । মর্মাহত। এরা জ্ঞানানুসন্ধানের অভিযাত্রায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এঁদের বিশ্বমানব স্মরণ করবে। চিরকাল।
তিনি নভােযাত্রীত্রয়ের শােক সন্তপ্ত পরিবারের কাছে বাংলাদেশের জনগণ সরকার ও তার নিজের | পক্ষ থেকে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
জয়বাংলা (১) t১ : ৯ + ৯ জুলাই ১৯৭১
শীঘ্রই হানাদার বাহিনীকে খতম করে বাঙলাদেশেকে সম্পূর্নরূপে শত্রু কবল মুক্ত করে শরনার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনবাে
—প্রধানমন্ত্রী। (বিশেষ প্রতিনিধি)
মুজিবনগর ৭ই জুলাই | মুজিব নগরে বাঙলা দেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদ ও সংসদ সদস্যদের এক যুক্ত বৈঠক গত ৫ ও ৬ই জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকে বাংলা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বিষদ ভাবে আলােচনা | করা হয়। আলােচনা কালে স্বাধীন সার্বভৌম গণ প্রজাতান্ত্রিক বাঙলা দেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজ উদ্দীন আহমেদ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন শীঘ্রই হানাদার বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে বাঙলাদেশকে সম্পূর্ণ ভাবে শত্রু কবল মুক্ত করা হবে। | এই বৈঠকে প্রায় – ৪০০ শতেরও অধিক-সংসদ সদস্য, যোগদান করেন। এই বৈঠকে নিৰ্বাচিত সংসদ সদস্য ও মুক্তি বাহিনী প্রধান সদস্য ও মুক্তি বাহিনী প্রধান জেনারেল উসমানী হানাদার বাহিনীর উপর প্রচন্ড আক্রমণের জন্য প্রস্তুত মুক্তি ফৌজের ভূয়শী প্রশংসা করে বলেনএকটি সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের বাঙলা মুক্তি বাহিনীর কমান্ডােরা যে ত্যাগ এবং তিতিক্ষা সহ্য করে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নতুন নজীর স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মহােদয়দের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন আর সে দিন দূরে নয়-যেদিন আমাদের মুক্তি বাহিনী বীর বেশে জয়ের মাল্য পরে বাঙলা দেশের মাটিতে পদার্পন করবে। তিনি | আরও বলেন— এ পর্যন্ত সে সমস্ত রণাঙ্গনে আমাদের মুক্তি ফৌজেরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে | হানাদার খান সেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে-সেই সমস্ত রণাঙ্গন থেকে খান সেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। তিনি দৃষ্টান্ত স্বরূপ আরেকটি মুক্ত অঞ্চলের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন পূর্বে এই সমস্ত এলাকা হানাদার বাহিনীর কবলে ছিল কিন্তু আমাদের – কমাণ্ডোদের প্রচন্ড আক্রমণে খান সেনারা প্যুদস্ত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে’ – আর স্বীকৃত হয়েছে মুক্ত অঞ্চল হিসাবে।
এই বৈঠকে বিভিন্ন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মহােদয়রা যত শীঘ্র সম্ভব মুক্তি ফৌজকে সামনে এগিয়ে | দিয়ে বাঙলা দেশকে সম্পূর্ণ শত্রু কবল মুক্ত করে ভারতে বিতাড়িত শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য মত প্রকাশ করেন। তারা আরােও বলেন শরনার্থীদের ফিরে আসার পর তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ও মালামাল যাতে তারা ফিরে পায় তারও নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।
| জনাব তাজ উদ্দীন আহমেদ নানা প্রকার অত্যাচার ও নির্মম পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে ও বাঙলা | দেশের জনসাধারণ বাঙলা দেশ সরকারের প্রতি যে আস্থা স্থাপন করে আছেন সেজন্য দেশবাসীর প্রতি। আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংসদ সদস্যদের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন আপনারা ভুলে যাবেন না যে বাঙলা দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে আপনারা ও এক একজন মুক্তি সৈনিক সে পথ থেকে বিচ্যুত হলে দেশ আপনাদের ক্ষমা করবে না। তাই সর্বদা নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে কাজ করে যান জয় আমাদের নিশ্চিত। এ জয়ের পথে কোন শক্তিই বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা স্তব্ধ করতে পারে নাই এবং পারবে না ইতিহাসের সাক্ষ্য এ প্রমাণই বহন করে।
সােনার বাংলা (২) # ১: ৩ জুলাই ১৯৭১
সৈয়দ নজরুল কর্তৃক ? বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে তার।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের নেতৃবৃন্দের কাছে সম্প্রতি মুজিবনগর থেকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। জেদ্দায় আসন্ন | বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের প্রাক্কালে এই টেলিগ্রাম পাঠিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জনগণের
উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। | তিনি বলেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শতকরা আশি জন মুসলমান। ইয়াহিয়া সরকার জনগণের নির্বাচনী রায়কে অগ্রাহ্য করে বিশ্বাসঘাতকের মত অন্যায় যুদ্ধ শুরু করেছে বলেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। | অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, দশ লক্ষেরও বেশী লােককে তারা হত্যা করেছে। ষাট লক্ষেরও বেশী। লােক গৃহহারা হয়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছে এবং এখনাে হাজার হাজার লােক দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদাররা মসজিদসমূহ ধ্বংস করেছে, মসজিদের ইমামদের এবং নামাজরত মুসলমানদের গুলী করে হত্যা করেছে। আর তারা এসব করেছে ইসলামের নামেই । তিনি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের অনুরােধ করেছেন, যেন তারা বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সম্মেলনে তাদের প্রভাব খাটান।
স্বদেশ [ ১ : ৩ ৪ ১৪ জুলাই ১৯৭১
যুদ্ধ চলবে
সম্প্রতি মুজিবনগরে তিন শতাধিক এম,এন,এ,ও এম,পি, এদের এক অধিবেশনে স্বাধীনতার চরম লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত হানাদারদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে অন্যান্য প্রশাসনিক বিষয় নিয়েও আলােচনা হয়।
জয় বাংলা (৩) ॥ ১৪ সংখ্যা ॥ ১৭ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ
মুজিবনগর, ১২ই জুলাই : পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সেভিংস সার্টিফিকেট, জাতীয় সেভিংস সাটিফিকেট, প্রাইজব এবং সকল প্রকার সরকারী বা ব্যবসায়ী সংস্থার শেয়ার ও সিকিউরিটি না কেনার জন্য বাংলাদেশ সরকার আজ নির্দেশ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকার অর্থমন্ত্রক পাক অধিকৃত এলাকার জনগণের প্রতি এই নির্দেশ দিয়েছেন। দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত পােস্টাল জীবন বীমার প্রিমিয়াম দেওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। | দেশ যখন মুক্ত হবে তখন বকেয়া প্রিমিয়াম আদায় করা হবে এবং তজ্জন্য কোন জরিমানা দিতে হবে না। পলিসিও নষ্ট হবে না। মুক্তিযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পােষ্টাল সেভিংস ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া চলবে না।
বাংলাদেশ (1) ১: ৯ ১৯ জুলাই ১৯৭১
সুইশ প্রতিনিধির সামনে হাজির হয়ে বাঙলা মিশন কর্মীদের স্পষ্ট জবাব ঃ কেউ পাকিস্তানে যাবে না
নিজস্ব প্রতিনিধি
কলকাতা, ১৮ই জুলাই ঃ বাংলাদেশ মিশনের সংগে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা আজ সুইশ প্রতিনিধিকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা কেউ পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান না। তারা আরও জানিয়েছেন যে, স্বেচ্ছায়, সানন্দে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য পরিবর্তন করেছেন। তাদের উপর কোন শক্তিই কোন চাপ সৃষ্টি করেনি।
আজ সারাদিন ধরে সুইশ রাষ্ট্রদূতের উপদেষ্টা ডঃ বােনার্ড পাক প্রতিনিধি মিঃ মেহেদী মাসুদ এবং ভারতীয় প্রতিনিধি শ্রী অশােক রায়ের উপস্থিতিতে কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হােসেন আলী সহ মােট ৬৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ৬৪ জনের মতামত গ্রহণ করেছেন। সকলেরই এক। উত্তর ঃ না – নানা আমরা পাকিস্তানে ফিরে যাবাে না। একজন বাংলাদেশ মিশনের কর্মী ছুটিতে। আছেন এবং কলকাতার বাইরে থাকায় আজ তার মতামত গ্রহণ করা সুইশ প্রতিনিধির পক্ষে সম্ভব। হয়নি।
বাংলাদেশ (১) # ১: ৯ ॥ ১৯ জুলাই ১৯৭১
পঃ পাকিস্তানে প্রস্তুত পণ্য বয়কট করুন।
– মনসুর আলী
মুজিবনগর, ১৭ই জুলাই ॥ বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী মিঃ মনসুর আলি আজ জনগণের উদ্দেশ্যে আবেদন জানিয়ে বলেছেন যে, তারা যেন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রস্তুত দ্রব্যাদি বয়কট করে এবং শত্রুদের আর্থিক কাঠামাে যেন ধ্বংস করে দেয়। | বাংলাদেশ রেডিও মারফৎ প্রচারিত এক বেতার বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন যে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে এমন কোন শস্য বা পণ্য যেন জনগণ উৎপাদন না করেন। কারণ ওগুলির সাহায্যে পাক সৈন্যরা গণহত্যা চালিয়ে যাবার জন্য হয়তাে আরাে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে থাকবে।
| গ্রামীন অর্থনীতিকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার জন্য কুটির শিল্পের উপর জোর দেওয়া উচিত এবং জনগণের পারস্পরিক বােঝাপড়ার মাধ্যমেই এটা সম্ভব।’
বাংলাদেশ (১) ১ : ৯ ১৯ জুলাই ১৯৭১
জঙ্গী শাহীর সাথে কোন আপােষ হতে পারে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মুশতাক আহমদ সম্প্রতি রয়টারের প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকার কালে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেন যে, জঙ্গী ইয়াহিয়ার সাথে কোন আপােষই চলতে পারে না। তিনি আরও বলেন যে, ইয়াহিয়ার জঙ্গী ফয়সলার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোন সম্পর্ক নেই।
পাক সরকার এবং বাংলার মুক্তি সংগ্রামীদের মধ্যে পুনর্মিলনের কোন সম্ভাবনা আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ইয়াহিয়া যা করতে পারে তা হল অবিলম্বে সৈন্য অপসারণ ও গণহত্যা বন্ধ করা। এবং এটাই একমাত্র সমঝােতা।
জনাব আহমদ আরও বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব সরকার রয়েছে, ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী। সরকারের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। আমরা একটি স্বাধীন জাতি।
তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার সামরিক নিধন যজ্ঞের দরুন যদি গণতন্ত্র বাচতে না পারে তাহলে মানুষ | বৃহৎ শক্তি তথা গণতান্ত্রিক শক্তির উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।
তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী বাংলার অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে পাক জঙ্গী শাহীকে চাপ দেওয়ার জন্য বিশ্ব রাষ্ট্রসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি পাক জঙ্গীশাহীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানান। | তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তিদানের ব্যাপারে বিশ্বের রাষ্ট্রসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
জয়বাংলা (১) ১ : ১১ ২৩ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশ অর্থমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চাওয়ার অধিকার ইসলামাবাদ সরকারের নেই
মুজিবনগর, ১৮ই জুলাই – গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব এম, মনসুর আলী গতকাল সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেন যে, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সুতরাং, বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চাওয়ার কোন অধিকার ইসলামাবাদ সরকারের নেই।
| অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বিশ্বের যে সকল দেশ এবং সংস্থা পাক জঙ্গী পাক সরকারকে সাহায্য দিতে অস্বীকার করেছেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে আরও বলেন যে, একমাত্র সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই বাংলাদেশে। | বৈদেশিক সাহায্য আনতে পারে। তিনি আরও বলেন বস্তুতঃ ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্য করা মানেই হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যায় সক্রিয় অংশ নেয়া এবং বাংলাদেশ সরকার তা কিছুতেই বরদাস্ত করবেন। ।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী তার সারগর্ভ দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠন, বাংলাদেশের সীমিত পরিসরে সরকার কর্তৃক কতিপয় অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণের এবং বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধে দেশবাসীর কতিপয় রূপরেখা বিশ্লেষণ করেন। | অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জনাব মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধে যে সব বাঙ্গালী সন্তান জীবন। দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সেইসব বীর শহীদানের পরিবারবর্গের ভরণ পােষণের দায়িত্বভার গ্রহণের কথা ঘােষণা করেন। তিনি আরও বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধে যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়েছেন তাদের পরিবার বর্গকেও যথাসাধ্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার জন্য সরকার সমূহ চেষ্টা করবেন। | শক্র কর্তৃক বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব বলে ঘােষণা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধোত্তর বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামাে প্রণয়নে যে কথাটি আমরা সব সময়ই মনে রেখেছি সেটি হচ্ছে; চরম দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এই মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। সুতরাং স্বাধীনতার ফল ভােগ করার তাদের সবারই রয়েছে। এবং সেই লাভ থেকে তারা যাতে বঞ্চিত না হন তার যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণেরও তিনি নিশ্চয়তা দান করেন।
হানাদার পাক দস্যু বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে যে সমস্ত দুস্কৃতিকারী বাস্তুত্যাগী বাঙ্গালীদের বাড়ীঘর জোর করে দখল এবং ধনসম্পত্তি লুঠ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সতর্কবাণী
উচ্চারণ করে বলেন যে, এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে এবং প্রকৃত মালিককে তাঁর ধনসম্পত্তি অবশ্যই ফিরিয়ে দেয়া হবে।
তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আরও বলেন যে, জাতির এই চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে নিঃসহায় মানুষের অধিকার যারা পশ্চিমী শক্রর সহায়তায় কেড়ে নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বাঁচার কোন অধিকার নেই।
| বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী দেশবাসীর কর্তব্য ব্যাখ্যা করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপন্ন যাবতীয় দ্রব্য বয়কট, শক্রর সাথে পূর্ণ অর্থনৈতিক অসহযােগিতা অব্যাহত এবং কলকারখানার চাকা বন্ধ রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এককথায় শত্রুর অর্থনেতিক কাঠামাে ভেঙ্গে দিয়ে তাকে কাবু করার আহ্বান জানান।
| শত্রুকে খাজনা ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়া তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সেহেতু ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেরই প্রাপ্য। কোন বিদেশী সরকারের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার। কোন অধিকার নেই। | তিনি জনসাধারণকে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর জোর প্রদান, গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্প গড়ে তােলার, শত্রু কবলিত এলাকায় বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসলের উৎপাদন বন্ধ রাখার এবং গ্রামগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে শত্রুর মােকাবেলা করার আহ্বান জানান।
জয়বাংলা (১) # ১: ১১ | ২৩ জুলাই ১৯৭১
পাকচক্রের মিথ্যে প্রচারণার ধুম্রজাল ছিন্ন সর্বশেষ ব্যক্তিও বললেন না।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ মিশনের সর্বশেষ কর্মচারীও পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে সুইস প্রতিনিধিকে লিখিত ও মৌখিকভাবে সাফ জবাব দিয়েছেন, না, পাকিস্তানে। যাব না।’ ১৮ই জুলাই বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হােসেন আলীসহ অন্যান্য ৬৪ জন কর্মচারীও। সুইস প্রতিনিধিকে একই জবাব দেন। | জঙ্গী ইয়াহিয়া শাহীর বধ্যভূমি পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ মিশনের ৬৫ জন কর্মচারী স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘না’ জবাব দেয়ায় পাক জঙ্গীশাহী তার জয়ঢাক ঢাকা বেতারের মিথ্যা প্রচারের ধুম্রজাল থেকে সত্য উন্মোচিত হয়ে গেল। পাক জঙ্গীশাহী ও ঢাকা বেতার এই সকল সাবেক পাক কূটনীতিবিদকে ভারত সরকার বলপূর্বক আটকিয়ে রেখেছিল বলে অহােরাত্র গলাবাজী। করতাে। পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে সাবেক পাক মিশনের এই ৬৫ জন বাঙ্গালী কর্মচারীরই শুধু এই সাফ জবাব নয় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকেও আজ এই প্রশ্ন করা হলে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এক সুরে শুধু একটি জবাবই দিবেন— আমরা পাকিস্তান চাই না, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চাই ।
| উল্লেখযােগ্য যে, পাক সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র মানুষের উপর বর্বরােচিত সশস্ত্র হামলার পটভূমিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পর কলকাতাস্থ পাক ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হােসেন আলীসহ হাই কমিশনের ৬৫ জন বাঙ্গালী কর্মচারী ১৮ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দেশাত্ববােধের এক গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশের পর পাক জঙ্গী সরকার এতে ভারতের হাত রয়েছে এবং ভারত সরকার জোর করে এসব পাকিস্তানী কূটনীতিবিদকে আটকিয়ে রেখেছেন বলে ঢালাও অভিযােগ শুরু করে শুধু তাই নয়, এরই ঝাল মেটানাের জন্য পাক জঙ্গীশাহী ঢাকাস্থ ভারতীয়
কূটনৈতিক মিশন আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেয় এবং কূটনীতিবিদসহ মিশনের সকল কর্মচারীকে গৃহবন্দী করে রাখে।
| ভারতের বিরুদ্ধে পাক জঙ্গীশাহীর মিথ্যা অভিযােগের সারবত্তা প্রমাণ এবং ঢাকায় আটক ভারতীয়। কূটনীতিবিদকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে দিল্লীতে নিযুক্ত সুইস রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে কলকাতাস্থ সাবেক পাক কুটনীতিবিদদের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মতামত গ্রহণের এই ব্যবস্থা করা হয়।
গত ১৮ই জুলাই কলকাতায় সুইস প্রতিনিধির সাথে বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিবিদ ও অন্যান্য। কর্মচারীর এই বহু প্রতীক্ষিত এবং আলােড়ন সৃষ্টিকারী সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লীস্থ সুইস রাষ্ট্রদূত অসুস্থতার দরুন কলকাতায় উপস্থিত থাকতে না পারায় তার পক্ষ থেকে তার প্রথম সেক্রেটারী ডঃ বােনার্ড তাদের মতামত নেন। অনুষ্ঠানে ভারত সরকারের প্রতিনিধি মিঃ অশােক রায় এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জনাব মেহেদী মাসুদ উপস্থিত থাকেন।
| ডঃ বােনার্ড প্রথমে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হােসেন আলীর সাথে মিশনের নিকটস্থ । একটি বাড়ীতে সাক্ষাৎ করে তার মতামত নেন। পরে একটি স্কুলে মিশনের অন্যান্য ৬২ জন কর্মচারীকে এক এক করে মতামত নেন।
| জয়বাংলা (১) ! ১; ১১ ৫ ২৩ জুলাই ১৯৭১
উদ্ধত আচরণের প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হবে
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের তারবার্তা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল মিঃ উত্থান্ট ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় বলেন ইয়াহিয়া খান বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানের বিচারের প্রহসনে মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাসীর এ বিষয় অজানা নয় যে, জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশের প্রায় ১০ লক্ষ লােককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তার দুবৃত্ত সৈন্যদের অত্যাচারে ৭০ লক্ষের ও বেশী লােক নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
| সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যায় নিমগ্ন হয়ে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের যে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা চাপা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা হিসাবে জঙ্গী সরকার এখন বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রহসনে মেতে উঠেছে, এ ধরনের উদ্ধত আচরণের দ্বারা জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকার তার সৈন্যদের নৈতিক অধঃপতন ঠেকাতে পারবে না। | রাষ্ট্রপ্রধানগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে এ ধরনের কোন উদ্ধত আচরণ বা অপরিনামদর্শী উদ্যোগ নিলে তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক রূপ ধারণ করবে, রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় তিনি বঙ্গবন্ধু তার পরিবারবর্গের মুক্তির ব্যাপারে তাদের প্রভাব বিস্তারের। অনুরােধ জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ পশ্চিম পাকিস্তানে জল্লাদ। সরকারের হাতে বন্দী বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের নয়নের মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কথিত বিচার প্রহসন বন্ধের ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের পৃথক পৃথক এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে সমষ্টিগত আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। মুজিবনগর থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর তথাকথিত বিচার প্রহসনে কেবল প্রতিবাদীই বিচারক এবং রায় কার্যকরকারী। সুতরাং এহেন বিচার প্রহসনের ফলাফল সহজেই অনুমেয়। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া
খানের এই জঘন্য চক্রান্ত অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। আরও বলেন, জঙ্গী সরকারের এই উদ্দেশ্যমূলক বিচার প্রহসনের ব্যাপারে বিশ্ববাসী যদি কেবল নিরব দর্শক হয়ে থাকেন তাহলে ইহা মানবতা ও সভ্যতার মূল্যায়নের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধের কাজ হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানের জীবনের গুরুত্ব শুধু বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যেই নিহিত নয়, বিশ্বের এই অংশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ও তাঁর জীবনের গুরুত্ব অপরিসীম। | তিনি বলেন, পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল এবং বাংলাদেশের জনমত ও মানবাধিকারকে নিষ্পিষ্ট করার অপরাধে অপরাধী জেনারেলদের কোন নৈতিক ও আইনগত অধিকার নেই বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খর মূর্তপ্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বিচার করার।
জয়বাংলা (১) ১ ১২ | ৩০ জুলাই ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
মাননীয় সদস্য ও সদস্যাগণ,
আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা আমার চেয়ে বেশী আপনারাও জানেন। কাজেই নতুন করে আমার বলার প্রয়ােজন আছে বলে মনে করি না।
আজকে এই যুদ্ধের ফলে ৬০ লক্ষেরও অধিক লােক ছিন্নমূল হয়ে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। দলমত নির্বিশেষে ভারতের প্রত্যেকটি মানুষ বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা বিনা দ্বিধায় বুকে তুলে নিয়েছেন আমাদের ছিন্নমূল মানুষকে। আমাদের এত লােক ভারতে চলে যাওয়ার ফলে তাদের বহু কষ্ট হয়েছে, তাদের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড আঘাত পড়েছে, তাদের রাজনীতিতে প্রচণ্ড দোলা লেগেছে, তাদের সামাজিক অবস্থা পতনুখ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতের লােক দলমত নির্বিশেষে আমাদের লক্ষ লক্ষ লােককে বুকে টেনে নিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এই বন্ধুত্বের কথা মনে রাখবেন। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আজ আমরা নিশ্চয়ই ভারতের জনগণকে, ভারতের সরকার এবং ভারতের প্রতিটি রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই, আপনারা যে বন্ধুত্বের হস্ত প্রসারিত করেছেন, তার প্রত্যুত্তরে বাংলাদেশের মানুষ চিরদিনের জন্য আপনাদের বন্ধুত্বের কথা স্মরণ রাখবেন এবং চিরকাল বন্ধুত্বের হস্ত আপনাদের দিকে প্রসারিত করে রাখবেন।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
| আজকের যে ভয়াবহতা সকল দিকে তার পরিমাপ করা এক কথায় সম্ভব নয়। আপনারা বিভিন্ন বিপর্যয় দেখেছেন, বিভিন্ন দাঙ্গা হাঙ্গামা দেখেছেন। কিন্তু বাংলার মাটিতে যা ঘটে গেল তার নজীর সারা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আমার মনে হয় এমন নরহত্যা নারীজাতির উপর নির্যাতন ব্যাপকভাবে পাইকারী ভাবে নাৎসী জার্মানীও ইয়াহিয়ার বর্বরতার কাছে হার মেনে গেছে । আপনি ইতিহাসে দেখেছেন নাৎসী জার্মানীর নারী পুরুষ শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে ইহুদীদেরকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু মাতৃজাতির উপর এমনিভাবে পাশবিক অত্যাচার করে পরে তারা আমার মায়ের জাতিকে গাছে বেঁধে উলঙ্গ করে লজ্জাস্থানে সুটিং করেছে। এর প্রতিশোধ বাংলার প্রত্যেকটি সুসন্ত নিকে নিতে হবে। আমার এই মায়ের জাতিকে সম্মানের আসনে ফিরিয়ে নিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আমরা তা পারব না, ততদিন পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হবােনা; ততদিন পর্যন্ত আমরা মায়ের সুসন্তান দাবী করব না।
| তাই, আমার মাননীয় সদস্য ও সদস্যাগণ, আপনাদের সামনে সমস্যা অতি বড়, এক বিরাট । পরীক্ষা আপনাদের সামনে। ঘূর্ণিঝড় দেখেছেন, তুফান দেখেছেন, মর্মান্তিক ক্ষয় ক্ষতি। সে সব ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় আমরা রিলিফের কাজে যে আর্তের সেবার কাজে গিয়ে হিমসিম খেয়ে। গিয়েছি, মানুষের যা চাহিদা, তা মিটাতে পারিনি। আর আজ বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। যেখানে সুপরিকল্পিতভাবে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত আপনি সুষ্ঠুভাবে তাদের দুঃখ দূর করবেন এটা আশা করা কল্পনা ছাড়া কিছুই হবে না।
আজকে তাই অন্য সব ভুলে গিয়ে আমাদের বড় লক্ষ্য হবে আমার দেশের মুক্তি সংগ্রামকে। জোরদার করা এবং হানাদার বাহিনীকে সমূলে পর্যদস্ত করা। আমাদের আজ বড় লক্ষ্য হবে মাতৃভূমিকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে আমাদের ৬০ লক্ষাধিক ছিন্নমূল মানুষকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা। শুধু তাই নয়, ৬০ লক্ষাধিক যদি ভারতে চলে গিয়ে থাকেন, ১০ লক্ষেরও অধিক যদি মৃত্যুবরণ করে। থাকেন তাহলে সাড়ে ৭ কোটির মধ্যে বাকী সাড়ে ৬ কোটি বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় রয়ে গেছেন। তারা যে নির্যাতন ভােগ করছেন, যে কষ্ট ভােগ করছেন তাদের যে হাহাকার, যে দুঃখ, যে দুঃখ-যাতনা, যে যন্ত্রনাকাতরতা তার বর্ণনা কোন ভাষায় সম্ভব তা আমার জানা নেই। হৃদয় দিয়ে বুঝতে হলেও হৃদয়ের বল অনেক দরকার। ভাল করে বুঝতে গেলেও আমরা নিজেরা সজ্ঞান থাকতে পারব কি না সন্দেহ।
আজ সেই সমস্ত মানুষ পরম দুঃখকষ্টের মাঝেও প্রতিনিধিদের প্রতি চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেন। বাংলার আমাদের যুবকদের আশায় ও মুক্তিবাহিনীর আশায়। একদিন তারা আমাদের উদ্ধার করবেন, একদিন তারা আমাদের লাঞ্ছনা থেকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবেন, সেই আশা করে তারা বসে আছেন। আমার বিশ্বাস বাংলার প্রত্যেকটি যুবক, প্রত্যেকটি প্রতিনিধি সে ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা তাদের সেই অটুট আস্থা, এই আশা পূরণ করবােই করব । আমার মাননীয় প্রতিনিধিরা তার জন্য আজ যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে, সেই সমস্ত বিরাট সমস্যার তুলনায় তা কিছুই নয় । ৬০ লক্ষ । উদ্বাস্তুকে খাওয়ার ব্যবস্থা করা, তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা আপনার আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আজ আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত এবং তাদের জনগণ অকাতরে তাদের করদাতাদের পকেটের টাকা, শ্রমিকগণ তাদের শ্রমলব্ধ পয়সা এবং বিভিন্ন সহায়ক সমিতি পয়সা দিয়ে বাংলার ছিন্নমূল মানুষের জন্য দৈনিক কম হলেও দেড় কোটি টাকা খরচ করে চলেছেন। তা সত্ত্বেও মানুষ পেট ভরে খেতে পাচ্ছেন না। আমি আগেই বলেছি, পেট ভরে খাওয়ানাে সম্ভবও না। আজ তাই, কষ্ট আমাদের হচ্ছে। যদি আমরা দেশকে উদ্ধার করতে পারি তবেই সব কষ্টের লাঘব হবে। তাই আমরা যে সব পরিকল্পনা। করেছি, তার মূল লক্ষ্য দেশ উদ্ধার ।
জয়বাংলা (১) # ১: ১২ এ ৩০ জুলাই ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষ বরদাশত্ করবে না।
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
বঙ্গবন্ধুর বিচার করবে, একথা প্রচার করছে ইসলামাবাদের খুনীচক্র। কিন্তু এ অধিকার তাকে কে । দিয়েছে? ইতিহাসের পথরােধ করে যারা ক্ষমতার দাপটে উন্মাদ হয়ে উঠে, বাংলার সরল প্রাণ মানুষ তাদের শায়েস্তা করেছে। আর তাদেরই অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু আজ বন্দীদশায় কাল কাটাচ্ছেন জঙ্গীশাহীর কারান্তরালে। কিন্তু তাকে বিচার করবার অধিকার তাদের নেই। জবরদস্তি করে এ প্রহসন করলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে বরদাশত করবে না। এ উদ্ধত আচরণের সমুচিত জবাব দেবেই বাংলার মানুষ।
স্বাধীন বাংলাদেশ একটি সত্য। পৃথিবীর মানচিত্রে এ এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম । ইতিহাসে এ। নাম সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্তের অক্ষরে লেখা চিরভাস্বর। এই দেশেরই প্রতিটি মানুষের। প্রাণপ্রিয় সুহৃদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’র অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়, এমন ধৃষ্টতা কার? ‘পাকিস্তান নামের যে দেশটি আজ মৃত, তারই নরপতি ইয়াহিয়া যদি এই দুঃসাহস নিয়ে বিশ্বের মানব গােষ্ঠীকে বােকা বানাতে চায় আর বাংলার সার্বিক মুক্তির অপ্রতিরােধ্য। সংগ্রামকে করতে চায় দুর্বল তবে জেনে রাখাে ইয়াহিয়া তােমাদের জবাবের দিন সমাগত। এবারেতে। প্রতিশােধ কসম নিয়েছি, পালাবার পথ দেবাে না তােমাদের। | জঙ্গী পাক সরকারের হাতে মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে দেড় হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে। বন্দী বাংলাদেশের সাড়ে সাত ৭ কোটি মানুষের নয়ন মণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে জল্লাদ । অধিপতি ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সামরিক আদালতে বিচারের হুমকী সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী। রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার। পরিবারবর্গের আশু মুক্তির জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত। রাশিয়া, গ্রেট বৃটেন, গণচীন, ভারত, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট পৃথক। পৃথক তারবার্তা প্রেরণ করে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। | এ ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী খােন্দকার। মুশতাক আহমদ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্র লীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। যুবশক্তির অদম্য প্রেরণার অফুরন্ত উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে বিশ্বের যুব । সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নেতৃবৃন্দ তাদের বিবৃতিতে বলেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচার করার ন্যায় ও আইনসঙ্গত অধিকার আজ জঙ্গী। সরকারের নেই।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ১২ ॥ ৩০ জুলাই ১৯৭১
ঐতিহাসিক সমাবেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের ভাষণ
আমাদের এ সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
স্বাধীন বাংলাদেশের মাননীয় পরিষদ সদস্যবর্গ
আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার । পর আমরা সবাই আজ এই প্রথম এক সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযােগ পেয়েছি। আমাদের এই সম্মেলন হচ্ছে জাতির এক ক্রান্তি লগ্নে । এমনি এক সময়ে আমাদের এই সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা। আজ যখন এই পরিষদ কক্ষে তখন আমাদের মুক্তিফৌজের বীর নওজোয়ানেরা অপূর্ব বীরত্বের সাথে শত্রুর মােকাবেলা করছে। হাজার হাজার যুবক পবিত্র মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংকল্পে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আত্মােৎসর্গের মহান আদর্শে তারা বলীয়ান। তাদের সমর বিদ্যায় পারদর্শী করে তােলার সর্ব প্রকার । প্রচেষ্টা চলছে।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ, জানি আপনারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ। আপনাদের বিশ্বাস করে তাদের দায়িত্ব আপনাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়েছিল।
| মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আমি জানি আপনারা আমরা সবাই বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিকবই আর কিছু নই । আমি জানি আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবর রহমানের দীর্ঘদিনের সহচর আমরা এবং আমাদের মহান নেতার জীবনব্যাপী আদর্শ আর সংগ্রামের আমরা ধারক ও বাহক।
বন্ধুরা আমরা, আদর্শের জন্য, নীতির জন্য নেতার কাছে আর বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য এই ধরনের অটুট মনােবল আর কোন দেশের জনপ্রতিনিধিরা দেখাতে পেরেছেন কিনা তার নজির আমার জানা নেই। আপনাদের বীরত্ব আপনাদের আদর্শ নিষ্ঠা আপনাদের মনােবল ও মহান ত্যাগের প্রতি, আপনারা যারা গৃহহারা, সর্বহারা হয়েও বাংলার স্বাধীনতা। সংগ্রামে আত্মােৎসর্গ করেছেন, তাদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ আন্তরিক সালাম আর অভিনন্দন।
| বন্ধুরা আমার, নির্বাচন কালে আমরা রমনার রেসকোর্স ময়দানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সেদিন আমাদের মহান নেতা আমাদেরকে শপথ বাণী উচ্চারণ করিয়েছিলেন। আর সেদিন সাক্ষী ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দানের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী জনতা আর সাক্ষী ছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ। আমি আজ গর্বের সংগে বলব সেদিন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সাক্ষী রেখে মহান নেতার হাত ধরে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সে প্রতিজ্ঞায় আমরা অটুট এবং অটল রয়েছি। আমি সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতিবিদ, সারা পৃথিবীর যেখানে যে রাজনৈতিক দল আছেন সবাইকে আমরা বারে বারে আহ্বান করেছি। আবার আহ্বান করি। আপনারা দেখে যান মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞ। রক্ষার জন্য কি ধরনের আত্মত্যাগ আর অটুট মনােবল নিয়ে বাংলার জন নেতারা আজ স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। | বন্ধুরা আমার, আপনাদের আদর্শ নিষ্ঠা। আপনাদের এই আত্মত্যাগ, আপনাদের অসীম মনােবল বিগত তিন মাস যাবৎ স্বাধীনতা সংগ্রামকে জিইয়ে রেখেছেন। অবশ্য সংগে সংগে এই কথা বলতে হবে আমাদের যে সমস্ত বীর সৈনিকেরা, মুক্তিফৌজের যে তরুণ সগ্রামীরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে এদের অপূর্ব বীরত্ব বাংলার মানুষের জন্য এক গর্বের বস্তু। আর ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য এক অপূর্ব বীর গাঁথা। | বন্ধুরা আমার, এর পরবর্তী ইতিহাস যে ভাবে প্রবাহিত হয়েছে তার ধারাবাহিক বিবরণী বিশেষভাবে আমার দেওয়ার প্রয়ােজন পড়ে না। আপনারা জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আপনাদের নেতার কাছে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে দায়িত্ব পালন করতে আপনাদের নেতা এবং তার সহকর্মীবৃন্দ তারা কি কি প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তা আপনাদের জানা আছে।
| জাতীয় পরিষদের যারা সদস্য ছিলেন তারা জানেন একটা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে সেই খসড়া শাসনতন্ত্র আপনাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। আপনারা জানেন সেই খসড়া শাসনতন্ত্র পর্যালােচনা আর পরীক্ষার জন্য ৩০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি আপনারা গঠন করেছিলেন। এই ৩০ সদস্য বিশিষ্ট সাব-কমিটি যখন আলাপ আলােচনা চালাচ্ছিল, সেই সময় আপনারা জানেন মার্চ মাসের ১লা তারিখে কি করে হঠাৎ করে জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব ভুটো সাহেবের পরামর্শে আর ভুট্টো সাহেবের অভিমান রক্ষা করার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দেন। সারা পৃথিবীর কাছে আমরা বলেছি, আপনারা বলেছেন, আজকে পাকিস্তান দ্বিধা বিভক্ত হওয়ার যদি কোন মূল আর সঙ্গত কারণ থাকে, তাহলে সে অবস্থা সৃষ্টি আমরা করি নাই। সে অবস্থা সৃষ্টি করেছেন ইয়াহিয়া খান সাহেব। সেই অবস্থা সৃষ্টি করেছেন ভুট্টো সাহেব। আর সেই অবস্থা সৃষ্টি করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের শােষকেরা, যারা ২৩ বছর পর্যন্ত বাংলার গরীব, চাষী— মজুরের রক্ত শােষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
বন্ধুরা আমার, আওয়ামী লীগের মাননীয় সদস্যবৃন্দ, আমরা কি অপরাধ করেছি। আমাদের একমাত্র অপরাধ ২২ বছর পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম । আমরা বলেছিলাম, বাংলার মানুষকে শােষণ করে বাংলার চাষী মজুরের রক্ত শােষণ করে কায়েমী। স্বার্থবাদীরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদীরা যারা বাংলাকে আজ রিক্ত করেছে, শূন্য করেছে, বাংলার ঘরে ঘরে যারা অনাহারের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে, তারাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়। কিন্তু বন্ধুরা আমার নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সেই সমস্যার সমাধান করতে চাইলাম বলে আমরা নির্বাচনে অংশ । গ্রহণ করেছিলাম। আমাদের নেতা নির্বাচন পরবর্তী কালেও একটার পর একটা চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু যারা কায়েমী স্বার্থবাদের দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিবাদের দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্ত প্রভুদের দালাল, আজ যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের ছত্রছায়ায়। রাজনীতি করে শুধু বিলাস আর ভােগ করতে চায়, যারা বাংলার কোটি কোটি মানুষের স্বার্থকে চেয়ে দেখে নাই, সেই কায়েমী স্বার্থবাদীরা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাে। আওয়ামী লীগের আন্তরিকতাকে তারা দুর্বলতা মনে করে তাকে বানচাল করতে চেষ্টা করলাে। | বন্ধুরা আমার, ১লা মার্চের পর থেকে একটার পর একটা ঘটনা যে কত দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়ে। গিয়েছিল সে আপনারা অবশ্যই নিজেরা নিজের চোখে দেখেছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে যেদিন ইয়াহিয়া খান সাহেব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতবী ঘােষণা করলেন, সেদিন পূর্বাণী হােটেলে আমরা সম্মেলনে আর একবারের মত আর শেষ বারের মত বসেছিলাম। | মাননীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যবৃন্দ, আপনাদের এখানে স্মরণ করিয়ে দেই সেই ঐতিহাসিক। মুহূর্তের কথা যখন আমরা জাতীয় পরিষদের সদস্যরা সেই পূর্বাণী হােটেলে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটার পর একটা প্রতীজ্ঞাবাণী উচ্চারণ করেছিলাম। আর আপনারা সেই। প্রতীজ্ঞা প্রতিধ্বনিত করে আবার বলেছিলেন বাংলার মানুষের কাছে আপনারা বিশ্বাসঘাতকতা । করবেন না।
বন্ধুরা আমার, বিশ্বাসঘাতকতা আপনারা করেন নাই। জঙ্গী শাহীর অত্যাচার, ইয়াহিয়ার প্রলােভন কোন কিছু আপনাদের টলাতে পারে নাই। ইতিহাস এই কাহিনী একদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবে বলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস। | বন্ধুরা আমার, ইয়াহিয়া খান সাহেব আলােচনা করতে চেয়েছিলেন, আলােচনা হয়েছিল। আপনারা নিজ নিজ এলাকায় মফঃস্বলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। অসহযােগ আন্দোলনের বাণী নিয়ে বাংলাদেশের হাটে, মাঠে, ঘাটে, বাংলাদেশের সরকারী আদালতে। বাংলার দেশ-প্রেমিক ব্যবসায়ীবৃন্দ, বাংলাদেশ প্রেমিক ছাত্র জনতার সাহায্যে আপনারা যে অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন, ইতিহাসে তার নজীর নেই। সেই অসহযােগ আন্দোলনের মুহূর্তে যখন আমরা ক্রমে ক্রমে ধাপের পর ধাপ একটা থেকে একটা সঙ্কটের মুখে উত্তরণ লাভ করছিলাম, সেই মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান । সাহেব ১৫ই মার্চ ঢাকায় আলােচনা করতে এসেছিলেন। সেই আলােচনা বসেছিল । আপনারা ছিলেন
। আপনারা অনেকে শুনেছেন, অনেকে দেখেছেন, অনেকে খবরের কাগজে পড়েছেন আলােচনার সূত্রপাত হয়েছিল । ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলােচনা শুরু হলাে। ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি যদি বিন্দুমাত্র সত্য কথা বলেন, আজকে না হােক, কবরে গিয়েও যদি জবাব দেন তাহলে। অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম আলােচনাতেই আপনি স্বীকার করেছিলেন, জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিবেন! স্বীকার করেছিলেন যে, মার্শাল ল উঠিয়ে দিবেন। স্বীকার করেছিলেন ৬-দফা ভিত্তিতে একটা অন্তবর্তীকালীন শাসনতন্ত্র জারী করে ক্ষমতা আওয়ামী লীগের । হাতে তুলে দিবেন। বন্ধুগণ এর ভিত্তিতে আলােচনা শুরু হলাে। বঙ্গবন্ধুর আদেশ এবং নির্দেশে আমি । এবং আপনাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন সাহেব, আমরা আলােচনা শুরু করলাম । জনাব
ইয়াহিয়া খান সাহেবের পক্ষে ছিলেন লেঃ জেঃ পীরজাদা। তাকে সাহায্য করার জন্য আনা হয়েছিল । পাকিস্তানের প্রাক্তন বিচারপতি জাষ্টিস কর্ণেলিয়াস সাহেবকে। আর আনা হয়েছিল অর্থনীতিবিদ বাংলার মানুষের চির শত্রু মীর্জা মােহাম্মদকে। আলােচনা চললাে। ২৪শে মার্চ পর্যন্ত আলােচনা হলাে। আমার বন্ধু তাজউদ্দীন উপস্থিত । আমি বারবার এই কথা বলেছি এই আলােচনা কোন কালেই ব্যর্থ হয় নাই। ২৪ তারিখে ডকুমেন্ট (Document) তৈরী হলাে। জাষ্টিস কর্ণেলিয়াস সাহেব উপস্থিত ছিলেন। উনি যদি একজন সৎ খ্রীষ্টান হয়ে থাকেন তাহলে তাকে একথা স্বীকার করতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আপনারা বলতে পারেন, নিরস্ত্র মানুষকে কেন তারা গুলী করে মারলাে? মাননীয় পরিষদ সদস্যদের বাড়ী ঘর আক্রমণ করলাে। বাড়ী ঘরে কামান চালানাে হলাে। বহু পরিষদ। সদস্যদের জায়গা থেকে জায়গায় খুঁজে বেড়ানাে হলাে। আপনারা সে সব কাহিনী জানেন। | সেই ২৫শে মার্চের রাতের আঁধারে এই বীভৎস ঘটনার প্রতিবাদে আপনারা রুখে দাঁড়ালেন। রুখে দাঁড়ালেন বাংলার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা যে যেখানে ছিলেন। মফঃস্বল শহরে, জেলা শহরে গ্রামে বন্দরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আপনারা রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করবাে আমাদের বীর বাঙ্গালী সৈনিকরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছেলেরা যাদের বীরত্ব আজকের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু বন্ধুরা যা ভাবতেও পারি নাই তাই হয়েছে। আমাদের ই, পি, আর বাহিনী, আমাদের পুলিশ বাহিনী, আমাদের আনসার, আমাদের মােজাহিদরাও বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়াল। বন্দুক আর কামান তুলে নিল । আজ তারা সংগ্রামের পুরােভাগে। বাংলার গ্রামে বন্দরে, গঞ্জে আপনারা দাঁড়ালেন। আমি কি ভাবে যে আপনাদের শ্রদ্ধা জানাব তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। যে সমস্ত মিথ্যাবাদীরা বলে আওয়ামী লীগের নেতারা আর সদস্যরা সংগ্রামের পুরােভাগে ছিল না তাদের আমি জবাব দিতে চাই। বাংলার মানুষ জানে আপনারা ছিলেন পুরাে ভাগে। আমি জানি চট্টগ্রামে, ময়মনসিংহে, যশােরে, রংপুরে, খুলনায়, বরিশালে, ঢাকায়, ফরিদপুরে বাংলার সর্বত্র আপনাদের নেতৃত্বেই সংগ্রাম হয়েছিল। আপনারা সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন বর্বর ইয়াহিয়া। খান বাহিনীর বিরুদ্ধে। নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আপনারা গ্রাম বন্দরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলার সৈনিকদের পাশে পাশে আপনারা ছিলেন। অকুতােভয়ে আপনারা লড়েছেন। বাংলার সৈনিকরা বুকের তাজা রক্ত মাতৃভূমির জন্য ঢেলে দিয়েছেন। এরপরে বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা না করে আর কি পথ ছিল? স্বাধীনতার জন্য লড়াই না করে আর কি উপায় ছিল। তা কি কেউ বাতলে দিতে পারে? মূলতঃ এবং বাহ্যত বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী রেখে যান। আমরা দীর্ঘকাল যারা বঙ্গবন্ধুর পাশে পাশে থেকে সংগ্রাম করেছি, আমরা জানতাম, বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার হয়ে যান তবে স্বাধীনতা ঘােষণা তিনিই করে যাবেন। আর এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম পরিচালনা করে যেতে হবে।
প্রিয় বন্ধুরা আমার, ২৫শে মার্চের রাতের পরে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তাই আপনারা জানেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘােষণা করতে আমাদের একটু বিলম্ব হয়েছিল।
আমরা যে পাঁচজন শেখ সাহেবের পাশে পাশে ছিলাম এবং যাদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকারের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলার বনে, বনে, জঙ্গলে ঘুরেছি। ১৩ই এপ্রিল তারিখে আমরা বাংলার পূর্ব অঞ্চলে সর্বপ্রথমে একত্রিত হলাম । আমার মাননীয় সদস্যবৃন্দ যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সামনে সেদিন আমি আমার সহকর্মীবৃন্দের তরফ থেকে স্বাধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। আমার সেই সমস্ত বন্ধুরা অবশ্যই স্বীকার করবেন তখন এমন একটা সময় ছিল যােগাযােগহীন অবস্থায় যখন আপনাদের বেশীর ভাগই ছিলেন। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে। অথচ একটা সরকার গঠন না করলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে
পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। সেই হেতু সেদিন যারা উপস্থিত ছিলেন সেই বন্ধুদের কাছেই আমরা। পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম।
মাতৃভূমিকে মুক্ত করতেই অস্ত্র ধরেছি | ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আর একটি আম্রকাননে দাড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছি। | বন্ধুরা আমার স্বাধীনতা ঘােষণা করে ১৭ই এপ্রিল সারা পৃথিবীর মানুষকে যে কথা বলেছিলাম আমি বিশ্বাস করি এ আপনাদের অন্তরের বাণী । বিশ্বাস করি ১৭ই এপ্রিলের এই ঘােষণা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে মর্মবেদনার এক অগ্নি স্ফুলিঙ্গের বিরাট স্ফুরণ।। | ১৭ই এপ্রিল স্বাধীনতা ঘােষণার পর আমি আমার সহকর্মী বন্ধু জনাব তাজউদ্দিন সাহেবকে প্রধান। মন্ত্রির দায়িত্ব দিয়ে ছিলাম। তারই পরামর্শে এবং বঙ্গবন্ধুর পূর্বতম নির্দেশের বলে আমি আমার । সহকর্মী বন্ধু জনাব খন্দকার মােস্তাক আহমেদ সাহেবকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাজে নিয়ােগ করেছিলাম। জনাব মনসুর আলী সাহেবকে অর্থমন্ত্রীর পদে নিয়ােগ করেছিলাম। আর জনাব কামরুজজামান সাহেবকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেছিলাম। | ‘আমরা জানতাম আপনারা যে প্রয়ােজনে তাদেরকে দীর্ঘকাল নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছেন আমি আপনাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ না করেও নিঃসঙ্কোচে আর বিনা দ্বিধায় তাদেরকে সরকারের দায়িত্ব। দিতে পারি। | বন্ধুরা আমার, তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়ার পরে তিন মাস চলে গিয়েছে। এই তিন মাস যাবত । আমি আপনাদের কাছে স্বীকার করব, অকপটে স্বীকার করব— যা করার ছিল অনেক কিছু করা। সম্ভবপর হয় নাই। | কিন্তু আপনাদেরকে আমি একটি কথা বলব, জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তার মন্ত্রীসভার । সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের সরকারের। জন্মমুহূর্ত থেকেই কর্ণেল এ জি ওসমানীর মত একজন স্বনামধন্য দেশপ্রেমিক সমরবিশারদকে। সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিরূপে পেয়েছি। আপনারা জানেন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনী জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে কিভাবে আমাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এটাও আপনাদের কাছে অজানা না, যে আমাদের বীর মুক্তি বাহিনী অসীম বীরত্বের সাথে কর্ণেল ওসমানীর। নেতৃত্বে এই বিরাট পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অসম লড়াই লড়ে যাচ্ছেন। | মনে রাখবেন, বন্ধুরা, রণক্ষেত্রে পশ্চাৎপসরণ পরাজয় নয়। যুদ্ধের প্রয়ােজনে পশ্চাৎপসরণ করতে। হয় যাতে পুনরায় তীব্র আক্রমণে জয়লাভ করা যায় । যেদিন হিটলারের বাহিনী ফরাসীদেশ আক্রমণ করেছিল সেদিন শতশত, হাজার হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ফরাসী। সরকারকে ও হিটলারের কাছে মাথা নােয়াতে হয়েছিল।
| আপনারা মনে রাখবেন মাত্র ৩ দিনে সব ধ্বংস করে হিটলারের ট্যাংক বাহিনী প্যারিসের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়েছিল। সেদিন ফরাসী দেশের বীর নায়ক জেনারেল দ্যাগল মাত্র মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ইংলিস চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যাণ্ডের মাটিতে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আপনারা জানেন জেনারেল। দ্যাগল শক্তি সঞ্চয় করে যেদিন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে অবতরণ করেছিলেন সেদিন হিটলারের। বাহিনী তার সামনে টিকতে পারে নাই।
বৃটিশের মত শক্তিশালী সেনা বাহিনীকেও সিঙ্গাপুর থেকে হটে আসতে হয়েছিল। সাময়িকভাবে। বার্মা ত্যাগ করতে হয়েছিল। এইভাবে ঐতিহাসিক পশ্চাৎপসরণ করে তাদের শক্তি সঞ্চয় করতে
হয়েছিল। যুদ্ধে পশ্চাৎপসরণ করতে হয় যুদ্ধের কলা-কৌশলের প্রয়ােজনে। তাই বাঙলার মুক্তি বাহিনী আজকে সাময়িকভাবে যদি কোন কোন রনাঙ্গণ থেকে পশ্চাৎপসরণ করে তবে তাকে পরাজয় মনে করবেন না। আপনারা মনে রাখবেন আমাদের বীর মুক্তি যােদ্ধারা পরাজিত হওয়ার জন্য রনক্ষেত্রে অস্ত্র ধারণ করে নাই। আমাদের বীর মুক্তি যােদ্ধারা জয়লাভ করার জন্যই অস্ত্র ধারণ করেছে। জয় আমাদের হবেই।
বন্ধুরা আমার, আমি জানি আজকে বাঙলার ঘরে ঘরে কি হাহাকার। আমি জানি নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আপনাদের বুকের মধ্যে কি ক্রন্দনের রােল। আমি জানি আপনারা যখন শুনেন আপনার শহরে, আপনার গ্রামে, আপনার গঞ্জে যারা একদিন বিশ্বাস করে, ভালবেসে আপনাদেরকে ভােট দিয়েছিল তাদের ঘর বাড়ী আজকে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন কি মর্মবেদনায় আপনারা পীড়িত হন। | আমি জানি যখন আপনারা শুনেন আপনার প্রতিবেশী নারীদেরকে বর্বর পশুরা ইজ্জতের হানী করছে, আমি জানি আপনাদের কলিজা ফেটে যায়। এই ধরনের অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সৈন্যবাহিনী কোন দিন করে নাই। নারীর ইজ্জত লুষ্ঠিত হচ্ছে আজ আমার বাংলাদেশে। আমার বাংলাদেশে দশ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছে।
আমার বাঙলাদেশের মসজিদ আজকে ধ্বংস করা হয়েছে, বাঙলার মন্দির আজকে ধ্বংস হয়েছে, বাঙলার গীর্জা আজকে ধ্বংস হয়েছে বাঙলার ফসল আজকে মাঠে মাঠে লুটিয়ে পড়েছে। আমাদের বীর তরুণদেরকে আজকে হত্যা করা হচ্ছে, বুলেট দিয়ে গুলি করে মারা হচ্ছে। | এই কাহিনীর মর্মবেদনা আপনাদের বুকের ভিতর যেমন বাজে, আমার বুকে যেমন বাজে আর সকলের বুকেও তেমনি বাজে। যদি বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকতেন তার প্রিয় দেশবাসীর এই মর্মন্তু দুঃখের কথা শুনে তিনি হয়ত অধীর হয়ে যেতেন তাদের মুক্তির জন্য। তাই বন্ধুরা, আপনাদের ব্যথা আমরা জানি । আপনাদের ব্যথা বিশ্ববাসীকে বলার জন্য আপনার মন্ত্রিসভার সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। তারা কি পর্যন্ত সফল হয়েছেন তার বিচার করবেন আপনারা। কিন্তু একটা জিনিস আপনাদেরকে আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। আপনারা সমালােচনা করুন অনেক কিছু হয় নাই। কি ভাবে হতে পারে তার পথ দেখিয়ে দিন। কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা আর কূটনৈতিক কার্যকলাপের দ্বারা আমরা এই কথা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে বাঙলাদেশে আজ গণহত্যা চলেছে। বাংলাদেশে ধ্বংস যজ্ঞ চলেছে, আজকে আপনাদের মন্ত্রিসভা, প্রধানমন্ত্রী নিরলস চেষ্টা দ্বারা সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে ইয়াহিয়া ভুল আর ভ্রান্ত আর আমরা সঠিক পথে চলেছি। আজকে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা তা গ্রহণ করেছে।
চোখ মেলে চেয়ে দেখুন, আজকে লণ্ডনের অবজারভার খুলুন, “সান ডে টাইম” খুলুন, যে কোন পত্র-পত্রিকা খুলুন দেখবেন ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিন্দায় তারা মুখর। নিউইয়র্কের পত্রিকাগুলি দেখুন, যে আমেরিকা সারা পৃথিবীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সেই আমেরিকার জনমত আপনার সরকারকে সমর্থন করছে, নিউইয়র্কের টাইম এবং অন্যান্য সমস্ত প্রভাবশালী পত্রিকাগুলি প্রত্যেকেই আজকে ইয়াহিয়াকে ধিক্কার দিচ্ছে। তারা আজকে আপনার দাবীর নায্যতা তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয় ফরাসী দেশে, ইটালীতে, জার্মানীতে, স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলােতে এমন কি আরবেরও কোন কোন অঞ্চলে বিশেষ করে বৈরুতে আর সুদানের পত্রিকাগুলি আপনার পক্ষে আজকে মত প্রকাশ করে চলেছে।
| বন্ধুরা আমার, আপনারা বলতে পারেন যে এখন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের এই সরকারের স্বীকৃতি কেন লাভ করা সম্ভবপর হয় নাই? কূটনৈতিক প্রশ্নে বৃহৎ শক্তিবর্গ পৃথিবীতে নিজস্ব স্বার্থের কারণে অনেক কিছু করে ।।
| কিন্তু আপনারা জেনে রাখুন যেখানে বিশ্বের জনমত আপনার পক্ষে সেখানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি আপনাকে স্বীকৃতি দেবেই। আমাদের বন্ধু, আমাদের প্রতিবেশী ভারতবর্ষ আমাদের ৬০ লক্ষ শরণার্থীকে শুধু আশ্রয় দেয় নাই আমাদের দাবীর নায্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে সারা পৃথিবীতে আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছায় আজকে এগিয়ে এসেছে। সেই জন্য ভারত সরকারের কাছে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
বন্ধুরা আমার, মুক্তি সংগ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামে একদিকে যেমন সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করতে হয়। চরম আঘাত হানার জন্য তেমনি আর একদিকে কূটনৈতিক আক্রমণের দ্বারা শত্রুকে পর্যদুস্থ করতে হয়। আর তৃতীয়তঃ দেশের অভ্যন্তরের মানুষের মনােবলকে শক্ত রাখতে হয়। আর শত্রুর মনােবল ভাংতে হয়।
| বিদেশে কূটনৈতিক প্রচার চালিয়েছেন আপনার সরকার। মুক্তি ফৌজকে সুসংগঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। দলে দলে, হাজারে হাজারে ছেলে আজ মুক্তি ফৌজে যােগ দেওয়ার জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসছে। সবাইকে সমানভাবে সৈনিকের শিক্ষা দানের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয় নাই। তার একমাত্র কারণ আমাদের সীমিত সামর্থ ।
দ্ব্যর্থহীন ঘােষণা ও নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে।
| বন্ধুরা, ব্যাথায় দুঃখে বুক ফেটে যায় যখন দেখি আমাদের প্রতিবেশী যাকে আমরা বন্ধু বলে মনে। করতাম সেই মহানজাতি চীনের বর্তমান নায়কেরা ইয়াহিয়ার সংগে মিতালি গড়ে তুলেছেন। জানিনা এর পিছনে রাষ্ট্রগত স্বার্থ ছাড়া কি থাকতে পারে। আমরা তাে চীনকে এই দৃষ্টি ভঙ্গিতে দেখি নাই । চীনের বর্তমান নায়কেরা যাই বলুন না কেন মহান জাতি চীনের প্রতি কোন অবিশ্বাস আমরা পােষণ করি না। চীনের সাধারণ মানুষকে আমরা আমাদের ভালবাসাই দেই । আর আবেদন জানাই আপনারা আপনাদের নায়কদের বাধ্যকরুণ-যেখানে কৃষক শ্রমিক মরছে, যেখানে একটা জাতি নির্যাতনে নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানে একটা অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে সমর্থন যেন না জানায়। একটা সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে কি করে আজকে আপনাদের নায়কেরা সমর্থন করছে। তা একবার আপনারা চোখ মেলে দেখুন। তাদের কাছে আমি আবেদন করি।
তবু বন্ধুরা আমাদেরকে সাবধান হতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের স্বাধীনতা অন্য কেউ এনে দেবেনা। নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে। যদি কেউ মনের মধ্যে এই ধারণা করে থাকেন বাইরের কোন রাষ্ট্র স্বাধীনতার মেওয়া ফল এনে দেবে, আমরা সুখ করে খাব তা। হলে সেটা ভুল ধারণা। দশ লক্ষ বাঙ্গালী রক্ত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন মহান নেতাকে স্মরণ করে, আপনাদেরকে মনে করিয়ে দেই যে, রক্ত যখন আমরা দিতে শিখেছি তখন আরাে রক্ত দেবাে, বাংলার মানষকে মুক্ত করে ছাড়বাে । দশ লক্ষ বাঙালী বীরের কসম, যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের কসম দিয়ে। আপনাদেরকে বলছি, আজকে স্বাধীনতার লড়াই-এ প্রয়ােজন পড়লে আরাে আমরা প্রাণ বিসর্জন দিব। আপােষ আর করব না। ইয়াহিয়া খান সাহেব তার শেষ বেতার ভাষণে আমাদের হুমকী দিয়েছেন। এই ইয়াহিয়া খান বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের সদস্য পদ কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা
| ইয়াহিয়া খার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমরা নির্বাচিত সদস্য নই। বাংলার মানুষ আমাদেরকে নির্বাচিত করেছে। তাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যই আজ আমরা গৃহ-হারা, সর্বহারা, আজ আমরা বনে জঙ্গলে ঘুরছি। কে তুমি ইয়াহিয়া? তােমাকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব কে দিয়েছে?
এ দেশের জনগণ-নয় পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও তােমাকে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দেয় | নাই। সেখানেও তাে তুমি নিৰ্বাতি পাঠান, বেলুচ, সিন্ধিদেরকে তুমিও তােমার পূর্ব সুরীরা শাসন করে
চলেছে। পাঞ্জাবের চাষী মজুরদেরকে জমিদারদের অত্যাচারে তুমি সহায়তা করছ। তুমি বাংলার | নিৰ্বাচিত পরিষদ সদস্যদের সদস্য পদ কেটে দেওয়ার যে হুমকী দিয়েছে, তার উত্তর এই ঔদ্ধত্বের উপর রনক্ষেত্রে আমাদের বীর সৈনিকেরা দিবে।
| বন্ধুরা আমার তাই সর্বশেষে আপনাদেরকে বলি সংকল্পে অটুটু থাকতে হবে! দুর্বলতা কোন ভাবে যেন আমাদের মনে স্থান না পায়। মনে রাখতে হবে, যে পরিপূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য স্বাধীন সর্বভৌম বাংলার বিকল্প কোন প্রস্তাব, এর বিকল্প কোন সমাধান আপনাদের কাছে, বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। তৎসত্বেও ইয়াহিয়া খান সাহেবের কাছে বলেছিলাম আহ্বান জানিয়েছিলাম যুদ্ধ। বন্ধ করুন । আর কত রক্ত ক্ষয় করবে বাবা। আমরা দশ লক্ষ মরেছি, তােমার ১৫ হাজার সৈনিককে। | তাে ইতিমধ্যে মুক্তি বাহিনীর লােকেরা খতম করেছে।
মােটের উপর ২৫ থেকে ৩০ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। শুধু আমার বাংলার ঘরে ঘরে মাবােনের ক্রন্দন রােল নয়, আজকে পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে তাে ক্রন্দনের রােল। সেখানের বিধবার মর্মভেদী হাহাকার তােমার কানে পৌছে না? তাই যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান কর।
(১) বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার কর। (২) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দাও। (৩) সমস্ত সেনা বাহিনী প্রত্যাহার কর । আর (৪) যে ক্ষতি করেছ তার ক্ষতি পূরণ দাও। এই চারটি শর্ত আমি দিয়েছিলাম। এই চারটি শর্ত মেনে নিয়ে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে তুমি মীমাংসা করে ফেল । ইয়াহিয়া খান | প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। আঠাশে জুন তারিখে। আঠাশের পর থেকে শান্তিপূর্ণ আলাপ আলােচনার মাধ্যমে
সমস্ত সমস্যার সমাধান করার সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার | মাঠে, রণে, প্রান্তরে, বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কুলে কুলে। বাংলার
ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার শ্যামল মাঠের পথে প্রান্তরে যেখানে মুক্তি ফৌজের বীরেরা মরছে, যেখানে আপনাদের সুযােগ্য প্রধান সেনাপতির নির্দেশে তার সৈন্যবাহিনী রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। তাদের সেই তপ্ত লহু আজ আপনাদের সংকল্পকে আরাে দৃঢ় করুক। বাংলার যে শত শত সতী নারী তাদের ইজ্জত দিয়েছে, তাদের ইজ্জতের কসম ইয়াহিয়ার বাহিনীকে নির্মূল না করা পর্যন্ত আমাদের শাস্তি নাই। বাংলার যে দশ লক্ষ বীর আজ আত্মাহুতি দিয়েছে তাদের অমর আত্মার কসম, প্রতিশােধ না। | নেওয়া পর্যন্ত, বাংলার স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিশ্রাম নাই।
| বন্ধুরা আমার, আপনারা সঙ্কল্পবদ্ধ হউন, আপনারা শপথ করুণ, মুক্তিযুদ্ধে যে কোন অবস্থায়, যে। | কোন অধ্যায়ে আপনারা ঝাপিয়ে পড়বেন। আমি আপনাদের কাছে আকুল আবেদন করব।
| দীর্ঘকাল বহু সুখে দুঃখে আমি আপনাদের পাশে পাশে ছিলাম । আমার প্রিয়তম নেতা জনাব শেখ | মুজিবর রহমান স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন, আপনারা দীর্ঘকাল আমাকে ভালবাসা দিয়েছেন, স্নেহ | দিয়েছেন, আমার বন্ধু তাজউদ্দিন সাহেবকে, যেমন দিয়েছেন আমার বন্ধু কামরুজামান সাহেবকে, | যেমন দিয়েছেন আমার বন্ধু মুরব্বি মােশতাক সাহেবকে মুনসুর আলী সাহেবকে। কোন দিন কি আমর
আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি? বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস, আপনাদের স্নেহ, ভালবাসার বিনিময়ে আমরা | কি কোন দিন আপনাদের আদর্শ থেকে চ্যুত হয়েছি। ২০-২২ বছরের ইতিহাস যদি একথা বলে সুখে দুঃখে, জয় পরাজয়ে গৌরবে-অগৌরবে আপনাদের পাশে পাশে ছিলাম। আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করি নাই। তা হলে আপনাদের কাছে আকুল আবেদন জানাব আবার আপনারা বিশ্বাস। করুন। দেখুন আমরা কি করতে পারি, যদি না পারি তবে শুধু আপনাদের কাছে নয় অনাগত ভবিষ্যতের কাছে আমাদের কি জবাবদিহি করতে হবে। আমার বিশ্বাস আমার মন্ত্রিসভার সদস্যরা ও আমার প্রধান সেনাপতিও এ-সম্বন্ধে সজাগ।
বন্ধুরা, ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল এই তিন বছর আমি আপনাদের পরিচালনা করার দুর্ভাগ্য। বা সৌভাগ্য অর্জন করে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু এই তিন বছর কারাগারে ছিলেন। আইয়ুব শাহীর দাপট আর। অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমি দেখেছি তখনও আপনারা অধৈৰ্য্য হতেন। আমি কোন দিন ধৈৰ্য্য হারাই। নাই। বহুবার আপনাদের বলেছি, সংগ্রামী জয়ী হতে হলে ধৈর্যের প্রয়ােজন। বহুবার সংগ্রামের বহু কৌশল নিয়ে আপনাদের সাথে আমার মত বিরােধ হয়েছে। আমার সহকর্মী ভাইরা, আজকে আমি । গর্বের সাথে বলতে পারি আমার প্রবর্তিত কৌশলের ফলে আমরা ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেছিলাম, তথা আইয়ুব শাহীকে খতম করেছিলাম । | বন্ধুরা আমার, আমি জানি এই বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে আবার বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসাবে। প্রধান সহ-সভাপতি করেছিলেন। এই বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে জাতীয় পরিষদে ডেপুটি নেতা। করেছিলেন।
| আমি জানি, এই বিশ্বাসের বলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আবার আপনারা আমাকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার ভাগ্য এই যে, আমার নেতা, আমার ভাই, আমার প্রিয়তম বন্ধু শেখ সাহেব যখনই-যান, তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব ঘাড়ে পরে যায়।
বন্ধুরা আমার, কিন্তু সেই কাজ চিরকাল আপনাদের পাশে পাশে থেকে করেছি। বন্ধুরা আমার, আজও আপনাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিযদি বিশ্বাস ঘাতকতা করি, যদি সঙ্কল্পে কোন রকম মলিনতা দেখেন, যদি আপনাদের নীতি ও আদর্শ থেকে কোন দিন চ্যুত দেখেন, আপনারা আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এই সংকট মুহুর্তে জাতির স্বাধীনতা এই ক্লান্তি লগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে আজকে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর যেখানে হাজারে হাজারে সৈনিক আজকে বন প্রান্ত। রে ইতিহাস লিখে চলেছে, সেই মুহুর্তে আর একবার আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। আমার বন্ধু তাজউদ্দিন দীর্ঘদিন আপনাদের পাশে পাশে সংগ্রাম করেছে, বহু জেল খেটেছে। আমার ভাই। মােশতাক সাহেব, মনসুর সাহেব, কামরুজ্জামান সাহেব দীর্ঘকাল সংগ্রামের পরীক্ষিত সেনাপতি। তাঁদের উপর আপনারা আস্থা স্থাপন করুণ। একথা আমি বলব না, নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে সমালােচনা আপনারা করবেন না। আলােচনা করার অধিকার আপনাদের আছে। সমালােচনার … একটি – কি করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোড়দার করা। | আর যদি বাংলার স্বাধীনতা এই মন্ত্রি সভার নেতৃত্বে একদিন অজিত হয়, সেই গৌরব আপনারা নেবেন, আওয়ামী লীগের কর্মীরা নিবেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিবেন, মুক্তি যােদ্ধারা নিবেন। আর সেদিন শুধু কিছু ধন্যবাদ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দেন, তবে আমি কৃতার্থ হব । আপনাদের খাদেম আজকে এবং ভবিষ্যতে থাকবাে।
আপনাদের সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ । আচ্ছালামু আলায়কুম।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ১২, ১৩, ১৫ ॥ ৩০ জুলাই ও ৬, ২০ আগসট ১৯৭১
ইসলামাবাদ সরকার একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব এম. মনসুর আলীর বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ।
আমার প্রিয় দেশবাসী সংগ্রামী ভাই ও বােনেরা,
গত চার মাস ধরে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী স্বাধীনতা রক্ষার এক মরণপন সংগ্রাম করে। চলেছি। পশ্চিম পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনীর নগ্ন আক্রমণের মুখে রুখে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি করেছি নতুন ইতিহাস।
| এই সংগ্রামে যে সব স্বাধীনচেতা অকুতােভয় বীর সন্তান শহীদ হয়েছে তাদেরকে আমি গভীর। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। দেশমাতৃকার এইসব বীর সন্তানদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের মৃত্যুঞ্জয়ী। মুক্তিপণে আমরা সবাই দীক্ষিত।
| শক্রর বর্বর আক্রমণে যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছেন তাদের আমার পূর্ন সহানুভূতি জানাচ্ছি। আর যে সব অগণিত বীরসন্তান মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করে হানাদার পশুদের সাথে। প্রত্যক্ষ ভাবে লড়ে চলেছেন স্বাধীনতার রক্ষার শপথে যারা রােদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে দুর্গম এলাকায় দিনের পর দিন বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন সেল, গােলা বেয়নেটের সামনে ঝাপিয়ে পড়ে যারা। শত্রু নিধন করে চলেছেন তাদেরকে জানাচ্ছি আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন।
| চরম দুঃখ কষ্টের মাঝেও বাংলার শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনের যে অকুণ্ঠ সমর্থন। জোগাচ্ছেন বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। বন্ধুগণ,
আমাদের এ সংগ্রাম সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানী শােষণের ইতিহাস আজ আবার নতুন করে বলার প্রয়ােজন নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ একথা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এবং কিভাবে এই উপনিবেশকে। টিকিয়ে রাখা যায় সেই ষড়যন্ত্রেই সব সময় লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশে উৎপাদিত অর্থকরী ফসল বিদেশে রফতানী করে তারা পেয়েছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা, এখানকার কাঁচামালে সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের শিল্প। সংস্থা আর বাংলাদেশ হয়েছে তাদের পণ্যের বাজার মাত্র।
শুধু তাই নয়, বাংলার অগণিত মানুষের হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রমে লব্ধ অর্থে তারা গড়ে তুলেছে এক বর্বর সৈন্যবাহিনী বাঙ্গালীর স্বার্থকে দমন করাই হচ্ছে যে সেনাবাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ। বাঙ্গালী যখনই নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে গেছে এই বর্বর সেনাবাহিনী তখনই। তাদের পশু শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে মুক্তিকামী মানুষের উপর। এরই নগ্নরূপ আমরা দেখেছি। ১৯৫৮ সালে, ১৯৬৯ এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে।
বাঙ্গালীর এই অর্থনেতিক মুক্তির দাবীতেই প্রণীত হয়েছিল ৬ দফা কর্মসূচী। এর ভিত্তিতেই মুক্তির এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। শহরে বন্দরে। হাটে-মাঠে, গঞ্জে-গ্রামে সর্বত্র লাখাে জনতা একই রায় দিয়েছিল ৬-দফা বাঙ্গালীর বাঁচার দাবী । ৬ দফাই আমাদের মুক্তির একমাত্র সনদ। | কিন্তু পশ্চিমা সেনাবাহিনী বরদাশত করতে পারল না এই মুক্তি আন্দোলন। ৬-দফা আন্দোলনের নায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সহ ৩৫ জন বাঙ্গালীকে মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে জগতের। কাছে নিজেদের করলাে হাস্যস্পদ। জনতার রুদ্ররােষে তাদের ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। জনতার রায়ে শেখ মুজিব মুক্ত হলেন। আসল ষড়যন্ত্রকারী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কুখ্যাত আইয়ুব খান উপায়ন্তর না দেখে গদি ছাড়লেন। শান্তি রক্ষার নামে গদি নসীন হলাে ইয়াহিয়া খান । | গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করবে বলে ইয়াহিয়া দেশে সাধারণ নির্বাচন দিল। সে নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৬ দফার পক্ষে তাদের সুস্পষ্ট রায় ঘােষণা করলেন। বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক ৬-দফা আন্দোলনের সমর্থক আওয়ামী লীগ শতকরা ৯৮ ভাগ ভােট পেয়ে জয়যুক্ত হলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিজয় নজির বিহীন। | পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি কায়েমী স্বার্থবাদীদের এ বিজয় সইবে কেন? জনতার রায়কে নস্যাৎ করার জন্যে তারা মরিয়া হয়ে উঠল। চিরাচরিত উপায়ে এবারও তারা তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতে নিয়ােগ করলাে তাদের যাবতীয় দুষ্কর্মের দোসর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, তাদের
এই ষড়যন্ত্রে হাত মিলাল পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক মহল। নেমে এল ২৫শে মার্চের ভয়াল রাত । বন্ধুগণ, | তারপরের ইতিহাস একদিকে যেমন বর্বরতার দুরপনের কলঙ্কে কালিমা ময় অন্যদিকে তেমনি মুক্তিকামী মানুষের আত্মপ্রত্যয়ের ভাস্বর। পশ্চিম পাকিস্তানী নৃশংসতা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কময় অধ্যায়। নাদির শাহ, চেঙ্গিস খান আর হিটলারকেও নৃশংসতায় হার মানিয়েছে। নরখাদক ইয়াহিয়া-টিক্কা খান।
ওরা শুধু লাখাে লাখাে নিরাপরাধ নিরস্ত্র বাঙ্গালীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি এক সুপরিকল্পিত উপায়ে ওরা আমাদের অর্থনীতিকে করেছে সম্পূর্ণ ধ্বংস।
লুণ্ঠিত ধন সম্পত্তি প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আমার প্রিয় দেশবাসী, সংগ্রামী ভাই ও বােনেরা,
পাক সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে, হাজার হাজার পরিবারকে গৃহহারা বাস্তুচ্যুত করে আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে এক চরম সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। | ওরা আমাদের খাদ্যের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, গৃহস্তের সােনাদানা, গরু-ছাগল লুঠ করে তাদেরকে পথে বসিয়েছে। এক কথায় গ্রামীন অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই দিয়েছে চুরমার করে। | শহরাঞ্চলে ওরা দোকান পাট ভেঙ্গে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে এবং অবাঙ্গালীদের দিয়ে দোকানের জিনিষ পত্র লুঠ করিয়েছে। অনেক শিল্প সংস্থা জ্বালিয়ে দিয়েছে; যন্ত্রপাতি খুলে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচার করেছে। বাকী যে কয়েকটি রয়েছে সেগুলােতে বাঙ্গালী কর্মচারীর শতকরা নব্বই জনকে তাড়িয়ে দিয়ে অবাঙ্গালী বসিয়ে দিয়েছে। বাঙ্গালী শ্রমিকরা আজ বেকার; বাঙ্গালী শিল্পের কাঠামাে আজ সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে দিয়েছে। | শুধু তাই নয় শহরে-বন্দরে বােমা নিক্ষেপ করে ওরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালত, সড়ক সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। হাটেমাঠের লােককে ভীত সন্ত্রস্ত করে সাধারণ ব্যবসা বানিজ্যকে করেছে। বিপর্যস্ত। বিভিন্ন সরকারী ও আধাসরকারী সংস্থার হাজার হাজার কর্মচারীকে বরখাস্ত করে অসংখ্য পরিবারকে ঠেলে দিয়েছে অনাহার আর মৃত্যুর মুখে।
সবশেষে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে, অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের হত্যা করে মানবিক সম্পদে আমাদের বিনিয়ােগের পথকে করেছে রুদ্ধ; যার ফলে ভবিষ্যতে আক্রান্ত হতে পারে আমাদের দক্ষতা আর পারদর্শিতা। | কিন্তু বন্ধুগণ, সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা আর কুকর্মের খেসারত পােহাতে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকেও। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে ঘরেও আজ কান্নার রােল পড়েছে, সেখানকার অর্থনীতিও সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পড়েছে।
| বাংলাদেশ থেকে কাচা মাল যাওয়া বন্ধ হবার ফলে তাদের রফতানী বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের বাজার হারিয়ে ফেলায় পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যগুলােই গুদামে পচতে শুরু করেছে। নতুন উৎপাদনের সুযােগ-সম্ভাবনা ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে।
ফলে বহু শিল্প-কারখানা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে পড়েছে। বাকী অনেকগুলােতে প্রতিদিন শত শত শ্রমিক ছাটাই হচ্ছে। বেকারদের অভিশাপ নেমে আসছে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে।
তার উপর রয়েছে সমর পরিচালনার বিরাট ব্যয়ভার। বাংলাদেশে সমরাভিযান অব্যাহত রাখতে ইসলামাবাদ সরকারকে প্রতিদিন ব্যয় করতে হচ্ছে গড়ে এক কোটি টাকা। মুক্তি বাহিনী গেরিলার
হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে, আর ডিভিসনের পর ডিভিসন সৈন্য পাচার করছে। বাংলাদেশে। ফলে খরচের পাল্লা ভারী হয়ে চলেছে প্রতিদিন।
অথচ আয়ের সাধারণ পথ দিন দিন বন্ধ হয়ে আসছে। ইসলামাবাদ সরকার একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
তাই ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ থেকে প্রায়ই জোর করে নতুন ট্যাক্সের নামে টাকা পয়সা লুঠ করে চলেছে। কতিপয় নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়ে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনকে করে তুলেছে বিস্ময়। | তাই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে ধর্ণা দিয়েছিল ইসলামাবাদ সরকারের বিশেষ দূত। কিন্তু তাতেও বিশেষ সাড়া মিলেনি। অগত্যা উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সিকেয় তুলতে হয়েছে। হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছে ইয়াহিয়া সরকার।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সাহায্য সংস্থা পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে অস্বীকার করায় আমরা তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সাথে সাথে আমি একথা সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই—পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আজ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য অথনৈতিক সাহায্য চাওয়ার কোন অধিকারই ইসলামবাদ সরকারের নেই। একমাত্র সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা গঠিত। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য আসতে পারে। বস্তুতঃ ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্য করার মানেই হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যায় সক্রিয় অংশ নেয়া এবং বাংলাদেশ সরকার তা কিছুতেই বরদাসত করবে না।
ভারত সরকার ও জনসাধারণ নানারূপ অসুবিধার মধ্যে লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগী বাঙ্গালীকে বাঁচানাের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা এজন্য তাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। পৃথিবীর আরাে যে সব বন্ধু রাষ্ট্র বিভিন্ন রকম সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাদেরকে ও আমাদের কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি । বন্ধুগন,
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আমরা ইতিমধ্যে ‘বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি।
যেহেতু বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা এখনও শত্রু কবলিত রয়েছে তাই এ মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তবু সীমিত পরিসরে আমরা যে কয়েকটি অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছি তা হচ্ছে এই | (১) এই মুক্তি সংগ্রামে যে সমস্ত বাঙ্গালী সন্তান জীবন দিয়েছে বাংলাদেশে সরকার তাদের পরিবার বর্গের ভরণ-পােষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়েছে তাদের পরিবারকেও যথাসাধ্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার জন্য। বাংলাদেশ সরকার সমূহ চেষ্টা করে যাবে। | (২) শত্রুরা আমাদের অর্থনীতিকে ভেঙ্গে দিয়েছে। মুক্ত এলাকায় এই বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। মুক্ত এলাকায় সরকার এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
(৩) যুদ্ধোত্তর বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামাে প্রণয়নে যে কথাটি আমরা সব সময়ই মনে রেখেছি সেটি হচ্ছে : চরম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই এই মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সুতরাং স্বাধীনতার ফল ভােগ করার অধিকার তাদের সবারই রয়েছে। এবং সেই ফল থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হন তার যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মােট কথা সমগ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
| যে সব দুষ্কৃতিকারী বাস্তুত্যাগী বাঙালীদের বাড়ী ঘর জোর করে দখল করেছে; ধন সম্পত্তি লুঠ। করছে; তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং প্রকৃত মালিককে তার ধন সম্পত্তি অবশ্যি ফিরিয়ে দেয়া হবে।
জাতির এই চরম সংকটময় মুহূর্তে নিঃসহায় মানুষের বাঁচার অধিকার যারা পশ্চিমী শত্রুর সহায়তায় জোর করে কেড়ে নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বাঁচার কোন অধিকার নেই।
বন্ধুগণ,
জানি আপনারা চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জানি এ মুহুর্তে আপনাদের এই অর্থনৈতিক সংকট নিরসন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও আপনাদের কাছে অনুরােধ বিপদে ধৈৰ্য্যচ্যুত হবেন না। আজ আমরা এক অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। একমাত্র, চরম ত্যাগ তীতিক্ষার শপথেই আমরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি।
স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সে কর্তব্য রয়েছে সে গুলাে সম্পর্কে আপনাদের আবার মনে করিয়ে দেবার প্রয়ােজন বােধ করছি। | (১) যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সেহেতু ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা-ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেই প্রাপ্য। কোন বিদেশী সরকারের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে একথা অবশ্যি মনে রাখতে
(২) শক্ররা সুপরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশে চরম দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্যাভাব সৃষ্টি করছে। লাখাে লাখাে বাঙ্গালীকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বাংলাকে সত্যিকার শ্মশানে পরিণত করতে চাইছে।
এমতাবস্থায় প্রতিটি গ্রামকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পন্ন হতে হবে। গ্রামবাসী ভায়েরা আমার; খাদ্য উৎপাদনে আপনাদের যথাশক্তি নিয়ােগ করুন। শত্রু কবলিত এলাকায় বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসলের উৎপাদন বন্ধ রাখুন। কারণ এ ফসল বিক্রী করে শত্রু হাতিয়ার কিনবে বাঙলাদেশের। গণহত্যার জন্যে। | গ্রামীন অর্থনীতির উপর জোর দিয়ে গ্রাম গুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পন্ন করে তুলুন। গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্প গড়ে তুলুন। পরস্পর সহযােগিতার মাধ্যমে নিজেদের বাঁচার পথ বেছে নিন। | বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট ও অন্যান্য অর্থকরী ফসল ইয়াহিয়া সরকার নানারূপ ভয়-ভীতির মাধ্যমে বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করার জন্য মরণাস্ত্র কিনছে। আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই বানিজ্য বাের্ড গঠন করেছে। এই বাের্ড বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল বিদেশের বাজারে বিক্রীর সমূহ ব্যবস্থা করবে। আপনাদের উৎপাদিত ফসল আপনারা এই বাের্ডের মাধ্যমে বিক্রী করবেন। বাংলাদেশের কৃষকরা। যাতে তাদের উৎপন্ন ফসলের উপযুক্ত মূল্য পায় তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্যে বাের্ডের কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছি।
সর্বশেষে নাগরিক ভাইদের কাছে আমার একান্ত অনুরােধ, আপনারা শত্রুর সাথে পূর্ণ অর্থনৈতিক অসহযােগিতা চালিয়ে যান। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত যাবতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ রূপে। পরিহার করুন।
কলকারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখুন। শত্রুকে সদা সর্বত্র নাজেহাল করে তার অর্থনৈতিক কাঠামাে। সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে দিন।
মনে রাখবেন, আপনাদের অসহযােগিতায় শত্রুর তথা পাকিস্তানের অর্থনীতি ইতিমধ্যে প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। আপনাদের পরিপূর্ণ অসহযােগিতায় অচিরে তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। আপনাদের উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। বন্ধুগণ,
| এখানে একটি কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। একথা সত্যি যে শক্র কবলিত এলাকায় আমাদের মুক্তি বাহিনী পুল, সেতু, উড়িয়ে দিয়ে সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। শক্রর আশ্রয়স্থল কতিপয় দালান কোঠা ভেঙ্গে দিচ্ছে। প্রয়ােজনে রাস্তাঘাট কেটে শত্রুর পরিবহন ব্যবস্থাকে অকেজো করে দিচ্ছে।
এতে আমাদের অর্থনীতিতে কিছু ক্ষয় ক্ষতি হচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উপায় নেই।
শত্রু নিধনই আজ আমাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। নিজেদের কিছু ক্ষয় ক্ষতি সহ্য করে ও আমাদের এ কর্তব্য সমাধা করতে হবে। দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি হানাদার সৈন্যও উপস্থিত থাকবে ততক্ষণ আমরা শত্রু-নিধন পর্ব চালিয়ে যাব। সামনে যত বাধাই আসুক না কেন।
| অবশ্যি দেশ সম্পূর্ণ ভাবে শক্র মুক্ত হলে আমরা প্রথমেই এসব রাস্তাঘাট পুননির্মানের কাজ শুরু করব। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় এ সবের পুনঃ নির্মানে বেশী সময় লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস।
বন্ধুগণ, | বাঙালী জাতির ইতিহাসের আজ এক চরম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হতে চলেছে। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেচে থাকার মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে যারা পশু শক্তির বলে বঞ্চিত করতে চাইছে তাদের সাথে আমাদের কোন আপােষ নেই। রক্ত ভেজা পথে এগিয়ে চলেছে বাঙালীর মুক্তি কাফেলা। কালের দেয়ালে পড়ছে রক্তের ছাপ। রক্তের আখরে লেখা হচ্ছে নবযুগের ইতিহাস।
লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ বাঙালীকে হত্যা করে ইয়াহিয়া-টিক্কা যে পাপ করেছে ইতিহাসের কাঠ গড়ায়। তাদের জবাবদিহি করতে হবে। ইতিহাসের অমােঘ দণ্ড এড়ানাের উপায় কারাে নেই।
সাম্রাজ্যবাদের দিন বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীর যে দেশেই মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাভূত হয়েছে। সবক্ষেত্রে একথাই প্রমাণিত হয়েছ যে অস্ত্র প্রয়ােগে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম স্তব্ধ করা যায় না।
বাঙালীর এ মুক্তি-সংগ্রামকেও তাই বুলেট-ব্যয়নেট, সেলগােলায় স্তব্ধ করা যাবে না। রক্তে যখন মাতন জেগেছে, পদ্মা মেঘনায় বান ডেকেছে তখন তাকে রুখতে পারে এমন সাধ্যি কারাে নেই। মর্জি খােদা। জয় আমাদের সুনিশ্চিত এবং সে দিন বেশী দূরে নয় । জয় বাংলা।
| জয়বাংলা (১) ! ১: ১২, ১৩ ৩০ জুলাই ও ৬ আগস্ট ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী
১। স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের আদেশ নির্দেশাবলী মেনে চলুন এবং গ্রামবাসী সকলকে মানতে অনুরােধ করুন।
২। জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পূর্ণ প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টাকে বানচাল করুন।
৩। মুক্তিফৌজকে সর্বপ্রকার সাহায্য করুন— কারণ তাহারা দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়ে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তারা [অস্পষ্ট] সংগ্রামী ভাই এটা আপনার নৈতিক কর্তব্য।
৪। পাক বাহিনীকে সকল প্রকার সাহায্য থেকে বঞ্জিত করুন। আপনার নিজ নিজ বুদ্ধি দ্বারা তাদের ক্ষতি সাধন করুন। | ৫। স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন আপােষ নাই, কষ্ট আমাদের করতে হবে। “রক্ত যখন দিতে শিখেছি তখন আরাে দেব, দেশকে মুক্ত করব, ইনশা আল্লাহ।”
৬। পাক সেনাবাহিনীর তাবেদাররা হুশিয়ার! তাদেরকে একে একে মুক্তিফৌজ সমূলে বিনাশ করবে। আপনারা এগিয়ে আসুন বিশ্বাসঘাতকদের চরম শিক্ষা দিন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১:১ ৪ আগস্ট ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নয়া ডাক টিকেট চালু
(জয় বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি)
গত ২৯শে জুলাই থেকে বাংলাদেশের ওপর ভিন্ন ভিন্ন রকমের আটটি ডাক টিকেট চালু করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব ডাক টিকেট বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে দশ পয়সা থেকে সর্বাধিক দশ টাকার ডাক টিকেট।
কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে এসব ডাক টিকেট কিনতে পাওয়া যাবে। এছাড়া, লণ্ডনেও এসব ডাক টিকেট বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান জনাব হােসেন আলী গত ২৫শে জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে তথ্য প্রকাশ করেন।
ডাক টিকেট গুলাের ডিজাইন করেছেন প্রখ্যাত ডিজাইনার মিঃ বিমান মল্লিক। ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রথম সিরিজের এই ৮টি ডাক টিকেটের মধ্যে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করা হয়েছে।
ভয়বাংলা (১) | ১: ১৩ ৬ আগস্ট ১৯৭১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘোষণা এটা জনযুদ্ধ : ভাড়াটিয়া সৈন্যের যুদ্ধ নয়
| এই সরকারের আয়ের কোন রকম সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত নেই। শুধু মাত্র দান, শুধু মাত্র খয়রাত, শুধু মাত্র ঋণ, আর শুধু মাত্র কিছু কিছু বান্ধব মারফত টাকা সংগ্রহ করে কোন মতে সরকার চলছে। তাই আমাদের বীর যুবকেরা যারা প্রতি নিয়ত আজকে মুক্তি যুদ্ধে নাম লেখাবার জন্য ট্রেনিং গ্রহণ করতে বিভিন্ন অঞ্চলে এগিয়ে আসছেন, তাদের সবাইকে ট্রেনিং এর সুবন্দোবস্ত করা সম্ভবপর হয় নাই । কি করে এই সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে ভাল ট্রেনিং এর বন্দোবস্ত করা যায়, কি করে আমাদের বীর মুক্তি বাহিনীকে আরাে জোরদার করা যায় আপনাদের মন্ত্রিসভার সদস্যরা সেই কথা আপনাদের সঙ্গে আলােচনা করবেন। আমি বিশ্বাস রাখি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনারা গঠনমূলক সমালােচনা দ্বারা ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। আর মনে রাখবেন বর্তমান মুহূর্তে আমরা একটা যুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রয়ােজন ঐক্যের। ঐক্যকে আজকে অটুট রাখতে হবে। সারা পৃথিবীর মানুষ যেন দেখতে যায় পায়] আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা, বঙ্গবন্ধুর শিষ্যরা, বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়করা এক প্রাণ এক মন হয়ে বাঙলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ঐক্যের কোনরকম ফাটল ধরলে তার ফল হবে মারাত্মক। কেউ কেউ বাইরে থেকেও নানা প্রকার প্ররােচনায় আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করতে পারে। সেই সমস্ত প্রচেষ্টাকে আমাদের বানচাল করে দিতে হবে।
আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি আমার মন্ত্রি সভার সদস্যরা মনে প্রাণে এক। তাদের প্রতিনিয়ত চিন্তা মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে কি করে তরান্বিত করা যায় । | তাই বন্ধুরা, যে অটুট ঐক্য আজকে সরকারের মধ্যে বজায় আছে সেই অটুট ঐক্য আজকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নির্বাচিত সদস্য ও কর্মীদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। বন্ধুরা, আমাদের মনে। রাখতে হবে আমাদের প্রধান সেনাপতির বর্তমান রণকৌশলে আমাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। এবং গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় জিনিষ হলাে জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযােগীতা । আপনারা যারা প্রতিনিধি আপনাদের কাছে আমার আকুল আবেদন আমাদের গেরিলা যােদ্ধারা যে রণনীতি আর কৌশলে যুদ্ধ করে চলেছে, এই রণনীতি আর কৌশলে আপনারাই তাদের সর্বাধিক সাহায্য করতে পারেন জনগণের মনােবল অটুট রেখে আর সমর্থন বজায় রেখে।।
আপনাদের মনে রাখতে হবে যারা বন্দুক নিয়ে লড়াই করছে তারাও যেমন মুক্তি যােদ্ধা, আমরা আপনারাও তেমনি মুক্তি যােদ্ধা। এটা জনযুদ্ধ, ভাড়াটিয়া সৈন্যদের যুদ্ধ নয়। এটা হচ্ছে People’s War এই People’s War এর People হচ্ছে সবচেয়ে Important factor.
আর সেই People কে সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব জনসাধারণের প্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে। প্রতিটি সৈনিককে জনতার বন্ধু ভাবতে হবে। নির্যাতীত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত বাংলার মানুষ যেন ভাবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের কর্মীরা, সৈনিকেরা তাদের বন্ধু । যেই বন্ধুত্ব আমরা পেয়েছি, সেই বন্ধুত্বকে অটুট রাখার জন্য আমাদেরকে দিনরাত নিরলস সংগ্রাম করে যেতে হবে। যদি আমরা জনগণের এই সমর্থনকে বজায় রাখতে পারি তাহলে আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি যে, আপনাদের বীর সৈনিকেরা, পৃথিবী যা ভাবছে, তার চেয়ে বহু আগে বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করবে। | বন্ধুরা আমার, মনে রাখবেন এই জনগণের সমর্থন আদায় করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের চরিত্রে, প্রত্যেকের কার্যকলাপে জনগণের বন্ধু, জনতার বন্ধু, নির্যাতীত চাষীর বন্ধু বলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। অত্যাচারী জোতদারদের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতীত চাষীর বন্ধু, অত্যাচারী মিলমালিকের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতীত শ্রমিকের বন্ধু । বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর আমরা বন্ধু । এই বন্ধুত্ব প্রকাশের প্রধান উপায়ই হলাে আওয়ামী লীগের প্রণীত ম্যানিফেষ্টোকে বার বার জনগণের সামনে তুলে ধরা আওয়ামী লীগ ভােট পেলে পরে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে সমস্ত প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করব । এই প্রতিশ্রুতি আমি জনগনকে নেতাদের মাধ্যমে দিয়েছি। আপনাদের প্রতি গ্রামে, গঞ্জে, বন্দরে, এই প্রতিশ্রুতি বার বার দিতে হবে। এই মুহূর্তে যে মুক্তি সেনানীরা যে অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করবে তমুহূর্তে সেই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা, আপনারা অর্থনেতিক সামজিক সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি, তাকে বাহ্য রূপ দেওয়ার সক্রিয় ভাবে কাজে নামবেন। মনে রাখতে হবে সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করবে স্বাধীনতা তারা অর্জন করে দিবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পটভূমিকায় রূপ দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।
সেই দায়িত্ব আপনারা, আমরা যদি পালন করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে আমাদেরকে অনেকে আবার অনেক কথা বলার সুযােগ পাবেন। অনেক স্মৃতিকে মন্থন করে বহু ভুলের জন্য বহু প্রায়চিত্ব
| তাই বন্ধুরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের নীতি আদর্শে আপনারা অটল থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে। এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়ীকতা বা ‘সেকুলারিজমের
মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আমার বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি। এই একটি বিষয়ে। আপনাদের অস্পষ্ট থাকতে হবে। কোন প্রকারে সাম্প্রদায়ীকতার মালিন্যে যেন আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দের নাম ফলনিবাত না হয় সে বিষয়ে আপনাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গণতন্ত্র অর্থই হলাে। সাম্প্রদায়ীকতা যেখানে সাম্প্রদায়ীক ভেদ বুদ্ধি সেখানে গণতন্ত্র কোন দিন কার্যকারী হতে পারে না। | আজ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলে অসাম্প্রদায়ীকতা বা সেকুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান যারা আছেন তাদের মধ্যে এ প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবারই বন্ধু । আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখের সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।
বন্ধুরা আমার, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কাঠামােতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহু পূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারাে মনে সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত যে দেশ আপনারা ভবিষ্যতে পাবেন সেই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে যদি গড়ে তুলতে হয় তাহলে পরে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে। | বন্ধুরা আমার, আদর্শের উপর ফাটল যেন না হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলার বাঙ্গালীর জন্য আমাদের নিবেদিত প্রাণ । বাংলার বাঙ্গালীর স্বার্থে পৃথিবীর যে দেশের সঙ্গে যে কোন জায়গায় বন্ধুত্ব করা দরকার তা আমরা করব । বিশ্বের কোন রাষ্ট্রের কাছে যত বড় রাষ্ট্রই হােক আমরা আভ্যন্তরিণ বা বাহ্যিক কোন দাসত্ব লিখে দেই নাই। ভবিষ্যতেও দেব না। জাতীয় স্বাধীনতার প্রয়ােজনে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সবারই সঙ্গে আমরা আমাদের নিজস্ব স্বার্থে বন্ধুত্বের নীতি গড়ে তুলব। এর নামই হচ্ছে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি বিশ্বের নির্যাতীত মানুষের প্রতিটি জাতীর স্বাধীনতাকে অর্জন করার জন্য আমরা সেই সমস্ত জাতীর পাশে দাঁড়াব। বহু রক্তের বদলে, বহু দুঃখের রজনী পার করে আমরা মেনেছি স্বাধীনতার লড়াই কি? আমরা মেনেছি সাম্রাজ্যবাদীরা যারা এখনও পৃথিবীর দিকে দিকে বিভিন্ন জাতীকে পদানত করে রেখেছে সেই সমস্ত পদদলিত জাতীর বুকের মর্মজ্বালা কি তা আমরা উপলব্ধি করেছি। | বন্ধুরা আমার, এ উপলব্ধি কার না হয় । কিন্তু অনেকেই ভুলে যায়। একদিন আমেরিকাকে বৃটিশের রাজ্যের অধীন থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। বােষ্টনের বন্দরে যেদিন জাহাজ ডুবিয়ে দিল। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এবং জর্জ ওয়াশিংটনের ওসি ঝলসে উঠল। বােষ্টনের তীরে তীরে। আর জেফারসনের বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে দিন মানবতার জয় গান গাইল, সেদিনের আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। তাহলে কেন আজ সাম্রাজ্যবাদ ইয়াহিয়ার জন্য অস্ত্র আসছে। এই ব্যথা বেদনার সাথেই স্মরণ করি বলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে আপনাদের তরফ থেকে মনের বেদনা প্রকাশ করেছি আর প্রতিবাদ জানাচ্ছি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে।
বন্ধুরা আমার, বহু সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সােভিয়েত রাশিয়াকে তার জাতীয় স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল। জারের অত্যাচার সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত পরবর্তিকালে হিটলারের আক্রমণ তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বীর রুশ জাতীর লােকেরা জাতিয় স্বাধীনতার স্বর্ণশিখরে উপস্থিত হয়েছিল। সেই জন্য আপনাদের মাধ্যমে আর একবার আমি মহান রুশ জাতির কাছে আবেদন জানাই। তারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। চিরকাল বাংলার মুক্তিকামি মানুষ সােভিয়েত রাশিয়ার মানুষকে স্মরণ করবে।
জয়বাংলা (১) | ১: ১৪ ৪ ১৩ আগষ্ট ১৯৭১
বাংলাদেশের ডাকটিকিট
কলিকাতা, ২৬শে জুলাই : বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন প্রধান হুসেন আলী কর্তৃক বাংলাদেশের নােতুন ডাকটিকিটের প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বিশ্বের সমস্ত দেশগুলিকে ঐ ডাকটিকিটকে অনুমােদন দানের অনুরােধ করা হয়েছে। | আট রকমের ডাকটিকিট চালু করা হয়েছে। দশ, বিশ, পঞ্চাশ পয়সা, এক, দুই, তিন, পাঁচ ও দশ টাকার টিকিট মুদ্রিত হয়েছে। এই ডাক টিকিটগুলির পরিকল্পনা করেছেন লণ্ডন প্রবাসী প্রখ্যাত বাঙালী শিল্পী শ্রী বিমান মল্লিক। | দশ পয়সার টিকিট এ আছে বাংলাদেশের মানচিত্র, বিশ পয়সার টিকিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের প্রতীক, পঞ্চাশ পয়সা সাড়ে সাত কোটী বাঙালীর প্রতীক, এক টাকার টিকিট বাংলাদেশের পতাকা চিহ্নিত, দুই টাকার টিকিট আওয়ামী লীগের বিজয় এর প্রতীক, তিন টাকার টিকিট স্বাধীন সরকারের ঘােষণার প্রতীক, পাঁচ টাকার টিকিটে শেখ মুজিবের ছবি, দশ টাকার টিকিট বাংলাদেশের সমর্থনের জন্য আবেদনের প্রতীকবাহী।
সােনার বাংলা (বাংলার কথা) | ১:১ [ ১৪ আগষ্ট ১৯৭১
পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আপােষ নেই
আবু সাঈদ
লণ্ডন, ২১শে আগষ্ট—স্বাধীনতা, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কোন আপােষ নেই। বাংলাদেশের মানুষ আজ এমন একটি জায়গায় গিয়ে পৌচেছে, সেখান থেকে তাদের প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। ইরাণের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে শান্তি বৈঠক শুরু হবে বলে গতকাল ‘ডেইলি টেলিগ্রাফে যে সংবাদ বেরিয়েছে, সে সম্পর্কে এক বিবৃতিতে ঢাকা। হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ও বর্তমানে বৃটেনে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী এই মন্তব্য করেন।
জনাব চৌধুরী দ্বার্থহীন ভাষায় ঘােষণা করেন যে, বাংলাদেশ সরকার যে তিনটি সর্তের কথা। উল্লেখ করেছেন, সে সব সৰ্ত্ত পূরণ না হলে কোন রকম শান্তি আলােচনার প্রশ্নই উঠতে পারে না। সৰ্ত্ত তিনটি হলাে (১) পশ্চিম পাকিস্তান সরকার কর্তৃক স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি, (২)। অনতিবিলম্বে গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি এবং (৩) বাংলাদেশের মাটি থেকে প্রতিটি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের অপসারণ।।
তিনি বলেন, আমরা আর ফিরতে পারিনে। ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর গণ-হত্যায় লক্ষ লক্ষ প্রাণ। কোরবান হয়েছে সে ত্যাগ আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারিনে। শহীদদের আমরা ভুলতে পারিনে।
|
বাংলাদেশ (১) # ১; ১২ ২৩ আগস্ট ১৯৭১
শক্রর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরােধ গড়ে তুলুন দেশবাসীর প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আবেদন
মুজিবনগর, ২০শে আগষ্ট ; পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের যে সংগ্রাম তাহা হইল সর্বাত্মক মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামে জয়ী হইতে হইলে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার নয়নমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের নির্দশানুসারে শত্রুর মােকাবিলা করিতে হইবে। তজ্জন্য প্রয়ােজন বাংলাদেশের ঘরে
| ঘরে দুর্গ গড়িয়া তােলা এবং শক্রর অর্থনৈতিক অবরােধ কায়েম করা। অর্থনৈতিক কাঠামাে ধ্বংস। করিয়া দিতে পারিলে শক্র দুর্বল হইবে । বাংলা দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই নির্দেশ প্রচার করিয়াছেন। বাংলাদেশ সরকার। | উক্ত নির্দেশনামায় বলা হইয়াছে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বিভিন্ন ফসল যথা পাট, চা, তামাক | প্রভৃতির উৎপাদনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করুন। শ্রমিকদের নির্দেশ দেওয়া হইতেছে তাহারা যেন কলকারখানায় যােগদান হইতে বিরত থাকেন।
জনসাধারণকে আহ্বান জানাইয়া বলা হইতেছে, আপনারা সামরিক সরকারকে কোন প্রকার ট্যাক্স দিবেন না। আপনাদের ভােটে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার। নির্দেশনামায় বলা হইয়াছে—খেলা ধুলা, আমােদ প্রমােদ বর্জন করুন, বাস্তুত্যাগীদের সম্পত্তি নীলাম ডাক বা বন্ধক লওয়া পরিহার করুন। কোন সরকারী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ লগ্নী করিবেন না। কোথায়ও টাকা জমা থাকিলে তাহা উঠাইয়া লউন। সরকার পরিচালিত বিমান পথ, রেলওয়ে, ষ্টিমার বয়কট করুন। সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী এবং অবাঙ্গালী মালিকানাধীন প্রস্তুত দ্রব্য দৃঢ়তার সঙ্গে বর্জন করুন। আপনিও | একজন মুক্তিযােদ্ধা মনে রাখিবেন, আপনার সক্রিয় সহযােগিতা আমাদের বিজয়কে আরও নিকটবর্তী করিয়া তুলিবে।
বাংলাদেশ (১) ১: ১২ ২৩ আগষ্ট ১৯৭১
রাষ্ট্রপতির যুদ্ধ তহবিলে অর্থ সাহায্য
সম্প্রতি বৃহৎ বােম্বাই বাঙালী সমাজের পক্ষ থেকে শ্রীঅরূপ কুমার সাহা রাষ্ট্রপতির যুদ্ধ তহবিলের জন্য পঁচিশ হাজার টাকার একটি চেক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে প্রদান করেন। সে সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় চেম্বার অফ কমার্স-এর সভাপতি শ্রী এস, বি, দত্ত, জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব কে, এম, ওবায়দুর রহমান এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শ্রী ফণী। ভূষণ মজুমদার। রাষ্ট্রপতি চেক গ্রহণকালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের মহৎ উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
| জয় বাংলা (১) #১: ১৬ | ২৭ আগষ্ট ১৯৭১
| “জন্মভূমিকে শত্রুর কবল মুক্ত করবােই”
—প্রধানমন্ত্রী
মুজিবনগর, ২৯শে আগষ্ট – ‘জন্মভূমিকে শত্রুর কবল মুক্ত করবােই করবাে।” অদ্য | মুজিবনগরের রবীন্দ্র এভিনিউতে ‘জন্মভূমি’ পত্রিকার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের।
প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপরােক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন কেহই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিতে পারবে না, আমাদের স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়ে আমাদেরকেই আনতে হবে।’ | তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন ‘জনগণ বা জনগণের মুখপাত্রের কণ্ঠ চিরকালের জন কোন বর্বর। শক্তি রােধ করতে পারে না, জন্মভূমির পুনঃপ্রকাশ নেই সত্যই পুনঃপ্রমাণিত করলাে!’ | তিনি বলেন আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত, এই যুদ্ধে জয় আমাদের হবেই। যে কোন মূল্যে | বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত
আমরা করবােই।
জন্মভূমির এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বহু সংখ্যক গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সাংবাদিক, সাহিত্যিক, উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম, এ, জি ওসমানী | তাঁর ভাষণে বলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের সুজলা সুফলা জন্মভূমি আজকে মহাশ্মশানে। পরিণত। এই মহাশ্মশানকে সজীব করে দেশের স্বাধীনতা, জনগণের স্বাধিকার ও পুনর্বাসন এবং মানবতাবােধ পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশের সুসন্তানদের গঠিত মুক্তিবাহিনী দৃঢ় সঙ্কল্পে সহিত একনিষ্ঠ ভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘জন্মভূমি’ এই প্রচেষ্টার উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা। যােগাবে।’
“জন্মভূমি’র পুনঃ প্রকাশে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম | এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, “বাঙালী জাতির এই যুগসন্ধিক্ষণে জন্মভূমির পুনঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের জন্য এক নুতন অধ্যায় রচিত করলাে। তিনি বলেন, ‘এ-হিয়া সরকার যদি বাংলাদেশের আশা আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন বন্ধ করে তাহা হলে সারা পৃথিবীতে এর ভীষণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে এবং গণতন্ত্রের অপমৃত্যু হবেই। তিনি বলেন, বাংলায় শােষণমুক্ত দিন ফিরিয়ে আনার ঐকান্তিক সাধনায় ব্রতী হােন, এই আমার আন্তরিক কামনা।’ জনাব খন্দকার মােশতাক আহম্মদ —“আমি জেনে অত্যন্ত …।
জন্মভূমি ॥ ১: ৬ ৩০ আগস্ট ১৯৭১
বিদ্রোহী নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার ভাতা দেবে
(ষ্টাফ রিপাের্টার)।
মুজিবনগর, ২৯শে আগষ্ট বাংলাদেশ সরকার বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামকে মাসিক ৩৫০ টাকা ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের সম্পাদক মােস্তফা আল্লামার সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহম্মদ জানান যে, “বিদ্রোহী কবির প্রতি বাংলাদেশের অধিবাসীদের প্রগাঢ় ভালবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ বহুবিধ আর্থিক সমস্যা থাকা। সত্ত্বেও এই ভাতা মঞ্জুর করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এই ভাতা মঞ্জুর করেছিলেন এবং গত ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত কবিকে নিয়মিত এই ভাতা দেওয়া হত । কিন্তু জঙ্গী এহিয়া সরকার গত মার্চ মাস থেকে এই ভাতা বন্ধ করে দেয়।’
জন্মভূমি # ১: ৬ ! ৩০ আগস্ট ১৯৭১
গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জরুরী বিজ্ঞপ্তি।
এতদ্বারা সৰ্বসাধারণকে জানান যাইতেছে যে বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলে ও সীমান্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের নিযুক্ত কর্মচারী ব্যতীত কেহ কোন প্রকার শুল্ক, কর, খাজনা বা চাঁদা আদায় করিতে পারিবে না। কেবলমাত্র সরকার অনুমােদিত কর্মচারী উপযুক্ত রসিদযােগে উল্লিখিত কর প্রভৃতি আদায় করিতে পারিবেন। | ইচ্ছাছাড়া যদি কেহ অন্যায়ভাবে কোন প্রকার কর আদায় করেন তবে তাহাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হইবে।
বাংলাদেশ মিশন লণ্ডনে (বিশেষ সংবাদদাতা]
বাংলাদেশ মিশনের একটি অফিস আজ আনুষ্ঠানিকভাবে লণ্ডনে খােলা হয় বলে বি, বি, সির | খবরে জানা যায়।
খবরে আরাে জানা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই মিশনের প্রধান পদে নিযুক্ত হন। ভারতের বাইরে বাংলাদেশ মিশন এই প্রথম খােলা হল বলে জানা যায়।
বাংলার কথা ৪ ১: ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশন (বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত) ‘
নয়া দিল্লী : ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ উপলক্ষে আয়ােজিত এক গাম্ভীর্য পূর্ণ অনুষ্ঠানে নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব কে, এম, শাহাবুদ্দিন লাখাে বাঙ্গালীর খুনে রঞ্জিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় জনাব শাহাবুদ্দিন বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত সরকারের আন্তরিক সহযােগিতা ও সহানুভূতির জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। | স্মরণ করা যেতে পারে যে, কূটনীতিক জনাব শাহাবুদ্দিন এবং জনাব আমজাদুল হক নয়াদিল্লীস্থ অধুনালুপ্ত পাকিস্তান হাই কমিশনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন । জনাব শাহাবুদ্দিন পাকিস্তান হাই কমিশনের সেকেণ্ড সেক্রেটারী ছিলেন। এঁদের পরে হাই
কমিশনের বাঙ্গালী ষ্টাফ জনাব আবদুল করিম এবং জনাব আবদুল মজিদ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
জয়বাংলা (১) ! ১ : ১৭ # ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
লণ্ডনে বাংলাদেশ মিশন
ভারতের বাইরে লণ্ডনে ২৭শে আগষ্ট আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ মিশনের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বি বি সি এ খবর দিয়েছে।
মিশনের নেতৃত্ব করছেন বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী।
জনাব চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে শেখ মুজিবকে বন্দী করে রেখেছে। তিনি অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করেন। | বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে আবেদন জানান। এ ছাড়া ইয়াহিয়া সরকারকে তিনি সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার জন্যও সব রাষ্ট্রের নিকট আবেদন জানান। কারণ, ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহী এই সব আর্থিক ও সামরিক সাহয্য বাংলাদেশে গণহত্যায় ব্যবহার করে চলেছে। বাংলাদেশ মিশন, ২৪ পেম ব্রিজ গার্ডেনস, লণ্ডন ওয়েষ্ট-২ ঠিকানায় স্থাপিত হয়েছে।
জয়বাংলা (১) # ১ : ১৭ ৪ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বৃটেনে বাঙলাদেশ মিশন
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
গত ২৭শে আগষ্ট লণ্ডনে স্বাধীন বাংলাদেশ মিশনের উদ্বোধন করা হয়েছে। মিশনের প্রধান হিসেবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কাৰ্যভার গ্রহণ করেছেন। মিশনের উদ্বোধনকালে জনাব চৌধুরী শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তিদান, স্বাধীন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদান ও পাকিস্তানকে সকল প্রকার সাহায্য প্রদান বন্ধের জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আবেদন জানান।
‘মিশন’ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বি, বি, সি,-র জনৈক ভাষ্যকার বলেন, বৃটিশ সরকার বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছেতাই বাঙলাদেশ মিশনকেও স্বীকৃতি দিবেন। উল্লেখযােগ্য যে, ইতিপূর্বে। ভারতের কলিকাতা ও দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশন খােলা হয়েছে।
| বাঙলাদেশ [ ১ : ২ [ ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশন স্থাপিত
৩০শে আগষ্ট, আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, দিল্লীতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং কোরন, গীতা, বাইবেলের শ্লোক পাঠের মাধ্যমে আজ এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা দেশ মিশনের উদ্বোধন করা হয়। সরকারী ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের এটি চতুর্থ মিশন। আনন্দ নিকেতনের একটি ভাড়া বাংলােয় এই মিশন স্থাপিত হয়। এই অনুষ্ঠানে সাংবাদিক, কূটনীতিক এবং এদের বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতিতে মিশনের প্রধান মিঃ কে, এম, শাহাবুদ্দিন বলেন, ভারত আমাদের নতুন রাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতি এবং সমর্থন জানিয়েছেন। আমরা আশা রাখি ভারত শীঘ্রই আমাদের কূটনীতিক স্বীকৃতি দেবেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ৪ ১ : ৪ ৪ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের নতুন টাকা।
মুজিবনগর ৫ই সেপ্টেম্বরগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আগামী অক্টোবর মাস থেকে তাদের নিজস্ব টাকার নােট বাহির করিবে বলিয়া বিশেষ সূত্রে জানা গেছে। প্রথম পর্যায়ে ১, ৫ ও ১০ টাকার নােট বাহির করা হবে। নােটগুলির এক পিঠে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের ছবি ও অপর পিঠে। নৌকার প্রতিকৃত থাকবে।
উন্মভূমি £ ১ : ৭ ॥ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
জঙ্গীশাহীর পরাজয় স্বীকৃত
মুজিবনগর, ৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহমদ গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেন, জঙ্গীশাহী পশ্চিম পাকিস্তানের আগেই বাংলাদেশের লােক দেখানাে অসামরিক শাসন প্রবর্তনের তাগিদ অনুভব করলেন এবং গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের অগ্রনায়ক মহাপরাক্রান্ত টেক্কা খাকে অপসারিত করলেন তাতে তাদের বাংলাদেশে প্রথম দফায় পরাজয় স্বীকৃত। | তিনি বলেন ডঃ মালিক বিশ্বাসঘাতক কুইসলিং ছাড়া কিছুই নয়। বিশ্বের জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য তাকে এহিয়া সরকার তার হাতের পুতুল বানিয়ে দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে।
জনাব আহম্মদ বলেন, পাকিস্তানের কোন ব্যবস্থাই বাংলাদেশের জনগণ মানবে না। তারা অসামরিক শাসন বলতে শুধু তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনকেই বােঝে। আয়ুব খার পর এ-হিয়ার অসামরিক শাসনের ধােকাবাজি বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। তিনি আরও বলেন, ‘ডঃ মালিক একজন বৃদ্ধ । তার থাকার মধ্যে সন্দেহজনক অতীত, ভবিষ্যত বলতে কিছুই নাই।।
জন্মভূমি [ ১ : ৭ # ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তি পেতেই হবে।
মুজিবনগর, ৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গতকাল স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক বেতার ভাষণে বলেন, “দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবের প্রাণ নাশের ষড়যন্ত্র করছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরই । তিনি বলেন বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে ভারত-রুশ মৈত্রী চুক্তির ফলে। | জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার কৌশল হল বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করা। ঘৃণ্য টেক্কা খানের আসনে বেসামরিক ক্রীড়নক বসানাে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ধিকৃত বাঙালীকে জাতিসংঘ প্রতিনিধিরূপে পাঠানাে—এ সবই তার ছদ্ম আবরণ। ( পরিশেষে তিনি বলেন “যাদের সাহস আত্মােৎসর্গ ও সাফল্য সারা জাতিকে গৌরবে পূর্ণ করেছে এবং মহান ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত করেছে, সেই মুক্তি যােদ্ধাদের জন্য কামান করি সকল
জয়বাংলা
জন্মভূমি ॥ ১; ৭ ॥ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
বাংলাদেশের ডাক টিকিট
কলিকাতার কূটনৈতিক মিশন-প্রধান জনাব হােসেন আলী বাংলাদেশের নতুন ডাকটিকিটের প্রদর্শন সম্প্রতি আরম্ভ করেছেন। এই ডাকটিকিটগুলির পরিকল্পনা করেছেন লণ্ডন প্রবাসী বিশ্ববিখ্যাত বাঙালী শিল্পী বিমান মল্লিক। | মােট আট রকমের ডাকটিকিটের মধ্যে দশ পয়সার টিকিটে আছে বাংলাদেশের মানচিত্র, বিশ পয়সার টিকিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ডের প্রতীক, পঞ্চাশ পয়সার টিকিটে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রতীক। এক টাকার টিকিটে বাংলাদেশের পতাকা, দুই টাকার টিকিটে আওয়ামী লীগের ৯৮% ভােটে বিজয়ের প্রতীক, তিন টাকার টিকিটে স্বাধীন সরকারের ঘােষণার প্রতীক, পাঁচ টাকার টিকিটে শেখ মুজিবের ছবি, দশ টাকার টিকিট বাংলাদেশের সমর্থনের জন্য আবেদনের প্রতীকবাহী।
জন্মভূমি ॥ ১ : ৭ ॥ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বিদ্রোহী কবির ভাতা বাংলাদেশ মিটিয়ে দিলেন
মুজিবনগর, ৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কলিকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হােসেন আলি বিদ্রোহী কবিকে গত মার্চ মাস থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত ভাতা মাসে ৩৫০ টাকা হিসাবে ২১০০ টাকার একটি চেক প্রদান করেছেন।
এখানে উল্লেখযােগ্য গত মার্চ মাস থেকে পাকিস্তান সরকার কবিকে ভাতা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকার কবিকে ভাতা দেওয়ার ঘােষণা করার পরে পাকিস্তান সরকার আবার বিদ্রোহী কবিকে ভাতা দেবে বলে প্রকাশ করলে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী তাহা প্রত্যাখান করেন।
জন্মভূমি ১: ৭ ॥ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
স্বাধীন বাংলা সরকারের শুল্ক বিভাগ
রৌমারী ॥ ৬ই সেপ্টেম্বর –
শুল্ক বিভাগ পরিবেশিত সংবাদ সূত্রে প্রকাশ গত ১৫ দিনে রৌমারী থানার ও তদসংলগ্ন মুক্ত এলাকা থেকে মােট ৭৫ হাজার শুল্ক আদায় হয়েছে।
অগ্রদূত [ ১: ২ # ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দূনীর্তি
রৌমারী : ৫ই সেপ্টেম্বর
আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা কর্তৃক পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ গত কয়েকদিন পূর্বে মােল্লার চরের হাটে শুল্ক বিভাগের জনৈক কর্মচারী দুনীর্তির দায়ে ধৃত হন। তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন জানার জন্য এ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়।
অগ্রদূত ॥ ১ : ২ ॥ ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নবতর পর্যায় সরকারকে উপদেশ দানের জন্য সর্বদলীয় কমিটি গঠন
বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে বাংলাদেশের ৪টি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ের একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যগণ হচ্ছেন : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ভাসানী ন্যাপ), মিঃ মনি সিং (বাংলাদেশ কনিষ্ট পার্টি), মিঃ মনােরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস), অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ (মুজাফফর ন্যাপ), জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, প্রধান মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও খােন্দকার মােস্তাক আহমদ, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এছাড়া কমিটিতে আওয়ামী লীগের আরও দুইজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক আহ্বান ও পরিচালনা করবেন।
গত বৃহস্পতিবার প্রচারিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, মুজিব নগরে দলগুলার নেতৃবৃন্দের দুই দিন ব্যাপী বৈঠক শেষে সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটি গঠন করা
মুজিব নগরের বৈঠকে যােগদানকারী নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি দৃঢ় আস্থা ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেন। নেতৃবৃন্দ বিজয়ের দিনটিকে নিকটতর করার জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমবায়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পশ্চাতে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থন দানের জন্য নেতৃবৃন্দ বিশ্বের মুক্তি কামী ও সংগ্রামী মানুষের প্রতিও আবেদন জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, আওয়ামী লীগ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশে যা একমাত্র বৈধ সরকার প্রতি আস্থাবান বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুক্তি কামী মানুষের সার্বিক-ঐক্যের অভিব্যক্তি ঘটেছে এই কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শােষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় সংগ্রামে লিপ্ত সকল মত ও পথের মানুষের মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহণের ধারণা নিশ্চিত করা হয়েছে। | সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত জাতীয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানের বে-আইনী আটকের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ কর্তৃক শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের নির্লজ্জ প্রচেষ্টার নিন্দা করা হয়। সভা এই পৈচাশিক বিচার বন্ধ করে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধানের মুক্তির জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে বিশ্বে সমস্ত শক্তি ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান হয় । | সভার দ্বিতীয় প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আন্তরিক আস্থা ও বিশ্বাস জ্ঞাপন করা হয় এবং বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিক সমর্থন দানের কথা ঘােষণা করা হয়।
তৃতীয় প্রস্তাবে ভারতসহ বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান করে বাংলাদেশের শান্তি ও গণতন্ত্রকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান হয়। সভা বাংলাদেশ সরকারকে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ প্রদান সহ সর্বপ্রকারে সক্রিয় সাহায্য দানের জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি অনুরােধ জানান হয়। | চতুর্থ প্রস্তাবে সভা মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীদের দখলদার বাহিনীর কবলমুক্ত করার জন্য শত প্রতিকুলতার মধ্যেও বাংলাদেশের মুক্তি যােদ্ধারা যে বীরত্বের পরিচয়
দিয়েছেন কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্বীকার করা হয় এবং এ কাজে মাতৃভূমির যে সমস্ত বীর সন্তান শাহাদাৎ বরণ করেছেন তাদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ।
পঞ্চম প্রস্তাবে বাংলাদেশের সর্বহারা বাস্তুত্যাগীদের প্রতি অকাতরে সাহায্যের হস্ত প্রসারের জন্য ভারতের জনগণ ও ভারত সরকাররের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থনের জন্যও সভা সন্তোষ প্রকাশ করে।
অপর এক প্রস্তাবে সভা শােষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি একাত্মতা ঘােষণা করে এবং বাংলাদেশে তাদের ভাইদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানাে হয়। | সভায় ৭ম ও সর্বশেষ প্রস্তাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করা হয় যে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন রাজনীতিক সমাধান কোনদিনও বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না। প্রস্তাবে বলা হয়, মুক্তি অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং রক্ত যদি মুক্তির মূল্য হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণ প্রতি মুহূর্তেই তা দিয়ে চলেছেন।
দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সভায় উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ৬ জন জননায়ক ছাড়াও বাংলাদেশ। সরকারের অর্থ মন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব এ,এইচ, এম, কামারুজ্জামান ও বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা জনাব এম, এ, সামাদ উপস্থিত ছিলেন।
জয়বাংলা (১) # ১ : ১৮ ! ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
শত্রুর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটি নিশ্চিতরূপে ঘনিয়ে এসেছে
গত ৫ই সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত এক ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ দৃপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করেন : ঘূর্ণিঝড় বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের ওপরে বাংলার প্রাণশক্তির জয় অবশ্যাম্ভাবী। তিনি বলেন শক্রর অর্থনীতিকে বানচাল করার জন্য আমাদের দৃঢ়নীতি, জলে স্থলে, আমাদের মুক্তি যােদ্ধাদের উজ্জ্বল সাফল্য শত্রুর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটিকে নিশ্চিতরূপে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।
| বাংলাদেশে দুর্গত মানবতার জন্য প্রেরিত ত্রাণসমগ্রী পাকিস্তান সরকার যেভাবে দখলদার সৈন্যের। জন্য ব্যবহার করছে তার উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দীন জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের প্রতি হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন বিশ্ব প্রতিষ্ঠান যদি পৃথিবীর এই অংশে তার মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে চায় তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণকার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হতে পারে।
মাঝে মাঝে আপােষের নামে বিভিন্ন মহল থেকে যে সব প্রস্তাব করা হয় সেগুলােকে ‘ছলনাময়” বলে উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দীন দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘এসব প্রস্তাব চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে আপােষহীন সংকল্পকে দুর্বল করে দেয়া। এটা আমাদের জন্য ফাদ হতেও পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। | বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের বিষয় উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালােবাসা মেখে যিনি তাদের সুখের স্বপ্ন দেখেছিলেন দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দী জীবন যাপন করছেন। আমি দেশবাসীকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবর রহমানের প্রাণ নাশের ষড়যন্ত্র করেছে পরিনামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। | উপসংহারে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ জাতিকে ধৈৰ্য্য, সাহস ও একতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবসানে দেশের পুনঃগঠনের জন্য এই গুণগুলাে অর্জন করা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক।
| প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ তার বেতার ভাষণে বলেনঃ “আপনার উদ্দেশ্যে গতবার | আমার বক্তব্য পেশ করার পরে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে গেছে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে জীবন মরণ সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল এই যে, সামরিক শাসকচক্রের পশ্চিম পাকিস্তানী ক্ষমতার ভিত্তিতে ভাঙন ধরেছে এবং বাংলাদেশে তাদের মুষ্টিমেয়। নিরাপদ এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে এসেছে। তাদের অর্থনীতিকে বানচাল করার জন্য আমাদের দৃঢ় নীতি, জলেস্থলে আমাদের মুক্তি যােদ্ধাদের উজ্জ্বল সাফল্য এবং আমাদের প্রতিরােধের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গভীরতা—শক্রর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটিকে নিশ্চিতরূপে এগিয়ে নিয়ে এসেছে।। এ সত্ত্বেও ধৈর্য ও সাহসের প্রয়ােজনীয়তার উপরে আমি জোর দিতে চাই। শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবসানে দেশের পুনর্গঠনের জন্য এই গুণ দুটি অর্জন করা আজ আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক।
বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের সুযােগ লাভে তারা ব্যর্থ হয়েছে। | বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। এই ভারসাম্যের উপর | ভরসা করে শত্রুপক্ষ যা লাভ করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সফল হতে পারে নি। এর নবতম প্রমাণ | ভারত সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির যে বিস্ময়কর পরিচয় আমরা লাভ করেছি, নিঃসন্দেহে আমরা তারই উপর নির্ভর করি। তবে যে সব মহলে আগে শুধু সতর্কতার মনােভাব দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে যখন সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন আমাদের সন্তোষের কারণ ঘটে বৈ কি! কোন কোন দেশের সরকার এখনও অবশ্য নীতিবিবর্জিত ভুমিকা পালন করছে—যদিও সে-সব দেশের জনসাধারণ আমাদের প্রতি দ্বিধাহীন সমর্থন জ্ঞাপন করছে। আমরা শুধু আশা করব যে, এসব দেশের জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের আচরণের এই অসংগতি শীঘ্রই দূর
জাতিস যদি স্বীয় মর্যাদা বজায় রাখতে চায়…. | পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য যে বাংলাদেশের জনগণের ধ্বংস সাধন, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং, তারা যে জনগণকে ত্রাণ সাম্ৰগী ঠিক মতাে পৌঁছে দেবে, সেকথা | বিশ্বাস করার মতাে লােক পৃথিবীতে বিরল। তবু বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে। সাহায্য দিয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে তা দখলীকৃত এলাকায় বিলি করার ব্যবস্থা সংগত বিবেচনা করেছেন জাতিসংঘ। বিগত ঘূর্ণিঝড়ের পরে রিলিফের জন্য যে সব হেলিকপ্টার, জলযান ও অন্যান্য যানবাহন এসেছিল, বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধেই পাকিস্তান সরকার নির্বিকার চিত্তে সে সব ব্যবহার করেছে। দুর্গত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বহু সামগ্রী দখলদার সৈন্যদের প্রয়ােজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের সেবাদলে এখন একদল যােগাযােগ-বিশেষজ্ঞ এসেছেন উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতি নিয়ে । এতে পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর রণকৌশলে যে সাহায্য হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় ত্রাণ । কার্যের মানবতাবাদী উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হবার ঘােরতর আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারী । জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব-প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে চান তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণ কার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়।
আপােষ প্রস্তাবের আসল উদ্দেশ্য কি—
| ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের প্রকাশ্য বর্বরতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। মাঝে মাঝে আপােষের কতকগুলাে প্রস্তাবের মাধ্যমে তার গােপন ছলনার পরিচয়ও আমরা পাচ্ছি। এইসব।
প্রস্তাব চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের আপােষহীন সংকল্পকে দুর্বল করে দেওয়া। শত্রুপক্ষ আপােষ চাইতে পারে দুটি কারনে হয় সে দুর্বল, হয় সে আমাদের জন্য ফাঁদ পেতেছে যে ফাদ সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
ক্রীড়নক বসানাের অন্তরালে | জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার কৌশল হল বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করা । ঘৃণ্য টিক্কা খানের আসনে বেসামরিক ক্রীড়নক বসানাে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ধিকৃত বাঙালীকে জাতিসংঘে প্রতিনিধিরূপে। পাঠানাে—এ সবই তার ছদ্ম আবরণ। সে মিথ্যা আশা করে যে, এতে অব্যাহত সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা ও জনমতদলনের নিষ্ঠুর সত্যকে ঢাকা দেওয়া যাবে।
গণপ্রতিনিধিরা ফাঁদে পা দেবেন না। | জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কিছু সংখ্যক প্রতিনিধির আসন বাতিল করে আর কিছু সংখ্যকের আসন বজায় রেখে ইয়াহিয়া খাকে ধোকা দিতে চাইছেন? তিনি এমন ভান করছেন যে, যাদের আসন বাতিল হয়নি, তারা বুঝি তার চক্রান্তের সমর্থক। জনসাধারণের সুস্পষ্ট অভিপ্রায়ই জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার উৎস। তারা কোন ক্ষমতা দখলকারীর আজ্ঞাবাহী নন। এবং তার উদ্ভাবিত ফন্দি ফিকিরের সঙ্গেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। গত জুলাই মাসের সম্মেলনে এম, এন, এ ও এম, পি, এ-রা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা পুনরায় ঘােষণা করেন। জন প্রতিনিধিদেরকে বিচার করার হাস্যকর প্রচেষ্টা কিংবা তাদের বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রয়াস তাদের প্রতিজ্ঞা থেকে টলাতে পারবে না।
শাস্তি পেতে হবে পরিনামে তাদেরকেই …।
| বাংলাদেশে গণহত্যায় যে বিশ্ববাসী শিউরে উঠেছে তারাই এখন লক্ষ্য করছে যে, জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে কারারুদ্ধ করে সামরিক আদালতে গােপন বিচারের আয়ােজন হয়েছে এবং তার পক্ষ সমর্থনের জন্য একনায়ক ইয়াহিয়া সন্দেহজনকভাবে আইন চাপিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষ তাই আবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানী শাসক-চক্রের মিথ্যা ভাষণে এবং তাদের কলঙ্ক মােচনের কলাকৌশলে কেউ প্রতারিত হবে না।
| বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে আমি পৃথিবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালবাসা পেয়ে তাদের সুখের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন, দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দী জীবন। যাপন করছেন। তার বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার ও জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তােলার সর্বপ্রকার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ। কিন্তু বর্বর চক্রের অন্ধ ঔদ্ধত্যের উপর এর তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। তবে দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবর রহমানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করেছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। আর ইসলামাবাদের উপর যেসব সরকারের কিছুমাত্র প্রভাব আছে, শেখ সাহেবের মুক্তি সাধনের জন্য তাদের কাছে আমি আবার আবেদন জানাই।
স্বীকৃতির প্রশ্নে আরেকটি কারণ যুক্ত হয়েছে
| পাকিস্তান সরকারের কূটনীতিবিদেরা সম্প্রতি দলে দলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছেন। এতে আমাদের শক্তির প্রমাণ ঘটেছে এবং অন্যান্য দেশের সরকারের পক্ষে আমাদেরকে স্বীকৃতিদানের আরেকটি কারণ যুক্ত হয়েছে। আসলে স্বীকৃতিলাভ হল মুক্তিযুদ্ধের
দ্রুত ও সফল পরিসমাপ্তির সােপান স্বরূপ। বর্বর শক্তির দ্বারা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ আজ অস্ত্রধারণ করেছে। আমাদের জনসাধারণ যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছে, বােধ হয় আর কোন জাতির ভাগ্যে এমন ঘটেনি। সুতরাং, যারা গণতন্ত্রের অনুসারী এবং আমাদের প্রতি মানবিক সহানুভূতিসম্পন্ন, তাঁদের কাছ থেকে আরও অনেক আমরা প্রত্যাশা করি।
ওদেরই পাপে বাংলার মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে
পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নিষ্পেষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি আমাদেরকে আবার এক নিষ্ঠুর । আঘাত হেনেছে। তা হল সাম্প্রতিক বন্যার তাণ্ডবলীলা। বাৎসরিক দুঃখের বন্যায় বাংলাদেশের বহু অঞ্চল আজ প্লাবিত। এই প্লাবন পশ্চিম পাকিস্তানের মানবতাবিরােধী শােষণনীতির প্রতি এক সুস্পষ্ট অভিযােগ। কেননা, এই শাসকগােষ্ঠীই বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেনি। একথা আজ পরিষ্কার যে, বাঙালীরা নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে না। | বাঙালীর দুঃখের ব্যাপকতা ও গভীরতা আজ মানবীয় পরিমাপ শক্তির বাইরে। তবু আমি বাংলার অজেয় প্রাণশক্তিতে বিশ্বাসী। তাই আমার দৃঢ় প্রত্যয় ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের উপরে বাংলার এই প্রাণশক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী।
মুক্তি যােদ্ধাদের জন্য কামনা করি …
পরিশেষে, যাদের সাহস, আত্মােৎসর্গ ও সাফল্য সারা জাতিকে গৌরবে পূর্ণ করেছে এবং মহান ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত করেছে, সেই মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কামনা করি সকল শক্তি। বতমান সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসাধারণ নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছে। এই ঐক্যই যেন আমাদের শক্তির চিরকালীন উৎস হয়। জয়বাংলা।”
জয়বাংলা (১) £ ১: ১৮ | ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল নেপালে
| মুজিবনগর, ৮ই সেপ্টেম্বর, এখান থেকে প্রচারিত এক সংবাদে জানা গেছে, বাংলাদেশের একদল প্রতিনিধি নেপালে গেছেন। এই দলের নেতৃত্ব করছেন আবদুল মালেক উকিল। এই দল নেপালের জনগণকে এবং সরকারকে বাংলাদেশের সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সেখানে গিয়েছেন। নরপশু পাক সৈন্যদের নৃশংস অত্যাচারের করুণ চিত্র, মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্যের চিত্র, এবং কিছু পুস্তিকা ও স্বাধীন। বাংলার পতাকা পররাষ্ট্র দপ্তরের অফিসারদের হাতে অর্পণ করেন। জানা গেছে, প্রতিনিধি দল কাঠমাণ্ডুতে কূটনৈতিক কার্যকলাপ চালাবার জন্য এখানে একটি তথ্যকেন্দ্র খােলার পরিকল্পনা করছেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ : ৫ | ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
হােসেন আলী হাইকমিশনার হলেন
৬ই সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ। সম্প্রতি মুজিব নগরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে—ভারতে বাংলাদেশ হাইকশিনার পদে শ্রী হােসেন আলীকে নিযুক্ত করা হয়েছে। এই মিশনের নাম দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ হাইকমিশন ।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১ : ৫ | ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
কমনওয়েলথে বাংলাদেশ যােগ দেবে।
নয়াদিল্লী, ৮ই সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি জনাব কে, এম, শাহবুদ্দিন এখানের | প্রেসক্লাব অব-ইণ্ডিয়ার এক মধ্যাহ্ন ভােজ অনুষ্ঠানে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ বৃটিশ কমওয়েলথে যােগ দেবে। এই কারণেই জনাব হােসেন আলীকে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার রূপে নিয়ােগ করেছেন। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জনাব শাহাবুদ্দিন বলেন, এতে নব-সৃষ্ট বাংলাদেশের নানাদিক দিয়ে সুবিধে হবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১ : ৫ ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
উথান্টের প্রতি আবেদন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম।
| ৮ই সেপ্টেম্বর, মুজিবনগর। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মিঃ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারী মিঃ উথান্টের প্রতি এক আবেদনে বলেন, উথান্টের ব্যক্তিগত প্রভাব বাংলাদেশের ব্যাপারে কাজে লাগান। বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন বন্ধ করতে এবং বিনা সর্তে তার মুক্তির জন্যও উথান্টকে এগিয়ে আসতে অনুরােধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কোথায় কি অবস্থায় আছেন বাংলার মানুষ তা জানতে চায়। বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধুর যদি প্রাণনাশ করা হয় তাহলে বাংলার মানুষ প্রতিশােধ নিতে বদ্ধপরিকর।
বিপ্লবী বাংলাদেশ । ১ : ৫ ॥ ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত
৯ই সেপ্টেম্বর, মুজিবনগর। বাংলাদেশের পাঁচটি দলের দুদিনব্যাপি সম্মেলনের পর বাংলাদেশ সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছে। আজ মুজিবনগর থেকে এক যুক্ত বিবৃতিতে ঘােষণা করা হয়েছে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোন আপােষ মেনে নেবে না বাংলাদেশের জনগণ। এই কমিটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করবে। এই দল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। এই সম্মেলনে এক প্রস্তাবে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য অনুরােধ জানান হয়। বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের নিন্দা করা হয় এবং অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবী করা হয়। বাংলাদেশ থেকে ৮৫ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় এবং ভরণ পােষণের জন্য ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। পাঁচটি দলের ৮ জন সদস্য নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়েছে। উপদেষ্টা কমিটির মধ্যে আছেন, মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ভাসানী ন্যাপ), শ্রীমণি সিং (কমুনিষ্ট পার্টি), শ্রীমনােরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ কংগ্রেস), অধ্যাপক মােজফফর আহম্মদ (মােজাফফর ন্যাপ), তাজুদিন আহম্মদ (আওয়ামী লীগ), খােন্দকার মােসতাক আমেদ (আওয়ামী লীগ), জনাব তাজুদ্দিন আহম্মদ এই কমিটির আহবায়ক হয়েছেন। রাজনৈতিক মহল মনে করছেন এই কমিটি গঠিত হওয়ায় বাংলাদেশের স্বীকৃতি আরাে তরান্বিত হবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ | ১ : ৫। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জানান যে, বাংলার মানুষকে ঔপনিবেশিক দাসত্বের শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিয়া শােষণহীন স্বাধীন, সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের আঙিনায় পৌছাইয়া দেওয়ার যে আশ্বাস বঙ্গবন্ধু দিয়াছেন যে কোন মূল্যে আমরা উহা বাস্তবায়িত করিব।
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথই আমাদের মুক্তির পথ । মহান নেতার বিরুদ্ধে জল্লাদ এহিয়া। অশালীন ভাষায় মন্তব্যের জবাব দিবে বাংলার মানুষ রণক্ষেত্রে অস্ত্রের ভাষায়।” তিনি বলেন, বাঙ্গালীদের ঐক্য ও প্রতিরােধ যত বেশী শক্তিশালী হইবে, হানাদার বাহিনীর উপর মুক্তি যােদ্ধাদের। পাল্টা আক্রমণ যত বেশী জোরদার হইবে, ততই ত্বরান্বিত হইবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও শক্রমুক্ত স্বাধীন। বাংলা।
জনাব ইসলাম বলেন, বাঙাল জাতির এই যুদ্ধ রাজনৈতিক জনযুদ্ধ জনগণের আস্তাভাজন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধুর বিঘােষিত লক্ষ্য স্বাধীনতা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও শােষণহীন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্য এই যুদ্ধ চলিতেছে। | এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শেখ সাহেবের মুক্তি, বাংলাদেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃতি, হানাদার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং দখলদার বাহিনীর বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্থদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ছাড়া কোন রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন ওঠে না।
জন্মভূমি [ ১: ৮ ! ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
রাজনৈতিক মীমাংসার প্রশ্নই ওঠেনা।
মুজিবনগর, ৯ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ এ এইচ এম কামরুজ্জামান পুনরায় বলেছেন, পাকিস্তানী জান্তার সঙ্গে কোনরূপ রাজনৈতিক মীমাংসার প্রশ্নই ওঠে না।
গতকাল তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, নিরীহ বাঙ্গালী হত্যাকারী ও অর্থনৈতিক শােষকদের সঙ্গে এক চালের নীচে বসবাসের চিন্তাও আজ আর কোন বাঙ্গালী করেন না।
তিনি অতঃপর বলেন, আমরা সাফল্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছি এবং সেদিন আর বেশী দূর। নেই, যেদিন হানাদারবাহিনীকে তিক্ত ফলাহারেই কাল যাপন করতে হবে।
| এখানে অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা সিলেট জেলার দিরাই থানার অধীন সমস্ত অঞ্চল মুক্ত করেছে। | মুক্তিবাহিনী ঐ অঞ্চলে তাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছে। আগেই ঐ থানার কর্মীরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। | দিরাইয়ের লড়াই-এ অন্ততঃ ২২ জন পাক সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়েছে এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তি বাহিনী সখল করেছে। শত্রু সৈন্যরা ঐগুলি ফেলে পালিয়ে যায়।
জন্মভূমি ॥ ১ : ৮ | ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশ যােগ দেবে।
মুজিবনগর, ১২ই সেপ্টেম্বর- গত ৮ই সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লীতে প্রেস অব ইণ্ডিয়ার এক মধ্যান্নভােজে বাংলাদেশ সরকারের দিল্লীস্থ প্রতিনিধি জনাব শাহাবুদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন আসন্ন
বৃটিশ কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যােগ দেবে, কারণ তাতে এই নবজাত রাষ্ট্রের নানাদিক দিয়ে সুবিধা হবে।
তিনি বলেন, এহিয়া বাহিনী এখনও বাংলাদেশে নারী-শিশু নির্বিশেষে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে অথচ রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশন আসন্ন দেখে এহিয়া খাঁ বিশ্বাবাসীকে ধোকা দেবার উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আনার ভঙ্গী দেখাচ্ছেন।
| জন্মভূমি !! ১ : ৮ ! ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
খালি হাতে ফিরে এলেন
মস্কো, ১২ই সেপ্টেম্বর-এ-হিয়ার খানের বিশেষ দূত ও পাক পররাষ্ট্র সচিব সুলতান আহম্মদ শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই মস্কো থেকে ফিরে এসেছেন বলে কূটনৈতিক মহলের ধারণা। সােভিয়েত পত্রিকা প্রাভদা জানিয়েছে মক্কো থেকে সুলতান আহম্মদ চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর দৌত্যের সাফল্য সম্পর্কে কিছুই বলা হয় নি।
জন্মভূমি | ১ : ৮ # ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
কলকাতা মিশন হাইকমিশন হল
মুজিবনগর ১১ই সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ এক কেবিনেট মিটিংয়ে গত সপ্তাহে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনকে বাংলাদেশ হাইকমিশন করা হয়েছে। এবং মিশন প্রধান জনাব হােসেন আলিকে হাইকমিশনার পদে নিযুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
বাংলাদেশের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের এবং ভারতীয় বৈদেশিক নীতি রচনা বিভাগের চেয়ারম্যান ডি পি ধরের মধ্যে মুজিবনগরে আলােচনার পরে পদের নাম পরিবর্তিত হয়।
জন্মভূমি » ১ : ৮ | ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রী যােগ দিবেন মুজিবনগর, ১১ই সেপ্টেম্বর- আগামী ১৮ই সেপ্টেম্বরে দিল্লীতে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে তাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহম্মদ যােগ দিবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রথম বাংলাদেশের বাইরে প্রধানমন্ত্রী কোন সভায় যােগ দিচ্ছেন।
জন্মভূমি ! ১ : ৮ | ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন গঠনের উদ্যোগ।
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
বাংলাদেশ সরকার একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠনের প্রস্তাব বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করিতেছেন।
প্রস্তাবিত এই কমিশন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হইবার পর দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাঠামাে প্রস্তুত করিলেন। এই কাজের জন্য দেশত্যাগী বুদ্ধিজীবিদের মধ্য হইতে অর্থনীতিবিদদের খুঁজিয়া
বাহির করিবার জন্য শীঘ্রই কার্যকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে এবং যাহাতে তাহাদের মধ্য হইতে পরিকল্পনা সম্পর্কীয় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের গ্রহণ করা যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির ফলে দিন দিন অধিকৃত অঞ্চল মুক্ত হইবার ফলে বাস্তুত্যাগীদের স্থানান্তর ও পুনর্বাসনের জন্য পূর্ব পরিকল্পিত ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ ভাবে করিবার জন্য এই কমিশনের প্রয়ােজন। | বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ এই কমিশন প্রতিষ্টার ব্যাপারে ভারত সরকারের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য পাইবেন বলিয়া আশা পােষণ করিতেছেন। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে এই সিদ্ধান্তটি ভারত সরকারের বাংলাদেশ বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা মিঃ ডি, পি, ধরের সহিত বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের পূর্বে করা হইয়াছে এবং জানা গিয়াছে যে মিঃ ধর বাংলাদেশ সরকারকে এ ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য দানের আশ্বাস দিয়াছেন।
বাংলার বাণী ৪ ৩ সংখ্যা | ১৪ সেপ্টের ১৯৭১
এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রােধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ? বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অপ্রতিহত ‘অগ্রযাত্রা
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ডাক দিয়াছেন—তাই, এক দিনে এক দুর্জয়। সামরিক শক্তির দুর্লভ গৌরবে মাথা উচু করিয়া দাঁড়াইয়াছে দুর্ধর্ষ বাঙ্গালী জাতি। শৃঙ্খলিতা দেশমাতৃকার বুক হইতে হানাদার দুশমনকে সমূলে উৎখাত করার জীবনপণ প্রতিজ্ঞায় মুক্তি পাগল। বাংলার মানুষ প্রলয়রাত্রির বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের হিংস্র ছােবলের মত, দয়াহীন-মায়াহীন নির্মম নিয়তির মত প্রচণ্ডতম শক্তিতে একের পর এক আঘাত হানিয়া চলিয়াছে শত্রুর শিবিরে। অপ্রতিহতগতিতে অগ্রগামী বাংলার দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় অভিযানের রথচক্রতলে নিষ্পিষ্ট হইয়া ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া ধূলিস্মাৎ হইয়া যাইতেছে মুমূর্ষ পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের ভিত্তিমূল। বাংলার দশ দিগন্তে মুজিব বাহিনীর জয় জয়াকারের তৃর্যনাদ— থর থর করিয়া কাঁপিতেছে জল্লাদের বুক টলটলায়মান জঙ্গী মসনদ।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বীর প্রসবিনী বাংলার অপরাজেয় গণশক্তি জননী জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য অমিত বিক্রমে লড়িয়া চলিয়াছেন জল্লাদ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযােদ্ধাদের দুঃসাহসিক পাল্টা আক্রমণে প্রতিদিন নাজেহাল নাস্তানাবুদ হইতেছে হানাদার বাহিনী। অবিরাম মুক্ত। হইতেছে নয়া নয়া এলাকা। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আজ এক বিদ্রোহের জলন্ত অগ্নিকুণ্ড, মুক্তির দীপ্ত। তারুণ্যে উম্মিমুখর এক প্রমত্ত জলস্রোত। মানব ইতিহাসের ভয়াবহতম জল্লাদী বর্বরতার মুখেও অপ্রতিহত সাফল্যের জয়টিকা শােভিত বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর বিস্ময় উপনিবেশবাদী শৃঙ্খল আর জঙ্গী শাসনের সামনে এক উদ্ধত প্রশ্নের কান্ত সূর্যপিণ্ড, মুক্তিকামী বাঙ্গালী জাতির “এই যৌবন জল তরঙ্গ রােধিবি কি দিয়া বালিরবাধ?’।
এখানে উল্লেখ করা যায়, বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক পথেই…করিয়া দুরাশার বালুচরে। আত্মরক্ষার পথ খুঁজিয়া বেড়াইতেছে ইয়াহিয়া খান। ঢাকার একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক খবর দিয়েছে একটি আপােশ মীমাংসায় পৌছিবার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পারে। বিবিসির খবরে বলা হইয়াছে, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার লাটবাহাদুর আব্দুর মালিক বলিয়াছে একটি আপােষরফার জন্য আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা করিতে চাই।’
বাংলার বাণী । ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
‘আমাদের প্রতি গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী বিশ্বমানবের সমর্থনকে পুরাপুরি কাজে লাগানাের চেষ্টা করব
থােন্দাকর মােস্তাক পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের জাতিসংঘ যাত্রার প্রস্তুতি
আগামী ২১শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে সেই অধিবেশনে যােগদানের জন্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শক্তিশালী এক প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছেন। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খােন্দকার মােস্তাক আহমেদ। গত মঙ্গলবার মুজিব নগরে জয় বাংলা প্রতিনিধির সাথে এক বিশেষ সাক্ষাঙ্কারে পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আহমেদ এই তথ্য প্রকাশ করেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব মােস্তাক আহমেদ বলেন, প্রতিনিধি দল গঠন এখনাে চূড়ান্ত হয়নি।
জাতিসংঘের অধিবেশনের আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিষয় নিয়ে কোনাে কোনাে মহলে যে আলােচনা হচ্ছে সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন আমরা বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর থেকেই স্বীকৃতি পাবার আশা করে আসছি’। তিনি আরাে জানান অধিবেশনের পূর্বে স্বীকৃতি পেলে স্বাভাবিক ভাবেই গােটা পরিস্থিতিরই পরিবর্তন ঘটবে। তবে স্বীকৃতি না পেলেও জাতিসংঘে আমাদের মর্যাদা হবে রাজনৈতিক স্বীকৃতি না পাওয়া একটি দেশের স্বাভাবিক মর্যাদা যা হয়ে থাকে
তাই।
| জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কি কি বিষয় উত্থাপিত হতে পারে জিজ্ঞাসা করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দৃঢ় ভাবে জানান বাংলাদেশ সম্পকির্ত সকল বিষয়ই সেখানে তােলা হবে, শেখ মুজিবের মুক্তি, বাংলাদেশে গণহত্যা, শরণার্থী সমস্যা এবং অন্যান্য জরুরী বিষয় অবশ্যই আলােচনার অন্তর্ভুক্ত হবে।
এই সফরের সময় তিনি অন্য কোনাে দেশ সফরে যাবেন কিনা প্রশ্ন করা হলে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অধিবেশনের পর তিনি কতিপয় দেশে যাওয়ার আশা করেন। তবে কোন কোন দেশে তিনি সফর করবেন তা নির্দিষ্ট ভাবে বলতে অসম্মতি প্রকাশ করেন।
অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানান যদি অন্যান্য বিষয় অনুকূল থাকে, তবে তারা। আগামী ২০শে সেপ্টেম্বরের দিকে অধিবেশনে যােগদানের জন্য রওনা হবেন। অবশ্য এর আগেই তিনি একটি সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের ইচ্ছা রাখেন। জনাব মােস্তাক আহমেদ জানান, আমরা অবশ্যই আমাদের সফরকে আমাদের প্রতি শান্তি, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকামী বিশ্বমানবের সমর্থনকে পুরাপুরি কাজে লাগানাের চেষ্টা করব।
জয়বাংলা (১) # ১: ১৯ ॥ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলা সাহিত্য গগন থেকে খসে পড়লাে একটি তারকা
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় গত মঙ্গলবার সকাল ৬টা ২৪ মিনিটে কলকাতায় তার নিজস্ব বাসভবনে পরলােক গমন করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বৎসর। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তার অর্ধ শতাধিক গ্রন্থ বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধি করেছে।
প্রধান মন্ত্রীর শােক বার্তা
| তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে গভীর শােক প্রকাশ করে প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাবার জন্য বাংলাদেশের অধিবাসীরা এই প্রখ্যাত সাহিত্যিকের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
জয়বাংলা (১) ॥ ১; ১৯ # ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠক ? মাতৃভূমির বক্তব্য পেশের জন্য বাংলাদেশে প্রতিনিধিদলের নিউইয়র্ক যাত্রা
(কুটনৈতিক সংবাদ দাতা)
| বিংশ শতাব্দীর অপরাজেয় জাতীয়তাবাদী গণশক্তির আত্মপ্রতিষ্ঠায় দুর্জয় সংগ্রামের নিভকি … বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত বাংলা দেশের মধ্য দিগন্তে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদদের হিংস্র বর্বর গণহত্যা যজ্ঞের কালিমা লিপ্ত পটভূমিকে আজ (মঙ্গলবার) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হইতেছে। এই অধিবেশনকালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হইতে, স্বাধীন বাংলার পক্ষ হইতে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল বিশ্বের দরবারে জননী বাংলার দুঃখ ও বেদনার কাহিনী সংগ্রাম ও বিক্রমের কাহিনী পেশ করিলেন। | এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করিবেন লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরী। ইতিপূর্বে শােনা গিয়াছিল যে, | বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমদ এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করিবেন। কিন্তু
অনিবার্য কারণে তিনি নিউইয়র্ক সফরসূচী বাতিল করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। | প্রতিনিধিদলের ১১ জন সদস্য আজ মুজিবনগর হইতে নিউ ইয়র্কের পথে নয়াদিল্লী রওয়ানা হইয়া গিয়াছেন। ইহারা হইতেছেন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার এম, পি, এ, সৈয়দ আবদুস সুলতান এম, এন, এ, জনাব সিরাজুল হক এম, এন, এ, ডাঃ মফিজ এম, এন, এ, ডাঃ আজহারুল হক এম, পি, এ, জনাব সাহাবুদ্দিন আহমদ এম, পি, এম, জনাব এম, এম, সামাদ এম, এন, এ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ এ, আর, মল্লিক, ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণাকারী সাবেক পাকিস্তানী কূটনীতিক জনাব এ, এফ, এম, আবুল ফতেহ ও জনাব খুবরম খান পন্নী। প্রতিনিধিদলের অপর ৫ জন সদস্য হইতেছেন বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত বিচারপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরী, জনাব এম, আর, সিদ্দিকী এম, এন, এ অধ্যাপক রহমান সােবহান, জনাব এস, এ, করিম ও জনাব এ, এম, এ, মুহিত। তাঁহারাও ইতিমধ্যেই নিউইয়র্ক পৌছিয়াছেন বা পথে রহিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। | বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিযুক্তির প্রস্তাব, জল্লাদ ইয়াহিয়া কর্তৃক সুকৌশলে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার প্রয়াস এবং আপােষের জন্য বিভিন্ন দেশের দুয়ারে দুয়ারে মধ্যস্থতার ধর্ণার জবাব দানের জন্যই বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে যাইতেছেন। এই প্রতিনিধিদল জাতিসংঘকে দ্বাৰ্থহীন ভাষায় এই কথাই জানাইয়া দিবেন যে বাংলার জনগণ ও সরকারের। দৃষ্টিতে বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বাহিনী প্রেরণের চেষ্টার উদ্দেশ্য হইতেছে হানাদার দুশমনদের সাহায্য করা। তাই এমন অবস্থার উদ্ভব হইলে মুক্তিযােদ্ধারা জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের বিরুদ্ধেও চরম ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হইতে পারেন। প্রতিনিধিদল বিশ্বসংস্থাকে সুস্পষ্টভাবে আরও জানাইয়া দিবেন যে, একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বিনাশর্তে মুক্তিদান, বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতিদান হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দানের পরই বিবেচনা করা হইতে পারে জঙ্গীশাহীর সঙ্গে কোন আপােষ মীমাংসার প্রশ্ন আলােচনা করা যায় কি না।
বাংলার বাণী ॥ ৪ সংখ্যা ॥ ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
নেপালের জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে
মালেক উকিল।
নেপালে পক্ষকালব্যাপী কূটনৈতিক সফর সমাপ্ত করে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল মুজিবনগরে ফিরে এসেছেন। পার্লামেন্ট সদস্য জনাব আবদুল মালেক উকিল, শ্রী সুবােধকুমার মিত্র এবং জনাব আবদুল মােমেন তালুকদার প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন।
প্রতিনিধিদলের নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল মুজিব নগরে এক সাক্ষাঙ্কারে এ সফরকে ‘অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
জনাব মালেক উকিল বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপালের মন্ত্রী, সাংবাদিক, ছাত্র নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ প্রশ্ন এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে বিষদ আলােচনা করেন। তিনি বলেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নেপালের সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সার্বিক সহানুভূতি ও সহযােগিতা প্রকাশ করেন।
| প্রতিনিধিদল এছাড়া নেপাল প্রেস ক্লাব সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা এবং জনগণের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনও পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তি বাহিনীর কার্যক্রম সম্বলিত বাংলাদেশ সরকারের পুস্তক প্রদান করেন।
জয়বাংলা (১) # ১: ২০ ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তান আজ মৃত
শহীদের শবের পাহাড়ের নীচে পাকিস্তানের কবর হয়েছে। ইয়াহিয়ার হানাদার সেনাবাহিনী বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লােককে হত্যা করেছে এবং এ হত্যালীলা পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক অলঙ্ঘনীয় ব্যবধান রচনা করেছে।
পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যার আশ্রয় নিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিজ হাতে পাকিস্তানের কবর। খুড়েছে, এ কথা তার বােঝা উচিত।
—তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধান মন্ত্রী, বাংলাদেশ
বিপ্লবী বাংলাদেশ ৪ ১: ৭ ৪ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
রাষ্ট্রসংঘের পথে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল
| ২১শে সেপ্টেম্বর, সংবাদে প্রকাশ, রাষ্ট্রসংঘের আসন্ন অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, বিনাশর্তে একলক্ষ পাক সৈন্যকে সরিয়ে নেওয়া এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবীতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রসংঘের পথে রওনা হয়ে গেছেন। এই দলে প্রতিনিধিত্ব করবেন বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১: ৭ ৪ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
স্বীকৃতি নাই বা হােক, বাঙলাদেশ স্বপ্রতিষ্ঠিত হবে
—প্রধানমন্ত্রী (বিশেষ প্রতিনিধি)
মুজিবনগর, ২৪শে সেপ্টেম্বর স্বীকৃতি চাইনা, স্বীকৃতি ছাড়াই বাংলাদেশের মানুষ তাদের মাতৃভূমি থেকে হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সম্প্রতি মুজিনগরে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাঙ্কারে প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ উপরি উক্ত মন্তব্য করেন। | একথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রধান মন্ত্রী বলেন ১৯১৭ সালে সােভিয়েট ইউনিয়ন স্বাধীনতা লাভ করলেও দীর্ঘ দিন সে স্বীকৃতি পায়নি, ১৯৪৯ সালের পহেলা অক্টোবর গণচীন স্বাধীনতা লাভ করলেও আজ পর্যন্ত বিশ্ব রাষ্ট্রসংঘে তার কোন স্বীকৃতি মেলেনি। কিন্তু তথাপি তারা আছে এবং বিশ্বের মানচিত্রে খুব ভাল ভাবেই আছে।
প্রধান মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার স্বীকৃতি নাইবা হােক তবুও আত্মশক্তির । উপর নির্ভর করে পৃথিবীর মানচিত্রে সে স্থায়ী আসন লাভ করবেই।
যুদ্ধের কাল যতই বাড়বে মীরজাফরের সংখ্যা ততই কমে
জনাব তাজুউদ্দীন আহম্মদ বলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যতবেশী দিন ধরে চলবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে বাংলাদেশের ইয়াহিয়ার পা-চাটা কুকুররা ততই খতম হবে।
বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করবে। | স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ভারত, যুগােশ্লাভিয়া প্রভৃতি দেশের ন্যায় জোট নিরপেক্ষ নীতি পালন করবে বলে প্রধান মন্ত্রী উল্লেখ করবে। আমাদের প্রতিনিধির এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান মন্ত্রী বলেন সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ভারত-রুশ, শান্তি ও মৈত্রী চুক্তিকে তিনি কোনক্রমে সামরিক চুক্তি বলে মেনে নিতে পারেন না এবং এই চুক্তির ফলে ভারত যে জোট নিরপেক্ষ নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাও তিনি বিশ্বাস করেন না। এ প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দান করে প্রধান মন্ত্রী বলেন, অন্যায় আক্রমণের | বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা কখনই সামরিক চুক্তি হতে পারে না। দ্বিতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করেন তারাই যে একজোট ভুক্ত একথা বলারও কোন যৌক্তিকতা নেই ।
দুর্ভিক্ষ
বাংলাদেশে বর্তমানে যে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে সে সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান মন্ত্রী বলেন, কোন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় জনজীবনে স্বভাবতই বিশৃঙ্খলা, অভাব| অনটন, এবং জ্বালা-যন্ত্রণা এসে যায়। তা বলে আমাদের হতােদ্যম হলে চলবে না। সাহস এবং সততার সঙ্গে সমস্ত পরিস্থিতির মােকাবেলা করতে হবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলে খাদ্য, বস্ত্র, ও ঔষধ জনসাধারণের ত্রাণকার্যে পাঠানাে হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
স্বাধীনতা, স্বাধীনতা! | বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপােষ জওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে প্রধানমন্ত্রী তা সহাস্যে উড়িয়ে দিয়ে বলেন— ‘আমাদের এখন এক দফা, সাধীনতা, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা। এ ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক সমাধানই আরা কোন ক্রমে মেনে নিতে রাজী নাই।
বাঃ সুন্দর তাে!
বাঃ সুন্দর তাে।’ আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি সাপ্তাহিক বাংলার একটি সৌজন্য সংখ্যা প্রদান করলে উক্ত পত্রিকা সম্পর্শ্বে প্রধান মন্ত্রী একই সঙ্গে আনন্দ ও বিস্ময়ে উপরি উক্ত মন্তব্য করেন।
| প্রধান মন্ত্রী বলেন যে, ‘সাপ্তাহিক বাংলা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত সাড়ে সাতকোটি বাঙালীর মুক্তি | সংগ্রামের বিশেষ সহায়ক হােক এই কামনা করি।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ২ | ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাঙ্গালী জাতিকে দাবাইয়া রাখার সাধ্য কাহারও নাই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ইয়াহিয়ার আপােষ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার
“এই বাংলা বীর প্রসবিনী বাংলা সংগ্রামী বাংলা। চিরদিন কাহারও কলােনী হইয়া, বাজার হইয়া, গােলাম হইয়া রাখিতে পারিবে না। বাঙ্গালী জাতির জয় হইবেই।” স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের এই প্রত্যয় দৃপ্ত ঘােষণাই সগর্ব উল্লাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ-বর্ষ পূর্তির এই শুভলগ্নে আকাশে বাতাসে বজ্র নির্ঘোষে গজিয়া ফিরিতেছে নিরপেক্ষ নিয়তির কণ্ঠনিঃসৃত ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ঃ “সাবাস, বাংলাদেশ, অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নােয়াবার নয়।’ ছয় মাসের যুদ্ধে পচিশ হাজার হানাদার শত্রু সৈন্যকে খতম করার মাধ্যমে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর সুযােগ্য অনুসারীরা দেখাইয়া দিয়াছেন বাঙ্গালী জাতিকে দাবাইয়া রাখার সাধ্য কাহারও নাই । তাহারা দেখাইয়া দিয়াছেন, শুধু ব্যালেটরই নয় বাঙ্গালীর বুলেটের জোরও কত বেশী । আর এবার বুলেটের জোরে আপন বাহুবলে মাতৃভূমির বুক হইতে হানাদার দুশমনকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করিয়া জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার মহান লক্ষ্যে অবিচল থাকিয়াই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নর ঘাতক ইয়াহিয়ার আপােষ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করিয়া দিয়াছেন।
| মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম নরঘাতক দস্যু ইয়াহিয়া স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামাে, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুমহান উদ্দেশ্যে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শক্তির জোরে বানচাল করিয়া দেওয়ার উদ্ভট প্রচেষ্টায় মাতিয়া উঠিয়াছিল । কিন্তু বীর প্রসবিনী বাংলার দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাল্টা আঘাত পররাজ্য লােভী সেই শক্তিমত্ত নর-পশুর তােগলকি খেয়ালের শাদ্দাদী বালাখান ভাঙ্গিয়া-চুরয়াি ধুলিস্মাৎ করিয়া দিয়াছে। … হানাদার বাহিনীর সঙ্গে অমিতবিক্ৰমে বুঝাপড়া করিয়া বাংগালীজাতি বিশ্ববাসীকে এই ধ্রুব সত্যের জ্বলন্ত সূর্যের সামনে… প্রয়ােগের দ্বারা বাঙ্গালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা যাইবে না।…
বাংলার বাণী ॥ ৫ সংখ্যা ৪ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশন
(কূটনৈতিক সংবাদদাতা)
কলিকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশনের মর্যাদা অর্জন করিয়াছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে এই মিশনকে ভারতে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশনের মর্যাদায় উন্নীত এবং মিশনের প্রধান জনাব হােসেন আলীকে ভারতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলিয়া জানা। গিয়াছে।
ওয়াকেবহাল মহলের মতে ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক পরিকল্পনা সেলের চেয়ারম্যান মিঃ ডি, পি । ধরের সহিত মুজিবনগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্রদের যে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়, উহার পরিপ্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । কূটনৈতিকমহল কলিকাতাস্থ, বাংলাদেশ মিশনকে পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশনে রূপান্তরীত করার এবং জনাব হােসেন আলীকে ভারতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। হাইকমিশনার পদে উন্নীত করণের সিদ্ধান্তের উপর গভীর কূটনৈতিক গুরুত্ব আরােপ করিতেছেন।
উল্লেখযােগ্য যে, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ইহাই প্রথম হাই কমিশন।
ইহা ছাড়া, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারী জনাব মজিবুল আলমের দিল্লী সফর এবং নয়াদিল্লীস্থ ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের সহিত তাহার । আনুষ্ঠানিক আলাপ আলােচনার উপরও এই মহল গভীর কূটনৈতিক তাৎপর্য আরােপ করেন। তদুপরি । ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের প্রধান কর্মকর্তা মিঃ টি, এন, কাউলের মুজিব নগর সফর এবং বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্রগণের সহিত তাহার আনুষ্ঠানিক আলাপ আলােচনাকেও খুবই গুরুত্ব সহকারে পর্যালােচনা করা হইতেছে। | আরও জানা যায় যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আসন্ন জাতিসংঘের অধিবেশনে পর্যবেক্ষক প্রেরণ এবং কমনওয়েলথ সদস্যভুক্ত হওয়ার জন্য ভারত সরকারের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চালাইয়া। যাইতেছেন।
বাংলার বাণী ৪ ৫ সংখ্যা ৪ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের টাকার নােট
আগামী অক্টোবর মাস নাগাদ বাংলাদেশের নিজস্ব টাকার নােট বাহির হইয়াছে বলিয়া নির্ভরযােগ্য। সূত্র হইতে জানা গিয়াছে। প্রকাশ, এতদসংক্রান্ত প্রাথমিক প্রস্তুতি দ্রুত সম্পন্ন হইতেছে। | প্রথম পর্যায়ে ১ টাকা ৫ টাকা ও ১০ টাকার নােট বাহির করা হইবে। জানা গিয়াছে যে নােটগুলির। এক পিঠে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ছবি এবং অপর পিঠে আবাহমান বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নৌকার প্রতিকৃতি থাকিবে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, গত জুলাই মাসে বাংলাদেশের ৮ প্রকারের ডাকটিকিট বাহির করা হয়। বিচিত্র রংএর এই সকল ডাক টিকিট বিশ্বে এক নতুন আলােড়নের সৃষ্টি করে।
জাগ্রত বাংলা ॥ ১; ৩! ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
হয় জিতবাে না হয় ধ্বংস হয়ে যাবাে, তবু…
—সৈয়দ নজরুল ইসলাম
গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার জল্লাদ-চক্রের ইতিহাসের জঘণ্যতম গণহত্যা শুরুর পর ঐক্যবদ্ধ বাঙালী জাতির মরণজয়ী। স্বাধীনতা অর্জনের ছ’মাস পূর্তি উপলক্ষে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সঙ্কল্প ঘােষণা করে বলেছেন যে, আমরা হয় জিতবাে না হয় জাতি হিসেবে নিচিহ্ন হয়ে যাবাে, তবু আত্ম হত্যায় উদ্বুদ্ধ বাঙ্গালীর মস্তক ইয়াহিয়া শাহীর সঙ্গীনের সন্ত্রাসের সামনে নত হবে না।
| ২৫শে সেপ্টেম্বর রাতে যুদ্ধরত বাঙালী জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সুলিলত কণ্ঠ স্বাধীন বাংলা। বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে আবেগ সঙ্কল্পে উদ্ভাসিত ৪৫ মিনিট স্থায়ী ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্র।
প্রধান মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন গৌরবােজ্জ্বল দিক আলােচনা করেছেন, বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তি দাবী করেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্ব রাষ্ট্রসমুহের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
| বেতার ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ঘােষণা করেন যে, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীকে নৌ ও বিমান বহর দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে। তিনি গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন যে, মুক্তি বাহিনীর নৌ শাখা ইতিমধ্যেই চালনা, মঙ্গলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে বীরত্বপূর্ণ তৎপরতা চালিয়ে অনেকগুলি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে।
জয়বাংলা (১১) ॥ ১: ২১ ॥ ৪ অক্টোবর ১৯৭১
প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকারের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় : “ভারত-সােভিয়েট নেতৃবৃন্দের যুক্ত বিবৃতি বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের পর্যালােচনাধীন। কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয় মুজিবনগরের ঘনিষ্ঠ মহলের বরাত দিয়ে কতিপয় সংবাদপত্রে আলােচ্য যুক্ত বিবৃতির একটা প্রতিক্রিয়া ছাপানাে হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চান যে, আলােচ্য সংবাদে ঘনিষ্ঠ মহলের বলে কথিত যে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে তার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই।
জয়বাংলা (১) ১: ২১ ! ৪ অক্টোবর ১৯৭১
‘স্বাধীনতার জন্য মরতে দিন।
—মােস্তাক
স্বাধীনতা যুদ্ধের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে প্রদত্ত এক ভাষণে পররাষ্ট্র মন্ত্রী খােন্দকার মােস্তাক আহমদ শক্তি-ব্লকের স্বার্থে অর্থ রাজনৈতিক প্রভাব অক্ষুন্ন রাখার কাজে বাংলাদেশের রক্তকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। | তাঁর সরকারের বহু বিঘােষিত নীতির পুনরুল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, পূর্ণ। স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। | খােন্দকার মােস্তাক আহমদ বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর বাঁচা-মরার প্রশ্নে জাতিসংঘে কি আলােচনা ও সিদ্ধান্ত হয় তা প্রত্যক্ষ করার জন্য সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ সাগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় কতিপয় ইয়াহিয়াদের সামরিক বাহিনী ঔপনিবেশিক স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশ ধূম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অনুরূপ কতিপয় শক্তি বাংলাদেশ প্রশ্নে প্রকাশ্য মতামত …
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২১ ॥ ৪ অক্টোবর ১৯৭১
রক্ত যতই দিতে হােক না কেন মাতৃভূমিকে মুক্ত করবােই
—প্রধান সেনাপতি
গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এক ভাষণে মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম, এ, জি, উসমানী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন । আমরা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করছি। বাংলাদেশের সাড়ে
সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আমাদের জাতীয় পতাকা সমুন্নত রাখার জন্য যুদ্ধ করছি। বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে শেষ হানাদার সৈন্যটিকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত আমাদের এ যুদ্ধ ক্ষান্ত হবে না। জয় আমাদের অবধারিত।
| কর্ণেল উসমানী বাংলাদেশের বীর মুক্তি বাহিনীর শৌর্য-বীর্যের উচ্ছ্বশিত প্রশংসা করে বলেন, বাংলার বীর সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অভুতপূর্ব ও যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উন্নতমানের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং সংখ্যায় বহুগুণে বেশী শত্রুর বিরুদ্ধে তারা নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগ, কঠোর সংকল্প ও ‘আত্মপ্রত্যয়ের সাথে লড়ে চলেছেন। এ পর্যন্ত তারা কম করে ২৫ হাজার শত্রু সেনাকে খতম করেছেন। | প্রধান সেনাপতি মুক্তি বাহিনীর সাংগঠনিক তৎপরতার বিষয় বিশ্লেষণ করে বলেন, আমাদের সুযােগ্য সামরিক অফিসারগণ মুক্তি বাহিনীকে দ্রুত সুসংগঠিত করে তুলেছেন এবং বর্তমানে তারা একটা সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। এতে রয়েছেন নিয়মিত সৈনিক, নাবিক এবং বৈমানিক। এ জন্যই বাংলাদেশ বাহিনীকে মুক্তি ফৌজের বদলে মুক্তি বাহিনী’ বলা হয়ে থাকে। | নিয়মিত সৈনিক ছাড়াও যারা মুক্তি বাহিনীর প্রধান অঙ্গ এবং অতি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে চলেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বহুসংখ্যক অনিয়মিত বাহিনী, বেসামরিক সেচ্ছাসেবক (গণ বাহিনী)। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি এবং ছাত্র থেকে শুরু করে শিল্প কারখানার শ্রমিক ও কৃষক যুবকসহ সকল স্তরের ফৌজদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে।
প্রধান সেনাপতি বলেন, শত্রুর উপর আমাদের আঘাত দিন দিনই প্রত্তোতর হচ্ছে। অন্যদিকে দিশেহারা শত্রু বাহিনী নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে বীরত্ব দেখাচ্ছে।
| তিনি বলেন, আমাদের দুঃসাহসিক মুক্তি যােদ্ধাদের প্রচণ্ড আঘাতে শত্রু আজ আতঙ্কগ্রস্ত। সদলবলে ছাড়া তারা আজ চলাফেরা করতেও ভয় পায়। তাই তারা আজ স্থানীয় লােকদের বলপূর্বক ধরে এনে সামনে দিয়ে তাদেরই ছত্রছায়ায় এবার সাহস পায়। এর পরও তারা নিরাপদ বােধ করতে পারছে না। প্রতিদিনই আমাদের বীর মুক্তি বাহিনী বিপুল সংখ্যক শত্রু সেনা খতম করে চলেছেন।
বাঙ্গালীর জীবন মরণ প্রশ্নের এই সঙ্কট সময়ে যারা আজ শত্রুর দালালী করছে তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে প্রধান সেনাপতি বলেন, ন্যায়দণ্ড আজ শত্রুদের দালাল ও দেশদ্রোহীদের উপরও নিপতিত হচ্ছে। রাজাকার সহ যারা শত্রুদের সাথে আজ সহায়তা করছে তাদেরকে তিনি অবিলম্বে একাজ থেকে বিরত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র সহ মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের অনুরােধ জানান। যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রতি ভালাে ব্যবহার করা হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।
এছাড়াও তিনি অন্য সকলের প্রতি মুক্তি বাহিনীর সাথে সর্ব প্রকারে শত্রু ধ্বংসের ব্যাপারে সহযােগীতা করার আবেদন জানান। তবে তিনি সকলকে মুক্তি বাহিনীর কার্যকলাপের ব্যাপারে গােপনীয়তা রক্ষা করে চলার অনুরােধ জানান।
জয়বাংলা (১) [ ১ : ২১ ॥ ৪ অক্টোবর ১৯৭১
সীমান্তে বাংলাদেশ সরকারের চেকপােষ্ট
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের সহিত বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাংলাদেশ সরকার কয়েকটি চেকপােষ্ট স্থাপন করিয়াছেন। এই সমস্ত চেকপােষ্টে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী মুক্তিযােদ্ধাদের সহিত ভূমিশুল্ক বিভাগের উচ্ছপদস্থ কর্মচারী ও নিয়ােগ করা হইয়াছে।
সরকারী সূত্রে প্রাপ্ত খবরে আরাে প্রকাশ এই সব সীমান্ত চেকপােষ্টে নিযুক্ত মুক্তিযােদ্ধারা সীমান্তে পাক গুপ্তচরদের গতিবিধি ও তৎপরতার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখিবেন এবং অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করিবেন। এই সব সীমান্ত চেকপােষ্টে নিযুক্ত শুল্ক বিভাগের কর্মচারীরা সীমান্ত এলাকায় পাট ও তামাকের উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কর গ্রহণ করিবেন।
আরাে প্রকাশ, রংপুর জেলার বুড়িমারী, থানঝােড়া, নারায়ণপুর, এবং দিনাজপুর জেলার ডাঙাপাড়া, তেতুলিয়া, মাগুরমারী ভজনপুর প্রভৃতি স্থানের সীমান্ত চৌকীগুলিতে পাক গুপ্তচরদের তৎপরতার আশঙ্কা করিয়া অধিক সংখ্যায় সীমান্তরক্ষী নিয়ােগ করা হইয়াছে।
বাংলার বাণী ৬ সংখ্যা # ৫ অক্টোবর ১৯৭১
মুক্তি ফৌজের সর্বাধিনায়ক মিঃ এম, এ, জি ওসমানীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
গত ৫ই অক্টোবর রৌমারী মুক্তি ফৌজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রাঙ্গণে মুক্তিফৌজ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ। কর্মী ও জনসাধারণের এক বিরাট সমাবেশে ভাষণ দান উপলক্ষে মুক্তিফৌজ সর্বাধিনায়ক মিঃ এম এ, ওসমানী বলেন বাংলাদেশে গত ছয় মাসের অধিককাল থেকে যে সংগ্রামে লীপ্ত তা হল মুক্তির সংগ্রাম, সাড়ে সাত কোটি লােকের বাঁচার সংগ্রাম এবং সর্বোপরি একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। এ সংগ্রাম আমাদের স্বেচ্ছাকৃত নয়— আমাদের উপর সামন্তবাদ ও শােষনবাদদের কুচক্রের ক্রীড়ানক বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনীর চালিয়ে দেয়া সংগ্রাম । ইতিমধ্যে অতি প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও আমরা ইনশাল্লাহ এক বিরাট মুক্তি বাহিনী সংগঠিত করতে পেরেছি এবং আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর কার্যকরী।
ভূমিকা ও তৎপরতার সংবাদ সম্বন্ধে আপনারা নিশ্চয়ই অবহিত আছেন। | মুক্তি বাহিনীর সংগঠন ও যুদ্ধ প্রকৃতি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি বলেন আমাদের মুক্তি বাহিনী দুইটি ভাগে বিভক্ত- নিয়মিত সেনা বাহিনী ও গণবাহিনী। আমাদের এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ কারণ বাংলার
সাড়ে সাত কোটি লােকের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন এবং তারা তাদের অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ করছে। তার | ভাষায় বাংলার প্রতিটি মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে এ সংগ্রামের অংশীদার। আমাদের মুক্তি বাহিনীর দুইটি ধারায় অপূর্ব মিলন ও সহযােগ সাধনকে আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে এক বিরাট অগ্রগতি বলে তিনি মনে করেন। | তিনি মুক্ত অঞ্চলের জনগণ ও সরকারী কর্মচারীগণকে লক্ষ্য করে বলেন যে তাদের সব সময় মনে রাখতে হবে যে তারা এমন একটি স্বাধীন দেশ ও সমাজের রূপ রেখা দিতে অগ্রণী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন যা হবে বাংলার বর্তমান শত্রু অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসীদের আকর্ষণীয় আদর্শ এবং সারা বিশ্বের প্রসংশনীয়। অতীতের সমাজ ব্যবস্থা ও জীবনধারাকে ভুলে যেতে হবে। দেশকে শত্রু মুক্ত করা যেরূপ আমাদের আশু কর্তব্য তেমনি মুক্ত অঞ্চলের আমাদের জাতীয় পিতার ইঙ্গিত ক্ষণহীন ও শ্রেণীহীন ভ্রাতৃত্ব ভাবাপন্ন সমাজের রূপ রেখা রচনা করাও অপরিহার্য।
পরিশেষে তিনি বাংলার ত্রাণকার্য্যে উৎসর্গ প্রাণ স্বীয় মুক্তি বাহিনীর প্রতিটি কার্যে পূর্ণ সহযােগীতার উপদেশ দান করেন।
খবরে আরও প্রকাশ তিনি এই বলে আশ্বাস দেন যে বাঙ্গালী একথা ও আত্মত্যাগের প্রতিফল স্বাধীনতা ও শত্রু সৈন্যের পূর্ণ নিধন আর বেশি দেরী নেই।
|
অগ্রদূত # ১ : ৬ || অক্টোবর ১৯৭১
| রৌমারীতে মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ এম, এম, জি, ওসমানীর আগমন।
রৌমারী ॥ ৫ই অক্টোবর। | আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ ৫ই অক্টোবর বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ এম, এ, জি, ওসমানী রৌমারীতে আগমন করেন। তার সঙ্গে মুক্তি ফৌজ অধিনায়ক মিঃ জে, রহমান, মিঃ আবু তাহের ও আরও অন্যান্য উচ্চ পদস্থ সামরিক অফিসারগণও আগমন করেন। মুক্তি ফৌজের সর্বাধিনায়ক সাহেব রৌমারী মুক্তি ফৌজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, রৌমারী হাসপাতাল ও থানা পরিদর্শন করেন এবং থানায় স্বাধীন বাংলা পুলিশের অভিবাদন গ্রহণ করেন। তারপর তিনি মুক্তি ফৌজের জোয়ান, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণের এক বিরাট সমাবেশে ভাষণ দান করেন। অবশেষে তিনি স্থানীয় জননেতা, আওয়ামী লীগ কর্মী ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীবৃন্দের সঙ্গে নানাবিধ স্থানীয় সমস্যা সম্বন্ধে আলােচনা করেন এবং সেগুলি সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে আশ্বাস দেন। তারপর সহাস্যবদনে সকলের সঙ্গে করমর্দন করতঃ মুজিব নগরের উদ্দেশ্যে রৌমারী ত্যাগ করেন।
| অগ্রদূত ॥ ১ : ৬ ॥ ৬ অক্টোবর ১৯৭১
| আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে
—প্রধানমন্ত্রী
‘আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে, আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই অর্জন করতে হবে । যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহীত।
গত বুধবার মুজিব নগরে এক বিশেষ সাক্ষাঙ্কারে ‘জয়বাংলা প্রতিনিধির কাছে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ উপরােক্ত ঘােষণা করেন।
বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতিগতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেনঃ যারা মানব স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারে বিশ্বাসী তারা আমাদের সংগ্রামকে সমর্থন করতে ন্যায়তঃ বাধ্য। তবু সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থ বা বিশ্ব ট্রাটেজীর স্বার্থে যারা আমাদের সাহায্য ও সমর্থন দিতে অপারগ তাদের উচিৎ বাংলাদেশ প্রশ্নে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা। কেননা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধ্বংসযজ্ঞের হােতাদের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সাহায্য করা স্বাধীনতাও মানবিক মূল্যবােধের ধ্বংস সাধনেরই সামিল। | বিভিন্ন স্বার্থবাদী মহলের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক আপােষ’ ‘সমঝােতা’ প্রভৃতির যে ধূয়া তােলা হচ্ছে তৎসম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জনাব তাজউদ্দীন অত্যন্ত জোরের সাথে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমি পুনর্বার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করতে চাই যে, আমাদের সরকারের ৪ দফা পূর্বশর্ত পূরণ যথা—বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তি, বাংলাদেশ থেকে সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনীর ধ্বংসলীলার পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না হওয়া পর্যন্ত কারাে সাথে কোন আলােচনারই প্রশ্ন উঠতে পারে না।’ | এ প্রসঙ্গে আরাে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন বলেন : “আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে পূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য এবং তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধের বিরতি হবে না।’
এ পর্যন্ত মুক্তি বাহিনীর সাফল্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জনাব তাজউদ্দীন বলেন : মুক্তি বাহিনী | আজ সুসংগঠিত, জাতি সংঘবদ্ধ ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আমাদের মুক্তিযােদ্ধা-ভায়েরা মাত্র কয়েক মাসে যা | করেছেন তা বিশ্বের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসে এক নয়া নজীর হিসাবে ভাস্কর হয়ে থাকবে। তাদের প্রতি আমার আবেদন, শত্রুর উপর আঘাতের পর আঘাত করে যান এবং শক্রর দুর্গকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিন । যুদ্ধক্ষেত্রেই হবে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার চূড়ান্ত ফয়সালা ।
জয়বাংলা (১) # ১: ২২ ॥ ৮ অক্টোবর ১৯৭১
বিজয়া উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বাণী।
আজ অত্যন্ত সংকটজনক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবনে আনন্দময়ীর আগমন ঘটেছে। একদিকে স্বজন হারানাের বেদনা, অন্যদিকে জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম এর | মধ্যে মুক্তাঞ্চলে ও শরণার্থী শিবিরে যারা দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান করছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ | সরকারের পক্ষ থেকে আমি তাদেরকে বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আর দখলীকৃত এলাকায় যারা পূজানুষ্ঠানের স্বাধীনতা হারিয়েছেন তাদেরকে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
এই উপলক্ষে আমি স্বদেশবাসীকে আরেক বার বলতে চাই যে, দেশকে সম্পূর্নরূপে শত্রুমুক্ত | করার দিনটি ঘনিয়ে এসেছে। আমি আশ্বাস দিতে চাই যে, ফ্যাসিবাদী হানাদারদের বিতাড়িত করে আমরা যে ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলব সেখানে সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা | বিধান করা হবে।
জয়বাংলা (১) ১: ২২ ৪ ৮ অক্টোবর ১৯৭১
স্বাধীন বাংলা স্থায়ী হওয়ার জন্যই কায়েম হয়েছে।
মনসুর আলী
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, পৃথিবীর মানুষ আজ উপলব্ধি | করতে পেরেছেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশ চিরস্থায়ী হবার জন্যই কায়েম হয়েছে।
বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে প্রদত্ত বিবৃতিতে জনাব আলী বলেন, বাংলাদেশে। পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা ইতিহাসে বর্ণিত যাবতীয় ধ্বংসলীলাকে ম্লান করে দিয়েছে। আমাদের দেশপ্রেমিক জনগণ এবং বিক্রমশালী মুক্তি বাহিনী প্রতিরােধ সংগ্রামের | ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
জনাব আলী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে সর্বশেষ পাঞ্জাবী সেন্যকে সম্পূর্ণ না তাড়ানাে পর্যন্ত এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমরা বদ্ধ পরিকর। সুচনায় আমরা কোন প্রকার | সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, এই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। পৈশাচিক । সামরিক জান্তা যা আরম্ভ করেছে তা চিরদিনের জন্য শেষ করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই।
জনাব আলী বলেন, কোন সন্দেহ নেই যে, আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। খুব সম্ভব ভবিষ্যতে আরও অনেক ক্ষতি স্বীকার নিতে হবে, কিন্তু মাতৃভূমির জন্য যেকোন মূল্যের ত্যাগ স্বীকার করতে আমরা আজ প্রস্তুত।
| তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার দেশপ্রেমিক নাগরিক মুক্তি সংগ্রামে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। তাদের | শাহাদতের মর্যাদা রক্ষা করতে আমরা অঙ্গীকার বদ্ধ।
বিদেশের যে-সব শুভানুধ্যায়ী এই সংগ্রামে সাহায্য দান করেছেন জনাব মনসুর আলী তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। | যে সামরিক বাহিনীর হাতে, তার কৃপা দৃষ্টি যতদিন বহাল থাকবে ততদিন অপর দালালদের ভয়ে ভীত হবার কোন কারণ নেই। প্রয়ােজন হলে কাসেম নওয়াজেসরাই অপর পক্ষকে সংহতি, বিরােধী কার্যকলাপের দায়ে বহিষ্কার করতে পারবে।
| তবে বহিষ্কৃত তারা অবশ্যই হবেন, এ দুনিয়ার মাটি থেকেই বহিষ্কৃত হবেন, আর সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের বীর মুক্তি যােদ্ধারা। তারা যেদিন আঘাত হানবে সেদিন তাদের কোন প্রভুই রক্ষা করতে পারবে না।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২২ ॥ ৮ অক্টোবর ১৯৭১
মুজিবনগর বৈঠকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোন প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য নয়।
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
সম্প্রতি মুজিব নগরে অনুষ্ঠিত তিনদিন ব্যাপী বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠক এক ঐতিহাসিক গুরুত্বের অধিকারী বৈঠক। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন, ভারত-সােভিয়েট ইউনিয়ন যুক্ত বিবৃতি এবং জাতিসঙ্ঘে ইঙ্গমার্কিন ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও ঘােষণা সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন সম্পর্কে সংগ্রামী প্রত্যয়কে আরাে উজ্জ্বল করে তুলছে। বৈঠকে ভারত- যুক্ত বিবৃতিতে অভিনন্দিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সমস্যা অনুধাবনে সােভিয়েট নেতৃবৃন্দ অনেক এগিয়ে এসেছেন।
শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে বৈঠকে বলা হয়েছে, একমাত্র স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারে। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ভারতের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বের কোন কোন দেশ এখনাে বাংলাদেশ সমস্যার জটিলতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। বৈঠক যে বক্তব্যটিকে বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট করে তুলেছেন তা হল, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান সাফল্য এই সত্যটাকেই প্রমাণ করতে চলেছে যে, বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করবেন। অন্যান্য দেশ যদি বাস্তব সত্য উপলব্ধিতে দেরী করে তাতে মুক্তি যােদ্ধাদের মনােবল নষ্ট হবে না। বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্পষ্ট ভাষায় যে বক্তব্যটি তুলে ধরা হয়েছে, তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা ভিন্ন অন্য কোন রাজনৈতিক মীমাংসা প্রস্তাব তাদের নিকট গ্রহণযােগ্য হবে না।
উদয় বাংলা ॥ ১: ২২ ৮ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলার পবিত্র ভূমি থেকে শত্রুকে উৎখাত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।
—সৈয়দ নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন নিম্নে তার পূর্ণ বিবরণ প্রদত্ত হল ঃ
আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী ভাই-বােনেরা ও আমাদের মুক্তি বাহিনীর মহান বীর সেনারা
প্রথমে জানাই আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন ও সশ্রদ্ধ সালাম । আজ রক্তাক্ত পঁচিশে সেপ্টেম্বর । বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের ছ’মাস পূর্ণ হলাে। আজ থেকে ঠিক ছ’মাস আগে পঁচিশে মার্চ তারিখে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে বর্বর হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের উপর বীভৎস হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল। সেদিন থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই। স্বাধীনতা ঘােষণার মাধ্যমে শুরু হয় আমাদের মুক্তি যুদ্ধ। এই ছ’মাস সময়ের মধ্যে যে সব নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙ্গালী ভাই-বােনেরা আত্মহুতি দিয়েছেন এবং যে সব মুক্তিসেনা তপ্ত লহুর মাঝ দিয়ে শাহাদত বরণ করেছেন প্রথমে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই-এ এঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এর সঙ্গে সঙ্গে আমার সরকারের তরফ থেকে আমি যে প্রতিকুল অবস্থার মধ্য থেকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত আমাদের মুক্তি বাহিনী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন তাতে সমগ্র সভ্য জগত স্তম্ভিত হয়ে পড়ছে। বিশ্বের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসে আপনারা উজ্জ্বল নক্ষত্র। আপনাদের মৃত্যু নেই। আপনারা মহান ও অমর। আমার সরকার ও বাঙ্গালী জাতি এই জন্য। গর্ব অনুভব করছে।
এটা আমাদের জীবন মরণের যুদ্ধ।
আজকে জাতির উদ্দেশ্যে দুটো কথা বলতে যেয়ে বারবার দখলীকৃত এলাকার ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী-মধ্যবিত্ত লাখ লাখ বাঙ্গালীদের দুর্বিসহ জীবনের চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আপনাদের দুঃখে আমরা ব্যথিত। তবুও আপনারা যেভাবে মুক্তি যুদ্ধে সহযােগিতা করছেন তা আমাদের অবিভূত করেছে। তাই আমরা সর্বশক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করবার জন্য মরণপণ লড়াই-এ ঝাঁপিয়ে পড়েছি। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা যখন যুদ্ধকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, তখন আমরা সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছি। বাঙ্গালীর একতা, অটুট মনােবল, অদম্য সাহস আর দেশপ্রেমই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা লড়াই-এর মূলমন্ত্র। আজ বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে একটা দানবীয় পশু শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের তাজা তরুণ প্রাণগুলি। রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাঝ দিয়ে বিজয়ের বরমাল্য আনতে শুরু করেছে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ—এই যুদ্ধ বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা-কৃষক-মজদুরের জীবন-মরণের যুদ্ধ। তাই এ যুদ্ধ এখন জনযুদ্ধ। ছ’মাসের মধ্যে আমাদের অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্যে শত্রুপক্ষ হতভম্ব, বিপর্যস্ত ও তাদের মনােবল নিঃশ্বেষিত। | সামরিক শাসকচক্র ভেবেছিল মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই তারা কাৰ্য্য সমাধা করতে পারবে এবং পাকিস্তানের ‘ঘরােয়া ব্যাপার বলে বিশ্ব-বিবেককে বুঝাতে পারবে। কিন্তু কোনটাই আর বাস্তবে পরিণত হয়নি। ছ’মাসের মধ্যে তারা পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে পারেনি এবং বিশ্ব জনমতকেও বিভ্রান্ত করতে পারেনি। বরঞ্চ ছ মাসের মুক্তি যুদ্ধের খতিয়ান করলে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে আমাদের মহান মুক্তি সেনারা প্রতিটি সেক্টরেই অবিশ্বাস্য রকমের সফলতা অর্জন করেছে।
সমগ্র বিশ্ব আমাদের সংগ্রামের যৌক্তিতা উপলদ্ধি করেছে। প্রেসিডেন্ট বলেন
| শত্রু বাহিনীর চলাচল পথ বিকল করে দেওয়ার জন্য যােগাযােগ ব্যবস্থা বিছিন্ন করে দিয়েছে। রসদ সরবরাহ পথ রুদ্ধ করার জন্য রেল যােগাযােগ ও সড়ক পথ ও নদী পথে আক্রমণ তীব্রতর করে। তুলেছে। আমাদের বিশেষ বাহিনী চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে শক্রর অস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংস করে। দিচ্ছে। মুক্তি বাহিনীর এইসব গেরিলা সৈন্যদের ওপর এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, শক্রর
উপর আঘাত হানাে এবং সরিয়ে পড়াে’ এই নীতি চালিয়ে যাও। বীর মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর অস্ত্র দখল। করে সুদীর্ঘ ছ’মাস কাল ধরে সাহসিকতার সংগে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আমার সরকার ও | বাঙ্গালী জাতির পক্ষ থেকে তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। ইতিহাসের পাতায় এই সংগ্রামী যুদ্ধের কথা
স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
হানাদার বাহিনী আজ বিপর্যস্ত
সর্বাধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে বাংগালী মুক্তিযােদ্ধাদের এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আঘাতে আঘাতে হানাদার সৈন্যরা আজ বিপর্যস্ত—তাদের মনােবল নিঃশেষিত। জেনারেল ইয়াহিয়ার সেনাদল এখন ক্ষয়িষ্ণু। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তি বাহিনীর শক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। পদ্মা, মেঘনা যমুনা, কর্ণফুলীর বীর সন্তানেরা দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে শামিল হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবি, ছাত্র, যুবক ও আমাদের নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকেরা স্বাধীন বাংলার পতাকার নীচে এক কাতারে শামিল হয়েছে। তাদের ইস্পাত কঠিন ঐক্যই আজ মুক্তি বাহিনীকে আরও দুর্বার ও অজেয় শক্তিতে পরিণত করেছে।
নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রস্তুতি চলছে।
পদাতিক বাহিনী ছাড়াও আমাদের নৌ ও বিমান বাহিনীর বীর সৈনিকরা শত্রুর উপর আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশের সর্বত্র শহরে গঞ্জে, বন্দরে গ্রাম বাংলার প্রতি পথে প্রান্তরে আমাদের গেরিলা সৈন্যরা মৃত্যুর সংগে পাঞ্জা লড়ে যেভাবে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে চলেছে, তাতে আমরা বিরাট গর্ব অনুভব করছি। এর মধ্যেই আমাদের মুক্তি বাহিনী ভারী অস্ত্র ব্যবহারেও পারদর্শী হয়ে উঠেছে। ইশা খা, তিতুমীর, কেদার রায়, সূর্য সেনের ঐতিহ্য বহনকারী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের আদর্শে অনুপ্রাণিত আমাদের মুক্তি বাহিনীর সম্মুখে একটি মাত্র লক্ষ্য। সেটা হচ্ছে বাংলার বুক থেকে হানাদার সৈন্যদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। আমার স্থির বিশ্বাস, যে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের জোয়ানরা লড়াই করে চলেছে তাতে সেই সুদিন খুব শীঘ্রই এসে হাজীর হবে। আমি আবার আমাদের মুক্তি বাহিনীকে জানিয়ে দিতে চাই, সাড়ে সাত কোটি বাংগালী সন্তান আজ ইস্পাত কঠিন শপথে আপনাদের পিছনে রয়েছে। বাংগালী আপামর জনসাধারণ চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
মুক্তি সংগ্রামে আমরা আজ একা নই । | বাংলাদেশের স্বাধীনতাই আজ সবার কাছে সব চেয়ে বড় কথা। বাঙালী মাত্রই আজ মুক্তি সেনা।
দেউলিয়া হওয়ার পথে জান্তা | জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা দেউলিয়া হওয়ার মুখে। অন্তকলহে তারা বিপর্যস্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামাে প্রায় ভেঙে পড়েছে। সেখানকার অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ হওয়ার দরুন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বাজার হাতছাড়া হওয়ার দরুণই আজ পশ্চিম পাকিস্তানে এ ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তাই আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানী জিনিসপত্রের উপর বয়কট অব্যাহত রাখুন। সামরিক জান্তা বাংলাদেশের পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া ইত্যাদি বিদেশে রফতানী করতে না পেরে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিশ্বের দরবারে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তান এইড কনসাের্টিয়াম এখন এই সামরিক জান্তাকে আর অর্থ
সাহায্য বা ধার হিসাবে টাকা দিচ্ছে না। এ ছাড়া মনে রাখা প্রয়ােজন, যে কোন দেশের সরকারের পক্ষে শুধুমাত্র বিদেশী সাহায্য ও ধারের উপর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। উপরন্তু এই সামরিক জান্তা নিজেরাই দেড় হাজার মাইল থেকে একটা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জনসাধারণের মাঝেও নৈরাশ্য ও হতাশ দিন দিন দানা বেঁধে উঠেছে। সত্তুরের নির্বাচনে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল। আজ তারা দেখতে পাচ্ছে তাদের সন্তানরা সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের লড়াই ও ২২ পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় প্রাণ দিচ্ছে।
সে কারণে আজ পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ, সিন্ধি ও পাঠানদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা জেগে উঠছে। তাই আমরা দেখতে পাই বেলুচ ও পাঠান সৈন্যদের সাথে পশ্চিম পাঞ্জাবী অফিসারদের সংঘাত শুরু হয়েছে। পাঞ্জাবের কৃষক শ্রমিকেরা, যারা সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিগত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল তাদেরও মােহমুক্তি ঘটতে শুরু করেছে। আমি বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী নির্যাতিত মানুষদের আশ্বাস দিতে পারি, পাঠান বেলুচ ও সিন্ধি জনগণ যদি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে তাহলে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত মানুষ তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। পশ্চিম পাঞ্জাবের কৃষক শ্রমিকেরা যদি তাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই শুরু করে তাহলে বাংলার নির্যাতিত কৃষক শ্রমিকেরা তাদের সহানুভূতি জানাবে। তাই আজকের দিনে আমি পশ্চিম পাকিস্তানী সর্বহারা মানুষদের জানাই সামরিক জান্তা নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য আপনাদেরও শােষণ করে চলেছে। আপনাদের মিথ্যে ধােকা দিয়ে বাঙ্গালীদের উপর তারা যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এ লড়াইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কিছু লাভ হবে না।
ঘরােয়া ব্যাপার আর বাজারে বিকাচ্ছে না।
সত্যিকারভাবে বলতে গেলে আজকে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতি পদে পদে আমাদের শত্রু জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা শুধু দুর্বল হয়েই পড়েছে না, বাংলাদেশের ব্যাপারটাকে ঘরােয়া ব্যাপার দেখাবার জন্য সারা পৃথিবীব্যাপী তারা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বজনমত আজ বাংলাদেশের ব্যাপারে সােচ্চার হয়ে উঠেছে। বুদাপেস্টের শান্তি সম্মেলন, সিঙ্গাপুরে পার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং নয়াদিল্লীতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যােগদানকারী সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের। মানুষের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ের সপক্ষে রায় দিয়েছে। ওয়াসিংটন, নিউইয়র্ক, অটোয়া, লণ্ডন, বৈরুত, হংকং, ম্যানিলা, টোকিও সর্বত্রই আজ নানা ধরনের সভা ও শােভযাত্রা জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের কয়েক শ’ সদস্য কয়েক দফাই একযােগে ইসলামাবাদের শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ধিক্কার দিয়েছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টে এর মধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশ ইস্যু আলােচিত হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রমকারী বাঙালী শরণার্থী এবং অধিকৃত এলাকায় কোটি কোটি আমার ভাই-বােনেরা যে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে, তাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসবার জন্য সকলের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
তাদের প্রতি আমার আশ্বাস
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আজকে যারা অসহায় অবস্থায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, সে-সমস্ত বন্ধুদেরকে আমি আশ্বাস দিতে পারি আমাদের তরফ থেকে আমরা দ্রুত অধিকৃত এলাকাকে শত্রুমুক্ত করার সাথে সাথেই তাদের দুঃখ-দুর্দশা মােচন সম্ভব হবে অন্যথায় তাদের দুঃখ-দুর্দশা মােচন সম্ভবপর নয়। এতদসত্ত্বেও বিদেশী রাষ্ট্রগুলাে থেকে যে-সব সাহায্য বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় পাঠানাে
হয়েছে, আমরা শুনে ব্যথিত হয়েছি, দুঃখিত হয়েছি এবং আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক কর্তৃপক্ষ সে-সব সাহায্য থেকে আপনাদের বঞ্চিত করে তা হানাদার বাহিনীর কাজে লাগিয়েছে। এমনকি এ-সব সাহায্য দ্রব্য সরবরাহের জন্য যে-সব যানবাহন বিদেশ থেকে এসেছে সেসৰ হানাদার সৈন্যদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি রাষ্ট্রসংঘ ও বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি।
দেশকে শত্রু মুক্তির জন্য চালান হচ্ছে সমস্ত প্রচেষ্টা
সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী ভাই-বােনেরা আমার, আপনাদের সমর্থনপুষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার দেশকে শত্রুর কবজামুক্ত করবার জন্য সমস্ত রকমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সরকারের। প্রতিনিধিরা জাপান, ফিলিপাইন, থাইল্যাণ্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, সিংহল, নেপাল, লেবানন, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলােতে আমাদের সপক্ষে জনমত গড়ে তােলবার জন্য সফর করছে।
এই সমস্ত সফরের ফলে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যে সাড়া পেয়েছি তাতে বিশ্বাস করবার কারণ ঘটেছে যে, বিশ্বের ছােট বড় বহু দেশ অচিরেই সক্রিয়ভাবে আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসবে।
আমরা আজ আর একা নই।
এর মধ্যেই সােভিয়েট রাশিয়া বাংলাদেশ ইস্যুতে তাঁদের বক্তব্য ঘােষণা করেছেন। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট পদগণী এবং আফগানিস্তানের রাজা জাহীর শাহের যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে মত প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ব ইউরােপের দেশগুলােও আমাদের প্রতি সমর্থনের মনােভ প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, আফ্রিকা ও লেটিন আমেরিকার কোন কোন দেশ আমাদের স্বপক্ষে কথা বলেছেন। এ সমস্ত বিশ্ব রাষ্ট্রগুলাে আজকে আমাদের সংগ্রামের সত্যতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কেন না আমাদের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম ঘােষিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করার সংগ্রাম ।
ইয়াহিয়ার নতুন ধােকাবাজী
তাই আজ অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা বিশ্বজনমতকে ধোকা দেওয়ার ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় বেসামরিক শাসন চালু হয়েছে বলে একটা মুখােস পরাবার। চেষ্টা করছে। ডাক্তার মালিককে গভর্ণর নিয়ােগ করে, নির্বাচনে পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলির অধিকার বা সদস্য নিয়ে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছে। এর পেছনে দুটো মাত্র উদ্দেশ্য রয়েছে। এক নম্বর হচ্ছে, বিশ্ববাসীকে ধোকা দিয়ে বােঝানাে যে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর দুই নম্বর হচ্ছে, বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লােভ দেখানাের প্রচেষ্টা। অথচ কার্যক্ষেত্রে এটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। জঙ্গী নায়ক ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক সহচরেরা পর্যন্ত এই লােভ দেখানাে প্রহসনকে স্বীকার করে নিতে পারেন নি। স্বয়ং ভূট্টো। সাহেব এই লােভ দেখানাে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠাকে একটি ভাওতা বলে উল্লেখ করেছেন। এমন কি চরম দক্ষিণ পন্থী রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী রহমত এলাহী বলেছেন এ ধরণের বেসামরিক সরকার না হবে গণপ্রতিনিধিত্বমূলক, না হবে জনপ্রিয়। এর দ্বারা কোন কাজই সফল হবে না।
ইয়াহিয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ।
বন্ধুরা আমার, এই লােক দেখানাে সরকার প্রতিষ্ঠা করে ইয়াহিয়া খান মনে করেছিলেন যে, বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে একটা বিরােধ সৃষ্টি করবেন, এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে একটা ভাঙন ধরাবেন। ইয়াহিয়া খানের এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ লােক দেখানাে সরকারের সদস্য কারা? বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ তা জানেন। পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলাের সদস্য নিয়ে যে মন্ত্রীসভা আজকে ইয়াহিয়া সাহেব গঠন করেছেন সে মন্ত্রীসভার সদস্যদের, আর যে গভর্ণর তিনি নিয়ােগ করেছেন সেই ডাক্তার মালেক সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, আপনারা বলেছেন যে, আপনারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনছেন কিন্তু আপনারা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাংলাদেশে যে ভয়াবহ অবস্থা নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে তার কি কোন কৈফিয়ত আপনারা দিতে পারবেন? মালেক সাহেব গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পর কুমিল্লা জেলার কসবা, চৌদ্দগ্রাম, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় বিগত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকে যে ভয়াবহ নরহত্যা ঘটেছে তার কি কোন কৈফিয়ত মালেক সাহেব দিতে পারবেন? নির্মমভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু কুমিল্লার পূর্বাঞ্চলেই নয়, সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার কিশােরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলে বিগত ১৮ই আগস্ট থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চলেছে তার খবর কি মালেক সাহেব রাখেন? শত শত নারীকে আজকে আবার নির্যাতনের। শিকারে পরিণত করা হয়েছে। বাঙ্গালী মা-বােনদের ইজ্জত রক্ষা করতে যারা পারবে না, বাংলার নিরীহ মধ্যবিত্ত চাষীর জীবনকে যারা বাঁচাতে পারবে না, বাংলাদেশের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার। অধিকার তাদের নেই। বাংলাদেশের মানুষ ঘৃণা ভরে ইয়াহিয়া খানের এই পুতুল সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি বিশ্বাস করি তাদের সঙ্গে জনগণ কোন ভাবেই সহযােগিতা করবে না। | অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন ধরাতে ইয়াহিয়া খান শুধু ব্যর্থই হন নাই, তার সমস্ত প্রচেষ্টাকে আজ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি মনে। করেছিলেন আওয়ামী লীগের ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের সদস্য পদ বহাল রেখে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করবেন। কিন্তু দেশবাসী ভাইয়েরা আপনারা শুনে সুখী হবেন যে, আপনাদের নির্বাচিত সদস্যদের অধিকাংশই এখন মুক্ত এলাকায় এসে স্বাধীনতার সংগ্রামে শরিক হয়েছেন। বাকী সদস্যরা আত্মগােপন করে মুক্তি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে চলেছেন। আমি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের এ সমস্ত সংগ্রামী পরিষদ সদস্যদের তাদের ত্যাগ তিতীক্ষা এবং ঘােষিত স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে শরিক হবার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
| আমি দেশবাসী ভাইদের এ আশ্বাস দিতে পারি যতদিন পর্যন্ত না বাংলার মাটি থেকে হানাদার। বাহিনী উত্থাত হবে, যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত আপনাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আপনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করে যাবেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শ এবং নীতিতে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। যে। গণতন্ত্র বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা, বহু মনীষীর ত্যাগ ও তিতীক্ষা আজও পৃথিবীতে স্বীকৃত এবং রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠতম আদর্শ হিসেবে পরিগণিত সেই গণতন্ত্রের লড়াই আজকের বাংলাদেশের ভূমিতেই চলছে।
সেই গণতন্ত্রের লড়াই-এ ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর । রহমান আজ ফ্যাসিস্ট সরকারের কারাগারে বন্দী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা, গণতন্ত্রের মহান সাধক বাঙ্গালীর প্রাণ প্রিয় নেতা জনাব শেখ মুজিবর রহমানকে আজকে এক প্রহসনমূলক বিচারে শাস্তি দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের সরকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর বিচারের ধৃষ্টতা দেখিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ধিকৃত হয়েছেন।
গণতন্ত্রকামীদের প্রতি আহ্বান | বাংলাদেশের ভাই-বােনেরা আপনাদেরকে আমি সুস্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই পৃথিবীর ছােট বড় সমস্ত রাষ্ট্রই এই বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করেছেন। আমি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর তরফ থেকে ইয়াহিয়া খানকে সাবধান করে দিতে চাই যে বঙ্গবন্ধুর মিথ্যা। প্রহসনমূলক বিচার যদি আপনি চালিয়ে যান এবং বঙ্গবন্ধুকে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রিয়তম নেতার যদি আপনি কোন ক্ষতি করেন তাহলে বাংলার মানুষ এ অন্যায়কে সহ্য করবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সমস্ত মানুষের কাছে আকুল আবেদন জানাই——যারা গণতন্ত্রের সংগ্রামে আজকে লিপ্ত আছেন সে সমস্ত মানুষের কাছে আমি ফরিয়াদ করি ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়া সরকারের কারগারে আবদ্ধ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রকামী নেতার মুক্তির জন্য আপনারা আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসুন এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রিয় নেতাকে তাদের মধ্যে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করুন। সে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাবাসীর কাছে আমি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে আবেদন জানাই অবিলম্বে বাংলাদেশে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি, বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার বাহিনী। প্রত্যাহার এবং এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন অন্যথায় আমাদের মুক্তি বাহিনী দুর্বার গতিতে হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেশকে মুক্ত করবেই। সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ ধরণের রক্তপাতের মধ্য দিয়েই তা বাস্তবে পরিণত হবে। কেননা স্বাধীনতা, শান্তি ও গণতন্ত্রের লড়াইএ আমরা সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।
আমাদের জয় সুনিশ্চিত। বিশ্বের ছােট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানানাের সঙ্গে সঙ্গে আমি দেশবাসী ভাইদের জানাতে চাই যে আমরা শান্তিপূর্ণ সমঝােতার মাঝ দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ বৈঠক উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের গুরুত্ব বােঝাবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল আমার সরকারের পক্ষ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসঙ্রে সদর দফতরে গিয়ে হাজির হয়েছেন। আমি আশা করি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির প্রয়ােজনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌছাবাের জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন।
সার্বিক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত
বন্ধুরা আমার, জাতিসঙ্ঘে শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালানাের সঙ্গে সঙ্গে আমরা। সার্বিক লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত। আমাদের শক্তি এখন দিন দিনই বেড়ে চলেছে।
| দেশবাসী, ভাই-বােনেরা, আপনারা মনে রাখবেন বিশ্বের ইতিহাসে মুক্তি যুদ্ধ কখনাে বিফলে যায়নি। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আলজেরিয়ার বীর জনতা সফলকাম হয়েছে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাইপ্রাসের বীর জনতা সফলকাম হয়েছে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ভিয়েন্নামীরা সফলকাম হয়েছে। এই সফলতার জন্য আজ চাই সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঐক্য। বাংলাদেশের এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আজ প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইয়াহিয়ার বর্বর ফ্যাসিষ্ট সরকার। আর তার বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি সারা বাঙালী জাতি। তাই বন্ধুরা এবং ভাইয়েরা দল, মত, জাতিধৰ্ম-নির্বিশেষে আমি সমস্ত বাঙ্গালী জাতির কাছে আবেদন জানাই আপনারা ঐক্যবদ্ধ হউন, কঠিন সংগ্রামের শপথ নিন। আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার, ফ্যাসিষ্ট, সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়া সরকারকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য দুর্বার গতিতে এগিয়ে যান।
শত্রু সেনাকে নির্মূল করতে হবে
বন্ধুরা আমার, বীর মুক্তি সেনানী ভায়েরা আমার, তােমাদের স্মরণ রাখতে হবে এই মুক্তি যুদ্ধে হয় আমরা জয়লাভ করবাে, নয় জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবাে।
মধ্যে মধ্যবর্তী কোন অবস্থা নেই। যে বর্বর সেনাদল আমাদের মা-বােনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, যে বর্বর হানাদার বাহিনী আজও আমার দেশের শত শত মা-বােনকে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছ সেই নির্মম সেনাবাহিনীকে সমূলে উৎখাত না করা পর্যন্ত, আমাদের মা-বােনদের ইজ্জত রক্ষা না করা পর্যন্ত আমাদের কোন প্রকার বিশ্রাম থাকতে পারে। ।
আপােষ নেই
‘ বাংলার সংগ্রামী কৃষক ভায়েরা আপনাদেরকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের মেহনতের ফলে ২৩ বছর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী লুটেরারা শােষণ করে নিয়েছে। আর আপনারা অসহ্য দুঃখের মধ্যে জীবন যাপন করেছেন। হানাদার বাহিনী বাংলার গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে আজকে। আপনাদের ঘরবাড়ী ধুলিস্যৎ করে দিয়েছে। আপনাদেরকে তারা শেয়াল কুকুরের মতাে হত্যা করেছে। এমনকি আমি নিজে জানি, অনেক পরহেজগার মুসলমান যাদেরকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। তাদেরকে দাফন-কাফন পর্যন্ত করতে দেয় নাই। অনেক ধর্মপ্রাণ হিন্দুকে শ্মশানের চিতায় শুইয়ে তার। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছাবারও সুযােগ দেয় নাই। বাংলার কৃষক জনতা, এই বর্বর বাহিনীর সঙ্গে আমাদের কোন আপােষ হতে পারে না।
মেহনতী মানুষের শত্রুদের আঘাত হানাে
বাংলার শ্রমিক ভাইয়েরা, তােমাদের মেহনতের সব ফসল বাইশ পরিবার লুটে খেয়েছে। সেই বাইশ পরিবারের অর্থনৈতিক শােষণকে চুরমার করে স্বাধীন বাংলার বুকে এক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করার জন্য আমি এবং সরকারের প্রতিনিধিরা আমরা লড়ে চলেছি। তাই বাংলার মহান শ্রমিকেরা, তােমাদের কাছে আমি আহ্বান জানাই তােমাদের মেহনতের ফসলকে যারা শােষণ করেছে সেই বাইশ পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় যে সেনাবাহিনী আজ তােমাদের উপর আঘাত হেনেছে তাদের প্রতি প্রতিঘাত হানার জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তােমরা শরীক হও, দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাও। | বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা, বাইশ তেইশ বছর পর্যন্ত বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিকাশের পথে যে পশ্চিম পাকিস্তানী কুচক্রীরা একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করে চলেছে সে ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাঙ্গালী সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের জন্যেই আজকে স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা লিপ্ত হয়েছি। এই বাংলার অধ্যাপক, বাংলার শিক্ষক, বাংলার সঙ্গীত শিল্পী, বাংলার নাট্য-শিল্পী, বাংলার সাংবাদিক সহ সকল শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমি আকুল আবেদন জানাই এই সংগ্রামে আপনাদের লেখনী, আপনাদের প্রতিভা, আপনাদের চিন্তাধারা আজকে মুক্তি সেনানীদের বিপুল-বিজয়কে এগিয়ে নিয়ে যাক। আপনারা পিছনে পড়ে থাকবেন না, কারণ আগামী দিনের ইতিহাসে আপনাদের নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাক এই আমরা চাই।
সংগ্রামী ছাত্র সমাজ | বাংলার ছাত্ররা, ২৩ বৎসর পর্যন্ত তােমরা সংগ্রামের পুরােভাগে ছিলে। সালাম, বরকত, রফিক যেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিলাে সেদিন থেকে বার বার বাংলার সংগ্রামী ছাত্ররা তােমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, শােষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছ। ৬২ সালের আন্দোলন, ৬৯
সালের মহান আন্দোলনে তােমরা ছিলে অগ্রসেনানী। আমি জানি আজকের এই মহান মুক্তি যুদ্ধে। | তােমরা সংগ্রামের পুরােভাগে। আমি জানি আজকে তােমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্ত্বর ছেড়েছ, স্কুল ছেড়েছ, কলেজ ছেড়েছ; বাপ-মায়ের স্নেহের কোল ছেড়ে আজকে বাংলার পথে-প্রান্তরে তােমরা মুক্তি সেনানীদের অগ্রভাগে লড়াই করে চলেছ। তােমাদেরকে আমার অসীম ভালবাসা ও সঙ্গে সঙ্গে আমার। সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই। | বাংলার ছাত্র-যুবকেরা! যে স্বাধীনতার লড়াই আজ চলেছে সে স্বাধীনতার লড়াই সফল হলে। ভবিষ্যতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হবে—সে বাংলাতেই তােমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক | হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। মানুষের মতাে বাঁচতে পারবে। অন্যথায় তােমাদের গােলাম হয়ে গােলামীর জীবন যাপন করতে হবে। | তরুণ ভাই-বােনেরা, ভবিষ্যৎ তােমাদের। আমাদের দিন গত প্রায়। আমরা যারা আজ বয়সে। প্রবীন হয়ে গেছি আমরা জানি জীবনের মাত্র অবশিষ্ট কয়েকটি দিন আমাদের বাকী আছে। তােমাদের | ভবিষ্যতের জন্যেই আজকে জীবনের সুখ-সম্পদ ছেড়ে আমরা গৃহহারা, সর্বহারা হয়ে আজকে পথেপ্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
| ঐতিহাসিক দায়িত্ব
| ভাই, বন্ধুরা সংগ্রামী ছাত্ররা, যুবকেরা, আজকে তােমাদের মধ্যে আর আমাদের মধ্যে কোন | তফাৎ নেই। আমি তােমাদের কাছে আকুল আবেদন জানাবাে, ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে আজকে
যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তােমরা মাথায় তুলে নিয়েছ সে দায়িত্বকে পালন করার জন্য তােমরা দীপ্ত | গতিতে এগিয়ে যাও। ইনশআল্লাহ তােমাদের প্রতি আল্লাহ সহায় আছে। জয়লাভ তােমরা করতে পারবে।
বাংলার মা-বােন | সর্বশেষ আমি বাংলার মা-বােনদের উদ্দেশ্যে দু’টি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের মা-বােনেরা, | বহু অশ্র আপনাদের চোখ গড়িয়ে পড়ছে আমি জানি। আমি জানি আপনার বােনরা যখন বেইজ্জতি
হয়েছে আপনার সামনে কি মর্মদ মর্মবেদনায় আপনার বুক জ্বালা করেছে। কি অসহনীয় অপমানে | আপনি ঘরের ভেতর এবং বাইরে ঘুরেছেন। আপনার সন্তানদেরকে আপনি রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন, | আপনাদের বুক আপনারা খালি করেছেন। কিন্তু মা-বােনেরা, বীর সন্তানের মা হওয়ার যে সৌভাগ্য সে সৌভাগ্যের অধিকারী আপনারা হয়েছেন। আপনার যে সন্তান আজকে বাংলার পথে-প্রান্তরে লড়াই। করে চলেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আজ যারা বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। মা-বােনেরা মনে রাখবেন এরা সারা বাঙ্গালী জাতির সন্তান। আমি আপনাদের কাছে সবিনয়ে আবেদন করবাে, আপনারা এদের জন্য গর্ব অনুভব করুন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
অন্ধকার রজনী অবসান প্রায়।
| বাংলাদেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষেরা আপনাদের দুঃখ, আপনাদের কষ্ট, আপনাদের আজকের ত্যাগ ও তিতীক্ষা শুধু শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেই ভুল করা হবে। আমরা আপনাদের এখন। পর্যন্ত কোন স্বস্তি, কোন শাস্তি দিতে পারিনি। সে অপরাধ যদি আমাদের হয়ে থাকে, সে অপরাধে | আমরা অপরাধী। সে বিচার আপনারা করবেন। কিন্তু বাংলার মানুষেরা আপনাদেরকে আমি আমার সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দিতে পারি আপনাদের চোখে-মুখে হাসি ফুটাবার জন্য, আপনাদের।
সন্তানদের ভবিষ্যৎকে সুখী করার জন্যে আমরাও সারা বাঙ্গালী জাতির সঙ্গে কাধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে চলেছি।
বাংলাদেশের ভাই-বােনেরা, ন্যায়ের সগ্রাম কোনদিন ব্যর্থ হয় নাই। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনদিন ব্যর্থ হবে না । আঁধার রজনীর বিভীষিকা আমরা পার হয়ে এসেছি। বন্ধুরা আমার যে বিভীষিকাময় রাত্রির ওপারে আজকে নতুন সূর্য উদয় হচ্ছে, সে নতুন সূর্যালােকে যেদিন সারা বাংলার প্রান্তর উদ্ভাষিত হবে সেদিন আমি বিশ্বাস করি সেদিন বাঙ্গালী জাতি মাথা তুলে দাঁড়াবে। আর পৃথিবীর যেখানে যারা আজো বাঙ্গালী জাতির বৃহত্তর ত্যাগ সম্পর্কে কোন সন্দেহ পােষণ করেন। সেদিন তাদের মােহমুক্তি ঘটবেই ঘটবে।
সমস্ত দেশবাসীর জন্য আমি আমার তরফ থেকে, সরকারের তরফ থেকে আবার জানাই ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর সালাম। ইনশআল্লাহ জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।
জয়বাংলা (১) ১: ২২, ২৩, ২৪ | ৮, ১৫, ২২ অক্টোবর ১৯৭১
পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য বাংলার মানুষ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ
মনসুর আলি [ নিজস্ব রিপাের্ট।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব এম, মনসুর আলী আমাদের প্রতিনিধির সংগে এক সাক্ষাঙ্কারে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে বাংলার মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে মীমাংসাই মেনে নেবে না। তারা মাতৃভূমি থেকে প্রতিটি শত্রুসেনাকে খতম করেই দেশকে মুক্ত করবে। পৃথিবীর কোনাে শক্তিই বাঙালীকে তার স্বাধীনতার দাবী থেকে নড়াতে পারবে না। তিনি তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলেন যে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ও জনতা স্বাধীনতার প্রশ্নে এখন আগের চাইতে অনেক বেশী মনােবল সম্পন্ন সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
দাবানল ॥ ১: ৩ ॥ ১০ অক্টোবর ১৯৭১
| বঙ্গবন্ধু নৌবহর গঠন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জন ও শেখ নাসিরুদ্দিনের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন
গত ৭ই অক্টোবর শেখ সাহেবের কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসিরুদ্দিন এবং বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জমান খুলনা, ফরিদপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালি অঞ্চলের মুক্তি বাহিনীর প্রধান কার্যালয়গুলি পরিদর্শন করেন। ঐ অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী সেনানীদের সঙ্গে তাঁরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলােচনা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া কয়েকটি জলযানের দ্বারা বঙ্গবন্ধু নৌবহর—১” গঠন করা হবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ : ৮ ! ১০ অক্টোবর ১৯৭১
ক বঙ্গবন্ধুর ভ্রাতার মুক্তাঞ্চল পরিদর্শন
বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রিয় শেখ নাসিরুদ্দিন বঙ্গবন্ধু নৌবহর ১’ এর একখানা জলযানে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল ও রনাঙ্গণ পরিদর্শন করে ৯ তারিখ রণাঙ্গনের প্রধান কার্যালয়ে
ফিরে আসেন। এবং অসম সাহসী মুক্তিযােদ্ধাদের বিপুল সাফল্যের বিবরণ পেশ করেন। শেখ। নাসিরুদ্দিন আশা প্রকাশ করেন যে, অনতিবিলম্বে মুক্তিবাহিনী বিমান ও নৌবহরের আক্রমণ পরিচালনা। করতে সমর্থ হবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১: ৮ ! ১০ অক্টোবর ১৯৭১
বাঙলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপস নেই
—খােন্দকার মােশতাক। (কলকাতা প্রতিনিধি).
কলকাতা, ৪ অক্টোবর—কোনও স্বাধীন দেশ নিজেদের স্বাধীনতার বিনিময়ে কারও সাথে আপস করতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নেও একই কথা প্রযােজ্য।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খােন্দকার মােস্তাক আহমদ আজ কলকাতায় উপরউক্ত মন্তব্য করেন। তিনি মুজিবনগর থেকে কলকাতা পৌছে আজ বিকেলে সারকাস এভিনিউয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন। কর্মচারীদের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ২৫শে মার্চ রাত্রের ঐতিহাসিক ঘােষণার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম। হয়েছে দুনিয়ার এমন কোন শক্তি নেই তাকে ধ্বংস করতে পারে। | তিনি জোর দিয়ে বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ এক আত্মা এক প্রাণ হয়ে যেভাবে যুদ্ধ করে চলেছে তাতে সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন ইয়াহিয়ার জল্লাদ সেনারা বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে পথ পাবে না।
| বাংলাদেশের সরকারী কর্মচারীদেরকে স্বাধীনতা যুদ্ধে আরও ত্যাগ স্বীকারের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি ঘােষণা করেন, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তিনি নিজেই দু’এক দিনের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে যাচ্ছেন।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১ : ৩ [ ১০ অক্টোবর ১৯৭১
| বৃহৎ শক্তিবর্গের রক্তমাখা হাতে উদ্যত ছােরা। বাঙলাদেশ প্রশ্নে চাপ সৃষ্টির আন্তর্জাতিক পাঁয়তারা, বাঙলাদেশ সরকারের মনােভাব অটল
ফেরদৌস আহমদ কোরেশী
লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণে মূল্যে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসের অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত হিসাবে প্রতিভাত, মুক্তিপাগল বাংলা বাহিনীর নিভর্তি যােদ্ধাদের নিরন্তর আঘাতে যখন হানাদার পাঞ্জাবী দস্যুবাহিনী হতাশার সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত, ঠিক তখনই বিশ্ব-কায়েমী স্বার্থের ধারক, নয়া সাম্রাজ্যবাদী চেতনার নির্লজ্জ অভিভাবক, বৃহৎ শক্তিবর্গ আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক প্রভুদের নিকট প্রকারান্তরে নতি স্বীকারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির নতুনতর পাঁয়তারা শুরু করেছে। গত কয়েকদিন যাবত বাঙলাদেশ সরকারের এই অস্থায়ী রাজধানীতে বৃহৎ শক্তিবর্গের সাম্প্রতিক কার্যকলাপের সর্বশ্রেণীর মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সােচ্চার হয়ে উঠেছে। বিশেষতঃ বাঙলা দেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষকে পুনরায় ইয়াহিয়ার কর্তৃত্বে ফিরিয়ে নেবার প্রশ্নে সােভিয়েট রাশিয়ার সাম্প্রতিক ভূমিকায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মােটেই খুশী হতে পারছে না। বাঙলাদেশ সরকার, বাঙলাদেশের সকল শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, মুক্তিবাহিনীর
অধিনায়কবৃন্দ এবং বাঙলাদেশের আপামর জনসাধারণ ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার সাথে কোনপ্রকার।
আপােষরফার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন মত প্রকাশ করেছেন। | তাদের মতে খুনী দস্যুদের রক্তমাখা হাতের সাথে হাত মেলাবার কোন প্রশ্নই আর উঠতে পারে না। এবং স্বাধীনতা, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধানই বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণীয় হবে না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের ভাষায়, লক্ষ মানুষের মৃতদেহের নিচে যে পাকিস্তান সমাহিত হয়েছে, তাকে নতুন করে বাঁচিয়ে তােলার চেষ্টা নিরর্থক।
| জঙ্গীশাহীর জন্য বৃহৎ শক্তিবর্গের মাথাব্যথার কারণ।
| কিন্তু সেই মরা লাশে প্রাণ সঞ্চারের জন্য পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিবর্গের এত মাথাব্যথা কেন? পাকিস্ত | Iনের ক্ষুদে সাম্রাজ্যবাদীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের এত উদ্যোগ আয়ােজনই বা কেন?
বাঙলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের, তথা, পাকিস্তানেরই জনসমষ্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সার্বভৌম ইচ্ছাকে পদদলিত করে সামরিক বাহিনী পেন্টোগনের তাবেদারীর খাতায় নাম লিখিয়েছে অনেক আগেই। সেই তাবেদারীর এনাম হিসাবে আজ তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষার জন্য উদগ্রীব। পাকিস্তানে লগ্নীকৃত কিংবা ঋণ হিসাবে প্রদত্ত (প্রকৃতপক্ষে সেটাও লগ্নী ছাড়া আর । কিছুই নয়) মার্কিন পুজির ভবিষ্যত ভেবেও সম্ভবতঃ মার্কিন সরকার উদ্বিগ্ন। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীও। মার্কিন কূটনীতির জন্য খুব সুখকর নয়। কারণ ভারত-সােভিয়েট নৈকট্যের ফলে প্রকারান্তরে স্বাধীন। বাংলাদেশেরও সােভিয়েট শক্তিবলয়ে অবস্থানের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমতাবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অনুকুলে কোনকালেই মনস্থির করতে পারবে কি-না সন্দেহ। | তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালানাে হচ্ছে। এমনকি সিনেটর কেনেডির মত বিরােধী দলীয় নেতৃবৃন্দ এবং নিক্সন সরকারের ঘােরতর সমালােচকরাও ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির কথা বেশী কিছু চিন্তা করছেন। বলে মনে হয় না। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের সহায়তার জন্য এবং তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রুটিন মাফিক কিছু কাজ করা হলেও মার্কিন সরকার যে মূলতঃ বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার কর্তৃত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্যই সর্বতােভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশ্বব্যাঙ্ক কনসর্টিয়ামে পাকিস্তানকে ঋণদান স্থগিত রাখার কথা বলে বাহ্যত। পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির ভাব দেখানাে হলেও অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারকে ১০০ মিলিয়ন। ডলার বিশেষ সাহায্য দেবার প্রস্তাবও গত ৩রা আগস্ট মার্কিন প্রতিনিধি সভায় অনুমােদিত হয়েছে । এছাড়াও প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে পাক সামরিক বাহিনীর পশ্চাতে মার্কিন ডলারের যােগান যে এতটুকুও বন্ধ হয়নি, তাও সহজেই অনুমেয়।
গণচীনের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা
| চীন মূলত : তার ভারত বিদ্বেষের কারণেই পাকিস্তানের বন্ধু এবং সে কারণেই বাঙলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধী। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সর্বপ্রকার সহায়তার আশ্বাস চীন প্রথম থেকেই দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাংক ও মেসিনগান গুলির অধিকাংশই চীনের দেওয়া ‘বহিঃশত্রুর আক্রমণ মােকাবিলার জন্য দেওয়া এই সব অস্ত্র নির্বিকার গণহত্যার কাছে। ব্যবহৃত হচ্ছে। চীন সরকারের জ্ঞাতসারেহ এটা ঘটছে, এতে কোন সন্দেহের কারণ নেই। তাছাড়াও পাকিস্তানের অর্থনেতিক বিপর্যয় রােধের জন্য আর্থিক সাহায্যের ডালি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীনও।
দাঁড়াতে পিছপা হয়নি। বলা যায়, সাম্প্রতিক চীন মার্কিন কূটনৈতিক অভিসারের প্রথম পর্ব ঘটেছে পিংপং এর টেবিলে আর দ্বিতীয় পর্ব বাংলাদেশের রণাঙ্গনে, ইয়াহিয়ার সৈন্য শিবিরে।
বাঙলাদেশ প্রশ্নে সােভিয়েত মনােভাব। | অতঃপর সােভিয়েট রাশিয়া। সােভিয়েট নেতৃবৃন্দ বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে তুলনামূলকভাবে কিছুটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেবেন বলে আশা করা গিয়েছিল। ভারতের সাথে সােভিয়েট ইউনিয়নের হৃদ্যতার জন্য এই আশাবাদ আরাে দৃঢ় হয়েছিল। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে বাঙলাদেশ প্রশ্নে সােভিয়েট ভূমিকা ততই নেতিবাচক হয়ে পড়ছে এবং অপর দুই বৃহৎ শক্তি, যেটা সরাসরি ও স্পষ্টভাষায় বলছে সােভিয়েট বক্তব্যের মর্ম কথাও তার সাথে অভিন্ন হয়ে উঠছে। বিশেষতঃ ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তির পর। এক্ষণে সােভিয়েট কূটনীতি যেন নতুন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ভারতেরও সেই একই নৌকায় আরােহণ ছাড়া গত্যন্তর নেই বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
তবে কি আর এক তাসখন্দ | সােভিয়েত নেতৃত্ব কি আরেকটি তাসখন্দের পথ তৈরী করছেন? এবং তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে? জাতি সংঘের চলতি অধিবেশনে এবং সাম্প্রতিক রুশ ভারত যুক্ত বিবৃতিতে রুশ সরকারের যে ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা গেছে, তাতে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন বা সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেনি বরঞ্চ বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে ইয়াহিয়ার একক কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিয়ে কার্যতঃ বাঙালীদের মুক্তি সংগ্রামকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। | প্যারিসে অনুষ্টিত আন্তঃপার্লামেন্টারী ইউনিয়ন সম্মেলন রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানকে অত্যন্ত মৃদুভাষায় নিন্দা জানা বার প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছে । মধ্য প্রাচ্যের পাকিস্তান সমর্থক দেশগুলির মন রক্ষার জন্যই না-কি এরকম করা হয়েছে। তবে কি রাশিয়ার কাছে ভারত ও বাংলাদেশের চাইতে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব বেশী? | সব কিছু মিলিয়ে এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে একথাই শুধু বলা যায় যে, বৃহৎ শান্তিবর্গ বাঙলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের তথাকথিত ‘সার্বভৌমত্ব’ ক্ষুন্ন করতে নারাজ এবং ভারত সরকার যতই ক্ষুব্ধ হন না কেন, অন্যান্যদের মত রুশ নেতৃবৃন্দও এ ব্যাপারে ভারতকে পাকিস্তানের সমপর্যায়ে রেখেই কথাবার্তা বলছেন। অর্থাৎ রাশিয়াও ব্রিটিশ সরকারের মত বাঙলাদেশ সমস্যাকে ভারতপাকিস্তান সমস্যা হিসেবে বিবেচনার নীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মিঃ ডহালয়ান রজার্স এবং রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ আঁন্দ্রে গ্রোমিকোর বাৎসরিক যুক্তবিবৃতি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এতে নেতৃদ্বয় উপমহাদেশের শান্তির জন্য ‘ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকে সংযত করার সংকল্প ঘােষণা করেছেন।
রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাখ্যা কী
কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানটা আসলে যে কী, তা কেউ স্পষ্ট করে বলছেন না। সমসাময়িক কূটনেতিক শব্দসম্ভারের মধ্যে এই বহুবােধক শব্দটি একটি অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার। প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রয়ােজন ও দৃষ্টিভঙ্গীর মাপকাঠিতে এর অর্থ করে নিচ্ছেন, যার ফলে এই একই শব্দে স্বাধীনতা থেকে শুরু করে ইয়াহিয়া সরকারের বশ্যতা পর্যন্ত সব কিছুকেই বােঝানাে সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু এভাবে মনকে চোখ ঠেরে কত দিন প্রকৃত সমস্যা চাপা দিয়ে রাখা যাবে? বাংলাদেশ
সরকার বলেছেন, রাজনৈতিক সমাধানের একমাত্র অর্থই হতে পারে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা। ভারত সরকারের কোন কোন দায়িত্বশীল কর্মকর্তাও এ ধরনের মন্তব্য করেছেন। | কিন্তু একই সাথে ভারত সরকার একথাও ঘােষণা করেছেন যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে রাশিয়ার সাথে | তারা একমত। এখন রাজনৈতিক সমাধানের রুশ ব্যাখ্যা যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাটামােতেই | বাঙালীদের প্রত্যাবর্তন তাতে সন্দেহ নেই। তাহলে ভারত সরকারের অফিসিয়াল ষ্টাণ্ড কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? কেবল বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ হিসাবেই নয়, নিজস্ব গ্লোবাল স্ট্রাটেজীর স্বার্থেও এই সমীকরণে একমত হওয়া ভারতের পক্ষে পিচ্ছিল পর্বতগাত্রে পা রাখার শামিল বলেই এখানকার রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
বাংলাদেশ (১) 4 ১: ১৬ | ১১ অক্টোবর ১৯৭১
আয়
আর্জেন্টিনার পাক-রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার
‘বুয়েনােস আয়ার্স, ১২ই অক্টোবর : আর্জেন্টিনাস্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মিঃ আবদুল মােমিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করার উদ্দেশ্যে তার পদে ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি লণ্ডন যাত্রা করেছেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও তিনটি শিশু সন্তান রয়েছে। | এখানকার ফরেন প্রেস এ্যাসােসিয়েশনে তিনি যাবার আগে এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে প্রকৃতপক্ষে গেরিলা হবার বাসনাই তার রয়েছে। তবে এখন তিনি এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যে প্রচারে অবতীর্ণ হচ্ছেন। পুৰ্ব্ববঙ্গে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শােষণ ও আড়াই লাখ মানুষ খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে বেড়ালে আন্দোলনের পক্ষে এখন অধিকতর সহায়ক হবে তিনি মনে করেন। | তিনি আরও বলেন যে, সন্ত্রাসের রাজত্বকে ঠাণ্ডা করতে ফৌজ পাঠাতে বাধ্য হয়েছে বলে পশ্চিম
পাকিস্তান যে মিথ্যা প্রবাদ চালাচ্ছে তা শুনে যাওয়া আর সম্ভব নয়। আসল ঘটনা হচ্ছে পাকিস্তানের | ফৌজের শতকরা ১০০ জনই পশ্চিম পাকিস্তানী। পূর্ববঙ্গের জঘন্য হত্যালীলা ঢাকতে এখন তারা সব | রকমের মিথ্যা চালাচ্ছে।
| পূর্ববঙ্গের বিচ্ছিন্নতাকে সফল করে তুলতে ভারত সৈন্য ও অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে যে | অভিযােগ, তাকে তিনি মিথ্যা বিবরণ বলে অভিহিত করেন।
তিনি লণ্ডন থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘে যাবার বাসনা পােষণ করেন। বাংলা দেশের পক্ষে তিনি সেখানে। প্রচার চালাবেন। | মিঃ মােমিন ১৯৭০ সালের মে মাসে রাষ্ট্রদূতের কর্মভার গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাঙালী।
| বাংলাদেশ (১) ! ১: ১৬ # ১১ অক্টোবর ১৯৭১
বেহায়া নতুন কিছু বলেনি।
—হুমায়ুন রসিদ চৌধুরী
| নয়াদিল্লী, ১২ই অক্টোবর—দিল্লিস্থ পাক হাইকমিশনের ভূতপূর্ব উপদেষ্টা হুমায়ুন রসিদ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, “বেহায়া নতুন কিছু বলেন নি । গণহত্যার জন্য যে ব্যক্তি দায়ী তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য সত্যই ইচ্ছুক—এই কথাটা | বিশ্বাবাসীকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন। তিনি তার নির্লজ্জ ভাষণে একবারও বলেন নি যে, তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করার কথা উল্লেখ করেনি। বিশ্ববাসী দেখতে পারে যে, “বেহায়া খান বাংলাদেশের ব্যাপারকে ভারত-পাক সমস্যা বলে উল্লেখ করে ভারতের জনগণকে এই ব্যাপারে জড়িয়ে এবং তাদের। নিন্দা করে বাংলাদেশে তিনি যে অপকর্ম করেছেন তা ঢাকবার চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ (১) [১: ১৬ | ১১ অক্টোবর ১৯৭১
স্বাধীন বাংলা গ্রাম পঞ্চায়েৎ
| ১১ই অক্টোবর—খবরে প্রকাশ, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রথা চালু করিতে চলিয়াছেন। এই সম্পর্কিত প্রস্তাবে রহিয়াছে গ্রামের সকল কাজে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্বাধীনতাকামী গ্রাম পঞ্চায়েৎ গড়িয়া তুলিতে হইবে। গ্রামবাসিদের সাধারণ বৈঠকে শ্রদ্ধাবান সমাজ সেবক নেতাদের গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যরূপে মনােনীত করা হইবে। গ্রামের লােকসংখ্যা অনুযায়ী ইহার সদস্য সংখ্যা হইবেন তিন হইতে সাত। পঞ্চায়েতের নেতা হইবেন মুক্তিকামীদেরই একজন। প্রতি দুই মাসে একবার ইহার বৈঠক বসিবে। বৈঠকে সদস্যদের কাজের সমালােচনা করা। হইবে।
বাংলাদেশ (১) ১ : ১৬ ! ১১ অক্টোবর ১৯৭১
পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোন রাজনৈতিক সমাধানই গ্রহণযােগ্য নয়।
নজরুল ইসলাম
মুজিবনগর ১১ই অক্টোবর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আবার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করেন, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণের কাছে কোন রাজনৈতিক সমাধানই গ্রহণযােগ্য নয়। | গত শনিবার মুক্তাঞ্চলের কোন এক স্থানে মুক্তিবাহিনীর অফিসার ক্যাডেটদের প্রথম দলের শিক্ষা সমাপনি কুচকাওয়াজে ভাষণ দানকালে এই কথা বলেন বলে এখানে আজ খবর পাওয়া গেছে।
এর আগে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও তথ্য ও প্রচার দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত আঃ মান্নানকে নিয়ে কুচকাওয়াজ ময়দানে পৌছিলে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম এ জি ওসমানী তাদের স্বাগত জানান।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এর পর অভিনন্দন গ্রহণ ও কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন।
সমস্ত আপােষমূলক ফর্মুলা বাতিল করে জনাব ইসলাম বলেন যে সংগ্রাম আজ আমরা শুরু করেছি তাতে শেষ বর্বর দখলদারী বাহিনীর শেষ লােকটিকেও বাংলাদেশ ছাড়া না করা পর্যন্ত তা আসতে পারে না। | তিনি বলেন কেউ কোনদিন জাতীয় স্বাধীনতা দেয় না, বিরামহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করে নিতে হয়।
তার দেশের মানুষদের শত্রুর বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম যােগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জনাব ইসলাম বলেন, কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই আজ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়নি এবং আমরাও আমাদের এই সংগ্রামকে বিফল করতে দেবাে না।
| আমাদের সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম জনগণ তাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের শেষ শত্ৰুটিকেও এদেশ থেকে হটিয়ে দেবে।
অফিসার ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে জনাব ইসলাম বলেন, আপনারা নির্ভয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যান। ৭। কোটি লােক আপনাদের পেছনে আছে। জনগণই অতীতে সমস্ত ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। সেই রকম এই শক্তির বিরুদ্ধে আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম নিয়েছি। | ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনীর প্রতি অবিমিশ্র শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন ঢাকা ও অন্যত্র শত্রুবাহিনীর হঠাৎ ও সংগঠিত আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তারা। সংগ্রামকে জোরদার করেছেন।
বাংলাদেশ (১) # ১:১৬ | ১১ অক্টোবর ১৯৭১
মুক্তি বাহিনীর সম্প্রসারণে বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর, ১১ই অক্টোবর : খবরে প্রকাশ বাংলাদেশ সরকার মুক্তি বাহিনীর সম্প্রসারণে এক। বিরাট কর্মসূচী গ্রহণ করিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রিক্রুটমেন্ট চলিতেছে। সর্বোপরি মুক্তি বাহিনীকে সর্বাধুনিক অস্ত্রের সাহিত পরিচিত করারও ব্যবস্থা করা হইয়াছে।
বাংলাদেশ (১) ॥ ১ : ১৬ # ১১ অক্টোবর ১৯৭১
১০ লক্ষ শিশুদের বাচিয়ে তুলুন।
বাংলাদেশের সাহায্য, পুনর্বাসন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এম, এইচ, এম কামারুজ্জামানের সাথে এক। সাক্ষাঙ্কার আমাদের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধির মাধ্যমে তিনি বিশ্বের মানব দরদী এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ ও রাষ্ট্রের কাছে বর্তমানে শীতের হাত থেকে ভারতে আশ্রয় প্রার্থী ১০ লক্ষ শিশুদের বাঁচিয়ে তােলার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি আবেদনে বলেছেন ভারতে আশ্রয়প্রার্থী ৯৪ লক্ষ মানুষের মাঝে ১০ লক্ষ শিশুদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ শিশু গরম কাপড় ও প্রয়ােজনীয় ঔষধপত্র এবং উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে মারা যেতে পারে। তাদের সাহায্যে বিশ্ব রাষ্ট্রগুলি এবং বিভিন্ন রিলিফ সংস্থাকে অবিলম্বে এগিয়ে আসার জন্য | মন্ত্রীমহােদয় অনুরােধ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত এবং বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বাংলাদেশকে বিদেশী পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকের হাত থেকে যে কোন উপায়েই স্বাধীন করবে বলে আমি মনে করি।
জন্মভূমি ১: ১০ X ১১ অক্টোবর ১৯৭১
স্বাধীনতা ছাড়া কোন পথই নেই।
খন্দকার মােস্তাক আহমদ
মুজিবনগর, ১০ই অক্টোবর বাংলাদেশের সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব খন্দকার মােস্তাক | আহম্মদের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমাদের প্রতিনিধিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, স্বাধীনতা ছাড়া এখন আর বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্য কোন পথই নেই। সততা, দৃঢ়তা এবং ভ্রাতৃত্ব সম্বল করে আমরা এগিয়ে চলেছি। আর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সাড়ে সাত । কোটি বাঙালীর পূণ্য ভূমিতে বাঙলার দুঃখী জনগণ যেভাবে এহিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজীরবিহীন।
জন্মভূমি ॥ ১: ১০ ১১ অক্টোবর ১৯৭১
শেষ রক্তবিন্দু দিব
কামারুজ্জামান।
| গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ, এম, কামরুজ্জামান আমাদের প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পৃথিবীতে কোন মুক্তি যুদ্ধ ব্যর্থ হয়নি। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম ব্যর্থ হবে না। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য প্রয়ােজন হলে আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিতেও প্রস্তুত রয়েছি।
জনাব কামরুজ্জামান বলেন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য হানাদার বাহিনী। মনােবল হারিয়েছেন।
জন্মভূমি # ১: ১০ ১১ অক্টোবর ১৯৭১
মৃত পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে নয় স্বাধীন বাংলাই একমাত্র সমাধান
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যেও বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের সূত্র মিলিতে পারে বলিয়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী শরণ সিং যে মন্তব্য করিয়াছেন উহা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যুগপৎ বিস্ময় ও ক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে।
| তাহাদের মতে শ্রী শরণ সিং-এর এই বক্তব্য ভারত সরকারের পূর্ববর্তী বক্তব্যের সঙ্গে সংগতি বিহীন। এই প্রসঙ্গে তাহারা ভারতের মহান নেত্রী প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কিছুদিন আগেকার একটি মন্তব্যের কথা উল্লেখ করেন। গত মাসে কলিকাতায় শ্রীমতি গান্ধী সাংবাদিকদের কাছে বলিয়াছিলেন, “আমাকে বার বার স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়। আমি ভারতে বাংলাদেশ মিশনকে কাজ করিতে দিতেছি। ইহা কি এক অর্থে স্বীকৃতি দেওয়া নয়? শ্রীমতি গান্ধীর এই বক্তব্যে এই কথাই সন্দেহাতীত ভাবে স্পষ্ট করিয়া তুলিয়াছিল যে ভারত সরকার পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না বরং তারা স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করিলেও স্বাধীন বাংলাদেশই বিশ্বাস করেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম বলিয়াছেন, স্বাধীন। বাংলাদেশই একমাত্র সমাধান। কিন্তু শ্ৰী শরণ সিং-এর মন্তবকে কোন মতেই শ্রীমতি গান্ধী ও শ্রী জগজীবন রামের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলিয়া মনে করা যায় না। তাই ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মন্তব্য বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিস্ময়ও ক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে। এব্যাপারে বাংলার জনগণের বক্তব্য সুস্পষ্ট। ভারত মুক্তিযুদ্ধে নিয়ােজিত বাঙ্গালী জাতির জন্য যা করিয়াছে, তার কোন তুলনা নাই, এবং একজন বাংলার মানুষ চির দিন ভারতের জনগণের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ হইয়া থাকিবে। কিন্তু একমাত্র সত্য যে ভারতের কোন মহল যদি মনে করিয়া থাকেন যে পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভবপর, তবে মস্ত বড় ভুল হইবে। দশ লক্ষ বাঙ্গালীর লাশের উপর দিয়া হাটিয়া হাটিয়া আবার পাকিস্তানের কাঠামাে নামক উপনিবেশবাদী শাসনের নারকীয় গর্তের মধ্যে প্রবেশের কোন প্রশ্নই ওঠে না। বাংলার মানুষ চায় মাতৃভূমির পূর্ণ স্বাধীনতা। | এদিকে শ্ৰীশরণ সিং এর মন্তব্য প্রসঙ্গে সরাসরি কোন বক্তব্য পেশে বিরত থাকিলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হইতে অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে। জঙ্গীশাহীর সঙ্গে যে কোন প্রকার আপােষের সম্ভাবনার উপর চূড়ান্ত যবনিকা টানিয়া দিয়া পুনরায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি, এবং বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার স্বকৃিতিসহ চারি দফা পূর্ব শত পূরণের আগে কোন আপােষের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা স্বাধীনতার জন্য জীবন পণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছি। পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হইবার আগে আমরা ক্ষান্ত হইব না।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পূনর্বাসন মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জমান ঘােষণা করিয়াছেন পাকিস্তান আজ মৃত।
| যাহারা পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা করিতেছেন তাহারা প্রকারান্তরে উপনিবেশবাদ এবং শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাগ্রত জনগণের স্বার্থকেই ক্ষুন্ন করিতেছেন। এই অঞ্চলে যদি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত করিতে হয় তবে অবশ্যই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করিয়া লইতে হইবে।
আমরা মনে করি স্বাধীনতার কোন বিকল্প ব্যবস্থা থাকিতে পারে না এবং যে কোন মূল্যেই তাহা আমরা অর্জন করিব।
বাংলার বাণী | ৭ সংখ্যা | ১২ অক্টোবর ১৯৭১
পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহম্মদের রৌমারী আগমন
[নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
রৌমারী ॥ ৯ই অক্টোবর
স্বাধীন বাংলা সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহম্মদ ৯ই অক্টোবর বেলা ১২ ঘটিকার সময় রৌমারী আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে পররাষ্ট্র বিষয়ক সেক্রেটারী জনাৰ মহবুবুল আলম, জনাব আবু তাহের ঠাকুর এম, এন, এ ও আরও অনেক জনপ্রতিনিধি এবং পদস্থ সরকারী কর্মচারী রৌমারী আসেন। মন্ত্রীমহােদয়ের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বিপুল জনতার এক বিরাট মিছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হস্তে নানা প্রকার জয়ধ্বনির মধ্য দিয়ে তাঁকে রৌমারী স্বাগতম জানায়। তিনি রৌমারী পৌছে এখানকার আওয়ামীলীগ কার্যালয়, মুক্তি ফৌজ ট্রেনিং ক্যাম্প, ইউথক্যাম্প এবং থানা পরিদর্শন করেন এবং প্রত্যেকখানে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিবাদন গ্রহণ করেন। মুক্তি ফৌজের জোয়ানদের উদ্দেশ্যে এক চমকপ্রদ ও চিত্তাকর্ষক ভাষণ দেন। তারপর থানার অন্যান্য সরকারী কাৰ্যালয় ও স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল পরিদর্শন করেন এবং বিকালে থানা উন্নয়ন পরিকল্পনা কেন্দ্র প্রাঙ্গনে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় এস, এন, এ জনাব সাদাকাত হােসেন। উক্ত সভায় স্থানীয় হাই স্কুলের হেড মাস্টার জনাব আজিজুল হক, প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ কর্মী আমিনুদৌলা ও জনাব মােতাহার হােসেন এম, এন, এ পর পর ভাষণ দান করেন। জনাব সাদাকাত হােসেন এম, এন, এ তার সভাপতির ভাষণে স্থানীয় সমস্যাবলী ও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে রৌমারী জনসাধারণের বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন।
অগ্রদূত ! ১; ৭ ৪ ১৩ অক্টোবর ১৯৭১
পররাষ্ট্র মন্ত্রীর ভাষণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
গত ৯ই অক্টোবর রৌমারীতে এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দানকালে স্বাধীন বাংলা সরকারের পররাষ্টমন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহম্মদ বলেন- আজ আমরা স্বাধীন বাংলার শত্রুমুক্ত অর্থও রৌমারীতে আগমন করে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এই বিরাট মুক্ত অঞ্চলের জনগণের কোন বিশেষ পুন্যের ফলে ও আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর অসীম সাহসী প্রতিরােধের জন্য বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনীর রক্ত থাবা থেকে আপনারা নিরাপদ। তারপর তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে অত্যন্ত আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে অধিকৃত অঞ্চলের নিরিহ সাধারণ মানুষের উপর পান্জাবী দস্যু বাহিনীর নজীরবিহীন বর্বর হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও দহন লীলার মর্মান্তিক বর্ণনা দেন। তিনি বলেন আমাদের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য ও দায়ীত্ব শক্রকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের নিপীড়ন থেকে আমাদের ভাই বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনদের উদ্ধার করা আপনাদের সরকার যে বিষয় সদা জাগ্রত প্রচেষ্টায় রত। আমাদের মুক্তি সংগ্রামে বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন যে- ইনশাল্লাহ সারা বিশ্বমত আজ-আমাদের এই ন্যায়ের সংগ্রামের পক্ষে। সারা বিশ্ব আজ ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতিবাদে মুখর আমরা যদিও এখনও কোন দেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি গ্রহণ করতে পারিনি তবুও সারা বিশ্বের একশত চারটি দেশে আমাদের মিশন স্থাপিত হয়েছে। এবং সেগুলি রীতিমত কাজ করে চলেছে। এগুলি আন্তর্জাতিক বিধিসম্মত স্বীকৃতির এক একটি সুউচ্চ সােপান। | স্থানীয় সমস্যাবলীর উল্লেখ করে তিনি বলেন- যদিও আমরা যুদ্ধে লিপ্ত এবং আমাদের সম্পদ অতি সিমিত তবুও স্থানীয় সমস্যাবলীর সমাধানে আমরা সব সময়ই জনগণের পার্শ্বে থাকবাে।
মুক্তি বাহিনীর জোয়ানদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন যে আমরা জানি তােমাদের কি কি। অসুবিধা কিন্তু নিতান্ত সীমিত সম্পদে আমরা তােমাদের সব অভাব মােচন করতে পারিতেছি না।
কিন্তু শত অসুবিধা ও বাধা সত্বেও তােমরা যে তােমাদের সঠিক ভূমিকা পালন করে চলেছ সেজন্য সারা জাতি আজ-গর্বিত ও আশাবাদী এবং সমস্ত দুনিয়ার জনগণ প্রসংশায় উচ্ছ্বসিত। তােমাদের এ ত্যাগ ও তিতিক্ষা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। ( পরিশেষে তিনি বলেন আমরা অন্যের দেশ জোর করে দখল করতে যাইনি, আমরা পরের সম্পদ লুণ্ঠন করিনি আমরা অন্যের মেয়েকে ধর্ষণ করতে চাইনি আমরা সগ্রাম করছি বাচার সংগ্রাম, আত্মরক্ষার সংগ্রাম। তাই তােমাদের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম এবং এ সংগ্রামের জয় সুনিশ্চিত ও অতি নিকটবর্তী।
অগ্রদূত ॥ ১: ৭ ॥ ১৩ অক্টোবর ১৯৭১
অধিকৃত অঞ্চলের অর্থমন্ত্রী আবুল কাসেমের রুদ্ধদ্বার কক্ষে মিটিং
কুড়িগ্রাম : ৯ই অক্টোবর
আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ বাংলার অধিকৃত অঞ্চলের পশ্চিমা দালাল মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য ৫৬ হাজার পরাজিত ইয়াহিয়ার গণ প্রতিনিধি আবুল কাসেম গত ৯ই অক্টোবর কুড়িগ্রাম কলেজ হলে এক রুদ্ধদ্বার জনসভায় মিলিত হন। তার সভায় সাধারণ লােকের চেয়ে তার দেহরক্ষীরাই সংখ্যাগুরু ছিল।
| সংবাদে আরও প্রকাশ মন্ত্রী সাহেব আগামী ২১শে অক্টোবরের মধ্যে কুড়িগ্রামের সমস্ত মুক্ত অঞ্চলগুলি দখল করার জন সেনা বাহিনীকে আদেশ দিলে পাক মেজর তাদের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করায় পশ্চিমা দালালদের মনােবল একদম ভেঙ্গে পরে এবং তারা তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ভেবে খুব সংকিত হয়ে উঠে। সত্যি কথা বলতে কি উলিপুর থানার নছির উদ্দিন পীর (সাতদরগার পীর) ও আরও অন্যান্য দালালরা মুক্তি বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণের কথা সক্রিয়ভাবে চিন্তা করে। দেখেছেন।
অগ্রদূত ॥ ১ : ৭ ॥ ১৩ অক্টোবর ১৯৭১
রৌমারী উন্নয়ন পরিকল্পনা সংসদ গঠন
রৌমারী : ৯ই অক্টোবর
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ রৌমারী থানা ও তদসংলগ্ন অন্যান্য থানার মুক্ত অঞ্চলগুলির উন্নয়ন কল্পে অদ্য রৌমারীতে স্বাধীন বাংলা সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারী সাহেবের উপস্থিতিতে ১৮ জন সদস্য বিশিষ্ট এক উন্নয়ন পরিকল্পনা সংসদ গঠিত হয়। জনাব সাদাকাত হােসেন এম, এন, এ সভাপতি ও জনাব আব্দুস সাহিত চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে।
|
অগ্রদূত ৪ ১ ৭ ॥ ১৩ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ।
৯ই অক্টোবর, শনিবার। অদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কমিশন স্কাউটদের পরিচয় পত্র প্রদান অনুষ্ঠানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। কয়েক শত কমিশন ব্যাংক এর
| নওজোয়ানদের ট্রেনিং সমাপ্তির পর অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং তাহাদিগকে পরিচয়। পত্র প্রদান করে এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দান করেন। | তিনি বলেন, খুনী ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে কোন আপােষ নাই। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কায়েমই আমাদের শেষ কথা। যারা আমাদের দশ লক্ষাধিক দেশবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। এককোটী লােককে গৃহহারা করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। মা-বােনের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে ইজ্জত লুটে নিয়েছে সে হানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশ হতে খতম করে দেওয়াই এখন আমাদের কাজ। বাংলার সাড়ে সাত কোটী মানুষের সহিত হাতে হাত মিলায়ে কাঁধে কাঁধ মিলায়ে আমাদের এই সশস্ত্র সন্ত্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের সংগ্রাম ন্যায় সত্যের ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম। জনগণই আমাদের শক্তির উৎস-তাই তাদের সাহায্য সহানুভূতিই হবে আপনাদের প্রধান হাতিয়ার। তাদের জন্যইতাে আমরা লড়ছি আর আমাদের এই লড়াই শেষ হবে সেই দিন যে দিন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ঢাকায় আপনাদের অভিবাদন গ্রহণ করবেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা পপত্ করে উড়বে। | কমিশনারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা জাতির এক যুগসন্ধিক্ষণে বিদেশী পাক হানাদার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তৈয়ার হচ্ছেন। আপনারা ভাড়াটিয়া সৈন্য নন, আপনারা দেশমাতৃকার স্বাধীকার রক্ষার জন্য সাড়ে সাত কোটী বাঙ্গালীর আবাস ভূমি রক্ষা করার জন্য দখলদার বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছেন। বাংলার মাটি দুর্জয় খাটী। এদেশ কেদার রায়-ঈশা খাঁর দেশ, সূর্যসেন শাহ শরিফুল্লাহর দেশ। এ দেশের সােনা আর স্বর্ণ আঁশের লােভে অনেকেই হানা দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই প্রতিরােধ করেছে বীর বাঙ্গালীরা । ইনশাআল্লাহ্ জয় আমাদের অবধারিত। মনে রাখবেন এক দিকে গেরিলা যুদ্ধ যেমন চলছে তা ঠিকই চলবে। অন্যদিকে নিয়মিত বাহিনীও তাদের পাশে পাশে যুদ্ধ করে যাবে। সে দিন বেশী দূরে নয় সে দিন বিদেশীরাও একযােগে আমাদের এই মুক্তি সংগ্রামের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। আর যদি কেউ সাহায্য না করে তাহলেও আমরা এগিয়ে যাবই। আমাদের বিজয় উল্লাসের দিনে কেউ দূরে থাকবে না। পরের মুখাপেক্ষী হয়ে আমরা লড়ছি।
। আমরা লড়ছি নিজের পায়ে দাড়িয়ে নিজেদের বাঁচার জন্য এ সাড়ে সাত কোটী বাঙ্গালীর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক আকাক্ষায় জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয়বাংলা।
জাগ্রত বাংলা # ১: ৪ ॥ ১৪ অক্টোবর ১৯৭১
ডঃ মজহারুল ইসলামের ব্যক্তিগত মত
সম্প্রতি ভারতের কাজিকোদ নামক স্থানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নব-নিযুক্ত ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে পরিচয় দানকারী’ ডঃ মজহারুল ইসলাম “যুক্ত বাংলা পরিকল্পনা বাংলাদেশের জনগণ অভিনন্দিত করবে, তবে ভারত তা পছন্দ নাও করতে পারে বলে যে মন্তব্য করেছেন প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মুখপাত্র ওটাকে অবান্তর ও ডঃ ইসলামের ব্যক্তিগত মত বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশ সরকারের সাথে ও ধরনের মতামতের কোনও সম্পর্ক নেই বলে মুখপাত্র জানান।
জয়বাংলা (১) [ ১ : ২৩ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
‘সেদিন দূরে নয় যেদিন বঙ্গবন্ধু ঢাকায় মুক্তি বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন
—সৈয়দ নজরুল। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)।
| বর্ষা মৌসুম অবসান প্রায়। বাংলাদেশের প্লাবিত অঞ্চলগুলাে এখন শুকনাে হয়ে উঠছে। মুক্তিবাহিনীও তাই বর্ষা মৌসুমের গেরিলা যুদ্ধ—“হিট ডেস্ট্রয় এ্যাণ্ড রান’, ‘আঘাত কর, ধ্বংস করা এবং নিরাপদ ঘাটিতে ফিরে যাও’ এই নীতি ত্যাগ করে সকল রণাঙ্গনে সর্বাত্মক সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এক বৈদেশিক সংবাদ সূত্রে বলা হয়েছে, ট্রেনিং প্রাপ্ত প্রায় এক লাখ সেনার একটি দক্ষ বাহিনী (৩০ হাজার নিয়মিত সৈন্য সহ) অবিলম্বে সকল রণাঙ্গনে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ঘােষণা
সম্প্রতি মুক্তি বাহিনীর এক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, “সেদিনের আর বেশী দেরী নেই, যেদিন শক্রর জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকায় মুক্তি বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন। মুক্তি বাহিনীর বীর যােদ্ধারা শীঘ্রই হানাদারদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে।’ | অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আরাে জোর দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কোন আপস নয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে উপলব্ধি করতে হবে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর কোনদিন পাকিস্তনীদের সঙ্গে বাস করবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলা তার নিজের শক্তিতেই রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত আছে এবং থাকবে।
প্রধান সেনাপতির বিবরণ | বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ও পার্লামেন্ট সদস্যগণ এখন মুক্তাঞ্চল সফর করছেন। মুক্তাঞ্চলে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় তারা যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যালােচনা করেন। মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কঃ এ, জি, ওসমানী মন্ত্রিসভাকে যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করান।
| জয়বাংলা (১) # ১ : ২৩ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য কোন সমাধান হতে পারে না।
– অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল
স্বাধীনতা আমাদেরকে অর্জন করতেই হবে। বাংলাদেশের মানুষ দখলদার পাক নাজদীদের সমূলে উৎখাত করেই স্বাধীনতা অর্জন করবে।
গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম তরুণ মুক্তি যােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ দুর্বার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা করছিলেন। তিনি আরাে বলেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোন বিকল্প সমাধান হতে পারে না। বিশ্বের কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কখনই ব্যর্থ হয়নি। বাংলার মুক্তি পাগল সংগ্রামীদের দুর্বার সংগ্রামও ব্যর্থ। হবে না। হতে পারে না।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে যেদিন বঙ্গবন্ধু মুক্তি বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন সেদিনই বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হবে। | সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ। তাদেরকে স্বাগত জানান মুক্তি বাহিনীর প্রধান কর্ণেল ওসমানী।
প্রতিনিধি # ১ : ৩ # ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
এবারের রক্ত স্বাধীনতার রক্ত
—সৈয়দ নজরুল ইসলাম
| ১৩ই অক্টোবর, বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডের কোন এক মুক্তাঞ্চলে এক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে নব প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের এক কুচকাওয়াজে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, এবারের রক্ত স্বাধীনতার রক্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবেই, মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেন, মুক্তিযােদ্ধারা বাঙ্গালী জাতির মেরুদণ্ড। এই কুচকাওয়াজে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মদ এবং কর্ণেল ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন।
|
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১ : ৯ [ ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস নাই
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করেন যে, স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপস নাই। তাহারা বলেন যে, আমাদের মাতৃভূমি হইতে প্রতিটি হানাদার বিতাড়িত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম থামিবে। ।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন দেশের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন ব্যর্থ হয় নাই। আমাদের সংগ্রামও ব্যর্থ হইতে পারে না। তাহারা বলেন, বাঙলাদেশের জনগণ নজিরবিহীন নির্যাতন। সহ্য করিয়াছেন এবং মুক্তিবাহিনী প্রতিদিন বুকের রক্ত ঢালিতেছেন স্বাধীনতার দাবিতেই। পাকিস্তানকে কবর খুঁড়িয়া পুনরুজ্জীবিত করার কোন প্রচেষ্টাকে দেশবাসী বরদাশত করিবে না।
বাঙলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান এক বিবৃতিতে স্বাধীনতার দাবিতে কোনরূপ আপস হইতে পারেন না বলিয়া মন্তব্য করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ! ১ : ১৫ x ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চলের পৌর সংস্থাগুলির পুনর্বিন্যাস
রৌমারী ১৯শে অক্টোবর (জোনাল অফিস সূত্র)
স্বাধীন বাংলার মুক্ত অঞ্চল রৌমারী থানার ইউনিয়নের পূর্ব পৌর সংস্থাগুলিকে ভেঙ্গে দিয়ে উহার পুনর্বিন্যাস সাধন কল্পে বাংলাদেশ সরকার সাময়ীকভাবে নিম্নলিখিত প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ কর্মীকে চেয়ারম্যান হিসাবে মনােনীত করেছেন বলে সংবাদে প্রকাশ
১) মিঃ আবদুল জলিল— দাতভাঙ্গা ইউনিয়ন ২) মিঃ দিদার হােসেন মােল্লা—শৌলমারী ৩) মিঃ এবাদুল্যা মণ্ডলবন্দবেড় ৪) মিঃ নওশের আলী আকন্দ রৌমারী ৫) মিঃ মতিয়ার রহমান যাদুর চর। ৬) মিঃ ছলিমউদ্দিন–রাজিবপুর
প্রকাশ যে- মিঃ এবাদুল্যা মণ্ডল ও মিঃ ছলিম উদ্দিন এর পূর্বেও চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউনিয়নের প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে একজন করে সভ্যকে মনােনীত করা হয়েছে। এইসব মনােনীত চেয়ারম্যান ও সভামহােদয়গণ অতিশীঘ্র বাংলাদেশ সরকারের কার্যে সহায়তা করার জন্য ও স্থানীয় পৌর সমস্যা সমাধানের জন্য শপথ গ্রহণ করছেন বলে প্রকাশ।
অগ্রদূত !! ১: ৮ ২০ অক্টোবর ১৯৭১
ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র | বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী।
(ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি)
“এ লড়াই বেঁচে থাকার লড়াই, এ লড়াই মৌলিক ও মানবিক অধিকার সুরক্ষিত করার আন্দোলন—এ লড়াই স্বাধীনতার লড়াই। বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত। সম্প্রতি বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে বক্তৃতা প্রসঙ্গে উপরােক্ত মন্তব্য করেন।
| “আমাদের সরকার এমন এক রাষ্ট্র গঠনে ইচ্ছুক যে রাষ্ট্র হবে সার্বিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক এবং যার বৈদেশিক নীতি হবে গােষ্ঠী নিরপেক্ষ”—মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় ঘাঁটি রৌদ্রক্ষরা মালভুমি দিনাজপুরে প্রায় তিন হাজার সুশিক্ষিত গেরিলাদের উদ্দেশ্য বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দৃপ্তকণ্ঠে উপরােক্ত ঘােষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সকল প্রকার মতপার্থক্য পরিহার করার জন্য আকুল আহ্বান জানিয়ে বলেন যে, “এই সঙ্কটকালে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখে রাজনৈতিক মতপার্থক্য কোন প্রকার বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না”। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ৫০ জন আহত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাক্কালে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে অসীম সাহস ও মনােবল প্রত্যক্ষ করেছেন বলে প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রতিনিধিকে জানান। আমাদের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি জানান যে, মুক্তাঞ্চল সফরকালে প্রধানমন্ত্রী মুক্তাঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে অসীম সাহস ও মনােবলের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
স্বদেশ ! ১ : ৪ # ২১ অক্টোবর ১৯৭১
রমজান মাসে অফিসের সময়।
পবিত্র রমজান মাসে বাংলাদেশ সরকারের সকল অফিস শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিনে সকাল ন’টা। থেকে দু’টো এবং শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে ১২টা পর্যন্ত চলবে।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৪ | ২২ অক্টোবর ১৯৭১
বিমান কর্মচারীদের সভা
পি, আই, এর প্রাক্তন কর্মচারীদের মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা চালুর সম্ভাব্যতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
সাবেক পি, আই, এ, কর্মচারীদের বিভিন্ন এসােসিয়েশন ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা সভায় অংশ গ্রহণ করেন। সভায় পি, আই, এর প্রাক্তন সিকিউরিটি অফিসার জনাব এস, এ, হােসেন সভাপতিত্ব করেন।
সভায় পি, আই, এর প্রাক্তন বাঙ্গালী কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতের জন্য জনাব এস, এ, হােসেন ২২/৩ ব্রাইট দ্রীট, পার্ক সার্কাস, কলিকাতা—১৭ এই ঠিকানায় নাম ও চাকুরীর বিবরণ পাঠাতে অনুরােধ করা হয়েছে।
জয়বাংলা (১) { ১: ২৪ | ২২ অক্টোবর ১৯৭১
নিরস্ত্র প্রতিবাদ নয় এবার সশস্ত্র সংগ্রাম
—সৈয়দ নজরুল (বিশেষ প্রতিনিধি)
| গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তাঞ্চলে সামরিক অফিসারদের এক সমাবেশে প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা এবং বাঙ্গালী জাগৃতির মহানায়ক শেখ মুজিবর রহমান যেদিন ঢাকার বুকে আপনাদের অভিবাদন গ্রহণ করবেন, সেদিন হবে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সার্থকতা। | অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে দেশবাসী এবং বিশ্বের কাছে পুনরায় সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানী কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান প্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেছেন যে, লাখাে শহীদের পবিত্র রক্তে সিক্ত বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই আমরা স্বীকার করে নেবাে না।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান গত ৯ই অক্টোবর মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অফিসারদের প্রথম শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন।
পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী অধিকৃত মাতৃভুমির শৃঙ্খল মােচনের রক্তাক্ত সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তি বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে সমগ্র বিশ্বকে তিনি পুনরায় জানিয়ে দেন যে, বর্বর বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটীতে রেখে কোন রূপ আপােষের প্রশ্ন উঠতে পারে না। তিনি বলেন, “আমরা রক্তাক্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আমাদের অস্ত্র বিশ্রাম নেবে না।”
সৈয়দ নজরুল গর্বের সাথে ঘােষণা করেন যে, আজকের এই একাত্তর সালের প্রতিবাদ নিরস্ত্র প্রতিবাদ নয়। আমাদের আজকের সংগ্রামও নয় নিরস্ত্র সংগাম।
এর আগে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম, এ, জি ওসমানী কুচকাওয়াজ মাঠে অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে বেতার ও তথ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত এম, এন, এ, এবং ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি জনাব আবদুল মান্নানও উপস্থিত ছিলেন। | সৈয়দ নজরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বলেন : আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পর যে যুদ্ধ আমরা শুরু করেছি বর্বর হানাদার বাহিনীর প্রতিটি সৈন্যকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমরা থামবাে না।
ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে ইতিহাসের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে উল্লেখ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, “জাতীয় স্বাধীনতাকে কেউ হাতে তুলে দেয় না। রক্তাক্ত লড়াই-এর মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়।”
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পবিত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান। জানিয়ে ইতিহাসের পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, বিশ্বের কোথাও জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। আমাদের সংগ্রামকেও আমরা ব্যর্থ হতে দেবাে না। আমাদের আজকের যুদ্ধ জাতীয় যুদ্ধ, এই যুদ্ধ গণযুদ্ধ। জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার দুর্বার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। | নব শিক্ষা প্রাপ্ত অফিসারদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, বাংলার পদানত নিপীড়িত জনগণ। আপনাদের পাশে আছেন। এই দুঃসাহসী জনগণই অতীতে দেশী বিদেশী সমস্ত স্বৈরাচারী শক্তির | বিরুদ্ধে লড়াই করেছে রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে কিন্তু মাথা নত করেনি। | অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান ক্ষোভ ও বেদনার সাথে বলেন, গণতন্ত্রের পুরােধা ও সংগ্রামী সাধক বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবর রহমান আজ শত্রুর কারাগারে দুঃসহ অবস্থায় বন্দী জীবনযাপন করছেন। যেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর ঢাকার বুকে আপনাদের অভিবাদন গ্রহণ করবেন সেদিন হবে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সার্থকতা। | তিনি সংগ্রামী ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই, পি, আর ও পুলিশ বাহিনীর অপূর্ব দেশপ্রেম ও বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে শত্রু বাহিনীর অতর্কিত ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আক্রমণের মুখে তারা তুলনাহীন বীরত্বের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দেশের স্বাধীনতার রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রামকে জোরদার করে তুলেছিলেন। তারা সবাই দেশকে শক্রর। কবল থেকে মুক্ত করার জন্য ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন।
সর্বাধিনায়ক
এর আগে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানী অফিসারদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।
ভাষণের শুরুতে সেকেণ্ড লেফট্যানেন্ট হিসেবে কার্য পরিচালনার দক্ষতা অর্জনের জন্য অফিসার ক্যাডেটদের তিনি অভিনন্দন জানান। | মাতৃভূমির চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি অফিসারদের আত্মত্যাগের মনােভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে। স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার উপদেশ দেন। | কর্ণেল ওসমানী বলেন, দেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে এবং বিজয় সম্পর্কে সম্পূর্ন নিশ্চিত হয়েই স্বাধীনতা সগ্রামীদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছতে হবে। | সর্বাধিনায়ক ওসমানী সর্বশেষে বলেন, স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে রণ-কৌশলগত যােগ্যতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনের মতাে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে এবং | প্রত্যেকের সাহসিকতাপূর্ণ কাজ যেন অন্যকে অনুপ্রাণিত করে তােলে সেভাবে যুদ্ধ করে যেতে হবে।
| জয়বাংলা (১) | ১: ২৪ | ২২ অক্টোবর ১৯৭১
দিনাজপুর রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে প্রধান মন্ত্রী তাজুদ্দীনের ভাষণ
বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তির দিন সমাগত প্রায়।
(বিশেষ প্রতিনিধি)
দিনাজপুর রণাঙ্গন : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, বাংলার জাগৃতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রচারিত বাঙালী জাতীয়তাবাদ রক্ষা এবং
হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ জল্লাদ পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন। এবং তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন সমাগত প্রায়।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিগত ১৩ই অক্টোবর দিনাজপুর রণাঙ্গনের একটি যুব ক্যাম্পে তিন হাজার শিক্ষাপ্রাপ্ত মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন। | প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালীদের মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বিগত ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়ার হিংস্র হায়েনা বাহিনী নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুর রক্ত আর লাশের নীচে চাপা দেওয়ার নৃশংসতম প্রচেষ্টা চালানাের পর বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক এবং আপামর জনসাধারণ সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য হয়েছ।
তিনি বলেন, বাঙালীদের অস্তিত্ব, মৌলিক ও মানবিক অধিকার এবং পূর্ন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের এই যুদ্ধ। এই জনযুদ্ধে আমরা অবশ্যই বিজয়ী হবাে।
জনাব তাজউদ্দীন আবেগ জড়িত কণ্ঠে মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে বর্বর কসাই বাহিনীর বধূভূমিতে পরিণত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডোদের মৃত্যুশীতল কাঠিন্য ও দুর্জয় মনােবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
জনাব আহমদ রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ স্বাধীনতার সূৰ্য্য সৈনিকদের সর্বপ্রকার বিভেদ বিস্মৃত হয়ে প্রত্যেককে “মুক্তি যােদ্ধা” এই গৌরবােজ্জ্বল পরিচয়ে চিহ্নিত হওয়ার জন্য আবেদন জানান।
তিনি বলেন, জাতীয় ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের মরণজয়ী মুক্তি সংগামের রক্তপিচ্ছিল পথ রাজনৈতিক স্বাধীনতার কালিমায় কলঙ্কিত হওয়াও উচিত নয়। | প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, হানাদার বাহিনী-মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন আমরা জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুরণ করে যাবাে।
স্বাধীনতার অগ্নিশপথে বলীয়ান মুক্তি যােদ্ধারা তার বক্তৃতার মাঝে মাঝেই উদাত্ত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত করেন। পরে তিনি আহত মুক্তি যােদ্ধাদের অবস্থা ব্যক্তিগতভাবে অবলােকনের জন্য হাসপাতাল পরিদর্শন করেন।
হাসপাতালে রংপুরের রণাঙ্গনে আহত সৈনিক হাসান তােরাবের সাথে তিনি কথা বলেন। মুক্তি যােদ্ধা তােরাব যুদ্ধে তার ডান হাত এবং বাম চোখ হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একদিকে গর্ব এবং অন্যদিকে অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে যখন তােরাবকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি তাঁর (প্রধানমন্ত্রী) কাছে কিছু চান কিনা তখন তিনি প্রধান মন্ত্রীর হাত বাম হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আবেগ-বিহ্বল কণ্ঠে বলেন, “প্লাষ্টিক সার্জারী দ্বারা আমার হাতটি ঠিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। হাত ঠিক হলেই আবার আমি যুদ্ধে যাবাে এবং আমার বলিষ্ঠ কজী আবার শক্র হত্যার কাজে ব্যাপৃত হবে। এ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।”
পূর্বাহ্নে জনাব তাজউদ্দীন রংপুর জেলার তেতুলিয়া রণাঙ্গনের বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এখানকার অসম সাহসী মুক্তিবাহিনী ৭০টি গ্রাম মুক্ত করেছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় তিন লাখ লােক বসবাস করছে। তিনি দিনাজপুর ও রংপুরে বেশ কয়েকটি জনসভায় বক্তৃতা করেন।
| জয়বাংলা (১) ! ১: ২৪ | ২২ অক্টোবর ১৯৭১
ইন্দিরার প্রতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন।
| (নিজস্ব সংবাদদাতা)
‘বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ব জনমত গঠনের অভিপ্রায়ে বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশ হতে সফর শেষে বাংলাদেশের নিকটতম বন্ধু ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে পৌছলে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীকে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম লিখিত অভিনন্দন বাণীটি অর্পণ করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এতে ভারতীয় প্রধান মন্ত্রীকে তার শ্রম সাধ্য সফরের জন্যে অভিনন্দিত করেছেন। বাণীতে বলা হয়, “মহােদয়া বিশ্বের দরবারে মানবজাতির বিবেকবাণী সরূপ দীর্ঘ এবং শ্রম-সাধ্য সফরে শেষে আপনার প্রত্যাবর্তনে আমাদের জনগণ, সরকারের তরফ হতে ও ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে আন্তরিক সম্বর্ধনা জানাচ্ছি। আমাদের জনগণের জন্য আপনি যা করেছেন কখনাে আর কেউ অন্য দেশের অত্যাচারি জনগণের লক্ষ্য পূরণে এতটা। করেনি।”
উত্তাল পন্না ॥ ১; ১২৪ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকায় গণ-যুদ্ধের বিজয় উৎসব অচিরে
নজরুল ইসলাম।
| মুজিবনগর, ১৮ই অক্টোবর, গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে প্রদত্ত ‘গার্ড অব অনারের মাধ্যমে শীঘ্রই ঢাকা শহরে গণ-যুদ্ধের বিজয়ােৎসব পালন করা হবে। | গত তিনদিনে চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, কুমিল্লা ও শ্রীহট্টের মুক্তাঞ্চলে বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা ও সমর … সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হবার জন্য সশস্ত্রবাহিনী গুলির প্রতি আহ্বান। জানান। তিনি বলেন, পাক জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের নিরস্ত্র ও নিরীহ অসামরিক লােকদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে, তার প্রতিশােধ নেওয়া প্রতিটি লােকের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। | জনাব ইসলাম আরাে বলেন, তার সরকার বাংলাদেশের প্রশ্নে ঘাতক ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে কোনরূপ আপােস কখনও করবে না। যতদিন পর্যন্ত একজন বাঙ্গালীও জীবিত থাকবে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকবে।
| অপরাপর রাষ্ট্র কর্তৃক গণতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্যদান সম্পর্কে তিনি বলেন, কোন দেশের স্বাধীনতা বৃহৎ রাষ্ট্রের দান হিসেবে কখনও আসে না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘােষণা করেন যে, কেবলমাত্র বাঙ্গালীরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে সক্ষম।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ তাঁর ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লােকের প্রত্যেকেই এখন মুক্তিযােদ্ধা এবং মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি পবিত্র ভূমি উদ্ধারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ভারত সরকার যে অভূতপূর্ব সাহায্য দিচ্ছেন সেজন্য তিনি ভারত সরকার ও ভারতবাসীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ (1) ! ১: ১৮ ২৫ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের সন্তোষ
২১শে অক্টোবর ভারত-যুগােশ্লাভ যৌথ ইস্তাহারে বাংলাদেশ সরকারী মহল সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এই ইস্তাহারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। মহান
| নেতা শেখ মুজিবর রহমান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজী এবং প্রেসিডেন্ট টিটো যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনের কথা।
উক্ত মুখপাত্র বলেছেন শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে আমাদের নীতি ইস্তাহারে সমর্থিত হওয়ায় আমরা খুশী । স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশেই শরণার্থীরা মর্যাদার সঙ্গে যেতে পারেন, নিরাপত্তা অনুভব করতে পারেন।
ইস্তাহারে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছে। আমরা জোর দিয়ে জানাতে চাই যে, বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পূর্ব স্বাধীনতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। অন্য কিছুই তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়।
বাংলাদেশ (১) # ১ : ১৮ ! ২৫ অক্টোবর ১৯৭১
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।
সামাদ।
গত ৯ই অক্টোবর গ্রেট বৃটেনস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিখ্যাত হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেটের কৃতীসন্তান—সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম, এ সামাদ। প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে যেয়ে তিনি বলেন, আপােষের কোন প্রশ্ন নেই, বাংলাদেশের স্বাধীনতাই হলাে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এবং কেউ আমাদেরকে এ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারবে
জনাব সামাদ আরাে বলেছেন, যে অত্যাচার ও অবিচার পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠি বাংলাদেশে চালিয়ে। | ছিলাে তার জবাব দেওয়ার উপযুক্ত সময়েই বাঙালীরা অস্ত্র ধারণ করেছে।
বাংলা ১: ৬ | ২৫ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকার কিছুই জানে না
কামরুজ্জামান।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ উপমহাদেশে উত্তেজনা হাসের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সরকারীভাবে | যােগাযােগ স্থাপন করেছেন। ফলে লণ্ডনের একটি সংবাদ সংস্থা যে রিপাের্ট প্রচার করেছেন বাংলাদেশ | সরকারের স্বরাষ্ট্র, সাহায্য এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী, জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান তা সরাসরি
অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, মার্কিণ কর্তৃপক্ষ সরকারী বা বেসরকারী কোন পর্যায়েই বাংলাদেশ | সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন নি।
জনাব কামরুজ্জামান দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধানই সম্ভবপর নয় । | তিনি বলেন, ‘হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করে জন্মভূমিকে আজাদ করাই আমাদের জনগণের একমাত্র লক্ষ্য। পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য তারা আজ নিবেদিত।’
তিনি আরও বলেন যে, আওয়ামী লীগের গতিশীল নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশের জনগণ এখন হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করার মত শক্তি অর্জন করেছেন। তারা তাদের অধিকার আদায় করে। ছাড়বেনই। | তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, কিছু লােক যা ভাবছেন তার বহু আগেই মুক্তি বাহিনী নিজেদের | অধিকার ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করবেন।
জয়বাংলা (১) { ১: ২৫ ৪ ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
ওরা অনুপ্রবেশকারী নয় বাঙ্গালী সন্তান ইয়াহিয়ার মিথ্যার বেসাতির জবাবে কর্ণেল ওসমানী।
মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম, এ, জি, ওসমানী ইয়াহিয়া খানের অভিযােগকে ‘ইচ্ছাকৃত সত্যের অপলাপ’ বলে বর্ণনা করেন । ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন যে বাংলাদেশে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা লড়াই করছে। | ফরাসী পত্রিকা ‘লে এঁদে’-র জনৈক প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঐ অভিযােগ
| কর্ণেল ওসমানী বলেন যে, অনুপ্রবেশকারীরা ইয়াহিয়ার ২৫০০০ সশস্ত্র সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে না এবং বাংলাদেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন পেতে পারে না। রাজনৈতিক এবং জাতিগতভাবে গঠিত বাঙ্গালী জাতি স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের জন্য মরণ পণ করে লড়াই করছেন।
নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং সর্বস্তরের লােকজন দিয়েই মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষিত লােক যেমন রয়েছেন তেমনি এতে আছেন ছাত্র, শ্রমিক এবং গ্রাম বাংলার ক্ষেত মজুর। এরা সকলেই একনিষ্ঠতা ও সাহসিকতার সঙ্গে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং জঘন্য ধরনের উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্তিলাভের জন্য দৃঢ় মনােবল নিয়ে লড়াই
শত্রুসেনারা উন্নত ধরনের অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে মরিয়া হয়ে লড়াই করলেও যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে চলেছে। | ইয়াহিয়া খান এখন সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক রূপদানের চেষ্টা চালাচ্ছে এবং অনিবার্য পরাজয়ের কলঙ্ক ঢাকা দিতে চেষ্টা করছেন।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৫ + ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি ভূমি উদ্ধার করবাে
প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ সম্প্রতি তাঁর ভাষণে বলেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লােকের প্রত্যেকেই এখন মুক্তিযােদ্ধা এবং মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি পবিত্র ভূমি উদ্ধারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ | মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে ভারত সরকার যে অভূতপূর্ব সাহায্য দিচ্ছেন সেজন্য তিনি ভারত সরকার ও ভারতবাসীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। | সম্প্রতি বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, এম, এন, এ এবং এম, পি, এ গণ বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন সফর করেন। তারা যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতালগুলােতে আহত এবং সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন।
‘জয়বাংলা (১) [১: ২৫ [ ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
নেতাজী আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন যে, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী। | বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও বাংলাদেশ সরকারের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
আজাদ হিন্দ ফৌজের ২৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে প্রেরিত এক বাণীতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম একথা বলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, নেতাজীর লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মাতৃভূমির মুক্তি আনয়ন। সুতরাং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আমরা আজ যে ধরণের সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়ােজিত রয়েছি তার সাথে নেতাজীর সংগ্রামের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
জয়বাংলা (১) ! ১: ২৫ x ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
বাঙলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। প্রশাসনিক কাজ শুরুর ২য় পদক্ষেপ
| বাঙলাদেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাজ পুরাদমে চলছে। রংপুর জেলার পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধার বিস্তীর্ণ এলাকায় তার যােগাযােগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এবং সরকারী কর্মচারী নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় জনসাধারণ বাঙলাদেশ সরকারের কর, খাজনা ইত্যাদি পরিশােধ করছেন। | এই এলাকায় প্রশাসনিক কাজ চালুর দ্বিতীয় পদক্ষেপ স্বরূপ সরকার ১টি হাইস্কুল ও ১৩টি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শেখার জন্য স্কুলসমূহ খুলে নিয়মিত ক্লাশ পরিচালনা করছেন। ছাত্র সংখ্যা আশাতিরিক্তভাবে নিজেদের ক্লাশে যােগদান করছে। শতকরা ৮৫ জন ছাত্র নিয়মিত ক্লাশে যােগদান করে বলে খবর পাওয়া গেছে। সত্বর এখানে কয়েকটি ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে বলেও খবরে প্রকাশ।
রণাঙ্গন (৩) [ ৩০ অক্টোবর ১৯৭১
বাঙলাদেশের অধিকৃত এলাকার। স্বাক্ষী গােপাল মন্ত্রীদের প্রতি একটি খােলা চিঠি
মহামান্য মন্ত্রী মহােদয়গণ!
আপনারা আমাদের রক্তমাখা ছালাম গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল প্রান্তরে গ্রামচাষীদের ঘরে পান্তাভাত খেয়ে আপনারা মানুষ হয়েছেন। জন্মের পর থেকে মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে। লেখাপড়া শিক্ষা করেছেন। আপনাদের মাতা অথবা পিতা কেহই পশ্চিমা বেনীয়ার ঔরষজাত নন। অথচ আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরােধীতা করে গণহত্যার নায়ক জঙ্গী ইয়াহিয়া খানের উচ্ছিষ্ট অর্থের লােভে দালাল সেজে নিজেদের বিবেককে পশুর বিবেকে পরিণত করেছেন। কিন্তু আপনারা কি কখনাে ভেবেছেন আপনাদের দিয়ে শুধু বাঙ্গালী নিধন যজ্ঞেই সহায়তা করে নেওয়া হবে? ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মাটি থেকে যখন ইয়াহিয়া গােষ্ঠীকে পাততাড়ী গুটে নিয়ে সুদূর ১২ শত মাইল। দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে হিজরত করতে হবে তখন আপনারা বাঙালী গাদ্দার বলে তাদের দয়া থেকে পরিত্যক্ত হবেন। সেই সময় আপনারা কোন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করবেন? পৃথিবীর কোন দেশই বালাদেশের গণহত্যার নায়কদের ভবিষ্যতে কোন আশ্রয় দিতে পারে না বলে ভবিষ্যতে বাণী দানকারী পণ্ডিত ব্যক্তিরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। | বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর আন্দোলন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৪ বছর পাঞ্জাবী পুঁজিপতি গােষ্ঠীর শাসন শােষণে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশের মানুষ তাদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এ আন্দোলন বাংলাদেশে বসবাসকারী। কোন বাঙালী অথবা অবাঙালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। কিন্তু সে স্বত্বেও কতিপয় ব্যক্তি ধর্মের
দোহাই দিয়ে পাঞ্জাবী গােষ্ঠীর যে দালালী করে আসছেন সে সম্পর্কে আমাদের মতামত হচ্ছে ধর্ম একটি মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ইচ্ছা করলে একটি মানুষ তার ধর্মত্যাগ করতে পারে কিন্তু ভাষা ত্যাগ করতে পারে না। তাই ধর্মের বড়ি দিয়ে মানুষকে বােকা বানানাের দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। | অধিকৃত এলাকার স্বাক্ষী গােপাল মন্ত্রীসভার শ্রমমন্ত্রী জনাব এ, এস, এম, সুলায়মান সাহেব আপনি তাে পেশাদার দালাল। আপনার দালালী করার অভ্যাস নতুন নয়, পুরাতন? আপনি তাে ঢাকায় অধুনালুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানে একটি দালাল (বীমা) কোম্পানীর প্রধান ছিলেন। সেই সময় থেকেই আপনি দালালী ব্যবসায় পাকা হয়ে উঠেছেন। অপর পক্ষে নিজেকে শ্রমিক দরদী বলে পরিচয় দিয়ে একজন শ্রমিক নেতা রূপে বড় বড় কল কারখানার মালীকদের ও পয়সায় আপনি শান শওকতে গাড়ীবাড়ী করে আরাম আয়াসেই বসবাস করতেন। কিসের দুঃখে আপনি ইয়াহিয়া খানের দালালীর খাতায় নতুন করে নাম লিখালেন?
বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত মরহুম নেতা শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক সাহেবের নাম ভাঙ্গিয়ে নেতার গড় কৃষক-শ্রমিক পাটির সর্বেসর্বাও বনেছিলেন এক সময় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন পুরােভাগের নেতা বলে জাহির করার জন্য বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সভায় উপস্থিত থেকে সােচ্চার কণ্ঠে নিজেকে স্বাধীনতার অগ্রনায়ক বলে দাবী করেছিলেন। কিন্তু, কোথায় আপনার সেই মাতৃভূমির দরদ, আজ যখন লক্ষ লক্ষ কৃষক-শ্রমিক বেকার। এবং নর ঘাতক এহিয়ার হাত শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত তখন আপনি কি করে এহিয়ার স্বাক্ষীগােপাল মন্ত্রী। সভার শ্রম মন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করলেন?
তাই আপনাদের প্রতি আমাদের সৎ উপদেশ— আপনারা যদি নিজেদের এবং আপনাদের বংশধরদের কুখ্যাত গভর্ণর মােনেম খাঁর ন্যায় নিশ্চিহ্ন করতে না চান তবে দালালীর পথ পরিহার করে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে আসুন। অন্যথায় ইতিহাসের লিখন আপনাদের ক্ষমা করবে না। “জয় বাংলা”! আমাদের খেদমতে’বাংলাদেশের ছিন্নমূল জনসাধারণ
রণাঙ্গন (৩) # ৩০ অক্টোবল্ল ১৯৭১
কালদিঘীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব কামরুজামান কালদিঘী শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যান। সেখানে। বক্তৃতা দান কালে মন্ত্রী বলেন যে আজ সব দুঃখ কষ্টকে ছাপিয়ে রেখে স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মন্ত্রী মহােদয়ের সঙ্গে অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জনাব আব্দুর রহিম এম, পি, জনাব আজিজুল ইসলাম এম, এন, এ, এবং বহু আরাে গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। এধরনের শিবিরে পরিদর্শনে শরণার্থীরা তাদের দুঃখ কষ্টকে ভুলে গিয়ে নিজের মনে উৎসাহ পায় ।
দাবানল ॥ ১: ৪ ৪ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান স্বাধীনতায়
| নয়াদিল্লী ২১শে অক্টোবর : দিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেছেন, স্বাধীন বাংলার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব। | বাংলাদেশের মানুষ শান্তিকামী কিন্তু তারা এক পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে সমাধানে আর আসতে পারে না মিশন প্রধান জোরের সংগে এ মন্তব্য করেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক সেক্রেটারী জেনারেল উ-থান্টের পাক-ভারত উপমহাদেশে আমন্ত্রণ প্রসংগে তিনি বলেন যে, ২৫ শে মার্চে কেন ইয়াহিয়া খান উ-থান্টকে আমন্ত্রণ করেন নি?
জনাব চৌধুরী পরিষ্কার করে বলেছেন এ সমস্যা বাংলাদেশের মানুষ ও পাক সামরিক জান্তার। মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটা কোন পাক ভারত সমস্যা নয়।
দাবানল এ ১ ৪ ৪ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
চেয়ারম্যান মাও সকাশে বাঙলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির তারবার্তা।
পৃথিবীর সর্বাধিক মানুষের আবাস ভূমি এশিয়ার সর্ববৃহৎ শক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জাতিসঙ্ঘে অনুমােদনের বিরুদ্ধে এতােকাল যাবত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ষড়যন্ত্র করে আসছিলাে। তাই বিশ্বসংস্থা বলে কথিত এই প্রতিষ্ঠানটিতে পৃথিবীর বৃহত্তম মানব গােষ্ঠীর কোনাে প্রতিনিধি ছিলােনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছলচাতুরী করে এই সুদীর্ঘ সময়ে চীনের জাতিসঙ্ েঅন্তর্ভুক্তির পথ অবরুদ্ধ করে রেখেছিলাে। শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। তাইওয়ান এবং মূল চীনকে দ্বৈতভাবে জাতিসঙ্ েআসন দান করার মার্কিন প্রস্তাব সংখ্যাগুরু দেশের প্রতিনিধির ভােটে নাকচ হয়েছে। জাতিসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পরাজয় সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদী শক্তির নৈতিক পরাজয়। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জাতিসঙ্ েঅন্তর্ভুক্তি পৃথিবীর সর্বহারা মানুষের চোখে এক উজ্জ্বল আশার আলাে বহন করে এনেছে।
পাকিস্তানী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বাঙলাদেশ যখন মরণপন সংগ্রামে লিপ্ত, সেই সময়ে জাতিসঙ্ঘে চীনের আসন প্রাপ্তি বাঙলাদেশের গণমানুষের দৃষ্টিতেও এক ইতিহাসের শুভ সূচনা প্রত্যাসন্ন করে তুলেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম জনগণতান্ত্রিক চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের সকাসে প্রেরিত এক তার বার্তার গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারবার্তায় তিনি আরাে বলেছেন জনগণতান্ত্রিক চীনকে সুদীর্ঘকাল ব্যাপী উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতাও তেমনি আরেকটি উপনিবেশবাদী স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম। করে যাচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির প্রেরিত এই বার্তা সর্বতােভাবে সময়ােচিত এবং সুগভীর তাৎপর্য সম্পন্ন। বাঙলাদেশের সংগ্রামী জনগণের পক্ষ থেকে তিনি চীনের জনগণকে অভিনন্দিত করেছেন। এই বিশাল জনগােষ্ঠীর শান্তি সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। বাঙলাদেশের জনগণের এই উপনিবেশবাদ বিরােধী মরণপণ সংগ্রামে যাতে বিজয় লাভ করতে পারেন, তার জন্য চীনের জনগণও এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থন করতে, এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে, অস্ত্রশস্ত্র এবং সর্বপ্রকারের সাহায্য দিয়ে বাঙলার জনগণের উপনিবেশবাদ বিরােধী সংগ্রামকে জয়যুক্ত করার জন্যেও তিনি চীন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
দাবানল # ১ : ৪ [ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
মুক্তি সংগ্রামে চীনের সমর্থন কামনা
মুজিবনগর, ২৭শে অক্টোবর, অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম আজ বাংলাদেশের মুক্তি। সংগ্রামে চীনের সমর্থন চেয়েছেন।
রাষ্ট্রসংঘে চীনের অন্তর্ভুক্তিতে চেয়ারম্যান মাওসেতুং-এর নিকট এক অভিনন্দন বাণীতে বলা | হয়েছে, নির্যাতিত মানবাত্মার সশস্ত্র অভুত্থানের দ্বারা উপনিবেশ থেকে মুক্ত একটি মহান জাতির এক বিরাট সাফল্য। বাংলাদেশের জনগণও আজ পশ্চিমা অত্যাচার আর নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সংগ্রামে লিপ্ত। তাই বাংলার নির্যাতিত মানুষ অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রামে চীনের সমর্থন আশা। করে। | ওই বার্তায় চীনের জনগণের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়েছে বাংলাদেশের জনগণও সরকারের পক্ষ থেকে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১:১১ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
বাঙলাদেশে সরকারের নির্দেশ
(বিশেষ প্রতিনিধি)
গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসকের দপ্তর (উত্তর অঞ্চল থেকে বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয়েছে যে রংপুর জিলার বিভিন্ন মুক্ত এলাকার হাট, বাজার ও খােয়াড়সমূহের ‘তােলা’ উঠাবার জন্য প্রত্যেক অঞ্চলের ইজারাদারগণকে বাংলাদেশ সরকারের অনুমােদিত রসিদ বই প্রদান করা হয়েছ। জনগণের জ্ঞাতার্থে জানান হয়েছে যে তারা যেন ইজাদারগণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য আর কাউকে কোন গণ্ডি’ বা ‘তােলা’ না দেন। বিজ্ঞপ্তিতে আরাে জানান হয়েছে যে বাংলাদেশ সরকারের শুষ্কবিভাগীয় কর্মচারীদের রসিদের সাদা পৃষ্ঠায় প্রশাসকের অফিসের শীলমােহরকৃত রসিদ দিয়ে শুল্ক আদায় করছেন। কোন ব্যক্তি যেন অনুরূপ রসিদ ব্যতীত শুষ্কবিভাগীয় কর্মচারী ছাড়া অন্য কাউকে শুল্ক দেন। তােলা উঠাবার নিরখি নামা।
সােনার বাংলা (মুক্তিবাহিনী) ৪ ১ : ৮-৯ অক্টোবর ১৯৭১
ভারত-যুগােশ্লাভি যুক্ত ইস্তাহারে বাংলাদেশ সরকারের সন্তুষ্টি
বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, ভারতযুগােশ্লাভি যুক্ত ইস্তাহারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও যুগােশ্লাভ প্রেসিডেন্ট যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষেরই মনের কথা। | মুখপাত্র আরাে বলেন শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে আমাদের নীতি সমর্থিত হওয়ায় আমরা খুশি হয়েছি। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেই শরণার্থীরা সম্মানের সঙ্গে আসতে পারেন এবং নিরাপত্তা অনুভব করতে পারেন। | ইস্তাহারে নির্বাচিত প্রতিনিধি গণের নিকট গ্রহণ যােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছে। আমরা জোর দিয়ে জানাতে চাই যে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পূর্নস্বাধীনতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। অন্য কিছুই তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়।
মুক্তবাংলা # ১; ৭ | ১ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের সপক্ষে বিশ্বজনমত আরও জোরদার হইয়াছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের বক্তব্য পেশের ফলশ্রুতি সম্পর্কে ফণি মজুমদার
রাজনৈতিক সংবাদদাতা
জাতিসংঘে প্রেরিত ১৬ সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য, আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীন জননেতা শ্রীফনিভূষণ মজুমদার বলেন যে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অত্যন্ত কার্যকরীভাবে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশের দুঃখ লাঞ্ছনা এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম সাধনার কাহিনী বিশ্বের দরবারে পেশ করিয়াছে। ফলে বিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আরও বলিষ্ঠতর হইয়া উঠিয়াছে।
| নিউইয়র্ক হইতে মুজিবনগরে ফিরিয়া গত কাল সােমবার বাংলার বাণীর প্রতিনিধির সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে শ্রীমজুমদার আরও বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বিশ্ব-রাষ্ট্রবর্গের কাছে মাতৃভূমির। বক্তব্য পেশের পর এযাবাল নিরপেক্ষ ছিল এমন দেশও বাংলাদেশের সংগ্রামের সমর্থন সূচক মনােভাব ব্যক্ত করিয়াছে।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে বিংশ শতাব্দীর অপরাজেয় জাতীয়তাবাদী গণশক্তির আত্ম প্রতিষ্ঠার দুর্জয় সংগ্রামের নির্ভীক সিপাহশালার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে নিয়ােজিত বাংলাদেশের দশদিগন্তে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশবাদী ভাড়াটিয়া সেনা দস্যুদের হিংস্র বর্বর গণহত্যা যজ্ঞের কালিমা লিপ্ত পটভূমিতে গত ২১শে সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হইলে বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীন বাংলার পক্ষ হইতে বিচারপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বিশ্বের দরবারে জননী বাংলার বক্তব্য পেশের জন্য নিউইয়র্ক গমন করে। | শ্রী ফণি মজুমদার বলেন, এই প্রতিনিধিদল বিশ্বের বিভিন্ন জাতিকে এই সত্য উপলব্ধি করাইতে সক্ষম হইয়াছে যে, বাংলাদেশ ইস্যু পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বা “পাক ভারত বিরােধ’ নয়বরং বাংলাদেশ ইস্যু হইতেছে মহান নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর বাঁচা মরার জ্বলন্ত প্রশ্ন। তিনি বলেন জাতিসংঘ সদর দফতরে লবিং এর মাধ্যমে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদল নিয়ােগের প্রস্তাব, জল্লাদ ইয়াহিয়া কর্তৃক সুকৌশলে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার প্রয়াস, ভারতের বিরুদ্ধে জল্লাদী রণ হুঙ্কারের অন্তরালবর্তী নিগুঢ় রহস্য এবং মৃত পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের হাস্যকর উদ্ভট প্রস্তাবের ব্যাপারে বাংলাদেশের বক্তব্য পেশ করিয়াছে। শ্রী মজুমদার আরও জানান, আমরা বিশ্বসংস্থাকে জানাইয়া দিয়াছি যে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বিনাশর্তে মুক্তি দান বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দান, হানাদার বাহিনী প্রত্যাহার এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দানের পরই বিবেচনা করা হইতে পারে জঙ্গীশাহীর সঙ্গে কোন আপােষ মীমাংসার প্রশ্ন আলােচনা করা যায় কিনা।
বাংলার বাণী # ১০ সংখ্যা ! ২ নবেম্বর ১৯৭১
|
শাসক।
নয়াদিল্লীস্থ পাক দূতাবাসের পৈশাচিক কাণ্ড প্রহারের চোটে বাঙ্গালী কর্মচারী নিহত?
(নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত)
মুজিবনগর, ৩রা নভেম্বর : নয়াদিল্লীস্থ পাক দূতাবাসের অন্যতম পদস্থ কর্মচারী জনাব হােসেন | আলীকে দূতাবাস ভবনের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে বেদম প্রহারের মাধ্যমে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে
বলে আশংকা করা হচ্ছে। আজ এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, জনাব হােসেন আলী দূতাবাস ভবনের কড়া পাহারা এড়িয়ে পালাবার সময় ধরা পড়েন এবং তাকে হাইকমিশন ভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার উপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়। জনাব আলীর স্ত্রী ও মেয়েরাও এই বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পাননি। গত মঙ্গলবার সকালের দিকে দূতাবাসের কড়া পাহারার ব্যুহ ভেদ করে পাক হাইকমিশনের ১১ জন বাঙ্গালী কর্মচারী সপরিবারে পালাবার চেষ্টা করলে নিরাপত্তা রক্ষীসহ বাইশজন পশ্চিম পাকিস্তানী তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং প্রচণ্ড মারধাের শুরু করে দেয়। এই মারামারির সুযােগে নয়জন কর্মচারী তাদের স্ত্রীপুত্র নিয়ে কোন রকমে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
নিরাপত্তা রক্ষীদের হাত থেকে কয়েকজন সহকর্মীকে রক্ষা করতে গিয়ে মােহাম্মদ ইউনুস নামে দূতাবাসের অন্যতম কর্মচারী কাধে ও পিঠে প্রচণ্ড আঘাত প্রাপ্ত হন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা। হয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীরা লােহার রড, ছুরি ও হকি স্টিক ব্যবহার করে নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর আশংকা, ভারতে পাক গােয়েন্দ তৎপরতার প্রধান আবদুল গণির ব্যক্তিগত সহকারী জনাব হােসেন আলী প্রহারের চোটে নিহত হয়েছেন। | বাংলাদেশ মিশনের প্রতিনিধিরা ও স্থানীয় জনসাধারণ জনাব হােসেন আলীর স্ত্রী ও মেয়েদের বাইরে নিয়ে আসার জন্যে চেষ্টা করেন কিন্তু তাঁদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। একদল বিদেশী সাংবাদিক আহত বাঙ্গালী কর্মচারীদের সাথে দেখা করতে চাইলে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেননি। এতদ্ব্যতীত, এই সংবাদ সংগ্রহ করার জন্যে সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হাইকমিশন ভবনের ভেতর থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে তাদেরকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় ।
সপরিবারে যারা পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন, মেসার্স সাফিউদ্দিন, মুজাম্মিল হক, নুরুল হক, ইউনুস মিঞা, খলিল উদ্দিন, শফীউর রহমান, আবদুল হােসেন, আবদুল চৌধুরী, আলিমুদ্দিন ও কুলিমুদ্দিন। পাক হাইকমিশন এদেরকে সরকারী ভাবে বহিস্কৃত ঘােষণা করেছে। পাক হাইকমিশনের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা রক্ষী কর্তৃক বাঙ্গালী কর্মচারীরা যেভাবে প্রহৃত ও অপমানিত হয়েছেন তা বিদেশী দূতাবাসের ইতিহাসে অশ্রুতপূর্ব। এই ঘটনা পাক জঙ্গীশাহীর কলঙ্কিত ইতিহাসে আর একটা ঘৃণ্য অধ্যায়ের সূচনা করল । | বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, নয়াদিল্লীস্থ পাক দূতাবাস থেকে, যে এগারজন বাঙ্গালী কর্মচারী পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন তারা পাক হাইকমিশনের অভ্যন্তরে আটক অন্যান্য বাঙ্গালীদের মুক্তির দাবীতে ধর্ণা দিয়েছেন। এই ধর্ণা ৪৮ ঘণ্টাকাল চলিবে।
অমর বংল্য ১:১ 5 নভেম্বর ১৯৭১
তাজুদ্দিনের সমবেদনা (নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত)
মুজিবনগর, ৩রা নভেম্বর : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ওড়িশার ঘুর্নিঝড় বিধ্বস্ত অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানিতে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন। | ওড়িশার গভর্ণর শ্রী যােগেন্দ্র সিংহের কাছে প্রেরিত এক তারবার্তায় জনাব আহমদ বলেন, এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে তাতে আমার সরকার ও আমার দেশের জনসাধারণ গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন। বিগত বছর সমুহে বাংলাদেশে এই জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের যে বর্ণনাতীত দুর্দশা হয়েছিল, ওড়িশার বিপর্যয় আমাদের সেই দিনগুলাের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
| এই বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের প্রতি আমি আমার সরকার ও আমার দেশের জনসাধারণের পক্ষ থেকে গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। এই পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য আল্লাহ আপনাদের শক্তি ও সাহস দিন, এটাই আমার প্রার্থনা।”
|
অমর বাংলা ॥ ১:১ # ৪ নভেম্বর ১৯৭১
চৌধুরীর চরমপত্র
গতকল্য অধিক রাত্রে মুজিবনগর থেকে প্রাপ্ত অপর এক খবরে জানা যায় যে নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী পাক হাইকমিশনার জনাব সাজ্জাদ হায়দারের কাছে ৪৮ ঘণ্টা মেয়াদী এক চরমপত্র দিয়েছেন। এই চরমপত্রে পাক হাইকমিশনের বাঙ্গালী কর্মচারী জনাব হুসেন আলীর মুক্তির দাবী পূরণ করা হয়, তবে বাংলাদেশ মিশন পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এই চরমপত্রের মেয়াদ অদ্য বেলা ১২টা পর্যান্ত থকবে।
অমর বাংলা ॥ ১:১ [ ৪ নভেম্বর ১৯৭১
ওড়িশার ঝড়ে প্রধান মন্ত্রীর তারবার্তা
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ গত শনিবারের ঘূণিঝড় ও জলােচ্ছাসে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের উপকূলবর্তী অঞ্চলে জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করেছেন। ওড়িশার রাজ্যপালের নিকট প্রেরিত এক তারবার্তায় তিনি বলেছেন, দূর্গতদের প্রতি আমার জনগণ ও সরকারের মনােভাব প্রকাশের ভাষা নেই। বিগত বছরগুলােতে বাংলাদেশ এই জাতীয় ঘটনায় আমাদের যে বর্ণনাতীত দুর্দশা ঘটেছে, ওড়িশার বিপর্যয় সেই কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।
জয়বাংলা (1) ১ ৪ ২৬ if ৫ নভেম্বর ১৯৭১
স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই বাংলাদেশ মানবে না।
মালেক উকিল
জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব আব্দুল মালেক উকিল গত সােমবার সুইডিশ ব্রডকাষ্টিং কর্পোরেশনের প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশের কাছে আর কোন কিছুই গ্রহণযােগ্য হবে না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ধারা আলােচনা করে বাংলাদেশ ও ভিয়েৎন্নাম যুদ্ধের চারিত্রিক পার্থক্য বিশ্লেষণ করেন। | তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না কারন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত যুবক এবং শ্রমিক, বণিক, কৃষক দেড় হাজার মাইল দূর থেকে আগত হানাদার দখলকারের বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানছে।
জয়বাংলা (১) | ১ ২৬ f৫ নভেম্বর ১৯৭১
সমাধান সম্ভব নয়।
দিল্লী মিশন
দিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন যে, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিলে বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান এখনাে সম্ভব।
জনাব চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে শান্তি। দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে জনাব চৌধুরী বলেন, ‘পাকিস্তানের কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সম্ভব নয়।’
| ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারী জেনারল উথান্টকে পাক-ভারত সফরে আমন্ত্রণ প্রসঙ্গে জনাব চৌধুরী বলেন, ইয়াহিয়া খান এখন, শান্তির কথা বলছেন। তার কারণ, ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার ‘পরিকল্পিত হঠকারিতা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, এখন তিনি বুঝতে পারছেন, এতে তার নিজের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
| জনাব চৌধুরী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “আমরা স্বাধীনতা অর্জনে ওয়াদাবদ্ধ। এরই জন্য আমরা লড়াই করছি এবং আমরা পাক বাহিনীকে লাথি মেরে বাংলাদেশ থেকে তাড়াব।’
সম্প্রতি এক ইটালীয় টেলিভিশন সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে তিনি উপরােক্ত মন্তব্য করেন।
মুক্তিবাহিনীর সংগঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর মধ্য থেকে মুক্তিবাহিনীর লােক সংগৃহীত হয়। এখন পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর চরম আঘাত হানার মতাে ক্ষমতা হয়েছে।’
জনাব চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ট্রেনিং নিচ্ছে এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্য সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।
তিনি বলেন যে, প্রচুর সংখ্যক যুবক মুক্তিবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
শরণার্থীদের মধ্য থেকে মুক্তিবাহিনীর লােক সংগ্রহ করা হয় কি না এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি । বলেন, বাঙ্গালীমাত্রেই মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিতে উদগ্রীব । আমরা সবাই মুক্তি বাহিনীর সদস্য।
| জয়বাংলা (১) | ১: ২৬ ৪ ৫ নভেম্বর ১৯৭১
কষ্ট সহ্য করে এগিয়ে যেতে হবে
এখােন্দকার মােশতাক আহমেদ।
২রা নভেম্বর, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব খােন্দকার মােস্তাক আহমদ বাংলাদেশের মুক্তিসেনাদের ৯নং সেক্টর পরিদর্শন শেষে মুক্তি যােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, “আমি প্রতিমুহূর্তে উপলব্ধি করছি তােমাদের নিদারুণ কষ্টের কথা, আমি জানি তােমরা ঠিকমত খাওয়া পর্যন্ত পাচ্ছ না। কিন্তু বিদেশ থেকে আমরা যা সাহায্য পাচ্ছি তার পরিমাণ হচ্ছে সামান্য।”
অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি বলেন, “তােমাদের মত আমরাও এক ছেলে রনাঙ্গণে যুদ্ধ করছে তার সংবাদ পর্যন্ত আমি জানিনা। তােমরাও আমার সন্তানের মত প্রিয় । তােমাদের দেশের মা-বােন, বাপভাইর উপর হানাদাররা অকথ্য নির্যাতন করেছে, একথা মনে রেখেই সমস্ত কষ্ট হাসিমুখে জীবনের পাথেয় বলে মনে করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে।”
তিনি বলেন, “তােমরা শপথ নাও জীবনের বিনিময়েও তােমরা মুক্তিসেনার দায়িত্ব যথাযােগ্য রক্ষা করবে।” একথায় মুক্তিসেনারা হাত তুলে শপথ নেয় আবার নতুন করে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ £ ১ ১২ ! ৭ নভেম্বর ১৯৭১
‘স্বাধীনতা ছাড়া আপােষ নেই’
উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্ত
মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির এক বৈঠকে “স্বাধীনতা ছাড়া কোন আপােষ নেই” বলে এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহন করা হয়। তা ছাড়া সভায় ইয়াহিয়া সরকারের বর্তমান যুদ্ধ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার অভিসন্ধি বলে অভিহিত করা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদানের দাবী জানিয়েছেন এবং অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে অসামরিক শাসন প্রবর্তনে ইয়াহিয়ার অপচেষ্টার কঠোর নিন্দা করেছেন।
আমার দেশ ১; ১১ # ১১ নভেম্বর ১৯৭১
মুজিবনগর সন্তুষ্ট
বাংলা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ, এইচ, এম, কামারুজ্জামান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সাংবাদিক সম্মেলন সম্পর্কে মন্তব্য করে মুজিবনগরে বলেন যে, ভারত ও ভারতের মহান জনগণ বাংলা দেশের ব্যাপারে যে ভূমিকা নিয়েছেন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী সেজন্য চিরদিন তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবেন।
| শ্রীমতি গান্ধী বাংলাদেশের জনগণ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনের কথাই বলেছেন। বাংলাদেশ সমস্যা বাংলাদেশের গণ প্রতিনিধিদের সঙ্গেই মেটাতে হবে। যুদ্ধ বাধিয়ে এই সমস্যার কোন সমাধানই হবে না।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৪ ১১ নভেম্বর ১৯৭১
আবার ঝড় : প্রধানমন্ত্রীর বাণী
১৯৭০ সনের ১২ই নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের ক্ষতিচিহ্নের দাগ না শুকুতেই একই অঞ্চল দিয়ে পুনরায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেল। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নােয়াখালী এবং দ্বীপাঞ্চলের কুতুবদিয়া মহেশখালীর উপর দিয়ে বীভিষিকার কালাে রাত নেমে এসেছিল।
গত ৬ই নভেম্বর বাংলাদেশের সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের দরুন বহু লােকের মৃত্যু ও বিপুল সম্পত্তি বিনাশ হয়েছে।
কক্সবাজারের দক্ষিণ অঞ্চল এবং চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলেও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নােয়াখালী জেলার রামগতি ও হাতিয়া দ্বীপের সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও কলমপুরচরও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘণ্টায় একশাে মাইলের বেশী বেগে ঘুর্ণিঝড় বয়ে যাওয়ার ফলে বহু ঘরবাড়ী ধ্বংস হয়ে গেছে । বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের তার ছিড়ে পড়ে গেছে।
গত বছর এই সব অঞ্চলেই ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসের দরুন ছয় লক্ষ লােকের মৃত্যু ঘটে।
প্রধানমন্ত্রীর সমবেদনা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এক বিবৃতিতে বলেন, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার এবং বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে পুণরায় ঘুর্ণিঝড়ের বিপর্যয়ে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের পর পাক সৈন্যবাহিনীর অত্যাচারে জনগণ জর্জরিত হয়েছেন। এখন এ-সব অঞ্চলেই আমার ভাইয়েরা নতুন এক বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন। শােকসন্তপ্ত পরিবারবর্গ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রতি আমি আন্তরিক সহানুভূতি জানাচ্ছি। আমাদের জনগণ ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতা দিয়ে এই বিপর্যয়ের মােকাবেলা করার। শক্তি অর্জনে সক্ষম হবেন। এই সব অঞ্চলের দুর্গত জনগণকে অবিলম্বে সাহায্য দেবার জন্য বাংলাদেশের সমাজসেবী এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির কাছে আমি আবেদন জানাচ্ছি।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৭ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
জঙ্গী চক্রের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করার আহ্বান
মুজিবনগর, ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটি আজ ইয়াহিয়া খার যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ভারত আক্রমণের প্রকাশ্য সিদ্ধান্তের কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অভিসন্ধি বলে অভিহিত করেছেন।
কমিটির সভায় প্রস্তাব নেওয়া হয় যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের একমাত্র লক্ষ্য পূর্ণ স্বাধীনতা, হানাদারদের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরােধ বাহিনী দিন দিন যে সাফল্য অর্জন করেছেন তা থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র ফিরানােই পশ্চিমা শাসকচক্রের উদ্দেশ্য। দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও স্বাধীনতা যােদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানান হয়েছে। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ। এছাড়া সভায় জনাব মনসুর আলি, আবদুস সামাদ আজাদ, অধ্যাপক মুজাফর আহমেদ, শ্রীমনােরঞ্জন ধর, শ্রীমণি সিং উপস্থিত ছিলেন। জননেতা মৌলানা ভাসানী অসুস্থতার জন্য এ সভায় উপস্থিত হতে পারেননি।
কমিটি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করেছেন, এছাড়া বাংলাদেশ প্রশ্নে সরকম সাহায্য ও সহযােগিতার জন্য ভারত সরকার ও জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানানাে হয়েছে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ১: ১৩ ১৪ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ সর্বহারার বাংলাদেশ হবে শােষণহীন এবং ধর্মনিরপেক্ষ
কামরুজ্জামান
১১ই নভেম্বর, মুজিবনগর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান সরকারের নীতি স্পষ্ট ঘােষণা করে বলেন, পাকিস্তান কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নয়। বাংলাদেশ আজ এক অতি বাস্তব সত্য।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ হবে শােষণবিহীন, বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রকে নির্মূল করা হবে—শােষক শ্রেণীকে ধ্বংস করে সর্বহারা মানুষকে স্থান করে দেওয়া হবে। শরণার্থীদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের প্রথম কাজ হবে ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ও নিজ নিজ বাসভূমিতে পুনঃপ্র
ভারতের অবিস্মরণীয় বন্ধুত্বের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী করার জন্য উপযুক্ত কর্মনীতি গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া যে সব দেশ ভারতের বন্ধু বলে বিবেচিত ও স্বীকৃত, সেইসব দেশকেও বাংলাদেশ মিত্র রাষ্ট্র বলে মনে করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পৃথিবীর শােষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বপক্ষে ও সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে শােষিত মানুষের মুক্তির ক্ষেত্রে সােভিয়েট ইউনিয়নের অবদান অনস্বীকার্য্য বলে মন্তব্য করেন। তিনি সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন রাখার প্রতি বিশেষ করে জোর দেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ১৩ ॥ ১৪ নভেম্বর ১৯৭১
ঐক্যবদ্ধভাবে চূড়ান্ত আঘাত হানিয়া শত্রুকে পর্যুদস্ত কর
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
যে-স্বাধীনতার বেদীমূলে ‘অগণিত দেশবাসী অকাতের আত্মবলি দিয়াছেন উহার প্রতি বেইমানী বরদাশত করা হইবে না।
বাঙলাদেশ সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ ঐক্যবদ্ধভাবে চরম আঘাত হানিয়া পাক জঙ্গীশাহীর ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করার জন্য সমগ্র জনগণ ও সকল মুক্তি সংগ্রামীর প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। উপদেষ্টা পরিষদ বাঙলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আপসহীন লড়াইয়ের সঙ্কল্প পুনরায় ঘােষণা করেন এবং যে-স্বাধীনতার জন্য অগণিত দেশবাসী অকাতরে আত্মদান করিয়াছেন উহার সহিত কোন অবস্থাতেই বেইমানী করা হইবে না বলিয়া ওয়াদা করেন।
উপদেষ্টা পরিষদ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহায়তার জন্য ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা। জ্ঞাপন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার প্রশংসা করেন।
গত ৬-৭ নভেম্বর মুজিব নগরে অনুষ্ঠিত বাঙলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উপরােক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অভিমত প্রকাশ করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বাঙলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এবং অংশগ্রহণ করেন বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির শ্রীমণি সিং, আওয়ামী লীগের জনাব আবদুস সামাদ আজাদ ও শ্রীফণী ভূষণ মজুমদার, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ও কংগ্রেস নেতা শ্রী মনােরঞ্জন ধর। ইহা ছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ ও সভায় যােগদান করেন। | বৈঠকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগতি পর্যালােচনা করিয়া সর্বসম্মতিক্রমে নিম্ন লিখিত প্রস্তাবসমূহ গ্রহণ করা হয় । (১) কমিটি মনে করে যে, ইয়াহিয়ার যুদ্ধবৎ প্রস্তুতি ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধানাের প্রকাশ্য
পাঁয়তারা বাঙলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন ও দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরােধের ক্রমবর্ধমান সাফল্য হইতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরানােরই একটি কুমতলব। কমিটি শত্রুর
স্পষ্টত দৃশ্যমান দুর্বলতাসমূহের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ এবং শক্রর পতন দ্রুততর করার উদ্দেশ্যে তাহার উপর এক্যবদ্ধ ও চরম আঘাত হানার জন্য সকল শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের
মানুষ এবং সকল স্তরের মুক্তি সেনানীদের প্রতি আহ্বান জানাইতেছে। (২) কমিটি সভ্যতার সকল নিয়ম কানুন ভঙ্গ করিয়া শেখ মুজিবর রহমানকে অব্যাহতভাবে
আটক রাখার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করিতেছে এবং বাস্তবকে স্বীকার করিয়া লইয়া অবিলম্বে
বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানাইতেছে। (৩) কমিটি জালিয়াতিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত বে-সামরিক শাসনে
প্রত্যাবর্তনকে শঠতা বলিয়া মনে করে। ইহা শুধু তাহাদেরকেই মুগ্ধ করিবে যাহারা ইহাকে বিশ্বাস করার ভান করে বা বিশ্বাস করিতে ইচ্ছুক।
(৪) কমিটি ভারতের জনগণ ও সরকারকে বাঙলাদেশের প্রশ্নে তাহাদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের
জন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতেছে এবং বাঙলাদেশ প্রশ্নে সােভিয়েত ইউনিয়নের নীতির প্রশংসা
করিতেছে। (৫) কমিটি সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ন্যায্যতার প্রতিনিধিত্বকারী গণপ্রজাতন্ত্রী
বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিশ্বের সরকারসমূহের প্রতি আবেদন জানাইতেছে। (৬) কমিটি লক্ষ্য করিতেছে যে, কতিপয় দেশ বাঙলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল হইলেও
তাহাদের মনােভাব প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত। কমিটি ন্যায়, গণতন্ত্র ও মুক্তির পক্ষে তাহাদেরকে
আরও সােচ্চার হইয়া আগাইয়া আসার আহ্বান জানাইতেছে। (৭) যে-সব দেশের সরকার ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ দিয়া বাঙলাদেশে
গণহত্যায় সাহায্য করিতেছে, কমিটি সেই সব দেশের জনগণের প্রতি আবেদন জানাইতেছে, তাহারা যেন বাঙলাদেশের ব্যাপারে তাহাদের সরকারের এই নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ
বন্ধ করেন। (৮) কমিটি পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার সঙ্কল্প পুনরায় ব্যক্ত করিতেছে এবং
স্বাধীনতার কমে সমাধানের নিমিত্ত প্রদত্ত সকল বক্তব্য ও ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করিতেছে। স্বাধীনতার জন্য যাঁহারা জীবন দিয়াছেন, তাঁহাদের ত্যাগ স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে কমিটি ঐসব নিহত বীরদের সহিত সংহতি ঘােষণা করিতেছে এবং শপথ গ্রহণ করিতেছে যে, যে কারণে তাঁহারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, উহার সহিত কখনও বিশ্বাস ভঙ্গ করা
হইবে না। শেষ দুইটি প্রস্তাবে কমিটি নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তানী হাইকমিশনে আটক জনাব হােসেন আলী ও তাঁহার স্ত্রী-কন্যাদের মুক্তি দাবি করে এবং ওড়িষ্যার প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থদের প্রতি গভীর সহানুভূতি জ্ঞাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধ ! ১ : ১৯ ৪ ১৪ নভেম্বর ১৯৭১
জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের প্রতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির আহ্বান
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
দিল্লীর পাকিস্তানী দূতাবাসের কর্মচারী জনাব হােসেন এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জীবন রক্ষার জন্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিশ্ব সংস্থার কাছে আবেদন জানিয়েছেন। জনাব আলী এখনও দিল্লীস্থ পাক দুতাবাসে বন্দী জীবন যাপন করছেন।
জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের কাছে প্রেরিত এক তার বার্তায় অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান সরকারের দূতাবাসগুলােতে বাঙালী কর্মচারীদের ওপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার নিন্দা করতে আহবান জানিয়ে একে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের গণহত্যা এবং নির্যাতনের সম্প্রসারিত রূপ বলে অভিহিত করেছেন। বাঙালী কর্মচারীদের ওপর নির্যাতনের চিত্রও তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে।
| অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জনাব হােসেন আলী এবং তার পরিবারের সদস্যদের মুক্তির জন্যে সেক্রেটারী জেনারেলকে হস্তক্ষেপ করতে অনুরােধ করেছেন।
| জাতীয় বাংলাদেশ | ১:১৮ ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
আমরা চীনের সাহায্য আশা করি
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত, নিগৃহীত ও শােষিত মানুষ তাদের জাতীয় মুক্তি। সংগ্রামে চীনের সাহায্য চায়। চীনের জাতিসঙ্ঘভুক্তি উপলক্ষ্যে চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর কাছে প্রেরিত এক অভিনন্দন বাণীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
| অভিনন্দন বাণীতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, এটা এমন একটা জাতির বিজয় যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে। | অভিনন্দন বাণীতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আরাে বলেন, বাংলাদেশের জনগণও আও অনুরূপ একটি সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়ােজিত রয়েছে। সুতরাং তাদের স্বাধীনতা ও স্ব-শাসনের এই সংগ্রামে তারা চীনের সাহায্য আশা করে।
জাতীয় বাংলাদেশ [ ১ : ১ [ ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
নেপালের জনগণ বাংলাদেশকে সমর্থন করছে।
আবদুল মালেক উকিল
নেপালে পক্ষকালব্যাপী কূটনৈতিক সফর সমাপ্ত করে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল মুজিবনগরে ফিরে এসেছেন। পার্লামেন্ট সদস্য জনাব আবদুল মালেক উকিল, শ্রীসুবােধ কুমার মিত্র এবং জনাব আবদুল মােমেন তালুকদার প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন।
প্রতিনিধিদলের নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল মুজিব নগরে আমাদের প্রতিনিধিদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এ সফরকে ‘অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেন।
জনাব আবদুল মালেক উকিল বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপালের মন্ত্রী, সাংবাদিক, ছাত্র। নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ প্রশ্ন এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে বিষদ আলােচনা করেন। তিনি বলেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নেপালের সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সগ্রামের প্রতি সার্বিক সহানুভূতি ও সহযােগিতা প্রকাশ করেন। | প্রতিনিধিদল এছাড়া নেপাল প্রেস ক্লাব সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা এবং জনগণের ওপর সেনা বাহিনীর নির্যাতনও পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তি বাহিনীর কার্যক্রম সম্বলিত বাংলাদেশ সরকারের পুস্তক প্রদান করেন।
জাতীয় বাংলাদেশ # ১ : ১ / ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
রৌমারীতে রেজিষ্ট্রেশন অফিস
| [ জোনাল অফিস সূত্র ||
রৌমারী থানা ও এর সংলগ্ন অন্যান্য থানার মুক্ত অঞ্চলগুলির রেজিষ্ট্রেশন ভিত্তিক অসুবিধা মােচনের জন্য বাংলাদেশ সরকার রৌমারীতে রেজিষ্ট্রেশন অফিস স্থাপন করেছেন বলে সংবাদে প্রকাশ। আসন্ন ঈদের বন্ধের পর থেকে এই অফিসের কার্য আরম্ভ হবে। দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশিত একটি রেজিষ্ট্রেশন অফিস যা পাক সরকার পূরণ করতে পারে নাই তা আজ স্বাধীন বাংলা সরকার পূরণ করে
| এই বিরাট অঞ্চলের জন সাধারণের দীর্ঘদিনের অসুবিধা দূর করছেন। এ সংবাদটা এ অঞ্চলের জন। সাধারণের জন্য নিশ্চয়ই সুখবর এবং অভিনন্দনীয়।
অগ্রদূত [ ১ : ১২ ॥ ১৭ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ-পাকিস্তান আলােচনা প্রসঙ্গে প্রচারিত সংবাদ ‘দুরভিসন্ধিমূলক’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহমেদ সম্প্রতি ইউ পি আই এর সাথে এক সাক্ষাঙ্কারে বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে আলােচনা সংক্রান্ত প্রচারিত সংবাদ মিথ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক। বাংলাদেশের সরকারী ও বেসরকারী কোন স্তরের নেতৃবৃন্দই কলিকাতা বা অন্য কোন | দেশস্থিত মার্কিন কূটনীতিকদের মাধ্যমে কোন রকম প্রস্তাব বা আশ্বাস কখনও পাননি। কাজেই ইয়াহিয়া খা বা তার প্রতিনিধির সাথে আলাপ আলােচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না। | পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর পূর্ব ঘােষণার পুনরুক্তি করে বলেন : পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের লক্ষ্য। যারা | বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী কাজে নিয়ােজিত তাদের প্রতি আমাদের। অনুরােধ, আমাদের জন্য যদি কিছু না করতে পারেন তবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের অন্ততঃ মৃত্যুবরণ। করতে দিন।
অভিযান ॥ ১:১ ১৮ নভেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেবার অপচেষ্টা মাত্র
ইয়াহিয়া-চক্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির অভিমত
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং ভারতের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের প্রকাশ্য হুমকীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অভিসন্ধি বলে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটি মন্তব্য করেছেন। | ৬ই নভেম্বরে মুজিব নগরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের এই অভিসন্ধির আরেকটি অর্থ হল হানাদারদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরােধ বাহিনী ক্রমবর্ধমান হামলা চালিয়ে যে সাফল্য অর্জন করেছেন, তা থেকে সকলের দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নেওয়া। | কমিটির সভায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা। | পর্যালােচনা করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের ঐ দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করার জন্য বাংলাদেশের সমস্ত শ্ৰেণী, সম্প্রদায় এবং স্বাধীনতা যােদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। শক্রর দুর্বলতার পূর্ণ সুযােগ নিয়ে তাকে খতম করার আবেদনও জানানাে হয়েছে।
| বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং এই লক্ষ্যের | প্রতি তাদের অদম্য সঙ্কল্পের কথাও কমিটির প্রস্তাবে পুনরায় উল্লেখ করা হয় ।
বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন। | সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমেদ, অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব | এ, এইচ, এম, কারুজ্জামান, এবং জনাব আবদুস সামাদ, শ্রী ফণীভূষণ মজুমদার (আওয়ামী লীগ), অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি), শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস) ও শ্রী মণি সিং (বাংলাদেশ কমুনিষ্ট পার্টি) উপস্থিত ছিলেন।
অসুস্থতার দরুণ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভায় উপস্থিত হতে পারেন নি। | কমিটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তিদানের দাবী জানিয়েছেন। এবং অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে অসামরিক শাসন প্রবর্তনে ইয়াহিয়া খানের অপচেষ্টার নিন্দা করেছেন।
কমিটি গণ-প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতার জন্য কমিটি ভারত সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
জয়বাংলা (১) [ ১ : ২৮ | ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
খুনী ইয়াহিয়ার সাথে আলাপ-আলােচনার কোন প্রশ্নই উঠেনা স্বার্থবাদী মহলের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার জবাবে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আহমেদ এক বিশেষ সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে দৃঢ়তার সাথে ঘােষণা করেন যে ‘ইয়াহিয়া খান বা তার কোন প্রতিনিধির সাথে কোন রকম আলােচনা শুরুর প্রশ্নই উঠতে পারে না।’
খন্দকার মােস্তাক আহমেদ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘােষণা করেন যে, বাংলাদেশের যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ণ স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানান যে, বাংলাদেশ নেতৃত্ব সরকারী বা বেসরকারী কোন পর্যায়েই কলকাতায় মার্কিন কূটনীতিগণ বা অন্য কোনও লােকের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছ থেকে কোন রাজনৈতিক টোপ বা বাণী পান নি। তিনি এ ধরণের প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা সরাসরি অস্বীকার করেন।
খন্দকার মােস্তাক আহমেদ বলেন, কলকাতায় মার্কিণ কুটনীতিকদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বা স্বয়ং ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে দূতালী করার সংবাদ প্রচারের একমাত্র উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের বন্ধুদের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করা এবং বাংলাদেশ মুক্তি যােদ্ধাদের কৃতীত্বপূর্ণ ও বিরাটতর সাফল্যের মুখে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি আনয়ন ও যুদ্ধের ব্যাপারে তাদেরকে উদাসীন করে তােলা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট স্বার্থবাদী মহলের প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, আপনারা যদি আমাদের বাঁচার জন্য কিছু করতে না পারেন, তা হলে অন্ততঃ আমাদের স্বাধীনতার জন্য মরতে দিন। বাংলাদেশের মানুষের রক্তস্রোতকে শক্তি শিবিরের স্বার্থে বা অন্যদের উপর প্রভাব রাখার কাজে ব্যবহার করবেন না।’
যারা বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আলােচনার সংবাদ প্রচার করেন তারা পাকিস্তানেরই। বন্ধু এবং দূরভিসন্ধি নিয়েই তারা তা করে থাকেন বলে খন্দকার মােস্তাক মন্তব্য করেন। | উপসংহারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর প্রতি যে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছে বাংলার বীর মুক্তিবাহিনী সেই অস্ত্রের ভাষাতেই তার। সমুচিত জবাব দিচ্ছে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই অস্ত্রের ভাষাতেই জাবাব দিতে থাকবে।
জয়বাংলা (১) ১ : ২৮ | ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
এই ঈদে আমাদের প্রার্থনা হােক ….’
গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ঈদ বাণীতে বলেন : ‘আমাদের দেশে এবারে ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শক্রসৈন্যের তাণ্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন, মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন-হারানাের শােক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প। | গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জন সাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্তকরব। আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথা সর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত, তার চুড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়ােগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হােক আমাদের প্রার্থনা।’
জয়বাংলা (১) ১ : ২৮ | ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
এ বৎসরেই ঢাকায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে
কর্ণেল ওসমানী
অতি সম্প্রতি একটি প্রভাবশালী ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকার এক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাঙ্কারে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেন যে, আমাদের মুক্তিবাহিনী এখন এত দ্রুততার সঙ্গে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে অগ্রসর হচ্ছেন যে, আশা করা যায় এ বৎসর শেষ হওয়ার আগেই ঢাকার বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবােজ্জ্বল পতাকা উডঙীন হবে। | তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনী এখন স্থল, নৌ এবং বিমানবাহিনী দ্বারা সজ্জিত এবং ইতিমধ্যেই নৌ। বাহিনীর ডুবুরী গেরিলারা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। এখন বাংলাদেশের টাঙ্গাইল, যশাের, খুলনার সুন্দরবন, নােয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, রংপুর ইত্যাদি অঞ্চলে ২৫,০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্তিবাহিনী অসম সাহসী যােদ্ধারা মুক্ত করেছেন এবং এসমস্ত অঞ্চলে বেসামরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ * ১ : ১৪ # ২১ নভেম্বর ১৯৭১
মিজানুর রহমানের উত্তর অঞ্চল সফর
| বাংলাদেশে সরকারের উত্তর বিভাগের প্রশাসনিক চেয়ারম্যান জনাব মিজানুর রহমান এম এল এ সম্প্রতি ফুলবাড়ী, সােনাহাট, হাতীবান্দা, পাটগ্রাম প্রভুতি থানা সফর করেন এবং কতিপয় জনসভায়। ভাষণ দেন। তিনি জনতাকে আরও ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। সভাসমূহে অংশগ্রহণকারী সকলে। পবিত্র বাংলাদেশের মাটি থেকে পাক হানাদারদের নির্মূল করার জন্য একবাক্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১ : ১৪ | ২১ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক বিষয়ে কর্মসূচী নিচ্ছেন
ঢাকা ২২শে নভেম্বর : মুজিবনগর থেকে আমাদের “বাংলাদেশ প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ ও সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক কাঠামাে সম্পর্কে এখন থেকেই সুনির্দিষ্টভাবে চিন্তা করছেন এবং এই বিষয়ে তারা ইতিমধ্যে বেশ কিছু আলােচনাও সেরে ফেলেছেন। মুক্ত বাংলাদেশে যাতে যথাশীঘ্র আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় তার। জন্য পার্লামেন্টারী, আইন ও পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী জনাব খােন্দকার মােশতাক আহম্মদ সাহেব তার। সহকর্মীদের সহযােগিতায় যথাযােগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলেছেন।
বাংলাদেশ (১) # ১ : ২২ [ ২২ নভেম্বর ১৯৭১
যুব সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী
ঈদ উপলক্ষে মুজিববাহিনীর এক যুবসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী জবাব তাজুদ্দীন আহমেদ ভাষণ দান করেন। প্রধানমন্ত্রী মুক্তি বাহিনীর জন্য ধন্যবাদ … যে সকল দল বল … এদেশের সমর্থন জানাচ্ছেন তাদের সকলকেই দলমত নির্বিশেষে একযােগে কাধে কাধ মিলিয়ে সংগ্রামে অংশ নিতে হবে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আশু বিজয়ের কথা উল্লেখ করেন।
উত্তাল পদ্মা ! ১ : ১ | ২৪ নভেম্বর ১৯৭১
ইন্দিরার প্রতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন
| (নিজস্ব সংবাদদাতা)
‘বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ব জনমত গঠনের অভিপ্রায়ে বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশ হতে সফর শেষে বাংলাদেশের নিকটতম বন্ধু ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে পৌছলে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দুত প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীকে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম লিখিত অভিনন্দন বাণীটি অর্পণ করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এতে ভারতীয় প্রধান মন্ত্রীকে তার শ্রম সাধ্য সফরের জন্যে অভিনন্দিত করেছেন। বাণীতে বলা হয়, “মহােদয়া বিশ্বের দরবারে মানবজাতির বিবেকবাণী সরূপ দীর্ঘ এবং শ্রম-সাধ্য সফরে শেষে আপনার প্রত্যাবর্তনে আমাদের জনগণ, সরকারের তরফ হতে ও ব্যক্তিগত ভাবে আপনাকে আন্তরিক সম্বর্ধনা জানাচ্ছি। আমাদের জনগণের জন্য আপনি যা করেছেন কখনাে আর কেউ অন্য দেশের অত্যাচারি জনগণের লক্ষ্য পূরণে এতটা। করেনি।”
উত্তাল পন্ন ॥ ১:১ # ২৪ নভেম্বর ১৯৭১
জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী ‘একযােগে সর্বাত্মক আঘাত হানুন
মুজিবনগর, ২৩শে নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে বলেন “বাংলাদেশের সর্বত্র বর্বর পাক সেনাদের উপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে ক্রমশঃ তীব্রতর হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসী তা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণে শত্রু সেনারা সবদিক দিয়ে আজ বিপর্যন্ত। জলে-স্থলে
অন্তরীক্ষে তারা আজ ক্রমশঃ পিছু হটতে শুরু করেছে। নদী পথের মধ্যে চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দরে নৌগেরিলাদের দুঃসাহসী আক্রমণে উল্লেখযােগ্য পরিমাণ জাহাজ ধ্বংস হওয়ায় বন্দর দুটি কাৰ্যতঃ অকেজো হয়ে পড়েছে।
পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অত্যাসন্ন। | মুক্তিবাহিনীর চমকপ্রদ সাফল্যের সাথে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছে। সমগ্র মুক্তাঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত প্রচণ্ড আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অত্যাসন্ন। বাংলাদেশে নির্বিচার গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠন চালাতে গিয়ে জঙ্গীশাহী পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। বিশ্বব্যাপী কুটনৈতিক পরাজয় এবং বাংলাদেশে পাকবাহিনীর পতনােন্মুখ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কপট ইয়াহিয়া ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাঁধিয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশে তাদের পরাজয়ের গ্লানীকে চাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সফল হবে না। আমাদের মুক্তিবাহিনী পাক বর্বরদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে এবং তাদের নিশ্চিহ্ন করার ক্ষমতা আমাদের করায়ত্ব। | পাকবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধিয়ে কিছুই করতে পারবে না, উপরন্তু নিজেদের আত্মবিনাশ ও আত্মধ্বংসের পথকে প্রসারিত করবে মাত্র।
পশ্চিমা দেশের নীরবতা
| বাংলাদেশ প্রশ্নে পাশ্চাত্য দেশগুলাের নীরবতা লক্ষ্যনীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন দুৰ্বত্ব । | ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যদের গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠনের মতাে ক্ষমাহীন অপরাধকে নীরবে মেনে নিয়েই চুপ থাকেনি, উপরন্তু পাক কশাইদের রক্তকলঙ্কিত হাতে দেদার অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ তুলে দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা ও নির্যাতন দীর্ঘায়িত করেছে।
নিক্সনের এই চালবাজী কেন? | প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন দেয়ার জন্য ভারতের কাছে যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা শুনে আমরা শিউরে উঠেছি। শরণার্থীদের স্বদেশে বসবাস করার অলংঘনীয় অধিকারকে টাকার বিনিময়ে ক্রয় করার মতাে ক্ষমাহীন ঔধ্যত্ব প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি করে দেখালেন। তা আমরা জানিনা। শুধু এখানেই শেষ নয়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বাংলাদেশ সংকটের প্রশ্নে ভারত ও পাকিস্তানে ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন’ প্রেরণের সিদ্ধান্তও ঘােষণা করেছেন। এই মিশন প্রেরণের তাৎপর্য। কি তা আমরা বুঝিনা। দীর্ঘ আট মাস ধরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে মার্কিন কূটনীতিক ও পার্লামেন্ট সদস্যরা যে ওয়াকেফহাল নন তা নয়। তবু প্রেসিডেন্ট নিক্সনের এই চালবাজী কেন? বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাক বর্বরদের ধ্বংস অথবা বিতাড়ন ছাড়া আমাদের কাছে এখন আর কিছুই গ্রহণযােগ্য নয়। পাক পশুদের ধ্বংস করার ক্ষমতা আমাদের আছে এবং আমরা অচিরেই তা প্রমাণ করছি।
সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকুন
| বাংলার মুক্তিযুদ্ধে যেসব বীর যােদ্ধারা শহীদ হয়েছেন এবং যারা পাক বর্বরদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ অভিনন্দন ও সহানুভূতি । শহীদদের রক্তকে
| আমরা বৃথা যেতে দেবােনা। শহীদদের পুত পবিত্র রক্তের পূর্ণ মর্যাদা দেয়ার জন্য শত্রুদের চিরতরে | নির্মূল করার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
মুজিবের বাংলা কায়েম হবে।
বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে যে বাংলাদেশের জন্য আমরা মরণপণ যুদ্ধ করছি সে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে | জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমানাধিকার থাকবে এবং সবাইকে পুনর্বাসন দেয়া হবে।
| বঙ্গবন্ধুর মুক্তির একমাত্র পথ | বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন বাংলার জনক, বাংলার নয়নমণি বিশ্ববন্দিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ শত্রুর কারাগারে আত্মীয় পরিজনহীন নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দী জীবন যাপন করছেন। তাকে শক্রর জিন্দানখানা থেকে মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সকল প্রকার যাতায়াত ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে একযােগে সর্বাত্মক আঘাত হানুন।
আত্মসমর্পণ করুন। | যেসব সরকারী কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সাহিত্যিক বিবেকের বিরুদ্ধে বর্তমানে পাক পশুদের সহযােগিতা করছেন তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
করার সুযােগ গ্রহণ করুন। শক্রদের গােপন তথ্য ফাস করে দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করুন। যারা | শক্রর সাথে হাত মিলিয়ে বাঙ্গালীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন তারা অবিলম্বে নিকটবর্তী
মুক্তিবাহিনীর দফতর অথবা আওয়ামী লীগের অফিসে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন। নতুবা অনুতাপহীন রাজাকার ও দালালরা গ্লানীকর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকুন।
আমার দেশ ॥ ১: ১৩ ৪ ২৫ নভেম্বর ১৯৭১
স্বাধীনতা লাভের দিন সমাসন্ন।
প্রধানমন্ত্রী। (ষ্টাফ রিপাের্টার)
| মুজিবনগর, ২৩ নভেম্বর-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আজ জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে বলেন, “অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতার জন্য লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন বেতার | কেন্দ্র থেকে এই ভাষণ শােনা যায় । | প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার ধারণা অনেক অর্থবহ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মূল্য দেই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি তার উপর। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারকে বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম। তিনি জানান, আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ | প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে সকলের সমানাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনেতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতায় উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশ গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী তার
বেতার ভাষণে বলেন যে, সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন, আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপুত হােক না কেন, বাঙলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই—আর তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন “ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিকসন কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তাঁর দেশের কূটনিতীবিদ ও আইনসভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশলক্ষ বাঙলীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এককোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তাঁরা লাভ করতে চান, তা জানি না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তবে এতে আমদের সংকল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না— সে সংকল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।”
সাপ্তাহিক বাংলা :: ৬ [t ২৫ নভেম্বর ১৯৭১
প্রতিধ্বনি [অভিযান রাজনৈতিক পর্যালােচক
গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ গত ২৩শে নভেম্বরের বেতার ভাষণে বলেছেন, বাঙলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারত পাকিস্তান বিবাদে পরিণত করার। পাকিস্তান কিংবা পাকিস্তানের পৃষ্ঠপােষক সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি দুরভিসন্ধি বাঙলার জনগণের ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মুখে বানচাল হয়েছে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘােষণা করেছেন, “বাঙলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই আর তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা।” এই পূর্ণ স্বাধীনতার দাবীতে বাঙলার জনগণ লড়ছে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে আদায় করেই ছাড়বে!
| প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে আরাে বলেছেন, স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগর্ভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য। নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় আমরা কি মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি তার উপর। তার বক্তব্যের নির্গলিতাৰ্থ, আমরা স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রচুর আত্মত্যাগ করছি এ জন্যে যে তার বিনিময়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধিশালী সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠিত করবাে। একটি সুন্দর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা রচনা করার জন্য আত্মত্যাগ, যে ক্লেশ ভােগ প্রয়ােজন তা আমাদের অবশ্যই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য সম্প্রসারণ করে আরাে কিছু কথা বলা প্রয়ােজন। বাঙলাদেশের কতিপয় মানুষ (যদিও তারা সংখ্যায় অল্প) যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাদের কাছ থেকে যা প্রত্যাশিত ছিলাে সে ধরনের কর্ম কিম্বা আরচণ করেননি। এতাে রক্তপাত, এতাে আত্মত্যাগ, এতাে বীরত্ব ব্যঞ্জুক সংগ্রামেও তারা ক্ষুদ্র স্বার্থের কথা ভুলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের প্রয়াস প্রযত্ন জড়িত করেননি। এখনাে অনেকের কর্ম এবং চিন্তাধারা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের বদলে ক্ষুদ্র আত্মস্বার্থের খাতেই প্রবাহিত হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখের বিষয়। যারা এ ধরনের কাজকর্ম করে যাচ্ছেন, তারা হয়তাে মনে করে থাকতে পারেন, সংগ্রাম এবং নৈরাশ্যের ডামাডােলে অনেকের অনেক অপকীর্তিই ধামাচাপা পড়ে যাবে। স্বাধীন বাঙলাদেশে এর জন্য তাদের কোনােরকম জবাবদিহি করতে হবে না। এ ধারণা পােষণ করে যদি তারা নিশ্চিন্ত বােধ করতে চান, তা হলে বলতে হয়, সময় সবকিছু ফাস করে দেবে। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হওয়া ভালাে।
| আমাদের সংগ্রামের লক্ষ্য স্বাধীনতা। স্বাধীনতা পেলেই আমাদেরকে শান্তি সম্প্রীতিতে ভারপুর একটি সমৃদ্ধিশালী সমাজ নির্মাণে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। শুরু থেকেই আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ
সে লক্ষ্যে ধাবিত করা উচিত। চিন্তার একমুখীতা কাজে শৃঙ্খলা আনবে। নচেৎ এলােমেলো চিন্তা, বিশৃঙ্খলা ডেকে আনবে। তার ফলে সমাজে একটা অরাজকতা আসা মােটেই অস্বাভাবিক নয়। শুরুতেই বিচার বিশ্লেষণ না করে সামাজিক শক্তিগুলােকে যদি আপন গতিবেগে বাড়তে দেয়া হয়, তা হলে সামাজিক শান্তির আশা সুদূর পরাহত। এখন থেকেই রণাঙ্গনে, গেরিলা এ্যাকশনে, মুক্তি যােদ্ধাদের সাধারণ মানুষের প্রতি আচরণে, রাজনৈতিক শক্তি এবং সামরিক শক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা, প্রীতি, সংযম এবং বিচার বােধ জাগরিত করা একান্ত প্রয়ােজন। | কেননা আজকের যুদ্ধচলাকালীন অবস্থার মধ্যে আমরা যে বীজ রােপন করছি, ভবিষ্যতে সেই বৃক্ষই | গজাবে তা’ থেকে।
অভিযান ॥ ১; ২ [ ২৫ নভে’র ১৯৭১।
বিশ্বাসঘাতকার পথ এখনও পরিহার করুন। তা না হলে মৃত্যুর গ্লানিকর শাস্তিই হবে একমাত্র অবশ্যম্ভাবী পরিণতি
বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহম্মদ গত ২৩শে নভেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে এক || বেতার ভাষণে বলেছেন, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর পর্যায়ে উপনীত, যে কোন স্থানে যে কোন। জায়গায় এমন কি শক্রর নিরাপদ অবস্থানের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে | দিতে পারে।
| একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুরা যেমন মার খাচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ও ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ পশ্চিম পাকিস্তানও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙনের মুখে। এ থেকে নিস্তার পাবার জন্য পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে | বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রধান মন্ত্রী ঘােষণা করেন, এর দ্বারা বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহী সুনিশ্চিত পরাজয় | এড়াতে পারবে না অথচ তাদের ভ্রান্ত, অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে, পরিণামে তাদের আত্মবিনাশ | সুনিশ্চিত হবে। | পাকিস্তানের বিদেশী পৃষ্ঠপােষক যারা বাংলাদেশের সংগ্রামকে ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষে চিহ্নিত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটি তা হােল পূর্ণ স্বাধীনতা। সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের সংকল্প, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আর স্বাধীনতা রক্ষার অপরাজেয় শক্তির মধ্য দিয়ে।
| ভারতকে যথেষ্ট অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের পাকাপাকি ভাবে ভারতে। বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্য কোন একটি দেশের প্রস্তাব উল্লেখ করে তাজউদ্দিন বলেন, “এর দ্বারা পর্বতপ্রমাণ অবিচার অন্যায়কে বিনা বাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। তাদেরকে হুশিয়ার করে তাজউদ্দীন আহম্মদ বলেছেন, “শরণার্থীরা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে হাতবদল করা যাবে। তিনি । সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করেছেন শরণার্থীরা সম্মান ও মর্যাদার সাথে জন্মগত অধিকার নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাবেন, সেদিন প্রত্যাসন্ন। তাজউদ্দীন আহম্মদ প্রশ্ন করেন, উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য। প্রেসিডেন্ট নিক্সন একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিক ও আইন সভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি তথ্য জানতে চান? ব্যাপক গণহত্যাকে যারা নিন্দা করেন নি, তারা তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল লাভ করতে চান, তিনি বুঝতে পারেন না। তিনি সুস্পষ্ট ভাবে
ঘােষণা করেন “তাতে আমাদের সংকল্পের ব্যাত্যয় হবে না, সে সংকল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা”।
| প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা লাভের দিনটি আজ নিকটতর হয়েছে। তাই আজ শত্ৰু সংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সাথে সাথে শহীদের রক্তের মর্যাদার উপযুক্ত সমাজ গঠনে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। | তিনি আরও বলেন, “আমাদের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব”।
বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানী জঙ্গী সরকার মুক্তি না দিলে বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হবে। আর তখনই ইয়াহিয়া তুর সত্যের মুখােমুখি হবে বলে তিনি মনে করেন।
পরিশেষে বাংলাদেশের বীর শহীদ ও অকুতােভয় যােদ্ধা, সংগ্রামী জনগণকে যথাক্রমে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন।
যে সব রাজাকার, পুলিশ বা সরকারী কর্মচারী বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তাদেরকে বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করবারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। যারা শত্রু পক্ষের সাথে স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছে তাদেরকে তিনি শেষবারের মত হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন, তা নাহলে পরিণতি একটিই, তা হল গ্লানিকর মৃত্যু।
অভিনি # ১ : ২ ” ২৫ নভেম্বর ১৯৭১
মুক্তাঞ্চলের জনগণের প্রতি পূর্বাঞ্চলীয় প্রশাসনের বক্তব্য।
বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ এলাকা বর্তমানে বীর বাংলার মুক্তিপাগল সেনারা দখল করে। নিয়েছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও গেরিলাদের হাতে মার খেতে খেতে পাক বর্বর সেনারা দিন দিন মনােবল হারিয়ে পিছু হটতে। বাধ্য হচ্ছে। সেদিনও হয়তাে বেশী দূরে নয় যেদিন সমস্ত বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে এবং স্বাধীন। সার্বভৌম ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রূপে বিশ্বের মানচিত্রে সােনালী অক্ষরে “সােনার বাংলা” স্থান পাবে।
বাংলাদেশের যে সকল এলাকা পূর্বে মুক্ত হয়েছে, সদ্যমুক্ত এলাকার সম্মুখে শত্রু সেনাদের বিবর ঘাটি অবস্থিত, সে সকল এলাকার জনসাধারণ নানা অসুবিধার মধ্যে দিনযাপন করছেন। তাদের সুষ্ঠু জীবনধারণ, স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধ কার্যে অগ্রগতির জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রশাসন ব্যবস্থার সহিত মুক্তাঞ্চলের জনগণের সহযােগিতা একান্তভাবে কামনীয়। প্রশাসন। ব্যবস্থার যে অস্থায়ী কাঠামাে এবং কার্য বিবরণ কার্যকরী হতে যাচ্ছে তার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ। বিচার বিভাগ : ‘জনগণ নানাবিধ সমস্যার মধ্যে জীবন যাপন করছেন। নিজেদের মধ্যে কোন বিষয়ে। চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করবেন না। আপনাদের নানাবিধ সমস্যা সম্পর্কে সরকার সম্পূর্ণরূপে সচেতন, আপনার নিকটস্থ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধির নিকট আপনার সমস্যাবলী পেশ করুন। মনে রাখবেন, এ সরকার আপনার দ্বারা গঠিত, আপনার জন্য। পুলিশ বাহিনী : যুদ্ধ কালীন অবস্থায় নিরীহ গ্রামবাসীদের দুষ্কৃতিকারী ও অশান্তি সৃষ্টিকারীদের সম্মুখীন হতে হয়। মুক্তিবাহিনী নামধারী কতিপয় দুষ্কৃতিকারী জনগণের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে পারে। আপনার নিকটেই পুলিশ বাহিনী রয়েছে আপনারই শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য। সুতরাং যখনই কোন দুষ্কৃতিকারী ও অশান্তি সৃষ্টিকারী টাউটের সম্মুখীন হবেন তখনই পুলিশ বাহিনীর হাতে তাদেরকে সমর্পণ করুন।
স্বাস্থ্য বিভাগ : যুদ্ধ কালীন অবস্থায় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা ও গেরিলা বাহিনী ছাড়াও মুক্তাঞ্চলের জনগণ অসাবধনতা বশতঃ যে কোন মুহুর্তে শক্র দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আহত হতে পারে। যে যেখানেই যখনই কোনরূপ গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই তাকে নিকটস্থ বাংলাদেশ সরকারের হাসপাতালে প্রেরণ অথবা নিকটবর্তী ডাক্তারকে সংবাদ দিতে সচেষ্ট থাকবেন। বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা যেমনি একজন মুক্তিযােদ্ধা তেমনি আপনিও একজন মুক্তি সংগ্রামী। সুতরাং আপনার ক্ষতি দেশের ক্ষতি। উন্নয়ন, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও সাহায্য ; দীর্ঘ আট মাস যাবৎ শত্রু সেনারা সােনার বাংলাকে মরণ কামড় দিয়ে শ্মশানে পরিণত করে চলেছে। তদুপরি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর যান-বাহন চলাচল এবং জনাধারণের স্বল্প সময়ে সহজতর উপায়ে সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সহিত যােগাযােগ, এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণের পুনর্বাসন ও সাহায্য করার জন্য উক্ত উন্নয়ন বিভাগের সহিত সহযােগিতা রক্ষা করে চলুন। ক্ষতি নিরূপণ : পাক সামরিক বাহিনীর বর্বর সেনা, বাংলাদেশের মীরজাফর গােষ্টির দালাল, শান্তি কমিটি ও শেষ পর্যায়ে বিশ্বাসঘাতক বাঙ্গালী রাজাকারেরা মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে যে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন ও সর্বশেষে ধ্বংসাত্মক কার্যে লিপ্ত তা আজ সর্বজন বিদিত। বাড়ীঘর লুঠপাট থেকে শুরু করে অগ্নিসংযােগ করতে তারা দ্বিধা করেনি। তদুপরি বর্বর বাহিনীর অসংখ্য গােলাগুলির আঘাতে আজ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল কেন, অধিকৃত অঞ্চলের দিকে তাকালেও, তার পূর্বের স্বরূপ এর অংশও পাওয়া যায় না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আপনার ক্ষতি নিরুপণের দায়িত্ব উক্ত বিভাগের উপর ন্যাস্ত করেছেন। তাই অবিলম্বে আপনার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে উক্ত বিভাগের গােচরীভূত করুন। ব্যবসা ও বাণিজ্য : যুদ্ধকালীন অবস্থায় সাধারণত : উৎপাদন, আমদানী রপ্তানী ইত্যাদি কাজ প্রায়ই বন্ধ। জনসাধারণ অন্যান্য জিনিষ পত্র পাওয়া দূরে থাকুক দৈনন্দিন জীবন ধারণের জন্য নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিষ পত্র উচ্চ মূল্য দিয়েও পাচ্ছে না। তাই সরকার জনসধারণ যাতে ন্যায্য মূল্যে নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিষ পত্র পেতে পারেন তার একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেছেন। ন্যায্য মূল্যের চেয়ে অধিক দাম দিয়ে জিনিষ পত্র কিনবেন না – কালােবাজারী বন্ধ করুন। কালােবাজারীকে ধরিয়ে দিন। মনে রাখবেন কালােবাজারী সামাজিক অপরাধী। শত্রুদের কোন পণ্য ব্যবহার করবেন না। সংযােগ রক্ষাকরী (বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সাহিত) : বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সেনা ও গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা রাত দিন ব্যাঙ্কারে, বনে জঙ্গলে দিন কাটাচেছ। তাদের একমাত্র লক্ষ্য শত্রু সেনাকে খতম করে সামনে এগিয়ে যাওয়া। তাদের এই অগ্রগতির পিছনে আপনাদেরও সাহায্য প্রয়ােজন আছে। শত্রু সেনাদের গােপন খবর আপনার নিকটবর্তী মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরে অবিলম্বে পাঠিয়ে দিন। ভ্রান্তিমূলক খবর দিয়ে শত্রু সেনাদের বিপর্যস্ত করুন। গােলাবারুদ, খাদ্য সামগ্রী ইত্যাদি তাড়াতাড়ি সরবরাহ করে মুক্তি বাহিনীকে যুদ্ধ জয়ে এগিয়ে দিন। তারা আপনাদেরই ভাই– এ দেশ আপনাদেরই শত্রুকে তাড়াতেই হবে, এই পণ নিয়ে যে যেভাবেই পারেন সাহায্য করুন, এর জন্য রয়েছে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সহিত বেসামরিক সংযােগ রক্ষাকারী— অবিলম্বে তাদের সাথে। যােগাযােগ করুন, এক মুহুর্তে নষ্ট করিবেন না। স্বাধীনতা সংগ্রামের আপনিও একজন সৈনিক। তথ্য ও প্রচার : যুদ্ধকালীন অবস্থায় শত্রু সেনাদের গােপন খবর সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আপনার নিকটে যদি কোন মুক্তি বাহিনীর সদর দফতর না থাকে তা হলে তথ্য ও প্রচার দফতরে সামরিক বিষয়ের গােপন খবরাদি সরবরাহ করুন। গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দেবেন না। মনে রাখবেন দেওয়ালেরও কান আছে। জনগণের মনােবল বাড়িয়ে তুলুন। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করুন। কৃষি ও সেচ : দেশের অর্থনৈতিক কাঠামােকে শক্ত করতে হলে প্রথমে প্রয়ােজন কৃষিজাত দ্রব্য প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা। বাংলাদেশের কিছু অংশ এখনও শত্রু কবলিত। কবলিত। অধিক পরিমাণে ধান, পাট ইত্যাদি উৎপাদনে এগিয়ে আসুন। বেসামরিক প্রতিরক্ষা : অসাবধানতাবশতঃ নিরীহ জনসাধারণ যে কোন সময়ে শক্রর শিকার হতে পারেন । অবিলম্বে বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের শরণাপন্ন হউন সাবধানের মার নেই। শিক্ষা : অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস। অবিলম্বে প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায় চালু করা হবে। মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এখনও বিবেচনাধীন। ছােট ছােট শিশুরা যাতে বই পুস্তক নাড়াচাড়া করতে পারে তাতে এগিয়ে আসুন। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। ডাক বিভাগ : মুক্তাঞ্চলে দ্রুত যােগাযােগ ব্যবস্থার জন্য সরকার অনতিবিলম্বে ডাক বিভাগ চালু করছেন। বাংলাদেশের নতুন আঙ্গিকের ডাক টিকিট, খাম, পােষ্ট কার্ড জনগণের ব্যবহারের জন্য প্রচার করা হবে। শুল্ক : অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানী করে সরকারকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করুন এবং সীমান্ত চৌকিতে শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে নিন।
উপরােক্ত বিভাগগুলি ছাড়াও কোষাগার ও রাজস্ব বিভাগও কাজ করতে থাকবে। সময়মত জনগণের নিকট ইহাদের বিস্তারিত কার্য বিবরণ প্রচার করা হবে।
| মুক্তাঞ্চলের জনগণের দায়িত্ব স্বাধীনতার জন্য অনেক। তাই—যে যে ভাবেই পারেন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিন। দুর্নীতিমূলক কাজে লিপ্ত হবেন না কাউকে কারতেও দেবেন না। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীন বাঙালী জাতি হিসবে নিজেকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরবার জন্য তৈরী হউন।
আমার দেশ # ১৩ সংখ্যা | ২৫ নভেম্বর ১৯৭১।
বাঙলার স্বাধীনতা অশ্রু আর রক্তে
—তাজউদ্দীন
অশ্রু আর রক্ত। এরই বিনিময়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলার সাড়ে সাতকোটি নর-নারীর। স্বাধীনতার সংগ্রাম। কালের গতির সাথে সাথে স্বাধীনতার সােনালী সুর্যের ক্ষণটি নিকটতর হচ্ছে। কিন্তু এর জন্যে চাই আরাে রক্ত, আরাে অশ্র, আরাে আত্মত্যাগ আরাে জীবন ও কষ্ট । | গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে এই অভিমত ব্যক্ত করেন। আত্মত্যাগের মহিমার উজ্জ্বল সগ্রামী প্রতিটি নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। এই পর্যায়ে শত্রু সংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে চাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত মর্যাদার বিনিময়ে সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আত্মপন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদের উৎখাত এবং অসাম্যও সুবিধা ভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম। আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। হবাে। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করছেন সেখানে সকলে সমাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশ গ্রহণ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় হিসাবে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমনের সকল পথ রুদ্ধ করে দেয়ার কথা বলেন। জলে
স্থলে অন্তরীক্ষে শত্রুকে আমার চরম আঘাত হানবাে আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখােমুখি হবেন ।
| জনাব তাজউদ্দীন বক্তৃতায় এশিয়ার গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কোন কোন পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মনে হয় মানুষ হিসাবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশী, এটা শােচনীয়। কিন্তু ভারতকে অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেখানে স্থায়িভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোন রাষ্ট্র উত্থাপন করেন। তখন আমরা শিউরে না উঠে পারিনা। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নিরবে মেনে নেয়া হয়েছে। পর্বত প্রমাণ অবিচার ও অন্যায়কে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও তার ব্যাপক বাস্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানী সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন, তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে হাতবদল করা হবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে যেভাবেই ফিরে আসবেন। আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশী দেরি নাই।
প্রসঙ্গত জনাব তাজউদ্দীন আমেরিকার কথা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের এই চরমতম ক্ষণে প্রেসিডেন্ট নিক্সন উপমহাদেশের তথ্য সংগ্রহের জন্যে একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান ; এই হলাে তার জিজ্ঞাসা। তিনি বলেন, তাঁর দেশের কূটনীতিবিদ ও আইন সভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এককোটি মানুষকে বাস্তত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান, জানিনা। তবে এতে আমাদের সঙ্কল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না। সে সঙ্কল্প হল দেশকে শত্রু মুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
জনাব তাজউদ্দীন মুক্তি সংগ্রামের সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সেকথা শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনী এখন যে কোন সময়ে যে কোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে, এমনকি শক্রর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে । জলে স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তি বাহিনীর। নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্থ, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শত্রুমুক্ত। ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য, সামগ্রী ও মনােবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠছে। | তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকসামরিক হুঙ্কার দিশাহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারী নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই সংশয় ও ভীতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছেন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাঙ্গনের দিকে। এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এমন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে। মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গােপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপােষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না। বরং এতে তাদের ভ্রান্তি অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পরিণামে তাদের আত্মবিনাস সুনিশ্চিত হবে।
সর্বশেষে জনাব তাজউদ্দীন জনগণকে মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলার আহ্বান জানান। যেসব সরকারী কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযােগ নেয়ার আহ্বান জানান। শত্রু পক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছে তাদের শেষ বারের মত তিনি জানিয়ে দেন যে, বিশ্বাস ঘাতকতার পথ পরিহার করুন। অনুতাপহীন বিশ্বাস ঘাতকদের আর তাদের বিদেশী প্রভূদের পরিণতি এক হবে—আর তা হলাে গ্লানিকর মৃত্যু।
| বাংলার মুখ ॥ ১: ১০ [ ২৬ নভেম্বর ১৯৭১
স্বাধীনতা লাভের দিন নিকটে
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে বলেন, “অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি অতি নিকটে।” স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৩শে নভেম্বর রাতে এই ভাষণ প্রচারিত
| প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থবহ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এরজন্য আমরা কি মূল্য দেই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি তার উপর। তিনি বলেন, বাঙলাদেশের সহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারকে বিতাড়িত করার সংগাম এবং অসাম্য ও সুবিধা ভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম। তিনি জানান, আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের যে ভবিষ্যৎ রূপ আজ বাঙলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানে সকলের সমানাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশ গ্রহণ করবেন।
| প্রধানমন্ত্রী তার বেতার ভাষণে বলেন যে, সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন, আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপুত হােক না কেন বাঙলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই আর তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তাঁর দেশের কূটনীতিবিদ ও আইনসভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশলক্ষ বাঙালীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেন নি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান, তা জানিনা।” প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তবে এতে আমদের সংকল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না। সে সংকল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।”
জয়বাংলা (১) ! ১; ২৯ [ ২৬ নভেম্বর ১৯৭১
আমরা বিজয়ের ঈদ-উৎসব পালন করবাে।
পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত জাতির প্রতি প্রদত্ত । বাণীতে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, পবিত্র রমজান মাসেও হানাদার বাহিনীর
বর্বরতায় বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু নির্বিশেষে অসংখ্য নরনারী নিহত হচ্ছে। গত বছর আমরা বারােই নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে নিহত দশ লাখ মানুষর শােকে মুহ্যমান অবস্থায় ঈদ উৎসব পালন করতে পারিনি। এবারও আমরা ইয়াহিয়ার সৈন্যদের বর্বরতায় নিহত দশ লাখ ভাই-বােনের বিয়ােগ। বেদনা বুকে নিয়ে ঈদের জামাতে সামিল হয়েছি। কিন্তু দুঃখ-কষ্ট যাই হােক, এবার ত্যাগের মন্ত্রে আমরা উদ্বুদ্ধ এবং যে কোন ত্যাগের মূল্যে স্বাধীনতার ঘােষিত লক্ষ্যে পৌছতে বদ্ধপরিকর। দেশকে শক্র কবল মুক্ত করার পরই মাত্র ঈদুল ফতেহ্ বা বিজয়ের ঈদ উৎসব পালন করবাে এবং সেদিন যে খুব দূরে নয়, এই প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের দিতে পারি।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৯ ॥ ২৬ নভেম্বর ১৯৭১।
বাংলার প্রতিটি ঘর আজ রণাঙ্গন
– তাজউদ্দিন
মুজিবনগর, গত ২৩শে নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত বেতার ভাষণে বলেন, ‘অচিরেই আমাদের মাতৃভূমি মুক্ত হয়ে যাবে। কেননা বাংলার প্রতিটি ঘর আজ প্রতিরােধের দুর্ভেদ্য দুর্গ এবং প্রতিটি ইঞ্চি জমি এখন রণাঙ্গন। যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মুক্তিবাহিনী ততই শক্তিশালী হচ্ছে এবং তারা যে কোন সময় যে কোন স্থানে পাকবাহিনীকে আঘাত হানতে সক্ষম। জনাব আহমেদ বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়ার দয়ার দান হিসাবে আমাদের কাছে পেতে চাই না। আমরা শত্রুর কারাগার ভেঙ্গেই তাঁকে ছিনিয়ে আনব। দেশের ভবিষ্যত সমাজ ব্যবস্থার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যে দেশ গড়তে যাচ্ছি তা হবে বিশ্বের অন্যতম কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। এখানে শ্রমিক-কৃষকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন, আমাদের এ সংগ্রাম সেদিন সার্থক হবে যেদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্রাষ্ট্র কায়েম করতে পারব।
বাংলাদেশ (৪) [ ১ ৫ ২৬ নভেম্বর ১৯৭১
বাঙলাদেশে সরকার ও তার ব্যাপক সাফল্য।
আমাদের স্বাধীন সরকার গঠন করার পর মাত্র কয়েকটি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দেশের মাটি থেকে একটি বিদেশী শােষকগােষ্ঠীর পােষা পেশাদারী সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করার কর্তব্যই আমাদের প্রাথমিক এবং মৌলিক কর্তব্য। এই কর্তব্য সম্পাদনের প্রাথমিক পর্বে আমাদের শক্তি ছিল সীমিত এবং শত্রুপক্ষের তুলনায় একেবারে নগন্য। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য, ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস সহ পুলিশ এবং আনসারের সামান্য শক্তিই ছিল আমাদের মূলধন। এই সামান্য শক্তি নিয়ে যে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিলাে তাকে আজকের বিশ্লেষণে এক অভাবনীয় সাফল্যের সূচনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বলে বলতে হয়। কারণ আমাদের সমস্যা ছিলাে অস্ত্রের এবং অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী সুসংহত বাহিনীর। বাহিনী বলতে যে তাৎপৰ্য্যময় একটি সামরিক শক্তিকে বােঝার তা যেমনি ছিলাে না, তেমনি ছিলাে না প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ছাড়াও সামরিক যানবাহন এবং সামরিক প্রয়ােজনে যােগাযােগের ব্যবস্থা। অপরপক্ষে শত্রু সেনাদের ছিল আধুনিক যুদ্ধোপযােগী সব কিছুই এবং কয়েকটি রাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহও তাদের নিশ্চিত রেখেছে ভবিষ্যত সম্পর্কে।
বস্তুতঃ এই যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের অতি সামান্য সামরিক শক্তি ছাড়া ছিলাে সাড়ে সাত । কোটি মুক্তিকামী মানুষের নৈতিক সহ সার্বিক সমর্থন।
এই কয়েকটি মাসের ব্যবধানে বহুমুখী সমস্যার মধ্যে দিয়ে এগুতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকার তথা বাংলাদেশের জনগণকে। একদিকে যেমন সক্ষম যুবকদের এক বিরাট অংশকে যুদ্ধ বিদ্যায় ট্রেনিং দিতে হয়েছে অন্য দিকে তেমনি অর্থনৈতিক সমস্যার মােকাবেলা করতে হয়েছে এ ছাড়া দ্রুত প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র সমস্যার সমাধানও করতে হয়েছে। সর্বোপরি বিপৰ্য্যস্ত যােগাযােগ ব্যবস্থার মধ্যেও সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে জেগে ওঠা স্বাধীনতার দুর্বার বাসনাকে রফা করতে হয়েছে অতি সন্তর্পণে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দেখা দিয়েছিলাে আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে আমাদের সংগ্রামের সত্যিকার রূপ তুলে ধরা এবং সমর্থন লাভ।
এই সমস্ত বহুমুখী সমস্যা সত্ত্বেও আমদের যুদ্ধ সাফল্য আজ বিশ্বের কাছে এক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। | আন্তর্জাতিক বিশ্ব আমাদের সংগ্রামের সত্যিকার রূপটি যেমন চিনতে পেরেছে তেমনি সর্বক্ষেত্রে নৈতিক সমর্থন লাভ করতে শুরু করেছি। আমরা, অন্যদিকে ইয়াহিয়া সামরিক চক্রের সমর্থনকারী দেশগুলাে আমাদের বক্তব্যের মৌলিকত্ব অনুধাবনের সঙ্গে ইয়াহিয়া সামরিক চক্রের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে আমাদের স্বার্থের অনুকূল মনােভাবও প্রকাশ করেছে। আমাদের সংগ্রামের এই দিকটিতে বিশেষ সাফল্য ইয়াহিয়া চক্রকে এক বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। প্রশাসন ব্যবস্থার প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে বহু দেশেই আমাদের দূতাবাসের কার্যপােযােগী অফিসগুলাে স্থাপিত হয়েছে। এগুলাের মাধ্যমে দেশের আভ্যন্তরিন অবস্থার সাথে বিশ্বকে পরিচিত করে তােলা সহজ হয়েছে । সামরিক ক্ষেত্রে আমাদের দ্রুত সাফল্যের তথ্য এবং ইয়াহিয়ার বর্বরােচিত অত্যাচারের রূপটি বিশ্বের জনগণের কাছে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে। এক কথায় আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে সর্বতােভাবেই আমাদেরই সাফল্য লাভ সম্ভব হয়েছে। | বর্তমান অবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হচ্ছে আমাদের শত্রু নিধন অভিযান। একটি সামরিক বিষয় এবং সামরিক ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আজ তর্কাতীতভাবে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ভীতির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। পাকিস্তানী সেনাদের নিহতের সংখ্যা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেয়ে গত এক মাসেই তা হয়ে দাড়িয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশী। চলতি মাসের হিসাবে এখন দৈনিক গড়ে দু’শাের মত পাকিস্ত নিী সেনা মুক্তি বাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে। সার্থক ভাবে গেরিলা যুদ্ধ কায়দা রপ্তের পর আমাদের গেরিলাদের ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়েছে এবং তা এখন তীব্রতর হয়ে শত্রু বাহিনীকে একেবারে কোনঠাসা করে ফেলেছে। শত্রু বাহিনী নিজেদের নিয়মিত সৈন্যদের জীবনের ওপর ঝুঁকি না নেয়ার। জন্যে যে রাজাকার বাহিনীর সৃষ্টি করেছিলাে তাও ভেঙ্গে পড়ছে। দলে দলে রাজাকাররা অস্ত্রসহ আত্ম সমর্পণ করছে। অগত্যা পাক সেনাদের রাজাকারদের ওপর নির্বারশীলতা ছেড়ে নিজেদের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে এসে লড়তে হচ্ছে এটাই পাক-সেনাদের বেশী হারে নিহত হবার কারণ। আমাদের সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটিতেই আমাদের সাফল্য সবচেয়ে বেশী। গেরিলা তৎপরতার এতাে বড় রকমের সাফল্য এর আগে অন্য কোথাও দেখা যায়নি। আমদের বাহিনীতে সদ্য সামরিক শিক্ষা। সমাপ্তকারী অফিসাররা যােগদান করেছেন এরই প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে মুক্তিবাহিনী এই সাফল্য লাভ করছে।
বাংলার মুখ | ১: ১০ ২৬ নদের ১৯৭১
জকিগঞ্জে বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়েছে।
(স্টাফ রিপাের্টার)
শক্রমুক্ত জকিগঞ্জে এখন বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন পুরােপুরি চালু হয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণ পরম উল্লাসে মুক্তিবাহিনী ও তাদের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দকে স্বাগত জানাচ্ছে। ঘরে ঘরে
স্বাধীন বাংলার পতাকা শােভা পাচ্ছেন। হানাদারদের অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে স্থানীয় যে সব অধিবাসী এতদিন ঘর বাড়ী ছেড়ে প্রবাস যাপন করছিল তারা এখন পরমানন্দে নিজ নিজ গৃহে ফিরছে। দোকানপাট ও হাটবাজার স্বাভাবিকভাবে চালু হয়েছে। ছেলেমেয়েরা আগের মত স্কুলে। যাতায়াত শুরু করেছে।
শতাধিক পাক-তস্কর বন্দী হয়েছে। | গত ২৫শে নভেম্বর জকিগঞ্জ মুক্ত করার পর এ পর্যন্ত প্রায় দেড়শত পাক-সৈন্য ও তাদের স্থানীয় সশস্ত্র তাবেদারদেরকে জীবন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। বন্দীদের মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন ও একজন। জেসিও সহ প্রায় ৪০ জন নিয়মিত সৈন্য এবং শতাধিক রাজাকার ও তাবেদার পুলিশ রয়েছে। এদের অনেকেই যুদ্ধে পরাজয়ের পর আত্মসমর্পণ করেছে। যুদ্ধে শত্রুপক্ষের হতাহতের সর্বশেষ সংখ্যা দুইশতাধিক হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এখনও মৃত দেহ উদ্ধার করা হচ্ছে।
মুক্তবাংলা ॥ ১ : ১০ ৪ ২৭ নভেম্বর ১৯৭১
শত্রুকে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হউন।
—তাজউদ্দিন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গত মঙ্গলবার স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র হইতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত একভাষণে দেশবাসী জনগণের প্রতি মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামিল হওয়ার জন্য সর্বতােভাবে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের মুক্তির দিন নিকটতর হইয়াছে।
| প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, ঘরে বাইরে কোণঠাসা ও বিপর্যস্ত হইয়া পাক জঙ্গীশাহী ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাইয়া পরিত্রাণের পথ খুঁজিতেছে এবং একটি আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করিয়া তাহাদের পৃষ্ঠপােষকদের বাঙলাদেশে হস্তক্ষেপ করার একটা সুযােগ করিয়া দিতে চাহিতেছে।
তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসনের তথ্য সংগ্রহ মিশন প্রেরণের যৌক্তিকতা ও মতলব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিয়া বলেন, যে সরকার ১০ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা ও ১ কোটি মানুষকে দেশছাড়া করানাের জন্য। পাকিস্তান সরকারকে নিন্দা পর্যন্ত করেন নাই। তাহারা তথ্য সংগ্রহ মিশন প্রেরণ করিয়া কি ফল লাভ করিতে চান উহা বােধগম্য নয় এবং তাহারা বাঙলাদেশের জনগণের সংকল্পে কোন ফাটল ধরাইতে সক্ষম হইবেন না।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১:২১ ২৮ নভেম্বর ১৯৭১
ভারত আক্রান্ত হলে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের পাশে থাকবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
মুজিবনগর, ২৮শে নভেম্বর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আবুল হেনা কামারুজ্জামান সপ্তাহব্যাপী মুক্ত এলাকা সফর করে এসে বলেন যে, ভারত আক্রান্ত হলে মুক্তিবাহিনী ভারতের বীর সৈন্যদের পাশে দাড়িয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বে।
জনাব কামারুজ্জমান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগ সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে তিনি বলেন,
সীমান্তে পাক দস্যুরা ভারতের উপর বার বার গােলবর্ষণ করছে। এটা পাক সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই নগ্ন। প্রকাশ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি আরাে বলেন, শান্তিপ্রিয় বন্ধু প্রতিবেশী ভারতের উপর পাকিস্তানের নগ্ন হামলার চাপ যদি অব্যাহত থাকে তবে বাংলাদেশের জনসাধারণ সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়ার জন্ধাদী নেশা ও যুদ্ধের তেষ্টা মেটানাের জন্যে আমরা ভারতের পাশে আছি, পাশে থাকব।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ : ৭ ॥ ২ ডিসেম্বর ১৯৭১।
কামারুজ্জামান বলেনবাঙলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল সুন্দনের মনােরম লীলাভূমিতে দাঁড়িয়ে বাংলার বীর মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামারুজ্জামান বজ্রকল্টে ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানের কাঠামােতে বাংলাদেশ সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। | তিনি বলেন, পাকিস্তানের কাঠামােতে বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক সমাধানই সম্ভব নয়, এটি চিরন্তন সত্য এবং সকলের কাছেই গ্রহণযােগ্য হতে বাধ্য। নূতন বাংলাদেশ হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং সর্বপ্রকার শােষণ থেকে মুক্ত। দেশের বুর্জোয়া গঠনতন্ত্রকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্র চালু করা হবে।” বাস্তুত্যাগীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং শরণার্থীগণ সচ্ছন্দে তাঁদের ভবনে বসবাস করবেন।
তিনি বলে, “বর্তমান আমরা ভারতের সাথে বন্ধুত্বের চিরন্তন সূত্রে আবদ্ধ। এই বন্ধুত্বকে আরাে। সুদৃঢ় করার জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ভারতের বন্ধুরা হবে। আমাদের বন্ধু।”
| সােভিয়েত রাশিয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশকতার বিরুদ্ধে মানবতার যুদ্ধে রাশিয়ার অবদান সীমাহীন। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সােভিয়েত রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ। সম্পর্ককে আরাে উন্নত করতে পারবেন।”
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৭ ॥ ২ ডিসেম্বর ১৯৭১
পাকিস্তান কর্তৃক আক্রান্ত হলে। মুক্তিযােদ্ধারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জমানের ঘােষণা
| গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আবু হেনা মােহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘ভারত আক্রান্ত হলে মুক্তি বাহিনী ভারতের বীর সৈনিকদের পাশে দাড়িয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। লড়বে।’
| স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সম্প্রতি মুক্ত এলাকায় সপ্তাহব্যাপী সফর শেষ করে সম্প্রতি মুজিবনগরে ফিরে এসে উপরােক্ত মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জনাব কামরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগ সবরকম সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণ বাদের বিরুদ্ধে।
সীমান্তে পাক দস্যুদের বার বার ভারতের উপর গােলাবর্ষণকে তিনি পাক সাম্রজ্যবাদী নীতির নগ্ন প্রকাশ বলে মন্তব্য করেন।
| তিনি বলেন, ‘শান্তিপ্রিয় বন্ধু প্রতিবেশী ভারতের উপর পাক নগ্ন হামলার চাপ যদি অব্যাহত থাকে তবে আমরা, বাংলাদেশের জনসাধারণ, সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়ার জল্লাদী নেশা ও যুদ্ধের তেষ্টা মেটনের জন্য ভারতের পাশে আছি এবং থাকব।’ | বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য জেলা শাসক ও পুলিশের পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রতিটি স্তরে অফিসার নিয়ােগ এবং তার তালিকা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই প্রকাশ করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
জয়বাংলা (১) # ১: ৩০ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
‘অশুভ পরিণতির জন্য প্রেরকরাই দায়ী থাকবেন” বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের হুঁশিয়ারী।
| (জয়বাংলা প্রতিনিধি)
১০ লক্ষাধিক বাঙ্গালী হত্যার জঙ্গী নায়ক ইয়াহিয়া খানের অনুরােধে বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রশ্নটি সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের বিবেচনাধীন রয়েছে বলে প্রকাশিত খবর মুজিবনগরে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার সঞ্চার করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রশ্নটিকে একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র” বলে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন “এটা হচ্ছে পেছনের দুয়ার দিয়ে সামরিক চক্রকে রক্ষার একটি অপচেষ্টা মাত্র।” | প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সংগ্রামের এই চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সেজে যারাই আসুক না কেন তাদের “অবধারিত অশুভ পরিণতির” জন্য যারা তাদের পাঠাবেন তারাই দায়ী হবেন। | প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবতার দুষমন ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সৃষ্টি করেছিল তখন যারা টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি আজ তারাই জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে জঙ্গী চক্রকে রক্ষার শেষ চেষ্টা করছেন। | জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ থেকে মুক্ত হবার সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন আমরা উপনীতি হয়েছি তখন কোন অজুহাতে যদি কেউ অন্তরায় সৃষ্টি করতে আসে আমরা তা সহ্য করবাে না।
জয়বাংলা (১) | ১: ৩০ | ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
বেহায়া খান!
নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব এইচ, আর, চৌধুরী সত্যই একজন বাস্তববাদী ও স্বচছদৃষ্টি সম্পন্ন লােক। তিনি কিছুদিন আগে ছােট্ট একটি মন্তব্যে তথাকথিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের সত্যিকার চরিত্র চমৎকারভাবে তুলে ধরেছিলেন। তিনি তাকে “বেহায়া খান” বলে অভিহিত করেছিলেন। জনাব চৌধুরীর প্রদত্ত উপাধিটা যে কত সত্য ইয়াহিয়া নিজেই তা প্রমাণ করল। [ মাত্র মাস দু’য়েক আগে যুদ্ধোন্মদ, রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া ফ্রান্সের “ল্য ফিগারাে” পত্রিকার প্রতিনিধির কাছে বলেছিল: “কোনদিন যদি এই মেয়ে মানুষটির সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় আমি প্রথমেই তাকে বলব, চুপ কর মেয়ে মানুষ।” | বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশের ও বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি এটা নিশ্চয়ই শােভন মন্তব্য ছিল না। তবে বিশ্বের সমস্ত বিবেকবান মানুষই সেদিন ধরে নিয়েছিলেন যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ইয়াহিয়া কোনদিন আলােচনায় বসার ইচ্ছা রাখে না। সেরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সে আত্মহত্যা করে হলেও নিজের ‘মান’ রক্ষা করবে, কথার মূল্য রাখবে। কিন্তু হায়! দু’মাস যেতে না যেতেই ইয়াহিয়া তার সমস্ত হারায় বিসর্জন দিয়ে একেবারে ‘বেহায়ার মত ইন্দিরা। গান্ধীর সাথে আলােচনায় বসার জন্য পাগল হয়ে গেছে। এই আলােচনা-বৈঠকের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে এগিয়ে আসার জন্য সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের দুয়ারে ধর্ণা দিয়েছে। কিন্তু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সবাইকে ‘না’ বলে দিয়েছেন।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ ‘বেহায়া খান’ এবার স্বয়ং ইন্দিরার দুয়ারে ধর্না দিয়েছে।
ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী জে কে অটলের মাধ্যমে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে একখানা ব্যক্তিগত পত্র পাঠিয়েছে। তাতে অনেক কান্নাকাটির পর ‘বেহায়া খান ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের খায়েস প্রকাশ করেছে। শ্রী অটল ও এ পত্র নিয়ে দিল্লী গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে আবার ইসলামাবাদে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তাঁর কাছে লিখিত ‘বেহায়া খানের পত্রের কোনও জবাব দেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করেন নি।
তবে অনুমান করা হচ্ছে যে শ্রী অটলের মাধ্যমে ‘বেহায়া খানকে ইন্দিরা গান্ধী একটি কথাই জানিয়ে দিয়েছেন । তাহল, তাঁর মতে ‘বেহায়ার সাথে সাক্ষাতের তার কোনও প্রয়ােজন নাই।
জয়বাংলা (১) 1 ১: ৩০ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রধান সেনাপতির প্রত্যয়
| বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্ণেল উসমানী সদ্যমুক্ত খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে এই আশা প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে পাক হানাদারদের বিদায় ও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিন এসে গেছে।
জয়বাংলা (১) # ১: ৩০ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
সােহরাওয়ার্দী অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে
প্রধানমন্ত্রী
আমাদের অভিযানে যে গৌরব- জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ এক বাণীতে বলেনঃ
“ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্রদূত জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী আগামী ৫ই ডিসেম্বর দেশের সর্বত্র পালিত হতে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর সকল চক্রান্তের বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ একনায়কত্ববাদের উচ্ছেদ, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শােষণের অবসান ও দেশবাসীর মৌলিক অধিকার। প্রতিষ্ঠার জন্য যে নেতৃত্ব তিনি দিয়েছেন, ইতিহাসের পাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সামরিক চক্রের নির্যাতন ও নিপীড়ন সত্ত্বেও তার মনােভাব ছিল আপােষহীন। তাই পশ্চিম পাকিস্তানী শােষকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তাকে বিদেশে স্বজনহীন পরিবেশে রহস্যময় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। সে রহস্য একদিন উদ্ঘাটিত হবে।
জয়বাংলা (১) ঃ ১: ৩০ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ “খান সেনাদের পলায়নের সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে দৃঢ়তার সাথে পুনরায় বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণের নিকট গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই—আর তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি বলেন, এক বিশ্ব। শক্তির সমর সম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তি সংগ্রাম দমন করা যায় না।
| ২৩শে নবেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বেতার বক্তৃতায় বাংলার দুর্ধর্ষ দামাল ছেলে মুক্তি। | সৈন্যদের অননুকরণীয় রণনিপুণতার প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলাে ঃ “দেশবাসী সংগ্রামী ভাই-বােনেরা,
গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের কাছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পর্যালােচনা করেছিলাম। তারপর আড়াই মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আমাদের সাফল্য এসেছে নানাদিক থেকে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সে কথা শক্ৰমিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তি বাহিনী এখন যে-কোন সময়ে যে-কোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমনকি শক্রর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে। জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তি বাহিনীর। নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্ত, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শক্রমুক্ত। ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী। বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য, সামগ্রী ও মনােবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় ততই উন্মাদ হয়েছে উঠছে।
মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজয়ের গ্লানি গােপন করার প্রচেষ্টা
একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি। আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা আজ দিশাহারা ও কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। নিজেদের ভবিষ্যত সম্পর্কেই সংশয় ও ভীতির উদ্রেক হয়েছে তাদের মনে। বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা মােচনের জন্য তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙনের মুখ । এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এখন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্ষক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তি বাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের। গ্লানি গােপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপােষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না। বরঞ্চ এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পরিণামে তাদের আত্মবিনাশ। সুনিশ্চত হবে।
বাঙ্গালীর কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই … | সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে-ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপুত হােক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিইআর তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প ও সে স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি। ইতিহাস মানুষকে অন্ততঃ এই শিক্ষা
দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই—এমনকি, এক বিশ্বশক্তির সমর সম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তি সগ্রাম দমন করা যায় না।
কোন কোন রাষ্ট্র যখন শরণার্থীদের …
এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কোন কোন পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তি লক্ষ্য করার মতাে। মনে হয় মানুষ হিসাবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশী। এটা শােচনীয়। কিন্তু ভারতকে অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোন রাষ্ট্র উত্থাপন করেন, তখন আমরা শিউরে না উঠে পারি না। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেওয়া হয়েছে, পর্বতপ্রমাণ অবিচার। ও অন্যায়কে বিনা বাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তুত্যাগের। পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানী সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন, তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে হাত বদল করা হবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরা। জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন। আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশী দেরী নেই।
নিক্সন কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চান? | ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইসভার সদস্যেরা অবগত নন এমনকি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ লক্ষ বাঙালীকে সুপরিকল্পিত ভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান, জানিনা। তবে এতে আমাদের সংকল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না। সে সংকল্প হল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
আমাদের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে … | অশ্র ও রক্তের বিনিময়ে যে-স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরও আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবনদানের প্রয়ােজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগর্ভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি, তার উপর। শত্রসংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদেরকে বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সগ্রাম। আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে, যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের সে ভবিষ্যত রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করছেন, যেখানে সকলের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।
বঙ্গবন্ধুকে পাওয়ার একমাত্র পথ …
| বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে বন্দী হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায়
হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করবার শক্তি। আমাদের আছে এবং আমরা তা-ই করতে যাচ্ছি। জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে শত্রুকে আমরা চরম আঘাত হানব আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখােমুখী হবেন।
অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি একটাই …
| বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমার আহ্বান : মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে। চলুন, যেসব সরকারী কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে। হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযােগ গ্রহণ। করুন । শত্রুপক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছেন, তাদেরকে আমি শেষবারের মত বলতে চাই : বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন। অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশী প্রভুদের পরিণতি একই হবে—আর তা হল গ্লানিকর মৃত্যু। হাজার হাজার মুক্তিসেনা আজ শক্রকে ঘিরে রেখেছে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে।
চরম মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকুন
দিয়ে শত্রুকে একযােগে চরম আঘাত করতে পারেন।
| বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে যারা সাফল্যের বর্তমান স্তরে নিয়ে এসেছেন, সেই বীর শহীদ, অকুতােভয় যােদ্ধা ও সংগ্রামী জনগণকে আমি সালাম জানাই। জয়বাংলা।”
ঐক্যবদ্ধভাবে শক্রর বিরুদ্ধে আঘাত হানার দৃঢ় সঙ্কল্প
মুজিবনগর, গত ৬ই এবং ৭ই নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি জনাব তাজউদ্দিনের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সভায় উপরােক্ত সঙ্কল্পের কথা পুনরায় ঘােষণা করা হয়। বৈঠকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালােচনা করিয়া। সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নলিখিত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। | ১। কমিটি মনে করে যে, ইয়াহিয়ার যুদ্ধবৎ প্রস্তুতি ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধানাের প্রকাশ্য। পাঁয়তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন ও দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরােধের ক্রমবর্ধমান। সাফল্য হইতে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরানােরই একটি কুমতলব। কমিটি শত্রুর স্পষ্টত দৃশ্যমান দুর্বলতা সমুহের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ এবং শত্রুর পতন দ্রুততর করার উদ্দেশ্যে তার উপর ঐক্যবদ্ধ ও চরম। আঘাত হানার জন্যে সকল শ্রেণীর ও সম্প্রদায়ের মানুষ এবং সকল স্তরের মুক্তিসেনানীদের প্রতি আহ্বান জানাইতেছে। | ২। কমিটি সভ্যতার সকল নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে অব্যাহতভাবে আটক। রাখার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করিতেছে এবং বাস্তবকে স্বীকার করিয়া লইয়া অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানাইতেছে।
৩। কমিটি জালিয়াতিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত বে-সামরিক শাসনে প্রত্যাবর্তনকে শঠতা বলিয়া মনে করে। ইহা শুধু তাদেরকেই মুগ্ধ করিবে যাহারা ইহাকে বিশ্বাস করার। ভান করিতে ইচ্ছুক।
৪। কমিটি ভারতের জনগণ ও সরকারকে বাংলাদেশের প্রশ্নে তাহাদের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাইতেছে এবং বাংলাদেশ প্রশ্নে সােভিয়েত ইউনিয়নের নীতির প্রশংসা করিতেছে।।
| ৫। কমিটি সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খার ন্যায্যতার প্রতিনিধিত্বকারী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিশ্বের সরকারসমুহের প্রতি আবেদন জানাইতেছে । | ৬। কমিটি লক্ষ্য করিতেছে যে, কতিপয় দেশ বাংলাদেশের প্রশ্নে সহানুভূতিশীল হইলেও তাহাদের মনােভাব প্রকাশ্যে দ্বিধাগ্রস্ত। কমিটি ন্যায়, গণতন্ত্র ও মুক্তির পক্ষে তাহাদেরকে আরও সােচ্চার হইয়া আগাইয়া আসার আহ্বান জানাইতেছে। | ৭। যে সব দেশের সরকার ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ দিয়া বাংলাদেশে গণহত্যায় সাহায্য করিতেছে, কমিটি সেইসব দেশের জনগণের প্রতি আবেদন জানাইতেছে, তাহারা যেন বাংলাদেশের ব্যাপারে তাঁহাদের সরকারের এই নিষ্ঠুর হস্তক্ষেপ বন্ধ করেন।
৮। কমিটি পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার সঙ্কল্প পুনরায় ব্যক্ত করিতেছে এবং স্বাধীনতার কমে সমাধানের নিমিত্ত প্রদত্ত সকল বক্তব্য ও ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করিতেছে । | ৯। স্বাধীনতার জন্য যাঁহারা জীবন দিয়াছেন তাহাদের ত্যাগ স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে কমিটি ঐ সব নিহত বীরদের সহিত সংহতি ঘােষণা করিতেছে এবং শপথ গ্রহণ করিতেছে যে, যে কারণে তাঁহারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, উহার সহিত কখনও বিশ্বাস ভঙ্গ করা হইবে না।
বাংলাদেশ (8) a১: ৬ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১।
বাংলাদেশ সরকারের জরুরী আলােচনা সভা
মুজিবনগর ৪ ডিসেম্বর।
বাংলাদেশ সরকাররে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ সময় এক জরুরী আলােচনায় মিলিত হন। খােন্দকার মােস্তাক আমেদ আমাদের প্রতিনিধিদের জানান, এবারকার যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান ও পুরােপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। জনাব আমেদ বিশ্বে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানবতার কাছে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেবার জন্য জল্লাদ ইয়াহিয়া চক্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে অনুরােধ করেন। জনাব কামরুজ্জামান বলেন, মুক্তিবাহনী শীঘ্রই বাংলাদেশকে শত্রুর হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করবে। | জনাব মনসুর আলী বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করবে। আমাদের মিত্ররাষ্ট্র ভারত দেশ গঠনেও সক্রিয় সাহায্য করবেন এ আশা আমরা পােষণ করি। | তিনি বলেন, বাংলাদেশ সর্বদাই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের পাশে থাকবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ১৬ [ ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১।
এরূপ নগ্ন হামলা ইতিহাসে বিরল মােস্তাক আহমেদ
মুজিননগর : গতকাল বাঙলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব খন্দকার মােস্তাক আহমেদ এক বিবৃতিতে | ভারতের উপর পাকিস্তানের নগ্ন হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেন, বাঙলাদেশের সমস্যাকে চাপা দেবার | জন্য পাক সরকার ভারতের উপর এই নির্লজ্জ আক্রমণ চালিয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারতের দুর্দিনে বাংলাদেশের জনগণ ভারতের পাশে সবসময় থাকবে।
বাংলাদেশ (৪) ॥ বিশেষ সংখ্যা | ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
এবার পশ্চিম পাকিস্তান নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে
—খােন্দকার মােশতাক।
ইয়াহিয়ার যুদ্ধ ঘােষণার পর এখানে বাংলাদেশ সরকারের মহলে দারুণ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়াছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহম্মদ এখন মুক্তাঞ্চলে।
স্বরাষ্ট্র পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী অধিক রাত্রি পর্যন্ত যুদ্ধ পরিস্থিতি লইয়া আলােচনা করেন । বধু জাতীয় পরিষদ সদস্য ও মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করিয়া পরিস্থিতি পর্যালােচনা কালে সন্তোশ প্রকাশ করেন। | রাত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মােস্তাক আহম্মদ বলেন এইবার পশ্চিম পাকিস্তানও নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে। মিঃ আহম্মদ পৃথিবীর শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানবতার কাছে বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়া দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়াচক্রের উপর চাপ দিতে অনুরােধ জানান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ কামরুজ্জমান বলেন, এই যুদ্ধে ইহা পরিষ্কার হইয়া যাইবে পৃথিবীর মানচিত্রে পাকিস্তান নামক কোন রাষ্ট্র থাকিবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু ও বালুচ নেতাদের প্রতি তিনি অবিলম্বে ব্যাপক আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার জন্য আহ্বান জানান। | মিঃ কামরুজ্জামান বলেন, মুক্তিযােদ্ধারা খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের শত্রু কবলিত এলাকা মুক্ত করিবেন।
ভারত সরকার ভারতীয় জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া তিনি বলেন, শ্রীমতী গান্ধী এশিয়া তথা বিশ্বের গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ পূজারী। তাই তিনি সংকটকালে বাংলাদেশের, মুক্তিযুদ্ধে সামিল হইয়াছেন, প্রতিটি বাঙ্গালী তাহার কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী কাপ্টেন মনসুর আলী বলিয়াছেন, মুক্তিযােদ্ধারা এক নতুন বাংলাদেশ তৈরী করিয়াছেন।
বাংলার বাণী # ১০ সংখ্যা ৪ ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবী জানাইব বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের জাতিসংঘ গমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ফণী মজুমদার
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও বিনাশর্তে দখলকারী পাক ফৌজের অপসারণের দাবীতেই আমরা রাষ্ট্র সংঘে বিশ্ব বিবেকের নিকট যাইতেছি। আমাদের বিশ্বাস বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনপ্রতিনিধিরা বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানবাত্মার এই আবেদনে সাড়া দিবেন।” | আওয়ামী লীগ ওয়াকিং কমিটির সদস্য, সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার গত ২১শে সেপ্টেম্বর মুজিবনগর হইতে নিউইয়র্ক যাইবার পথে বাংলাদেশের কোন এক স্থানে সাংবাদিকদের নিকট এই মন্তব্য করেন। | শ্রী মজুমদার বলেন, জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভূটান বাংলা দেশের উপর। পাকিস্তানের বর্বর আক্রমণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিবে। পাকিস্তানের হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে যুগােশ্লাভিয়া, চেকোশ্লাভাকিয়া, ইরাক, রাশিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশ তাহাকে সমর্থন করিবে। কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে জাতি সষ্মে অন্তর্ভুক্তির দাবী ও উত্থাপন করিবে বলিয়া তিনি জানান। তিনি বলেন বিচারপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের যে প্রতিনিধি দল জাতিসঙ্ে যাইতেছেন তাহারা জাতিসঙ্ েবিভিন্ন দেশের কূটনেতিক প্রতিনিধিদের সহিত ব্যক্তিগত যােগাযােগ স্থাপন করিবেন। ইহা ছাড়াও তাঁহারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসনের সহিত ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মিঃ
উইলিয়াম রজার্সের সহিত যােগাযােগ স্থাপন করিবেন। জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টকে | | তাহারা বাংলাদেশ সম্পর্কে আধুনিক তথ্যাদি পরিবেশন করিয়া তাহাদের দাবীর যথার্থতা তুলিয়া ধরিবেন। | শ্রী মজুমদার বলেন পৃথিবীর কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের আক্রমণকে পাক ভারত সংঘর্ষ বলিয়া চিত্রায়িত করিবার প্রয়াস পাইতেছে। প্রতিনিধি দলের অন্যতম উদ্দেশ্য হইবে এই | সব দেশকে এই ভ্রান্তির বালুচর হইতে স্বাধীন বাংলার বাস্তব সত্যের সূর্যের সামনে টানিয়া নেওয়া।
| জাতিসঙ্ঘের অধিবেশন শেষে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের কতিপয় সদস্য মস্কো যাত্রা করিলেন । সেখানে রুশ প্রধানমন্ত্রীর সহিত তাঁহাদের সাক্ষাতের কথা আছে।
বাংলার বাণী ॥ ১০ সংখ্যা ॥ ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি সম্পাদিত
বাঙলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তির বলে উভয় দেশের সেনাবাহিনী একই কম্যাণ্ডের অধীনে পারস্পরিক সহযােগিতা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করিবে।
| ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং বাঙলাদেশের পক্ষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ২৩ ! ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
স্বাধীন বাংলায় কার্টেল, মনােপলির কোন স্থান থাকবে না।
মতিউর রহমান। (কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
| গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প বাের্ডের চেয়ারম্যান এবং পার্লামেন্ট সদস্য জনাব মতিউর রহমান গত ২৩শে নভেম্বর কলকাতায় ভারতীয় ক্ষুদ্র শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে হানাদার জানােয়ার বাহিনীর নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে তােলার ব্যাপারে ভারত সহ সহানুভূতিশীল প্রতিটি রাষ্ট্রের সর্বাত্মক সহযােগিতা কামনা করেন। | বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মহানায়ক শেখ মুজিবর রহমানের ঘােষণার পুরাবৃত্তি করে জনাব মতিউর রহমান বলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং সমানাধিকারের আদর্শ ভিত্তিতে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র পরিচালিত হবে। আমরা সব ব্যাপারেই সব দেশের সহানুভূতি কামনা করবাে। কিন্তু শােষণের মনােভাব নিয়ে বাংলাদেশে যারা প্রবেশ করতে চাইবে তাদের প্রবেশের দুয়ার আমরা | রুদ্ধ করে দেবাে। | ফেডারেশন অব এসােসিয়েশনস অব স্মল ইণ্ডাস্ট্রিজ অব ইণ্ডিয়ার পূর্বাঞ্চল শাখা আয়ােজিত এক অনুষ্ঠানে জনাব রহমান বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে যােগাদনের জন্য বাংলাদেশ নেতা মুজিবনগর থেকে কলকাতা এসেছিলেন।
| জনাব মতিউর রহমান বলেন যে, আমাদের বীর জনগণের সুগভীর দেশপ্রেম এবং দেশকে গড়ে। তােলার স্পৃহা আমাদের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনের প্রধান সহায়ক হবে। লাখাে শহীদের রক্ত স্নাত | বাংলাদেশ কার্টেল ও মনােপলির কোন স্থান থাকবে না। বাংলাদেশ সরকার সুস্পষ্টভাবে এ নীতি ঘােষণা করছেন।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নৈতিক সাহায্য এবং এক কোটি শরণার্থীকে ভারতে ভরনপােষণের ব্যবস্থা করার জন্য ভারতীয় জনগণ এবং সরকারের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জনাব রহমান আমাদের দেশ গঠনে ভারতীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সহযােগিতা কামনা করেন। | অনুষ্ঠানে ভারতীয় শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে শ্রী এন, দত্ত বক্তৃতা করেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ৩১ | ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বেতার ভাষণ। “বাত্যা তাড়িত সাগর পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছি”
‘আজ আমরা ঝঞা বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিতে সমর্থ হয়েছি। বিদায়-উনুখ দুর্ভাগ্যের অমারাত্রি শেষে সম্ভাবনাময় মঙ্গল উষা সমাগত, তার রজত রেখা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের দিগন্ত স্বাধীনতার পূণ্য আলােকে উদ্ভাসিত।
| আমাদের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে আবেগ প্রকম্পিত ভাষায় উপরােক্ত আশা প্রকাশ করেন। গত ৭ই ডিসেম্বর তিনি উক্ত বেতার ভাষণ দেন।
তিনি জাতির মহৎ প্রাপ্তির মুহূর্তে দেশবাসীকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন “আজ আমরা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করেছি। আমাদের বন্ধু প্রতিবেশী, গণতন্ত্রের মহান পাদপীঠ, ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।’
পাক সামরিক জান্তার মুখােস উন্মোচন করে বিশ্বে জনমত গঠনের জন্য এবং বিশ্ব সমাজের কাছে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য দাবীকে উপস্থাপন করার ব্যাপারে ভারতের প্রধান মন্ত্রীর আটমাসব্যাপী ‘অনলস প্রয়াসের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি আবেগময় কণ্ঠে বলেন, ‘অনিবার্য বিজয়ের লগ্নে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করি । পরমলগ্নে তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। বর্বর পাকিস্তানী (জানােয়ারদের) কারাগারে তিনি দুঃসহ বন্দী জীবন যাপন করছেন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মহৎ সন্তান কী উদ্বিগ্নতার মধ্যে আছেন আমরা জানিনা।
| প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেন আমাদের মধ্যে যিনি স্বাধীনতার উদ্দীপনা জাগিয়েছিলেন, বিজয়ের লক্ষ্যে যাঁর আদর্শ আমাদের পথপ্রদর্শক তাঁর স্বপ্ন সার্থক করে তাকে দেখাতে আমরা তাকে আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনবই। আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, এই লক্ষ্যে আমরা আমাদের সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাবই।’ | তিনি বিশ্বের স্বাধীনতা প্রিয় নাগরিকদের গণতন্ত্রের বিজয়ের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য আহবান জানান। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, অচিরেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন। |অসমাপ্ত পরবর্তী অন্য কোন সংখ্যায় পাওয়া যায়নি।
জয়বাংলা (১) [ ১ : ৩১ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণ। সযত্নে ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের লােকদের রক্ষা করুন
গত ৮ই ডিসেম্বর বিকাল চারটায় রেডিও বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, হানাদারদের চূড়ান্ত আঘাত হানার সময় এসেছে। এমন কথা যেন কেউ বলতে না পারেন, এই পরম প্রত্যাশিত মুহূর্তে আমাদের কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছি।
তিনি বাংলাদেশের জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তারা যেন আইন ও বিচার নিজেদের হাতে গ্রহণ না করেন । বরং আইনানুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে সহযােগিতা দেন। ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন সম্প্রদায়ের কোন লােককে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধুর অম্লান আদর্শ এবং স্বাধীনতার গর্বোন্নত পতাকার অবমাননা করা হবে। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশােধ গ্রহণের স্পৃহা থেকে সকলকে বিরত থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শীঘ্রই সারা বাংলাদেশকে হানাদার কবলমুক্ত করার কাজ শেষ হবে এবং তখন। গৃহহীন, অসুস্থ, শিশু-বৃদ্ধ-নারী সকলেই নিজেদের বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারবেন।
জনাব তাজউদ্দীন ঘােষণা করেন, নবজাত স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শ শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, জোট নিরপেক্ষতা এবং সকল প্রকার ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরােধীতা। আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী জীবন গঠনে অভিলাষী।
তিনি বলেন, ভারত ও ভূটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যান্য সকল দেশের উচিৎ বাংলাদেশকে, স্বীকৃতি প্রদান করা। জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিণ চক্রান্তকে তিনি অন্ধ ও বিকৃতনীতি আখ্যা দেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক পারস্পরিক বন্ধুতা ও মৈত্রীর দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবােনেরা, | পাকিস্তানী সমর নায়কেরা আজ সারা উপমহাদেশে এক সর্বনাশা যুদ্ধ ডেকে এনেছে। বাংলাদেশে তাদের শাস্তি ও অপরাধের পরিণতি যে এ পথেই ঘটবে গত কয়েক মাস থেকেই তা বােঝা যাচ্ছিল। | একদিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের লজ্জাজনক বিপর্যয় এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসাধারণের ন্যায় সংগত সংগ্রামের প্রতি ভারতের আন্তরিকতাপূর্ণ সমর্থন এই । পটভুমিকায় পকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করেছে।
উভয়ের শত্রু এক
ভারত ও বাংলাদেশের বিপদ এসেছে একই শত্রুর কাছ থেকে। এর ফলে দুই দেশের মানুষের। সম্পর্ক নিবিড়তর হয়েছে। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সৈনিকেরা এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে উভয়ের মিলিত রক্তধারায় রঞ্জিত হচ্ছে আমাদের দেশের মাটি । ইতিহাস এই দুদেশের মানুষের যে বন্ধুত্বের পথ নির্দেশ করেছে, এই রক্তধারায় সেই মৈত্রীর বন্ধন রহিত হল। | ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের পক্ষে এ এক বিজয় বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আর বিজয় তাঁদের মুক্তিবাহিনীর।
| স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসাবে আমাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতিলাভ আজ সম্ভব হল অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক তৎপরতা, অপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুর্ভেদ্য ঐক্যের ফলে। এ বিজয় ভারতের জনসাধারণেরও বিজয় বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে তাদের সর্বসম্মত অভিপ্রায় আজ বাস্তবে রূপায়িত হল।
ভারতের স্বীকৃতিদান একটি মহৎ ঘটনা | স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদেরকে জগৎসভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। এক কোটি ছিন্নমূল বাঙ্গালীর পরিচর্যার ক্লেশ স্বীকার করে এবং
বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধের আপদ বহন করে মানবতাও স্বাধীনতার
আদর্শের প্রতি যে সুগভীর নিষ্ঠার পরিচয় ভারত দিয়েছে, তা বর্তমানকালের এক আশ্চর্য ঘটনারূপে | বিবেচিত হবে। ভারতের এই দৃঢ়তাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত।
| আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের ভিত্তি মূলে এই ঐতিহাসিক অবদানের জন্য আমরা ভারতের জনসাধারণ, পার্লামেন্ট, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় বাঙালী জাতি অপরিসীম কুতজ্ঞতা বােধ করছে। ভারতের এই স্বীকৃতিদান একটি মহৎ ঘটনা। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরস্পরের জন্য মৈত্রী ও শ্রদ্ধাবােধ। বিপদের দিনে যুদ্ধের দুর্যোগের মধ্যে ভারতীয় জনসাধারণের সঙ্গে যে সম্পর্ক আমরা প্রতিষ্ঠিত করলাম, সম্পদে ও শান্তির কালে তা অক্ষুন্ন থাকবে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তা উভয় জাতির স্থায়ী। কল্যাণ সাধন করবে।
ভারতের পরে ভূটান স্বীকৃতি দিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভূটানের রাজা। ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ।
বঙ্গবন্ধু সর্বদাই বাঙ্গালীর অন্তরে জাগরুক
| বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু ম্লান হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায় । বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপায়িত হল, তখন সেই স্বপ্নের দ্রষ্টা, বাঙ্গালী। জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকটে অথবা দূরে, যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরূক রয়েছেন তাদের অন্তরে । যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক; যে রূপকাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে যােগাৰে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নীতি
| স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে সকল প্রগতিশীল রাষ্ট্রেরই স্বাগত জানানাে উচিত। আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট-নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরােধীতা করা। আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সাড়ে সাতকোটি মানুষের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য আমি সকল রাষ্ট্রকে আহ্বান করছি।
পশ্চিম পাকিস্তান নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছে | পশ্চিম পাকিস্তান সরকার যে অমঙ্গলের সূচনা করেছে বাংলাদেশে, পরিণামে তা-ই আজ তাকে ধ্বংস করতে চলেছে। এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে তার পৃষ্ঠপােষকেরা তাকে বাঁচাতে চেয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কিন্তু সে-প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সংঘর্ষের মূল কারণ। বিবেচনা না করে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র এই উপমহাদেশে যুদ্ধ বিরতির যে প্রস্তাব করেছে, তা মার্কিণ সরকারের অন্ধতা ও বিকৃত বিচারবুদ্ধির পরিচায়ক। চীনও একই ধরনের বিচারবুদ্ধিহীনতার পরিচয়। দিয়েছে। তাই নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়ােগ করায় সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কৃতজ্ঞ। [অসমাপ্ত পরবর্তীতে আর ছাপা হয়নি]
জয়বাংলা (1) l ১: ৩২ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণ।
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
বাঙলাদেশ গণ-প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ গত ৭ই ও ৮ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র হইতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। বেতার ভাষণে তাঁহারা এই দৃঢ় প্রত্যয় ঘােষণা করেন যে, আমরা চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌছিয়াছি । বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার জন্য তাহারা ঐ দুই দেশের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ সর্বদা সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। এবং সকল নিপীড়িত জাতির মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে থাকিবে।
প্রধানমন্ত্রী তাঁহার ভাষণে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্র ও চীনের বাঙলাদেশ বিরােধী চক্রান্তের তীব্র নিন্দা করেন।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ২৩ x ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারত তার অনুসৃত নীতিকেই রক্ষা করেছে
—খােন্দকার মুশতাক
গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মুশতাক আহমদ ভারতের প্রতি সাড়ে সাতকোটি বাঙালীর আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন যে গণ। প্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে ভারত সরকার মানবসভ্যতা, শান্তি ও প্রগতি প্রতিষ্ঠায় তার অনুসৃত নীতিকেই রক্ষা করেছে। এই ঐতিহাসিক যুগান্তকারী মুহূর্তে আমরা। বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণ তাই ভারতের জনগণ এবং তার সরকারের প্রতি জানাই আন্ত রিক অভিনন্দন।
| পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাে বলেন যে, আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির কাছে। যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠার অস্বীকার করেছিলেন আজকের এই ঐতিহাসিক দিনে। আমরা সেই শপথই নেব যাতে করে আমরা বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত কাঠামােকে প্রতিষ্ঠা করতে পারি । আজকের এই শুভ মুহূর্তে আমরা এই আশাই করবাে যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার বন্ধুত্বের বন্ধন যেন অমর হয়ে থাকে।
পঞ্চশীল নীতির অধীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উল্লেখযােগ্য নজীর সৃষ্টি করতে মহান ভারত এবং বাঙলাদেশের জনগণ একে অন্যকে যথাসাধ্য সাহায্য করে যাবে বলেও জনাব আহমেদ তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেন।
মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর যে সব বীর যােদ্ধারা ইতিহাসের এই নতুন অধ্যায়ের সূচনা। করেছেন, জনাব আহমেদ তাদেরকেও আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে এই বিজয় গৌরব অসম সাহসী বীর মুক্তিযােদ্ধাদেরই প্রাপ্য।
| তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে বাঙলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে ইসলামাবাদের বর্বর ঘাতকদের কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনতেই হবে। রক্তের বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা যায় তাহলে এই রক্তের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকেও তার স্বপ্নভুমি বাংলাদেশে নিয়ে আসা যাবে।
সর্বশেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্বের মুক্তিকামী ও শান্তিকামী দেশগুলাের প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন যে তারা যেন অতি শীঘ্রই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতন্ত্রের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সাহায্য করেন।
অভিযান ॥ ১ ৩ ৪ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
শাস্তি দেবার ক্ষমতা সরকারের
—তাজউদ্দীন আহমেদ
জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন হানাদার শত্রুর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্যে উদাত্ত আহ্বান জানান। | তিনি জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে আইন শৃংখলা যেন তারা নিজেদের হাতে তুলে না নেন। সকলেরই একথা মনে রাখা উচিত যে অপরাধীকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা একমাত্র সরকারেরই রয়েছে। ভাষা কিংবা বর্ণের বিচারে কারাে যদি বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয় তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশ পতাকার চরম অবমাননা এবং জাতির জনকের অনুসৃত নীতির পরিপন্থি। একথা চিন্তা করতে আজ সত্যিই খুব আনন্দ লাগছে যে অচীরেই মুক্তিসংগ্রাম সম্পূর্ণ হতে চলেছে এবং শরণার্থীরা শীঘ্রই দেশে ফিরে যাচ্ছেন।
প্রত্যেকটি প্রগতিশীল রাষ্ট্রই নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ রেন।
নবজাত রাষ্ট্রের আদর্শ প্রসঙ্গে জনাব তাজউদ্দীন বলেন যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে আন্ত ‘জাতিক রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদ বিরােধী নীতি বাংলাদেশ সবসময়েই মেনে নিবে।
ভূটান এবং ভারতকে অনুসরণ করে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে প্রধানমন্ত্রী। অন্যান্য রাষ্ট্রগুলাের কাছেও আহ্বান জানান। যুদ্ধ বিরতি সম্পর্কিত মার্কিন প্রস্তাবের কঠোর সমালােচনা করেন। তিনি বলেন চীনও সমদোষে দুষ্ট। সােভিয়েট সরকারের ভেটো প্রদানে প্রধানমন্ত্রী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সম্পর্কে তিনি বলেন যে পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে আমাদের বন্ধুত্ব অমর হয়ে থাকবে।
অভিযান। ১ : ৩ ৪ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
দেশবাসীর প্রতি আবেদন
সর্বত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। আইন নিজেদের হাতে নিবেন না। অপরাধীদের দণ্ডবিধানের ভাৱ সরকারের হাতে ছেড়ে দিন। জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করুন।
| ধর্ম বা ভাষার পার্থক্যের দরুন যদি কাউকে নিগ্রহ ভােগ করতে হয় তা হবে বাঙলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শের অবমাননা। (প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ থেকে)
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ২৩ # ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
জনগণের দুঃখদুর্দশা মােচনে বাংলাদেশ সরকার প্রাণপণ চেষ্টা চালাবে। গণপ্রতিনিধিরাই মুক্ত এলাকায় প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন
কামরুজ্জামান নিজস্ব প্রতিনিধি।
সম্প্রতি সাতক্ষীরা মহকুমার মুক্তাঞ্চল দেবাহাটা, কালিগঞ্জ এবং শ্যামনগর থানায় কয়েকটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান। তাছাড়া এই এলাকার এম, এন, এ জনাব কামাল বখত সহ বেশ কিছু সংখ্যক এম-এন-এ, এম, পি, এ-ও সেখানে উপস্থিতি ছিলেন। | থানাবাসীদের উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে জনাব কামরুজ্জামান বলেন, সুদীৰ্ঘ আট মাস যুদ্ধ করার পর আমরা এই এলাকাকে পাকহানাদার মুক্ত করেছি আমরা জানি যে পাক দস্যুদের বর্বর অত্যাচারে আপনাদের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এই ক্ষতি পূরণের পূর্ণ ক্ষমতা না থাকলেও যতদূর সম্ভব এই ক্ষতি মােচনের জন্য বাঙলাদেশ সরকার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। | যেসব হাসপাতাল ও স্কুল কলেজ পাক ঘাতকরা ধ্বংস করেছে সেগুলি অতি সত্বর নূতন করে। তৈরী করে স্থানীয় লােকজনের চিকিৎসা ও শিক্ষা দীক্ষার সুবিধা করে দেয়া হবে বলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপস্থিত জনগণকে আশ্বাস দেন।
জনাব কামরুজ্জামান আরাে বলেন, জঙ্গীচক্রের নায়ক ইয়াহিয়া খা একের পর এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। করেও বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। বাঙলার মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাক সৈন্যদের কবর রচনা করে সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন।
| এম এন, এ, এম পি এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, তারা এই স্বাধীনতা যুদ্ধে শরীক না হয়ে পাক জঙ্গী শাহীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমরা এতাে শীঘ্র স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম না। তারা আত্মসর্মপণ না করে সশস্ত্র সংগ্রামে শরীক হয়ে ত্যাগ তিতিক্ষারই পরিচয় দিয়েছেন। জনগণের মঙ্গল চান বলেই তারা এই ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
মুক্ত এলাকার বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসন সম্পর্কে জনাব কামরুজ্জামান বলেন যে, স্থানীয় গণপ্রতিনিধিরাই এই সব মুক্ত এলাকার প্রশাসনের দায়িত্বে থাকবেন। মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে এব্যাপারে সাহায্য করবেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন যাতে সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হয় সেজন্যে গণ প্রতিনিধিদের পূর্ণ সহযােগিতা করতে জনাব কামরুজ্জামান স্থানীয় জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান ।
সবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার ভাষণে সমাজবিরােধীদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে, বাঙলার মানুষ পাক বর্বরদের লুণ্ঠনে আজ একেবারে নিঃস্ব। কিন্তু এর পরও যদি কেউ কোন রকমে জনসাধারণকে ব্রিত করে তাহলে তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে। | সভায় জনাব ওবায়দুর রহমান, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম সহ বেশ কয়েকজন জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যও ভাষণ দেন।
অভিযান ॥ ১ : ৩ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
আমরা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী।
—সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
মুজিবনগর : বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে বাঙলাদেশের ভবিষ্যত কর্মসূচী ও মৌলিক দিকগুলি ঘােষণা করে এক গুরুত্বপূর্ণ বেতার ভাষণ দেন।
বাংলাদেশেকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে সুখী, সমৃদ্ধশালী ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানান। তিনি বলেন, “আজ আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রয়ােজন। এখন দেশ গঠনের যে সংগ্রাম শুরু হবে তা হবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। বিদেশী হানাদারদের কল্যাণে আমাদের সমস্ত অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে। এই অর্থনৈতিক কাঠামােকে পূণর্জীবিত করতে হলে এখন আমাদের সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মুক্তির প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এবং এই অর্থনৈতিক কাঠামাের মধ্যে ধনী, দরিদ্রের কোন ব্যবস্থা থাকবে না। তিনি দৃঢ়তার সহিত বলেন, জনগণের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি আর এই জন্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ঘােষণা করে বলেন, জোট নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতিই হলাে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। আমরা সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরােধী। বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি থাকবে।” তিনি ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে ভারতের সহিত চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব কামনা করেছেন। সর্বশেষে তিনি মুক্তিবাহিনীকে মিত্রবাহিনীর সহিত মিলিতভাবে শত্রু হত্যার অভিযান তীব্রতর করে অবিলম্বে দেশকে শত্রুমুক্ত করার আহবান জানান।
বাংলাদেশ (৪) ! ১; ৭ ॥ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
ভারত ও ভূটানের দৃষ্টান্ত অনুরণ করুন
তাজউদ্দিন
মুজিবনগর, গত ৮ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এক বেতার ভাষণে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির কাছে উপরােক্ত আবেদন জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারের ভ্রান্তি ও অপরাধের পরিণতি এভাবেই ঘটবে তা গত কয়েক মাস থেকে বুঝা যাচ্ছিল। একদিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকবাহিনীর লজ্জাজনক বিপর্যয় এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি ভারতের আন্তরিক সমর্থন, এই পটভূমিকায় পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করেছে। ভারত ও বাঙলাদেশের বিপদ এসেছে একই শক্র থেকে। ভারতের জনগণ অনেক আগেই আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের স্বীকৃতি আজ সম্ভব হলাে অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে। স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদেরকে জগৎ সভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। আমরা ভারতের জনসাধারণ ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর ভারতেরই পথ অনুসরণ করে ভূটান স্বীকৃতি জানিয়েছে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে। একজন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হলাে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান এবং সকল প্রকার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশিকতাবাদের বিরােধিতা করা। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেবার জন্য ভারত ও ভূটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য সকল বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানাচ্ছি।
চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব এক বিকৃত বিচার বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক । ভাষাগত ও অন্যান্য দৈন্যের জন্য বাংলাদেশের একটি নাগরিকও যদি বিপদগ্রস্ত হন, তাহলে জানবেন, তা হবে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সেই দিন বাস্তবে রূপায়িত হবে, যেদিন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ (৪) # ১: ৭ ॥ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণা। বিশেষ প্রতিনিধি শ্রীজিষ্ণু দে
ভূটান ও ভারতকর্তৃক স্বীকৃত ৫৫,১২৬ বর্গমাইল, সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশ, বাংলাদেশের সরকার ঘােষণা করছেন ঃ ১) সরকার ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষকে জীবন স্বাধীনতা ও সম্পত্তি
সম্পর্কিত অধিকার দিতে প্রতিশ্রুত। ২) ভাষা, আচার, সামাজিকতা ও ধর্ম সম্বন্ধে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা সংবিধানে প্রতিশ্রত হবে। ৩) সমস্ত ব্যক্তিগত অপরাধ বিচার্য ও দণ্ডনীয় । ৪)। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা স্বীকৃত হবে।
আদালত ও বিচার বিভাগ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হবে।। দেশ সকল প্রাপ্তবয়স্ক ভােটে নির্বাচিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে। এই সরকার হবে। পার্লামেন্টারী—অর্থাৎ সংসদীয় । মানুষ গণতন্ত্রকামী এবং এই দেশে বহু অত্যাচারের বিরুদ্ধে এরা প্রাচ্যনীতি ও গণতন্ত্রের
জন্য লড়াই চালিয়েছে। ৮)। বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক। যতক্ষণ না সকলের স্বাচ্ছন্দ্য আসছে ততক্ষণ
কারাের প্রাচুর্য সহ্য করা হবে না।
পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করা হবে। ১০) বাংলাদেশ শিল্পে অনুন্নত ও একচেটিয়া পুঁজির দিকে এর ঝোক। এই ঝোক কাটিয়ে উঠে।
শিল্পউন্নয়ন পুঁজি ও পুঁজিদ্রব্য সমবিতরণের দিকে ঝোঁক রেখে কাজ করা হবে।
কুটীরশিল্প হবে দেশের শিল্পের খুঁটি। একে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠবে বড় বড় শিল্প। ১২) শিল্প প্রতিষ্ঠানের লাভ ও পুঁজির শেয়ার শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বিজ্ঞানের সাহায্যে কৃষি-উন্নয়ন এই কৃষিপ্রধান দেশের সরকারের বিশেষ লক্ষ্য। ১৪) জমিদারী প্রথা দেশে নেই । কিন্তু জমি বিলিবন্টন ব্যবস্থা-নিয়ন্ত্রণ সরকারের সামনে এক
সমস্যা সরকার এ সম্বন্ধে অবহিত ।। ১৫)। ২৫ বিঘা (৮ একর) অবধি জমি নিষ্কর। ১৬) সরকারী খাসজমি জমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। ১৭) “জমি, যে চাষ করবে তার এই হল সরকারের জমি বিলির মূল মন্ত্র । ১৮) দেশের কৃষ্টি হল কবি, সাহিত্যিক, গ্রাম্য শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিদের সৃষ্ট বাংলা কৃষ্টি। ১৯) প্রকৃতির প্রাচুর্য এই দেশে মানুষের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে এবং নদনদীর সুরে
সুরে বাধা গান তাদের নাড়া দেয়। ২০) সকলের প্রতি সৌহার্দ্য এবং কোনাে দেশের প্রতি হিংসার অভাবই বাংলাদেশ সরকারের
প্রধান বৈদেশিক মূলমন্ত্র ।। সাম্রাজ্যবাদ, নয়াসাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ
সােচ্চার। উপরােক্ত ঘােষণাবলী ১২ই ডিসেম্বরে প্রকাশিতব্য দিল্লীর “নিউ ও এভ” কাগজ থেকে গৃহীত। এই কাগজ “নতুন ঢেউ” নাম দিয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি চারপাতা বাংলা কাগজ বার করবেন। প্রথম সংখ্যায় ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলা হস্তাক্ষরে লিখিত শুভেচ্ছাসহ এই কাগজ বেরােবে বিপ্লবী বাংলাদেশের পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুদের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগের মাধ্যমে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ম ১: ১৭ ॥ ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১
জানােয়ার নিধনের সংগ্রাম চলবে মুক্ত কালীগঞ্জে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তৃতা
আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান, আওয়ামী লীগ নেতা শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার ও জনাব তােফায়েল আহমদ সমভিব্যহারে খুলনার মুক্ত এলাকা কালীগঞ্জ পরিদর্শন করেন। তাদের সাথে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীও কালীগঞ্জ গমন করেন। মন্ত্রী সরকারী কর্মচারীদের সাথে এলাকায় প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করে পালনীয় কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশ দেন। | বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কালীগঞ্জ সফর উপলক্ষে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ডাক বাংলাে এলাকায় লাখাে শহীদের রক্ত রঞ্জিত বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন করেন।
| জনাব জামান জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে হানাদার বাহিনীর একটি জানােয়ার বাংলাদেশের পবিত্র। মাটীতে অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণকে আহ্বান জানান। | কোন রাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “বৃহৎ শক্তি তারা তাদের রাজনীতি করে যাক। আমরা আমাদের কাজ করে যাবাে।”
| তিনি শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের ওয়াদার কথা জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন এবং মওজুতদারী ও কালােবাজারী সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।
জনাব জামান ঘােষণা করেন যে, এ জাতীয় সমাজ বিরােধীকার্যে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হবে।
‘জয়বাংলা (১) ১ : ৩২ ॥ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১।
দিকে দিকে মুক্ত বাংলার জয়ধ্বনি যশাের সহ মুক্তাঞ্চলের বিভিন্ন জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নীতি নির্ধারণী
ভাষণ ঃ সৰ্ব্বত্র জনমনে বিপুল উল্লাস
গােটা বাংলাদেশের মুক্তি যখন আসন্ন, তখন যশাের থেকে ঢাকার প্রান্তদেশ পর্যন্ত প্রকম্পিত জয়বাংলার বিজয়-নিনাদে। যশােরে ও মুক্তাঞ্চলের অন্যান্য জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন নবলব্ধ স্বাধীনতাকে রক্ষা ও সংহত করার কাজে দেশবাসীকে সজাগ থাকার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। (বিস্তারিত খবর পরবর্তী সংখ্যায়)
জয়বাংলা (১) ১: ৩২ ॥ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
শত শােষণেও বাংলাদেশ স্বর্ণ-প্রসবিনী।
অধ্যাপক সামাদ
ভূমিকা।
| স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বের অনেকে প্রশ্ন করছেন। তাদের প্রশ্ন, স্বাধীন বাংলাদেশ | কি অর্থনৈতিক দিক থেকে টিকে থাকতে পারবে? সম্ভব হবে কি বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সুখী সমৃদ্ধ
জীবন গঠন? আমাদের উত্তর, বাংলাদেশ কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকে টিকে থাকবে তাইই নয়, আজকের চাইতে স্বাধীন বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক জীবন হবে অনেক সচ্ছল এবং সমৃদ্ধ। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এটাই হবে অন্যতম সম্পদশালী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের যা সম্পদ আছে তাকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগিয়ে সুখী, উন্নত অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা গড়ে তােলা যাবে।
পাকিস্তানে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল একটা কলােনি বা উপনিবেশ— পশ্চিম পাকিস্তানের ধনকুবেরদের উপনিবেশ। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে যা ঘটে, বাংলাদেশের ভাগ্যেও ঘটছিল তাই। বাংলাদেশের অর্থ গিয়ে জমছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ধনকুবেরদের পকেটে। বাংলাদেশ, তার নিজের অর্থনৈতিক জীবন নিজে নিয়ন্ত্রণে ছিল অক্ষম। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থ হল এই ঔপনিবেশিক অর্থনীতির নাগপাশ থেকে মুক্তি। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভ হচ্ছিল না কিছুই, বরং সে হচ্ছিল শােষিত। এই শােষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস বর্তমানে শেষ হতে চলেছে। আর তাই আজ বাংলাদেশে চলেছে এই রক্তক্ষরা যুদ্ধ । বাংলাদেশের বাতাস ভরে উঠেছে বারুদের গন্ধে।
বাংলাদেশের সম্পদ | ফরাসী অর্থনীতিবিদ, যাদের উল্লেখ করা হয় ফিজিওক্রাট বলে, তারা মনে করছেন, কৃষিই একটি জাতির মেরুদণ্ড, একটি জাতির সম্পদের উৎস। আজকের দিনে নতুন করে অনেকেই ভাবছেন এদের ধারায়। একটা জাতিকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হলে কৃষক ছাড়া চলে না। পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। সব জাতিকে তাই ভাবতে হচ্ছে যতদূর সম্ভব নিজ নিজ দেশের কৃষিসম্পদকে। বাড়িয়ে অন্ন সমস্যা সমাধানের কথা। নিজের দেশের কৃষিজাত দ্রব্যের উপর নির্ভর করে কল কারখানা চালাবার কথা। বাংলাদেশ কৃষি সম্পদে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে তা থেকে এতকাল পশ্চিম পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি পূরণ করে আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পলিমাটিতে গড়া। এদেশের উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ার উর্বর পলিমাটিতে গাছপালা সহজেই জন্মায়। এদেশের সাথে মেলেনা পশ্চিম পাকিস্তানের জনবিরল, তরুপল্লবহীন, উষর-মরুময় প্রকৃতির মানচিত্র। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ভূগােলের দিক দিয়ে পাঁচ গুণের বেশী বড়। কিন্তু তবু বাংলাদেশে অধিক মানুষের বাস। কারণ শ্রম সস্তা বলে কম পুঁজিতে (Capital) এখানে কলকারখানা চালু করা সম্ভব। আমাদের অর্থনীতিতে বর্তমানে শ্রমের প্রাচুর্য (labour intesive) দিয়ে পুঁজির অপ্রাচুর্যকে পুষিয়ে নেওয়া যাবে। পরে আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে হবে মজুরের মজুরী বৃদ্ধি। দেখা দেবে আর্থিক সচ্ছলতা ও সমৃদ্ধি। বাংলাদেশে এখন যেসব কলকারখানা আছে তার অনেকগুলির মালিক হল পশ্চিম পাকিস্তানের লােক। তাই এই সব কলকারখানার আয়ের টাকা চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। কিন্তু ভবিষ্যতে টাকার এই চালান বন্ধ হবে। বাংলাদেশের কারখানার আয় পুঁজি হিসাবে খাটবে বাংলাদেশেই। এর ফলে পুঁজির মাত্রাবৃদ্ধি হবে দ্রুততর। | বাংলাদেশে মজুরীর হার সস্তা। বাংলাদেশ বাইরে থেকে তুলা রপ্তানি করে, এখানে বয়ন শিল্পের যথেষ্ট প্রসার করা চলে। বিশ্বের বাজারে সস্তায় উৎপাদিত কাপড় প্রতিযােগিতামূলক দামে বেচে যথেষ্ট লাভ করা সম্ভব। তা ছাড়া দেশের মানুষের বস্ত্রের চাহিদা মেটাবার জন্যেও বহু বস্ত্রের প্রয়ােজন। বাংলাদেশ ইংরেজ আমলে ১০টি কাপড়ের কল ছিল। কিন্তু পাকিস্তান হবার পর বাংলাদেশে যে হারে কাপড়ের কল হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। বাংলাদেশের বাজারে তাই পশ্চিম পাকিস্তানের কাপড় বিক্রী হত। বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্পের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের জলবায়ু বস্ত্র শিল্পের উপযােগী। একদিন বাংলাদেশ ছিল বস্ত্রশিল্পে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ। ইউরােপীয় বণিকরা বাংলাদেশের প্রতি প্রধানত আকৃষ্ট হয় বাংলাদেশের তৈরী কাপড় বেচে ব্যবসায় লাভ করার জন্য। ফরাসী পর্যটক বেরনিয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় বাংলাদেশে আসেন। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনীকে লিখেছেন, বাংলাদেশকে বলা যায় সারা পৃথিবীর বস্ত্রের আড়ত।
বাংলাদেশের মাটির নিচে কি কি প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও। যথেষ্ট নয়। তবে অনেক জায়গায় প্রাকৃতিক গ্যাস আছে। ব্রাহ্মণবাড়িতে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস, অনেক দিন পর্যন্ত জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা চলবে। এছাড়া বগুড়ার জয়পুরহাট অঞ্চলে কয়লাখনির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। খুঁজলে বাংলাদেশের মাটির নীচে কোথাও তেলও পাওয়া যেতে পারে। সমুদ্রতীরে জোয়ার ভাটার যে শক্তি তৈরী হয়, তা থেকে ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন সম্ভব হতে পারে। | এছাড়া বাংলাদেশের নদনদী থেকে আরও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এই ভাবে কলকারখানা চালাবার জন্য প্রয়ােজনীয় শক্তির অভাব বহুল ভাবে পূরণ করা চলবে।
যুদ্ধক্ষতি ও পুনর্গঠন | যুদ্ধে ক্ষতি হয় সেই সব দেশের বেশী যাদের অর্থনীতি বিশেষ ভাবেই কলকারখানা নির্ভর। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষ ভাবেই কৃষি নির্ভর। জমি থাকবে। সব কৃষক যুদ্ধে মরে যাবে না। তাই ফসল উৎপাদন বন্ধ হবে না। কলকারখানা গত চব্বিশ বছরে যা গড়ে উঠেছিল, মনে হয়, দখলদার বাহিনী দেশ ছাড়াবার আগে তার বহু কিছুই ভেঙ্গে দিয়ে যাবে। এসবই আমাদের নতুন করে গড়তে হবে। তবে যুদ্ধের শেষে সবদেশের মানুষের মনেই বিশেষ ধরনের নিষ্ঠা ও কর্মোদ্যম পরিলক্ষিত হয়। | এই নিষ্ঠা ও উদ্যমের তােরে একটা দেশ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি অনেক দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে। গত | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও জাপানের হয়েছিল ভয়াবহ ক্ষতি। কিন্তু তারা তাদের এই ক্ষয়ক্ষতিতে দ্রুত | কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল তাদের নিষ্ঠা ও কর্মতৎপরতার ফলে। যুদ্ধশেষে আশা করা যায় আমাদের
মধ্যেও জাগবে গঠনমূলক কর্মোদ্যম । আমরা যেমন এখন একযােগে লড়ছি, তখনও একযােগে কাজ | করব দেশের আর্থিক পুনর্গঠনের জন্য।
| পাকিস্তান এ পর্যন্ত বহু বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ পেয়েছে। কিন্তু এই সাহায্য ও ঋণের টাকার | মাত্র শতকরা ১০-১৫ ভাগ খরচা হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ এখন যা সাহায্য ও ঋণ।
পাবে তা সরাসরি কাজে লাগাবে বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এমন, যে | বর্তমান বিশ্বে তার সামরিক গুরুত্ব আছে যথেষ্ট। আর কোন কারণে না হােক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যও অনেক রাষ্ট্র উদ্যোগী হবে বাংলাদেশকে সাহায্য দেবার জন্য। অবশ্য সাহায্য গ্রহণের আগে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, তা আমাদের জাতীয় স্বার্থের সাথে সংগতিপূর্ণ হবে কিনা।
| স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সম্বন্ধ হবে মৈত্রীপূর্ণ। এই সব রাষ্ট্রের সাথে | সে আরম্ভ করতে পারবে সহজে ব্যবসা বানিজ্য। আর এই বাণিজ্যের মধ্য দিয়েও ঘটবে তার আর্থিক | শ্রীবৃদ্ধি।
| বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। আজকের দিনে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে যথাযথ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পেলে জনসাধারণ নিজেই এক বিরাট শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে, জনসমষ্টি একটা দেশের পক্ষে অর্থনৈতিক বােঝা নয়, অর্থনৈতিক শক্তির উৎস। কারণ শেষ পর্যন্ত মানুষের শ্রমেই সৃষ্টি হয় সম্পদ। কোন দেশের মানুষকে কাজে লাগাতে না পারলে, সমৃদ্ধ না করতে পারলে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব হয় না। আশা করা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষ যথাযথ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাবে। | যেটা দেশের মানুষের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ নির্ণয় করে সেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষের কর্মকুশলতা ও সামাজিক ব্যবস্থার উপর আগামী বাংলাদেশের সমাজ সংগঠন গড়ে উঠবে তার | অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রয়ােজনের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে।
স্বদেশ | ১৫ ॥ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সাম্প্রদায়িক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত
(দেশবাংলা রিপাের্ট)
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ঘােষণা করেছেন, বাংলাদেশে অতঃপর কোন সাম্প্রদায়িক দল থাকবে না। জামাতে ইসলামী, তিন মুসলিম লীগ, পিডিপি ও নেজামে ইসলাম দলকে বেআইনী ঘােষণা করে জনাব তাজউদ্দিন যশােরে স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম প্রকাশ্য | জনসভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, এখন থেকে আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না।
| বলা বাহুল্য প্রধানমন্ত্রীর এই ঘােষণা সর্বত্র অভিনন্দিত হয়েছে। বিগত চব্বিশ বছর যাবৎ বাংলাদেশকে পদদলিত করে রাখার ব্যাপারে পশ্চিমা চক্র ধর্মের লেবাসধারী এই দলগুলিকে সর্বপ্রকারে মদত দিয়েছে এবং বাংলাদেশে একটি প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থ-সর্বস্ব দালাল শ্রেণী সৃষ্টি করার কাজে এই দলগুলিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে। গণতন্ত্রের টুটি টিপে ধরে, সর্বপ্রকারে প্রগতির পথ আগলে দাঁড়াবার ব্যাপারে এই সব রাজনৈতিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলি যথেষ্ট সংগ্রাম ও করেছে। | ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের উপর নারকীয় দুর্যোগ নেমে আসার পর এই দলগুলির গাঁয়ে মানেনা। আপনি মােড়ল নেতৃবৃন্দ নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে শান্তি (?) কমিটি গঠনের জন্য টিক্কা খাঁর কাছে ধর্ণা। | দেয়। তারপর থেকে এই সব শান্তিসৈনিকরা ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের কামানের খােরাক এবং কামনার | শিকার সন্ধানের জন্য শিকারী কুকুরের ভূমিকা পালন করে এসেছে। তারই ইনাম হিসাবে তাদের ভাগ্যে জুটেছিল উপনির্বাচন’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হাতের গ্রাস হাতেই থেকেছে, মুখে পৌছাবার। আগেই কম্ম-কাবার হয়ে গেছে। | অতীতে দক্ষিণপন্থী ধ্যান ধারণা পােষণ এবং সাম্প্রদায়িক চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের পিছনে অন্ততঃ এইটুকু যুক্তি ছিল যে জনগণকেই ভালােমন্দ বিচার করতে দেওয়া হােক। গণতন্ত্রে কোন মতকে জোর করে স্তব্ধ করে দেওয়া চলে না। কিন্তু গত আট মাসে এই তথাকথিত দলগুলি দেশ | ও জাতির সাথে যেভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং দেশের মাটি রক্ত রঞ্জিত করার কাজে শত্রুকে সর্বপ্রকারে সহায়তা করেছে, তার প্রেক্ষিতে আজ আর সে ব্যাপারে কোন শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযােগ নাই। পঞ্চমবাহিনীকে দেশের বুকে রাজনীতি করতে দেওয়া যাবে না, এ সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণভাবেই গণতান্ত্রিক।
এই দলগুলি বেআইনী ঘােষিত হবার পর বাংলাদেশে ছােট-বড় মিলিয়ে যে সব দল-উপদল | জীবিত থাকবে বলে মনে হয়; যেগুলি কম-বেশী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশীদার থেকেছে, সেগুলিকে | এভাবে সাজানাে যেতে পারে। (১) আওয়ামী লীগ : বৃহত্তম এবং বলতে গেলে বর্তমান পর্যায়ে একক রাজনৈতিক দল ।
সহযােগী ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, শ্রমিক সংগঠন, জাতীয় শ্রমিক লীগ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মােজাফ্ফর পন্থী) ও বাংলাদেশ কমুনিষ্ট পার্টি। সহযােগী ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড-ইউনিয়ন সেন্টার। সংগঠনগত ও জনসমর্থনের দিক থেকে বর্তমানে এই দলটির স্থান দ্বিতীয়। ন্যাপ ও কমুনিষ্ট পার্টি দু’নামে সংগঠন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হবে বলে মনে হয়, তবে তেমন অবস্থায় কোন্টি রেখে
কোটি ভেঙ্গে দেওয়া হবে, তা সম্ভবতঃ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে। (৩) বাংলা জাতীয় লীগ (সভাপতি, আতাউর রহমান খান) সহযােগী ছাত্র সংগঠন, বাংলা
ছাত্রলীগ। সংগঠনগত ও জন সমর্থনের দিক থেকে এই দলের স্থান হবে তৃতীয়; আতাউর রহমান খান সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি ঢাকাতেই থেকে যান। তাঁর দলের কর্মীরা মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন।
(৪) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী পন্থী)। বহুধা বিভক্তির পর এবং চরম বামপন্থী।
উপদলগুলির পৃথক পৃথক সংগঠন গড়ে তােলার ফলে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন এক কালের বিরাট সংগঠনটি এখন পূর্ব জৌলুষ হারিয়ে ফেললেও, মওলানার ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রিয়তা এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাট প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। মওলানার
পরবর্তী কার্যক্রমের উপর এর ভবিষ্যত নির্ভর করবে। (৫) বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস। পূর্ব পাকিস্তানের এক কালীন অর্থমন্ত্রী মনােরঞ্জন ধর এবং
প্রবীন কংগ্রেস নেতা ভবেশ নন্দীর নেতৃত্বাধীন এই দলটি এযাবষ্কাল ‘সংখ্যালঘুদের দল হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসলেও, বর্তমান সংগ্রাম এবং মনােরঞ্জন বাবুর বাংলাদেশ সরকারের কনসালটেটিভ কমিটির সদস্য হওয়ার প্রেক্ষিতে এই দলটি এখন গুরুত্ব অর্জন
করেছে। দলের ভবিষ্যত কার্যক্রম বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। (৬) বামপন্থী কমুনিষ্ট উপদলসমূহ। বামপন্থী কমুনিষ্ট উপদলগুলির একাংশ মুক্তি সংগ্রামের
অনুকূলে বক্তব্য পেশ করেছে, অপর অংশ বিরােধিতা করেছে। এ সব সংগঠনের অনেকগুলি হয়তাে ভবিষ্যতেও ‘আণ্ডার গ্রাউণ্ড সংগঠন হিসাবেই কাজ চালাবে। আইনসিদ্ধ। প্রকাশ্য কমুনিষ্ট পার্টি করারও চেষ্টা হতে পারে। এ সম্বন্ধে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।
পিকিং এর সাম্প্রতিক ভূমিকা এঁদের পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক হয়েছে। (৭) এ ছাড়াও শ্রমিক কৃষক-সমাজবাদী দল এবং অলি আহাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগের
উপদলটিও পৃথক দলীয় অস্তিত্ব বজায় রাখবে বলে মনে হয়। উভয় দলেরই কয়েকটি
শ্রমিক এলাকায় প্রভাব রয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আগামী দিনের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ছাড়াও আরাে কয়েকটি দল মাঠে থাকছে। তন্মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মােজাফফর পন্থী) ছাড়া অন্য দলগুলির সাংগঠনিক অবস্থা। ভালাে নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে নামসর্বস্ব । কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশে নিশ্চিতভাবেই পার্লামেন্টারী। রাজনীতি চালু হতে যাচ্ছে এবং যেহেতু স্বাধীনতার প্রশ্নে এসব দলেরও কমবেশী অবদান রয়েছে, সেহেতু আগামীতে এরাই হবে বিরােধী দল। পার্লামেন্টারী রাজনীতিতে বিরােধীদলের ভূমিকা থাকে। মুখ্য। কাজেই কালক্রমে এসব দলও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। | তবে, আওয়ামী লীগের বিরাট শক্তির মােকাবিলায় ক্ষুদ্র দলের কাজের সুযােগ যে খুবই সীমিত তা এসব দলের কর্মকর্তাদের না বােঝার কথা নয়। এমতাবস্থায় ক্ষুদ্রতর দলগুলির কয়েকটি একত্রিত হয়ে শক্তিশালী দলে রূপান্তরিত হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দেশবাংলা ॥ ১ : ৮ ॥ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
এবার দেশ গড়ার পালা দেশবাংলা বিশেষ নিবন্ধ
“আর কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকায় বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী স্থানান্তরিত হবে।’ সম্প্রতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ কথা ঘােষণা করেছেন। | মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর সম্মিলিত অগ্রাভিযানের মুখে পাকিস্তানী জঙ্গী চক্রের পশ্চাদপসরণ এবং একের পর এক শত্রু ঘাঁটিগুলির পতন দেখে তার এ আশাবাদে বিশ্বাস স্থাপন না করার কোন কারণ আমরা দেখিনা। ইতিমধ্যেই মুক্ত জেলাগুলিতে পুরাদমে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থার পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা এখন বাংলাদেশ সরকারের
নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর প্রভৃতি কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পাকিস্তানী বাহিনী এখন কার্যতঃ আত্মসমর্পণের দিন গুনছে।
একের পর এক বিভিন্ন এলাকা বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কর্তৃত্বে আসার সাথে সাথে এখন স্বভাবতই পুনর্গঠনের প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভাঙ্গার পর্ব শেষ হয়েছে। এবার দেশ গড়ার। পালা।
চার প্রদেশ
বাংলাদেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করে প্রশাসন ও উন্নয়ন তৎপরতায় প্রতিটি অঞ্চলের প্রতি। যথাযােগ্য গুরুত্ব আরােপের দাবী উঠেছিল ২৫শে মার্চের আগেই। এখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার | সময় এসেছে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেছেন জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি । ‘কনষ্টিটিউয়েণ্ট এসেমব্লি’ গঠন করা হবে। এই এসেমব্লিকে চার প্রদেশের কাঠামাে এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের সম্পর্ক নির্ধারণের ভার দেওয়া যেতে পারে। এ সব প্রদেশ কেবলমাত্র প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের প্রয়ােজনে গড়তে হবে, এক্ষেত্রে স্বায়ত্বশাসনের প্রশ্ন ওঠার কোন কারণ নেই। আপাততঃ চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশের মর্যাদা দিলেই চলবে। এতে করে ঢাকা শহরের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ কমবে এবং দেশে আরাে কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর শহর গড়ে তােলা সম্ভব হবে। তবে মনে রাখা দরকার, কোন অবস্থাতেই ‘দুই’ প্রদেশ গঠনের কথা চিন্তা করা চলবে না। কারণ সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক রেষারেষিতে জাতীয় ঐক্য দুর্বল হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
গণহত্যা ঠেকাতে হবে।
শক্রর চর এবং সহযােগীদের শাস্তি দেবার ভার জনতার উপর বা স্থানীয় নেতৃত্বের উপর ছেড়ে। দেওয়া চলবে না। কারণ, তেমন অবস্থায় ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্য অনেক নিরীহ ব্যক্তিরও লাঞ্ছিত । হবার সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়া শক্রর সহযােগী অবাঙ্গালীদেরকেও হত্যা করার লাইসেন্স’ কাউকে। দেওয়া চলবে না। এ ব্যাপারে সরকারের সময়ােচিত ঘােষণা সুবিবেচনার কাজ হয়েছে। বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের মাধ্যমে যথাবিহিত বিচার করে তবেই অপরাধীকে যােগ্য শাস্তি দিতে হবে। বাংলার মাটিতে অনেক রক্ত ঝরেছে, আর একফোটা রক্তও অনাবশ্যকভাবে ঝরানাে উচিত হবে না।
ঋণভিত্তিক অর্থনীতি চাই না।
বাংলাদেশে প্রায় সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকেই ব্যাপকভাবে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে তড়িঘড়ি ‘সােনার বাংলা’ বানাবার কথা বলছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সতর্ক হওয়া দরকার ।। বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে কৃষিভিত্তিক। কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য হতে হবে, ঋণভিত্তিক তথাকথিত শিল্পপতিদের অর্থনীতি’ নয়। তাই অনাবশ্যক ঋণ। পরিহার করে সুস্থভিত্তিতে জাতীয় অর্থনীতিকে ধাপে ধাপে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্যে দেশবাসীকে। কৃচ্ছতা সাধনার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে এখন থেকেই।
ঋণ করা যার অভ্যাস, তার ঋণের অভাব হয় না। বিশেষ করে বিশ্বে যখন ‘মহাজনী রাজনীতি’। পুরাদমে চালু রয়েছে। কিন্তু ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার পরিণতি পাকিস্তানে আমরা দেখেছি, দুনিয়ার। বিভিন্ন দেশে দেখছি। বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেওয়া যাবে না ।
দেশবাংলা ॥ ১ : ৮ ॥ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার সমীপেষু
আজ একথা আর বলিবার প্রয়ােজন রাখে না যে— গণপ্রজাতন্ত্রের আদর্শকে সামনে রাখিয়াই এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবক স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়াছে। জীবন ছাড়া যেমন জীব হয়না তেমনি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতার কোন অর্থ হয় না। কৃষকরা বলাবলি করিতেছে। এবারে তারা জমি পাইবে, পাটের ন্যায্য মূল্য পাইবে ।, প্রতিদিনের প্রয়ােজনীয় জিনিষ পত্রের দাম কমিবে, ঘুষ রিশওয়াত ও অন্যান্য দুনীর্তির হাত হইতে মুক্তি পাইবে। শ্রমিক মনে করে সে তার বাঁচার মত ন্যায্য মজুরি পাইবে। ছাত্র ভাবে এবার তার লেখা-পড়ার সুযােগ হইবে। যুবক মনে করে এবার তার চাকুরীর সংস্থান হইবে । এক কথায়—আজ এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র শিক্ষক, যুবক বৃদ্ধ, নর-নারী, ডাক্তার কবিরাজ, দোকানদার-ব্যবসায়ী, রিক্সাওয়ালা ক্ষেতমুজুর আপামর জনসাধারণ ভাবিতেছে- পারিব এবারে মানুষের মত বাচিতে কথা বলিবার অধিকার পাইব। মানুষকে মানুষের মত বাঁচিতে দেওয়া ও তাকে কথা বলিবার অধিকার দেওয়া এবং তার কথা মত কাজ করা এই-ই হইতেছে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সারমর্ম । এই লক্ষ্যকে সামনে রাখিয়াই আজ আমাদের আগাইয়া। যাইতে হইবে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশেষ করিয়া সমাজতন্ত্রে এক লাফে পৌছান যায় না তাই, আমাদের তিন পর্যায়ে কাজ করিয়া যাইতে হইবে।
প্রথম পর্যায় ও আশু ব্যবস্থা ও কার্যাবলী ১! অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের স্বরূপ ক) বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের প্রতিনিধিদের লইয়া
সরকার গঠন করিতে হইবে। খ) রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং তাহার মন্ত্রিসভার সদস্যগণ পরিচলনা
করিবেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী দলগুলি কর্তৃক ইহারা মনােনীত হইবেন। গ) ক ধারায় সুস্পষ্টভাবে ঘােষিত নীতি সরকারের সকল স্তরে অনুসরণ করিতে হইবে। ঘ) সরকারী পদস্থ কর্মচারী এবং স্বায়ত্বশাসিত, আধা-স্বায়ত্ত্বশাসিত, সরকারী সংস্থার
পদস্থকর্মচারী ও সাধারণ কর্মচারী এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য হইতে দালালদের বহিষ্কারের জন্য উপযুক্ত স্ক্রীনিং পদ্ধতি স্থির করিতে হইবে। সকল স্তরে যেমন থানা, মহকুমা, জিলা, বিভাগ এবং জাতীয় স্তরে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে প্রশাসন পূর্বের মত চলিতে থাকিবে। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে পদস্থ কর্মচারী ও সাধারণ কর্মচারীদের কার্যনির্বাহ করিতে হইবে। পাকিস্তান সরকারের সর্বপ্রকার দমনমূলক ও গণ-বিরােধী আইন, অর্ডিন্যান্স এবং সার্কুলার
(ঘঘাষণা) প্রত্যাহার করিতে হইবে। ছ) যুদ্ধাপরাধী এবং দালালদের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করিতে হইবে এবং বিধি।
বিধান প্রণয়ন করিতে হইবে। জ) মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ কাজ, সাহস ও ত্যাগের স্বীকৃতিদান এবং তজ্জন্য পুরস্কৃত করার
ব্যবস্থা করিতে হইবে।
| ২। শরণার্থীদের পূনর্বাসন
ক) শরণার্থীদের ফিরাইয়া লইবার জন্য ভারত ও বার্মা সরকারের সহযােগিতায় উপযুক্ত লিয়াজো ।
(যােগযােগ) ব্যবস্থা সংগঠিত করিতে হইবে।
শরণার্থীদের আশ্বাস প্রদান ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের নিমিত্ত সকল শরণার্থী শিবির ও
শরণার্থীদের আস্তানাগুলিতে সর্বদলীয় কমিটিগুলিকে সফরে যাইতে হইবে। গ) স্ব স্ব এলাকায় শরণার্থীদের গ্রহণের নিমিত্ত উপযুক্তভাবে সংগঠিত অভ্যর্থনা ব্যবস্থা গড়িয়া
তুলিতে হইবে। এইসব অভ্যর্থনা কমিটি সর্বদলীয় ভিত্তিতে হইতে হইবে।
শরণার্থীদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ফেরৎ পাওয়ার ব্যবস্থা করা । উ) শরণার্থীদের পূনর্বাসনের জন্য সাহায্য সংগঠিত করা।
সমাজ সেবামূলক ত্রাণ কার্য সংগঠিত করা- অনাথ, বিধবা, বৃদ্ধ এবং পঙ্গু-ব্যক্তিদের
রক্ষণাবেক্ষণ। ছ) জমি বেদখল, জোর পূর্বক বাড়ী দখল এবং এক এলাকার লােক অন্য এলাকায় জোর পূর্বক
অপসারণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা।
৩। খাদ্য সরবরাহ ক) দেশের অভ্যন্তর ও বাহির হইতে খাদ্য সংগ্রহের নিমিত্ত এবং বিভিন্ন এলাকার প্রয়ােজন
অনুসারে ইহার সমবণ্টনের জন্য সরকারকে সরকারী সংস্থা স্থাপন ও সংঘটিত করিতে হইবে। মজুতকরণ, চোরাকারবারী, মুনফাবাজীর ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
চোরাচালান বন্ধের জন্য কঠোর বিধি-নিষেধ আরােপ করিতে হইবে। গ) খাদ্য ও জীবনধারণের পক্ষে অপরিহার্য দ্রব্যাদির উপযুক্ত মূল্য বাধিয়া দিতে হইবে যেন
উৎপাদকগণ তাহাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাইতে পারে। ঘ) যথারীতি ফসলকাটা ও বীজ বপনের নিশ্চয়তার সপক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। ৬) সার, কীটনাশক ঔষধ ও শস্যের রােগ নিবারক ঔষধের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৪। যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনঃ প্রতিষ্ঠা ক) সকল ক্ষতিগ্রস্ত বিমান বন্দর, সড়ক, সেতু, আভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল, টার্মিনাল, খেয়াতরী
রেল লাইন অবিলম্বে মেরামত করিতে হইবে। খ) যাত্রীসাধারণ বহন ও মালবহনের জন্য সকল বে-সরকারী ও সরকারী যানবাহন সরকারের
কর্তৃত্বে লইতে হইবে এবং অবিলম্বে চালু করিতে হইবে। গ) টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, টেলিকমিউনিকেশন (টেলিযােগাযােগ) এবং ডাক ব্যবস্থা অবিলম্বে
পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। যাত্রীসাধারণ ও মাল বহনের জন্য সরকারী পরিবহনের ভাড়া শতকরা ২৫ ভাগ হ্রাস করিতে
হইবে। ঙ) বাংলাদেশের সর্বত্র যাহাতে জ্বালানী এবং জ্বালানী তেল পাওয়া যায় উহার ব্যবস্থা করিতে
হইবে। চ) রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্র চালু করিতে হইবে। সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির নির্দেশ
মােতাবেক রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচার কার্য চালাইতে হইবে।
| ৫। সংবাদপত্র ও সংবাদ প্রচার মাধ্যম। ক) পাক জঙ্গীচক্র সমর্থনকারী ও সহযােগী সংবাদপত্র ও সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য
সংবাদ ও মতামত প্রচার মাধ্যম বাজেয়াপ্ত করিতে হইবে। বাংলাদেশের স্বার্থবিরােধী
বাংলাদেশে যে সকল সংবাদপত্র বর্তমানে চালু রহিয়াছে সেগুলি নিষিদ্ধ করিতে হইবে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সামরিক জান্তার আক্রমণের পর সংবাদপত্রগুলি যে নামে প্রকাশিত হইত সেই নামে সেগুলিকে আর প্রকাশের অনুমতি দেওয়া চলিবে না।
৬। বিদ্যুত সরবরাহ | ক) সকল ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্র মেরামত করিতে হইবে এবং বিদ্যু সরবরাহ লাইন পুনরায়
স্থাপন করিতে হইবে। খ) বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রাখার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। গ) গ্যাস সরবরাহ পুনরায় করিতে হইবে।
৭। শিক্ষা ব্যবস্থা।
ক) প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবিলম্বে | শিক্ষাদান কার্য শুরু করিতে হইবে। খ) জাতীয় প্রয়ােজনের উপযােগী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্খার উপযােগী
পাঠ্যসূচীর আশু সংশােধন করিতে হইবে এবং অবিলম্বে উহা চালু করিতে হইবে। গ) ১৯৬৯ সাল হইতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য যেসকল ছাত্রের শিক্ষাজীবন
ক্ষত্রিস্ত হইয়াছে তাহাদের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা করিতে হইবে। ঘ) মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী যুবকদের ক্ষেত্রে তাহাদের অধ্যয়ন চালাইয়া।
যাইবার জন্য আর্থিক সাহায্য সহ বিশেষ বিবেচনা বাঞ্ছনীয়। বাংরাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যে সকল শিক্ষক, অধ্যাপক এবং শিক্ষাবিভাগ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যান্য পদস্থ কর্মচারী আয়ুব ও ইয়াহিয়া সরকারকে সহযােগিতা করিয়াছেন বলিয়া প্রমাণ পাওয়া যাইবে তাহাদের কঠোর দণ্ড এবং শাস্তিদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
৮। ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু
ধর্মীয় এবং ভাষাগত ইত্যাদি সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে । ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
৯। যুদ্ধাপরাধী এবং দালাল।
ক) যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের ক্রীনিং এর জন্য সংস্থা স্থাপন করিতে হইবে। খ) যুদ্ধাপরাধী ও দালালের শাস্তিদানের জন্য বিশেষ আদালত স্থাপন করিতে হইবে। গ) যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া উহা রাষ্ট্রের নিকট গচ্ছিত রাখিতে
হইবে। এইভাবে দখলকৃত গ্রাম্য কৃষি জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিলিবন্টন করিতে হইবে।
১০। মুক্তিবাহিনী | ক) জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকে জাতীয় সম্মান বলিয়া স্বীকৃতি দিতে হইবে এবং
মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি সদস্য যেন তাহার এই দেশ সেবার উপযুক্ত স্বীকৃতি পান। খ) শিক্ষালাভের জন্য মুক্তিবাহিনীর তরুনদের বিশেষ সুবিধা দিতে হইবে।
গ) সাহসিকতার জন্য পুরস্কার দানের রীতি প্রচলন করিতে হইবে। ঘ) বর্তমানে মুক্তিবাহনীতে যুদ্ধরত তরুণদের বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও মিলিশিয়াতে
যােগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তাহাদের গ্রহণ করিতে হইবে।
১১। জন স্বাস্থ্য ক) সকল হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, প্রসুতিসদন, গ্রাম ও শহরের শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে
অবিলম্বে দিন রাত কাজ শুরু করিতে হইবে। খ) ঔষধ সরবরাহের প্রয়ােজন মিটাইবার জন্য সকল ঔষধ প্রস্তুত শিল্পকারখানা কর্মক্ষম করিতে
হইবে এবং অবশ্যই উৎপাদন চালু করিতে হইবে। গ) জীবন রক্ষাকারী ঔষধ আমদানীর জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
১২। শাসনতান্ত্রিক সমস্যা
ক) একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র গ্রহণ করিতে হইবে।
১৩। সর্বদলীয় কমিটি ক) জেলা হইতে শুরু করিয়া ইউনিয়ন স্তরে সকল পর্যায়ে সর্বদলীয় কমিটি স্থাপন করিতে
হইবে। উপরে বর্ণিত লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্ত সরকারের প্রশাসনিক সংস্থাকে স্থানীয় সর্বদলীয় কমিটিগুলির সর্বাধিক সহযােগিতা ও পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত হইবে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বাধীন বাংলার রূপরেখা (১) যে এক কোটি দেশবাসী পাক সৈন্যের বর্বর অত্যচারে তাহাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি ফেলিয়া
প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও বার্মায় আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাঁহাদিগকে পূর্ণ মর্যাদার সহিত দেশে ফিরাইয়া আনিতে হইবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সকলেই স্পষ্টভাবে দেখিয়াছেন— আমেরিকা, চীন অন্যান্য। কয়েকটি রাষ্ট্র আমাদের প্রতি দুষমণী করিয়া আসিতেছে। তাহাদের ও তাহাদের এজেন্ট মুসলিমলীগ, জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পি-ডি-পি এবং চরম বামপন্থীদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সর্বদাই হুশিয়ার থাকতে হইবে। এই চরম বিপদের দিনে যে সব বন্ধুরাষ্ট্র (ভারত, রাশিয়া, পােলান্ড ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র) আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকিতে হইবে। স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়িয়া তুলিতে হইবে স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে। বলা বাহুল্য, ইহা হইবে একটি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অর্থাৎ সকল ধর্মের সমান অধিকার থাকিবে। | পার্লামেন্ট হইবে সার্বভৌম জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ শাসন করিবেন । প্রাপ্তবয়স্করাই ভােট দিতে পারবেন। নির্বাচন হইবে যুক্ত।
বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ হইতে পৃথক হইবে। (৭) নর-নারী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার থাকিবে। (৮) নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করিবে। ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়ন প্রভৃতি
গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলির সহিত সখ্যের সম্পর্ক গড়িয়া তুলিবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপক্ষে দাঁড়াইবে । সিন্ধি, বালুচ, পাঠান প্রভৃতি নিপীড়িত সকল জাতির সহিত মৈত্রী সম্পর্ক গড়িয়া তুলিবে।
(৯) সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের সহিত কোনরূপ অসম চুক্তি করিবে না। (১০) দেশের একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিপতিদের অধিকার খর্ব করা হইবে। ভারী ও মূল শিল্প জাতীয়
করণ করিবে একচেটিয়া পুঁজিবাদ গড়িয়া উঠিতে দিবে না। ছােট ও মাঝারী জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উৎসাহিত করিবে। ব্যাঙ্ক, ইনৃসিওরেন্স, বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ব করা হইবে। ভূমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করিবে। অতিরিক্ত মালিকদের যথাযােগ্য ক্ষতিপূরণ দিবে। বাড়তি
জমি গরীব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করিবে। (১২) শ্রমিক কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ও ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা বিধান করিবে। ক্ষেত
মজুররা যাহাতে কাজ পায় ও ন্যায্য মুজরি পায় তাহার ব্যবস্থা করিবে।। পাট শিল্প ও চা শিল্প জাতীয়করণ করা হইবে এবং কৃষক যাহাতে পাটের ন্যায্য মূল্য পায়। তাহার বাস্তব ব্যবস্থা করিবে। অন্যান্য কৃষিপন্যের ন্যায্য মূল্য কৃষককে দিবার সুব্যবস্থা
করিবে। (১৪) দালালদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিবে।। (১৫) বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা, সভাসমিতি ও সংগঠন করার নিশ্চয়তা থাকিবে। (১৬) জনগণের মিলিশিয়া থাকিবে। (১৭) শিক্ষা ব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক মতে আধুনিকীকরণ করিবে। মাতৃভাষাই হইবে শিক্ষার মাধ্যম। (১৮) সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষা মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করিতে হইবে। (১৯) কারিগরী শিক্ষা প্রসারের উপর গুরুত্ব দিতে হইবে। (২০) জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের যথাযােগ্য মর্যাদা ও স্বকৃিতি প্রদান করিবে। ক্ষতিগ্রস্থ
পরিবারবর্গকে সাহায্য দিবে। (২১) শােষণমুক্ত স্বাধীন বাংলা গঠনের চেষ্টা করিতে হইবে।
তৃতীয় পর্যায়ে সমাজতন্ত্র | এ যুগ সমাজতন্ত্রে উত্তরণের যুগ। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পথে সমাজতন্ত্রের দিকে আগাইয়া। চলিয়াছে। বাংলাদেশও তার নিজস্ব পথেই সমাজতন্ত্রের দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। তবে আমাদের আজ মেকি ও বাচনিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে হুশিয়ার থাকিতে হইবে। সােনার যেমন পিতলা কলসী হয়।
, কানাছেলে নাম যেমন ‘পদ্মলােচনা হয় না তেমনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন সমাজতন্ত্র ও সত্যিকারের সমাজতন্ত্র নয়। এ পর্যায়ে আমাদের সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্পর্কে কর্মসূচী নিতে হইবে।
নতুন বাংলা ৪ ১ : ১৮ # ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকা আমাদের মহানগরীর সরকারী বেসরকারী ভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা : বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হােন ধ্বনিতে
আকাশ বাতাস প্রকম্পিত
আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জোয়ানদের সম্মিলিত অভিযানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী মুক্ত হয়েছে এবং সকল সরকারী বেসরকারী ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন হয়েছে। মুজিব। নগর থেকে শীঘ্রই স্বাধীন বাংলার প্রশাসনিক সদর দপ্তর স্থানান্তরিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। তাবেদার। গভর্ণর মালেকের পদত্যাগের পর খান সেনারা নিজেরাই যুদ্ধ বিরতির আরজি জানায়।
| আজ বাংলাদেশের বীর মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় জওয়ানগণ পাকিস্তানী ও হানাদারদের পশ্চাৎধাবন করে মহানগরী ঢাকায় প্রবেশ করলে বিরান ও ধ্বংসস্তুপ নগরী আবার সজীব হয়ে ওঠে এবং জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হােক, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী স্থায়ী হােক ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। খান সেনারা এবং তাদের তাবেদারেরা সদলে আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণের পর তারা জেনারেল মানেক শ’র কাছে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব জানালে ভারতের সেনাপতি তাদের আত্মসর্পণের নির্দেশ দেন।
| ঢাকা শহর মুক্ত হওয়ার খবরে অশ্রুসজল কণ্ঠে আমাদের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এক বাণীতে বলেছেন, আমাদের বিজয় লাভ সম্পূর্ণ হল। এখন আমাদের সামনে আরাে কঠিন কাজ বাকী। তা হল ধ্বংসস্তুপের মধ্যে একটা জাতির পুনর্বাসন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন।
প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বে নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত মানবতার একটি অকৃত্রিম বন্ধু জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। আমরা দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে জয়ী হয়েছি। কিন্তু এখন জাতির পিতাকে মুক্ত করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে।
জয়বাংলা (১) ১ : ৩৩ ৫ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সপ্তম নৌবহরের তৎপরতা বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া
কোলকাতাস্থিত বাংলাদেশ মিশনের এক মুখপাত্র বলেন, সপ্তম নৌবহরের ভারত মহাসাগরের দিকে আগমন ও চীনা সৈন্যের ভারতীয় সীমান্তে তৎপরতা ভারতকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করার ছলাকলা মাত্র। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণ যুক্তভাবে এ চ্যালেঞ্জ মােকাবেলা করবে বলেও তিনি ঘােষণা করেন।
মুজাফফর আহমদের উদ্বেগ
ওয়ালী-পন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি প্রফেসর মুজাফফর আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের হীন তৎপরতার দরুন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ জেনে রাখুক এ ধরনের চাপ বাংলাদেশের মানুষের অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে পারবে না।
ছাত্র ইউনিয়নের বিবৃতি
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি জনাব নুর ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেছেন, সপ্তম নৌবহরের দ্বারা হুমকি প্রদর্শন সাম্রাজ্যবাদী কুটনীতিরই এক উলঙ্গ প্রকাশ। সাম্রাজ্যবাদীরা যদি বাংলাদেশে নাক গলাতে চেষ্টা করে তবে তাদের ভিয়েনামের মতই ভাগ্য বরণ করতে হবে।
অভিযান ॥ ১ : ৪ ! ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে
বাঙলাদেশের সরকার সম্প্রতি ঘােষণা করেছেন যে যদিও বাঙলাদেশ এখনও জাতিসংঘের । সদস্যপদ লাভ করেনি, তথাপি তারা জাতিসংঘ সনদের নীতিগুলােকে যথাযােগ্য মর্যাদা দেবেন।
বাঙলাদেশ সরকার আরও আশ্বাস দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে অবস্থানরত জাতিসংঘের সমস্ত কর্মচারী এবং কূটনীতিক সহ সকল বিদেশী নাগরিক যাঁরা বাঙলাদেশ ত্যাগ করতে ইচ্ছুক, তাদের সকলকে স্ব স্ব স্থানে নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের সর্বপ্রকার সুযােগ দান করা হবে।
অভিযান ॥ ১:৪ | ১৭ ডিসেস্বর ১৯৭১।
আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক চক্রান্ত প্রতিরােধ
‘বাঙলাদেশের পরিস্থিতি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, শুধু মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের নিরিখেই নয়, বিশ্ব। পরিস্থিতির দ্রুত উত্থান পতনও বাঙলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে, এক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে বাঙলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরােক্ত মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, চীন ও আমেরিকান চক্র এখন ভারত ও বাঙলাদেশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই ব্যাপারে সবচাইতে সতর্ক থাকার প্রয়ােজন। জনাব নজরুল ইসলাম বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য দেশের ভিতরে একটি আন্তর্জাতিক চক্র কাজ করে যাচ্ছে। ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র—শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট নয়, তবুও প্রচার চলছে ভারতের বিরুদ্ধে। বাঙলাদেশ সরকার এ কথা বারবার বলেছে যে, ভারত বাঙলাদেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে কখনই হস্তক্ষেপ করবে না। তবে বাংলাদেশ সরকার সকল রাষ্ট্রের কাছেই সাহায্য ও সহযােগীতা চায় ।
অভিযান ॥ ১ : ৪১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১।
বাঙলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকার সম্প্রতি এক নির্দেশ অনুসারে বাঙলাদেশের চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছেন। এই চারটি রাজনৈতিক দল হলাে জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পি,ডি,পি, এবং মুসলীম লীগ। | পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে এই আদেশ জারী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। গত তেইশ বছরের ইতিহাসে পূর্ব বাঙলার যে কবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে প্রত্যেকবারই এই চারটি দলের তিনটি দল তাতে সক্রিয় অংশ নিয়েছে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবীকে বিভ্রান্ত করেছে। এই দলগুলাের নেতৃবৃন্দ প্রতিবারই পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে পূর্ব বাঙলার জনগণের বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী শােষণ অক্ষুন্ন রাখতে সক্রিয় সহযােগিতা রাখছে।
এদিক দিয়ে বিচার করলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এই আদেশ সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশ বাদের বিরুদ্ধেও একটি দৃঢ়পদক্ষেপ।
অভিযান ॥ ১: ৪ | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
শক্র ও শত্রুর সহযােগী এবং বাস্তত্যাগীদের অস্থাবর সম্পত্তি : বাঙলাদেশ সরকার।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্প্রতি এক। সাক্ষাতকারে বলেন যে, গত ২৫শে মার্চের পরে সমস্ত দলিল অডিন্যান্স জারী করে বাতিল করা হবে। আর যারা এই সময়ে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের সঙ্গে সহযােগীতা করে বাঙলাদেশে পাক সামরিক বাহিনীর অত্যাচার ও গণহত্যার শরিক হয়েছে তাদের সকলকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। যারা গত কয়েক মাসে পাক চক্রের সঙ্গে সহযােগীতা করে এখন দেশান্তরী হয়েছে তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি। হিসাবে গণ্য করে জাতীয় সম্পত্তি হিসাবে ঘােষণা করার কথা বিবেচনা করা হবে।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থ দফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য। বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্নস্থানে বহুলােক তাদের অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই অস্থাবর সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে এমন লােকও রয়েছে যারা রাষ্ট্রের শক্রর সহায়তা করেছে কিংবা রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি শত্রুতা করেছে। যে সমস্ত সম্পত্তি এখনও অরক্ষিত অবস্থার পড়ে রয়েছে সেগুলি এখনই আঞ্চলিক পরিষদ, সাব সেক্টর কমাণ্ডার অথবা বাঙলাদেশ সরকারের অনুমােদিত বিশেষ প্রতিনিধির কাছে জমা দিতে হবে। যারা এই নির্দেশ অমান্য করবে তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে বলে ঐ বিজ্ঞপ্তিতে জানানাে হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে আরও বলা হয়েছে যে, পরে প্রকৃত মালিককে তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
অভিযান ॥ ১:১ # ১৭ ডিসেম্বর,
যশােহরের সমাবেশ
গত ১১ই ডিসেম্বর যশােহর টাউনহল ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় প্রধান বক্তাদের মধ্যে ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। বিজয় উৎসব উপলক্ষে আয়ােজিত এই প্রথম জনসভায় কতকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়।
ঘােষণায় বলা হয় যে বাঙলাদেশ সরকার যুদ্ধ আদালত গঠন করেছেন এবং এই আদালতে। গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযােগের অভিযােগে যুদ্ধবন্দীদের বিচার হবে। দ্বিতীয়তঃ চলতি বছরের ২৫শে মার্চের আগে যিনি যে জমির মালিক ছিলেন সেই দখলীকৃত জমি তাকে ফেরত দিতে হবে। যদি সে জমিতে চাষ হয়ে থাকে তাহলে বর্গাদার হিসাবে চাষী অর্ধেক ফসল পাবেন। পাক হানাদারদের আক্রমণে যারা অন্যত্র চলে যান তাদেরকে সেই দোকান ফিরিয়ে দিতে হবে। তৃতীয়তঃ হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ খৃস্টান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বীদের স্ব স্ব ধর্ম পালনে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।
| এছাড়া সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে এই সভায় বাংলাদেশের চারটি রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ। ঘােষণা করা হয়।
অভিযান ॥ ১; ৪ | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত দুর্জয় পৌরুষের ঐতিহাসিক পুরস্কার
| এক নদী রক্ত, অশ্রু এবং হাহাকারের অতলান্ত করে পাকিস্তানী হানাদার জঙ্গী দস্যুদের সর্বশক্তি চিরকালের মত সমাধিস্থ হয়েছে। গতকাল বিকাল পাঁচটা এক মিনিটে শত্রু কল মুক্ত হয়েছে বাঙলাদেশের সমস্ত অঞ্চল। ঢাকা শহরের আনন্দ বিহ্বল হাজার হাজার নাগরিকের কণ্ঠে ধ্বনি হয়েছে। “জয় বাংলা” “বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ” “ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ” “বাঙলাদেশ-ভারত মৈত্রী জিন্দাবাদ।” এই বিশাল জনতার সামনে রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে নতশীরে সসৈন্যে আত্মসমর্পণ করেছে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর অধিনায়ক হতমান লেঃ জেনারেল নিয়াজী। সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকা শহরে চালু হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
তােমার আসন শূন্য আজি হে বীর পূর্ণ করাে। | রাজধানী ঢাকা শহরে আজ স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা যখন আপন গৌরবে উডডীন, তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অনুপস্থিতি সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর হৃদয়কে বিষাদে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।
যে মানুষটির মুখের একটি কথায় তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত পদ্মার উচ্ছাসের মত কেঁপে। কেঁপে উঠতাে, তিনি আজ বাঙলার সবুজ, নরােম মায়ের মতাে স্নিগ্ধ মাটি থেকে হাজার মাইল দূরে, রুক্ষ, উষর বান্ধবহীন নির্জন নিঃসঙ্গ পরিবেশে বর্বর পাকিস্তানী ফ্যাসিষ্ট চক্রের কারাগারে বন্দী। তাই স্বাধীনতার কোন উৎসবই আজ আনন্দ মুখর হয়ে উঠবে না যতক্ষণ বঙ্গবন্ধুকে আমাদের ভেতর ফিরে
| বাঙলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে এটাই প্রমাণ হ’ল বেয়নেট দিয়ে গণতন্ত্র ও ও স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রাখা যায় না। আজকের দিনে আমাদের মন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্যে উদগ্রীব। আমি আশা করব ইয়াহিয়া খান পরাজয় মেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে দেবেন।
—সৈয়দ নজরুল ইসলাম “ভারত আমাদের মিত্র হিসাবে আমাদের অনুরােধে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিল বাঙলাদেশ মুক্ত করার জন্য দখল করবার জন্যে নয়।”
—তাজুদ্দীন আহম্মেদ “সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের অন্তে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা সমাতন্ত্রের আদর্শে বলীয়ান হয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য এক নব সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। নতুন সমাজ ব্যবস্থা, নতুন মূল্যবােধ গড়ে তােলার জন্যে দেশবাসীকে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। রচনা করতে হবে পরম্পরাগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র এবং অসৎ বৃত্তিকেন্দ্রিক উচ্চাভিলাষের সমাধি। | স্বাধীনতা কেবল নিশান বদলানাে নয়। রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা সম্পূর্ণ। ভিন্ন ও এর পূনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে এবং সমবেতভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতেই বাঙলাদেশের। পরাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে ঘাতক ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলােকে চাপ সৃষ্টি করতে অনুরােধ জানাচ্ছি। ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি স্বাধীন রাষ্ট্র ভুটানকে।”
—খােন্দকার মােশতাক “মুক্তিবাহিনীর বীর তরুণ এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জওয়ানদের বীরত্বে আমরা অভিভূত।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার এবং ভারতীয় জনগণ আমাদের পাশে দাড়িয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। আমরা সােভিয়েট রাশিয়া পােল্যাণ্ড এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছেও কৃতজ্ঞ।”
“বিধ্বস্ত বাঙলাদেশ পুনর্গঠনের কাজে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তুলতেই আমরা আত্মনিয়ােগ করব।”
—মনসুর আলী। “ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। বিজয়ের এই মুহূর্তে বাঙলাদেশের জনগণকে আমরা অভিনন্দন জানই । জয়ধ্বনি দিই মুক্তিবাহিনীর তরুণ বীরদের শৌর্য ও নিবেদিত চিত্ততার। জন্যে ।
বাংলাদেশের জনগণ এবং মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করা; সন্ত্রাসের রাজত্ব থেকে তাদের দেশকে। রক্ষা করাই ছিল ভারতের উদ্দেশ্য। প্রয়ােজনের বেশী সময় আমাদের বাহিনী বাঙলাদেশে থাকবে না। | আমরা আশা করি এবং প্রার্থনা করি, নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমান জনগণের মধ্যে তার যথাযােগ্য অভিনন্দন গ্রহণ করবে এবং শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে | যাবেন। | আমরা বাঙলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানাই, সােনার বাঙলায় তাদের জন্যে যেন সমৃদ্ধ | ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে।
এ জয় তাদের একার নয়, যে সব জাতি মানবতার মূল্য দেয় তাদের সকলের জন্যে এ জয় | অশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী অভ্যান ৫১ : ৪ | ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
মুক্তাঞ্চলে অসামরিক প্রশাসনে সরকারী নির্দেশ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ তার সহকর্মীদের সাথে মুক্ত অঞ্চলে সুষ্ঠু অসামরিক প্রশাসন গড়ে তােলার জন্যে ক্রমাগত আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা | গেছে। মুক্তাঞ্চলে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনীয় যাবতীয় জিনিস সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকার সাহায্য করবেন। | বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসনে সহায়তা করবার জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকে কিছু কর্মচারী। | বাঙলাদেশ সরকার পাবার আশ্বাস পেয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে এরা বাংলাদেশে বিভিন্ন কাজ নিয়ে যাবেন এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা পুনরায় ভারতে চলে আসবেন বলে প্রকাশ। | বাংলাদেশ মন্ত্রী পরিষদ, মুক্ত অঞ্চলের প্রয়ােজনীয়তার সামগ্রিক পরিচয় না পাওয়াতে সঠিক পন্থা। গ্রহণ করতে সমর্থ হচ্ছেন না। এ ব্যাপারে গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে যে জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে তাদের কাছে থেকে এগুলি সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। এ সমস্ত খবর সরাসরি পৌছতে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ মুক্তাঞ্চলগুলাে প্রায়ই যােগাযােগ ছিন্ন ।
মুক্তাঞ্চলে অগ্রাধিকার ভুয়া প্রশাসনিক বিষয়গুলাে নিয়ে সরকার ইতিপূর্বেই কর্মপন্থা গ্রহণ। করেছে। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল –
(১) আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা (২) পাক সৈন্য ও রাজাকারবাহিনী যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ফেলে গেছে সেগুলাে উদ্ধার করা। | (৩) ছিন্নমূল জনসাধারণকে পুনর্বাসন করানাে। (৪) পূর্ণ সরকারী প্রশাসন ও গঠনমূলক তৎপরতা চালানাে।
বাংলাদেশ সরকার প্রশাসন চালানাের জন্য যে পরিমাণ অভিজ্ঞ অফিসারের প্রয়ােজন তার অভাব বােধ করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার সমস্ত সরকারী অফিসারদের যেখানে তারা অবস্থান করছেন, যে ভাবে তাদের পক্ষে সম্ভব সেভাবে তারা যেন কাজে যােগ দেন। যারা এখনাে বিচ্ছিন্ন এবং আত্মগােপন করে আছেন তাদের কাছে এ নির্দেশ আশাব্যঞ্জক হবে। | এ ছাড়াও সরকার তথ্যানুসন্ধান কমিটি নিয়ােগ করেছেন। এই কমিটি লক্ষ্য রাখবেন কোন কোন | অফিসার শক্রদের হয়ে কাজ করেছেন।
| স্বাভাবিক ভাবেই পূর্ণ সরকারী ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য মুক্তি বাহিনীর সাহায্য অতি | প্রয়ােজন। সঠিক মালিককে সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে মুক্তিবাহিনীকে সরকারকে সাহায্য করতে বলা
হয়েছে। যে লােক নিজে থেকে অবৈধভাবে দখলীকৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবে না। তাদের শাস্তি দেয়া
পুনর্গঠনের ব্যাপারে পরিকল্পনা পরিষদ যে প্রিন্ট পেশ করেছেন সরকার তা অনুমােদন করেছেন। বলেও, মুজিবনগর থেকে খবর পাওয়া গিয়েছে।
অভিযান ॥ ১: ৪ ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু থাকবে না
—নজরুল ইসলাম বিপ্লব শেষ হয়নি, বিপ্লব সবেমাত্র শুরু
—তাজউদ্দিন
যশােহর, গত ১১ই ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী যশােহর উপস্থিত হলে স্থানীয় জনগণ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত বিভিন্ন ধ্বনি সহকারে তাদেরকে অভিনন্দন জানায়। যশােহরের এই সমাবেশ বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। বাংলার রাষ্ট্রনয়কগণ এই জনসভায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যে কর্মসূচী ঘােষণা করেছেন তাতে জনগণের আশা আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার দীর্ঘ ভাষণে বলেন, “বাংলাদেশে কোন ধর্মীয় সংখ্যালঘু থাকবে না সেখানে রাজনৈতিক সংখ্যালঘু দল থাকতে পারে। বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সুখী সমৃদ্ধশালী কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। তিনি জনগণকে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে সমাজ গঠনে আত্মনিয়ােগ করার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এই জনসমাবেশে প্রায় ১ ঘণ্টাকাল ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে বাংলাদেশের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক কাঠামাে ও পররাষ্ট্রনীতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি শান্তি, শৃঙ্খলা বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুকে চূড়ান্ত আঘাত হানার আহবান জানান। তিনি দৃঢ়তার সহিত বলেন, আমাদের বিপ্লব শেষ হয়নি, বিপ্লব সবেমাত্র শুরু । সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিপ্লব চালিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ (8) a ১: ৮ ! ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
দেশের পুনর্গঠনের জন্য সকলকে আত্মনিয়ােগ করতে হবে
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও জনাব তাজউদ্দিন
| বাংলাদেশ ১৭, ডিসেম্বর। গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলার জনগণকে সম্বােধন। করে বলেন—রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি সেই স্বাধীন। বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজেও আমাদের সকলকে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। | প্রধানমন্ত্রী ভারতের উদার সাহায্য ও সমর্থনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন শরণার্থীরা শীঘ্রই স্বাধীন বাংলায় ফিরে যাবেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১ : ১৮ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
রাজধানী ঢাকায় যাচ্ছে
১৬ই ডিসেম্বর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আজ ঘােষণা করেন যে, তাঁর সরকার আগামী সপ্তাহে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তরিত করবেন ।
বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে স্বাধীন বাংলার সরকারী মহলে বিপুল আনন্দ ও উল্লাস দেখা দেয় । দলে দলে জনসাধারণ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের অভিন্দন জানাবার জন্য এগিয়ে আসেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১ : ১৮ | ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
আয়তন : ৫৪,৫০১ বর্গমাইল।
জনসংখ্যা : ৭ কোটি ৫০ লক্ষ (আনুমানিক), পৃথিবীর [অস্পষ্ট] দেশ। জনসংখ্যার দিক হইতে চীন, ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলের পরেই বাংলাদেশের স্থান।
রাজধানী ঢাকা। অস্থায়ী রাজধানী ছিল মুজিবনগর। সীমানা : উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বে ভারতবর্ষ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ।
ভূ-প্রকৃতি : সমতল ও নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা প্রধান নদ-নদী। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি [অস্পষ্ট] দক্ষিণাংশে বিখ্যাত সুন্দরবন।
| কৃষিজ উৎপন্ন : পৃথিবীর প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশ (বার্ষিক উৎপাদন ৭০ লক্ষ বেল); ধান (বার্ষিক উৎপাদন এক কোটি টন) তামাক, ডাল, সুপারি ও তৈলবীজ উল্লেখযােগ্য। | শিল্পোৎপাদন : পাট শিল্প সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য। কাগজ, নিউজ প্রিন্ট উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। চট্টগ্রামে একটি ইস্পাত শিল্প, ঢাকার নিকটে একটি মেশিন টুল কারখানা আছে। কাপড়ের কল, চিনিকল, সার, সিমেন্ট, দেশলাই ইত্যাদি। | আমদানী রপ্তানি : প্রধান রপ্তানি পাট, পাটজাত দ্রব্য, চামড়া ও বনজ সম্পদ । আমদানি। অটোমােবাইল শিল্পজাত দ্রব্য ও ঔষধ ইত্যাদি।
যাতায়তা : জলপথ, রেল, সড়ক ও বিমান। ঢাকা প্রধান বিমান বন্দর। চট্টগ্রাম ও চালনা সমুদ্র বন্দর।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ২৪ | ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
বেয়নেট দিয়ে গণতন্ত্রকে দাবিয়ে রাখা যায় না।
জনাব নজরুল ইসলাম
আমাদের প্রতিনিধির সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই। অভিমত প্রকাশ করেন যে, বেয়ােনেট দিয়ে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে কেহ দাবিয়ে রাখতে পারে না। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ এই সত্যটিই প্রমাণ করেছে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ : ১৮ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
আজকের দিনে জাতির জনক কোথায়?
—জনাব তাজউদ্দিন
মুজিব নগর, ১৬ ডিসেম্বর । বাংলা দেশের দল-মত নির্বিশেষে জাগ্রত জনগণ, মুক্তি বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতাদের মনে আজ আনন্দের বান । বিজয়ােল্লাসে চারদিক মুখরিত। কিন্তু এই স্বাধীনতার সংগ্রামে জাতিকে যিনি উদ্বুদ্ধ করলেন সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আজ কোথায় । আমাদের কাছ থেকে ১৬ শ কিলােমিটার দূরে জীবন্ত অবস্থায় তিনি পাকিস্তানের জেলে বন্দী রয়েছেন।
আজ খান সেনাদের পুরােপুরি আত্মসমর্পণের পর বাংলা দেশের প্রধান মন্ত্রী তাঁর বিবৃতিতে দুঃখ করে বলেছেন আজকের এই বিজয়ােৎসবের দিনে জাতির জনক কোথায়?
বিপ্লবী বাংলাদেশ | ১; ১৮ | ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাঙলাদেশের মূলনীতি : গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা জোটনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র
নিজস্ব সংবাদদাতা]
| গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ রাষ্ট্র গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির দ্বারা পরিচালিত হইবে। একচেটিয়া পুঁজি গড়িয়া উঠিতে দেওয়া হইবে না, মুষ্টিমেয় লােকের হাতে সম্পদের পাহাড় জমিবে না। রাজনীতির সহিত ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকিবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা। চলিবে না। | অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্ত যশােরে তাহাদের প্রথম জনসভায় গত ১১ই ডিসেম্বর সরকারের এই সকল নীতি ঘােষণা করেন। | সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাহার ভাষণে বলেন যে, প্রাপ্ত বয়স্কের সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ পরিচালিত হইবে এবং দেশের অর্থনেতিক কাঠামাে হইবে সমাজতান্ত্রিক। ব্যাঙ্ক, বীমা, ভারী ও মূল শিল্প জাতীয়করণ করা হইবে। পাট, চা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-বাণিজ্য রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে আনা হইবে। | ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি বিস্তারিত বিশ্লেষণ করিয়া জনাব ইসলাম বলেন যে, সকল ধর্মের সমান। অধিকার থাকিবে, ধর্ম বিশ্বাসের জন্য কাহাকেও নিগৃহীত হইতে হইবে না। ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হইবে। | সরকারের স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির কথা পুনর্ঘোষণা করিয়া জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন যে, ভারতের সহিত বাঙলাদেশের পারস্পরিক সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে মৈত্রী ও সহযােগিতার সম্পর্ক থাকিবে । রক্তের বন্ধনে গড়িয়া ওঠা বাঙলাদেশ-ভারত মৈত্রীর বিরুদ্ধে মহল বিশেষের অপপ্রচার সরকার সহ্য করিবে না বলিয়া নেতৃবৃন্দ হুশিয়ার করিয়া দেন। | প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ তাঁহার ভাষণে দেশের পুনর্গঠনের কঠিন কাজে সকলকে আগাইয়া। আসার আহ্বান জানান এবং শান্তি ও শৃংখলা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করার আহ্বান জানান।
কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের সফর
পাক হানাদার সৈন্যদের কবল হইতে যশাের শহর মুক্ত হওয়ার পর গত ১৪ই ডিসেম্বর | বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির তিনি জন সদস্য কমরেড মণি সিং, কমরেড খােকা
রায় ও কমরেড কবির আহমেদ যশাের শহর সফর করেন। তাহারা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়া । জনগণের সহিত আলাপ-আলােচনা করেন। | যশাের শহরে নূতন স্থাপিত কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ে নেতৃবৃন্দ স্থানীয় পার্টি কর্মী ও মুক্তিযােদ্ধাদের সহিত আলােচনা করেন।
ন্যাপের জনসভা
গত বুধবার যশােরের টাউন হল ময়দানে আয়ােজিত এক বিরাট জনসভায় বাঙলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতৃবৃন্দ ঘােষণা করেন যে, বাঙলাদেশকে সত্যিকার সুখী সমৃদ্ধিশালী ও প্রগতিশীল। রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিয়াই লক্ষ শহীদানের আত্মত্যাগকে সার্থক করিয়া তুলিতে হইবে।
সভায় বাঙলাদেশে আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ তাহার বক্তৃতায় ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্লেষণ দিয়া বলেন যে, এই নীতি সকল ধর্মের সমান অধিকারের সাথে সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহকেও রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ বলেন যে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির অর্থ শত্রু এবং মিত্র উভয়ের প্রতি নিরপেক্ষ থাকা নয়। তিনি বলেন, বাঙলাদেশের জনগণ তাহাদের মুক্তিসংগ্রামের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের বর্তমান সরকারের সঙ্গে মিত্র ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিকে একই দৃষ্টিতে দেখিতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির ভিত্তিকে মজবুত করার জন্যই সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলির সহিত দৃঢ় মৈত্রীর সম্পর্ক গড়িয়া তুলিতে হইবে।
মতিয়া চৌধুরী।
| বাঙলাদেশের অগ্নিকন্যা ন্যাপ নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় উপলক্ষে সংগ্রামী দেশবাসী, মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীকে অভিনন্দন জানান এবং দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার লড়াইয়ে যারা প্রাণ দিয়াছেন সেই অগণিত বীর শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য ও সমর্থনের জন্য ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। | মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাঙলাদেশ হানাদারদের কবল মুক্ত হইয়াছে, কিন্তু উহার পুনর্গঠন, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন প্রভৃতি দুরূহ কাজ আমাদের সামনে রহিয়াছে। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন যে-সকল রাজনৈতিক দল বা শক্তি স্বাধীনতার সংগ্রামে রক্ত ঢালিয়াছেন তাহাদের একতা। তিনি বলেন, আসুন সকল সঙ্কীর্ণ দলাদলি ভুলিয়া আমরা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া স্বাধীন বাঙলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধিশালী সত্যিকারের সােনার বাঙালা রূপে গড়িয়া তুলি সকল প্রকার শােষণ পীড়নের অবসান ঘটাই।
সভায় সভাপতিত্ব করেন যশাের ন্যাপ সভাপতি জনাব আবদুর রাজ্জাক এবং বক্তৃতা করেন বাঙলাদেশ ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন, যশােরের ন্যাপ নেতা জনাব নুরুল ইসলাম ও কাজী আবদুস শহিদ। | সভায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য-সমর্থন দানের জন্য ভারত এবং সােভিয়েত ইউনিয়ন। ও পােল্যাণ্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিন্দন জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এক প্রস্তাবে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন ইত্যাদি কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য মুক্তিসংগ্রামী সকল দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন এবং সকল পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ গণকমিটি গঠনের আহ্বান জানানাে হয়।
প্রস্তাবে রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয় এবং তাহার জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানাে হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ২৪ ॥ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
একটি মহত্তম ব্যবস্থা | (জয়বাংলা প্রতিনিধি)
বাংলাদেশ সরকার দখলদার হিংস্র হায়েনাদের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত আমাদের রক্তস্নাত দেশের লাখাে লাখাে উৎপীড়িত মা-বােনদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এক অননুকরণীয় মানবিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন।
আমাদের স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ, এইচ, এম, কারুজ্জামান বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে মুজিবনগরে এ ঘােষণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমাদের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বহু মা-বােন হানাদার দস্যুদের হাতে ধর্ষিত হয়েছেন, অপহৃত হয়েছেন। তাদের “যুদ্ধ বীরের সম্মান দেওয়া হবে। | তিনি বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝটিকা বিক্ষুব্ধ দিন গুলিতে আমাদের নারী সমাজ আত্মত্যাগের যে সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বর্বর হানাদার বাহিনীর সাথে সংগ্রাম বিজয়ী মুক্তিযােদ্ধাদের | চাইতে কম গৌরবােজ্জ্বল নয়।
| জনাব কামরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের জনগণ তাদের সম্মানের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং সরকার তাদের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জয়বাংলা (১) # ১: ৩৪ | ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের কাছে আবেদন
জনাব কামরুজ্জামান অপর এক বিবৃতিতে বাঙলাদেশের কোটি কোটি ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বাঙলাদেশকে সমর্থনকারী বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং বন্ধু রাষ্ট্রের নিকট আবেদন জানান।
জয়বাংলা (১) # ১: ৩৪ | ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
বিপুল সম্বর্ধনা
বুধবার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য নেতা মুজিবনগর থেকে ঢাকা পৌছলে তাদের বিপুল সম্বর্ধনা জানান হয়।
জয়বাংলা (১) # ১: ৩৪ | ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকা কলকাতা দিল্লী
কলকাতা ও দিল্লীর সঙ্গে ঢাকার টেলিফোন যােগাযােগ সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে।
| আমাদের ডাক ও তার বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল জনাব লােকমান হােসেন ভারতের যােগাযােগ দফতরের সেক্রেটারী শ্ৰী এন, ভি, শেলয় ও ভারত সরকারের উপদেষ্টা শ্ৰী এম, কে বসুর সঙ্গে গত ১৮ই ডিসেম্বর নতুন লাইনে কথাবার্তা বলেছেন। উল্লেখযােগ্য, ভারতের বিদেশ সংযােগ ব্যবস্থার আওতায় এই টেলিফোন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে।
জয়বাংলা (১) ! ১: ৩৪! ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
আমরা দেশকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তুলব।
কামরুজ্জামান (কলিকাতা প্রতিনিধি)
গত ১৯শে ডিসেম্বর আমাদের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন পৃথিবীর মুক্তি আন্দোলনের অঙ্গ। আমেরিকা ও চীনের ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও আমাদের সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়েছে। এ জয়কে সুনিশ্চিত করেছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও সােভিয়েট ইউনিয়নের সমর্থন।’ | জনাব কামরুজ্জামান ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী সমিতি আয়ােজিত জনসভায় আরাে বলেন, ‘আমরা দেশকে পুজিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তুলব।’
জয়বাংলা (১) এ ১: ৩৪ | ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
রাজধানী মুজিবনগর থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত | অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় আগমন
ঢাকা : ২২শে ডিসেম্বর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তার মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ দীর্ঘ ৯ মাস পর বাংলাদেশ সরকারের সকল দপ্তরসহ ঢাকায় আগমন করেন। নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করলে মুক্তিপাগল জনগণ আনন্দ উল্লাসে বিহ্বল হয়ে পড়ে। ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ফুলের পাপড়িতে ভরে উঠে তেজগা বিমান বন্দর। এরপর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর বীর জোয়ানরা নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার দিয়ে সম্বর্ধনা জানান। উৎসবমুখর জনতার সম্মুখে সংক্ষিপ্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, দীর্ঘ ৯ মাস কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আজ আমরা স্বাধীন হয়েছি। এই কৃতিত্বের দাবীদার আমরা নই। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি জনতার সুদৃঢ় ঐক্য আর আত্মত্যাগ, এ-সাফল্য এনে দিয়েছে বাংলার বীর মুক্তিবাহিনী । অস্ত্র ধরে প্রমাণ করে দিয়েছে পৃথিবরি কোন শক্তি স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীকে দমন করতে পারে না এবং ভবিষ্যতেও পারবে
। তিনি বাংলার জনগণকে হুশিয়ার করে বলেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা আর আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ভারত সরকারের। ভারত ও বাংলাদেশ দু’টো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। শত্রুদের বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার দ্বারা কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। তিনি বলেন, কুপমণ্ডুকতার পরিবর্তে গতিশীলতা, কুসংস্কারের পরিবর্তে নতুন ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের বিপ্লব অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী ?
প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ তেজগা বিমান বন্দরে সমবেত লক্ষাধিক জনতার উদ্দেশ্যে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন, বাংলার জনগণ রক্ত আর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে যে স্বাধীনতা লাভ করলাে, তা টিকে থাকবেই থাকবে। লাখাে লাখাে শহীদের রক্তে যে বাংলার মাটি উর্বর হয়েছে সে মাটির ফসল বাংলার গরীব, চাষী, তাঁতী ও সাধারণ মানুষ ভােগ করবে; তাতে পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদীদের হাত বাড়াতে দেয়া হবে না। আমাদের বিপ্লব শেষ হয়নি, নিরন্ন মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য সাম্যবাদী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বিপ্লব চলতে থাকবে।
বাংলাদেশ (৪) ॥ ১ : ৯ ! ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১।
ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তরিত
গত ২২শে ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও তাহার মন্ত্রিসভার অপরাপর সদস্যদের ঢাকা আগমনের মধ্য দিয়া স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের রাজধানী মুজিবনগর হইতে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়।
বাঙলাদেশ সরকারের নেতৃবর্গ ঢাকায় পৌছিলে তেজগাঁও বিমানবন্দরে সমবেত লক্ষাধিক জনতা তাহাদের প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। নয় মাস দখলদার পাক বাহিনীর পদানত থাকার পর সদ্যমুক্ত ঢাকার সংগ্রামী জনতা এই দিন যেন বাঁধভাঙা জোয়ারের মত ভাঙিয়া পড়ে।
বিকাল চারটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে নেতৃবৃন্দকে বহনকারী একটি বিশেষ হেলিকপ্টার তেজগাঁও বিমান বন্দরের মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে জনতার লক্ষ কণ্ঠে শ্লোগান ওঠে—জয় বাঙলা, মুক্তিবাহিনী। মিত্রবাহনী জিন্দাবাদ, শেখ মুজিবকে মুক্ত কর, বাঙলাদেশ-ভারত মৈত্রী জিন্দাবাদ, বাংলাদেশসােভিয়েত মৈত্রী জিন্দাবাদ, মহান সােভিয়েত দেশ জিন্দাবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হােক।
অন্যান্যদের মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মণি সিং, ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, ন্যাপ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী বিমানবন্দরে বাঙলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দকে । সংবর্ধনা জানান।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী নেতৃবর্গকে গার্ড অব অনার প্রদান করে।
রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর বাঙলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক গত | বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে (পূর্বর্তন গভর্নর হাউস) অনুষ্ঠিত হয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হইবে বাঙলা এবং | উহা সরকারী অফিস, আদালত সহ সর্বস্তরে চালু হইবে । স্টেট ব্যাঙ্কের নাম হইবে বাঙলাদেশ ব্যাঙ্ক।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের জন্য ঢাকায় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হইবে। শহীদদের পরিবারবর্গের সাহায্যের। জন্য তহবিল খােলা হইবে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবিলম্বে পুনর্নির্মিত হইবে এবং এই জন্য কমিটি নিযুক্ত হইবে।
জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরাে, পাকিস্তান কাউন্সিল ও প্রেস ট্রাস্ট বিলুপ্ত হইবে। ইহার জন্য প্রয়ােজনীয় আর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করা হইতেছে।
২৫শে মার্চের পরে গৃহীত সকল পরীক্ষাদি বাতিল বলিয়া ঘােষিত হইল এবং তদস্থলে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে শীঘ্রই পরীক্ষা গৃহীত হইবে যাহাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ২৫ ॥ ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশ মার্কিন সাহায্য নিবে না
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সম্প্রতি মুজিব নগরে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের যে-কোন সাহায্যের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা হইবে।
ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটে সরকারী কর্মচারিদের এক সমাবেশে গত বৃহস্পতিবার তিনি পূর্বের এই উক্তির পুনরাবৃত্তি করিয়া বলেন, প্রয়ােজন হইলে উপবাস করিয়া থাকিৰ তথাপি বাঙালীদের রক্তে রঞ্জিত হাত হইতে আমরা কোন সাহায্য নিব না।
| জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সেক্রেটারিয়েটের সমাবেশে স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে, কোন কোন বিদেশী চক্র বাঙলাদেশের সহিত ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টির জন্য গােপনে ষড়যন্ত্র করিতেছে। তিনি এই সকল চক্রকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়া বলেন যে, তাহাদের কার্যকলাপ বরদাশত করা হইবে না। | জনাব তাজউদ্দিন চীনের বাঙলাদেশ বিরােধী ভূমিকার নিন্দা করেন এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা বাঙলাদেশকে আর একটি ভিয়েতনামে পরিণত করিতে চাহিয়াছিল বলিয়াও অভিযােগ করেন। বাঙলাদেশের শত্রুরা অভ্যন্তরীণ গােলযােগ সৃষ্টি এবং বাহির হইতে প্রভাব বিস্তার করিতে সচেষ্ট রহিয়াছে বলিয়া তিনি দেশবাসীকে হুঁশিয়ার করিয়া দেন। | প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শত্রুতাকারী কোন কোন শক্তি এখন টাকার থলি। নিয়া আসিয়া বাঙলাদেশকে প্রলুব্ধ করিতে চেষ্টা করিবে কিন্তু আমরা কিছুতেই তাহাদের ফাঁদে পা দিয়া ভারত ও সােভিয়েতের সহিত বন্ধুত্ব জলাঞ্জলি দিতে পারি না। তিনি ভারতের জনগণ, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাঙলাদেশের জনগণের তরফ হইতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। সােভিয়েত সরকার ও জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া তিনি বলেন যে, নিরাপত্তা পরিষদের ভিতরে ও বাহিরে সােভিয়েতের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের ষড়যন্ত্র প্রতিরােধ করা সুকঠিন হইত।
শ্ৰোতৃমণ্ডলী শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’, ‘বাঙলাদেশ-ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী জিন্দাবাদ’, প্রভৃতি শ্লোগানে সভাস্থল মুখরিত করিয়া তােলেন।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১; ২৫ ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সাংস্কৃতিক মুক্তি পরিষদের প্রশংসনীয় অভিযান
বলাই পাল প্রদত্ত
গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগর থেকে অর্থমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী সাহেব বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করতে এলে বাঙলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি পরিষদ তার সম্মানে “অপরাজেয় বাংলাদেশ” নামক একটি গীতি নকশার আয়ােজন করেন।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতে সহযােগিতা করেছেন উত্তরাঞ্চলের প্রশাসক জনাব ফয়েজ আহমেদ। এই অনুষ্টানে মন্ত্রী মহােদয়কে স্বাগত জানিয়ে বক্তৃতা করেন ডা. এ, আর চৌধুরী ও জনাব গাজী রহমান এম, পি, এ এবং অভিনন্দনের জবাবে মন্ত্রীমহােদয় বলেন “আমাদের আর বেশী দিন বাকী। নেই দিন দেশ থেকে হানাদার মুক্ত বলে আমরা দেশে ফিরে যাব।” এই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন …
রণাঙ্গন (৩) ॥ ১৯৭১
বাঙলা দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। প্রশাসনিক কাজ শুরুর ২য় পদক্ষেপ
বাঙলা দেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাজ পুরােদমে চলছে। রংপুর জেলার পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধার বিস্তীর্ণ এলাকায় তার যােগাযােগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং সরকারী কর্মচারীরা নিজ নিজ দায়ীত্ব পালন করে চলেছেন। এই বিস্তীর্ণ এলাকার জনসাধারণ বাঙলাদেশ সরকারের কর, খাজনা ইত্যাদি পরিশােধ করছেন। | এই এলাকার প্রশাসনিক কাল চালুর দ্বিতীয় পদক্ষেপ স্বরূপ সরকার ১টি হাই স্কুল ও ১৩টি অবৈতিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া শিক্ষার জন্য স্কুল সমূহ খুলে নিয়মিত ক্লাশ পরিচালনা করছেন। ছাত্র সংখ্যা আশাতিরিক্ত ভাবে নিজেদের ক্লাশে যােগদান করছে। শতকরা ৮৫ জন ছাত্র নিয়মিত ক্লাশে যােগদান করে বলে খবর পাওয়া গেছে। সত্বর এখানে কয়েকটি ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে বলেও খবরে প্রকাশ।
রণাঙ্গন (৩) ॥ ১৯৭১
দেশবাসীর প্রতি
মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্জি মাটি শক্র কবলমুক্ত না করা পর্যন্ত আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার এই সংগ্রাম চলবেই । বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী বাংগালীই আজ মুক্তি সেনা।
মুক্তিবাহিনীর প্রতি
বাংলামায়ের দামাল ছেলেরা চরম ধৈৰ্য, ত্যাগ ও তিতীক্ষার মধ্য দিয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে যে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে বিশ্বের কোন শক্তিই এঁদের অগ্রাভিযানকে আর রােধ করতে পারবে না। কেননা এঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত। বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর বিজয় গাঁথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এঁরা বাংলাদেশ ও জাতির গৌরব।
বিশ্ববাসীর প্রতি
পৃথিবীর সমস্ত দেশের প্রতি আমরা সহযােগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করেছি। জোট-নিরপেক্ষতাই হচ্ছে আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি। গণতন্ত্রের আদর্শকে সামনে রেখে ধর্ম-নিরপেক্ষ ও শােষণহীন সমাজ ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করাই আমাদের লক্ষ্য। (প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মদ)
| ওরা দুজয় ওরা দুর্বার ১ : ২ # ১৯৭১
বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকা নগরী
২৫শে মার্চ, সেই ভয়াল রাত্রিতে ঢাকা নগরী থেকে যে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে | দেওয়া হয় তাদের মধ্যে আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইম-এর সংবাদদাতা ডান কগিনও | ছিলেন। ঢাকার নারকীয় হত্যাকান্ডের কোন খবর যাতে বাইরে বিশ্বের মানুষ না জানতে পারে, একথা | ভেবেই জঙ্গীশাহী ঢাকায় থাকতে দেননি কোন বিদেশী সাংবাদিককে। সর্বপ্রকার খবরের উপর
পাকিস্তান সরকার চেয়েছিলেন নিষেধাজ্ঞার কালাে পরদা টাঙ্গিয়ে দিতে । সারা পৃথিবীর মানুষকে বােকা বানাতে। তাদের নাদীরশাহী অত্যাচারের কুকীর্তি ঢেকে রাখতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। একাধিক সাংবাদিক মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে পরে সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন বাঙলাদেশের মধ্যে; সংগ্রহ করে আনেন এবং এখনও আনছেন নানা খবর। আর এই সব খবর সৃষ্টি করছে বিশ্ব জনমত। ধিক্কার উচ্চারিত হচ্ছে ইয়াহিয়া সরকার ও তার জঙ্গী চক্রের বিরুদ্ধে। টাইম পত্রিকার সাংবাদিক ডান কগিন পশ্চিম বাঙলা থেকে হুন্ডায় চড়ে প্রবেশ করেন বাঙলাদেশে। তারপর বাসে, ট্রাকে, সাইকেলে চেপে পৌছান ঢাকা সহরে। সেখান থেকে আবার খবর সংগ্রহ করে ফিরে আসেন ভারতে। তিনিই প্রথম। মার্কিন সাংবাদিক যিনি ঢাকায় গিয়ে নিজে চোখে দেখে বাইরের বিশ্বে ইয়াহিয়া শাহীর কুকীর্তির কথা বিশ্ব সমক্ষে তুলে ধরেছেন।
কগিন লিখেছেন।
| ঢাকা এখনও মৃত নগরী। সামরিক আক্রমণের এক মাস পরেও সরকারি দপ্তরে, অফিস আদালত কিছুই চালু করা সম্ভব হয়নি। কত লােক মারা গিয়েছে তার হিসাব এখনও দেওয়া চলে না। হাজার হাজার লােক নিহত হয়েছে সামরিক আক্রমণে । ঢাকা সহরের অর্ধেক কি তার বেশী লােক পালিয়ে গিয়েছে সহর ছেড়ে। সহরে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে দারুণ ভাবে। সহরের ১৮টি বাজারের মধ্যে ১৪টি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক সামরিক বাহিনী। যে সব পথে একসময় মানুষের ভিড়ে পথ চলা দায় হত, সে সব পথ আজ প্রায় জনশূন্য। বিজন পথে, পথ চলতে ভয় করে। | সহরের বাড়ীগুলির মাথায় মাথায় উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা। অনেক স্থানেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে জিন্না এমনকি ইয়াহিয়া সাহেবের বড় বড় ছবি। কিন্তু এসবই বাহ্যিক । প্রত্যেকটি বাঙালীর মনে জ্বলছে আগুন। তারা মনে করছেন, যুদ্ধে তাদের হার হয়নি। তারা আপাতত পিছিয়ে গিয়েছেন মাত্র। একজন বাঙালী আমার কথার উত্তরে বলল, “আমরা ভুলে যাব না কখনও এই স্মৃতি। আমরা কখনও ক্ষমা করবাে না ওদের।”
আমি সাংবাদিক একথা জানতে পেরে সহরের অনেকে আমাকে নিয়ে চলল দেখাতে সেই সমস্ত স্থান গুলি, যেখানে মাটিতে খাদ খুড়ে দেওয়া হয়েছে বহু লােককে কবর । আমি জানতে পারলাম, ধর্ম প্রাণ মানুষও রেহাই পাইনি হত্যাযজ্ঞ থেকে। মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে বের হবার সময় গুলি করে মারা হয়েছে বৃদ্ধকে। সেনা বাহিনীকে বােঝান হয়েছে বাঙালী মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করবার মধ্যে কোন অপরাধ নেই, বরং সওয়াব হবে। কারণ বাঙালী মুসলমানরা আসলে ছদ্মবেশী হিন্দু। শুধু এই নয়, ঢাকায় একাধিক নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ৫০০ ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে পুরান ঢাকার । সেখানেই ঘটেছে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ও জঘন্য হত্যাকান্ড ।। পুরান ঢাকার একাধিক অংশ বাড়ীতে পেট্রল ঢেলে তার উপর গােলা ছুড়ে ধরিয়ে দেওয়া | হয় আগুন। মানুষ যখন বাইরে পালাতে যায়, তখনই তাদের উপর মেশিন গান থেকে ছোঁড়া হয় গুলি।
কিন্তু তথাপি মানুষের মনােবল ভেঙ্গে যায়নি। যেখানেই আমি গিয়েছি সর্বত্র লক্ষ্য করেছি মানুষের অবাক করা মনােবল। তাদের সকলেরই এক প্রতিজ্ঞা কি ভাবে পাক বাহিনীকে উৎখাত করে দেশকে চিরতরে মুক্ত করা যাবে; | কগিন মন্তব্য করেছেন, বর্ষাকাল আসছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে। ভয়ঙ্কর সংকট। ইসলামাবাদকে হয়ত বুঝতে হবে, কেবল গায়ের জোরে একতা রক্ষা করা যায় না এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্না ঠিক এমনি পাকিস্তানের কথা কখনও চিন্তা করেননি। (টাইম, ৩রা মে, ১৯৭১)।
জয় বাংলা (১) # ১:১৪ ১১ মে ১৯৭১ হবু রাজার শাসনে!
| হবু রাজার দেশে গৰু মন্ত্রী হবে তাতে বিচিত্র কি? বাংলা দেশের অর্থে পােষা সেনাবাহিনীতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানা স্কুল পালানাে টিক্কা খান জেনারেল হয়েছেন তাতেও হয়তাে অনেকে। আশ্চর্য হননি। কিন্তু হাল আমলের হবু রাজা টিক্কা খান বাংলাদেশে আজ যা করছে তাতে বােধ হয় আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না। | বাংলাদেশে লাখাে লাখাে বাঙালীকে মেরে জল্লাদ টিক্কা খান বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার (অবশ্য বাংলা দেশে কোন পর্যায়ে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কথা টিক্কা খানদের মুখপত্র ও মুখপাত্ররা কোন সময়ই স্বীকার করেনি) জন্য টিক্কা খান পাগল হয়ে গেছে। ফলে অনেকেরই কপাল খুলে গেছে। কেননা, হাতের কাছে বিশ্বস্ত লােক যাকেই পাচ্ছে তাকেই নিয়ে জোর করে বা বিনা জোরে বসিয়ে দিচ্ছে প্রশাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন পদে। এর ফলে অনেক গৃহভৃত্য হয়েছে থানার দারােগা, পান-বিড়িওয়ালা হয়েছে ও-সি, কেরাণী হয়েছে এস, ডি, ও, দারােগা হয়েছে এস, পি এবং কনভেনশন লীগের দাগী চোর ডাকাত হয়েছে ডি, সি।
আমাদের কথায় বিশ্বাস না হয় টিক্কারূপী হবু রাজার দেশ থেকে একবার ঘুরে আসুন। দেখবেন। চট্টগ্রামের এস, পি’র পদে যে লােকটি বসে আছে সে ছিল ঢাকারই এক দারােগা । পাবনা ও রাজশাহীর ডি, সি-র পদে যারা অধিষ্ঠিত হয়েছে তারা মাত্র দেড় মাস আগেও বাংলা দেশের দাগী আসামী রূপে সুপরিচিত ছিল।
| আর রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার ও, সি হিসাবে যে লােকটি সমাসীন আছে মাত্র দেড় মাস। আগেও সে ছিল গৃহভৃত্য। | প্রকাশ, থানার দায়িত্ব পেয়েই এই ‘ও, সি সাহেব’ পুলিশ দল নিয়ে গিয়েছেন তার থানার এলাকাধীন একটি গ্রামে লুটতরাজ করতে। কিন্তু ঘটনাস্থলে যে অপ্রত্যাশিত নাটকের অবতারণা হয়েছে। তাতে ওসি সাহেব লজ্জা পেয়েছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই; তবে যার বাড়ী লুট করতে গিয়েছিলেন সেই ভদ্রলােক যে লজ্জা পেয়েছেন এবং মনের দুঃখে বনে গিয়েছেন সে বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত। প্রকাশ, এই ‘ও-সি সাহেব, ২৫শে মার্চের আগে পর্যন্ত জেলা শহরে ঐ ভদ্রলােকের বাসার চাকর ছিলেন। তাই মনের দুঃখে ভদ্রলােক সপরিবারে অনিশ্চিত পথে পাড়ি জমিয়েছেন।
জয়বাংলা (১) # ১ : ৩ ২৬ মে ১৯৭১
পাক গােয়েবলসদের স্বাভাবিক অবস্থার নমুনা !
পাক দস্যু কবলিত বাংলা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বলে পাক বেতার থেকে জঙ্গী শাহী আদা জল খেয়ে গােয়েবলসীর কায়দায় যতই গলাবাজী করুক না কেন প্রকৃত পক্ষে স্বাভাবিক
অবস্থা যে জঙ্গী শাহীর দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয় একথা বিশ্বের বিভিন্ন পত্র পত্রিকাসহ বিভিন্ন সময়ে বাংলা দেশের অধিকৃত এলাকা সফরকারী বিদেশী প্রতিনিধিগণও স্বীকার করেছেন।
| ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, ঢাকার বিভিন্ন সরকারী আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানে কিছু। সংখ্যক বাঙ্গালী কর্মচারী যােগ দিলেও প্রকৃত পক্ষে অফিসে কোন কাজকর্মই হয় না। কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে সময় কাটিয়ে কর্মচারিগণ পাঞ্জাবী জল্লাদদের ভয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে যান। ঢাকানারায়ণগঞ্জের আশে পাশের কলকারখানাগুলােতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। তবে জল্লাদ বাহিনী। কোন-কোন কলকারখানার মালীক বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের কারখানাগুলােতে পূর্বের ন্যায় নিয়মিত সিটি বাজিয়ে এবং কিছুক্ষণের জন্য কারখানার ইঞ্জিন চালু করে চিমনা দিয়ে ধােয়া উদগীরণ করিয়ে বুঝতে চায় যে কলকারখানায় কাজ চলছে। কিন্তু ভিতরে জল্লাদ বাহিনীর। পদলেহী অবাঙ্গালী উর্দুভাষী এক শ্রেণীর লােক কিছুক্ষণ সােরগােল করে থাকে! এরা কাজ কিছুই বুঝে
চা বাগানে কাজ বন্ধ।
সিলেট থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে, সিলেট জেলার চা বাগানগুলােতে কোন কাজই হচ্ছে । । চা বাগানের শ্রমিকগণ পশ্চিমা জল্লাদ বাহিনীল আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য শ্রমিক পল্লী ছেড়ে দিয়ে পলায়ন করেছে। অপর দিকে উন্মত্ত জল্লাদ বাহিনী অভুক্ত কুকুর কর্তৃক পরিত্যক্ত ছেড়া জুতা কামড়ানাের মতাে চা বাগান শ্রমিকদের পরিত্যাক্ত জীর্ণ কুটীরগুলাে জ্বালিয়ে দিয়ে বীরত্বের ছাপ রেখেছে। | যােগাযােগ ব্যবস্থা বলতে অধিকৃত এলাকায় কিছু নেই। বাংলা দেশের প্রায় সব জায়গায় রেল লাইন উঠিয়ে ফেলায় এবং রেলওয়ের সেতু ধ্বংস করে দেয়ায় জঙ্গী শাহী এখনও রেল গাড়ী চালু করতে পারেনি। কেবল ঢাকা থেকে নিকটবর্তী নরসিংদী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যে দিনে একটি ট্রেন চলাচল। করে । কোনদিন বা কোন ট্রেনই চলে না। অবশ্য ট্রেনে কোন বাঙ্গালী আরােহী উঠেন না উর্দুভাষী। একশ্রেণীর লােক চলাচল করে তাকে এবং এরা মুক্তি বাহিনীর হাতে নিহত পাক দস্যুদের লাশ উঠানামা করায়ে সেনা বাহিনীকে সাহায্য করে।
ঢাকা, কুমিল্লা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রামে প্রভৃতি শহরে কেবল অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের কিছু দোকানপাট খােলা হয়ে থাকে। | অধিকৃত পাক বেতার থেকে প্রত্যহ ঢালাও চেচামেচি করলেও বাংলা দেশের অধিকৃত এলাকার। কোন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী আসছেন না। কেবল উর্দুভাষী পাঞ্জাবী তাবেদারদের কতিপয় অছাত্র ছেলেমেয়ে পাঠ্য তালিকা বহির্ভূত কতিপয় বইপত্র বগল তলায় নিয়ে শহরের স্কুল কলেজগুলােতে যাতায়াত করে থাকে। অবশ্য কেবল বিদেশী প্রতিনিধিদল শহর পরিদর্শন কালেই কেবল এ দৃশ্যের অবতারণা করা হয়ে থাকে।
এ ছাড়া, বাংলার অধিকৃত এলাকায় খেলার মাঠগুলাে শূন্য খাঁ খাঁ করছে। খেলা ধুলা নেই, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানও বন্ধ । সিনেমা হল গুলাের দরজা তালাবন্ধ। ঢাকার কয়েকটি ছবি ঘরে। কেবল উর্দু ছবি চলছে। এর দর্শক হচ্ছে কেবল উর্দু ভাসীরাই। এই হচ্ছে বাংলা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি।
জয় বাংলা (১) [ ১ : ৯ ৯ জুলাই ১৯৭১
পাক গােয়েবলসদের স্বাভাবিক অবস্থার নমুনা!
| পাক দস্যু কবলিত বাংলা দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বলে পাক বেতার থেকে জঙ্গী শাহী আদা জল খেয়ে গােয়েবলসীয় কায়দায় যতই গলাবাজী করুক না কেন প্রকৃত পক্ষে স্বাভাবিক অবস্থা যে জঙ্গী শাহীর দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয় একথা বিশ্বের বিভিন্ন পত্র পত্রিকাসহ বিভিন্ন সময়ে বাংলা দেশের অধিকৃত এলাকা সফরকারী বিদেশী প্রতিনিধিগণও স্বীকার করেছেন।
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, ঢাকার বিভিন্ন সরকারী আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানে কিছু সংখ্যক বাঙ্গালী কর্মচারী যােগ দিলেও প্রকৃত পক্ষে অফিসে কোন কাজকর্মই হয় না। কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে সময় কাটিয়ে কর্মচারিগণ পাঞ্জাবী জল্লাদদের ভয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে যান। ঢাকানারায়ণগঞ্জের আশে পাশের কল-কারখানাগুলােতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। তবে জল্লাদ বাহিনী কোন-কোন কলকাখানার মালিক বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের কারখানাগুলােতে পূর্বের ন্যায় নিয়মিত সিটি বাজিয়ে এবং কিছুক্ষণের জন্য কারখানার ইঞ্জিন চালু করে চিমনী দিয়ে ধােয়া উদ্গীরণ করিয়ে বুঝাতে চায় যে কলকারখানায় কাজ চলছে। কিন্তু ভিতরে জল্লাদ বাহিনীর পদলেহী অবাঙ্গালী উর্দুভাষী এক শ্রেণীর লােক কিছুক্ষণ সােরগােল করে থাকে। এরা কাজ কিছুই বুঝে না। | অধিকৃত পাক বেতার থেকে প্রত্যহ ঢালাও চেঁচামেচি করলেও বাংলা দেশের অধিকৃত এলাকার কোন স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রী আসছেন না। কেবল উর্দুভাষী পাঞ্জাবী তাবেদারদের কতিপয় অছাত্র ছেলেমেয়ে পাঠ্য তালিকা বহির্ভূত কতিপয় বইপত্র বগল তলায় নিয়ে শহরের স্কুল কলেজগুলােতে যাতায়াত করে থাকে। অবশ্য কেবল বিদেশী প্রতিনিধিদল শহর পরিদর্শন কালেই কেবল এ দৃশ্যের অবতারণা করা হয়ে থাকে।
এ ছাড়া, বাংলার অধিকৃত এলাকায় খেলার মাঠগুলাে শূন্য খাঁ খাঁ করছে। খেলা ধূলা নেই, সামাজিক আচার অনুষ্ঠানও বন্ধ । সিনেমা হল গুলাের দরজা তালাবন্ধ । ঢাকার কয়েকটি ছবি ঘরে কেবল উর্দু ছবি চলছে। এর দর্শক হচ্ছে কেবল উর্দু ভাষীরাই। এই হচ্ছে বাংলা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি।
স্বদেশ ॥ ১; ৩ | ১৪ জুলাই ১৯৭১
বাচ্চু কোথায়? (নিজস্ব প্রতিনিধি)
বর্বর পাক সেনারা ফেঞ্চুগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ জনাব আছকর আলীর কলেজে অধ্যয়নরত ছেলে আসাদুজ্জামান ওরফে বাচ্চুকে গত ৪ঠা মে ধরে নিয়ে গিয়েছিল । বাচ্চু আর ফিরে আসেনি কিংবা তার কোন খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকায় হানাদার শয়তানেরা এক সন্ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছে। তারা স্থানীয় থানা আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক জনাব আবুল হােসেনের বাসায় অগ্নিসংযােগ করে বাসার সমস্ত মূল্যবান দ্রব্যাদি লুঠ করে নিয়ে গেছে। তারা জনাব আছকর আলীর দুখানা পাকা ঘর, হাজী সিদ্দেক আলীর একখানা পাকা ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা এখন ফেঞ্চুগঞ্জ রেলওয়ে ব্রীজের দুপাশে দুটি ক্যাম্প করে অবস্থান করছে এবং অত্যাচার উৎপীড়ণের মাধ্যমে এলাকাবাসীর জীবন দুর্বিসহ করে তােলছে। বর্তমানে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন পাকসৈন্য এখানে অবস্থান করছে।
জয়বাংলা (৩) # ১৪ সংখ্যা | ১৭ জুলাই ১৯৭১
| আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামের বাড়ী পুড়িয়ে দিয়েছে।
| (নিজস্ব প্রতিনিধি)।
সম্প্রতি বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও বিয়ানীবাজার থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামের বাড়ীতে হামলা চালিয়ে হানাদার বাহিনী তাঁর পাকা বাসগৃহ পুড়িয়ে দিয়েছে। | অপর এক সংবাদে জানা গেছে জেলা আওয়ামীলীগের কৃষি সম্পাদক জনাব নজির আহমদের চর মােহাম্মদপুরস্থ বাড়ীতে শান্তি কমিটীর দালাল আখতার চৌধুরী ৫ জন সশস্ত্র হানাদার নিয়ে হামলা চালিয়ে তিনখানা ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। অধিকন্তু, তারা ভিটেগুলি খনন করে গােপন আস্তানার সন্ধান চালায়। | বিয়ানীবাজার এলাকায় দস্যু বাহিনী যাদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে তারা হচ্ছেন অধ্যক্ষ ইমদাদুর রহমান, হাজী তফজ্জুল আলী, আসিদ আলী, আবদুল লতিফ সমছ খান, আবদুর রহমান, কমর উদ্দিন, কাজী আলাউদ্দিন, আবদুল মুব্বির, ইন্দাজ আলী, নছিব আলী ও সিরাজ উদ্দিন। (এতদ্বিষয়ক সংবাদ পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে এবং পূর্বে যাদের তালিকা দেওয়া হয়েছে এ তালিকায় তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে।)
জয় বাংলা (৩} ১৪ সংখ্যা ॥ ১৭ জুলাই ১৯৭১
সাব্বাশ ভাই সাব্বাশ দিই সাব্বাশ তাের শমসেরে
(জয় বাংলা প্রতিনিধি)
সম্প্রতি নবীগঞ্জ থানার নবীগঞ্জ ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামীলীগের আহ্বায়ক বাবু বিধুভূষণ দাশগুপ্তের বাড়ীতে কতিপয় দালাল রাইফেল, পিস্তল ইত্যাদি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে তিনি নির্ভীকভাবে মাত্র একটী বন্দুক নিয়ে তাদের মােকাবেলা করেন। আক্রমণকারী দল আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা নেবার পূর্বেই তিনি বন্দুক থেকে গুলী বর্ষণ করেন। ফলে ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হয় এবং অন্যান্যরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বিধুভূষণ অক্ষত অবস্থায় মুক্ত এলাকায় চলে এসেছেন।
জয় বাংলা (৩) ॥ ১৪ সংখ্যা ॥ ১৭ জুলাই ১৯৭১
সকল রণাঙ্গনে গেরিলা তৎপরতা সম্প্রসারিত : বহু পাক সেনা হতাহত
ঢাকার জনজীবন এখনও অচল
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
ঢাকা : স্বাভাবিক অবস্থা প্রতিষ্ঠা করিয়া বিদেশী সফরকারীদের সামনে সব ঠিক হ্যায়’ গােছের। চিত্র তুলিয়া ধরার চেষ্টায় পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকেরা শােচনীয়রূপে ব্যর্থ হইয়াছে। ইয়াহিয়া টিক্কানিয়াজীকে হতাশ করিয়া ঢাকার সাধারণ মানুষ নীরব অসহযােগিতা অব্যাহত রাখিয়াছেন। মুক্তিফৌজের অতর্কিত হামলা ও বিস্ফোরণের শব্দ পাকবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বেতারের স্বাভাবিক অবস্থা সংক্রান্ত প্রচারণার ফানুস বিদীর্ণ করিয়া দিতেছে। আর জঙ্গী শাসকদের কপাল খারাপ, বিদেশী। সফরকারীদের চোখেও এসব ধরা পড়িয়া যাইতেছে ।
প্রকৃত অবস্থা হইল এই, গ্রামাঞ্চলে ত কথাই নাই, খােদ ঢাকা শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনা জঙ্গী শাসকদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। আর শাসনের ভিত্তি যেখানে শুধুমাত্র সন্ত্রাস ও বলপ্রয়ােগ, যেখানে আইন বলিতে ‘জঙ্গলের আইন’ ছাড়া আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নাই সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনা কোনমতেই সম্ভব নয়। ঢাকা শহরে স্কুল কলেজ খােলা হইয়াছে কিন্তু শতকরা দশ জন ছাত্রও হাজির হয় না। শিক্ষক অধ্যাপকদেরও অনেকেই অনুপস্থিত। যাহারা প্রাণের ভয়ে বা চাকরির
মায়ায় কাজে যােগ দিয়াছেন, তাহারাও ক্লাসে গিয়া নাম ঢাকিয়া দায়িত্ব শেষ করেন। বিভিন্ন পরীক্ষার | তারিখ ঘােষণা করিয়া রেডিও মারফত ছাত্র-ছাত্রীদিগকে পরীক্ষা দিতে আবেদন জানান হইতেছে কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের দেখা নাই।
মৃত্যুপুরীর বাসিন্দা।
অফিস আদালত খুলিয়াছে কিন্তু কাজকর্ম চলিতেছে না। কর্মচারীরা অফিসে যান কিছুক্ষণ থাকেন, তারপর চলিয়া আসেন। অফিসে বা রাস্তাঘাটে কুশল বিনিময় ছাড়া পরস্পরের মধ্যে কোন কথা নাই । যেন মৃত্যুপুরীর বাসিন্দা। সকলের মুখে ছিপি আঁটা। বুকে পাষান ভার চাপান । চেহারায় আতঙ্কে ছাপ সুপরিস্ফুট। অফিস হইতে বাড়ী ফিরিয়া নিতান্ত জরুরী কাজ না থাকিলে কেহ বাহির হয় না। দুপুরের পর হইতেই রাস্তাঘাটে লােক চলাচল কমিতে থাকে, সন্ধ্যার পর একেবারে জনশূন্য। দোকানপাট, হােটেল, রেস্তোরা, চাখানা খা খা করিতেছে।
মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা। | এই কবরের শান্তিকে বিদীর্ণ করিয়া মাঝে মাঝেই মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলা। সম্প্রতি মুক্তিফৌজ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আক্রমণ চালাইয়া বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা আংশিকভাবে বিকল করিয়া দেয়। টহলদারী পাক সেনাদের উপরও প্রায়ই আক্রমণ ঘটে। এই সকল অতর্কিত আক্রমণের দরুণ পাক দস্যুদের মনে এরূপ ত্রাসের সৃষ্টি হইয়াছে যে, কোথাও একটা রিকশার চাকা ফাটার শব্দ হইলেও হানাদার সৈন্যরা এলােপাথাড়ি গুলি চালাইতে শুরু করে।
পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার উৎপীড়ন এখনও অব্যাহত। মাঝে মাঝে মুক্তিফৌজ লুকাইয়া আছে সন্দেহে বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও করিয়া এলাকাবাসীর উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় । নারী নির্যাতন এখনও সমানে চলিতেছে। ছাত্র যুবকদের ধরিয়া নিয়া গিয়া বিনা বিচারে হত্যা করিতেছে। | মুক্তিফৌজকে ধরাইয়া দিতে পারিলে মােটা পুরস্কার দেওয়া হইবে বলিয়া রেডিও এবং মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার প্রভৃতি মারফত দিনের পর দিন বিজ্ঞাপন প্রচার সত্ত্বেও মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামীর মুষ্টিমেয় মুখচেনা বেইমান ব্যতীত কোন নাগরিকের সহযােগিতা পাইতেছে না জঙ্গী শাসকেরা।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ২ ॥ ১৮ জুলাই ১৯৭১
| এই রিপাের্টে আরও বলা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের অপসারণ বাহাস | ও বে-সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে না। | রিপাের্টের রাজনৈতিক দিক খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশ্ব ব্যাঙ্কের ডাইরেক্টর রবার্ট ম্যাকামারা ও | রিপাের্টটি গােপন রাখতে চেয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল এই রিপাের্ট প্রকাশিত হলে পাকিস্তানকে | সাহায্যকারী দেশগুলি তাকে আর সাহায্য দিবে না ও রিপাের্টটি সরাসরি পাকিস্তানের প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের
অনাস্থার প্রকাশ। কিন্তু এর কিছু অংশ ‘ওয়াশিংটন পােষ্টে’ প্রকাশিত হবার পর রাজনৈতিক … হয়েছে। এই রিপাের্টের এক লিপি ব্যাঙ্কের সকল এক্সিকিউটিভ ডিরেকটরদের হাতে দেওয়া হয়েছে। | যদিও গত সপ্তাহে ব্যাঙ্কের সভাপতি রবার্ট ম্যাকনামারা এই রিপাের্ট প্রচার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মার্কিন সাহায্য বন্ধ | এই রিপাের্ট প্রকাশিত হবার পর যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জন্য কেবল ত্রাণকার্য ছাড়া অন্য সব সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে। মার্কিন সরকারের এই সিদ্ধান্ত সরকারী ও বেসরকারী। পর্যায়ে পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ (১) | ১; ৯ | ১৯ জুলাই ১৯৭১
খােদ ঢাকা শহরেই
মুজিনগৰ : ১৮ই জুলাই। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরের গনসংযােগ বিভাগ সূত্রে। | জানা গেছে যে দুর্জয় মুক্তি যােদ্ধারা শত্রু পাক সেনাদের সদর দফতরে প্রচণ্ড তৎপরতা বৃদ্ধি করেছেন। | দুর্ধর্ষ মুক্তি যােদ্ধারা এমাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার একটি অভিজাত রেষ্টুরেন্টে ঢুকে হাত বােমা নিক্ষেপ করে পাক সেনাদের একজন অফিসার খতম করেন। তারা জঙ্গী শাহীর পদলেহী পদস্থ সরকারী কর্মচারী জনৈক শহীদ আহমদকে হত্যা করেন। বীর মুক্তিযােদ্ধারা বাংলা দেশের মীরজাফর। পিডিপি নেতা জনাব মাহমুদ আলীর বাস ভবনে হাতবােমা নিক্ষেপ করলে ১ ব্যক্তি নিহত হয়। | শহরে টহল দান রত ৪ জন খান সেনা এবং ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ মুক্তিযােদ্ধাদের আচমকা আক্রমণে খতম হয়। | এ ছাড়া মুক্তি যােদ্ধারা বকশীবাজারস্থ সেকেণ্ডারী এডুকেশন বাের্ডের দফতরে বােমা নিক্ষেপ করে বাের্ডের মূল্যবান কাগজ পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে এবং ভবনের ক্ষতি সাধন করেছে। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার | ষ্টেশনটি ও মুক্তি যােদ্ধারা অকেজো করে দিয়েছেন।
জয়বাংলা (১) [ ১: ১১ ২৩ জুলাই ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন : কুষ্টিয়ার পতন আসন্ন
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
সব শহরের তিনটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের উপর মুক্তিবাহিনীর সফল আক্রমণের পরে ১৯শে জুলাই রাত্রে শহরের একাংশ অন্ধকারে নিমর্জিত হয়। মার্কিন সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান এ, পি’র খবরে প্রকাশ, ঐ রাত্রে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চামেলিবাগ ও শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে অতর্কিত হামলা কেন্দ্র দুইটিকে বিকল করিয়া দেয় । উহার ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুইটির কয়েকজন প্রহরী আহত হয়। খবরে আরও বলা হয় যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুইটির কর্তৃপক্ষ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করিয়াছেন।
গত এক পক্ষকালের মধ্যে মুক্তিবাহিনী গেরিলা তৎপরতা উল্লেখযােগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করিয়াছে। | এই সময়ের মধ্যে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত এলাকগুলিকে কেবল ধরিয়াই রাখে নাই উহাদের
সীমা আরও সম্প্রসারিত করিয়াছে। খবরে প্রকাশ, মুক্তি ফৌজ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর হইতে পাক। | সেনাদের হটাইয়া দিয়া মেহেরপুর দখল করে এবং পাক সদস্যদের ঘাটি ধ্বংস করে। | চুয়াডাঙ্গা হতে মুক্তিবাহিনী পরবর্তী সংবাদে জানা যায় মুক্তিবাহিনী চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে আগাইয়া চলিয়াছে। কুষ্টিয়া জিলার বাদবাকী অধিকৃত এলাকার উপরও মুক্তিফৌজ প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করিয়াছে। কুষ্টিয়া শহরটিকে মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক হইতে অবরােধ করিয়া রাখিয়াছে। দখলকারী পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কুষ্টিয়া শহরে নিম্প্রদীপ’ ব্যবস্থা চালু করিয়াছে। | কয়েকদিন পূর্বে মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়াতে পাক বাহিনী নির্মিত অস্থায়ী বিমান ঘাঁটিটি ধ্বংস করিয়া দিয়াছে। | মুক্তিফেীজ সূত্রে জানা যায়, নরসিংদী ভৈরব বাজারের মধ্যবর্তী একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু ধ্বংস করিয়া মুক্তিবাহিনী রেল চলাচল ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করিয়াছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা জিলার অন্যান্য স্থানেও সেতু, টেলি যােগাযােগ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা প্রভৃতি বিকল করিয়া দিয়াছে । গত এক সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর হাতে কয়েক শত পাক সৈন্য নিহত হইয়াছে।
মুক্তিযুদ্ধ # ১: ৩ ৪ ২৫ জুলাই ১৯৭১
কত রঙ্গ জান রে যাদু কত রঙ্গ জান
(নিজস্ব ভাষ্যকার)
গায়ের বল কমে আসছে বলে মনে হয়, তাই খান সাহেবরা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। মিথ্যা বলে। বলে যখন আর কুলাচ্ছে না তখন সত্য মিথ্যার মিশ্রণ আরম্ভ হয়েছে। সম্প্রতি মুক্তি ফৌজের নাম দিয়ে রাস্তা-ঘাট, পুল ইত্যাকার যাতায়াত ব্যবস্থা ধ্বংস না করার অনুরােধ জানিয়ে জঙ্গীশাহী প্রচার পত্র | ছেড়েছে। বলা হয়েছে মুক্তি বাহিনীর চলাচলের জন্য এগুলাে প্রয়ােজন এবং কেউ এ’সব হীন কাজে। লিপ্ত হলে তাকে ধরে দেবেন অথবা নিকটবর্তী মুক্তি শিবিরে খবর দেবেন। সকলেই জানেন আমরা এখন গেরিলা রণ কায়দায় এগােচ্ছি। আমাদের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাটের প্রয়ােজন নেই। স্পষ্ট যে। খান সেনাদের চলাচলের জন্য রাস্তা ঘাট প্রয়ােজন। এবং বিজ্ঞপ্তিটি এরা দিয়েছে। শত্রুদের হাতে ও | ভাতে মারার জন্য যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য অম্লান।
বদনে এত দুর্ভোগ যারা সইতে পারে, নির্বিকার প্রাণ বলি দিতে পারে। যােগাযােগের সামান্য অসুবিধা | ভােগ করতে স্বাধীনতা কামী বাঙালীরা একটুকুও বিমুখ হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। শত্রুদের। | প্রতারণা ও করতে পাবে না বিভ্রান্ত।
| বাংলাদেশ (১) # ১: ১০ ৯ আগস্ট ১৯৭১।
ক্যামন বুঝতাছেন!
কুমিল্লা থেকে আমাদের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি লিখেছেন যে, গত ৩রা আগষ্ট চৌদ্দগ্রাম থেকে লাকশাম যাওয়ার পথে জনৈক পাক-মেজর বাঙ্গড়া বাজারে এক ভাষণ প্রদান করেন। মুক্তি ফৌজআতঙ্কগ্রস্থ অফিসার বলেন এ পর্যন্ত চৌদ্দগ্রাম থানায় আমাদের ৪ শতাধিক নিয়মিত সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে। আমরা তার জবাব দেব। প্রয়ােজন হলে চৌদ্দগ্রামের অস্তিত্ব বিলীন করবাে। তিনি বলেন আপনারা আর ১টি যুবককেও মুক্তিফৌজে দিবেন না। কারণ ১ জন মুক্তিফৌজের পেছনে।
আমাদের ১২০ জন সৈন্যকে নিয়ােজিত থাকতে হয়। আমাদেরকে এভাবে অদৃশ্য আক্রমণও হয়রানি করা হলে আমরা অবশ্যই সকল যুবককে খতম করবাে।
বাংলাদেশ (১) # ১: ১২ | ২৩ আগষ্ট ১৯৭১
উত্তরাঞ্চল প্লাবিত : লক্ষ লক্ষ নরনারী ভাসছে
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
ভয়াবহ বন্যায় বাঙলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলি বিশেষতঃ কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী জেলা প্লাবিত হইয়া গিয়াছে। পাবনা জেলা সদর মহকুমায় পাবনা-সুজানগর সঁথিয়া বেড়া এবং ঈশ্বরদী এই পাঁচটি থানাতে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষাধিক নরনারী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে।
কুষ্টিয়া ২নং রাজশাহী জেলার কয়েকটি এলাকার অবস্থাও এই রূপ ।
পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার রেডিওতে প্রচার করিতেছে যে, তাহারা বন্যার্তদের ত্রাণের জন্য অনেক রিলিফ পাঠাইতেছে । কিন্তু আসলে রিলিফ যাইতেছে খুব কম। যতটুকু রিলিফ যাইতেছে তাহার বেশির ভাগ পাক সরকারের দালাল ও রাজাকাররা আত্মসাৎ করিতেছে।
| তাহা ছাড়া সাধারণ লােকের ভিতর এই ভয় আছে যে, মিলিটারির নিকট হইতে রিলিফ নিতে গেলে তাহাদের গ্রেফতার করিয়া মারিয়া ফেলা হইবে। কাজেই রিলিফ আনিতে লােকজন বিশেষ যাইতেছে না। একমাত্র বৃদ্ধরাই মাঝে মাঝে রিলিফ আনিতে যায়। | সমগ্র পরিস্থিতি মিলাইয়া অবস্থাটা দাড়াইয়াছে যে, একদিকে পাক মিলিটারির নানাবিধ অত্যাচার এবং অন্যদিকে ভয়াবহ বন্যা—এই দুই চাপে পড়িয়া উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনের সমস্যা দুর্বিষহ হইয়া উঠিয়াছে।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ৮ | ২৯ আগষ্ট ১৯৭১
বন্যার ফলে ৬০ লক্ষ লােক গৃহহীন।
| (স্টাফ রিপাের্টার)।
মুজিবনগর, ১৯শে আগস্ট-বাংলাদেশের ১০টি জেলায় সর্বনাশা বন্যার ফলে কমপক্ষে ৩০০ লােকের প্রাণহানি ৮ লক্ষ গৃহ ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রায় ৬০ লক্ষ লােক ও ৯০ লাখ লােক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর জল বিপদসীমা অতিক্রম করে যাওয়ার ফলে তার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের প্রায় ১০ লক্ষ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।
জন্মভূমি ॥ ১: ৬ # ৩০ আগষ্ট ১৯৭১
ভয়াবহ বন্যায় এবারও প্লাবিত পূর্ববাংলা
(স্টাফ রিপাের্টার)
ভয়াবহ বন্যায় এবারও পূর্ব বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত । সরকারী সূত্রে জানা যায় যে, প্রায় দশ লক্ষ লােক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পঞ্চাশ লক্ষ ডলার মূল্যের পাট ও অন্যান্য ফসল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু বেসরকারী সূত্রে ক্ষতির পরিমাণ আরাে বেশি বলে জানা গেছে। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় এখনাে পর্যন্ত সরকারী কোন সাহায্য পৌছায় নি। পাক বেতারের খবরেই প্রকাশ যে, বন্যায় এ পর্যন্ত ৭২ জন মার গেছে, ৫০ জন মারা গেছে কলেরায় ।।
কিন্তু ঘটনাটি হচ্ছে, পূর্ব বাংলায় প্রতিবছর বন্যা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লােক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। মারা গেছে হাজার হাজার লােক। বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা আজো গড়ে না উঠায় ভবিষ্যতেও যে প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যার ছােবলে পূর্ব বাংলা বিধ্বস্ত হবে—পূর্ব বাংলার তথা পাকিস্তানের সরকারের তা ভালােভাবেই জানা আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনের গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী হাতে নিতে চেয়েছিল পূর্ব বাংলাকে বন্যার সর্বনাশা হাত থেকে বাঁচাবার জন্য। সে কর্মসূচী পাকিস্তান সরকার গ্রহণ করেনি। কিন্তু কেন? কেন পাকিস্তান সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এতাে উদাসীন? পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ লােক মরে যাক এটাই কি পাকিস্তান সরকারের কাম্য? নচেৎ কি আমরা ধারণা করতে পারি—যখন জমির লবণাক্ত দূরীকরণ প্রকল্পে পশ্চিম পাকিস্তানে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে? সত্তর সালের ১২ই ডিসেম্বরে পূর্ব বাংলার দক্ষিণাঞ্চল সামুদ্রিক ঝড় আর জলােচ্ছাসে বিধ্বস্ত হওয়ার পিছনে দায়িত্ব পালনে পাকিস্তান সরকার কি অবহেলা দেখায়নি? ২০ লক্ষ লােকের গলিত শব আর এক কোটিরও অধিক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বুকের ওপর বসে এই নির্মম প্রহসনের কারণ কি? ঝড়ে, বন্যায়, জলােচ্ছাসে পূর্ব বাংলার মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাক—এটাই পাকিস্তান সরকারের কাম্য। নচেৎ পূর্ব বাংলায় প্রতি বছর বন্যা হবে এটা নিশ্চিত জেনেও পাকিস্তান সরকারের বন্যা নিয়ন্ত্রণে এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ কি? এ ছাড়া বন্যার ক্ষতির পরিমাণ লুকোবারই বা কারণ কি? এটা উদ্দেশ্যমূলক নয় কি?
এবারের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত পূর্ব বাংলার ৭টি জেলা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পাক বেতারের খবরেই জানা গেছে একমাত্র ফরিদপুর, পাবনা, যশােহর জেলারই প্রায় সাড়ে সাত হাজার বর্গকিলােমিটার অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে পাক বেতারের আর এক খবরে জানা গেছে। লক্ষ লক্ষ পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। কোটি কোটি টাকার ফসল বিনষ্ট হয়েছে। মারা গেছে শতাধিক লােক !
আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংবাদদাতা সম্প্রতি প্রদেশের উত্তরাঞ্চল ঘুরে এসে জানিয়েছেন যে, উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলা, কুষ্টিয়ার সদর মহকুমা ও কুষ্টিয়া শহরটির অধিকাংশ এলাকা এখন বন্যার পানির তলে । দেড় লাখেরও বেশি ঘরবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত । এবং প্রায় পনেরাে কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ফসল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি বিনষ্ট হয়েছে। | সংবাদদাতা আরাে জানান, পাবনা শহরের ও আশেপাশের দুই লক্ষাধিক পরিবার তাদের ঘরবাড়ী বন্যায় বিধ্বস্ত হওয়ায় মুক্ত আকাশের নীচে বন্যার অনন্ত পানিরাশির মধ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া, সাপের পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিন গুণছে।
ঢাকার সাথে উত্তরাঞ্চলের সড়ক পথে যােগাযােগের একমাত্র পাবনা নগরবাড়ী সড়কটিও এখন কয়েক ফুট পানির তলে । ঈশ্বরদী বিমান বন্দরটিও এখন দু ফুট পানির নিচে থাকায় ঈশ্বরদি-ঢাকা বিমান চলাচল একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে ।
আমাদের সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে, এবারের ভয়াবহ বন্যায় পূর্ব বাংলার যােগাযােগ ব্যবস্থাটিই মূলতঃ বিনষ্ট হয়ে গেছে।
বন্যার বিষাক্ত ছােবল থেকে রাজশাহী জেলাও রক্ষা পায়নি এবার। ব্যাপক অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রাজশাহী জেলার । লক্ষ লক্ষ একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লােককে ঘরবাড়ী হারিয়ে মুক্ত আকাশের নীচে দাড়াতে হয়েছে।
মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসকের সূত্রে জানা যায়, একমাত্র রাজশাহী থেকেই ৮ হাজার লােক বন্যার ফলে মুর্শিদাবাদে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার অবস্থা দিন দিন আরাে অবনতির দিকে এগুচ্ছে। রাজশাহী শহরের বাধের অবস্থাও আশংকাজনক।
কিন্তু এখনাে পর্যন্ত পূর্ব বাংলার বন্যা উপদ্ৰত অঞ্চলসমূহে সরকারী কোন সাহায্য পৌছায়নি বলে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা গেছে। লক্ষ লক্ষ লােক সরকারী সাহায্যের অভাবে এখন
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখােমুখি । খােলা আকাশের নীচে বন্যার পানির মধ্যে অনাহারে, অসুখে গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুরের পাশাপাশি—আবার সেই মৃত্যুর আর্তনাদ তুলছে জল্লাদ ইয়াহিয়ার বুলেটে, বেয়নেটে, আগুনে, ধর্ষণের মৃত্যুর মত, গত ২ ডিসেম্বরে সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত দক্ষিণ বাংলার লক্ষ মানুষের মত । মৃত্যুরই দেশ যেন আজ পূর্ব বাংলা। | কবি সুকান্তের কথা তাই মনে আসে : “অবাক পৃথিবী অবাক যে বারবার এদেশে দেখি মৃত্যুরই | কারবার।”
বাংলার কথা ॥ ১: ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
আপনি যদি মৃত্যু বরণ করতে চান
[জয়বাংলা প্রতিনিধি
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় নরককুণ্ড থেকে শুধুমাত্র জীবন নিয়ে যারা ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি আবার বেয়নেটের ডগায় বিদ্ধ হওয়ার জন্য পড়ি-মরি করে পুরানাে যায়গায় ফিরে যাচ্ছে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা অন্ততঃ এর-রকম আভাষ দিচ্ছে তাদের | গায়েবী আওয়াজ ও নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে ।
| ভারত থেকে যে সব শরণার্থী ফিরে যাবে তাদের অভ্যর্থনা ও হত্যার জন্য কি জাতীয় ব্যবস্থা | গ্রহণ করা হবে তার নির্দেশ প্রদান করেছে ইষ্টার্ন কম্যাণ্ডের কম্যাণ্ডার লেঃ জেনারেল আমির আবদুল্লাহ | খান নিয়াজী। নিয়াজী স্বাক্ষরিত ‘নিরাপত্তা পাস’ নামক গােলাবী রঙ এর কার্ডে বলা হয়েছে, “যে কোন মিলিটারী /পুলিশ ফাঁড়ি অথবা শান্তি কমিটি এই কার্ড ধারীকে গ্রহণ করিবেন এবং তাহার উপর কোন প্রকার শারীরিক নির্যাতন করা যাইবে না, তাহাকে পাকিস্তানী হিসাবে পুনরায় গ্রহণ করিতে হইবে। যেহেতু সে পরের প্ররােচনায় পথভ্রষ্ট হইয়াছিল। এর উর্দু তরজমাও ‘পাস’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে।
| অপর পাতায় জরুরী নির্দেশাবলী’ শিরােনামায় বলা হয়েছে “১। কার্ডধারী ইহা ডান হাতে উচু করিয়া ধরিবেন এবং আত্মসমর্পনের সময় যখন মিলিটারী পুলিশ ফাড়ির দিকে অগ্রসর হইবেন তখন উভয় হস্ত মাথার উপর উঠাইবেন। | “২। যদি কাহারাও সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র থাকে তবে তাহা ঘাড়ের উপর ঝুলাইয়া ব্যারেলটিকে নীচের | দিকে নামাইয়া আসিতে হইবে।
“৩। তাহাকে গ্রহণ করার পর নিরস্ত্র করা হইবে এবং যত্নের সহিত খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা। করিয়া যতশীঘ্র সম্ভব নিরাপদ স্থানে অপসারণ করা হইবে।” | এ নির্দেশেরও উর্দু তরজমা ছাপা হয়েছে। কার্ডের নীচে ইংরেজীতে লেখা রয়েছে EPGP–70/714605HI Lakh. এ কার্ডেই ‘শরণার্থী অভ্যর্থনার নমুনা পাওয়া যাবে।
নিরাপত্তা পাস। যে কোন মিলিটারী/পুলিশ ফাড়ি অথবা শান্তি কমিটি এই কার্ডধারীকে গ্রহণ করিবেন
पवर তাহার উপর কোন প্রকার শারীরিক নির্যাতন করা যাইবে না তাহাকে পাকিস্তানী হিসাবে পুনরায় গ্রহণ
করিতে হইবে যেহেতু সে পরের প্ররােচনায় পথভ্রষ্ট হইয়াছিল।
حفاظتی پاس کے عامل کو کسی بھی فوجی چوکی پولیس
کمیٹی میں قبول کیا جائیگا . یا پیس
اس اس چوکی
اسے جسمانی ضیزر نہیں پہنچایا جائیگا . اسے پاکستانی
کرول کیا جائیگا جو غلط رهنمائی حیثیت سے واپس کی کی وجس سے گمراه هو گیا ہے اور اس میں اس کی اپنی
خطا نم لای
Lieutenant General Commander Eastern Command
(Amir Abdullah Khan Niazi) জয়বাংলা (১) ৪ ২ ১৭ ॥ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বিদেশী সাংবাদিকের মতে গেরিলা আক্রমণের মুখে বাংলাদেশে পাক সেনাদের মনােবল আর বেশী দিন অক্ষুন্ন
রাখা যাবে না
অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে লণ্ডনের ডেলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা প্রেরিত এক খবরে বলা হয়েছে যে, ঢাকাস্থ পাক জেনারেলরা খুবই ফাপরে পড়েছে। সংবাদদাতা মিঃ হােলিংওয়ার্থ লিখেছেন, সপ্তাহে চারখানি সরবরাহকারী জাহাজ গেরিলারা ডুবিয়ে দেওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও সামরিক দ্রব্য সামগ্রী পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসার ব্যাপারে গুরুতর অসুবিধা দেখা দিয়েছে । ২৩শে আগষ্ট এসংবাদ ‘ডেলি টেলিগ্রাফে’ প্রকাশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, আট দিন আগে চট্টগ্রাম বন্দরে মেয়াদী মাইনের বিস্ফোরণে দু’খানা জাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ায় এবং গত শনিবার চাঁদপুরের কাছে ৯০০ টনের একখানি উপকূলবর্তী মালবাহী জাহাজ ও একটি বিরাট বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় পাক জঙ্গী চক্রের সঙ্কট এখন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। | খবরে জানা গেছে, গেরিলারা সুরক্ষিত সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ শুরু করেছে এবং গেরিলা তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫৭টি প্রধান সড়ক ও রেলসেতু বিধ্বস্থ করেছে । তা ছাড়া প্রায় এক হাজারের মত ছােট সেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
খবরে আরও প্রকাশ, পাক সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল সেতুটি এখনও পর্যন্ত মেরামত করতে পারেনি। গত শুক্রবার কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী প্রধান রেল সেতুটি বিধ্বস্থ হওয়ায় বন্দর থেকে খাদ্য দ্রব্য এবং অন্যান্য জিনিষপত্র পরিবহনেও গুরুতর অসুবিধা দেখা দিয়েছে।
| আরও জানা গেছে যে, পাক সেনাদেরকে গেরিলা তৎপরতা সম্পর্কে একদম অন্ধকারে রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য খান-সেনাদের মনােবল অটুই রাখা। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাস্তায় পােতা গুপ্ত মাইন, সৈন্যবাহী ট্রেনের লাইনচ্যুতি ও অপ্রত্যাশিত গােলাগুলি বর্ষণে তাদের মনােবল বেশী দিন অটুট রাখা আদৌ সম্ভব হবে না।
দাবাংলা (2) ২: 17 { ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বন্যার করাল গ্রাসে পৌনে দু’কোটি বাঙ্গালী সন্তান” এদের বাঁচাতে হবে।
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
নবেম্বরে মানব ইতিহাসের সর্বাধিক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাস, পঁচিশে মার্চ। পরবর্তী সময়ের সুপরিকল্পিত গণহত্যা, লুণ্ঠন ধর্ষণের বিভীষিকায় বিপৰ্যন্ত বাংলাদেশের গণজীবনে আবার মত্ত হাতীর মতাে সর্বগ্রাসী বন্যা ঝাপিয়ে পড়েছে। বন্যা, তার দুরন্ত আক্রোশে মাঠ-ঘাট, বনবাদাড়, ক্ষেতের ফসল আর মাথা গুঁজবার ঠাই টুকু পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের রাহু গ্রস্ত বাংলাদেশে বন্যা আবার নরকের যন্ত্রণা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।
ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, যশাের, কুষ্টিয়া সহ আটটি জেলা সম্পূর্ণ পানির নীচে চলে গেছে। লাখাে মানুষের ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার অবলম্বন ক্ষেতের ধান বন্যার মত্ত তােড়ে ভেসে গেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। | বন্যায় পৌনে দু’কোটি লােক ক্ষতিগ্রস্ত, ৫০ লাখেরও বেশী লােক (বন্যায়) গৃহহীন, দু’লাখ গৃহ বিধ্বস্থ এবং দু’শো কোটি টাকার ফসল বিনষ্ট হয়েছে। প্রতি বছরই বন্যায় তার ধ্বংসলীলা রেখে যায় আর কোটি কোটি মানুষ নিঃস্ব ও সর্বহারা হয়। বন্যার ধ্বংসলীলা চরমে উঠলে ইসলামাবাদের বাংলা ও বাঙ্গালী ঘাতী কণ্ঠ সাময়িকভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার জাল বােনে। আবার সব হিমাগারে চলে যায় । বাঙ্গালীদের সহায় সম্বলহীন করা, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া, বিভিন্ন কায়দায় হত্যা দ্বারা জনসংখ্যা কমানাে যাদের পরিকল্পনার অন্তর্ভূক্ত তাদের কাছে, তাদের হৃদয়ে কোটি বাঙ্গালীর দুর্দশা কোনরূপ মানবিক স্পন্দন কোন দিন জাগাতে পারেনি।
বিগত নবেম্বরের প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় পনের লাখ লােক নিহত এবং এক কোটি লােক গৃহহীন ও সহায় সম্বলহীন হওয়ার পর সারা বিশ্বের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত দিয়ে যে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সাহায্য সামগ্রী ও নগদ অর্থ এনেছিল তার অধিকাংশই বর্তমানে জন্তুাদ সেনাবাহিনী তাদের বাঙ্গালী নিধন কাজে লাগাচ্ছে। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অধিকাংশ অর্থ লাহােরের ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল। তা থেকে একটি পাই পর্যন্ত বাঙ্গালীদের দুর্দশা মােচনের জন্য ব্যয় হয়নি। বর্তমানে ইয়াহিয়া সরকার সে অর্থ বাঙ্গালী নিধনের জন্য তাদের সমরাস্ত্রের চাকাকে গতিশীল ও ঘূর্ণায়মান রাখার কাজে ব্যবহার করছে। নবেম্বরের দুর্যোগে বিধ্বস্ত উপকূলের অবস্থা পরিবেষ্টনের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পাওয়া যায়নি কিন্তু বর্তমানে বাঙ্গালীদের নিধনের জন্য অসংখ্য হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বের যে দু’একটি দেশ রিলিফ কাজের জন্য হেলিকপ্টার প্রদান করেছিল টিক্কার হারমাদ বাহিনী তাও সামরিক কাজে ব্যবহার করছে।
এবারের বন্যায় বাংলাদেশের কোটি লােক ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বহারা হলেও জল্লাদদের হাত দিয়ে। রিলিফের একটি কানাকাড়িও গলছে না। তবে অর্থ মঞ্জুরের সংবাদ ঠিক ঠিক ভাবে দখলীকৃত বেতার ও সংবাদপত্র থেকে প্রচার করা হচ্ছে। বন্যার ধ্বংসলীলার সংবাদ অধিকৃত বেতার থেকে প্রচারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচেছ বিদেশী সাহায্য আসলে তা দিয়ে তাদের শূন্য তহবিল ভরে তােলা।
বাঙ্গালীদের বাঁচিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ যে ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্রের রয়েছে সে অপবাদ তাদের অকৃত্রিম মিত্ররাও দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ সরকার তাই মনে করে, বন্যার্ত কোটি মানুষের দুর্গতি লাঘবের জন্য বিশ্ববাসীর। সাহায্য হয় বাংলাদেশ সরকার অথবা কোন নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করতে হবে, তা না হলে সমুদয় সাহায্য সামরিক জান্তা বাঙ্গালী রক্ষা নয়, হত্যার কাজেই ব্যয় করবে বলে দাবী করেছেন। তার বাস্তব প্রমাণও সম্প্রতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সামরিক সরকার বিভিন্ন জেলার । প্রধানদের বিদেশ থেকে প্রাপ্ত রিলিফ সামগ্রীর একটি বিরাট অংশ সৈন্যবাহিনী ও রাজাকারদের আগামী। ছয় মাসের জন্য যাতে ভরণ পােষণ করা হয় তার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতে গােপন নির্দেশ প্রদান। করেছে।
জয়বাংলা (১) ১ : ১৭ ৪ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মুক্তি পরিষদের ডাকে ঢাকায় হরতাল
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক গােষ্ঠী বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে দমনের জন্য একদিকে তীব্র ও | বর্বর অত্যাচার অব্যাহত রাখিয়াছে, অপর দিকে তথাকথিত বে-সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার কৌশল গ্রহণ। করিয়াছে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দিন দিন আরও জোরদার হইতেছে।
ঢাকা শহরে হরতাল | কে ভাবিতে পারে যে বাঙলাদেশের মূল রাজধানী পাক হানাদার বাহিনী অধিকৃত ঢাকা শহরে বর্তমানে হরতাল সম্ভব? কিন্তু এই অসম্ভবকেই সম্ভব করিয়াছে ঢাকার বীর জনগণ। পাকিস্তানের। তথাকথিত স্বাধীনতা দিবস ১৪ই আগস্ট তারিখে ঢাকার জনগণ সফল হরতাল পালন করিয়াছেন। এই দিন অবশ্য সরকারী অফিস-আদালত বন্ধ ছিল ইয়াহিয়া সরকারের নির্দেশ মতে । কিন্তু জনগণের ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, গাড়ী-ঘােড়া প্রভৃতি বন্ধ ছিল ঢাকায় বামপন্থীদের উদ্যোগে গঠিত গােপন ‘মুক্তি পরিষদের আহ্বানে। মুক্তি পরিষদ প্রচারপত্র, পােস্টার প্রভৃতির মাধ্যমে শহরবাসীকে হরতাল পালনের আহ্বান জানায়। | অন্যদিকে গত মাসের মাঝামাঝি হইতে ঢাকা শহরে ইয়াহিয়াচক্রের সামরিক বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। সামরিক বাহিনী ক্ষেপা কুকুরের মত সারা শহর চষিয়া বেড়াইতেছে। ইহাদের আশংকা হইয়াছিল যে মুক্তিফেীজ বােধহয় ঢাকা শহরে এখনই সম্মুখ সমরে লিপ্ত হইবে। উপরন্তু গেরিলা বাহিনীর আক্রমণ তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইহারা আরও ভীত হইয়া পড়ে।
ধরপাকড়, তল্লাশী
| তাই গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হইতে সামরিক বাহিনী ঢাকা শহরের সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব, পূর্ব, উত্তর এবং পশ্চিম এলাকায় বিপুল বিক্রমে ব্যাপক তল্লাশী করিয়াছে। যাত্রাবাড়িতে দুই বার ইহারা তল্লাশী করিয়াছে। ইহা ছাড়া মতিঝিল কলােনী, শাজাহানপুর, মগবাজার, বাসাবাে, মাদারটেক, কমলাপুর, স্টাফ কোয়ার্টার্স, স্বামীবাগ, গােপীবাগ রেল লাইনের অপর পার, কলা বাগান, রায়ের বাজার ও ধানমণ্ডীর কোন কোন স্থানের প্রতিটি বাড়ি-ঘর তন্ন তন্ন করিয়া তল্লাশী করিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু গ্রেপ্তারও করিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এগার জন অধ্যাপককে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। ইহা । ছাড়াও শহরের পথে পথেও আকস্মিক তল্লাশী চালানাে হইয়াছে।
মগবাজার চৌরাস্তার মােড়ে সারা দিনরাত্রির পাহারা বসানাে হইয়াছে।
ঢাকা শহরের নাগরিকদের ঘর-বাড়ি তল্লাশী করার সময় ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর বর্বর সেনা বাহিনীর লােকেরা যে কেবলমাত্র ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট করিয়াছে তাহাই নহে সেই সঙ্গে হাতের কাছে যাহা পাইয়াছে উহাই লুট করিয়া লইয়া গিয়াছে। তল্লাশীর সময় অনেক ক্ষেত্রে এই পিশাচেরা স্বামী পিতা বা পুত্রের সামনেই মা-বােনদের বেইজ্জত করিয়াছে, ধর্ষণ করিয়াছে।
ইয়াহিয়া খানের লেলাইয়া দেওয়া পশুগুলি সম্ভবতঃ আশা করিয়াছিল যে ব্যাপক তল্লাশী ও শহরের পথে ঘাটে চেকপােষ্ট বসাইবার ফলে ঢাকা শহরে হয়ত গেরিলা ও কমাণ্ডে তৎপরতা হাস পাইবে।
কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের দমন করার সাধ্য ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর নাই। তাই এই ব্যাপক তল্লাশীর মধ্যেও ঢাকা শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা বন্ধ হয় নাই । প্রায় প্রতি রাতেই গেরিলা ও কমাণ্ডা তৎপরতা চলিয়াছে। ঢাকা শহরের জনগণ বলাবলি করিতেছেন “আমাদের গেরিলা বাহিনী। বাহাদুর বটে।”
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ৯ ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
জল্লাদের স্থলে বেইমান। (নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া-চক্র এক নূতন চাল চালিয়াছে। বাংলাদেশের অধিকত এলাকার গভর্নর পদে জেনারেল টিক্কার স্থলে শাসকচক্রের পা-চাটা, মুসলিম লীগপন্থী ডাঃ এ, এম, মালিককে নিয়ােগ করা হইয়াছে। জঙ্গী শাসকেরা বােধহয় ভাবিয়াছে, একজন বাঙালী বেসামরিক গভর্নর নিয়ােগ করিলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনা হইতেছে বলিয়া বিদেশে প্রচারের সুবিধা হইবে। বিশেষত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে ইহার উপর গুরুত্ব দেওয়া হইতেছে।
কিন্তু বেসামরিক গভর্নর নিয়ােগের বিষয়টি যে, নিছক ভাওতাবাজি ছাড়া কিছু নয় তাহা বুঝিতে দেশে বা বিদেশে কাহারও অসুবিধা হইবে না। কারণ প্রথমত, সামরিক শাসন চালু থাকার ফলে প্রকৃত ক্ষমতা সামরিক বাহিনী বা মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের হাতেই রহিয়া যাইবে এবং গভর্নর হইবে সাক্ষী গােপাল মাত্র। দ্বিতীয়ত, ডাঃ মালিক জনপ্রতিনিধি বা জনগণের আস্থাভাজন নয়, সে ইয়াহিয়া চক্রের অনুগত দালাল মাত্র। জনগণের কাছে টিক্কা বা মালিকের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই, সে বাঙালী হইলেও বেইমান। আর বেইমানকে কিভাবে সাজা দিতে হয় তাহা মুক্তিবাহিনী ভালভাবেই জানে। | ডাঃ মালিককে গভর্নর পদে নিয়ােগ ইয়াহিয়া-চক্রের রাজনৈতিক চালে ব্যর্থতা ও দেউলিয়াপনারই জাজ্বল্যমান প্রমাণ । ইয়াহিয়া-চক্র ইতিপূর্বে বাঙলাদেশের কিছু সংখ্যক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ভাগাইয়া নিয়া শিখণ্ডী সরকারি খাড়া করিতে চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু উহা ব্যর্থ হওয়াতেই জঙ্গী শাসকগােষ্ঠী ডাঃ মালিকের মত পুরাতন পাপী ও মুখচেনা দালালকে গভর্নর নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইয়াছে।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ৯ ! ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের নিকট বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের আবেদন
| ২রা আগষ্ট, বাংলাদেশ। সংবাদ পাওয়া গেছে। পাক জঙ্গী চক্র বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য আসা লক্ষ লক্ষ মণ খাদ্য দ্রব্য আত্মসাৎ করেছে। নরপিশাচ ইয়াহিয়া সরকার
বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কথা বলে বিদেশ থেকে প্রচুর রিলিফ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই সমস্ত রিলিফ বাংলাদেশের অন্নহীনদের ভাগ্যে এক কণাও জুটছেনা। এই সমস্ত রিলিফ সামগ্রী পাকসৈন্যরা উদর ভর্তি করছে। আর এদিকে বাংলার লাখাে লাখাে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ না খেয়ে পথে পড়ে মরছে। তাই এই বাংলাদেশের ভুখা অন্নহীন মানুষগুলাে বিশ্বের কাছে এক আবেদনে বলেছেন, আমরা লাখাে লাখাে লােক না খেয়ে মরছি আর আপনাদের মানবতার সেবায় প্রেরিত খাদ্যশস্য পাকসৈন্যরা নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে। আমাদের অনুরােধ, বিশ্ববাসী যেন পাক নরপশু সরকারের নিকট কোন রিলিফ সামগ্রী না পাঠান। তাঁরা নিজেদের স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা রিলিফ দ্রব্য বন্টনের যেন ব্যবস্থা করেন, তাহলেই আমরা বাঁচতে পারব।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ৪ | ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
নুরুল আমিন অসম্মত
| ঢাকা, ৩রা সেপ্টেম্বর রাষ্ট্র সংঘ সাধারণ পরিষদের আগামী অধিবেশনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও ডেমােক্রেটিক পার্টির একমাত্র জাতীয় পরিষদ সদস্য নুরুল আমিন ভগ্ন স্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে পাক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব নিতে অসম্মতি প্রকাশ করেছেন।
জন্মভূমি | ১৭ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পুতুল গভর্ণর
এ-হিয়ার দখলিকৃত বাংলাদেশে পুতুল গভর্ণর হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেছেন ডঃ মালিক। অসামরিক গভর্ণর হিসাবে মালিককে নিযুক্ত করলেও জঙ্গীশাহীর কঠোর শাসনের কোন হেরফের ঘটবে না বলেই পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
বেলুচিস্তান, পাখতুনিস্তান এবং সর্বশেষে বাংলাদেশে অত্যাচার ও হত্যালীলা চালিয়ে টেক্কা খা যে। রেকর্ড সৃষ্টি করেছে তার জন্য তাকে বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কমাণ্ডার পদে নিযুক্ত করা। হয়েছে।
জন্মভূমি ॥ ১ : ৭ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দুর্ভিক্ষের কবলে বাংলাদেশ
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
মুজিবনগর, ৫ই সেপ্টেম্বর-হাজারাে মাইলয়ের বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া নেমে এসেছে। বাংলা দেশের কোটি কোটি ভাগ্যহত মানুষ আজ চরম অর্থাভাব আর অন্নাভাবে দুর্ভিক্ষের মুখােমুখি হয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, গােটা বাংলাদেশটাই যেন আজ এক মহাশশ্মানে পরিণত হয়েছে ।
দুর্ভিক্ষের ফলে ১৯০১ জনের মৃত্যু। | দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতারা জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে এ পর্যন্ত ১৯১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।
দুর্ভিক্ষের ফলে যারা অকাল মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের জেলাওয়ারী একটা প্রাথমিক হিসাব নিম্নে দেওয়া হলাে ।
ঢাকা জেলার বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং নবাবগঞ্জ এলাকায় দুর্ভিক্ষের ফলে ২১ জনে। মৃত্যু হয়েছে বলে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতা জানিয়েছেন। | সিলেট জেলার দুর্ভিক্ষাবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিয়ানীবাজার, গােলাপগঞ্জ, মৌলবীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ এলাকায় খাদ্যাভাবে ৩১ জনেরও বেশী লােকের মৃত্যু হয়েছে।
খাদ্যাভাবের ফলে কুমিল্লার হাজীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি এলাকা থেকে ৭ জন, দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬ জন, রংপুর থেকে ৬ জন, পাবনা থেকে ১৪ জন, বরিশাল, পটুয়াখালী, নােয়াখালীর বিভিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে কমপক্ষে ২৯ জনের প্রাণ হানি ঘটেছে বলে আমাদের সংবাদদাতা জানিয়েছেন।
এছাড়া ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দুর্ভিক্ষের ফলে কমপক্ষে ১৬ জন, ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানে ১৮ জন, যশােহরের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হওয়ায় নড়াইল ও মাগুরাতেই ২২ জন এবং খুলনায় দুর্ভিক্ষের অশুভ পদধ্বনিতে ফকিরহাট, সাতক্ষীরা প্রভৃতি এলাকাতে ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। | দেশের অভ্যন্তরে সমস্ত যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকার দরুণ এবং বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে এই দুর্ভিক্ষের অবস্থা মারাত্মক আকার ধারন করতে পারে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
জন্মভূমি ॥ ১ : ৭ ৪ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
পূর্ববাংলার অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক (?) স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে
(বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি)।
পাক সরকার তাদের “গােয়েবলীয় যন্তর” রেডিও পাকিস্তানের খবরে বার বার বলছে দেশের অবস্থা স্বাভাবিক, স্কুল-কলেজ সব খুলেছে, এইচ, এসসি, এস, এস, সি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য পরীক্ষাগুলি নিয়মিত হচ্ছে এবং হবে।
| রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বসাকুল্যে ৮৬ জন ছাত্র ক্লাস করছে এবং তারা সবাই অবাঙালী । স্বাভাবিক অবস্থার বাস্তব ছবি বটে!
বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের সঠিক অবস্থা জানতে না দেওয়ার জন্য পাক সরকার ভীষণ চেষ্টা। পাচ্ছেন।
ডঃ সাজ্জাদ হােসেন সম্প্রতি লণ্ডনে বলেছেন যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সম্পূর্ণ। স্বাভাবিক ও সেখানে একজন শিক্ষক মারা যায়নি। আমাদের প্রশ্ন উঃ সাজ্জাদ কোন যন্ত্রে পরীক্ষা করে ঐ মন্তব্য করলেন? যে সব শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে যােগদান করেছেন তাঁদের সম্পর্কে তিনি নিঃসন্দেহে বলতে পারেন তারা জীবিত” । কিন্তু যারা অনুপস্থিত, যাদের কেউ কেউ পাক জল্লাদদের বেয়নেট-গুলিতে নিহত হয়েছেন, যারা ভারত-বর্মায় আশ্রয় নিয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে ডাঃ সাজ্জাদ কি ভাবে বলতে পারেন যে তারা সবাই জীবিত? তাঁর কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন তিনি সব শিক্ষকদের দিয়ে একটা বিবৃতি দেওয়ান যাতে আমরা এবং বিশ্বজনগণ বুঝতে পারে সত্যিই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষক নিহত হননি। যদি তা না পারেন তবে সত্যকে স্বীকার করুন, যারা নিহত হয়েছেন তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করুন।
বাংলার কথা ১: ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বন্যার ফলে ভারতে যাচ্ছে।
(স্টাফ রিপাের্টার)
মুজিবনগর, ৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে বন্যার ফলে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ লক্ষ লােক গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ১১টি জেলার নদনদীর জল এখন পর্যন্ত বিপদসীমার বহু উপরে রয়েছে। দিন দিন আরও জল বাড়ছে এতে মানুষের দুঃখ কষ্টের সীমা নেই। এদিকে এহিয়ার হত্যাকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশের মানুষ প্রাণের দায়ে ভারতে চলে যাচ্ছে।
জন্মভূমি | ১; ৭ ৪ ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
খান সেনাদের জুজুর ভয়।
বিদেশী পত্রিকা পড়তে মানা
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি রাওয়ালপিনড়ি থেকে জানিয়েছেন এহিয়া সরকার পাকিস্তানের ভিতরে বিদেশী পত্র-পত্রিকার ওপর সেন্সর বিধি প্রয়ােগ করে সকল রকম বিদেশী পত্রিকার বন্টন স্থগিত রেখেছেন যাতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কে বিদেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাহা যেন পাকিস্তানীরা বুঝতে না পারে।
মাখলা মাথায় দেওয়া নিষেধ
বাংলাদেশের কৃষকরা রােদ বৃষ্টিতে মাখলা (বাঁশ দিয়ে তৈরী বড় ছাতার মত) মাথায় দিয়ে ক্ষেতে খামারে কাজ করেন। পাক-সেনাদের ভয়, এগুলাের মধ্যে মুক্তি যােদ্ধারা অস্ত্রসস্ত্র লুকিয়ে রাখেন। সুতরাং বাংলাদেশের এহিয়ার দখলীকৃত এলাকায় আইনজারী হয়েছে মাখলা মাথায় দেয়া চলবে না।
পদ্মা মেঘনা যমুনায় নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ
জঙ্গীশাহী নুতন আর একটি ফরমান জারী করেছেন অতপর বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীতে এখন থেকে আর কোন নৌকা চলাচল করতে পারবে না।
৭ বৎসর কারাদণ্ড
এখন থেকে এহিয়া একটি নূতন ফরমান জারি করেছেন, পাকিস্তানের ভিতরে কেহ সামরিক সরকারের সমালােচনা করতে পারবে না। যদি সামরিক সরকারের সমালােচনা কেহ করে তাহলে ৭ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হবে। আমাদের শুক্কা আলির জিজ্ঞাসা পাকিস্তান সম্বন্ধে বিদেশীদের সমালােচনা করাও কি এহিয়া বন্ধ করতে পারবেন?
জন্মভূমি | ১: ৭ # ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি জঙ্গীশাহীর নির্দেশ
| (জয়বাংলা প্রতিনিধি)
ইয়াহিয়ার রক্ত খেকো সামরিক জান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, বাংলা একাডেমীর একজন গবেষক, ১৩ জন সি, এস, পি এবং ৪৪ জন ই, পি, সি এস অফিসারকে তাদের সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার ফতােয়া জারী করেছে।
শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডঃ মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ইংরেজী বিভাগের প্রধান ডঃ সারােয়ার মাের্শেদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডঃ মাজহারুল ইসলাম এবং বাংলা একাডেমীর গবেষক জনাব আবু জাফর শামসুদ্দিন। সামরিক আদালতে হাজির অন্যথায় অনুপস্থিতিতে তাদের বিচারের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সামরিক জান্তা যে ১৩ জন সি, এস, পি অফিসারকে তাদের বেয়নেটের সামনে কণ্ঠনালী এগিয়ে দিতে বলেছে তাদের মধ্যে রয়েছেন জনাব আসাদুজ্জামান, সৈয়দ আবদুস সামাদ, জনাব তৌফিক এলাহী, জনাব কুদরত এলাহী, জনাব নুরুল কাদের খান, জনাব খসরুজ্জামান চৌধুরী, জনাব রফিক উদ্দিন আহমদ, জনাব ওয়ালি উল ইসলাম, জনাব কামাল সিদ্দিকী, জনাব আকবর ও জনাব সাহাদাৎ হােসেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১; ১৮ ॥ ১০ সেপেটম্বর ১৯৭১
ওরা বাংলা ভাষাকে মুছে ফেলতে পারবে না।
৮ই সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ। আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, নরপিশাচ ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে বাংলা ভাষাকে মুছে ফেলার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। এরি মধ্যে পাক নরপশুরা | বাংলাদেশে ঘােষণা করেছে, বাংলায় কোন রকম সাইনবাের্ড এবং গাড়ীতে নাম্বার প্লেট ব্যবহার করতে
পারবে না। উর্দু কিংবা ইংরেজিতে লিখতে হবে। ইদানিং আর এক খবরে জানা গেছে সমগ্র দেশের জন্য ইয়াহিয়া সরকার উর্দুতে বর্ণমালা প্রবর্তনের চেষ্টা করছে। কিন্তু এই হীন ষড়যন্ত্র বাংলার মানুষ সহ্য করবে না। বুকের রক্ত ঢেলে যে ভাষাকে বাংলার মানুষ সােনার সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেই মাতৃভাষার অবমাননা বাংলার বিপ্লবী মানুষ কিছুতেই হতে দেবেন না।
| বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১:৫ ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ছাত্রবিহীন বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা, ৮ই সেপ্টেম্বর সর্বশেষ সূত্র থেকে জানা গেছে যে, এহিয়ার দখলিকৃত আলােকার ছাত্রছাত্রীরা কার্যতঃ স্কুল কলেজ বয়কট করে চলছেন। গত কয়েকদিনের মধ্যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২০ জন অধ্যাপককে গ্রেফতার নয়তাে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের কাছে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আহম্মদ শরীফ ও ইংরেজী বিভাগের আহসানুল হকের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এছাড়া জানা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ হাজার ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৩০/৪০ জন ছাত্র ক্লাসে আসছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ হাজার ছাত্রের মধ্যে উপস্থিতির সংখ্যা ১৬ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ হাজারের মধ্যে মাত্র ১৭ জন উপস্থিত থাকে। ঢাকা ল’ কলেজের ৭০০, নটরডাম কলেজের ১ হাজার, জগন্নাথ কলেজের ১০ হাজার ছাত্রের। মধ্যে কেহ ক্লাসে যােগদান করছে না।
উন্মভূমি | ১: ১৮ ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বেগম মুজিব অগ্রাহ্য
মুজিবনগর, ১১ই সেপূটেম্বর বিশেষ সূত্রে জানা গেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী। লুন্নেসা বেগমকে ধানমন্ডিতে নিজস্ব বাস ভবনে ফিরে যাবার জন্য সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব করলে তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে যেসব জিনিস খােয়া গেছে তা ফিরিয়ে
দেওয়া পর্যন্ত ধানমন্ডির বাড়িতে যাব না। | বর্তমানে তাদের নিজস্ব বাসভবন থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে দুই মেয়ে হাসিনা শেখ ও রেহানা। এবং চার বছরের ছেলে রাসেলসহ পরিবারের ৮ জন সদস্যকে সামরিক সরকার অন্তরীন করে রেখেছে।
জন্মভূমি ॥ ১ : ৮ ॥ ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কি দেখিলাম
অতি সম্প্রতি বাংলার বাণী’র একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। সফর করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ। লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহারই শেষ অংশ এখানে ছাপা হইল।
অধিকৃত এলাকায় পাক সেনারা যথেচ্ছভাবে স্থানীয় অবাঙালী কুলি-কামিন এবং চোর-ডাকাত গুণ্ডা-বদমায়েশদের লইয়া বদর, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করিয়া চলিয়াছে। তাহাদের সহিত কিছু মুসলিম লীগ ও জামাতের গুণ্ডা-পাণ্ডাও জুটিয়াছে। তাহারা পাক বাহিনীর ছত্রছায়ায় থাকিয়া যে। ঘৃণ্য কেলেঙ্কারীর ইতিহাস সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। পাক বাহিনী নিজেরা । যে কোন সম্মুক সময়ে গা বাঁচাইয়া চলিয়া প্রায়শঃই ইহাদিগকে মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলিয়া দেয়। রাত্রিকালে পাক বাহিনী যেখানে শিবিরের বাহিরে আসিবার কল্পনাও করিতে পারে
সেখানে রাজাকার বা মুজাহিদ বাহিনীর লােকদের দিয়া শিবির সমূহে নৈশকালীন পাহারা দিবার। ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সামান্য কয়েকদিন অনুশীলনীয় পরই তাহাদিগকে ফ্রন্টে পাঠাইয়া দিয়া খান সেনারা নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে গা বাঁচাইয়া অবস্থান করে। সে জন্য প্রতি ক্ষেত্রেই স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত এইসব বালিখিলারা হয় পালাইয়া প্রাণ বাঁচায় না হয় মুক্তিযােদ্ধাদের নিশ্চিত নিশানায় পরিণত হয় ।
হাট-বাজার | অধিকৃত এলাকার হাট-বাজার প্রায় সবই কোনমতে চলিতেছে। এবং জিনিস পত্রের দাম আগুন হইয়া উঠিয়াছে। অতি সম্প্রতি সেখানে লবন প্রতি সের দুই টাকা হিসেবে এবং কিছুদিন আগে কেরােসিন তেল প্রতি টিন ৪৫ টাকা হইতে ৫২ টাকা পর্যন্ত বিক্রী হইয়াছে, ইদানিং তাহা কমিয়া ২৮ টাকা হইতে ৩২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হইতেছে। চাউল আটা প্রায়ই হঠাৎ করিয়া বাজার হইতে উধাও হইয়া যায়। সাধারণ চাউলের দর এসময় সাধারণতঃ মণপ্রতি ৪২ টাকা হইতে ৪৮ টাকা পর্যন্ত হইয়া । থাকে, বর্তমানে উহা ৬০ টাকার উপরে। গ্রামাঞ্চলে তাহাও পাওয়া দুষ্কর। এই সব নিত্য প্রয়ােজনীয় । দ্রব্য এবং খাদ্য শস্যের এরূপ উর্ধগতির কারণ কি এই সম্পর্কে জনৈক বাঙ্গালী ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করা হইলে তিনি জানান যে, প্রতিটি নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য শহর হইতে খরিদ করিয়া অবাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় মজুত করা হইতেছে। সামরিক বাহিনীর খাদ্যশস্য যথেষ্ট জমা হইয়া যাওয়ায় তাহারা লুটপাট করিয়া নিজেরা না লইয়া অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রয় করিয়া দিতেছে। এবং সেইগুলি। সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, শান্তাহার, ঈশ্বরদি, খালিশপুর ইত্যাদি বিশেষ এলাকায় জমা করা হইতেছে।
তাহাদের উদ্দেশ্য কি জানা ভার। ব্যবসায়ীটি আরাে জানান স্থানীয় হাট বাজারগুলির আড়তগুলিতে। প্রথমদিকে যে লুটের তাণ্ডব চলিয়াছিল সে তাণ্ডবে কোন বাঙ্গালী আড়তই রক্ষা পায় নাই। | বর্বররা হয় লুটপাট করিয়া মালামাল লইয়া গিয়াছে না হয় আড়ত অগ্নিদগ্ধ করিয়াছে। কাজেই ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পথের ভিখারী হইয়া ব্যবসা গুটাইতে বাধ্য হইয়াছেন।
জনৈক গ্রামবাসীকে স্থানীয় হাটের ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রশ্ন করিলে তিনি জানান প্রায়ই কিছু না কিছু রাজাকার ও পাকবাহিনী আসিয়া জোরপূর্বক দোকানদারের নিকট হইতে সাধ্যাতিরিক্ত অর্থ চাহিয়া বসে এবং অর্থদানে বিলম্ব ঘটিলে মারধাের, খুন-জখম করিতেও দ্বিধাবােধ করে না। তাহারা সবকিছু লুটপাট করিয়া লইয়া যায় । ইহার ফলে কোন ব্যবসায়ীই আর নতুন জিনিষ না কিনিয়া দোকান আপাততঃ বন্ধ করিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন।
| স্কুল-কলেজ।
অধিকৃত এলাকায় স্কুল-কলেজগুলির অবস্থা চরম নৈরাশ্যজনক। স্কুল গুলিতে ৫০০-৬০০ ছাত্রের মধ্যে ২/১ জন ছাত্র মাঝে মধ্যে বেড়াইতে আসে। পড়াশােনার প্রশ্ন উঠে না। বাের্ডের ফাইনাল পরীক্ষা হলগুলিতে ছাত্রদের অনেক ভয় ভীতি প্রদর্শন করাইয়াও মুষ্টিমেয় সংখ্যক ছাড়া কাহাকেও উপস্থিত করাইতে পাক বাহিনী ব্যর্থ হইয়াছে। যাহারা পরীক্ষায় উপস্থিত হয় নাই তাহাদের পিতামাতার নিকট কারণ দর্শাইবার নােটিশ যাইতেছে বলিয়া প্রকাশ । কলেকগুলিতে কিছু কিছু অবাঙ্গালী ছাত্র হাজিরা | দেয় এবং এইসব অবাঙ্গালী ছাত্ররা প্রায়ই ক্লাসের দিকে না যাইয়া ক্যান্টিন ও কমনরুমের আশে-পাশে ঘােরাঘুরি করিয়া কালক্ষেপ করে।
শহরের পথ-ঘাট
শহরের পথচারী প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব পরিস্ফুট। পথচারী সকলেই প্রায়। | নিরাপত্তার ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত। শহরবাসীরা একান্ত বাধ্য না হইলে ঘর হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করেন না।
শহরের প্রায় বড় বড় দোকানগুলি তালাবন্ধ হইয়াছে। দোকানগুলির সাইনবাের্ড ও বিজ্ঞাপনে নতুন উর্দু অক্ষর বসিয়াছে। বাঙালী পথচারীকে ব্যঙ্গ করিতেছে। রাতারাতি শহরের সকল সাইনবাের্ড | ও মােট গাড়ী, রিকশার নম্বরপ্লেট বাংলা হইতে উর্দুতে লিখিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ীঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটগুলি ইতিমধ্যে অবাঙালী ও জামাত মুসলিম লীগ সমর্থকদের মধ্যে নামমাত্র মূল্যে বিক্রী করা হইয়াছে।
বাংলার বাণী ॥ ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ধরপাকড় অব্যাহত মুজিবনগরে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, যে, দলখকারী বর্বর জঙ্গীশাহী কর্তৃক বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবিদের গ্রেফতার অব্যাহত রহিয়াছে। বিগত একপক্ষ কালের মধ্যে ঢাকাতে ১১ জন অধ্যাপক, শিল্পী ও আইনজীবিকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে রহিয়াছেন ঢাকা | বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ আহমেদ শরীফ, জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব শহীদুল্লাহ, জনাব আবুল | খায়ের প্রমুখ । | কিছুদিন আগে বিশিষ্ট সংগীত পরিচালক জনাব আলতাফ মাহমুদকে তাহার শহীদবাগস্থ বাসভবন। হইতে ধরিয়া লইয়া যাওয়া হয়।
| আর একটি খবরে প্রকাশ বরিশালের বিশিষ্ট আইনজীবি জনাব আবদুস সাত্তার হাওলাদারকে তাহার বাড়ী হইতে গ্রেফতার করা হইয়াছে ।।
বাংলার বাণী ॥ ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
অধিকৃত অঞ্চলে স্বাভাবিক অবস্থার নমুনা। শিক্ষকদের হয়রানি অব্যাহত স্কুল কলেজে ছাত্র সংখ্যা হাস্যকররূপে নগণ্য
(বিশেষ প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় হানাদার বাহিনীর চণ্ডনীতি অব্যাহত রহিয়াছে। বাঙ্গালী জাতিকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিক্ষেপ করিয়া চিরতরে পঙ্গু করিয়া রাখার দুরভিসন্ধি হাছিলের উদ্দেশ্যে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যে বর্বর নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করে, উহার বিভীষিকাময় স্মৃতি বাঙ্গালীর মন ও মানস হইতে এখনও মুছিয়া যায় নাই। আজো ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবিদের বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহের ময়আতংক দৃশ্য, আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন আবাসিক হল ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসস্তুপ বাংলার ছাত্র-শিক্ষকদের নিরন্তর চাবুক মারিয়া বলিয়া দিতেছে হানাদার পাঞ্জাবী ডালকুত্তার দল চায় বাংলাদেশের শিক্ষা জীবনকে পঙ্গু করিয়া দিতে, ছাত্র-শিক্ষক বুদ্ধিজীবীসহ গােট বাঙ্গালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিতে চায় বাংলাকে চিরদিন পদানত করিয়া রাখতে। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ৭ই মার্চের ভাষণে নির্দেশ দিয়াছেন, যতদিন বাংলার মানুষের মুক্তি না আসে, ততদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ । তাই আজ আর বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকদের ভীড় নাই। শিক্ষাঙ্গন ছাড়িয়া ছাত্র-তরুণেরা সমরাস্ত্র হাতে রণাঙ্গনের প্রান্তে প্রান্তে খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন শত্রুবাহিনী। আর শিক্ষকরা পালন করিতেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবিস্তৃত প্রাঙ্গনে আপন আপন দায়িত্ব।
সেই কারণেই, অধিকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিয়াছে বলিয়া জঙ্গীশাহীর অবিরাম প্রচারণা সত্ত্বেও স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এখনও গড়ের মাঠ। আর ইহাতে ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। জল্লাদশাহী। প্রতিহিংসা চরিতার্থতার জন্য পাক ফেীজ এখন ঝাপাইয়া পড়িতেছে অধিকৃত এলাকায়। | এখনও সে অল্পসংখ্যক শিক্ষাবিদ রহিয়াছেন তাদের উপর।
| তথ্যাভিজ্ঞ মহলের খবরে প্রকাশ যে, দখলদার জঙ্গীবাহিনী সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্ততঃ | ১৫ জন বিশিষ্ট অধ্যাপককে গ্রেফতার করিয়াছে কিংবা সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট হাজির হইবার নির্দেশ দিয়াছে ।। | হানাদার বাহিনী যাহাদের উপর এই নির্দেশ জারী করিয়াছে তাহাদের মধ্যে রহিয়াছেন ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ডঃ আহমেদ শরীফ, ইংরাজী বিভাগের রীডার ডঃ এহসানুল হক এবং | বিজ্ঞান বিভাগের দুজন বিশিষ্ট অধ্যাপক। এই গ্রেফতারের ব্যাপারে অবশ্য পাকিস্তান সরকার নীরব।
শিক্ষা বিভাগের সহিত সংশ্লিষ্ট মহলের সংবাদে প্রকাশ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে সাত হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে গড়ে ৪৭/৪৮ জন ছাত্র ক্লাসে আসে। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন হাজারেরও
অধিক ছাত্রের মধ্যে উপস্থিতির সংখ্যা মাত্র ১৮ জন এবং ঢাকা কলেজের প্রায় ১ হাজার ছাত্রের মধ্যে | ৬০ জন ল কলেজ ও নটর ডাম কলেজে কেহই ক্লাসে যােগদান করিতেছে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের | দুই হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে উপস্থিতির সংখ্যা মাত্র ১৬ জন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপস্থিতির সংখ্যাও প্রায় অনুরূপ।
বাংলার বাণী ॥ ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ইহা কিসের আলামত?
নিজস্ব প্রতিনিধি
বাংলাদেশে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদে সারা বিশ্ববিবেক যখন প্রচন্ড ধিক্কারমুখর এবং প্রিয় মাতৃভূমির নারীপুরুষ বৃদ্ধ শিশু নির্বিশেষে নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে হত্যার প্রতিবাদে যখন ইসলামবাদের পাষণ্ড জল্লাদশাহীর বিদেশস্থ কূটনৈতিক মিশনসমূহের বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ ও অন্যান্য বাঙ্গালী কর্মচারী বাঙ্গালীর রক্তমাখা মােটা মাহিনার চাকুরী ঘূণার সহিত ইস্তফা। দিয়া বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিয়া চলিয়াছেন, ঠিক তখনও বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় যে সকল সরকারী আমলা। কসাই টিক্কা খানের পদলেহনপূর্বক চাকুরীতে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান ছিল। সম্প্রতি গাদ্দার মালেক গভর্নর হওয়ার পর ইহারা এক মহা ফ্যাসাদে পড়িয়াছে।
প্রকাশ, ইয়াহিয়ার গর্দভ ডাঃ মালেক বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার গভর্নর নিযুক্ত হওয়ার পর। বাঙ্গালী সরকারী কর্মচারীদের উপর এক নুতন ফরমান জারি করিয়াছে। এই নুতন নির্দেশে সরকারী কর্মচারীদের ছেলে বা ভাই কিংবা নিকট আত্মীয়ের হিসাব এবং তাহাদের কে কোথায় কি করিতেছে ।।
ছেলে-মেয়ে কিংবা ভাই ও নিকট আত্মীয় স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী হইলে তাহারা কেন স্কুলকলেজে যায় না তাহার জন্য কৈফিয়ৎও তলব করা হইয়াছে। শুধু তাহাই নহে; তাহাদিগকে অবিলম্বে স্কুল-কলেজ কিংবা তাহাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে পাঠাইবার জন্যও বাঙ্গালী সরকারী কর্মচারীদের উপর কঠোর চাপ দেওয়া হইতেছে।
উল্লেখযােগ্য যে, বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীগণ জল্লাদশাহীর স্কুল-কলেজ ত্যাগ করিয়া। মুজিব বাহিনীতে যােগ দিয়া হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাপাইয়া পড়িয়াছেন। কেহ কেহ বা মুক্ত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করিতেছেন।
| এমতাবস্থায় গর্দভ মালেকের হুকুম তামিলের ব্যর্থতার পরিণতির দিক ভাবিয়া, তদুপরি দখলীকৃত এলাকায় মুজিব বাহিনীর প্রচণ্ড তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কোন কোন আমলা দখলীকৃত এলাকায় আর থাকিতে নিরাপদ বােধ করিতেছে না। তাই সম্প্রতি এই শ্রেণীর আমলারা নাকি মুজিবনগরে আগমন করিতে শুরু করিয়াছে। প্রকাশ, ইতিমধ্যেই কতিপয় আমলা মুজিবনগরে আসিয়া সশরীরে হাজির হইয়াছে। হঠাৎ ইহাদের এই সুমতি’ হইল কেন তাহা বুঝিয়া ওঠা ভার । ইহারা কি গর্দভ মালেক তথা। ইসলামাবাদ জঙ্গী শাহীর বিশ্বস্ত ও অনুগত চর হিসাবে কোন মহৎ উদ্দেশ্য লইয়া কিংবা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দফতরে ঢুকিয়া ইহাদের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারকে আমলাতন্ত্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াইয়া জঙ্গীচক্রের বিভেদাত্বক উদ্দেশ্যই চরিতার্থ করার দূরভিসন্ধি লইয়া আগমন করিয়াছে বা করিতেছে কি না তাহাই বুঝিবার উপায় কি!
| প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, আইয়ুব কর্তৃক সৃষ্ট এবং ক্রীম অব দি সােসাইটি’ হিসাবে আইয়ুবমােনেম কর্তৃক লালিত এই শ্রেণীর আমলা আইযুব মােনেমের কালাে দশকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সহিত প্রভৃভক্তি প্রদর্শন করিয়াছে। ইহার পর জঙ্গী ইয়াহিয়াশাহীর রাজত্বের এক যুগসন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আহূত অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের সময় ইহারা অবস্থা বুঝিয়া ‘জনতার কাতারে ঠেলা । গােছাইয়াছে । ইহাদেরই কেহ কেহ আবার ইদানীং দখলীকৃত এলাকার অবস্থা বেগতিক দেখিয়া মুক্ত। এলাকায় আগমন করিলে বিস্মিত হইবার কি আছে ।
তবে ভীড়ের মধ্যে পকেট মারার মত এই জনাবদের কেই কেই ফাকতালে ডিকেত তেলেসমাতি কারবার চালায় কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখার দরকার আছে বৈকি।
বাংলার বাণী ৪ ৩ সংখ্যা [ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
| ভয়াল দূর্ভিক্ষের করালগ্রাসে বাংলাদেশ ১৯১ জনের মৃত্যু : দিকে দিকে বুভুক্ষ মানুষের আর্তনাদ
(বাংলার বাণীর বিশেষ প্রতিনিধি)
বিগত নভেম্বরের প্রলয়ংকরী সামুদ্রিক ঝড়-প্লাবনের ক্ষতচিহ্নের উপর দিয়া প্রবাহিত সাম্প্রতিক সর্বনাশা বন্যার উন্মত্ত জলরাশির তান্ডবনৃত্যের অবসান সূচিত হইবার আগেই যুদ্ধবিক্ষত দূর্ভাগা বাংলা নিক্ষিপ্ত হইয়াছে ভয়াল দুর্ভিক্ষের বিভিষীকাময় করালগ্রাসে। বাংলাদেশের ১২টি জেলায় ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের হিংস্র ছােবলে ইতিমধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছে ১৯১টি মানুষ। একদিনের সােনার বাংলার দশদিগন্তে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খার তীরে তীরে বিষন্ন বাতাসে বাতাসে ভাসিয়া বেড়াইতেছে আশ্রয়হীন, অন্নহীন, বুভুক্ষু কংকালসার অগণিত নর-নারী শিশুর আর্তচীক্কার : অন্নদাও বিশ্ববাসী, বাঁচাও আমাদের বাঁচাও ।।
অনাহারে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর প্রাণহানির বেদনাদায়ক স্মৃতিবিজড়িত ১২৭৬ সালের মন্বন্তরের দুই শতাধিক বছর পরে ঝড়-বন্যা-মন্বন্তর-মহামারির ধ্বংসলীলা নিকেতন বাংলার মাটিতে এবার দুর্ভিক্ষ ছােবল হানিয়াছে সর্বাত্মক হিংস্রতা লইয়া । দূর্ভিক্ষ প্রপীড়িত ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, বরিশাল, নােয়াখালী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশাের ও খুলনা জেলায় … উঠিয়াছে নিরন্ন নরনারী, শিশুর সকরুন আর্তনাদ। দুঃসহ ক্ষুধার অস্ত্রীর যন্ত্রনায় তিলে তিলে রক্তাক্ত জর্জরিত হইয়া ইতিমধ্যেই মৃত্যুর অতলান্তে হারাইয়া গিয়াছে ১৯১টি অমূল্য মানব জীবন।
| বাংলার বাণী ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের পদধ্বনি
| ॥ বার্নার্ড ব্রেইনী |
দিনের পর যেমন অবধারিত জীবন নিয়মে রাত্রি আসে স্বাধীন অক্টোবর মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ শুরু হইলে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা হইলে এই দূর্ভিক্ষ নড়াইবার সাধ্য কাহারাে নাই ।
সম্প্রতি কানাডার টরােন্টোতে দক্ষিণ পূর্ব এশীয় বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইয়াছে। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল কানাডায় আক্সফাম নামক ত্রাণসংস্থা। অকটোবরে। বাংলাদেশে ভয়াবহতম দূর্ভিক্ষের আশংকার কথা ঐ বিশেষত্ররাই বলিয়াছেন। | কিছুকাল আগে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা সফর করিয়া গিয়াছেন। তাহারা একবাক্যে বলিয়াছেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দখলীকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থার চিহ্ন রাখে নাই। পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের সময়ে সেখানে জনসাধারণ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন যাপন করিতেছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অথবা হানাদার বাহিনীর পদলেহী দালালদের প্রতি জনগণের অন্তহীন ঘৃণা আর বিক্ষোভ। মিল-কারখানা সমূহে শ্রমিকেরা কাজে যােগদান করে নাই। সরকারী বেসরকারী অফিসসমূহে যাহারা কাজে যােগদান করিয়াছে তাহাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
পরিস্থিতির অবনতি হইতেছে।
ইতিমধ্যে আরাে সময় অতিক্রান্ত হইয়াছে। বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধি দল যখন অধিকৃত এলাকা সফর করিয়াছেন তাহার পর পরিস্থিতি সামান্য উন্নতিও হয় নাই। বর্তমানে ভারতে প্রায় ৮৫ লক্ষ শরণার্থী। আশ্রয় নিয়াছে। আরাে অনেকে প্রাণ বাচাইবার জন্য ভারত সীমান্তের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে ।
শরণার্থীদের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাইতেছে। মর্মাহত কংকালসার ভগ্নস্বাস্থ্য এইসব দুর্ভাগা মানুষদের দেখিলেই বুঝা যায় অধিকৃত এলাকায় যাহারা বাস করিতেছে তাহারা কি অসহনীয় ভয়ঙ্কর অবস্থায় কাল কাটাইতেছে।
| ঔপনিবেশিক জঙ্গীশাহী অবশ্য ইতিমধ্যে তাহাদের পদলেহী একজন দালালকে বাংলাদেশের অধিকৃত দখলকার গভর্ণররূপে নিয়ােগ করিয়াছে। কিন্তু সেখানে জনজীবনের কোথাও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিবার লক্ষণ নাই। সবচেয়ে বড় কথা, সাড়ে সাত কোটি বাংগালীর অবিসংবাদিত প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে আটক করিয়া ইয়াহিয়া তাহার বিচার প্রহসন শুরু করিয়াছে।
এই ধরণের ঘটনার পর বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসে নাই, আসিতে পারে না।
দূর্ভিক্ষের আশঙ্কা কেন?
সূজলা সূফলা শস্যশ্যমলা বাংলাদেশ। উর্বর ভূমি এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলার মাটি স্বর্ণ প্রসবিনা।
কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতা একটি মারাত্মক সমস্যা। অনাহার ও অর্ধাহারতে প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ খাদ্য মাছ ভাত। সঙ্গে সজী এবং কখনাে কখনাে মাংস।
গত বৎসর বিশ্বব্যাঙ্কের এক রিপাের্টে বলা হইয়াছিল গড়ে একজন বাংগালীর খাদ্যের পরিমাণ হইতেছে ১৬.১ আউন্স এই খাদ্যে ক্যালােরির পরিমাণ ১৭০০। তুলনামূলকভাবে উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরােপের দেশসমূহে দৈনিক গড়পড়তা ক্যালােরীর পরিমাণ হইতেছে ২৭০০। | ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের এক সরকারী রিপাের্টে স্বীকার করা হইয়াছিল উল্লিখিত ক্যালােরীর পরিমাণও শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের জোটে না। গ্রামাঞ্চলে অনাহার ও পুষ্টিহীনতা এক মারাত্মক সমস্যা। শিশু মৃত্যুর হার শতকরা ২৬! ইউরােপের এই হার হইতেছে মাত্র ২,৪।
| টরােন্টো সম্মেলনে এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করিয়াছেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল এর ডাঃ জন রােড । ডাঃ রােড সম্প্রতি বাংলাদেশের দখলীকৃত অঞ্চল পরিভ্রমণ করিয়াছেন।
তাঁহার অভিমত যে দেশে স্বাভাবিক সময়ে খাদ্যের পরিমাণ এত কম, সেখানে এই দুঃসময়ে প্রকৃত অবস্থার আরাে অনেক বেশী অবনতি হইবে তাহাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।
দূর্ভিক্ষের কারণ।
১৯৬৬ সাল হইতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের গড় পরিমাণ ছিল বার্ষিক ১০৮ লক্ষ টন। এই উৎপাদিত পরিমাণ প্রয়ােজনের তুলনায় কম ছিল বলিয়া বার্ষিক ১২ লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানী করিতে হইত।
১৯৭০-৭৫ সালের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পায় খাদ্যোৎপাদন বাড়াইবার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু বাস্তবে এই উৎপাদন আরাে কমিয়াছে। | ডাঃ রােড এই সম্পর্কে মার্কিন সরকারী তথ্যের উদ্ধৃতি প্রদান করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য বিভাগের সংগৃহীত তথ্য উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন এই বৎসর প্রায় ২৩ লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানীর প্রয়ােজন।
সংক্ষেপে বলা যায় ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর বর্তমানে সে ধরণের খাদ্যাভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়াছে এইরূপ সাংঘাতিক অবস্থা আর কখনাে দেখা যায় নাই। ডাঃ রােড বলিয়াছেন, কম করিয়া ধরিলেও প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ আসন্ন দূর্ভিক্ষের সময় অনাহারে মৃত্যুবরণ করিতে বাধ্য হইবে।
কৃষকদের পলায়ন। | বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার এই নাজুক পরিস্থিতির কারণ খুঁজিতে খুব বেশী দূর যাওয়ার প্রয়ােজন নাই। | হাজার হাজার কৃষক পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হইয়া ঘর বাড়ি, ভিটামাটি ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছে আশ্রয় লইয়াছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। অন্যদিকে অধিকৃত এলাকায় কোথাও কোনােরকম স্বাভাবিক কর্মতৎপরতার বিন্দুমাত্র আভাস নাই। ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম অফিস | আদালত সব কিছুই কার্যতঃ বন্ধ রহিয়াছে। সমগ্র এলাকায় নিদারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রতিদিন
স্পষ্টতর হইয়া উঠিয়াছে। চাউলের মূল্য প্রতিদিন তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে। | ডাঃ রােড জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থার বিবরণ উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই বিবরণে বলা হয়। বাংলাদেশে দূর্ভিক্ষ প্রতিরােধের জন্য জরুরী ভিত্তিতে ২৯ লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানীর প্রয়ােজন। কিন্তু খাদ্য আমদানী সম্বব হইলেও খাদ্য শষ্যের বিতরণ ব্যবস্থা সম্ভব হইবে না। যােগাযােগ ব্যবস্থা। সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে অধিকৃত এলাকায় খাদ্যশস্য বিতরণ সম্পূর্ণ অসম্ভব। চট্টগ্রামসহ
অন্যান্য সব কয়টি নৌ-বন্দরে কাজ প্রায় বন্ধ রহিয়াছে। বন্দরে যে সব শ্রমিক কাজ করিত তাহাদের | বেশির ভাগ কাজ ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছে এবং অদূর ভবিষ্যতে কোন বন্দরের কার্য ক্ষমতা বৃদ্ধি করার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের দুঃসাহসী গেরিলা ইউনিটগুলির ক্রমবর্ধমান তৎপরতার ফলে যােগাযােগ ব্যবস্থা কার্যতঃ স্তব্ধ হইয়া পড়িয়াছে।
বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন লােক গ্রামাঞ্চলে বাস করে। ইতিমধ্যে এই সংখ্যা আরাে | বাড়িয়াছে। শহরসমূহের অর্ধেকেরও বেশী লােক গ্রামাঞ্চলে চলিয়া যাওয়ায় অধিকৃত এলাকার শহরসমূহ জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছে।
এতদ্সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী যদি খাদ্য বিতরণের ভার নেয় তাহা হইলে গেরিলাদের আক্রমণাত্মক দুঃসাহসিক তৎপরতায় তাহা ব্যর্থ হইতে বাধ্য।
ডাঃ রােড বাংলাদেশের এই দূর্ভিক্ষ প্রতিরােধের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যদি খাদ্য বন্টন করা যায় তাহা হইলে হয়তাে এই বৃহৎ বিপর্যয় এড়ানাে সম্ভব। | ডাঃ রােড সাবধানবানী উচ্চারণ করিয়া বলেন, সময় অত্যন্ত কম । জরুরী বিষয়রূপে বিবেচনা করিয়া অগ্রসর না হইলে বিশ্ববাসী অচিরেই ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করিবেন।
| টরােন্টোর এই সম্মেলনে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার যে ভয়াবহ চিত্র বিশ্ববাসীর সম্মুখে | তুলিয়া ধরিয়াছে তাহার প্রতি যথােপযুক্ত মনােযােগ দেওয়া না হইলৈ বাংলাদেশে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যার পর, ইহা হইবে আরাে এক বিরাট গণহত্যা। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী অবিলম্বে বাংলাদেশ হইতে চলিয়া না গেলে এই অবস্থার বাস্তব কোন পরিবর্তন ঘটিবে বলিয়া আশা করা যায় না।
নীরব দর্শক?’ | প্রশ্ন করা যায় বাংলাদেশের এই অবস্থায় বিশ্ববাসী কি নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করিবে?
জল্লাদ ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে ধরণের গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইয়া যাইতেছে একমাত্র মধ্যযুগের বর্বরতা ছাড়া বিংশ শতাব্দীতে ইহার দ্বিতীয় নজীর নাই । | বিশ্ব বিবেক অন্ধ ও হৃদয়হীন না হইলে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের উচিত বাংলাদেশের মাটি হইতে | সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিতে ইয়াহিয়াকে বাধ্য করা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে আপন অধিকারের শান্তিতে বাচিয়া থাকিবার সুযােগ দেওয়া। লন্ডন টাইমস
বাংলার বাণী # ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
এবারে নিজেরাই নিজেদেরকে খতম করছে।
(স্টাফ রিপাের্টার)
বাঙালীদেরকে গলাজলে নামাতে গিয়ে খান সেনাদের এখন নাক পর্যন্ত ডুবে যাওয়ার উপক্রম। ২৫শে মার্চের পর থেকে প্রতিদিন দু’ডজন অফিসার সহ কয়েকশত করে হতাহত সামরিক বাহিনীর লােককে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হােত করাচীতে। বােঝাই হয়ে যেতে লাগল একের পর এক হাসপাতাল গুলি।
হাসপাতালের কর্তারা বললেন, ঠাই নাই, ঠাই নাই । কিন্তু সামরিক প্রশাসকের হুকুম, ঠাই দিতেই হবে। উপায়ন্তর না দেখে নতুন আহত আগন্তুকদের জায়গা করার জন্য পটাপট ফিনিশ করা হতে লাগল পুরানা আদমীদের।
এবারে আহত খানসেনারা এমনই একটা নিশ্চিত আশ্রয় পেল, যেখানে জায়গার কোন অভাবই নেই।
সাপ্তাহিক বাংলা ১:১ । ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বিলেত থেকে আগত বাঙালীদের প্রত্যাগমনে দুর্ভোগের একশেষ
| ॥ আব্দুস শহীদ
সিলেট, ১৩ই সেপ্টেম্বর বিলেতে বসবাসকারী যে সব বাঙালী আত্মীয় স্বজনকে দেখার জন্য বাংলাদেশে এসেছিল তারা এখন আর সহসা সেখানে ফিরে যেতে পারছেন না। অনেকে খুন হচ্ছেন রাজাকার অথবা খান সেনাদের হাতে। অনেকে সর্বস্ব হারিয়েছেন লুঠতরাজ আর অগ্নিসংযােগে। সহায় সম্পত্তির সঙ্গে অনেকের আবার পাসপাের্টটি ও খােয়া গেছে। সুতরাং বিলেত থেকে আগত কয়েক হাজার সিলেটী জনসাধারণ চরম অসুবিধার মধ্যে কালাতিপাত করছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, একমাত্র সিলেট জেলারই প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ ইংল্যাণ্ডে বসবাস।
| বর্তমানে সিলেট জেলার হবিগঞ্জ, বালাগঞ্জ, গােলাপগঞ্জ, বিয়ানী বাজার, ধীরাই, রাজাপুর, কোয়াঙ্গপুর, বাঘমায়না, বিশ্বনাথ, লােহরপুর, সদর গাঁও, লােহার গাঁও, রাণীগঞ্জ, ভবানীপুর, কোনার চর, ছাতক প্রভৃতি এলাকার বিলেত থেকে আগত ভদ্র লােকদের পাসপাের্ট রাজাকার বাহিনীর বর্বররা ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। | এই সব পাসপাের্ট পশ্চিমাদের দালাল সিলেট শহরস্থ লতিফ ট্রাভেলস, মাসুম ট্রাভেলসও তাহের ট্রাভেলস-এ জমা দেওয়া হচ্ছে। পরে এই সব পাসপাের্ট মালিকদের করাচী হায়ে ইংল্যাণ্ড ফিরে যাবার নির্দেশ দেওয়া হয়।
জঙ্গীশাহীর নির্দেশ
এরপর এই সব যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালীদেরকে সেনাবাহিনীর প্রহরায় করাচী নিয়ে গিয়ে এই মর্মে শাসানাে হচ্ছে যে, আগামী তিন মাসের মধ্যে তারা যদি প্রত্যেকে কমপক্ষে ৭০০ পাউণ্ড করে পাকিস্তানে না পাঠান, তা হলে তাদের ঘর-বাড়ী, সহায়সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হবে এবং পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।
| এছাড়া পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর পক্ষে প্রচার চালানাের জন্যও তাদের কে বিশেষ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
চিঠি আসিল না কেন, টাকা আসিল না কেন? | কিন্তু এখানেই কাহিনীর শেষ নয়। বিলেত প্রবাসী বাঙালীদের আত্মীয়-স্বজনকে রাজাকার বাহিনীর লােকেরা স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট ধরে নিয়ে যাচ্ছে । অতঃপর তাদেরকে দিয়ে জোর করে লণ্ডন ও অন্যান্য স্থানে এই মর্মে চিঠি লিখানাে হচ্ছে যে, পাকিস্তানে বর্তমানে পূর্ণ ‘শান্তি বিরাজ করছে। পশ্চিমা সৈন্যদের আচরণ বেশ ‘মিঠে মিঠে লাগছে। সুতরাং তারা যেন বিদেশ থেকে পাকিস্তানে নির্দ্বিধায় টাকা পাঠায়।
পাছে চিঠিগুলি বিদেশে না পাঠানাে হয়, এই সন্দেহে রাজাকার বাহিনীর লােকেরাই এগুলাে পােষ্ট করছে। | চিঠি পাঠানাের দু’সপ্তাহের মধ্যে কোন জবাব কিংবা টাকা-পয়সা না এলে রাজাকাররা আবার সেই প্রবাসী ভদ্রলােকদের আত্মীয় স্বজনের বাড়ী গিয়ে চড়াও হচ্ছে। হুকুম করছে—আবার চিঠি লিখ। লােলুপ প্রশ্ন—“চিঠি আসিলনা কেন, টাকা আসিল না কেন?’
সাপ্তাহিক বাংলা # ১:১ । ১৬ সেপেটম্বর ১৯৭.
যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ৩ জন বাঙালী খুন
সম্প্রতি বালাগঞ্জ থানার আলমপুর গ্রামের তিনজন যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালীকে খানসেনার খুন করেছে।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ইস্রাফ আলী, রফিকুল ইসলাম ও রজনী দেব নামক এই তিন ব্যক্তি তাদের আত্মীয় স্বজনকে দেখবার জন্য লণ্ডন থেকে বাংলাদেশে আসেন। গােবিন্দশ্রী গ্রামের সফিক রাজাকার গত মাসে এঁদেরকে লঙ্কাটিলাস্থ পাক সামরিক বাহিনীর হাতে সােপর্দ করে। পরে পাকবাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন তাদেরকে গুলী করে হত্যা করে।
| সাপ্তাহিক বাংলা ১:১ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭
ঢাকা শহর বন্দী শিবিরে পরিণত
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনী ঢাকা শহরকে এখন কার্যতঃ বন্দী শিবিরে পরিণত করিয়াছে। উপর্যুপরি কম্যাপ্তে ও গেরিলা আক্রমণে ভীত হইয়াই এই ব্যবস্থা লওয়া হইয়াছে। কিন্তু এতদসত্বেও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বন্ধ হয় নাই। | পাকিস্তানী বাহিনী শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করিতেছে। বুড়িগঙ্গা নদীতে সশস্ত্র টহলদার বাহিনী গানবােট ও লঞ্চ যােগে দিবারাত্র ঘােরাফেরা করিতেছে। শহরের সহিত অন্যান, স্থানের যােগাযােগ একেবারে নাই বললেই চলে। শহর হইতে বাহিরগামী সড়কসমূহের প্রবেশ পথে সশস্ত্রবাহিনী ও কড়া চেক পােস্ট ব্যবস্থা মােতায়েন করা হইয়াছে।
| সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও বরিশালের মধ্যে লঞ্চ চলাচল করিতেছে। ইহাও আবার অনিয়মিত। সন্ধ্যা হইলেই স্থল ও জলপথে যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া যায়। পানির ট্যাঙ্কসমূহ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে সেনাবাহিনীর ২৪ ঘন্টা প্রহারা মােতায়েন রহিয়াছে।
| সেনাবাহিনীর লােকেরা জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের রাজাকার গুণ্ডাদেরকে লইয়া বিভিন্ন রাত্রে বিভিন্ন মহল্লা ঘেরাও করে ও তল্লাশী চালায়। সাধারণতঃ যেসব এলাকায় বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয় থাকে, সেই সব এলাকাতেই এই ধরণের অভিযান চালান হয়। কিন্তু ইহাতেও শহরবাসীর মনােব
দমিয়া যায় নাই । মুখ ফুটিয়া প্রকাশ্যে হয়ত তাহারা কিছু করিতে পারিতেছে না; কিন্তু শত্রুকে চরম আঘাত হানার সঙ্কল্প তাহাদের দৃঢ়তর হইতেছে।
নতুন বাংলার ॥ ১ : ৫ ! ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
নতুন করিয়া বুদ্ধিজীবি গ্রেফতার শুরু
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
ঢাকাসহ বাংলাদেশের অধৃিক অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে আবার নূতন করিয়া শিক্ষক, শিল্পী, আইনজীবী সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবী গ্রেফতার করা হইতেছে। জঙ্গীশাহীর নির্যাতনের ফলে অধিকাংশ | বুদ্ধিজীবীই বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন।
| গত পক্ষ কালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন শিক্ষকসহ কয়েকজন শিল্পী ও আইনজীবি | গ্রেফতার হইয়াছেন গ্রেফতারকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে জনাব আহমদ শরীফ, জনাব আবুল খয়ের, জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব শহীদুল্লাহ প্রমুখ রহিয়াছেন।
পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে অবস্থিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী শিবির | হইতে প্রেরিত এক পত্রে জানান হয় যে, সম্প্রতি বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক জনাব আলতাফ মাহমুদকে ঢাকায় তাহার শহীদবাগস্থিত বাসভবন হইতে গ্রেফতার করা হয়। ঐ একই পত্রে জানান হয় যে, বরিশালের বিশিষ্ট আইনজীবি জনার আব্দুস সাত্তার হাওলাদারকেও গ্রেফতার করা হইয়াছে। বলা হয় যে, এইসব গ্রেফতা েপর গ্রেফতারকৃতদের আর কোন হদীস পাওয়া যাইতেছে না।
নতুন বাংলার ॥ ১ : ৫ ॥ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সেই পুরাতন খেলা
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলা’য় একটি নতুন নাটকের অভিনয় চলছে। নাটকটি যদিও নতুন কিন্তু তার বিষয়বস্তু অত্যন্ত পুরােন । এই বিষয়বস্তু হল, একজন অসামরিক তাবেদার বাঙালীকে গভর্ণরের পদে বসিয়ে বিশ্ববাসীকে বােঝানাে, বাংলাদেশে আর সামরিক শাসন নেই। এমন চেষ্টা আইয়ুব খাও করেছিলেন। তার দশ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে মােনেম খা নামক এক বটতলার উকিলকে গভর্ণর পদে বসিয়ে দুনিয়ার মানুষকে বােঝাতে চেয়ে ছিলেন, বাঙালীদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। মােনেম খার বদলে এবার ভাড়া পাওয়া গেছে আবদুল মােতালিব মালেক নামক এক দাঁতের ডাক্তারকে। | ঢাকার লাটভবনে শুধু তাবেদার গভর্ণর বসিয়ে নয়, পিণ্ডির জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার আসল অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য আরাে ছল চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে। হঠাৎ খুনী ইয়াহিয়া একেবারে ‘মহানুভব ব্যক্তি সেজেছেন এবং তাদের কথিত এক শ্রেণীর “রাষ্ট্রবিরােধী” বাঙালীর প্রতি সাধরণ অনুকম্পাও’ ঘােষণা করেছেন। দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে বলা হয়েছে, কিছু সংখ্যক আটব লােককে নাকি জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই কিছু সংখ্যক লােক কারা, তাদের নাম f৮ম কি, তা কিন্তু বেতার ঘােষণায় বলা হয়নি। সুতরাং আশঙ্কা হয়। শিয়ালের কুমীর ছানা প্রদর্শনের মন এই ক্ষমা প্রদর্শনের মহড়াটিও জঙ্গীচক্রের কোন নতুন শয়তানি অভিসন্ধির বহিঃপ্রকাশ কিনা। | এদিকে এইসব লােক দেখা ভড়ং, অন্যদিকে দখলীকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের বর্বরতা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এখনাে বাঙালী মেয়েদের ইজ্জত নাশ করা হচ্ছে এবং এক
একজন অশিক্ষিত সেপাইকে বাঙালী মেয়েদের বলপূর্বক পত্নী (উপপত্নী) হিসাবে গ্রহণে উৎসাহ জোগানাে হচ্ছে। দখলীকৃত এলাকায় চলছে গ্রামের পর গ্রাম লুণ্ঠন, হত্যা ও অগ্নৎসব। দখলীকৃত এলাকায় বাঙালীদের এই অবস্থা। বিদেশেও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করা হচ্ছে। ইয়াহিয়া-চক্র বুঝতে পেরেছে, তাদের বিদেশী দূতাবাসে যেসব বাঙালী কর্মচারী রয়েছে, তাদের কেউ আর পিণ্ডির খুনী চক্রের প্রতি অনুগত নয়। তারা স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের প্রতি আনুগত্য পােষণ করেন এবং সুযােগ পেলেই তা ঘােষণা করবেন। গত পাঁচ মাসে বহু বাঙালী কূটনীতিবিদ ও দূতাবাস কর্মচারী বাঙলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘােষণা করে বহির্বিশ্বে ইয়াহিয়া চক্রের মিথ্যা প্রচারণার বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন। শঙ্কিত ইয়াহিয়া-চক্র তাই অবশিষ্ট বাঙালী কর্মচারীদের আটকানাের জন্য তাদের পাসপাের্ট আটকের আদেশ দিয়েছেন। যদিও নির্দেশে বলা হয়েছে, এই আদেশ সকল দূতাবাস-কর্মচারীর বেলাতেই প্রযােজ্য, কিন্তু কাজের বেলায় বেছে বেছে যে কেবল বাঙালী কর্মচারীদের পাসপাের্টই আটক করা হচেছ, বিশ্ববাসীর সে খবর জানতেও আর দেরী হয়নি। | দেশে বিদেশে এই বাঙালী-নিধন ও বাঙালী-বিতাড়ন নীতি অব্যাহত রেখেও ইয়াহিয়া-চক্র ঢাকায় কেন এক বিশ্বাসঘাতক বাঙালীকে তাবেদার হিসাবে লাটের গদিতে বসিয়ে এই অসামরিক শাসনের ভং দেখাচ্ছে? এই প্রশ্নটির জবাব বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত ৫ই সেপ্টেম্বর রাত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তাঁর ভাষণ দিয়েছেন। প্রধান মন্ত্রী বলেছেন, “জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক গােষ্ঠী। বাংলাদেশে অসামরিক শাসন পূনঃ প্রবর্তনের ভাব সৃষ্টির একটা কৌশল অবলম্বন করেছে।” প্রধান মন্ত্রী আরাে বলেছেন, ইয়াহিয়া ঘৃণ্য চিক্কা খার স্থলে একজন অসামরিক সাক্ষী গােপালকে বসিয়েছেন এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন মুষ্টিমেয় হতাশ বাঙালীকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি করে জাতিসঙ্ েপাঠাবার চেষ্টা করছেন—এ সবই ওই একই কৌশলের অঙ্গ। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে সামরিক আইন, গণহত্যা ও দমন নীতি অব্যাহত রয়েছে, এই নগ্নসত্য গােপন করার চেষ্টা।” | কিন্তু পিণ্ডির খুনী চক্রের এই সত্য গােপন প্রচেষ্টা সফল হয়নি। তাই বাংলাদেশে একজন তাবেদার গভর্ণর নিয়ােগ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক পােষ্ট’ পত্রিকা স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, “বাংলাদেশে গভর্ণর হওয়ার কোন যােগ্যতা এই লােকটির নেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের একমাত্র অধিকার রয়েছে জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের। নেদারল্যাণ্ডের একজন প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য ডাঃ মালিককে বাংলার দখলীকৃত এলাকার গভর্ণর নিয়ােগ করা সম্পর্কে বলেছেন, ‘এটা ঔপনিবেশিক ধরণের নিয়ােগ।’ বস্তুতঃ ইয়াহিয়া-চক্র যতই চেষ্টা করুণ, বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করা তাদের চোখের ধূলাে নিক্ষেপের কোন চেষ্টাই সফল হবে না। বাংলাদেশের মানুষ আর ইয়াহিয়া-চক্রের দাসত্ব করবে না। বরং মুক্তিবাহিনী অস্ত্রের মুখেই ইয়াহিয়ার এই নবনাট্যাভিনয়ে সকল ভাড়ামীর অবসান ঘটাবে।
জয়বাংলা (১) এ ১: ১৯ | ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় কালাে দিবস
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়েছে যে, অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার তথাকথিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের যে আয়ােজন করেছিল। ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বাংলাদেশের বীর মুক্তি যােদ্ধারা তার উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। জঙ্গীশাহীর ‘স্বাধীনতা দিবসের প্রস্তুতি পর্বের সূচনায় বুধবার রাত থেকেই গেরিলা আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ঐ রাতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে বােমা বিস্ফোরনের ফলে ২০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
দালাল শান্তি বাহিনীর উদ্যোগে ঢাকার কুখ্যাত ও দাগী গুণ্ডাদের নিয়ে গঠিত মুষ্টিমেয় লােকের। একটি মিছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে ধ্বনী দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করার সময় যে সামান্য গুটিকতক দোকান পাট খােলা ছিল তাও বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকায় অবরুদ্ধ বাঙালীরা জঙ্গীদিবসে’ অংশ গ্রহণ না করে নীরব প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে এই দিবসকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মহড়া এই দিবসের কর্মসূচীর একটি উল্লেখযােগ্য অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আকৰ্মণে বিব্রত পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক কর্তারা এবারে ঢাকাবাসীকে তাদের শক্তির মহড়া দেখাতে সাহস করেনি।
‘জয়বাংলা (১) | ১ : ১৯ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
কঠোর শাস্তি পেতে হবে!
সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ। জানা গেছে, পাকিস্তানী পুলিশদের ছুটির আবেদনের কারণ যদি না টেকে। তবে কঠোর শাস্তি পেতে হবে ছুটি দরখাস্তকারীদের। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, পাকিস্তানী । পুলিশ ছুটি মঞ্জুর হওয়ার পর তারা পশ্চিম পাকিস্থানে পালিয়ে যায়। খবর পাওয়া গেছে, মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড মারে কিছুদিন আগে আগত এই সব পাঞ্জাবী পুলিশরা এরই মধ্যে পালাতে শুরু করেছে, কেন না এই সব পুলিশের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের যে ভাবে হােক বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বার বার চিঠি লিখছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই পাক সরকার এই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন এই কঠোর ব্যবস্থা দ্বারাও এদের আটকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কেন না মুক্তি। বাহিনীর ভয়ে এরা ভীত, সন্ত্রস্ত।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১ : ৬ ॥ ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে শতাধিক মানুষের মৃত্যুবরণ। বিশ্ব এগিয়ে না এলে অচিরেই লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে
বাংলাদেশের উপর দুর্ভিক্ষের কালাে ছায়া পতিত হয়েছে। এরি মধ্যে এর করাল গ্রাসে শতাধিক লােক শােচনীয় ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এই সমস্ত মৃত্যুর সংবাদ এসেছে ভােলা, পটুয়াখালী, নােয়াখালী এবং সন্দীপের বিগত ১২ই নভেম্বরের বন্যা দুর্গত এলাকা থেকে। সংবাদ পাওয়া গেছে বন্যা দুর্গত চরাঞ্চলে অসংখ্য মানুষ আজ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে। এর কারণ জানতে গিয়ে জানা । গেছে, এই সমস্ত দুর্গত এলাকায় বিদেশ থেকে আসা প্রচুর খাদ্যদ্রব্য বাংলাদেশে হানাদার বর্বর। ইয়াহিয়া বাহিনী গুদামজাত করে রেখেছে। এই সমস্ত রিলিফ সামগ্রী পাক সেনারা নিজেদের কাজে ব্যবহার করছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন; ইয়াহিয়া সরকারের বাঙ্গালী নিধনের এ আর এক নতুন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র । এ ছাড়া ময়মনসিংহ থেকেও মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। এই করুণ মৃত্যুর হাত । থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে অতি শীঘ্র বিশ্বকে এগিয়ে আসতে হবে। নচেৎ অচিরেই বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১; ৬ ! ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ফাঁকা মাঠে গােল!
ঢাকা, ৭ই সেপ্টেম্বর। সংবাদে প্রকাশ একটি সাময়িক ট্রাইবুনালে আওয়ামী লীগের ৭২ জন পার্লামেন্টারী সদস্যের অনুপস্থিতিতেই তাদের বিচার করা হচ্ছে। আর এক খবরে প্রকাশ এই সমস্ত সদস্যরা বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে বাংলার বুক থেকে হানাদারদের সমূলে ধ্বংস। করার কাজে নিয়ােজিত আছেন। এঁদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়ার বাহিনীকে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে মুক্তি বাহিনী।
| বিপ্লবী বাংলাদেশ ৪ ১ : ৬ ॥ ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের বন্যা দুর্গত এলাকায় কলেরার প্রাদুর্ভাব
১৬ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের বন্যাদুর্গত এলাকায় ভীষণ আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা। দিয়েছে। এরি মধ্যে দেড়শত লােকের প্রাণহানির সংবাদ পাওয়া গেছে। বর্বর ইয়াহিয়া সরকার এর প্রতিকারের কোনই ব্যবস্থা করেনি। এমন কি কলেরা ইনজেকশন পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না এই সমস্ত দুর্গত এলাকায়।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ! ১ : ৬ ! ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দখলীয় এলাকার পাকিস্তানী প্রশাসন অচল।
মুজিবনগর হতে বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেল যে—সদ্য আগত শরণার্থীরা বলেন—বেশ কিছু দিন আগে থেকেই পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে প্রচার করছিলেন যে খুব শীঘ্রই সামরিক শাসনের অবসান ঘটাবে। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং রংপুর থেকে যে সমস্ত খবর পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় যে ঐ সকল জেলার সরকারী অফিস, কাছারী এবং আদালতে শতকরা ২৫ জনের বেশী কর্মচারী কাজে যােগদান করেন নি। জনৈক শরণার্থী বলেন যে ফরিদপুর শহরের আদালতে একজন বিচারকও নেই—শুধু মাত্র দুইজন সামরিক অফিসার। আদালতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কাছে এখনও বিচারের জন্য কোন মামলা আসেনি। এ অবস্থায় টিক্কা খানের স্থলে ডাঃ মালিককে গভর্ণর করায় কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। রংপুরের সংবাদে জানা যায় যে এখানকার জজ ও মুন্সেফ পালিয়ে গেছেন। কয়েকজন অবাঙ্গালী অফিসার। নিয়ােগ করা হচ্ছে। কিন্তু লােকের আস্থা ফিরে আসছে না।
ঢাকায় প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ যে—সেখানকার অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটাবার তালে আছেন। মেয়ে ছেলেদের তারা পূর্বেই করাচীতে স্থানান্তর করেছেন। বাঙ্গালীরা কোন অবাঙ্গালী দোকানে যান না।
মুক্তবাংলা ॥ ১:১ # ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
উপনির্বাচনের নামে
ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র তাহাদের দালালদের বাংলাদেশের ৭৮টি জাতীয় পরিষদ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করাইয়া লওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাইতেছে। | নিউইয়র্ক টাইমস্ এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধি ম্যালকম, ডব্লিউ ব্রাউন গত ২রা নভেম্বর ঢাকা হইতে এই রিপাের্ট দিয়াছেন।
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় ইসলামাবাদ সরকারের নিযুক্ত গভর্নর ডাঃ মালিক এক। সাক্ষাৎকারে বলেন, এই উপনির্বাচনে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি থাকিবে সন্দেহ নেই। তবে ইহা একেবারে কিছু না হওয়ার চাইতে ভালাে ।
আওয়ামী লীগের সমমতাবলম্বী সকল রাজনীতিককে এই উপ নির্বাচনের বাইরে রাখা হইয়াছে। মিঃ ব্রাউন আরাে লিখেছেন যা সংবাদপত্রসমূহে সকল বিরােধী দলের বক্তব্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হইয়াছে।
ইসলামাবাদ সরকার তার তল্পিবাহক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডানপন্থী দলগুলিকে সমর্থন দিতেছে এবং এই সকল দলই ইচ্ছামতাে উপনির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করিতেছে।
| যাহাদের সদস্যপদ বাতিল করা হয় নাই জঙ্গীচক্র তাহাদের যথাসময়ে পরিষদে আসন গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হইতে আহ্বান জানাইয়াছে। অবশ্য ঢাকা হইতে প্রেরিত এই রিপাের্টে বলা হয় যে তাহাদের অধিকাংশই হয় আত্মগােপন করিয়া আছেন অথবা স্বদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ। করিয়াছেন।
বাংলার বাণী ৪ সংখ্যা | ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ঠ্যালা সামলাও
গত ৩১শে অক্টোবর ঢাকাস্থ নির্বাচনী কমিশনের অফিসের ভিতরে মুক্তিযােদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত বােমার আঘাতে একজন কর্মচারী নিহত এবং অপর একজন আহত হয়।
| এসােসিয়েটেড প্রেসের খবর অনুযায়ী গত ১লা নভেম্বর এই কথা প্রকাশ করিয়া ইসলামাবাদের সরকারী কর্তৃপক্ষ আরাে জানায় অন্ততঃ ১০ জন মুক্তিযােদ্ধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র ও গ্রেনেড লইয়া ঐ অফিসে হামলা করেন। রবিবার গভীর রাত্রিতে পরিচালিত স্বাধীনতাকামী বীর গেরিলাদের এই হামলায় বহু প্রয়ােজনীয় দলিলপত্রও বিনষ্ট হইয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে।।
অফিসটি পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা জোরদার করা হইয়াছে।
রবিবার রাত্রির এই প্রচন্ড বিস্ফোরণের ফলে নির্বাচনী অফিস তার স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ করিয়া। দেয় । ইসলামাবাদ কর্তৃপক্ষ ইহার বেশী আর কিছু অবশ্য প্রকাশ করে নাই।
বাংলার বাণী ॥ ৪ সংখ্যা # ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দুর্ভিক্ষের শুরুতেই ১৯১ জনের মৃত্যু
বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত। ১৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং শত শত মানুষ ক্রমাগত অনাহারে, অসুখে নিশ্চত মৃত্যুর মুখােমুখি এসে দাঁড়িয়েছে বলে আমাদের সংবাদদাতারা জানিয়েছেন।
বাংলার কথ? # ১ ৩ ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
তােদের বাধন যত শক্ত হবে …
দখলীকৃত বাংলাদেশের ক্রীড়নক গভর্ণর ডাঃ মালিকের পুতুল সরকারের আড়ালে পাকিস্তানী জঙ্গীচক্র বাঙালী শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর নতুন করে হামলা শুরু করেছে।
| এখানে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বার বার হুমকী দেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের। সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফাকা রয়েছে।
হানাদারচক্র ছাত্রদের শায়েস্তা করতে না পেরে বর্তমানে শিক্ষাবিদদের উপর খড়গহস্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইসলামিক ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রােফেসার এমিরেটাস ডাঃ এনামুল হক ও বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ডঃ মােহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ডঃ মনিরুজ্জামানের ওপর হুকুম জারী হয়েছে যে, আগামী ৬ মাস তিনি কোন সরকারী বা বেসরকারী চাকরীই করতে পারবেন না।
তাছাড়া রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপের জন্য ডঃ কুদরত-ই-খুদা, ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম ও উঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
| ইতিপূর্বে ডঃ আবুল খয়ের, জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব সহিদুল্লাহ, জনাব শাদউদ্দীন ও জনাব আশাবুল হক সহ বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষাবিদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। | এদিকে গত মাসের গােড়ার দিকে হানাদার সৈন্যরা মর্ণিং নিউজের চীফ রিপাের্টার জনাব শহিদুল হক, ঢাকা বেতারের বার্তা সম্পাদক জনাব সাইফুল বারী, এপিপির রিপাের্টার জনাব মােজাম্মেল হক ও পিপিআই এর রিপাের্টার জনাব নাজমূল হককে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তাদের আর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
সদর ঘাটের বুড়ীগঙ্গা তীরের চারিদিকে কাটা তারের বেড়ায় আটকানাে হয়েছে। ষ্টিমার, লঞ্চ বা অন্য কোন জলযানে যে সব যাত্রী ঢাকায় আসেন তাদের তল্লাসী করার জন্যই এই ব্যবস্থা।
জয়বাংলা (১) [১: ২০ | ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
চামচা মল্লিকের জনসভা
ইয়াহিয়ার পাদুকালেহী চামচা গভর্ণর আবদুল মােত্তালেব মল্লিক বড় শখ করে চুয়াডাঙ্গায় জনসভা করতে গিয়েছিল। গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছেন তাই ষ্টেডিয়ামে জনসভা করতে হবে। কয়েকদিন থেকে ঢাক-ঢােল পিটিয়ে সভার কথা ঘােষণা করা হলেও লােক হবে না বুঝতে পেরে সভার স্থান মল্লিকের বাড়ীতে করা হয় । জনশূন্য চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে দুশাে লােককে ধরে এনে সভায় শ্রোতার আসনে। বসিয়ে দেওয়া হয়। দু’শাে লােকের বিশাল মহতী জনসভা পাহারা দেওয়ার জন্য তিন শ’ সেনাবাহিনী নিয়ােগ করা হয় ।
দু’শাে যােগ তিন শ’ এই পাঁচ শ’ সাদা এবং খাকী পােষাক পরিহিতদের ‘মহতী জনসভায়’ চামচা। মালিক নাকি ‘উদ্দীপক’ ভাষণ দিয়েছেন।
জয়বাংলা (১) ১ : ২০ ॥ ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সুরমা নদীর তীরে খানদের দুর্দশা
সিলেট, ২৩শে সেপ্টেম্বর—সম্প্রতি মুক্তিবাহিনীর এক নৈশকালীন গ্রেনেড আক্রমণে সুরমা নদীর তীরবর্তী কদমতলা বাসষ্ট্যাণ্ডের সন্নিকটে কয়েকজন খান সেনা হতাহত হয় ।
পরদিন এই ঘটনার প্রতিশােধ নেবার জন্য পাকসেনারা সেখানকার প্রায় ২০০ জন লােককে মারধাের করে। এছাড়া বহুসংখ্যক নারীকে বিবস্ত্র করে বারংবার তাদের শ্লীলতা হানি করে।
বিভিন্নস্থানে খানসেনাদের হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযােগ
| জগন্নাথ থানা সদরে ব্যারিষ্টার আবদুল মতিনের বাড়িসহ খানসেনারা অসংখ্য বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে দেয় এবং বহু ব্যক্তিকে হত্যা করে। রসুলগঞ্জ এবং জকিগঞ্জ এলাকায় খানসেনারা ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ চালায়।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১ : ২ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
দাঁতের ডাক্তার মালেক এবং দুর্গোৎসব
ষ্টাফ রিপাের্টার)
মুজিবনগর, ২৪শে সেপ্টেম্বর—সম্প্রতি চট্টগ্রাম থেকে আগত এক বিশিষ্ট ব্যক্তি আমাদের সংবাদদাতাকে বলেন যে, দন্তরােগের চিকিৎসক এবং বর্তমানে বাংলাদেশের ইয়াহিয়ার অসামরিক গর্ণর ডাঃ মালিক বিভিন্ন স্থানে দুর্গোৎসব পালন করবার জন্য এক অভিনব পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। তিনি আরাে বলেন যে, গত বৎসর যাদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে দুর্গোৎসব হয়েছিল, পাক সৈন্যরা তাদের খুঁজে বার করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশতঃ তাদের অধিকাংশই হয় নিহত, নয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন।
এই মতলব হাসিল করার উদ্দেশ্য মালিক সরকার জেলে আটক কোন কোন হিন্দুকে অন্ততঃ এই পূজার সময়ের জন্য মুক্তি দিয়েছেন। অবশ্য, শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার পুলিশ ও অন্যান্য তাবেদাররা তাদের ওপর কড়া নজর রাখছেন।
স্থানীয় জনগণ মনে করেছেন যে, নিশ্চয়ই এসব পূজানুষ্ঠানের আলােক চিত্র গৃহীত হবে এবং তা সংবাদ পত্রে প্রকাশ ও দেশে বিদেশে প্রচার করে বােঝান হবে যে, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে, এমন কি সংখ্যালঘুদের অবাধে দুর্গোৎসব করতে ও দেওয়া হচ্ছে।
সাপ্তাহিক বাংলা # ১: ২ | ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাঙলাদেশে মা এসেছেন আনন্দময়ী রূপে নয়, রুদ্রাণী রূপে
ষ্টাফ রির্পোটার)
স্মরণকালের ইতিহাসে এমন ঘটনা কখনাে ঘটেনি। বাঙলাদেশে সােনার ধান, শ্যামল ঘাসের মাথায় শিশিরের ঝালর, পাতায় পাতায় বিচিত্র বর্ণের ফুলের সমারােহ, নীল আকাশের গায়ে রাজহাঁসের ঝাকের মত মেঘ নিয়ে শরৎ এসেছে, অথচ মা আসেন নি।
এবার কিন্তু তাই হােল। বাঙলাদেশের কোথাও দুর্গাপূজা হচ্ছে না। মন্দিরগুলাে বুকের মধ্যে এক দারুণ শূন্যতা নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যে অনুষ্ঠানে বাঙালীর জীবনে আনন্দের বান ডেকে যেত, সেখানে আজ হাহাকার কান্নায় শ্মশানের ছায়া মূর্ত হয়ে উঠেছে, সেখানে আনন্দময়ীর স্থান কোথায়? আনন্দময়ীর স্থান নেই, সে কথা ঠিক। কিন্তু দুর্গতি নাশিনী দুর্গার? তিনিও কি আসবেন না?
কী করে নতুন করে আসবেন? তিনি তাে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অকালবােধনে অনেক আগেই হানাদার দানবদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য বাংলার মাটিতে পা রেখেছেন, দৈনন্দিন অগণিত লুঠেরা বগীর ধরাশায়ী হওয়ার খবর বয়ে আনছে তারই আভাস। | সুতরাং এবার বাঙলা দেশে মায়ের আবির্ভাব আনন্দময়ী রূপে নয়—অসুর সংহারকারিনী। রুদ্রানীরূপে আকৃতিতে আসেন নি, এসেছেন প্রকৃতিতে ধর্ম, কর্ম ও সত্যে।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ২ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় বােমা বিস্ফোরণ ইয়াহিয়ার নুরুল হুদা খতম
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
ঢাকা ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর হাতে জঙ্গীশাহীর সমর্থক ও দালাল মুসলিম লীগ নেতা নুরুল হুদা খতম হয়েছে। নুরুল হুদা বাংলাদেশ আইন সভার প্রাক্তন মুসলিম লীগ সদস্য। তার নিজ গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের মেসিনগানের গুলিতে এই শান্তি কমিটির বড় দালাল এন্তেকাল ফরমাইয়াছে।
| ইয়াহিয়ার নবনিযুক্ত দালাল স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন মন্ত্রী মৌলানা মহম্মদ ইসাক আজ ঢাকায় নিজ মটরে একটি টাইম বােমা বিস্ফোরণে গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।
| একটি সভা থেকে ফেরবার পথে এই বিস্ফোরণ ঘটে বলে জানা যায়। আহত অবস্থায় মােটরের চালক এবং ইসাককে ঢাকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ২৫ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি বন্দী
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিভিন্ন শহরে আবার নতুন করে শিক্ষক, শিল্পী, আইনজীবী সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার করার সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। | সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ জন শিক্ষকসহ কয়েকজন শিল্পী ও আইনজীবী বন্দী হইয়াছেন। গ্রেফতারকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে জনাব আবুল খায়ের, জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব শহীদুল্লা, সুরকার জনাব আলতাফ মাহমুদ এবং ঢাকা বেতারের নাট্যকার জনাব আলী মনসুর ও রয়েছেন।
এ ছাড়া বরিশালের বিশিষ্ট আইনজীবী জনাব আবদুস সাত্তার হাওলাদারকেও বন্দী করা হয়। বলা হয় যে, এই সব গ্রেফতারের পর গ্রেফতারকৃতদের আর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
সাপ্তাহিক বাংলা #১: ২ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সাবাস!
মন্ত্রীর এক হাত ও এক পা। রৌমারী ॥ ২৪শে সেপ্টেম্বর
| স্বাধীন বাংলা বেতার পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ বাংলার অধিকৃত অঞ্চল খুনি ইয়াহিয়ার মনােনীত মন্ত্রীসভার সদস্য মৌলানা মহমন্দ ইসাকের মটর গাড়ীতে আমাদের দূর্বার গেরিলাগণ টাইম বােমা গােপনে রেখেছিলেন এই বােমা বিস্ফোরণের ফলে নব মনােনীত মন্ত্রী সাহেবের এক হাত ও এক পা ওফাত বরন করেছে। ঢাকা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে বঙ্গবৈরী মন্ত্রী সাহেব তার কৃতকর্মের ফলাফলের যােগ বিয়ােগ করছেন আর বাকী মন্ত্রী সাহেবরা তাে এখন কি করি কি করি’ করে অস্থির হয়ে উঠেছেন।
অগ্রদূত ! ১ : ৫ ( ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
কি বিষয়?
গত শুক্রবার রাত্রিতে ঢাকায় ব্লক আউটের মহড়া দেওয়া হয়েছে বলিয়া রেডিও পাকিস্তানের এক খবরে জানা গিয়াছে। ব্লাক আউট ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেওয়া হইবে বলিয়াও রেডিওতে সাবধান করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
| বাংলার বাণী ॥ ৫ সংখ্যা ! ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ডাহা মিথ্যা (বিশেষ প্রতিনিধি)
| স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলার জনমনে কি দাবি সৃষ্টি এবং তাহাকে ও তাঁহার পরিবার বর্গকে লােক চক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র একটার পর একটা চক্রান্ত করিয়া চলিয়াছে।। | ইসলামাবাদ চক্রের রাজনৈতিক জারজ সন্তান হামিদুল হক চৌধুরীর পাকিস্তান অবজার্ভার সম্প্রতি | এই মর্মে একটি খবর পরিবেশন করিয়াছে যে, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বেগম শেখ মুজিবর রহমান নাকি বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার গভর্ণর গাদ্দার ডাঃ মালিকের বাসভবনে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। এই সংবাদটি পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করিয়া প্রকাশ করিয়াছে। কিন্তু আসলে খবরটি একটি গাজা। | উল্লেখযােগ্য যে ২৫শে মার্চ রাত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে ইসলামবাদের হানাদার বাহিনীর ট্যাঙ্ক মেশিনগানের গােলাগুলির মুখে গ্রেপ্তারের সময় হইতে তাঁহার সহধর্মিনী বেগম মুজিব | এবং তাহার কন্যা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে গ্রেফতার করিয়া অন্য একটি বাড়িতে অন্তরীণবদ্ধ
অবস্থায় রাখা হয়। নিজ আত্মীয়-স্বজনের সহিতও দেখা করিবার জন্য তাহাদিগকে কোন সুযােগ | দেওয়া হয় না। | সম্প্রতি কড়া সামরিক প্রহরায় তাহাদিগকে ডাঃ মালিকের বাড়ীতে লইয়া যাওয়া হয়। ঢাকা হইতে | বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া খবরে জানা যায়, সামরিক বাহিনীর লােকেরা বেগম শেখ মুজিবকে কোথায় লইয়া যাইতেছে গাদ্দার ডাঃ মালিকের বাসভবনে পৌছিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কিছুই জানিতেছেন না। কি
উদ্দেশ্যেই বা তাহাকে গভর্ণরের বাসভবনে লইয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছিল তাহা সকলেই বুঝিতে পারিয়াছেন। | বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খাইয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুয়ারে আপােসের | আবেদন লইয়া ইয়াহিয়াচক্রের ধর্না দেওয়ার পটভূমিকায় বেগম শেখ মুজিবকে গভর্ণর ভবনে লইয়া | গিয়া গাদ্দার ডাঃ মালিকের সহিত সাক্ষাৎ করানাের অন্তরালে বঙ্গবন্ধু এবং তাহার সুযােগ্যা পত্নীকে
হেয় প্রতিপন্ন করার দুরভিসন্ধিই নিহিত ছিল। আর অবজার্ভার পত্রিকা উহাকেই ফলাও করিয়া পরিবেশনের মাধ্যমে উহার প্রভু হামিদুল হক চৌধুরীর দালালী ব্যবসায়টিকে পাকা পােক্ত করিয়াছে
| আসলে দেশ বিদেশের গণমনে বিভ্রান্ত সৃষ্টির জন্যই কসাই বাহিনী বেগম মুজিবকে কড়া প্রহরাধীনে গাদ্দার মালিকের ‘গােলামের আস্তানায়’ লইয়া যায়। বেগম মুজিব ইচ্ছা করিয়া গাদ্দার মালিকের সঙ্গে দেখা করিতে যাইবেন এমন কথা ইয়াহিয়ার পয়সার কেনা কুত্তার বাচ্চার দল ছাড়া আর কেহই বিশ্বাস করিবেনা। কারণ, এই সেদিন বেগম মুজিবই অন্য বাড়ী হইতে ধানমন্ডির নিজের | বাড়ীতে গিয়া অন্তরীনাবদ্ধ থাকার জল্লাদী প্রস্তাব ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করিয়া দিয়াছেন।
| বাংলার বাণী ৫ সংখ্যা ৪ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
অধিকৃত এলাকায় বুদ্ধিজীবীদের উপর দমন নীতি অব্যাহত
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
দখলীকৃত এলাকার অসামরিক গভর্ণর ডাঃ মালেকের সরকারকে শিখণ্ডী খাড়া করিয়া বর্বর | জঙ্গীশাহী সরকার বাঙালী শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর অব্যাহতভাবে দমননীতি | চালাইয়া যাইতেছে।
সম্প্রতি জল্লাদী বর্বরতার শিকার হইয়াছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইসলামের ইতিহাসের অধ্যক্ষ ডঃ হাবিবুল্লা, বাঙলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মনিরুজ্জামান ও ইমিরিটাস | অধ্যাপক ডাঃ মুহম্মদ এনামুল হক। তাহাদিগকে চাকুরী হইতে বরখাস্ত করা হইয়াছে। উঃ মনিরুজ্জামান আগামী ছয় মাস কোন সরকারী বা বেসরকারী চাকুরী করিতে পারিবেন না বলিয়া হুকুম জারী হইয়াছে। | ইহা ছাড়া রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকিবার অভিযােগে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডঃ কুদরত-ইখুদা, ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম ও ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে হুঁশিয়ার করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
ইতিপূর্বে ডঃ আবুল খায়ের, জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব শহীদুল্লাহ প্রমুখ বিশিষ্ট অধ্যাপক ও কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। | অন্য এক সংবাদে প্রকাশ, বেশ কিছুদিন পূর্বে জসীশাহীর বর্বর সৈন্যরা মর্নিং নিউজের চীফ রিপাের্টার জনাব শহীদুল হক, ঢাকা বেতারের সাইফুল বারি এ, পি, পি’র জনাব মােজাম্মেল হক ও পি,পি,আই, এর নাজমুল হক সহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে ধরিয়া লইয়া যায়। পরে তাঁহাদের কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই। | সামরিক সরকার বাঙালী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিশ্বাস করিতে না পারিয়া পশ্চিম পাকিস্তান। হইতে অবাঙ্গালী চীফ সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ ও চীফ সেক্রেটারী আমদানী করিয়াছে।
বাংলার বাণী ॥ ৫ সংখ্যা ॥ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কি দেখিলাম—
॥ নিজস্ব প্রতিনিধি ॥
| অতি সম্প্রতি ‘বাংলার বাণীর একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। সফর করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তারই অংশ বিশেষ এখানে ছাপা হইল। | তরুণ গেরিলাদের অত্যাচার ও উৎপীড়ন আরাে তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। বিশ্বের সেরা সৈনিকরা মুক্তিযােদ্ধাদের সহিত সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হইবার পরিবর্তে সাধারণ গ্রামবাসীর উপর চরমতম নিগ্রহ চালাইয়া তাহাদের দুর্বলতা ঢাকিবার চেষ্টা করিতেছে। ভীত সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের তাহারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করিতেছে। বিশেষ করিয়া মুক্তিযােদ্ধরা যে জায়গায় একবার খান সেনাদের উপর হামলা করিয়া গিয়াছে তাহার আশেপাশে সাধারণ মানুষের উপর হানাদাররা বর্বর নির্যাতন চালাইতেছে। অতি সম্প্রতি গাইবান্ধার রসুলপুরের সুইস গেটের নিকটবর্তী ফুলছড়ির বাঁধের উপর মানাস নামক জায়গার একটি পুল গেরিলা যােদ্ধারা রাত্রিকালে আক্রমণ করিয়া রাজাকার ও পাকসেনাদের একটি ছােট পাহারা ঘাঁটি বিধ্বস্ত করিয়াছেন এবং পুলটির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। মানাশের নিকটবর্তী কামারজানী ও গাইবান্ধাতে পাকসেনাদের দুই বিরাট শক্ত ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ চলাকালে তাহারা আক্রমণস্থলে আসতে সাহস পায় নাই। পরদিন সকালে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একদল বর্বর সৈন্য ঘটনাস্থলে আসিয়া ৩/৪ মাইল এলাকা জুড়িয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালাইয়া প্রায় ১০০ লােক হত্যা করে। রাজাকার ও স্থানীয় অবাঙালীরা পরে তাহাদের সহিত মিলিত হইয়া মানাশ ও রসুলপুর এলাকা তছনছ করিয়া
| অনুরূপভাবে গেরিলারা রেডিও পাকিস্তান রংপুরের উপর আক্রমণ চালাইলে পাহারারত পঞ্চাশজনেরও অধিক পাকসেনা আত্মগােপন করে এবং তাহাদের অনেকে আহত হয়। রেডিও ষ্টেশন হইতে মাত্র হাফ কিলােমিটার দূরে পাক সরকারের সিভিল আর্ম ফোর্সের সেক্টর অফিস এবং মাত্র এক কিলােমিটার দূরে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থাকা সত্ত্বেও তাহারা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি পাল্টা আক্রমণ করিবার জন্য কেহই বাহির হয় নাই। এখানে অর্ধঘন্টা ব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিযােদ্ধারা রেডিও ষ্টেশনের বেশ ক্ষতিসাধন করে। পরদিন সকালে যথারীতি “বিশ্বের সেরা সৈনিকেরা” রেডিও ষ্টেশনের সংলগ্ন এলাকা ছাড়াও প্রায় পাঁচ মাইল পর্যন্ত ব্যাপক অভিযান চালাইয়া বহু ঘর বাড়ি জ্বালাইয়া দেয় ও বহু | নিরপরাধ গ্রামবাসী ও ৩৮ জন তরুণীকে ধরিয়া নিয়া যায় । তাহাদের ভাগ্যে কি হইয়াছে তাহা জানা। যায় নাই। | একইদিনে তাহারা উক্ত রেডিও ষ্টেশনের প্রােগ্রাম অরগানাইজার জনাব মহিউদ্দিন হায়দার, ড্রাইভার তারামিয়া ও কয়েকজন টেকনিশিয়ানকে রংপুরের দ্বিতীয় সামরিক শিবির মডেল স্কুলের নিকট দম দম পুলের নিকট অতি নৃশংসভাবে হত্যা করে। | পাকবাহিনীর হিংস্রতা যেভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে তাহাতে তাহাদের দুর্বলতাই প্রকাশ পাইতেছে। দেশবাসীকে আতঙ্ক ও ভীস্থ করিয়া তাহারা “স্বাভাবিক অবস্থা” ফিরাইয়া আনিতে | চাহিতেছে। কারণ তাহারা বুঝিতে পারিয়াছে এদেশে তাহাদের আয়ু ফুরাইয়াছে।
বাংলার বাণী ॥ ৫ সংখ্যা ৪ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ঝড়
৩০শে সেপ্টেম্বর।গত রাত্রে বরিশাল, খুলনা ও পটুয়াখালী জেলার উপর দিয়া প্রবল ঝড়। বহিয়া গিয়াছে। ইহাতে প্রাণহানি সহ বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হইতেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ জানা সম্ভব হয় নাই।
মুক্তিযুদ্ধ | ১: ১৩ [! ৩ অক্টোবর ১৯৭১
মারকিন জাহাজ আক্রমণের কথা স্বীকার
ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর-পাকিস্তান সরকারের জনৈক মুখপাত্র বলেন যে, পূর্ববঙ্গের জন্য খাদ্যশস্য নিয়ে আসা একটি মারকিন জাহাজ গতকাল চালনা বন্দরে ডিনামাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়।
মুখপাত্রের বক্তব্যঃ ভারতীয় এজেন্টরা ওই জাহাজের উপর আক্রমণ চালায়। পাক সামরিকচক্র বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধার পরিবর্তে সব সময় ওই বিশেষণটি ব্যবহার করে। -ইউ এন আই
বাংলাদেশ (১) ৪১: ১৫ ॥ ৪ অক্টোবর ১৯৭১
পাক বন্দরগুলির বিপন্নের কথা বেতার স্বীকৃতি
২৫শে সেপ্টেম্বর : পূর্ববঙ্গের বন্দরগুলাে যে আক্রান্ত হয়েছে গতকাল পাক বেতার প্রথম তা । স্বীকার করে।
ঢাকাস্থ একজন সরকারী মুখপাত্রের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বেতারে বলা হয় যে, খাদ্যশস্যবাহী একটি। বিদেশী জাহাজ ভাসমান মাইনে ঘায়েল হয়েছে ।
অবশ্য এই মুখপাত্র গতানুগতিক ধারায় এই আক্রমণের দায় “ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের কাধে। চাপিয়েছেন। মুক্তি বাহিনীকে তারা এখন এই নামে অভিহিত করছেন।
বাংলাদেশ (১) #১: ১৫ ॥ ৪ অক্টোবর ১৯৭১।
জঙ্গীশাহীর রাজকোষ শূন্য আর তাই
রাজনৈতিক সংবাদদাতা
ইসলামাবাদে জঙ্গীশাহীর ট্র্যাক যে সত্য সত্যই খালি হইয়া পড়িয়াছে, দিন দিনই ইহার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। ট্যাকে ভাটা পড়ার দরুন বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় সরকারী কর্মচারীদের বিভিন্ন ধরনের ভাতা পরিশােধ ইতিমধ্যেই বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। বর্তমানে জঙ্গীচক্র সরকারী। কর্মচারীদের নিয়মিত বেতনও দিতে পারিতেছে না।
ঢাকা হইতে প্রাপ্ত জনৈক সরকারী কর্মচারীর চিঠি হইতে জানা যায় যে সরকারী কর্মচারীদের বেতন দানের ব্যাপারে জঙ্গীচক্র এক বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করিয়া চলিয়াছে। এই নীতি অনুযায়ী। সামরিক কর্তৃপক্ষের একান্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত কর্মচারীগণকে মাসের শেষে পুরা বেতন দান করা হয় । আর যাহাদের উপর সামরিক কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস বা আস্থা নাই তাহাদিগকে বেতন দানের ব্যাপারে নানারকম উপায়ে হয়রানি করা হইয়া থাকে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মচারী বিশেষকে মূলবেতনের
শতকরা মাত্র ৫০ ভাগ পরিশােধ করা হয়। ইহা ছাড়া কোন কোন সরকারী দফতরের কর্মচারীর কয়েক মাসের বেতন ও বাকী পড়িয়া রহিয়াছে। গত ৪ মাস যাবত একটানাভাবে বেতন বাকী পড়ার পর। জনৈক সরকারী কর্মচারী সম্প্রতি চাকুরী ত্যাগ করিয়া মুজিব নগরে চলিয়া আসিয়াছেন। বলাবাহুল্য যে, কেবল বাঙ্গালী কর্মচারীদের বেলায়ই বেতন বাকী কিংবা অদেয় থাকে। ইসলামাবাদ হইতে | আমদানীকৃত কর্মচারীদের বেতন নিয়মিতই পরিশােধ করা হইয়া থাকে।
| ঢাকা হইতে মুজিবনগরে প্রাপ্ত জনৈক সরকারী কর্মচারীর পত্র হইতে আরও জানা যায় যে, | জঙ্গীচক্র বাঙ্গালী কর্মচারীদের পুরা বেতন কিংবা নিয়মিত বেতন না দেওয়ার অজুহাত হিসাবে বলিয়া থাকে যে, গােলযােগপূর্ণ পরিস্থিতিতে অফিস আদালতে পূর্বের মত স্বাভাবিক কাজকর্ম নাই । তাহা ছাড়া প্রায়ই কর্মচারীগণ অফিস কামাই দিয়া থাকে। অতএব, তাহারা পুরা মাহিনা দাবী করিতে পারে।
| পুরা বেতন না দেওয়ার কারণ হিসাবে জঙ্গীচক্র বাঙ্গালী কর্মচারীগণকে “দেশের স্বার্থের খাতিরে। এই জররী পরিস্থিতিতে ত্যাগ স্বীকারের উপদেশ বর্ষণ করিয়া থাকে। প্রসঙ্গ” আত্মীয় স্বজন ফেলিয়া দূরদেশে জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকির মুখে কাজ করিয়া যাইতেছে। কাজেই তাহাদিগকে পুরা বেতন দিতে হইবে।
| শুধু তাহাই নহে, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার বড় সরকারী কর্মচারীদের বেতন হইতে ৬৫ সালের যুদ্ধ তহবিলের নামে চঁাদা কাটিয়া রাখা হয় বলিয়াও জানা যায় ।
| যে সকল বাঙ্গালী কর্মচারী পুরা বেতন দাবী করিয়া থাকে তাহাদিগকে দেশদ্রোহী হিসাবে। | আখ্যায়িত করার হুমকী প্রদান করা হইয়া থাকে। তাহাদিগকে আরও বলা হইয়া থাকে যে, পুরাতন | বেতন চাহিলে তাহাদিগকে ইসলামাবাদে বদলী করা হইবে।
প্রকাশ গাদ্দার মালিক গভর্ণর নিযুক্ত হওয়ার পর কতিপয় বাঙ্গালী কর্মচারী তাহার নিকট পুরা। বেতন চাহিয়া একটি স্মারক লিপি পেশ করে। গাদ্দার মালিক উহার কোন জবাব দিতে পারে নাই।
আরও জানা যায় যে, দখলীকৃত এলাকায় নিযুক্ত বিশেষ করিয়া ঢাকায় রিজার্ভ হিসাবে রক্ষিত খানসেনাদের অনেককেই জঙ্গীশাহী বেতন দিতে পারিতেছে না। এই সকল খানসেনা শহরের বিভিন্ন হােটেল রেস্তোরায় খানা-পিনা করিয়া বিল না দিয়াই চলিয়া যায় ।
টাকা আদায়ের জন্য খান সেনারা সম্প্রতি একটি জঘন্য ফন্দি ও আবিস্কার করিয়াছে। ইহারা। কোন কোন বাঙ্গালী ব্যবসায়ী কিংবা বড় সরকারী কর্মচারীকে আকস্মিকভাবে ধরিয়া লইয়া গিয়া আটক করিয়া রাখে।
অতঃপর ইহাদের অবাঙ্গালী দালাল কিংবা মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর দালালদের দিয়া আটক ব্যক্তিদের আত্মীয় স্বজনের নিকট খবর দেয় যে, মােটা টাকা দিলে আটক ব্যক্তিকে ছাড়িয়া দেওয়া হইবে। এভাবে টাকা আদায় করিয়া অনেকক্ষেত্রে ধৃত ব্যক্তিকে ছাড়িয়া ও দেওয়া হইয়া থাকে বলিয়া জানা যায় ।
| ঢাকা হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়াছে যে, সম্প্রতি ঢাকার কোন একটি ব্যাঙ্কের বাঙ্গালী কর্মচারীকে সামরিক বাহিনীর কতিপয় অফিসার ধরিয়া লইয়া যায়। পরে উক্ত অফিসারের আত্মীয় স্বজনের কাছে দালাল পাঠাইয়া জানায় যে, মােটা অর্থ দিলে তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইবে। উক্ত অফিসারটি এখনও আটক অবস্থায় রহিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। উক্ত হতভাগ্য অফিসারের আত্মীয় স্বজনেরা মােটা অর্থও দিতে পারে নাই, তাই তাহাকেও ছাড়াইয়া আনিতে পারিতেছে না।
বাংলার বাণী ॥ ৬ সংখ্যা ৫ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা খণ্ডবিখণ্ড করার পরিকল্পনা। | জল্লাদী ষড়যন্ত্রের আরেক অধ্যায়।
রাজনৈতিক সংবাদদাতা
পৃথিবীর সবদেশে সবকালে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদীদের চরিত্র-চেহারা একই রূপে বীভৎস নগ্নতায় আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকে। আর সম্ভবতঃ সেই কারণেই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা যে “ডিভাইড এণ্ড রুল পলিসি’ খাটাইয়া ভারতবর্ষকে পদানত রাখার চেষ্টা করিয়াছিল, পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদের শেষ প্রতিভূ জল্লাদ ইয়াহিয়া খানও দুইশত বছর পরে বাংগালীদের উপর ঔপনিবেশিক শাসনও শােষণ অব্যাহত রাখার জন্য সেই একই বিভেদ নীতি অনুরসণের পথ বাছিয়া লইয়াছে। ইয়াহিয়া খান যে শাসনতন্ত্রটি চাপাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছে, উহাতে এই বিভেদ নীতিরই প্রতিফলন ঘটিয়াছে। ‘পাকিস্তান টাইমস্’ পত্রিকায় ইয়াহিয়ার সংবিধানের একটি খসড়া প্রকাশ করা হইয়াছে। এই খসড়ায় বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলকে তিনটি পৃথক প্রদেশে পরিণত করার পরিকল্পনা সন্নিবেশিত হইয়াছে। ইহাছাড়া হিন্দুদের ভােটাধিকারও হরণ করা হইয়াছে।
কিছুদিন পূর্বে জঙ্গীশাহী সংবিধান রচনার জন্য একটি কমিটি নিয়ােগ করিয়াছিল। এই কমিটি উপরােক্ত সুপারিশ করিয়াছে বলিয়া প্রকাশ। ইয়াহিয়া আগামী মাসে সরকারীভাবে উক্ত সংবিধানটি প্রকাশ করিবে। | একটি কূটনৈতিক সূত্রের মারফৎ জানা যায় যে রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম—এই তিনটি বিভাগ লইয়া একটি পৃথক প্রদেশ গঠিত হইবে এবং সেখানে তিনটি পৃথক আইন সভাও থাকিবে। | পাক জঙ্গী সরকার কর্তক হিন্দুদের ভােটাধিকার কাড়িয়া লওয়া সম্পর্কে উক্ত খসড়ায় বলা হয় যে বাংলাদেশের হিন্দুদের সহযােগীতায় আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভাঙিয়া দেওয়ার চক্রান্ত করিয়াছিল—সুতরাং তাহাদের ভােটাধিকার থাকা উচিৎ নয় ।
| আওয়ামী লীগের নামে বা বেনামে কোন ব্যক্তি বা দল কোনদিন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে পারিবে না। খসড়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে প্রচুর ক্ষমতা দানের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। বলা হইয়াছে। যখনই প্রয়ােজন বােধ হইতে তখনই সামরিক শাসন জারী করা হইবে । গভর্ণরগণ মন্ত্রী নিয়ােগ করিবে এবং প্রদেশগুলির শাসন ক্ষমতা গভর্ণরের উপর ন্যস্ত থাকিবে। গভর্ণর সামরিক বা বেসামরিক হইতে পরিবে। উক্ত খসড়াতে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলে আরবি হরফ চালু করিবার সুপারিশ করা হইয়াছে। জানা গিয়াছে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান টাইমস্ পত্রিকার কুখ্যাত সম্পাদক আজন্ম দালাল সুলেরী খসড়াটি সমর্থন করিয়া কয়েকটি নিবন্ধ প্রকাশ করিয়াছে।
বাংলার বাণী # ৬ সংখ্যা ॥ ৫ অক্টোবর ১৯৭১
আবারও? (নিজস্ব প্রতিনিধি)
| ৫২’র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে ছাত্রহত্যা নূরুল আমিন আবার ২০ বৎসর পূর্বকার সেই ষড়যন্ত্র পাকাইয়া তুলিবার অপচেষ্টায় মাতিয়া উঠিয়াছে। সম্প্রতি সে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় উর্দু শিক্ষা বাধ্যতামূলক করিবার সােপারিশ করিয়াছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা বৈষম্য দূর করিবার জন্যই নূরুল আমিন এই প্রস্তাব দিয়াছে ।
পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি’ নূরুল আমিনের এই সােপারিশকে স্বাগত জানাইয়াছে। তাহারা ইয়াহিয়ার কাছে নূরুল আমিনের এই সােপারিশকে অবিলম্বে কার্যকরী করিবার
জন্য সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করিয়াছে। তাহারা জানাইয়াছে যে বিগত দিনে এই সমস্যাটির সমাধান করিবার মত রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল না—এইবার এই সুযােগে’ এই প্রস্তাবটি কার্যকরী করা প্রেসিডেন্টের উচিৎ।
বাংলার বাণী ! ৬ সংখ্য! # ৫ অক্টোবর ১৯৭১
এবার নিয়াজির বিদায়ের পালা
(রাজনৈতিক সংবাদদাতা)
ঢাকা হইতে অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার সামরিক শাসন পরিচালক লেঃ জেনারেল নিয়াজীর সামরিক শাসন পরিচালকের চাকুরীর মেয়াদের পরিসমাপ্তি ঘনাইয়া আসিয়াছে। পিণ্ডি-ইসলামাবাদের সামরিক চক্র নিয়াজীর উপর খুব সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই। নিয়াজী অন্ততঃ দখলীকৃত এলাকার পরিস্থিতি কিছুটা আয়ত্বে আনিতে সক্ষম হইবে এই আশায় এবং টিক্কা খানকে যে কোন প্রকারে অপসারণ করিতে হইবে এই উদ্দেশ্য লইয়া নিয়াজীকে বাংলাদেশের সামরিক শাসন পরিচালক নিযুক্ত করা হইয়াছিল। কিন্তু নিয়াজী পরিস্থিতির উন্নতি করিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়াছে। বাংলাদেশে মুক্তি যােদ্ধাদের তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছে এবং ইসলামাবাদের ভাড়াটিয়া সৈন্যদের প্রাণ হানির সংখ্যা দিন দিনই বাড়িয়া চলিয়াছে। তদুপরি খােদ ঢাকা শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধি এবং খুলনা, চালনা, চট্টগ্রাম ও মঙ্গলায় ইসলামাবাদের কতিপয় অস্ত্র বােঝাই জাহাজ মুক্তিযােদ্ধারা ডুবাইয়া দেওয়ায় কিংবা ক্ষতি সাধন করায়। ইসলামাবাদের সামরিক চক্র নিয়াজীর উপর হইতে আস্থা হারাইয়া ফেলিয়াছে। | এদিকে টিক্কা খান পিণ্ডির সামরিক ছাউনিতে বসিয়াও ইয়াহিয়া চক্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে চক্রান্ত পাকাইয়া চলিয়াছে। টিক্কা খানকে ইয়াহিয়া চক্র অবাঞ্ছিত ভাবে সরাইয়া দিয়া যে অপমান করিয়াছে উহারই প্রতিশােধ গ্রহণের প্রতিহিংসা লইয়া টিক্কা খান এক সূক্ষ্ম চাল চালিতেছে। নিয়াজীকেও সরাইয়া দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়াচক্রের গােপন প্রস্তুতি উহারই একটি অংশ বলিয়া ওয়াকিবহাল মহল মনে করিতেছেন। ইয়াহিয়ার কাছে একে একে সকলকেই বিরাগভাজন করিয়া তাহাদের ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ করিয়া তােলাকেই টিক্কা চক্র তাহার কার্য সিদ্ধির মােক্ষম উপায় বলিয়া মনে করিতেছে। তাই রাওয়ালপিণ্ডির ছাউনীতে বসিয়া টিক্কাচক্র ইয়াহিয়া খানকে দিয়াই নিয়াজিকেও নাজেহাল করাইয়া তাহাকে দলে ভিড়াইবার ফন্দি আঁটিয়াছে।
অপর দিকে, দখলীকৃত এলাকা হইতে টিক্কা খানকে সরাইয়া দেওয়া হইলেও তাহার কতিপয় বিশ্বস্ত ও অনুগত সামরিক অফিসার ঢাকায় রহিয়া গিয়াছে। ইহারা নিয়াজীর বিরুদ্ধে গােপনে ‘পিণ্ডির দরবারে সূযােগ পাইলেই অভিযােগ করিয়া বসে। তাহার অযােগ্যতা, অদক্ষতা এবং ভীরুতা সম্পর্কে বহু অভিযােগ পিণ্ডির প্রধান সামরিক ছাউনীতে প্রেরণ করিয়া নিয়াজীর বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া চক্রের মন বিষাইয়া তােলা হইয়াছে। তাই ইয়াহিয়া চক্র এখন নিয়াজীকে ঢাকা হইতে সরাইয়া লইয়া যাওয়ার বিষয় চিন্তা করিতেছে। আগামী দুই এক সপ্তাহের মধ্যেই তাহাকে সরাইয়া লইয়া যাওয়া হইবে বলিয়া ঢাকায় কানাঘুষা চলিতেছে।
অবশ্য তাহার স্থলে অতঃপর কাহাকে পাঠানাে হইবে এখনও ঠিক করা হয় নাই। তবে ইয়াহিয়া চক্রের বিশ্বাসভাজনদের মধ্য হইতেই কাহাকেও বাছাই করার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করা হইতেছে।
কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতার মুখে অবশ্যম্ভাবী পরাজয় বরণের জন্য কেহই। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় সামরিক শাসন পরিচালক হইয়া আসিতে ভরসা করিতে পারিতেছে। । কারণ, তাহাদের মতে বাংলাদেশের ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতিতে কোন জেনারেলের পক্ষে এমন
| কি খােদ ইয়াহিয়া খানের পক্ষেও নিজের যােগ্যতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করা সম্ভব নয়। বরং যে কেহই
বাংলাদেশে সামরিক শাসন পরিচালক হিসেবে আসিবে তাহাকেই কাপুরুষতা এবং ব্যর্থতার কলংক মাথায় তুলিয়া লইয়া বিদায় নিতে হইবে।
বাংলার বাণী ৪ ৬ সংখ্যা ৪ ৫ অক্টোবর ১৯৭১
জল্লাদী অপকৌশল
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড মার খইয়া ইসলামাবাদের ভাড়াটিয়া জানােয়ার সৈন্যরা দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছে। খান সেনারা কতিপয় দালাল ছাড়া বাংলাদেশের। | জনগণের নিকট হইতে কোন প্রকার সাহায্য সহযােগিতা পায় না।
| হানাদার সৈন্যগণকে সর্বপ্রকার, সাহায্য করার জন্য দখলীকৃত এলাকার জনসাধারণের প্রতি, | আহ্বান জানাইয়া সামরিকচক্র বিমানযােগে লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞাপন ছড়াইয়াছিল। গ্রামে গ্রামে এতদুদ্দেশ্যে | শান্তিবাহিনীও গঠন করা হইয়াছে। কিন্তু খানসেনারা জনসাধারণের নিকট হইতে কোন সাহায্যই পায়
। বরং জনসাধারণ চায় খানসেনাদের খতম করিতে । তাহারা মুক্তিযােদ্ধাগণকে বাড়ীতে আশ্রয় দিয়া তাঁহাদিগকে আদর-আপ্যায়ণ করিয়া থাকেন। | তাই মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপারে জনসাধারণের মনে বিভ্রান্তি এবং ঘৃণা সৃষ্টির জন্য ইহারা অভিনব | অপকৌশল অবলম্বন করিয়া চলিয়াছে। | কিন্তু ইহাদের সকল অপকৌশলই জনসাধারণের নিকট ধরা পড়িয়া গিয়াছে ।।
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার খুলনা হইতে প্রাপ্ত এক খবরে জানা যায় সম্প্রতি খানসেনারা বহু সংখ্যক উর্দুভাষী ব্যক্তিদের একপ্রকার সবুজ পােষাক (ইহা দ্বারা তাহারা বুঝাইতে চায় যে, এইসব উর্দুভাষী ব্যক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনীর লােক অথবা মুক্তিযােদ্ধা) পরাইয়া কোন একটি গ্রামে লুঠতরাজ এবং গ্রামবাসীগণকে হত্যা করার কাজে প্রেরণ করে। নিকটবর্তী এলাকাতেই হানাদার খানসেনারা অবস্থান করিতে থাকে।
| এইসব নকল মুক্তিযােদ্ধারা গ্রামবাসীদের উপর আক্রমণ চালাইলে গ্রামবাসীরা যখন চীকার | করিয়া ওঠেন, তখন খানসেনারা দলে দলে উক্ত গ্রামে ছুটিয়া গিয়া ফাকা গুলি করে এবং নকল
মুক্তিযােদ্ধাদের লােক দেখানাে গ্রেফতার করিয়া খুলনা শহরে লইয়া যায়। স্থানীয় জনসাধারণকে বলা | হয় যে এইসব মুক্তিযােদ্ধা ও ভারতীয় অনুচরগণই গ্রামে লুঠতরাজ করিতেছিল। কিন্তু তাহারা আসিয়া ইহাদের অত্যাচার হইতে গ্রামবাসীদের রক্ষা করিয়াছে। অতএব গ্রামবাসীদের উচিত তাহাদের সহিত সহযােগিতা করা, তাহাদিগকে খাদ্যদ্রব্য দিয়া সাহায্য করা। জনসাধারণকে আরও বলা হয় যে, ধৃত মুক্তিযােদ্ধাদের শহরে লইয়া গিয়া শাস্তি প্রদান করা হইবে।
কিন্তু শহরে গিয়া খানসেনারা ইহাদিগকে ছাড়িয়া দেয়।
ময়মনসিংহ হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, হানাদার খানসেনারা গ্রামের বাড়ীঘর ধ্বংস করিয়া কিংবা পােড়াইয়া দিয়া গ্রামবাসীদের নিকট হইতে স্বীকারােক্তি করাইয়া নেয় যে মুক্তিযােদ্ধারা তাহাদের বাড়িীঘর ধ্বংস করিয়া কিংবা পােড়াইয়া দিয়াছে। কাজেই মুক্তিযােদ্ধাদের দমনের ব্যাপারে গ্রামবাসীগণ সেনাবাহিনীর সাহায্য কামনা করে। শুধু তাহাই নয়, এই স্বীকারােক্তির জন্য খানসেনারা নাকি কোন কোন ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ৫০ টাকা করিয়া প্রদান করিয়াছে। | কোন বিদেশী পর্যবেক্ষক কিংবা সাংবাদিক ঢাকায় আসিলে সামরিক কর্তৃপক্ষ তাহাদিগকে ঐসব গ্রামে লইয়া যায় এবং জনসাধারণকে তাহাদের বাড়ীঘর ধ্বংসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া থাকে।
অগত্যা জনসাধারণ বিদেশী সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের নিকট বলিতে বাধ্য হয় যে, মুক্তিযােদ্ধারা তাহাদের বাড়ীঘর পােড়াইয়া দিয়াছে। | কিন্তু ইসলামাবাদের ফ্যাসিষ্ট খানসেনাদের এই অপকৌশলের আসল উদ্দেশ্য জনসাধারণের নিকট সুস্পষ্ট। তাহারা সুযােগ পাইলেই বিদেশী সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের নিকট প্রকৃত সত্য কথা বলিয়া দেয়।
বাংলার বাণী | ৬ সংখ্যা ৪ ৫ অক্টোবর ১৯৭১
বঙ্গবন্ধুর পিতামাতার অবস্থার অবনতি
ঢাকা হইতে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানাইয়াছেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের রুগ্ন পিতামাতার অবস্থার আরও অবনতি হইয়াছে। তাহারা ঢাকার পােষ্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রহিয়াছেন । বঙ্গবন্ধুর ৯২ বৎসর বয়স্ক পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং ৮২ বৎসর বয়স্কা মাতা দুরারােগ্য ব্যাধিতে ভুগিতেছেন। পিণ্ডি ইসলামাবাদের জল্লাদ সামরিকচক্র কর্তৃক তাঁহাদের প্রাণপ্রিয় পুত্রকে বার বার গ্রেফতার এবং বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া কারারুদ্ধ অবস্থায় তাহার জীবননাশের জঘন্য চক্রান্ত এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁহাদের মনে প্রচণ্ড আঘাত হানিয়াছে।
গত মে মাসে ইসলামাবাদের হানাদার জল্লাদ সেনারা তাঁহাদের গ্রামের বাড়ীটি পােড়াইয়া দিয়া বঙ্গবন্ধুর সর্বজন শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ পিতা মাতার সহিত যে দুর্ব্যবহার করে তাহা ছিল তাঁহাদের এই বার্ধক্য। জর্জরিত জীবনে আরও একটি মারাত্মক আঘাত স্বরূপ।
উল্লেখযােগ্য যে, আইয়ুব-মমানেমের স্বৈরতন্ত্রের আমলে শেখ মুজিবর রহমান তথাকথিত আগরতলা মামলার আসামী হিসাবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটক থাকা কালে তাঁহার বৃদ্ধ মাতা অসুস্থ হইয়া পড়িলে তাহাকে দেখার জন্য শেখ সাহেবকে প্যারলাে মুক্তিদান করা হইয়াছিল। কিন্তু এইবার। তাহাকে বাংলাদেশ হইতে দেড় হাজার মাইল দূরে শক্রদেশের এক অজ্ঞাত কারাগারে আটক রাখিয়া তাহার প্রাণনাশের জঘন্য অপচেষ্টা চলিয়াছে। কনিষ্ঠ পুত্র এবং অন্যান্য আত্মীয় স্বজনও আজ বঙ্গবন্ধুর মাতা পিতার পাশে নাই। পুত্রবধু বেগম শেখ মুজিব এবং প্রিয়তম নাতি নাতনীও কড়া সামরিক প্রহরাধীনে ঢাকায় একটি বাড়ীতে অন্তরীনাবদ্ধ। এইসব নির্মম ঘটনাবলী বৃদ্ধ বয়সে তাঁহাদের নিঃসঙ্গ জীবনে এক ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে । কবে আর শেখ সাহেবের সঙ্গে তাহার অশীতিপর মাতা পিতার দেখা হইবে, কে জানে?
বাংলার বাণী ॥ ৬ সংখ্যা ! ৫ অক্টোবর ১৯৭১
অবরুদ্ধ ঢাকা নগরী (নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
মুক্তিবাহিনীর তীব্র গেরিলা আক্রমণে শত্রু কবলিত ঢাকা নগরী এখন কার্যতঃ অবরুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর সূত্রে জানা যায় যে, গত ২৭শে সেপ্টেম্বর হইতে ১লা অক্টোবরের মধ্যে এক সুপরিকল্পিত ও ব্যাপক গেরিলা অভিযান চালাইয়া মুক্তিবাহিনী ঢাকা শহরের চারিদিকে ৩০ মাইল পরিধির মধ্যে দেশের অন্যান্য জেলার সাথে সংযােগ রক্ষাকারী সব কয়টি সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়াছে।
| এই অভিযানে গেরিলা বাহিনী ঢাকার পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ডেমরা শিল্পাঞ্চল, উত্তরে ঝিনারদি, নয়নবাজার, মঠখােলা, চর মন্দালিয়া ও কটিয়াদি, দক্ষিণে নবাবগঞ্জ দুয়ার এবং পশ্চিমে কালিপুর, মধুপুর এলাকা ও ঢাকা টাঙ্গাইল সড়ক পথে আক্রমণ চালায়। এই সব রাস্তায় মুক্তি বাহিনী।
প্রায় সব কয়টি কালভার্ট ও রেলসেতু উড়াইয়া দেয় এবং প্রধান প্রধান সড়ক ও রেলপথে মাইন পুঁতিয়া
প্রধান কয়টি সড়কে এই সময়ে গেরিলারা হালকা অস্ত্র ও গ্রেনেডের সাহায্যে সাতটি আকস্মিক আক্রমণ চালাইয়া ৬০ জন শত্রু সেনা ও ১০০ জন রাজাকারকে খতম করিয়াছে।
এই সব অভিযানের ফলে ঢাকা শহর কার্যত অবরুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে। অপর একটি খবরে প্রকাশ, দুই শত ফেরী কর্মচারী কাজ বন্ধ করিয়া দেওয়ার ফলে ফেরীঘাট সমূহ দিয়া সবরকম যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া গিয়াছে। পাক হানাদার বাহিনী এখন শহরের বাহিরের ঘাঁটিগুলিতে সরবরাহের জন্য বাধ্য হইয়া হেলিকপ্টার ব্যবহার করিতেছে।
মুক্তিযুদ্ধ ! ১ : ১৪ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশের নগর-বন্দর-গ্রাম।
—যাতির
বাংলা দেশের নগর-বন্দর ও গ্রামের কথা লিখতে বসে আজকে গ্রামের কথাই লিখব বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রামগুলাে মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে একথা অবশ্যই সত্য। পাক হানাদারদের বিতাড়িত করে গ্রাম বাংলায় যে আজ মুক্তি বাহিনী মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে পেরেছেন তার পেছনে গ্রাম বাংলার গ্রাম্য মানুষের অনেকখানি দান রয়েছে। | মুক্তি ফৌজ আজ বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে সক্রিয়। কিছুদিন আগে গ্রামগুলাে ছিল পাক সামরিক শাসনপুষ্ট মুসলিম লীগ আর জামাতের তথাকথিত নেতাদের নিয়ন্ত্রণে; এরা গ্রামবাংলার নিরীহ মানুষদের উপর যখন তখন চড়াও হয়ে যথেচ্ছ অত্যাচার উৎপীড়নে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এই সব মানুষগুলাে এতদিন ধরে প্রতিমুহূর্তে অপেক্ষা করেছে মুক্তি বাহিনীর।
আজকে গ্রামবাংলার এই সব নিষ্পেষিত মানুষগুলাে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, কেননা গ্রামবাংলা থেকে আজ বলতে গেলে মুসলিম লীগ আর জামাতের দালালরা নির্মূল হয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই এই সব বিশ্বাস ঘাতকরা মুক্তি বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেদু’চারজন আজো যারা বেঁচে আছে তারা মুক্তি বাহিনীর ভয়ে গ্রাম বাংলা ছেড়ে শহরে গিয়ে পাক সৈন্যের ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ওরা যতই পাক সৈন্যের পরিবেষ্টিত আশ্রয়ে গিয়ে উঠুক না, মুক্তি বাহিনী এই সব বেইমানদের ক্ষমা করবেনা। | কিছুদিন আগে রাজাকাররাও গ্রাম বাংলায় সক্রিয় ছিল। রাজাকাররা বাঙ্গালী অবশ্যই কিন্তু ওরা। বাঙ্গালীর কলঙ্ক। সাধারণতঃ মুসলিম লীগ আর জামাতে ইসলামের পােষ্য শুণ্ডারাই এই রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিয়েছে। অবশ্য ইয়াহিয়া সরকারের বাঙ্গালী নিধনের এ আর এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। বর্তমানে খান সেনারা মুক্তি বাহিনীর ভয়ে এত ভীত যে মুক্তি বাহিনীর সংবাদ পেলেও এরা ছাউনি থেকে বেরােতেই চায়না। মুক্তি বাহিনীর মােকাবিলায় তাই তারা রাজাকারদের পাঠিয়ে দেয়। | কিন্তু অসম সাহসী মুক্তি সেনাদের কাছে রাজাকাররা তাে তুচ্ছ। তাই বাংলাদেশ থেকে রাজাকার। বাহিনীও নির্মূল হয়ে আসছে। দু’ মাসের মধ্যে প্রায় তিন হাজার রাজাকার মুক্তি বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে। বহু সংখ্যক মুক্তি বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছে। বাকী যারা আছে তারা প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে।
লী আর তাই সব দিক দিয়েই মুক্ত। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার অনেক গ্রামাঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন, আশা করা যাচ্ছে কিছু দিনের মধ্যেই থানা পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার শাসন ব্যবস্থা চালু করতে পারবেন।
কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠার জন্যে সবার আগে গ্রাম বাংলার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তৃত আলােচনা করা হবে। গ্রাম বাংলার মানুষকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে আজকের মত এখানেই শেষ করছি।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১; ৮ ! ১০ অক্টোবর ১৯৭১
মহানগরী ঢাকা অবরুদ্ধ।
(ষ্টাফ রিপাের্টার)।
মুজিবনগর, ৮ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে এবং উপর্যুপরি হামলা জনিত চাপ সৃষ্টির ফলে মহানগরী ঢাকা এখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে নিদারুণ মার। খেয়ে খান সেনারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এখানে সেখানে পথেঘাটে সৰ্ব্বত্র মুক্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণে খান সেনারা খেই হারিয়ে ফেলেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে কমপক্ষে ৩০০ জন দস্যু সৈন্য নিহত হয়েছে।
| ঢাকা জেলার পূর্বাংশে বাংলাদেশের গেরিলারা পাঁচরখিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সেতু ডিনামাইট বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়ায় ঢাকা নগরী ও শিল্প শহর নরসিংদীর মধ্যে রেলসহ সকল সংযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে পাক-ফৌজ জিনার্দিতে যে ক্যাম্প স্থাপন করেছিল, মুক্তিবাহিনী সেটি দখল। করে নিয়েছেন, এবং এ ক্যাম্প থেকে প্রচুর চীনা অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করেছেন। দাউদকান্দির ফেরী সার্ভিস দখল করে গেরিলার ঢাকা চট্টগ্রাম রাজপথে শত্র সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট করে দিয়েছেন। মুক্তিসেনারা ওঁৎ পেতে থেকে জেলার উত্তর সীমায় মনােহরদী ও নারানবাজারে। ষাটজন পাকিস্তানী সৈন্যকে খতম করেন, তাদের হাতে ২৩শে সেপ্টেম্বর টহলদার পাক সৈন্য ও তিনজন অফিসারও ঢাকা শহরে নিহত হয় ।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে এক সাংঘাতিক সংঘর্ষে ৬৫ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে। গেরিলার কাওরাহদে আক্রমণ চালিয়ে পাক সেন্যবাহী একখানা ট্রেন ধ্বংস করেছেন।
ঢাকা প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, ঢাকার চতুস্পার্শ্বে নদীবেষ্টিত অঞ্চলে দুই শতাধিক খেয়াচালক কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় যাত্রা চলাচল বন্ধ ও দুধ মাছ টাটকা তরিতরকারি প্রভৃতির দাম শতকরা ৫০ ভাগ বেড়ে গেছে।
মুজিবনগর থেকে প্রচারিত সমর বুলেটিনে প্রকাশ, গত ১৫ দিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন খণ্ডে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে প্রায় ১০০ পাক সৈন্য খতম হয়েছে।
২৩শে সেপ্টেম্বর নােয়াখালি জেলার পূব ছাগলনাইয়ার একটি সামরিক ঘাটিতে এবং মনােহরপুর, আজানপুর কোটেশ্বর ও জাম্বরিতে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে মােট ২৫ জন পাক সৈন্যকে প্রাণ দিতে হয় । বৈদ্যগ্রামেও গেরিলারা ২ জন পাক সেনাকে খতম করে।
২৮শে সেপ্টেম্বর বুড়িচঙ এর ঢাকা চট্টগ্রাম সড়ক সেতুটি গেরিলারা মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস করে। এবং সেখানে ২৩ জন শত্রু সৈন্য খতম হয় শ্রীহট্ট জেলায় পাক সেনারা একটি বাজার লুঠ করার সময় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সেখানে ৮ জন পাক সেনা খতম হয়।
মুক্তিবাহিনী যশােহর ও কুষ্টিয়া জেলায় অন্ততঃ দশজন পাক সেনাকে নিহত করে ২০টি চীনা রাইফেল এবং প্রচুর পরিমাণ গােলা বারুদও লাভ করে। এবং ১৪ জন রাজাকার এবং পাকতাবেদারও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৩ ১০ অক্টোবর ১৯৭১
শব-ই-বরাত ভাগ্যরজনী।
শব-ই-বরাত’ একটি আরবী শব্দ যার অর্থ ভাগ্য-রজনী। ‘শব’ এবং ‘বরাত’ কথা দুটির অর্থ হচ্ছে যথাক্রমে রাত্রি এবং ভাগ্য। অর্থাৎ এই রাত্রিতে ভাগ্যবিধাতা মানুষের কর্ম অনুযায়ী তার বছরের ভাগ্য লিখে যান। | সামগ্রিকভাবে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মারাত্মকভাবে কঠোর হলেও, এ ব্যাপারে এতই উদারতা । প্রদর্শন করেছে, যা নমনীয় হিন্দু ধর্মও পারে নি। কিন্তু এতাে গেল বৈষম্যের কথা । সাদৃশ্যের দিকে দৃকপাত করলে দেখা যায় ভারতবর্ষের সঙ্গে এর নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক। | সব প্রথম তারিখটার কথাই ধরা যাক না কেন। ১৩ই শাবানের শেষে পৃথিবীর পট থেকে যখন। সূর্যের শেষ রশ্মিটা মিলিয়ে যায়, আসে রাত। সেই রাত ১৪ই শাবানের (হিজরি সন) রাত—শব-ইবরাত বা সৌভাগ্যের রাত। তার কয়েক ঘণ্টা পরেই আসে ১৪ই আশ্বিন (শকাব্দ)।
এ ছাড়া ভারতীয় ‘শবরী’ যার অর্থ রাত, তার সাথে আরবী ‘শব’ শব্দের কোন পার্থক্য আছে। বলেই মনে হয় না। আর হর-হামেশা ব্যবহারের ফলে ‘বরাত’ শব্দটি তাে বাঙলাই হয়ে গেছে। কিন্তু যাক সে সব।
জানা যায়—ফেরাউন বাদশাহ্ হযরত মুসা নবীকে হত্যা করার জন্য অসংখ্য মন্ত্র পুষ্ট সাপ ছেড়ে ছিলেন। সাপগুলাে কিল বিল করে তাকে দংশন করতে এলে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানালেন। আল্লাহ করুণাময় এই প্রার্থনা কবুল করে মুসা নবীকে ‘শাবান’ নামে একখানি লাঠি দিয়েছিলেন। এই শাবানের দ্বারাই মুসানবী সেদিন ফেরাউনের চক্রান্তকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
এর পর বহু বছর কেটে গেছে। পৃথিবীতে এলেন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ হযরত মােহাম্মদ (সঃ)। তাঁর প্রার্থনার চরম পুরস্কার পেয়েছিলেন এই ১৪ই শাবান—তাই এর নাম ভাগ্য-রজনী ‘শব-ইবরাত’।
বাঙলাদেশে আজ যে ফেরাউনের সাগরেদ ইয়াহিয়ার বিষধর সাপেরা কিলবিল করছে, তাদের মাথা থেতলে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত লাঠি এবং পরিশেষে শান্তি-সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ রাব্দুল আল আমীন শক্তি দিন—এবারের শব-ই-বরাতে এই ছিল সারা বাঙলার প্রার্থনা!
সাপ্তাহিক বাংলা # ১ : ৩ | ১০ অক্টোবর ১৯৭১।
ডিক্টেটর ইয়াহিয়ার চাল ২০ হাজার পরিবার ফতুর
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে যে ইয়াহিয়া খানের হুকুম মতে ২০ হাজার বাঙালী তাদের কষ্টার্জিত ৫ শত ও ১ শত টাকার নােট জমা দিয়েছিলেন। জমাকৃত মুদ্রার পরিমাণ প্রায় চোদ্দোশত কোটি টাকা। কিন্তু এখনাে পুরানাে নােট বদল করে নােতুন নােট দেয়নি ইয়াহিয়া খান । কবে যে দেবে তারও কোনাে ভরসা নেই এবং আদৌ দেবে কিনা কে জানে। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার টাকা জমাদানকারীরা এজন্য ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকের মতে একটা চাল দিয়ে ধুরন্ধর। ইয়াহিয়া কুড়ি হাজার বাঙালী পরিবারকে ফতুর করে দিলাে।
বাংলা # ১: ৪ | ১১ অক্টোবর ১৯৭১।
জবর খবর। আইয়ুবের দালাল মােনায়েম খান খতম।
ঢাকা, ১৪ই অক্টোবর : আইয়ুবী আমলের গভর্ণর জনাব আবদুল মােনায়েম খান বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর গেরিলার গুলিতে আজ নিহত হয়েছেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বি.বি.সি, ভয়েস অফ আমেরিকা ও ঢাকা বেতার কেন্দ্র এই সংবাদ পরিবেশন করেছেন। | ঘটনার বিবরণে প্রকাশ গতকাল রাতে দুজন গেরিলা মােনায়েম খানের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ আলােচনা করেন। এরপরই তাকে লক্ষ্য করে গুলী চালানাে হয় এবং গেরিলারা তৎপরতার সাথে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। আজ সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
| বাংলাদেশ (১) [ ১ : ১৬ ॥ ১১ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকার ডেপুটি কমিশনার, খাদ্য কমিশনার নিহত
গত এক সপ্তাহে ঢাকায় মুক্তিযােদ্ধা গেরিলারা ঢাকার ডেপুটি কমিশনার ও খাদ্য কমিশনারকে খুন করেছে এবং ঢাকা সদরের এস ডি ও-কে গুলীতে জখম করেছে। প্রাপ্ত সংবাদে জানা যায় ঢাকার ডেপুটি কমিশনার, খাদ্য দপ্তরের কমিশনার ও সদরের এস ডি ও-কে সঙ্গে নিয়ে কাপাসিয়া যাচ্ছিলেন। শীতলক্ষ্যা নদীতে গেরিলারা লঞ্চের মধ্যেই ডেপুটি কমিশনারকে আক্রমণ ও খুন করে ।
বাংলাদেশ (১} ১: ১৬ ॥ ১১ অক্টোবর ১৯৭১
পুতুলদের পদত্যাগ।
| ১৫ অক্টোবর খবর পাওয়া গেছে যে ডাঃ এ, এম, মালিকের পুতুল মন্ত্রীসভার ৬ জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাক্তন গভর্ণর মােনেম খানের মৃত্যু হওয়ায় ডাঃ মালিকের মন্ত্রীসভার সদস্যর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তার জন্যেই তারা মন্ত্রী হতে অস্বীকার করছেন।
ডাঃ মালিক এই মন্ত্রীদের পদত্যাগ না করার জন্য অনুরােধ করেন। কিন্তু মন্ত্রীরা সে অনুরােধ গ্রাহ্য করেননি। এই মন্ত্রীদের আরও ভয় হয়েছে, পাছে পাক সামরিক জুন্টা তাদের গ্রেফতার করে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ৯ ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থ প্রচেষ্টা
বাংলাদেশের যশােহর অঞ্চলে খান সেনারা বেয়ােনেট দেখিয়ে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা করে, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতায় পাক সরকার কোন রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। পাক সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা দিনের পর দিন কিভাবে ভেঙ্গে পড়েছে তার একটা নজির গায়ের জোরে রাজস্ব আদায়ের ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যে ধরা পড়ে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ » ১: ৯ ! ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
আদিম হিংস্র মানবিকতার আমরা যদি কেউ হই
মুজিবনগর ৭ই অকটোবর গত ২৫শে মার্চ বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর নির্মম অত্যাচার শুরু হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিযুক্ত ডঃ সাজ্জাদ হােসেন গত মাসে মুক্তি যােদ্ধাদের বুলেটে নিহত হয়েছেন বলে আজ বিশ্বস্ত সূত্রে এখানে জানা গেছে।
সংগ্রামী বাংলা (১) আলী আসাদ সংখ্যা ॥ ১৮ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকা জেলার গ্রামাঞ্চলের অবস্থা সম্পর্কিত একটি রিপাের্ট আর্থিক সঙ্কট তীব্রতর : তবে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হইয়াছে।
# রহুল সরকার |
| ঢাকা রণাঙ্গনে অবস্থিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টির লিয়াজো অফিস হইতে পার্টির সদর লিয়াজো অফিসে প্রেরিত এক রিপাের্টে জানা যায় যে, গ্রামবাংলার মানুষের অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হইয়াছে, স্বাভাবিক ক্ৰয় একেবারে লােপ পাইয়াছে। একই সঙ্গে আবার ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, পরিবারে পরিবারে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হইয়াছে, মুক্তিফৌজের ব্যাপক তৎপরতায় গ্রামে গ্রামে চুরি ডাকাতি হ্রাস পাইয়াছে। | চাউল ৪৫ টাকা, লবণ ২৫ টাকা ও আটা ৪২ টাকা মন দরে এবং সরিষার তৈল ১২ টাকা, নারিকেল তৈল ১৬ টাকা, কেরােসিন তৈল ১ টাকা, ডাল ১.৫০ টাকা সের দরে সুতা ৯০ টাকা বাণ্ডিল দরে বিক্রয় হইতেছে। কাপড়ের মূল্য শত করা ৭৫ ভাগ বৃদ্ধি পাইতেছে । মশলা ও সিগারেট, তামাক। পাতা, পান, সুপারি, খর চিনি প্রভৃতির মূল্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। | পাট, মাছ, ধান, চাল, মরিচ, কচু, হলদে, পেয়াজ, আদা প্রভৃতি অর্থকরী দ্রব্যাদির মূল্য একেবারে হ্রাস পাওয়ায় ৮০% মানুষের স্বাভাবিক ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাইতেছে। একশত টাকার নােট সরকারের প্রতি আস্থার অভাব হেতু জমা না দেওয়ায় বহু টাকা নষ্ট হইয়াছে।
| সুতার অভাবে তাঁতশিল্প অচল হইয়া গিয়াছে। ইহাছাড়া, পাকবাহিনী বাছিতপুর, বসন্তপুর, সিতাইকান্দি, কাপাসিয়া প্রভৃতি স্থানের তাত পুড়াইয়া দিয়াছে। পাট ২০ হইতে ৩০ টাকায় বিক্রয় হইতেছে। সৈন্য ও রাজাকারদের উৎপাতের ফলে ফড়িয়া ও দালালেরা ব্যবসায়ে উৎসাহ পাইতেছেনা। তাহাদেরকে ঘাটে ঘাটে নাজেহাল করা হয় ও ঘুষ লওয়া হয়। ধান ৮ হইতে ১২ টাকা মন দরে ক্রয় করা হইতেছে। | বৈরবাজার, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ ব্যবসা কেন্দ্রের মধ্যে স্বাভাবিক যােগাযােগ এখনও ব্যহত । ফলে, আমদানী-রফতানীও ব্যহত ।
| শিক্ষক, বেসরকারী চাকুরীজীবী, শ্রমিক প্রভৃতির বিপুল অংশ গ্রামে আশ্রয় লওয়ায় বেকার অবস্থায় দিন কাটাইতেছেন। প্রায় সকল পেশার মানুষই গ্রামে কৃষিতে নিয়ােজিত হইয়াছে। ফলে দিন মজুরের প্রয়ােজন ও মজুরী মূল্য দুইই হাস পাইয়াছে।
সারের অভাবে ফসল বাড়িতেছে না। কীটনাশক ঔষধের অভাবে ইরি চাষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে।
সময়মত আউশ ধানওতােলা সম্ভব হয় নাই। কারণ, পাক বাহিনীর গ্রামে গ্রামে বেপরােয়া আক্রমণ। জনগণের আশঙ্কা যে, আশ্বিন-কার্তিক মাসের মধ্যেই দূর্ভিক্ষের সূচনা হইতে পারে ।
গ্রামাঞ্চলের ডাক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল রহিয়াছে।
| এদিকে আবার ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, পরিবার পরিবারে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় রহিয়াছে। ব্যক্তিগত ও সম্পতিগত বিরােধ লুপ্ত প্রায়। সকলে মিলিয়া সংগ্রাম করিয়া বাঁচিতে চায়। পাক সেনারা যেসব জায়গায় ছাউনী ফেলিয়াছে, সেইসব জায়গা এবং বড় হাট-বাজার ও রেল-লাইনের আশেপাশের গ্রামবাসীরা নিজ নিজ গ্রাম ছাড়িয়া ভিন্ন গ্রামে দিন কাটাইতেছে। জনৈক বৃদ্ধ এক বাড়ীর দাওয়া বসিয়া | গল্প করিতে ছিলেনঃ পাক সৈন্যরা আমার বাড়ী পুড়াইয়াছে কিন্তু এই মাফিত আর পুড়াইতে পারিবেনা। | পাক বাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচারে হতাশ হইলেও মুক্তিফৌজের তৎপরতায় গ্রামের মানুষ | এখনও আশায় বুক বাধিয়া আছে। পাক সৈন্য অপেক্ষা রাজাকারদের বিরুদ্ধেই তাহাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ | বেশী। সীমাবদ্ধ পরিবেশেই গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাত্রা চালু হইয়াছে।
নতুন বাংলা ॥ ১: ১০ | ২১ অক্টোবর ১৯৭১
ইয়াহিয়ার নির্বাচনী প্রহসন কোন সাড়া নাই : কোন প্রার্থী নাই
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
কাহার গার্দানে দুইটি মাথা রহিয়াছে যে, ইলেকশন করিবে? ইয়াহিয়া খানের দল তাহাদেরই কথিত ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের দলকে বেআইনী ঘােষণা ও দলের যতটা খুশী ততটি | আসনের নির্বাচিত প্রার্থীদের বরখাস্ত করিয়া সেইসব আসনে তথাকথিত ‘উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা | ঘােষণা করিয়াছে। ডিসেম্বরই এই নির্বাচন কিন্তু কি গ্রামে, কি শহরে কোথাও এই নির্বাচনের কথা | শােনা যায় না কোন প্রার্থীও দেখা যাইতেছে না। সামান্য ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনেও দেখা যায় | যে, নির্বাচনের ৬ মাস পূর্ব হইতেই কি তােড়জোড়। কিন্তু ইয়াহিয়ার এই নির্বাচন ব্যতিক্রম এবং এই ব্যতিক্রম সহিত লড়াই করিতেছে সব দিক হইতেই। | ইহার কারণে কী? কারণ, জনগণ ইয়াহিয়াদের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে—তাহারা মুক্তিফৌজের | বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য। ব্যাপার অন্য রকম—শত্রুসৈন্য খতম কর, দালাল নিপাত কর। | দালালদের অবস্থা এমনিতেই নাজেহাল—তারপর ইয়াহিয়ার এই খেলা! অতএব; দালালরাও চুপ ধরা পড়িলে জীবন যাইবে। | অতএব, ইয়াহিয়ার নির্বাচন প্রহসনের উদ্যোগ যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়া গিয়াছে, গণতন্ত্রের তথাকথিত লীলাভূমি ওয়াশিংটন আর লণ্ডনের সরকারী দফতরে উহা অনুভূত না হইলেও মুক্তিফৌজ ইতিমধ্যেই শত্রু সৈন্য নিধন ও দালাল হালালের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলকেই উহা টের পাইয়া গিয়াছে।
…হাতে লইয়া এখানে সেখানে “পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ ফাঁদিতেছেন কেন? বলিতে পারেন বাংলাদেশ সরকারের পিছনে যে দলগুলি আজ সমর্থন দিতেছে নিবাচনের সময় তাহারা শেখ মুজিবর রহমানের | বিরােধিতা করিয়াছে, তাহার কর্মসূচী প্রসঙ্গে নিজস্ব বক্তব্য উপস্থিত করিয়াছে। মনে রাখিতে হইবে। নির্বাচনে বিভিন্ন দল স্ব স্ব কর্মসূচী অনুযায়ী কাজ করে। কিন্তু মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্য একটি ও কর্মসূচীও
একটি। তাহা হইল, দেশকে শত্রু কবল মুক্ত করা। সেখানে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক দলগুলি | মতাদর্শগত বিভিন্নতা সত্বেও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। চোখের সামনে ভিয়েতনাম তার উদাহরণ। | এখানে ২৬টি দল আজ ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রুর মােকাবেলা করিতেছে। তাই আমাদের বক্তব্য, মুক্তি
সংগ্রামের শরিক অঙ্গদলগুলির মতের সহিত আপনারা সববিষয়ে একমত হইবেন এমন নহে কেহ কেহ | এই দল বা অন্য কোন দলের মতাদর্শের সমর্থক হইতে পারেন কিন্তু এখন সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সেই প্রশ্ন তােলার অবকাশ কোথায় ভাবিয়াছেন কি? ইহা কি মুক্তি সংগ্রামে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে না, মুক্তি সংগ্রামকে দুর্বল করে না? ইহা যে কোন সাধারণ মানুষ বুঝিতে পারে …শেখ মুজিবর রহমানের বিভিন্ন বক্তৃতা ও উক্তিও সমালােচনা করেন নাই? করিয়াছেন। তবে এখন যদি আপনারা।
শেখ মুজিবুর বড় সমর্থক বলিয়া নিজেদের জাহির করেন এবং চালাইতে চাহেন তবে মুক্তিযুদ্ধে শরিক অঙ্গদলগুলির জোর কোথায়! আপনাদের মনে রাখা উচিত আজ যাহারা মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ডাকে সামিল হইয়াছেন, গত মার্চ মাসে শেখ মুজিবর রহমানের আহ্বানে বাংলাদেশব্যাপী অসহযােগ আন্দোলনে তাহারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়াছেন। সুতরাং সংগ্রামের ক্ষেত্রে ঐক্য সেদিন হইতেই চলিয়া আসিতেছে। ইহা নতুন কিছু নহে। পরিবর্তিত অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর ইহাকে নতুনভাবে রূপদানের প্রশ্নটিই সামনে আসিয়াছে। | চার, আপনাদের সর্বাপেক্ষা বড় অভিযােগ আমাদের দেশে কিছু লােক সােভিয়েত ইউনিয়নের বক্তব্যের বাইরে আসিতে চাহে না, প্রকারন্তরে বলিতে চাহেন যে, সােভিয়েত ইউনিয়নের মনােভাব প্রতিফলন ও উহার স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তাহারা পরিচালিত করিতে চাহেন। ইহাই বােধ হয় আপনাদের সর্বপ্রধান অভিযােগ। এই অভিযােগ যাহাদের বিরুদ্ধে উহার জবাব তাহারাই দিতে পারেন আমাদের একটি মাত্র বক্তব্য …
নতুন বাংলা | ১:১০ ২১ অক্টোবর ১৯৭১
মৃতনগরী ঢাকা । (কলকাতা প্রতিনিধি)
রেডিও সুইডেনের প্রতিনিধি মিঃ এরল্যাণ্ডসন তিনদিন ব্যাপী বাংলাদেশ সফর সমাপ্ত করে সম্প্রতি দিল্লীতে সাংবাদিকদের জানান যে, ঢাকা সন্ত্রাসকবলিত শহরে পরিণত হয়েছে। সূর্যাস্তের পূর্বেই দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এই সময়ে যুবকদের রাস্তায় দেখাই যায় না। এছাড়া সর্বত্রই পাক বাহিনী মােতায়েন রয়েছে। সমস্ত সুবিধাজনক স্থানে, এমন কি ডাকঘরে ও হােটেল ইন্টারকনটিনেনটালে সামরিক প্রহরা রয়েছে। হােটেলে প্রবেশ করার ও বাইরে আসার সময় তল্লাসী চালানাে হচ্ছে।
| মিঃ এরল্যাণ্ডসন বলেছেন যে, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ হাজার ছাত্রের তালিকা রয়েছে, কিন্তু তিন থেকে চারশাে ছাত্র ক্লাসে যােগ দেয়। সংবাদপত্রগুলির ওপর সেন্সরের কড়াকড়ি ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ’ শব্দটি সংবাদপত্রের মধ্যে কোন স্থান নেই এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত যে কোন সংবাদের ঐ একই অবস্থা। তিনি আরাে বলেছেন যে, সফররত বিদেশী সাংবাদিকের পক্ষে পরিস্থিতির সঠিক চিত্র সংগ্রহ করা অসম্ভব। ঢাকার বাইরে সফর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপের বিভিন্ন সংবাদ বিভিন্ন সূত্রে শহরে এসে পৌছায়। গেরিলাদের মাইন আক্রমণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ডুবানাের সংবাদ ঢাকায় পৌছেছিল ।
মিঃ এরল্যাণ্ডসন ক্ষোভের সঙ্গে জানান যে, যেহেতু বিদেশী ত্রাণ সামগ্রী বিলি বণ্টনের দায়িত্ব পাক কর্তৃপক্ষের হাতে সেহেতু বণ্টন মােটেই আশাপ্রদ নয়। তিনি এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, ত্রাণ-সামগ্রীর সিংহভাগই পাক সেনারা ভােগ করছে।
| স্বদেশ ১: ৪ g ২১ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকা এখন অবরুদ্ধ নগরী
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
মুজিবনগর, ২০শে অক্টোবর—পাক হানাদারদের এখন কঁদুনি সুরু হয়েছে। যারা ভেবেছিল, মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টায় তারা বাঙলাদেশকে শায়েস্তা করতে পারবে, তারা এখন নিজেদের বােকামীর কথা বুঝতে পেরে, ঢাকা শহরেই আত্মরক্ষার জন্যে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
| সংবাদে প্রকাশ, ঢাকার সদর ঘাটের বুড়ীগঙ্গার তীরকে এখন কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত। করার ব্যবস্থা হয়েছে। মাঝে মাঝে স্থাপন করা হয়েছে ‘চেকপােষ্ট’ । নদী পথে যারা ঢাকায় আসে,এই সব স্থানে ভালােভাবে তল্লাসী করা হয়। | যে সব বাস’ বাইরে থেকে ঢাকায় আসে, শহরের প্রবেশ মুখে পাক হানাদাররা তাদের। যাত্রীদেরও ভালােভাবে তল্লাসী করে। পাক হানাদারদের আশংকা, এই সব পথ দিয়েই মুক্তি বাহিনীর। বীর গেরিলারা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে পারে।
পাক হানাদারদের মনােবল এতােটা নেমে গেছে যে কাগজে থাকলেও তাদের মধ্যে ছােটা ছুটি। পড়ে যায়। কেউই সাহস করে সেই বন্ধুর কাছে যায় না। তাদের আশংকা সম্ভবতঃ কাগজে জড়ানাে। ঐ বস্তুটি ‘টাইম বম’ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু অনেক সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে যখন। ঐ মােড়ক খােলা হয়, হয়তাে তার মধ্যে দেখা যায়, কিছু পরিমাণ কমলা লেবুর খােসা।
ঢাকার অধিকাংশ অফিসের চার পাশে উঁচু প্রাচীর উঠেছে। ফটকের সামনে উঠে ‘ব্যাফেল ওয়াল । বা বিকল প্রাচীর।
| ঢাকার রাস্তায় পাক হানাদাররা দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। ফৌজি গাড়ীগুলি অতি দ্রুত রাস্তা। দিয়ে ছুটে পালায়। | ঢাকার রাত এখন পাক হানাদারদের চোখে বিভীষিকা নিয়ে আসে। শহরের বিভিন্ন অংশে মুহুর্মুহু বােমার শব্দ শােনা যায়। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট বন্ধ । লােক চলাচল বন্ধ । কোন কোন অংশে। মুক্তি বাহিনীর বীর গেরিলারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়ায় শহরের বহু অঞ্চলে ভুতুরে অন্ধকার বিরাজ করে।
সংবাদে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনীর বীর গেরিলারা খােদ ঢাকা শহরেই তাদের ‘খতমি কারবার শুরু। করে মােনেম খার সুরক্ষিত গৃহে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই দুঃসাহসী গেরিলাদের । কর্মকুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। তা ছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে পুতুল গভর্ণর। মালেকের পুতুল মন্ত্রিসভার জনৈক সদস্যকে ঘায়েল, বক্সীবাজারের নিকটবর্তী মেডিক্যাল মেসের কাছে। তিনজন রাজাকারকে খতম, একটি ব্যাঙ্কের নিকটে দাঁড়ানাে একটি বাড়ীতে বােমা মেরে পাঁচজনকে। হত্যা ইত্যাদি কাজ ঢাকা শহরের অস্বাভাবিক অবস্থার কথাই প্রমাণ করে।
| প্রকৃত প্রস্তাবে ঢাকা এখন অবরুদ্ধ নগরী। স্বাভাবিক জীবনের প্রাণ চাঞ্চল্য তার কোথাও লক্ষ্য। করা যায় না।
মায়ের ভাক ! ১: ২ # ২২ অক্টোবর ১৯৭১।
অন্ধকারের অতলে ঢাকা শহর
মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা দখলীকৃত ঢাকা শহরে আরাে ব্যাপক ও জোরদার আক্রমণ। চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গেরিলা যােদ্ধারা সম্প্রতি ঢাকা শহরের চার পাশের। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলােতে যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে সারা শহর গভীর অন্ধকারের ভিতর ডুবিয়ে দিয়ে হানাদার সৈন্যদের ব্রিত করে ফেলেন। এ আক্রমণে একটি বৈদ্যুতিক সাব ট্রান্সমিশন সেন্টার বিধ্বস্ত করে এবং একটি গ্যাস লাইন উড়িয়ে দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী ও ঘােরাশালের মধ্যে সরবরাহকারী লাইন বিপর্যস্ত করেছেন। এ ছাড়াও ঢাকার সন্নিকটে কাঞ্চনে অবস্থিত একটি পাটকলের বৈদ্যুতিক সাব-ষ্টেশন ধ্বংস। করে দিয়েছেন।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৪ # ২২ অক্টোবর ১৯৭১।
বাংলাদেশে ত্রাসের রাজত্ব অব্যাহতভাবে চলছে।
| বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্রিকা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’—এ বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে এখন | ত্রাসের রাজত্ব চলেছে। অধিকাংশ বিদেশী, যারা বাংলাদেশে সাহায্য করতে গিয়েছিলেন, তারা খুবই হতাশ হয়ে পড়েছেন। তারা মনে করছেন, শরণার্থীরা দেশে ফিরবার মত অবস্থা সহজে সৃষ্টি হতে পারবে না। | পত্রিকার সংবাদদাতা ম্যানাকম ক্রাউন বলেছেন, ঢাকা থেকে তরুণদের বিনা কারণে পাক ফৌজ কর্তৃক ধরে নিয়ে যেতে দেখা যাচেছ । বহু গণ্যমান্য লােককেও গ্রেফতার করা হচ্ছে। যদিও ইয়াহিয়া ঘােষণা করেছে, সকলকে সাধারণভাবে মাফ করে দেওয়ার কথা।
জয়বাংলা (১) # ১; ২৪ # ২২ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকা এখন ফ্যাসিষ্টদের কবলে
দিল্লীর নিউ ওএভ কাগজ থেকে সংগৃহীত/ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত গত ২৮শে সেপ্টেম্বর কলিকাতাস্থ গ্র্যাণ্ড হােটেলে আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর ষ্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। ইনি বিশ্বব্যাঙ্ক সংস্থার পক্ষ থেকে পূর্বঙ্গে কাজ করছিলেন এবং ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে কলিকাতা আসেন। তরুণ চল্লিশাের্ধ টাইগারম্যান তার ঢাকা সফরে খুব বিচলিত মনে হল।
| “আমি তাে রাজনৈতিক লােক নই” প্রথমেই তিনি বললেন, “আমি আমার পেশার মধ্যেই ডুবে থাকি। কিন্তু তার মানে তাে এই নয় যে আমার কোন মতামত থাকবে না। আমি ঢাকা ও পূর্ব বাংলায় যাই ১৯৬৪ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রকল্পের ৫টি টেকনিক্যাল ইনষ্টিটুট তৈরীর কাজে। সিলেট, বরিশাল, বগুড়া রংপুর ও পাবনা, প্রতি জায়গায় একটি । আমার কাজটাও ভালাে লাগত এবং খুব তাড়াতাড়ি পূর্ব বাংলার মানুষকেও আমি ভালাে বাসলুম। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ এর মধ্যে আমি ১৬ বার পূর্ব বাংলায় গেছি এবং আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমার আমেরিকাতে যত বন্ধু আছে বাংলাদেশে তার চেয়ে কম নেই। এর আগের বার আমি ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে ঢাকা গিয়েছিলাম যখন নির্বাচনের ফলাফল সবে বেরিয়েছে এবং বাঙ্গালী সাধারণের নিজভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দাবীকে আমি সমর্থন করেছিলাম । আমি সমস্ত সামরিক সরকার ও পুলিশ রাষ্ট্রের এক নায়কত্বকে ঘৃণা করি এবং আমি পাকিস্তান সামরিকচক্রের বিষয়ে আমার মতামত গােপন করিনি।’
২৫শে মার্চ থেকে আমি অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম বাংলাদেশের আন্দোলন এর সাফল্য নিয়ে এবং আমার ঢাকা ও অন্য জায়গায় বন্ধুদের নিয়ে। তাই চার সপ্তাহ আগে আমি আবার পূর্ব পাকিস্তানে রওনা হই। ঢাকা বিমান বন্দরে পৌছতেই বুঝলাম অবস্থা বেশ কঠিন, কারণ সমস্ত যাত্রীকেই খুঁটিয়ে সার্চ করা হল—এবং প্রত্যেকেরই শরীর সার্চও হল এর এক অংশ । তারপর হেটল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেতেই মুক্তি যুদ্ধের প্রথম চিহ্ন দেখতে পেলুম সেখানেই আসা যাওয়ার প্রতিবারই আমাদের সার্চ করা হত শরীর।” | “ওপরে ওপরে ঢাকা স্বাভাবিক বলা হয়। কিন্তু কোথায় স্বাভাবিকতা? যেখানে মধ্যরাত্রি অবধি ৭০ এর ডিসেম্বরেও আমি দেখেছি শহর প্রাণবন্ত, সেখানে সন্ধ্যে সাতটা থেকে দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা নির্জন! তা ছাড়া দিনের আলােয়ও পথে ঢাকার রাস্তায় খুব কম অল্প বয়সী ছেলে দেখা যায় তরুণী | তাে প্রায় একটিও না। আমি অন্ততঃ বাঙ্গালী মেয়ে ঢাকার রাস্তায় গােটা সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে একবারও দেখিনি।”
“একদিন কার্যগতিকে কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে দেখি বিশফুট দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া। উঠে গেছে সেই বাড়ীটির চারপাশে লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি, যে কেউ বাড়ীতে ঢুকছে সবাইকে পাকসৈন্যরা সার্চ করছে আমাকেও করল। যে কোন সরকারী অফিসেরই আজ এই হাল।”
“আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছে “তাহলেও মানুষ পাক সৈন্যের জন্য কাজ করছে কেন?” আমি। ঢাকায় আমার নিজচোখে দেখা এক দৃশ্য বলি। একটা রাস্তা মেরামত চলছিল বাঙ্গালী মজুর দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে । সত্তর আশিজন পাকসৈন্য রিভলবার হাতে এবং বেয়ােনেট লাগানাে রাইফেল হাতে তাদের তদারক করছিল। কোন সামান্যতম গােলমাল হলেই দুচারজন লােককে সরিয়ে ফেলা হয় এবং তারা উধাও হয়ে যায়। অন্যান্য বিদেশী বন্ধু ও আমার বাঙ্গালী বন্ধুরা একই কথা বললে : ঢাকায়। সরানাে মানেই ঐসব লােককে গুলী করে শেষ করা হয়েছে অথবা তাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানাে হয়েছে ঢাকার সর্বত্র বিশেষতঃ ইউনিভার্সিটি পাড়ায় (যেখানে জগন্নাথ হলের ধ্বংস স্তুপ দেখলাম) পাকসৈন্য গাড়ী করে মানুষের দিকে অটোমেটিক বন্দুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সহরের সর্বত্র। হাওয়ায় হাওয়ায় সকাল থেকে সন্ত্রাস ভেসে বেড়ায় অদ্ভুত ভাবে। যেকোন স্বাভাবিক পুরুষ বা মেয়ে ঢাকায় কাজ করতে ঘৃণা বােধ করবে। এই যদি ফ্যাসিজম্, এই যদি পুলিশ রাষ্ট্র না হয়, তবে এটা। কী? | আমাদের প্রকল্পের অনেক কর্মীকে শেষ করে নেওয়া হয়েছে এবং আমি স্থিরনিশ্চিত কোন । স্বাভাবিক মানুষ, কোন গণতন্ত্র বিশ্বাসী, পাক জঙ্গীর জন্য কাজ করতে পারে না। আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি এবং আমার স্বাক্ষরিত রিপাের্টে আমি বিশ্বব্যাঙ্ককে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে অনুরােধ করেছি কারণ এখন এই কাজ চালানাে অন্যায় এবং অসম্ভবতাে বটেই, আর আমি নিজে তাে আমেরিকায় সিভিল রাইটস্ এর পক্ষে ও ভিয়েত্নাম যুদ্ধের বিপক্ষে। তাহলে আমি কি করে । পাকিস্তানের পুলিশ রাষ্ট্রের জঙ্গী এক নায়কত্বের হয়ে কাজ করি? আমি আর কখনাে পাকিস্তানে ফিরে। যাবাে না, যদিও স্বাধীন বাংলা দেশের জন্য কাজ করতে পেলে তাকে আমি সম্মানজনক ও আকর্ষণীয়। কাজ বলে বরণ করে নেব।”
আমার সময় হয়ে গিয়েছিল। যাবার আগে প্রশ্ন করলুম “বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। তােমার কি মনে হয়?” স্থির শান্ত গলায় টাইগারম্যান বললেন “আমি স্বাভাবিক ভদ্র লােক, হিংসা আমি ভালােবাসি না, আমি খুশী হতাম যদি ওখানে রাজনৈতিক সমাধান হত। কিন্তু বিশ্বাস কর, পদ্মায় লালরক্ত অনেক বয়েছে; তাকে এড়িয়ে বাংলার মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু মেনে নিতে পারে না। আবার ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর শিকারী বাজেরা বাংলাদেশকে ইচ্ছামত স্বাধীন হতেও দেবে না। তাই বাংলাদেশকে স্বাধীনতার জন্য লড়তে হবে, লড়তেই হবে। যদিও তা দশ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধ হয়ে । দাঁড়ায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং জঙ্গীশাহী সেখানে চলবে না আমি ঢাকা ও আশেপাশে এক মাসে অনেক বাড়ীতে গেছি। সর্বত্র মানুষ ছেলেবুড়াে মিলে স্বাধীন বাংলা রেডিও শোনে এবং মুক্তিবাহিনীর। জয়কে অভিনন্দন জানায়। মৃত্যুহীন এই মুক্তিস্বপ্নকে কে নিরস্ত করতে পারে?”
| বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১ : ১০ ! ২৪ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। চালের মণ ১০০ টাকা পাট কেউ কিনছে না।
মুজিবনগর, ২৩শে অক্টোবর সম্প্রতি আমাদের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা সফর করে এসেছেন। তার রিপাের্টে জানা যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সর্বত্র দারুণ খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। সর্বত্র খাদ্যের অভাবে মানুষের মধ্যে হাহাকার ও হানাহানি শুরু হয়েছে। বাঙালীর
প্রধান খাদ্য-শস্য চাল বাজারে আজ দুষ্প্রাপ্য। যে সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায় তার মূল্যও সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার অনেক উর্ধে। প্রতি সের চাল ২.৫০ পয়সা দামে আর প্রতি মণ ৯৫ থেকে ১০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। আগে এগুলির দাম ছিল মাত্র ৮৭ পয়সা। মণ ছিল ৩০/৩৫ টাকা। সর্বত্র হানাদার দস্যুদের অত্যাচারে সাধারণ বাঙ্গালীরা এবার চাল আবাদ করতে পারেনি। | ফসল যা হয়েছে তার অধিকাংশ হানাদার দস্যুরা ধ্বংস করে দিয়েছে। কেননা এগুলি মাঠে পাকলে তাদের ভয় কখন বুঝি বা মাঠের মাঝ থেকে মুক্তি বাহিনী হানাদার কুকুরদের উপর আক্রমণ চালায়। বাজার ঘাট কিছুই বসে না। যে সব এলাকা গ্রামের অতি অভ্যন্তরে যেখানে পশুরা সহজে প্রবেশ করতে পারে না সেখানে। সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্যে কিছু লােক জমা হয়। কিন্তু সূর্য ডােবার সাথে সাথে যে যার ঘরে ঢুকে যায় । সবই ভীত সন্ত্রস্ত হঠাৎ করে হয়তাে পাক-পশুরা এসে জনসাধারণের উপর গুলি চালায়। বাংলার পাট এবার তেমন জন্মে নি। রােদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চাষীরা যে পাট সংগ্রহ করে থাকে তারও আজ ক্রেতা নেই। ক্রেতারা এতদিন ছিল হয় পশ্চিমা শােষক। নয় বাঙ্গালী দালাল পা চাটারা। | পশ্চিমা ক্রেতাদের মধ্যে ইস্পাহানী, আদমজী, বাওয়ানী প্রমুখ শােষকরা আর বাংলাদেশের বিশ্বাসঘাতক দালালদের মধ্যে খান ব্রাদস, মান্না, রসিদ কোম্পনীরা এবার আর ব্যবসা করার সুযােগ নিচ্ছে না। তারা কোথাও কোন এজেন্ট বা অফিস স্থাপন করে পাট কিনছে না। তারা এদেশের ব্যবসা বাণিজ্যের আশায় ‘ছাই দিয়ে পরপারে পাড়ী জমাতে ব্যস্ত। তাই বাঙ্গালী কৃষকেরা দ্বারে দ্বারে তাদের | কষ্টের ধন ‘সােনালী আঁশ’ মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে হতাশা নিয়ে অবিক্রিত পাটের বােঝা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে। তাই বাঙ্গালী কৃষকেরা আজ দিশাহারা। একদিকে তাদের জ্বলতে হচ্ছে জটরের জ্বালায় অপর দিকে সহ্য করতে হচ্ছে হানাদার পাক বাহিনীর লেলিয়ে দেওয়া পশুদের পাশবিক অত্যাচার।
বাংলার ডাক ॥ ১:৫ ॥ ২৪ অক্টোবর ১৯৭১
আতঙ্ক : পদত্যাগের অভিপ্রায় প্রকাশ
| ঢাকা, ১৫ই অক্টোবর—গেরিলাদের হাতে পূর্ববঙ্গের প্রাক্তন গভর্ণর মুসলিম লীগ নেতা মিঃ। আবদুল মােনেম খানের মৃত্যুতে মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামী নেতৃবৃন্দের ও ডাঃ এ, এম মালিকের পুতুল মন্ত্রীসভার মন্ত্রীদের মধ্যে মনােবল ভেঙ্গে পড়েছে।
এইসব সংবাদে বলা হয় যে, মিঃ খানের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ডাঃ মালিক মন্ত্রীসভার মন্ত্রীরা এবং কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলিম লীগ ও জামাত-ই ইসলামী নেতারা পরিস্থিতি পর্যলােচনার জন্য একটি গােপন বৈঠক করে। এই বৈঠকে নাকি তারা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে। | তারা পদত্যাগ করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারে, এই ভয়ে তারা নাকি ডাঃ মালিককে এ সিদ্ধান্ত জানাতে সাহসী হচ্ছে না।
এই গােপন বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন জামাত-ই ইসলামের অধ্যাপক গােলাম | আজম, মুসলিম লীগের খাজা খয়ের উদ্দিন ও শফিউল ইসলাম, পি, ডি, পির নুরুল আমিন ও ফরিদ
আহমদ। | আরও জানা গিয়েছে যে, এইসব নেতাদের অধিকাংশই পূৰ্ব্ববঙ্গের প্রাক্তন গভর্ণরের শেষ কৃত্যে। উপস্থিত থাকতে পারে নি। তাদের ভয় মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদেরও অনুরূপ অব হা ঘটতে পারে।
| সংবাদ প্রকাশ যে, এমনকি সরকারের উর্দ্ধতন অসামরিক অফিসাররাও নিঃ খানের মৃত্যুর পর তাদের নিজ নিজ অফিসে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ (1) ! ১: ১৮ # ২৫ অক্টোবর ১৯৭১
অধিকৃত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ছড়াইয়া পড় : সৈয়দ আলতাফ।
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক জনাব সৈয়দ আলতাফ হােসেন | বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলে মুক্তিসংগ্রাম জনতার মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা জোরদারের জন্য দলীয় কর্মীদিগকে ছড়াইয়া পড়ার আহ্বান জানান।
| সৈয়দ সাহেব পার্টির কার্যনির্বাহক কমিটির বর্ধিত সভায় বক্তৃতা করিতে ছিলেন। তিনি বলেন, | জনতাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করিয়া গেরিলা যুদ্ধের সহিত একাত্ম করিয়া তুলিতে হইবে এবং | এই জন্য আজ জনতার দুর্দিনে দলীয় কর্মীদিগকে অবশ্যই জনগণের সহিত সব-সময় থাকিতে হইবে। | সৈয়দ সাহেব বলেন, আজ অবধি সংগ্রামের সকল স্তরে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় বিভিন্ন সমস্যা
ও বিভেদের সৃষ্টি হইয়াছে। সর্বাত্মক ঐক্য এবং বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটি গঠনের বিরুদ্ধে | সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠী বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চক্রান্ত চালাইতেছে। | তিনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়নের ভূমিকার ভূয়শী প্রশংসা করেন এবং বলেন যে, স্বার্থ সংশ্লিষ্ঠ মহল আজ আমাদের এই মিত্রদের সম্পর্কেও নানারকম বিভ্রান্তি ছড়াইতেছে।
নতুন বাংলা ॥ ১: ১১ | ২৮ অক্টোবর ১৯৭১
মুক্তিবাহিনী তাে যাদু জানতা হ্যায়’ | পাত্তা নেহি…. কিধার সে আতা হ্যায় আওর কিধার জাতা হ্যায় হামলােগ কেয়া করেগা।
মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। বেলা একটার দিকে ঢাকার মতিঝিল এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন পাঞ্জাবী মেজর। সাথে রয়েছে কেবলমাত্র তার জীপের ড্রাইভার। মেজরের জীপখানা যখন মতিঝিল টি এ্যাণ্ড টি কলেজের সামনে গেল তখন হঠাৎ কোথা থেকে খান দুই তিন গাড়ী এসে জীপের সামনে থেমে গেল। আর জীপের পেছনেও ছিল খান দু’য়েক মােটরগাড়ী। মেজর ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক রাস্তা ‘জ্যাম’ মনে করে নিজের জীপখানার গতি থামিয়ে দিলেন। সাথে সাথে চারিদিকে থেকে ৮/১০ জন যুবক এসে মেজর সাহেবকে ঠেসে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় মেজর পকেট থেকে রিভালবার বের করারও সুযােগ পেলেন না। ড্রাইভারত দুই ঘুষিতেই কুপােকাত। তারপর তরুণরা মুখ | বেঁধে গাড়ীতে তুলে মেজরকে যে কোথায় নিয়ে গেল তার হদিস আজো পায়নি।
কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ নয়। ক্যান্টনমেন্টে খবর পৌছাতে না পৌছাতেই সেনা বাহিনীর ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল চারিদিকে। তারা ঘিরে ফেলল সমগ্র এলাকা। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ হল
মেজরের । টি এ্যাণ্ড টি কলেজ থেকে শ’দুয়েক গজ দূরে মতিঝিল পীরজঙ্গী মাজারের পাশেই ছিল। সেনাবাহিনীর একটা চেক পােষ্ট। তার তত্ত্বাবধানে নিয়ােজিত ছিলেন একজন বেলুচ ক্যাপ্টেন। মেজরকে কোথাও না পেয়ে পাগলের মত ছুটে আসলেন সেখানে আরেক জন পাঞ্জাবী মেজর । ‘সামরিক ভাষায় করলেন বেলুচ ক্যাপ্টেনকে যত সব অশ্রাব্য গালি-গালাজ।
| ক্যাপ্টেন ধৈর্য ধরে সবই শুনলেন। তারপর সবিনয়ে বললেনঃ “মেজর সাব, মুক্তি বাহিনী তাে যাদু জানতা হ্যায়। পাত্তা নেহী উয়ােলােগ কিধার সে আতা হ্যায় আওর কিধার যাতা হ্যায় । মাগার স্রেফ গোলিয়া নজর আতা হ্যায়। হামলাে কেয়া করেগা?” | অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় ২৪, ২৫ বছরের এক বাঙ্গালী মহিলা ঢাকা থেকে একাকী যশাের যাচ্ছিলেন। গােয়ালন্দ ষ্টিমার ঘাটে তাকে দেখেই এক বেলুচ মেজর জিজ্ঞেস করলে তিনি একা যাচ্ছেন
কি না। মহিলা বেশ কয়েক বছর ভায়ের সাথে করাচী ছিলেন। তাই তিনি ভাল উর্দু বলতে পারেন। ইংরেজীত তিনি ভাল বলেনই । কেননা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ । যাক, অনেক কথাবার্তার পর তাদের যখন বিদায় হবার পালা আসল তখন মেজর মহিলাকে বললেন : “আপ হামারা লিয়ে। দোয়া কিজিয়ে কে হামলােগ জিন্দা রহে।” মহিলাও কম চালাক নন্। তিনি কথাবাত্তায় বুঝে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনের ব্যাপারে বেলুচ মেজর পিণ্ডির সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে। একমত নন্ । তাই মহিলা জবাবে রসিকতা করে বললেন : “আপ ভি হামারী লিয়ে দোয়া কিজিয়ে কে । হামলােগ জিত জায়ে।”
মেজর মহিলার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন । কিন্তু মুখে কিছু না বলে একটু মুচকি হেসে চলে গেলেন।
গত রবিবার যশাের ক্যান্টনমেন্টের অদূরে অপারেশন করে ফিরে আসার সময় চারজন মুক্তি। বাহিনী গেরিলা পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। সৈন্যরা তাদের ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু যার কাছে তাদের হাজির করা হয়েছিল তিনি ছিলেন একজন বেলুচ মেজর । তিনি মুক্তি বাহিনী। গেরিলাদের নিরস্ত্র করে অন্য সবাইকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেন। মুক্তি বাহিনী গেরিলারা অভুক্ত। আছেন সন্দেহ করে তিনি তাদেরকে চা-নাস্তায় আপ্যায়িত করলেন। তারপর ফিস ফিস করে বলেন। “জয় বাংলা মাত বােলিয়ে । উওতাে হিন্দু লােককো জয় হিন্দকা মাফিক হ্যায় । মাগার আপলােগ । স্বাধীন বাংলা বলিয়ে । আপলােগ স্বাধীন হাে যাইয়ে উস্কা বান্দা হামলাে ভি স্বাধীন হাে জায়েগা।’ কথাগুলাে শেষ হতে না হতেই মেজর হাত ইসারা করে মুক্তি বাহিনী গেরিলাদের কেটে পড়তে বল্লেন । মেজরের মন, মানস ও ইঙ্গিত বুঝতে বাঙ্গালী তরুণদের এতটুকুও বিলম্ব হলাে না। তারা মেজরকে সালাম জানিয়ে আস্তে কেটে পড়লাে বদ্ধভূমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে।
১৪ই অক্টোবর। দখলীকৃত ঢাকা থেকে মুক্ত এলাকায় পালিয়ে আসছিলেন এক বাঙ্গালী লােক। কুমিল্লা জেলার কসবার কিছু দূরে এসে দেখলেন ফেরী ঘাটের কাছে দাড়িয়ে আছে জনা পাঁচেক সৈন্য। ভয়ে ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কারণ, তার কাছে ছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলসহ কাগজপত্র। তাকে দেখেই সৈন্যদের একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাবেন? ঐ লােক আসল কথা না। বলে একটি জায়গার নাম করলেন। সংশ্লিষ্ট সৈনিক জানালেন তারা ওর কাছেই যাবেন। তারা চান যে তিনি তাদের সাথেই যান, কেননা সাথে একজন বাঙ্গালী থাকলে তাদের উপর হয়ত কোন বিপদ আসবে না। ভদ্রলােকের ভিতরে ভিতরে অনিচ্ছা থাকলেও বাইরে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। ইতি মধ্যে ঘটে গেল একটা ব্যাপার যার থেকে বাঙ্গালী ভদ্রলােক বুঝতে পারলেন যে, তার সাথে যিনি কথাবার্তা বলেছিলেন তিনি একজন বেলুচ মেজর। সেই বেলুচ মেজরকে অন্য একজন পাঞ্জাবী মেজর বহন করতে দিয়ে ছিলেন তার টুপি ও হাতের ছড়িটি। কিছুদূর গিয়েই তিনি মনে করলেন তিনি কেন। একজন পাঞ্জাবী অফিসারের টুপি ও ছড়ি বহন করবেন। তাই তিনি একটু ঘৃণা ভরেই সাথের একজন। পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে তার ছাড়া ভাই এর টুপি ও ছড়ি বহন করার হুকুম করলেন। কিন্তু যেভাবে ও ভঙ্গিতে তাকে আদেশটি দেওয়া হয়েছিল তাতে তিনি রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর বেলুচ । মেজর ও পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের মধ্যে প্রকাশ্য রাস্তাতেই খণ্ডযুদ্ধ বাধার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল। যার শেষ পর্যন্ত একজন পাঞ্জাবী হাবিলদার এগিয়ে এসে টুপি ছড়ি বহনের দায়িত্ব নিয়ে নেয় যার ফলে। একটা রক্তাক্ত সংঘাত পরিহার করা সম্ভব হয়।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৫ ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকার অভ্যন্তরে। —রেডিও সুইডেন
তিন দিন ব্যাপী বাংলাদেশ সফর শেষ করে নয়াদিল্লী ফিরে এসে সুইডেনের সাংবাদিক মিঃ লারগানার এরল্যাণ্ডসন মন্তব্য করেন যে, ভীত সন্ত্রস্ত ঢাকা শহর।
| রেডিও সুইডেনের প্রতিনিধিরূপে ঢাকা সফরের পর মিঃ এরল্যাণ্ডসন বলেন যে, সর্বত্রই পাক সেনাবাহিনী মােতায়েন রয়েছে তা চোখে পড়বেই। সমস্ত সুবিধাজনক স্থানে এমনকি ডাকঘরে ও হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেও সামরিক প্রহরা রয়েছে। হােটেলে ঢােকার সময় ও বাইরে আসার সময় তল্লাসী চালানাে হচ্ছে। | তিনি বলেন, ‘ঢাকা সন্ত্রাস কবলিত শহরে পরিণত হয়েছে। সূর্যাস্তের পূর্বেই দোকান-পাট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং এই সময়ে যুবকদের রাস্তায় দেখাই যায় না। | মিঃ এরল্যাণ্ডসন বলেন যে, যদি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ছাত্রের তালিকা রয়েছে কিন্তু ৩ থেকে ৪ শ ছাত্র ক্লাশে যােগ দেয়।
তিনি বলেন যে, সংবাদপত্রগুলির ওপর সেন্সরের কড়াকড়ি ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ’ শব্দটির সংবাদপত্রের চৌহদ্দীর মধ্যে কোন স্থান নেই। শেখ মুজিব সম্পর্কিত কোন সংবাদই খবরের কাগজে ছাপা হয় না।
তিনি আরও বলেন যে, সফররত সাংবাদিকদের পক্ষে পরিস্থিতির সঠিক চিত্র সংগ্রহ করা সম্ভব। নয়। ঢাকার বাইরে সফর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুক্তি বাহিনী ও তার কার্যকলাপের সংবাদ বিভিন্ন সূত্রে শহরে এসে পৌছায়। গেরিলাদের মাইন আক্রমণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ধ্বংসের সংবাদ ঢাকায় পৌছেছিল ।
মিঃ এরল্যাণ্ডসন বলেন, যেহেতু পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের হাতে ত্রাণ বাবদ সাহায্য বিলিবণ্টনের দায়িত্ব রয়েছে সেহেতু বিভিন্ন দেশের প্রদত্ত ত্রাণ সাহায্যের বিলিবণ্টন মােটেই আশাপ্রদ নয়। | তিনি এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেন যে, ত্রাণ বাবদ সাহায্যের বেশীর ভাগটাই পাক সেনারা ব্যবহার করছে।
জয়বাংলা (১) # ১ : ২৫ ! ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকার বুকে গেরিলা যােদ্ধাদের শত্রু নিধন অভিযান অব্যাহত
গত সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী গেরিলা যােদ্ধারা কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক প্রাক্তন গভর্ণর আবদুল মােনায়েম খানকে হত্যার মাধ্যমে যে সাফল্যজনক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন তা ক্রমেই তীব্রতর হয়ে ওঠছে। দখলীকৃত ঢাকার বুকে গেরিলা যােদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের ওপর প্রকাশ্যে মারাত্মক আক্রমণ চালিয়ে শত্রু চলাচলের সবরকম গতিবিধি প্রতিরােধ করে ফঁাদে আটকিয়ে। ফেলছেন।
গত ১৯শে অক্টোবর ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি ব্যাঙ্কের সম্মুখে পাকিস্তানী জঙ্গী। সরকারের তাবেদারদের একটি মােটর গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমাদের দুঃসাহসিক বীর তরুণরা প্রকাশ্যে টহলরত হানাদার সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে উক্ত গাড়ীর আসনের নীচে একটা টাইম বােমা’ বসিয়ে দেন। এর পর তাবেদাররা ব্যাঙ্কে লুটকৃত অর্থ সংক্রান্ত কার্যাদি শেষ করে মােটরে আসন গ্রহণ। করার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত করে উক্ত বােমা বিস্ফোরিত হলে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গাড়ীও
এক সঙ্গে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ঘটনাস্থলে ৫ জন তাবেদার খতম ও অন্য ১২ জন মারাত্মক আকারে জখম হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর অপেক্ষায় দুস্কর্মের শাস্তি ভােগ করছে।
জয়বাংলা (১) [১: ২৫ ! ২৯ অক্টোবর ১৯৭১
প্রাথরি অভাবে
| ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর উপ-নির্বাচন প্রহসন ফাসিয়া গিয়াছে। বাঙলাদেশের অধিকৃত এলাকা হইতে ৫০ জন প্রার্থী পাকিস্তানের “জাতীয় পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত” হইয়াছে বলিয়া পাক বেতারের খবরে প্রকাশ। কারণ? প্রার্থীর অভাব। পাক শাসকচক্র কয়েক লক্ষ লােকের এক একটি নির্বাচনী এলাকা হইতে একজনের বেশী “প্রার্থী” সংগ্রহ করিতে পারে নাই।
| উল্লেখযােগ্য যে, আওয়ামী লীগ দলের ৭৮ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নির্বাচন “দেশদ্রোহিতার” অভিযােগে বাতিল করিয়া এই সকল উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় “নির্বাচিতদের মধ্যে অনেকেই গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে শােচনীয় পরাজয় বরণ করিয়াছিল।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ১৭ ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
পাক সেনাদের চা পান নিষিদ্ধ হল।
২৯শে অক্টোবর, বিশ্বস্তসূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে জঙ্গীশাহী অবশেষে বাংলাদেশে হানাদারদের জন্য চা পান নিষিদ্ধ করেছে। এর কারণ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর চা। বাগানগুলির কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, তা ছাড়া মুক্তিযােদ্ধারা বহুসংখ্যক চা বাগান ধ্বংস করে দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে চা দুষ্পাপ্য হয়ে উঠছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, রাওয়ালপিণ্ডি, করাচী, ইসলামাবাদেও চায়ের ব্যাপক অভাব দেখা দিয়েছে। এ অভাব পূরণ করতে হলে জঙ্গীশাহীকে বিদেশ থেকে চা আমদানী করতে হবে তার জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার দরকার হবে। কিন্তু হালে জঙ্গীশাহীর ভাগাড় শূন্য। অস্ত্র শস্ত্র কেনাই দুষ্কর চা তাে দূরের কথা। এইসব দিকে বিবেচনা করেই জঙ্গীশাসক কর্তৃপক্ষ সেনাদের চা পান নিষিদ্ধ করেছে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১: ১১ ! ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলার পরীক্ষার্থীদের প্রতি হুশিয়ারী
বাংলাদেশের যেসব পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়াছে তাদের প্রতি মুক্তিবাহিনীতে যােগদানকারী ছাত্র যুবকের এক কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, দেশের শত্রু এইসব ছাত্রের বিশ্বাসঘাতকতা কখনই বরদাস্ত করা হবেনা। স্বাধীনতার ডাকে লক্ষ লক্ষ ছাত্রের যখন মা বাপ ভাই বােন আত্মীয়স্বজন স্বার্থ ত্যাগ করে অকাতরে প্রাণ দিয়ে চলছে তখন সুবিধাবাদী আর এক দল ছাত্র আরামে স্বার্থসিদ্ধি করবে এটা তারা সহ্য করতে পারে না। যুদ্ধের সময় লেখাপড়া …
সােনার বাংলা (১) ॥ ৮ : ৯ # ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
বাঙলাদেশের পরীক্ষার্থীরা সব পাশ
ওয়াকিবহাল মহলের খবরে প্রকাশ-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরের সমন্বয়ে কতিপয় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার কথা বিবেচনা করছেন। ইতিমধ্যেই বেশ
কিছু সংখ্যক শিক্ষক, অধ্যাপক বাংলাদেশ সরকারের অধীনে চাকুরী করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আবেদন করেছেন। | একই সূত্রে প্রকাশ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সমস্ত ছাত্র ছাত্রী। পরীক্ষা দেবার জন্য টাকাপয়সা জমা দিয়ে পরীক্ষার্থীর তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন তাদেরকে বাংলাদেশ। সরকার পাশ ঘােষণা করবার কথা গভীরভাবে বিবেচনা করছেন। অবশ্য একসঙ্গে সরকারী পর্যায়ে …।
সােনার বাংলা (১) # ১ : ৬ !! ৩১ অক্টোবর ১৯৭১
মােনেম খার শব কবর থেকে তুলে জলে নিক্ষেপ
ঢাকা, ২৯শে অক্টোবর নির্ভরযােগ্যসূত্রে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশের মুক্তিকামী। তরুণেরা পূর্ববঙ্গের প্রাক্তন গভর্ণর মােনেম খাঁর কবর খুলে তার শব বের করে উহা নদীতে নিক্ষেপ করেছেন। তরুণেরা নাকি বলেছেন সে, দখলদার বাহিনীর পুতুল ও কুইসলিংকে বাংলা দেশের মাটিতে রেখে পবিত্র ভূমি অপবিত্র করা চলবে না।
বাংলাদেশ (১) # ১ : ১৯ ১ নভেম্বর ১৯৭১
পাক সেনারা এখন মর্যাদার জন্য যুদ্ধ করছে।
ঢাকা, ২৯শে অক্টোবর : মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান আক্রমণে হয়রান ও পরিশ্রান্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা এখন কেবল তাদের মর্যাদার জন্যই লড়াই করছে বলে পাকিস্তানী স্থলবাহিনীর ইষ্টার্ন কমাণ্ডের। প্রধান, লেটন্যান্ট-জেনারেল নিয়াজী রাওয়ালপিণ্ডিতে সৈন্যবাহিনীর সদর দপ্তরে এক গােপন রিপাের্ট | পেশ করেছেন। | রিপাের্টে বলা হয়েছে যে, র্যাশনের অভাবে ও অপর্যাপ্ত ঘুমে পাকিস্তানী সৈন্যদের যুদ্ধ করার উদ্যম অনেকটা কমে গেছে এবং তারা এখন আর নতুন কোনাে ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক নয়। | রিপাের্টে আরও বলা হয়েছে, রাজাকারদের আর বিশ্বাস করতে পারছে না, কারণ তারা সব সময়েই প্রথম সুযােগেই বিশ্বাসঘাতকতা করতে আগ্রহী।
লেফটন্যান্ট-জেনারেল নিয়াজি তার রিপাের্টে আরও বলেন, সামরিক অফিসাররা কিংবা ডঃ। মালিকের সরকার কেউই পাকিস্তানী সৈন্যদের মনােবল বৃদ্ধি করতে পারেননি। তাদের মনােবল এখন একেবারে নিচে নেমে গেছে। | পাকিস্তানী সৈন্যরা অসামরিক নাগরিকদের কাছ থেকে মােটেই সমর্থন পাচ্ছে না। তারা তাদের। সুযােগ পেলেই হয়রান করছে।
বাংলাদেশ (১) ॥ ১; ১৯ ৪ ১ নভেম্বর ১৯৭১
নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন জঙ্গীশাহীর ব্যর্থতা চাপা দেওয়ার নয়া কৌশল
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
ইসলামাবাদের হানাদার জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা লইয়াই শুধু ফ্যাসাদে পড়ে নাই- ইসলামাবাদ সাম্রাজ্য লইয়াও মহা ফ্যাসাদে পড়িয়াছে বলিয়া নির্ভরযােগ্যসূত্রে খবর পাওয়া। গিয়াছে। জঙ্গীচক্র ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের বিক্ষুব্ধ বেলুচিস্তান এবং মুক্তিকামী পাখতুনদের এখন আর
বিশ্বাস করিতেছে না। কিংকর্তব্যবিমুঢ় জল্লাদশাহী এখন “আন্ধার ঘরে সবই সাপ” দেখিতে শুরু করিয়াছে। | বাংলাদেশে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত খান সেনাদের পরিবার পরিজন এবং আত্মীয় স্বজনগণও এখন জঙ্গীশাহীর উপর তীব্র ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ হইতে যে এক ডিভিশন সৈন্য প্রত্যাহার করিয়া ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে লইয়া যাওয়া হইয়াছে ইহাদের অধিকাংশই পশ্চিম-পাঞ্জাবী এবং অবশিষ্টদের মধ্যে কিছু সিন্ধি সৈন্য রহিয়াছে। কিন্তু বালুচ এবং পাঠান সৈন্য নাই। ভারতের সহিত সম্ভাব্য যুদ্ধের সুযােগে বিক্ষুব্ধ বালুচপাঠানগণ বিদ্রোহ ঘােষণা করিতে পারেন এই ভয়েই ইহাদিগকে বদলী করিয়া ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে নেওয়া হয় নাই । উক্ত এক ডিভিশন সৈন্যের মধ্যে পাঠান বালুচ সৈন্য না থাকায় পাঠান ও বালুচ মুলুকে জঙ্গীচক্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধুমায়িত হইয়া উঠিয়াছে।
| বাংলাদেশে যাহারা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে খতম হইতেছে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্য নিবাসী তাহাদের আত্মীয়-স্বজনের নিকট উহাদের মৃত্যুর খবর সম্পূর্ণ গােপন করিয়া রাখা হইতেছে। বাংলাদেশে ইহাদের অবস্থা সম্পর্কে যাহাতে তাহাদের আত্মীয় স্বজন কিছু জানিতে না পারে তজ্জন্য বাংলাদেশের , দখলীকৃত এলাকা হইতে হানাদার সৈন্যগণকে অবাধে চিঠিপত্র লিখিতেও অনুমতি দেওয়া হয় না। চিঠিপত্র কড়া সেন্সর করার পর ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে প্রেরণ করা হইয়া থাকে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে হানাদার নিহত সৈনিকদের লাশ ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে তাহাদের নিকট প্রেরণ করা হইত। তাহাতে বিক্ষুব্ধ হইয়া লাহাের রাওয়ালপিণ্ডির রাজপথে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে পুত্রহারা, স্বামীহারা ভ্রাতৃহারা আর পিতৃহীন নর-নারীর সরােষ বিক্ষোভ মিছিলের পর হইতে জঙ্গীশাহী বাংলাদেশ হইতে ইলামাবাদ সাম্রাজ্যে আর সৈনিকদের লাশ প্রেরণ করে না। বাংলাদেশের নদীতে ভাসাইয়া দেয় কিংবা মাটিতে গাঁথিয়া রাখে । অবশ্য ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে নিহত দৈনিকদের লাশ প্রেরণ না করার আরও একটি কারণ আছে। তাহা হইতেছে জঙ্গীশাহী এত লাশ আর বিমানে পাঠাইয়া কুলাইতে পারে না। | বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের মৃত্যু সংবাদ তাহাদের আত্মীয়-স্বজনের নিকট গােপন রাখার উদ্দেশ্যে ইদানীং জঙ্গীচক্র নিহত সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনদের সহিত এক নিদারুণ প্রতারণা করিয়া চলিয়াছে।
জানা যায়, জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা হইতে নিহত সৈনিকদের নামে তাহাদের আত্মীয়-স্বজনের নিকট নিয়মিত চিঠিপত্র লিখাইয়া থাকে। শুধু তাহাই নহে, নিহত সৈনিকদের আত্মীয়স্বজনের ঠিকানায় নিয়মিত কিছু টাকাও প্রেরণ করা হইয়া থাকে । | টাকা এবং চিঠি প্রেরণের মাধ্যমে জঙ্গীচক্র নিহত সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজনকে বুঝাইতে প্রয়াস পাইতেছে যে, তাহারা বাঁচিয়া আছে।
নিহত সৈনিকদের বেনামীতে লিখিত এইসব পত্রে লেখা হয় যে, তাহারা (সৈনিকরা) ভাল আছে এবং হিন্দুস্থানের দুশমনদের’ সহিত রীতিমত লড়াই করিয়া ‘আল্লাহর ধর্মকে বাচাইতেছে।’ | অপরদিকে ইসলামাবাদের হতাশাগ্রস্ত জঙ্গীচক্র বাংলাদেশে হানাদার সৈন্যদের প্রাণহানির আসল সংবাদ ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এখন রাত দিন জোর প্রচার করিতেছে যে, ইসলামাবাদের সৈনিকরা বাংলাদেশের অমুক স্থানে অমুক দিন একজন ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীকে হত্যা কিংবা গ্রেফতার করিয়াছে।
এইসব কাল্পনিক খবর প্রচার করিয়া জঙ্গীচক্র ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণের মনােবলকে জোরদার এবং বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের আত্মীয় স্বজনকে প্রতারণা করার প্রয়াস পাইতেছে । তদুপরি ভারতের সহিত যুদ্ধের জিগির তুলিয়া বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের আত্মীয়-স্বজন তথা
ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের স্বজনহারা জনসাধারণের মনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চালাইতেছে। প্রচারের গােলক ধাধা ধুম্রজাল সৃষ্টি করিয়া জঙ্গীচক্র বাংলাদেশে খান সেনাদের কচুকাটা হইয়া যাওয়ার খবরটি চাপা দিয়া চলিতেছে।
ওয়াকেবহাল মহলের মতে ভারতের সহিত যুদ্ধ বাধাইবার ফন্দিফিকিরের অন্তরালেও ইসলামাবাদের অসহায় জঙ্গীচক্রের বাংলাদেশে নিহত সৈনিকদের ব্যাপারটি চাপা দেওয়ার এক সূক্ষ্ম অপচেষ্টা নিহিত রহিয়াছে। বাংলাদেশে সুনিশ্চিত পরাজয়ের মুখে বৈদেশিক সাহায্য ঋণ ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধের মাধ্যমে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের কায়েমী স্বার্থ ২৩ পরিবারের তথা গােটা ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকে ঠুটো জগন্নাথে দাড় করানাের এবং বহু বৎসরের অধ্যবসায় ও মােটা অর্থ ব্যয়ে সুশিক্ষিত সৈনিকদের ক্ষয়ের কোন কৈফিয়ৎ ক্ষমতাউন্মাদ জঙ্গীচক্র ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণের নিকট দিতে পারিবে না। তাই তাহারা যেনতেন প্রকারে ভারতের সহিত একটি যুদ্ধ বাধাইয়া এক ঢিলে দুই পাখী মারিবার ফন্দী আঁটিয়াছে; একটি হইতেছে তথাকথিত পাক-ভারত বিরােধের ডামাডােলের মধ্যে বাংলাদেশ ইসলামাবাদ বিরােধকে চাপা দেওয়া এবং অপরটি হইতেছে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণকে বুঝানাে যে, ভারতের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া অর্থাৎ ‘পাকিস্তানকে জিন্দা’ রাখিতে গিয়া সৈন্য ক্ষয় হইয়াছে এবং অর্থনীতি পঙ্গু হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জঙ্গীচক্রের কোন ভাওতাবাজীই চলিবেনা। ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যের জনসাধারণ গভীর আগ্রহ সহকারে জঙ্গীচক্রের সকল কারসাজী নীরবে পর্যবেক্ষণ করিয়া চলিয়াছে। যেদিন আকাশ ভাঙ্গিয়া তাহাদের মাথায় পতিত হইবে সেইদিন ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যেও এক চরম হানাহানি শুরু হইতে বাধ্য এবং তাহা ইরাকের নূরী আস সাইদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইলেও কেহ বিস্মিত হইবে না।
বাংলার বাণী | ১০ সংখ্যা ৪ ২ নভেম্বর ১৯৭১
ঠাই নাই (নিজস্ব প্রতিনিধি)
আজীবন করাচী পিণ্ডি ইসলামাবাদের বিশ্বস্ত দালাল মােনেম খানের লাশ বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদানের রক্তস্থানপুত পবিত্র মাটি গ্রহণ করে নাই। আবর্জনার মত মােনেম খানের আবির্ভাব হইয়াছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দিগন্তে বাংলাদেশের নদীর স্রোত সহস্র অপবিত্র পুতি গন্ধময় আবর্জনা রাশি ধুইয়া মুছিয়া নেওয়ার মতই মােনেম খানের লাশ ও ধুইয়া লইয়া গিয়া দেশমাতৃকার। লাখাে লাখাে বীর সন্তানের রক্তে পূত পবিত্র বাংলাদেশের মাটিকে এই বেইমানের লাশের বােঝার অসহনীয় চাপ হইতে রেহাই দিয়াছে। | পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে প্রকাশ, সতী-সাবিত্রী প্রসবিনী বীরাঙ্গনা বঙ্গমাতার কৃতিসন্তান। মুক্তিযােদ্ধারা এই বেইমানের লাশ কবর হইতে তুলিয়া আবর্জনা রাশির সহিত নদীর জলে ভাসাইয়া দিয়াছেন । বাংলা মায়ের খাঁটি সন্তান মুক্তিযােদ্ধারা এই প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে, বাংলাদেশের মাটিতে এই বেইমানের লাশ রাখিয়া কিছুতেই বাংলাদেশের মাটি অপবিত্র করিতে দেওয়া যাইতে পারে না। হয়ত বাংলাদেশের শৃগাল কুকুর শকুনও এই বেইমানের লাশ স্পর্শ করিবে না। বাংলাদেশের। নদীনালার বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা এই লাশ ভাসাইয়া লইয়া যাইবে সাগরে। সাগরের স্রোতের সাথে। ইসলামাবাদের সাম্রাজ্যে উপনীত হওয়ার পূর্বে উহার অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে সাগরের বিক্ষুব্ধরাঘাতে! বিশ্ব সভ্যতা জানিয়া রাখুক—যে যুগে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বাংলাদেশের মাটিতে ঠাই পাইয়াছিল। এ যুগের বাংলাদেশের মাটিতে কোন বেইমানের লাশের স্থান হইবে না।
বাংলার বাণী ৪ ১০ সংখ্যা ২ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় পিতামাতার পাশে বঙ্গবন্ধু।
অসুস্থ পিতা মাতাকে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সম্প্রতি ঢাকায় আনা হয়।
অধিকৃত অঞ্চল হইতে বাংলার বাণীর ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বিশ্বস্ত সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়া এই খবর জানাইয়াছেন। বঙ্গবন্ধুর অশীতিপর পিতা এবং মাতা বর্তমানে দূরারােগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী ঢাকার পােস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল হাসপাতালে তাহারা চিকিৎসাধীন। কিছুদিন আগে পুত্রকে দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সম্প্রতি ঢাকায় আনা হয়। | অধিকৃত অঞ্চল হইতে বাংলার বাণীর ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি বিশ্বস্ত সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়া এই খবর জানাইয়াছেন। বঙ্গবন্ধুর অশীতি পর পিতা এবং মাতা বর্তমানে দূরারােগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী ঢাকার পােস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল হাসপাতালে তাহারা চিকিৎসাধীন। কিছুদিন আগে পুত্রকে দেখার বাসনা প্রকাশ করিয়া বঙ্গবন্ধুর বৃদ্ধ পিতা শেখ লুৎফর রহমান জেনারেল ইয়াহিয়ার নিকট একটি তারবার্তা পাঠাইয়াছিলেন। অনুমান করা হইতেছে যে, রােগা পিতার এই অনুরােধেই জল্লাদ ইয়াহিয়া স্বল্পকালের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করে। খবরে বলা হয় একটি বিশেষ সামরিক বিমানে করিয়া কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে ঢাকায় আনা হয়। রাত্রি দুইটার সময় ঢাকা নগরী যখন গভীর নিদ্রায় অচেতন, সেই সময় শেখ সাহেবকে হাসপাতালে তাঁহার পিতা মাতার শয্যাপার্শ্বে আনা হয় এবং প্রায় ভাের পাঁচটা পর্যন্ত তাহাকে সেখানে রাখা হয়। এই সময় বঙ্গবন্ধুর পত্নী এবং এক বােন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন। ভােরে ভােরে বঙ্গবন্ধুকে আবার সামরিক প্রহরায় বিমান বন্দরে লইয়া যাওয়া হয় এবং সেখান হইতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাইয়া দেওয়া হয়।
বাংলার বাণী ॥ ১০ সংখ্যা ॥ ২ নভেম্বর ১৯৭১
হােলি ফ্যামিলি হাসপাতাল হস্তান্তরের নেপথ্য কাহিনী।
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় হানাদার বাহিনী কবলিত ঢাকা বেতারের খবরে দাবী করা হয়, ঢাকা নগরীর ইসকাটন এলাকায় খৃস্টান পাদ্রীদের প্রতিষ্ঠিত এবং তাহাদের দ্বারাই পরিচালিত হােলি ফ্যামিলি হাসপাতালটি কর্তৃপক্ষ দখলীকৃত এলাকার তাঁবেদার সরকারের হাতে অর্পণ করিয়াছে। হাসপাতাল হস্তান্তরের খবরটি ঢাক ঢোল সহকারে প্রচার করিয়া শত্রু কবলিত ঢাকা বেতার প্রকারান্তরে এই কথাই জাহির করার কৌশেষ করিয়াছে যে, তাবেদার সরকারের উপর খৃস্টান সমাজের অগাধ আস্থা রহিয়াছে। কিন্তু আসলে ইহা ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী এবং উহার জারজ সরকারের আরও একটি জঘন্য জালিয়াতী ছাড়া আর কিছুই নয়। | ঢাকার জনৈক সিনিয়র ডাক্তারের নিকট হইতে প্রাপ্ত খবরে হাসপাতাল হস্তান্তরের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটিত হইয়া পড়িয়াছে। বলাবাহুল্য যে উক্ত ডাক্তার নিজেও হােলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন শুধু তাহাই নহে, দখলীকৃত এলাকায় খৃস্টান সমাজ কি এক নিদারুণ অভাব অনটন, নির্যাতন আর বিভীষিকার মধ্যে দিনাতিপাত করিতেছেন তাহারও করুণ ইতিহাস জানা গিয়াছে।
বিগত ২৫শে মার্চ ঢাকায় ইসলামাবাদের রক্তপিপাসূ হায়েনা বাহিনীর নরমেধযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর হইতে হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তারগণ আত্মগােপন করিয়া প্রাণ রক্ষা করেন। অবশ্য হায়েনা বাহিনী হাসপাতালের নার্সদেরও রেহাই দেয় নাই। কয়েকজন যুবতী নার্সকে ধরিয়া তাহারা ক্যান্টমেন্টের বেশ্যালয়ে লইয়া যায় এবং তাহাদিগকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করে। কয়েকজন ডাক্তারও নিখোঁজ হয় এবং অদ্যাবধিও তাহাদের কোন খোজ খবর নাই। তাহারা জানােয়ার বাহিনীর হাতে নিহত হইয়াছেন বলিয়া আশঙ্কা করা হইতেছে।।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার পাকসেনা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে গুরুতরভাবে আহত হয়। জঙ্গীশাহী ক্যান্টনমেন্টের সামরিক হাসাতালে উহাদের ঠাই দিয়া কুলাইতে পারে নাই।
ইহার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রােগী দিগকে জোর করে মৃত্যুশয্যা হইতে তুলিয়া দিয়া কামান বন্দুকের গর্জনে কম্পিত ঢাকা নগরীকে অবশ্যম্ভবী মৃত্যুর দূর্গে ঠেলিয়া দিয়া আহত খানসেনাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অতঃপর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালেও আহত সেনাদের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালও সেনাবাহিনীর দখলে নেওয়া হয় । সেনাবাহিনীর আহত অফিসারদের চিকিৎসার জন্য খৃস্টান পাদ্রীদের দ্বারা বিনা মুনাফায় ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পরিচালিত ইসকাটন এলাকায় সুরম্য এবং অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জাম সজ্জিত এই হােলি ফ্যামিলি হাসপাতালটি দখল করা হয়।
| প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, এই হাসপাতালে রােগীদের নিকট হইতে শ্রেণীভেদে একটি নির্দিষ্ট হারে চিকিৎসার খরচ নেওয়া হইত। রােগীদের এই হাসপাতালে ডিসপেনসারী হইতেই ঔষধ ক্রয় করিতে হইত এবং বাজারের দুর্লভ ঔষধও এই হাসপাতালের ডিসপেনসারীতে পাওয়া যাইত। খৃস্টান। মিশনারী সংস্থা সরাসরি বিদেশ হইতে প্রয়ােজনীয় ঔষধপত্র আমদানী করিয়া হাসপাতালে মজুত রাখিত। বস্তুতঃ ঢাকায় হােলি ফ্যামিলি হাসপাতালটি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ও নির্ভরযােগ্য চিকিৎসা কেন্দ্র ছিল। | এই হাসপাতালটির যাবতীয় খরচ পরিচালনার জন্য প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ২ লক্ষ টাকা ব্যয় হইত বলিয়া জানা যায় । কিন্তু হানাদার বাহিনীর আহত অফিসারদের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালটি উহারা দখল করিয়া লয়। হাসপাতালের ডিসপেনসারীর যাবতীয় ঔষধ বিনা মূল্যে ব্যবহৃত হয়। এমন কি রােগীদের পথ্যও উহারা বিনামূল্যে খাইয়া ফেলে এবং ডাক্তার ও নার্সগণকে আটকাইয়া রাখে। | হাসপাতালের আয় বন্ধ হইয়া যাওয়ায় সুইপার, দারােয়ান, মালীসহ হাসপাতালের সকল স্তরের কর্মচারীর বেতন বাকী পড়িয়া থাকে। হাসপাতাল তহবিলে জমা সমুদয় অর্থ আহত খানসেনাদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় করা হয়। গত ৫ মাস ব্যাপী হাসপাতালের স্টাফদের বেতন বাকী । অবশ্য ইহার মধ্যে অনেকেই সুযােগ সুবিধামত প্রাণ লইয়া পলাইয়া গিয়াছেন। খৃস্টান মিশনারীদের দ্বারা। বাংলাদেশে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং কলকারখানাগুলি বন্ধ হইয়া পড়ায় তাহাদের। আয়ের সকল পথ রুদ্ধ হইয়া পড়ে। হাসপাতাল আঙ্গিনার মনােরম বাগানটিও জঙ্গলে ভরিয়া উঠে।
সামরিক কর্তপক্ষ হাসপাতালের যাবতীয় ব্যয় ভার বহনের জন্য পাদ্রীদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করিতে থাকে। হাসপাতালের আয়ের পথ বন্ধ হইয়া পড়ায় পাদ্রীগণ উপায়ন্তর না দেখিয়া হােলি। ফ্যামিলি হাসপাতালের পরিচালনার ভার তথা সকল দায় দায়িত্ব অবশেষে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হন। এই হইল হােলি ফ্যামিলি হাসপাতাল হস্তান্তরের অন্তরালের নিগূঢ় রহস্য। আর ইহাকেই পশ্চিম পাঞ্জাবী হানাদার কবলিত ঢাকা বেতার হইতে আনন্দ গদ গদ স্বরে প্রচার করা হয় যে হােলি ফ্যামিলী হাসপাতাল খৃস্টান পাদ্রীগণ সরকারের হাতে অর্পণ করিয়াছেন তথা আহত হানাদার সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য সরকারের প্রতি আস্তার নিদর্শন স্বরূপ উহা উপহার দিয়াছেন। | উল্লেখযােগ্য যে হানাদার বাহিনীর হামলার পর হইতে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্য কলকারখানার অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় খৃস্টান সমাজের জীবিকার সকল পথ রুদ্ধ হইয়া যাওয়ায় খৃস্টান সমাজ আজ বিপন্ন হইতে চলিয়াছে। বিশেষ করিয়া নদীতে মাছ শিকাররত খৃস্টান। জেলেদের মুক্তিযােদ্ধা তথা হানাদারদের গুলী করিয়া নদীতেই ভাসাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
জল্লাদ বাহিনীর কামান-বন্দুক, মেসিন গানের মুখামুখী দাঁড়াইয়া নিহত আত্মীয় স্বজনের ব্যথা। কাতর এই খৃস্টান সমাজ জল্লাদশাহীর উপর আস্থার নিদর্শন স্বরূপ হাসপাতাল উপহার দিবেন ইহা।
| কোন গাধাও বিশ্বাস করিবে না। কেবল ডাঃ মালেকের মত ইয়াহিয়ার গাদ্দারদের পক্ষেই ইহা বিশ্বাস। করা এবং প্রচার করা সম্ভব।
বাংলার বাণী ॥ ১০ সংখ্যা ৪ ২ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় হানাদার জল্লাদের নতুন কৌশল
জল্লাদ ইয়াহিয়ার হানাদার সেনাবাহিনী চরম পরাজয় ও নিশ্চিন্ত মুখে পেীছিয়া আবার তাহাদের নারকীয় হত্যা যজ্ঞের জঘণ্য খেলা শুরু করিয়াছে। জাঙ্গীচক্রের দুর্ভেদ্য দূর্গ বলিয়া কথিত ঢাকা শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের সুতীব্র গেরিলা আক্রমণে দিশাহারা হইয়া হাদানার জল্লাদ বাহিনী সম্প্রতি ঢাকার উপকণ্ঠে কয়েকটি গ্রাম পােড়াইয়া দিয়াছে হত্যা করিয়াছে প্রায় তিনশত গ্রামবাসীকে। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা গেরিলা কম্যান্ডোদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতা মােকাবেলা করার জনই জল্লাদরা এই সব নিরপরাধ গ্রামবাসীকে হত্যা করিয়াছে পােড়াইয়া দিয়াছে তাহাদের ঘরবাড়ি।।
| প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা গিয়াছে নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শেষের দিকেই দখলদার জানােয়াররা এই পৈশাচিক আক্রমণ চালায় এবং ঢাকার উত্তরে একদিনেই ৩০ জনকে হত্যা করে। | মার্কিন সংবাদ সরবরাহ সংস্থা এসােসিয়েটেড প্রেসের একজন আলােকচিত্র শিল্পী ঢাকার প্রায় ৭ মাইল উত্তরে তিনটি গ্রাম পরিদর্শন করিয়া দেখিতে পান, গ্রামের অধিকাংশ কাঁচা ঘর বাড়িই ভষ্মীভূত হইয়াছে।
তিনি বলেন পাকিস্তানী সৈন্যরা তাহাকে অন্যান্য গ্রামগুলি পরিদর্শন করিতে দেয় নাই। কয়েকজন গ্রামবাসী এই মার্কিন আলােকচিত্রীকে জানা।। প্রায় ৫০০ জন খানসেনা তিন বার এই গ্রামগুলির উপর আক্রমণ চালায়।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়িতে খানসেনারা এ্যানেড নিক্ষেপ করে। যেসব মানুষ জ্বলন্ত ঘর। হইতে বাহির হইয়া পলাইয়া যাইবার চেষ্টা করে তাহাদেরকে খান-বাহিনীর পশুরা … মুজিবনগরে এই ধরণের আরাে খবর আসিয়া পৌছিতেছে। বিবরণে জানা যায় খান সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের ক্রমাগত অগ্রগতির মুখে ঢাকা শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরাে জোরদার করার প্রস্তুতি লইতেছে। তাহারা শহরের চারিদিকে শহর হইতে ৪ মাইল দূরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ স্থাপনের পরিকল্পনা করিতেছে। | নদী বিধৌত বাংলাদেশের নদীর উপর সেতুগুলি আজ আর অক্ষত নাই ফেরীঘাটগুলি মুক্তিযােদ্ধারা ক্রমাগতঃ দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালাইয়া চলিয়াছে। অধিকৃত এলাকার যােগাযােগ ব্যবস্থা বস্তুতঃ সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
| বাংলার বাণী ॥ ১০ সংখ্যা ৪ ২ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকা থেকে পাক মেজর অপহৃত
(নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত)
মুজিবনগর, ৩রা নভেম্বর : গত এক সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা প্রকাশ্য দিবালােকে ঢাকা। শহরের রাস্তা থেকে পাক সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে অপহরণ করে নিয়ে গেছেন এবং অপর একজন মেজরের গাড়ী টাইম বােমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। | ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের তৎপরতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, রাত্রি বেলা দূরে থাক, দিনের বেলাও পাক সৈন্যরা ভয়ে রাস্তাঘাটে বেরােয় না।
ঢাকা শহরে টি এণ্ড টি কলেজের সামনে একজন মেজর ‘ট্রাফিক জাম’ এর দরুণ গাড়ী নিয়ে আটকা পড়ে। পেছনের একটা মােটর গাড়ী থেকে সাত আট জন যুবক এসে মেজরের গাড়ীর উপর | ঝাপিয়ে পড়ে। এক ঘুষি মেরে তারা ড্রাইভারকে ফেলে দেয় এবং মেজরকে টুটি চেপে ধরে। এতই | আকস্মিকভাবে ঘটেছে যে ঘটনাটা, মেজর আত্মরক্ষার কোন সুযােগই পাননি, এমনকি নিজের | রিভলভারটাও হাতে নিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত গেরিলারা মেজরের চোখ মুখ বন্ধ করে তাকে নিয়ে উধাও হয়ে যায়। | ঢাকার মতিঝিল এলাকায় হাবিব ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উঠাতে এসে অপর একজন মেজর। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের শিকার হন। গাড়ী রেখে মেজর ব্যাঙ্কের ভিতর ঢুকে পড়েন তখন মুক্তিযােদ্ধারা টহলদাররত সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে গাড়ীর চাকার নীচে একটা টাইম বােমা রেখে যায় । মেজর টাকা নিয়ে গাড়ীতে এসে বসলে আকস্মিকভাবে টাইম বােমার বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে পাঁচজন সঙ্গীসহ মেজর ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
লণ্ডনের কোন এক সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, গত সপ্তাহে আশিজন মুক্তিযােদ্ধা প্রকাশ্য দিবালােকে ঢাকার রাস্তায় গেরিলা তৎপরতা চালিয়েছে।
এছাড়া মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী গেরিলারা ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট বিল্ডিং ঢাকাস্থ নিৰ্বাচনী | অফিস ভবনে বােমা নিক্ষেপ করেছে। নির্বাচনী অফিসে নৈশ প্রহরী নিহত ও একজন গুরুতর রূপে আহত হয়।
অমর বাংলা (১) ॥ ১ : ১ | ৪ নভেম্বর ১৯৭১
লাকসামের ৩টি বৌদ্ধগ্রাম জনশূন্য।
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানার অন্তর্গত আলীশ্বর, দুপচর, বড়ইগাঁও প্রভৃতি বৌদ্ধগ্রামগুলাে পাক সৈন্যের অত্যাচারের ফলে একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়েছে। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ, পাক | সৈন্যেরা আলীশ্বরের বৌদ্ধ মন্দিরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে। গুলী করে ছয়জন নিরীহ বৌদ্ধকে হত্যা করেছে উক্ত গ্রামগুলাের বৌদ্ধ জনসাধারণ দলে দলে শরণার্থী হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রেসিডেন্ট ও ঢাকাস্থ কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরাে পাক জঙ্গীশাহীর পক্ষ থেকে উক্ত বৌদ্ধ গ্রামগুলাের ধ্বংসলীলা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে তিনি উক্ত গ্রামগুলাের অবস্থা জানাবার জন্যে একজন। বৌদ্ধেরও দেখা পাননি।
আগরতলায় আগত বৌদ্ধ শরণার্থীদের জন্যে তেলিয়ামুড়ার ও তাবাড়ীতে বিশেষ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বলে আলীশ্বর বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ জানিয়েছেন।
| অমর বাংলা ॥ ১ : ১ ] ৪ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে গ্রেণেড আক্রমণ
আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সংখ্যক দালাল প্রকৃতির ছাত্রছাত্রী মুক্তি সগ্রামের পিঠে ছুরিকাঘাতের উদ্দেশ্যে হানাদার সরকারের সাথে হাত মিলাতে ক্লাশে যােগদান করতে থাকে। শিক্ষকবিহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী (যাদের অধিকাংশ অবাঙালী) জটালা করতে থাকলে আমাদের দুর্ধর্ষ বীর যােদ্ধারা গত ৮ তারিখে দিন দুপুরে
গ্রেণেড নিক্ষেপ করলে দালালরা প্রাণ বাঁচানাের জন্য যে যেদিকে পারে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এর পর থেকে আর কোন দালাল বিশ্ববিদ্যায়ের চত্বরে প্রবেশ করতে সাহস পায়নি।
জয়বাংলা (১) ১ : ২৬ ৫ নভেম্বর ১৯৭১
বােমাঃ বােমাঃ বােমাঃ নির্বাচনী প্রহসন খতম
১লা নভেম্বর রাত্রে ঢাকায় নির্বাচনী কমিশনের অফিসে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা প্রচণ্ড বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। ফলে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। বােমা বিস্ফোরণের পর নির্বাচন অফিসের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৬ 4 ৫ নভেম্বর ১৯৭১।
এবার নির্বাচন কমিশনের অফিসই খতম
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
রাজারবাগ পুলিশ কোয়ার্টার্সের অতি নিকটে অবস্থিত নির্বাচন কমিশনারের অফিসটি গত রবিবার মধ্যরাত্রিতে দশ জন বীর গেরিলা বােমা ও আগ্নেয়াস্ত্র সহ আক্রমণ করিয়া বিধ্বস্ত করিয়াছে। ফলে নির্বাচন কমিশনের সকল কাজকর্ম বন্ধ হইয়া গিয়াছে। পাকিস্তান সরকারের সূত্রে প্রাপ্ত খবর পরিবেশন করিয়াছে মার্কিন বার্তা প্রতিষ্ঠান অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস। উল্লেখযােগ্য যে, নির্বাচন কমিশনের দপ্তর। এখন তথাকথিত উপনির্বাচনে ব্যস্ত থাকার কথা।
একে তাে একজনের বেশি প্রার্থী না পাওয়ার দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় উপ নির্বাচন ফাসিয়া গিয়াছে, তার উপর নির্বাচনী অফিসটিই অচল হইয়া যাওয়ায় ইয়াহিয়ার উপনির্বাচন মাদারির খেল এখন এক যে করুন প্রহসনে পরিণত হইয়াছে।।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ১৮ ॥ ৭ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষ অসাগরে ভাসছে
৭০’এর সর্বনাশা বন্যায় বাংলাদেশের সন্দ্বীপ, হাতিয়া, নােয়াখালী, ভােলা ও পটুয়াখালীর। চরাঞ্চলের ১৫ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিল। ৭১’এ আবার সেই সর্বনাশা ঘুর্নিঝড় ও বন্যায় ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ২৫ হাজার মানুষ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেল। ঈশ্বরের এই নির্মম পরিহাসে ভারতের মানুষ যেমন ব্যথিত ও মর্মাহত তেমনি বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষও শােকাহত।
| বাংলাদেশ আজ মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত, রক্তের সাগর পেরিয়ে চলেছে আজ বাংলার সংগ্রামী মানুষ—তা সত্ত্বেও উড়িষ্যার এই সাম্প্রতিক মর্মান্তিক বিপর্যয়ে বাংলার মানুষও অশ্রু সাগরে ভাসছে। বাংলার মানুষ আশা করে উড়িষ্যার দুর্গত মানুষের প্রিয়জন হারানাের করুণ আর্তি পৃথিবীর মানুষকে ব্যথিত করে তুলবে। বন্যাদুর্গত অঞ্চলে প্রিয়জন হারিয়েও এখনও মৃত্যুর সঙ্গে যারা জীবনপণ লড়াই করে চলেছে, সেইসব আর্তের সেবায় অবিলম্বে পৃথিবীর মানুষ এগিয়ে আসবে, বাংলাদেশের মানুষ এই আশা প্রকাশ করে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ৪ ১ : ১২ [ ৭ নভেম্বর ১৯৭১
মােনেমের লাশ উধাও
| আইয়ুবের পােষ্যপুত্র কুখ্যাত মােনায়েমকে বাংলার মাটিতে দাফন করা হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল করে তার লাশ নেই-বাংলার মাটি বেঈমানকে গ্রহণ করবে না।
বাংলাদেশ (১) ১ : ২ ৭ নভেম্বর ১৯৭১
| প্রলংঙ্করী ঝড়ে বাংলার উপকূল আবার বিধ্বস্ত দুর্গত মানবতার হাহাকার
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বাংলার দক্ষিণ উপকুল আবার বিধ্বস্ত হইয়াছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরের বিপুল ক্ষতি হইয়াছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আবার গৃহহীন হইয়া পড়িয়াছে। কত প্রাণ, কত | সম্পত্তি নষ্ট হইয়াছে, জঙ্গীশাহী এখনও সেই হিসাব চাপিয়া রাখিয়াছে।
| জানা যায় যে, ঢাকার সহিত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ায় নাকি জঙ্গীশাহী | কোন সঠিক তথ্য জানাইতে পারিতেছে না।
| দুর্গত মানুষ কিভাবে রহিয়াছে, উহা জানিবার কোন উপায় নাই । দূর্গত মানবতার ফরিয়াদ বিশ্ব | জানিতে পারিবে না।
নতুন বাংলা ॥ ১: ১৩ + ১১ নভেম্বর ১৯৭১
পত্র-পত্রিকার দৃষ্টিতে নির্বাচন-প্রহসন
বার্তা প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্রগুলি বাংলাদেশের | অধিকৃত অঞ্চলে জঙ্গীশাহী আয়ােজিত তথাকথিত ‘উগ্র নির্বাচন’—এর ন্যায্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ | করিয়াছে। এইসব পত্রিকার মধ্যে রহিয়াছে ‘ডন’, ‘কোহিস্থান’ ও ‘আজাদ’।
করাচীর ‘ডন’ পত্রিকায় ভূটোর পিপলস পার্টির ৬ জন প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে বিস্ময়। প্রকাশ করা হয়। ৩ মুসলিম লীগ, পি-ডি-পি ও জামাতে ইসলামী সমন্বয়ে গঠিত জোট ঐ ৬টি আসন হইতে রাতারাতি তাহাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করিয়া লয়। এবং জোটের নেতা নূরুল আমিন নাকি এই সম্পর্কে কিছুই জানিতেন না। | লাহােরের দৈনিক উর্দু পত্রিকা ‘কোহিস্থান অভিযােগ করেন যে, ভুট্টো ঐ ৬টি আসন লাভের জন্য ২২ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়াছেন। পত্রিকাটির মতে এই টাকা খাইয়াই ঐ জোটের প্রার্থীরা নাম প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছে।
নতুন বাংলা ॥ ১: ১৩ | ১১ নভেম্বর ১৯৭১
এবার কিশােরদের হাতে রাইফেল
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
| চট্টগ্রাম, ১২ই অক্টোবর-সাত জন কিশাের রাইফেল দেখিয়ে চট্টগ্রামে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কটিকে সম্পূর্ণ ভাবে দখল করে রাখে এবং প্রায় ৪০ হাজার পাকিস্তানী টাকা নিয়ে নিরাপদে চলে আসে।
ব্যাঙ্কের কাজকর্ম স্বাভাবিক ভাবে চলাকালে এই কিশাের দলটি ব্যাঙ্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে। রাস্তার পাশে একটা গাড়ী তৈরী রেখে এসেছিল। টাকা নিয়ে সেই গাড়ী করে কিশাের দল আত্মগােপন করে।
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১:৪ ১১ নভেম্বর ১৯৭১
কুমিল্লায় পাকচক্রের স্যাভর জেট ব্যবহার
মুজিবনগর, ১৯শে অক্টোবর কুমিল্লা জেলার সালদা অঞ্চলে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর চারটি স্যাভর জেট কয়েকশত পাউণ্ড বােমা বর্ষণ করে। জঙ্গীশাহীর এই বােমা বর্ষণের ফলে শত শত গ্রামবাসী গৃহহীন হয়ে পড়ে এবং প্রচুর লােক জন মারা যায় বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
সাপ্তাহিক বাংলা # ১:৪৪ ১১ নভেম্বর ১৯৭১
আরও দুজন পাক চমু খতম হােল।
মুজিবনগর, ৯ই নভেম্বর ঢাকা থেকে আমাদের সংবাদদাতা জানিয়েছেন, গত রবিবার নারায়নগঞ্জে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত (উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী) সদস্য সুলতান উদ্দিন খান এবং সরকার সমর্থিত শান্তি কমিটির সদস্য আমির হােসেন মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়েছে। | মহানগরী ঢাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের একটানা ২৪ ঘণ্টা ব্যাপী অভিযানের ফলে দুটি এয়ার লাইনস্ অফিসও একটি রাজাকার শিবির বিধ্বস্ত হয়। বিমান সংস্থা দু’টি হােল, পি, আই, এ, এবং মতিঝিল এয়ার লাইন্স।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে ইতিপূর্বেও মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকায় এবং ইলেকশন কমিশনারের অফিস ও পাকিস্তান কাউন্সিল ভবনে বােমা বিস্ফোরণ ঘটে।
| সাপ্তাহিক বাংলা ১ : ৪ | ১১ নভেম্বর ১৯৭১
শুরু হইয়া গিয়াছে। সুলতানুদ্দীন খতম (বিশেষ প্রতিনিধি)
| ঢাকা, ১০ই নভেম্বর। শুরু হইয়া গিয়াছে। জঙ্গীশাহীর নির্বাচনী প্রহসনের ভাগীদারদের খতম অভিযান শুরু হইয়া গিয়াছে। তথাকথিত উপ-নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সুলতানুদ্দীন খান ঢাকার অদূরে মুক্তি সেনাদের হাতে গুলী খাইয়া মরিয়াছে। | মুক্তি বাহিনী অন্যান্য সদস্যদেরও ধাওয়া করিতেছে। এইসব সদস্য গ্রামে থাকেনা। তাহারা শহরে সামরিক বাহিনীর ছাউনীর আশে পাশে আস্তানা লইয়াছে। কিন্তু সেইসব স্থানও আর নিরাপদ নহে।
ঢাকায় এখন মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা পূর্বাপেক্ষা জোরদার । রাজাকারের দলে ভয়ে তটস্থ। রাতে তাহারা শিবিরের বাহিরে যাইতে ভয় পায়।
শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করিতেছে। সম্প্রতি স্পীকার আবদুল জব্বারের বাড়ীর সম্মুখে বােমা পড়ে, এফ, এ, খানের বাড়ীর নিকটে জনৈক মেজরকে আচমকা আক্রমণ ও খতম করে (রােড নম্বর ১৪ নং ধানমণ্ডি, আর এ)। জনৈক কর্নেলের বাড়ী আক্রমণ, ই,
পি, আর হেড কোয়াটার্সের সামনে দুইটি মাইন বিস্ফোরণ, বাণিজ্যিক এরিয়া এবং নিউ মার্কেটের বােমা পড়ে! প্রভৃতি মুক্তি বাহিনীর গেরিলা কর্মতৎপরতা বৃদ্ধিরই লক্ষণ। ফলে যত রকমের রঙ বেরঙের দালাল বাংলার মাটিতে তথা, ঢাকায় পা রাখুক না কেন সেদিন খুব বেশী দূর নয় যে দিন মুক্তি বাহিনী …
নতুন বাংলা + ১; ১৩ ১১ নভেম্বর ১৯৭১
বাস্তুহারাদের মাঝে ৪০ হাজার টাকা বিতরণ।
(আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত)
পাকসেনাদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ও ঢাকা সদর উত্তর। মহকুমার হাজার হাজার মানুষকে রিক্তহস্তে পথে প্রান্তরে, বনে জঙ্গলে, খােলা আকাশের নীচে আশ্রয়। নিতে হয়েছে। বাড়ীঘর ছেড়ে জমিজমা ত্যাগ করে এরা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলছেন। ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণ ও ঢাকা সদর উত্তর মহকুমার মহান মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক জনাব আফছার উদ্দীন আহমেদ এঁদের দুঃখ, কষ্ট দেখে মর্মাহত হয়ে যথাসম্ভব সাহায্য করে চলছেন। এ যাবত অধিনায়ক নিজহাতে দুখী বাস্তহারাদের মাঝে ৪০ হাজার টাকা বিতরণ করেছেন। তিনি অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে টাকা বিতরণের পর বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্যই লড়ছি না বাংলার মানুষকে বাচাবার জন্য ও লড়ছি। কাজেই আমরা যদি গরীব দুঃখীদের সাহায্য না করি তবে তারা কোথায় গিয়ে দাড়াবে? তিনি আবেগ সিক্ত কণ্ঠে আরও বলেন, আমি না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু আমার দেশের গরীব দুঃখী মানুষদেরকে না খেয়ে থাকতে দিতে পারি না।
জাগ্রত বাংলা ॥ ১: ৬ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
মার্কিন সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকা নগরী। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী সৈন্যদের সমস্ত আরাম হারাম করে দিয়েছেন।
সিকাগাে ডেইলি নিউজ পত্রিকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক আর্নেষ্ট উইথরােল ‘ঢাকায় পাক জান্তা শান্তিতে নেই’ শিরােনামায় এক নিবন্ধে বলেন, ‘মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে।’
ভিয়োম যুদ্ধের সময় সংবাদদাতা আর্নেস্ট উইথরােল সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে এক প্রবন্ধ লেখেন।
বাংলাদেশের পঙ্গু যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের দুটি বৃহৎ শহর। ঢাকা ও চট্টগ্রাম-এর মধ্যে যােগাযােগ রক্ষাকারী রেলপথে যাতায়াত করা তার সফরের সময় প্রায় অসম্ভব ছিল। ব্রীজগুলাে ভাঙ্গা হওয়ার ফলে হাইওয়ে যােগাযােগ ব্যবস্থাও পঙ্গু হয়ে গেছে। ব-দ্বীপ অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ মাধ্যম নদী পথেও অনবরত গেরিলা আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে। সামরিক প্রহরায় একটি মাত্র সামরিক বিমানের সাহায্যে পাকিস্তানী আমী-পােষ্টে খাদ্য ও লােক সরবরাহ করা হচ্ছে।
| মিষ্টার উইথরােল মুক্তিবাহিনীর এক অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেন। তাকে মুক্তিবাহিনীর উক্ত অফিসার জানান যে, সূর্যাস্তের পর গ্রামাঞ্চলগুলাে মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকে।
উক্ত অফিসার তাকে বলেন, ‘যদি বিশ্বাস না হয় তবে চলুন, দু’রাতের মধ্যেই আমি আপনাকে ঢাকায় পৌছে দেব। শহরের বড় হােটেলে আপনার থাকার ব্যবস্থা করা না গেলেও ভালাে হােটেলে। আপনাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেব।’
| বিদ্রোহীরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। ঢাকাস্থ হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্রবল প্রহরায় রাখা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর এক যােদ্ধা জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের সঙ্গে সেই হােটেলেই দেখা করেন এবং উক্ত সাংবাদিককে ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলে পাক সেনাবাহিনীর যে কোন কর্তৃত্ব নেই তা প্রত্যক্ষ করার জন্য তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন। পরে পাক-সরকারের গােয়েন্দা পুলিশের চোখে ধুলাে দিয়ে। উক্ত সাংবাদিককে মুক্তাঞ্চল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখান। | মিষ্টার উইথরােল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রশংসা করে বলেন, জনৈক বিদায়ী পাকিস্তানী অফিসারের সম্মানে আয়ােজিত সান্ধ্যভােজ সভার খাদ্যতালিকা সেই রাতেই গােপন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। ঢাকা শহরের একটি বিশেষ বড় ঘড়ি যে পাঁচ মিনিট স্লো চলছে তা-ও পাক। সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্যে উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষণা করা হয় ।
| মিঃ উইথরােল তার প্রবন্ধের উপসংহার টানেন মুক্তিবাহিনীর উক্ত অফিসারেরই উক্তি দিয়ে। এসব ঘটনা খুবই সাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক কিন্তু এতেই শত্রু সেনাদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কারণ তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে, সমাজের প্রতিটি স্তরেই মুক্তিফৌজের নিজেদের লােক নিয়ােজিত রয়েছেন।
জয়বাংলা (১) # ১: ২৭ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দিনরাত কাফন তৈরী হচ্ছে
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় বর্তমানে খুবই সক্রিয়। গেরিলাদের তৎপরতার ফলে পাক সেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৮৯ জন পাকিস্তানী সেনা নিহত হচ্ছে। দুতারেরা মৃত অফিসারদের কফিন তৈরী করার জন্য ক্যান্টনমেন্টে দিনরাত কাজ করছে। কবরস্থ করার জন্য পাক সৈন্যদের লাশ এই সব কফিনে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হয় সম্প্রতি লণ্ডনের ‘সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত রিপােটে একথা বলা হয়েছে।
| বাংলাদেশ থেকে ‘সানডে টাইমস্’-এর সংবাদদাতা তার রিপাের্টে সম্প্রতি ঢাকায় একাধিক সরকারী ভবনের উপর আটশরও বেশী গেরিলার ধারাবাহিক আক্রমণের কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি সরকারী বাড়ী শহরের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্রে অবস্থিত।
উক্ত রিপাের্টে আরাে বলা হয় যে, গেরিলা আক্রমণের ফলে পাক বাহিনী বিমান বন্দর সুরক্ষিত। রাখার জন্য বিমান বন্দর পর্যন্ত প্রধান সড়কের দু’পাশে ‘পিল বক্স’ স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। | পি, আই, এ-র বিমানগুলােও মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় ভীত হয়ে পড়েছে। পি, আই, এর-র। বােয়িং বিমানগুলি পূর্বে আন্তঃমহাদেশীয় গতিপথে চলাচল করত। আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় নির্দিষ্ট গতিপথ ছেড়ে বর্তমানে যতটা সম্ভব জলপথের উপর দিয়ে যাতায়াত করে এবং বিমানের আলােক সংকেতও জ্বালানাে হয় না।
জয়বাংলা (১) [১: ২৭ ! ১২ নভেম্বর ১৯৭১
বাঙলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতি একেবারেই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।
| (নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার অর্থনীতিতে চরম অচলাবস্থা বিরাজমান। গত পহেলা মার্চ অসহযােগ আন্দোলনের সূচনা হইতেই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্মচাঞ্চল্যে ভাটা পড়ে গত কয়েক মাসের লড়াই উহাকে একেবারে অচল করিয়া দিয়াছে।
কলকারখানা আজও পুরােপুরি চালু করা সম্ভব হয় নাই। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ বলিলেই চলে। কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা তৎপরতা থাকিলেও ব্যবসা কেন্দ্রগুলি ধ্বংস হওয়ায় কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণের সুবিধা খুবই সীমাবদ্ধ। বাঙলাদেশের দুইটি সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম ও চালনা শ্রমিকদের অসহযােগিতা ও মুক্তিফৌজের আঘাতে আঘাতে প্রায় অচল । আমদানী রপ্তানী প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ । যােগাযােগ ও পরিবহন ব্যবস্থা ভাঙিয়া পড়ায় অধিকৃত এলাকার অভ্যন্তরেও পণ্য চলাচল খুবই সামান্য। ফলে স্থানীয় । চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতেই জিনিসপত্রের দাম নির্ধারিত হইতেছে। | আমাদের সংবাদদাতাদের প্রেরিত রিপাের্ট হইতে জানা যায়, কৃষকরা যাহা উৎপাদন করে উহা । পানির দরে বিক্রি হইতেছে আর শিল্পজাত পণ্য বা যাহার সরবরাহ বাহির হইতে আসে সেগুলি রীতিমত অগ্নিমূল্য। ধানচাউলের দর বেশি না হওয়া সত্ত্বেও লােকের ক্রয়ক্ষমতা একেবারেই লােপ । পাওয়ার ফলে দুর্ভিক্ষাবস্থা করিতেছে। | ময়মনসিংহ জিলার একটি এলাকা হইতে আমাদের একজন সংবাদদাতা জানাইয়াছেনঃ
ভৈরববাজার, নরসংদী ও নারায়ণগঞ্জ এই তিনটি ব্যবসাকেন্দ্রের সহিত প্রত্যক্ষ যােগাযােগের অভাবে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের আমাদানী ব্যাহত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য ভীষণভাবে বৃদ্ধি পাইয়াছে। কাপড় চোপড়, ঔষধপত্র, লবণ, কেরােসিন তৈল, নারিকেল তৈল, সরিষার তৈল, চা, সিগারেট, চিনি প্রভৃতির মূল্য দ্বিগুণ হইতে তিন গুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। চাউলের দর প্রতিমণ ৫০ টাকা, আটা ৪২ টাকা।
পাট
কৃষকের প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের উৎপাদন এবার খুবই কম। স্থানীয়ভাবে অনুমিত হয়, অন্যান্য বৎসরের তুলনায় অর্ধেক পাট উৎপন্ন হইয়াছে।
পাট বােনার মরশুমে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার শুরু হওয়ায় কৃষকেরা পাট বুনিতে পারে। নাই। অনেক কৃষক জঙ্গীশাহীর সহিত অসহযােগিতার উদ্দেশ্যে পাটক্ষেত ভাঙিয়া ধান বুনিয়াছিল। তা ছাড়া পাক সৈন্য ও রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে বহু কৃষক বাড়ীঘর ছাড়িয়া চলিয়া যাওয়ায় ক্ষেত্রের। পাট ক্ষেতে শুকাইয়াছে। ফলে পাট উৎপাদন গুরুতর রূপে হাস পাইয়াছে।
নারায়ণগঞ্জে পাটের দর চড়া থাকা সত্ত্বেও কৃষকরা উহার সুবিধা পাইতেছে না। অনেক ভাল ভাল । পাটের বাজার পাক হানাদার সৈন্যরা পুড়াইয়া দেওয়ায় পাট বিক্রয়ের দারুণ অসুবিধা সৃষ্টি হইয়াছে। আবার আর্থিক সঙ্কট এবং পাক বাহিনী বা রাজাকারদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ প্রভৃতির আশঙ্কায় কৃষক ঘরে পাট মজুত রাখা নিরাপদ মনে করিতে পারে নাই। কৃষকের এই অসহায় অবস্থার সুযােগে ফড়িয়া ব্যাপারীরা গ্রাম হইতে পানির দরে পাট কিনিয়া নিয়াছে। পাটের দর সূতী মণপ্রতি ২০ হইতে ৩০ টাকা এবং বগী ৩৫ হইতে ৪০ টাকা। নিরাপত্তার অভাব হেতু ব্যবসায়ীরা সরাসরি নারায়ণগঞ্জে পাট চালান না দিয়া নরসিংদীতে বিক্রি করিয়া দেয় । লুটেরা রাজাকার বাহিনী পাটের নৌকা আটক করিয়া যথেষ্ট টাকা আদায় করিতেছে। পাক সৈন্যরা পাটের নৌকা মুক্তিবাহিনী আছে সন্দেহ করিয়া হয়রানির একশেষ করে। ফলে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পাটের দর ও গ্রামের বাজারে কৃষক যে-দাম পায় উহার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হইয়াছে।
অন্যান্য অর্থকরী ফসল
এই মরশুমে কলা, কচু, মূলা, হলুদ, মরিচ পেঁয়াজ, রশুন, আদা, তরিতরকারী প্রভৃতি বিক্রি করিয়া কৃষকের হাতে কিছু পয়সা আসিত। কিন্তু বাজারজাতকরণের অসুবিধা এবং ক্রয়ক্ষমতা লােপ পাওয়ার দরুন স্থানীয় চাহিদা হ্রাসের ফলে এই সবের মূল্য শতকরা ৪০ হইতে ৫০ ভাগ কমিয়া গিয়াছে।
খাদ্য-শস্য
এই এলাকায় চাউলের দর বর্তমানে মণপ্রতি ৪৫ হইতে ৫০ টাকা। নিরাপত্তার অভাবে ধান। চাউলের মজুদ ব্যবসা নাই । পার্শ্ববর্তী ভাটি অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতার দরুন সেখানে ধান প্রতিমণ ৮ হইতে ১০ টাকা এবং চাউল ১৫ হইতে ২০ টাকার দরে বিক্রি হইতেছে। যােগাযােগ ও পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে মাল চলাচল নাই। | ভাটি অঞ্চলে ধানই সম্বৎসরের একমাত্র ফসল। কৃষক উহা পানির দরে বিক্রি করিয়া দিতে বাধ্য হইতেছে কারণ লুটেরা রাজাকার বাহিনীর দৌরাত্ম্যে কৃষক ঘরে ধানচাউল মজুদ রাখিতে ভরসা পাইতেছে না। অবিশ্বাস্য হইলেও সত্য যে, একদিকে ধান চাউলের নিম্ন মূল্য ও অন্যদিকে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া পাশাপাশি বিরাজ করিতেছে। রুটি রােজগারের অভাবে গ্রামের গরীব মানুষ ক্ষেতমজুর ভূমিহীন প্রভৃতি উপবাসে দিন কাটাইতেছে। তাছাড়া আমন ফসলের ফলন ভাল হয় নাই। সার ও কীট নাশকের অভাবে অধিক উৎপাদনশীল ‘ইরি ধরনের চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। যুদ্ধাবস্থার দরুন আউশ ধান সময় মত বােনা ও কাটা সম্ভব হয় নাই। ফলে কৃষকের সামনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ।
তাঁত শিল্প
সূতার অভাবে গ্রামীণ তাঁত শিল্প ধ্বংসের মুখে। পশ্চিম পাকিস্তানী মিলের কাপড় চালু করার উদ্দেশ্যে হানাদার পাক সৈন্যরা অনেক গ্রামে তাত পুড়াইয়া দিয়াছে। যথা : বাজিতপুর, বসন্তপুর, নিতাইকান্দি, কাপাসাটিয়া। পার্শ্ববর্তী ঢাকা জিলার নরসিংদী এলাকার তাঁত শিল্পও পাক বাহিনী ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।
বেকার সমস্যা
এই অর্থনৈতিক অবস্থার পটভূমিতে গ্রামাঞ্চলে বেকার সমস্যার তীব্রতা ভয়াবহরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে। শিক্ষক সরকারী কর্মচারী বেসরকারী চাকরিজীবী বেকার হইয়া গ্রামে আশ্রয় লইয়াছে এবং ভরণপােষণের জন্য নিজেদের যৎসামান্য জমির উপর নির্ভর করিতেছে। অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা দলে দলে গ্রামে আসিয়া ভিড় জমাইয়াছে। সরকারী ও বেসরকারী অফিসের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও বেকার হইয়া ক্ষেতমজুরের কর্মপ্রার্থী হইয়া একদিকে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি করিয়াছে অন্যদিকে ক্ষেতমজুরের চাহিদা ও মজুরি হাস পাওয়ার কারণ ঘটাইয়াছে।
মুক্তিযুদ্ধ ১; ১৯ # ১৪ নভেম্বর ১৯৭১
ঝড় উপকূল এলাকা বিধ্বস্ত
ঘুর্ণি ঝড় ও জলােচ্ছাস আর একবার প্রবল বেগে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানিয়াছে। গত ৬ই নভেম্বর রাতে ঘণ্টায় ১০০ মাইলেরও অধিক বেগে প্রবাহিত ঘুর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসে উপকূলবর্তী অঞ্চল সমূহে বহু লােকের মৃত্যু ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে।
কক্সবাজারের দক্ষিণাঞ্চল ও চট্টগ্রামের উত্তরাংশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে নােয়াখালির রামগতি, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালি প্রভৃতি দ্বীপের সহিত প্রদেশের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। | উদ্ৰত অঞ্চলসমূহ শত্রু কবলিত থাকায় বিস্তারিত সংবাদ অথবা রিলিফ কার্য সম্পর্কে বিশেষ | কিছু জানা যাইতেছে না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ উপকূলীয় অঞ্চলে এই বিপর্যয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন।
মুক্তিযুদ্ধ ১ : ১৯ ॥ ১৪ নভেম্বর ১৯৭১।
আয় নাই, ঘরে খাদ্য নাই, ভয়াবহ সঙ্কট গ্রাম বাঙলায় জঙ্গীশাহীর কর্তৃত্ব অচল
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাক জঙ্গীশাহীর কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ ভাঙিয়া পড়িয়াছে। অধিকৃত এলাকার বিভিন্ন অঞ্চল হইতে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতাগণ যে-প্রত্যক্ষদর্শীর রিপাের্ট পাঠাইয়াছেন তাহাতে বলা হয়, সৈন্যবাহিনী শহরগুলি হইতে সচরাচর বাহির হয় না। তদুপরি পাক জঙ্গীশাহী ভারতের। সহিত যুদ্ধ প্রস্তুতির অঙ্গ হিসাবে সেনা বাহিনীর প্রধান অংশকে সীমান্ত অঞ্চলে মােতায়েন করায়। অধিকৃত বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জঙ্গীশাহীর শাসন কার্যত রাজাকার ও অবাঙালী পুলিস বাহিনীর। লুটপাট ও জবরদস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু অধিকৃত এলাকার গভীর অভ্যন্তরেও মুক্তিবাহিনীর। তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষত বহু রাজাকার ও পুলিস মুক্তিবাহিনীর হাতে মারা পড়ায় পুলিস ও রাজাকাররা এখন থানা সদর কার্যালয় ও আশ পাশের দুই একটি গ্রাম ছাড়া বাহিরে যায় না। ইহার ফলে, আমাদের বরিশাল প্রতিনিধি জানাইতেছেন, প্রায় সমগ্র গ্রামাঞ্চল কার্যত মুক্ত। এসব এলাকায় পাক সরকারের প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল এবং মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় ভিত্তিতে গড়িয়া ওঠা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। | পরিষদগুলির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই সব এলাকায় বাঙলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসন চালু করা সম্ভব এবং অত্যন্ত দরকার। | পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত শহরগুলিতে স্কুল-কলেজ কিছু কিছু খােলা হইলেও। | গ্রামাঞ্চলে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ। পাক দস্যু বাহিনী সামরিক অভিযান চালাইবার পর স্থানীয় সমাজ বিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তথা পাক দালালেরা জনসাধারণের উপর নির্যাতন, লুটতরাজ প্রভৃতি দুষ্কর্ম করে। কিন্তু পরবর্তীকালে মুক্তি বাহিনী ও স্থানীয় গেরিলা বাহিনীগুলি সংঘবদ্ধ হইয়া ইহাদিগকে শায়েস্তা করে। বর্তমানে এই মহলটি একেবারে কোণঠাসা এবং মুখচেনা পাক দালালেরা সকলেই গিয়া শহরে আশ্রয় লইয়াছে। গ্রামে যারা আছে তাহারা মৌখিকভাবে হইলেও। মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়াছে। কিছু কিছু ‘ভুয়া মুক্তিফৌজ জনসাধারণের উপর অত্যাচার করিত। মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীগুলি ইহাদিগকেও ঠাণ্ডা করিয়াছে।
| অর্থনৈতিক সঙ্কট
পাক হানাদার বাহিনীর লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে জনজীবনে দারুণ। | অর্থনেতিক সঙ্কট সৃষ্টি হইয়াছে। গত আউশের মরশুমে ধান হয় নাই পাক সেনাদের অত্যাচারে | কৃষকেরা ধান বুনিতে ও কাটিতে পারে নাই। আমন ধানের আবাদ হইয়াছে কম। শ্রমিক, ব্যবসায়ী, | দোকানদার, কর্মচারী, ক্ষেতমজুর প্রভৃতির আয়ের কোন পথ নাই। ধান-চাউলের দর কোন কোন জায়গায় খুবই বেশি বরিশালের একটি এলাকা হইতে আমাদের প্রতিনিধি জানাইতেছেন, সেখানে নূতন আউশের চাল প্রতিমণ ৬০ টাকা দরে ক্রয়বিক্রয় হইতেছে। আবার যােগাযােগের ব্যবস্থার অভাবে পার্শ্ববর্তী উদ্বৃত্ত এলাকা হইতে ধানচাউল আমদানী করা যাইতেছে না।
| বরিশাল প্রতিনিধি জানান, কোন কোন এলাকায় শতকরা ৯০ জন অধিবাসী উপবাসে দিন কাটাইতেছে। পাক জঙ্গীশাহী খাদ্যশষ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করিবে না ইহা জানা কথাই। তাই বাঙলাদেশ সরকারের উচিত এই সব গ্রামাঞ্চলে খাদ্যশষ্য সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া। বস্তুত। খাদ্যসঙ্কট এরূপ তীব্র যে, আমাদের সংবাদদাতা লিখিয়াছেন, এই সমস্যা সমাধানের উপর মুক্তি সংগ্রামের ভবিষ্যৎ বহুল পরিমাণে নির্ভরশীল।
মুক্তিযুদ্ধ ৪ ১ : ১৯ ১৪ নবেম্বর ১৯৭১
কর্ণফুলী কাগজের কল বন্ধ
| ঢাকা, ১৪ই নভেম্বর : এক খবরে জানা গেছে চট্টগ্রামস্থিত কর্ণফুলী কাগজের কারখানাটি কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে কাচামালের অভাবে কারখানা কর্তৃপক্ষ কলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে কাগজের কারখানার প্রচুর কাচামাল পাওয়া যায় । লােকাভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করা হচ্ছে না বা কোন ঠিকাদার কাঁচামাল সরবরাহও করতে এগিয়ে আসছেন না। তদুপরি স্থানীয় জনসাধারণের অসহযােগিতা তাে রয়েছেই।
| বাংলাদেশ (১) # ১: ২১ ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় আবার সান্ধ্য আইন
আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা কর্তৃক গােপন সূত্রে পাওয়া এক খবরে প্রকাশ যে, হানাদার কবলিত ঢাকা শহরে মুক্তিফৌজের ব্যাপক তৎপরতা বৃদ্ধির ফলে আগামী ২/১ দিনের মধ্যে ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারী করিয়া বাড়ী বাড়ী হানা দিয়া মুক্তিফৌজ দমনের নামে আবার ২৫শে মার্চের কালরাত্রির অবতারণার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইতেছে।
| এখানে উল্লেখযােগ্য যে ঢাকার ৫টি থানাকে ইতিপূর্বে ১০টি থানায় রূপান্তরিত করিয়া প্রতি থানায় একজন করিয়া বিগ্রেডিয়ার নিযুক্ত করা হইয়াছে। | এখানে আরও উল্লেখযােগ্য এই পরিকল্পনা দিয়াছেন ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের ছাত্রজনতা হত্যাকারী খুনী নূরুল আমিন।
বাংলাদেশ (১) ॥ ১: ২১ ৫ ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকা ডায়েরী। (নিজস্ব প্রতিনিধি)
ঢাকা শহরে এখন পুরাদমে বেসামরিক প্রতিরক্ষা মহড়া চলছে। অবশ্য এমনিতেই জনসাধারণ সচরাচর ঘরের বাইরে থাকে না, রাস্তাঘাটগুলি সন্ধ্যা না নামতেই জনশূন্য হয়ে পড়ে। কারণ ভারতের হামলার আশংকায় যাদের নিরাপদ আশ্রয়ে লুকাবার মহড়া দিতে হচ্ছে, স্বদেশী রক্ষকদের হামলা থেকে বাঁচাবার জন্যই তাদের বাস্তবে প্রতিনিয়তই পালিয়ে বেড়াতে হয়।
প্রত্যেক বাড়ীর আঙ্গিনায় ট্রেঞ্জ খুঁড়তে বাড়ীর বাসিন্দাদের বাধ্য করা হচ্ছে এবং এই সপ্তাহে কয়েকবার ‘ব্ল্যাক আউটের মহড়া হয়েছে। মফঃস্বলের শহরগুলিতেও একইভাবে জনসাধারণকে “ভারতের আক্রমণের …
নারায়ণগঞ্জের অদূরে একটি কাপড়ের কলে পাক-বাহিনীর দালাল চাঁন মিয়া সর্দারকে গুলি করে । হত্যা করা হয়েছে। এই নিয়ে এ সপ্তাহে ঢাকা জেলায় মােট আট জন অতি পরিচিত দালালকে খতম করা হলাে।
পাক-সরকার বাঙালী ডাক্তার ও ইনজিনিয়ারদের দেশের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। বৈধ পাসপাের্ট থাকলেও ডাক্তার ইনজিনিয়াররা এখন আর বাইরে যেতে পারবেন না। দেশের ভেতরে যে চরম বর্বরতা চলছে তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে বহু সংখ্যক ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার মুক্তিবাহিনীর সাথে। সহযােগীতা করর জন্য বিদেশ ঘুরে মুক্তাঞ্চলে চলে এসেছেন। পাক সরকারের বিধিনিষেধ এই ডিকেশন বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই যে জারী করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। | সম্প্রতি খুলনার অদূরে মুক্তিবাহিনীর পাতা মাইনে যে মার্কিন জাহাজটি ধ্বংস হয়েছে সেটিতে জাতিসংঘ থেকে প্রেরিত রিলিফ দ্রব্যাদি ছিল বলে দাবী করা হচ্ছে। কিন্তু রিলিফ দ্রব্য বিতরণের নামে আসলে ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনীর জন্য রসদ পত্র সরবরাহ করা হচ্ছে বলেই সাধারণের ধারণা। তাছাড়া, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যে সব রিলিফদ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে, তা ইয়াহিয়ার দালালরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে, ফলে এভাবে রিলিফ বিতণের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার সমর্থনে একশ্রেণীর দালাল তৈরী ছাড়া আর কোন কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। কাজেই সাধারণ মানুষ তথাকথিত রিলিফবাহী জাহাজ ধ্বংসের ব্যাপারে মােটেই দুঃখিত নয় ।
দেশ বাংলা #১৪ | ১৮ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় চাপা আনন্দের সঞ্চার।
ঢাকা, ১৫ই নভেম্বর : গত কয়েকদিন থেকে ঢাকা শহরের সর্বত্র একটা চাপা আনন্দের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের প্রতিনিধি ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করে এই সম্বন্ধে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, ইদানিং খােদ ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযান এবং বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সাথে প্রকাশ্য সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন তাতে ঢাকার বাসিন্দারা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অত্যন্ত আশান্বিত হয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ক্যাডেটদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে ভাষণ দান কালে বলেন —সেই দিন আর দূরে নয় যেদিন ঢাকায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। ঢাকা বাংলাদেশের হানাদার অধিকৃত এলাকায় অধিবাসীদের মনে এটা গভীর আনন্দের সঞ্চার করেছে। তদুপরি হানাদার কবলিত এলাকাগুলি ক্রমশঃই মুক্তিবাহিনী দখল করে নিচ্ছে এসব খবরও আর ঢাকাবাসীদের নিকট গােপন থাকছে না। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রকাশ্য দিবালােকে বােমা বিস্ফোরণের ফলে হানাদার পাক সেনাদের মনােবল একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছে। রাতের বেলায় ঢাকা নগরীতে হানাদারদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বি,বি,সি থেকে এই বলে মন্তব্য করা হয়েছে যে রাতের বেলা ঢাকা নগরী মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকে। এমনকি দিনের বেলায়ও হানাদার বাহিনী দলবদ্ধ না হয়ে আজকাল শহরে ঘুরাফেরা করতে সাহস পাচ্ছে না। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সকল পুলিশ আমদানী করা হয়েছিল তারা দেশে ফিরে যাবার জন্য একদিনের ধর্মঘট করেছে। এই সকল অবস্থা আজ ঢাকাবাসীর মনে বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি করেছে যে, সে দিন। আর বেশী দূরে নয় যেদিন ঢাকা নগরী তথা সারা বাংলাদেশ নরঘাতক ইয়াহিয়ার দানবদের কবল মুক্ত
বাংলাদেশ (১) ॥ ১ : ২১ ॥ ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
একাত্তরের ঈদ আসছে।
এবারেও বাঙলাদেশের চিরাচরিত পথে পা বাড়িয়েছে ঈদ। সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা রূপসী বাঙলা, সােনার বাঙলার সুনির্মল আকাশের পশ্চিম দিগন্তে একফালি সুচিকণ রূপালী চাদের নিশান উড়িয়ে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষারত বাঙলার মানুষকে জানিয়ে দেবে তার আগমনের আনন্দবার্তা। | প্রকৃতির নিয়ম অমােঘ, অলঙ্ঘনীয়। মানুষের গড়া নিয়মের মধ্যেও কতগুলি নিয়ম আছে, যা একেবারে অলঙ্ঘনীয় না হলেও যুগ যুগ ধরে ব্যতিক্রম ও ব্যত্যয়ের পাশ কাটিয়ে সমাজের সড়ক ধরে এগিয়ে চলতে থাকে। মানুষের গড়া এমনি একটি নিয়মের সিড়ি বেয়ে প্রতি বছর ঈদ আসে সার বিশ্বের মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। এবারেও সে এগিয়ে আসছে সকল দেশের মানুষের জন্য খুশীর খবর নিয়ে।
| কিন্তু একি! বাংলাদেশের দ্বার প্রান্তে এসে ঈদ যেন এবার ক্ষণিকের জন্য থম্কে দাড়াল। তার নাকে যেন কী একটা উৎকট দুর্গন্ধের দমকা হাওয়া ঢুকে পড়ে মুখটাকে একটু বিকৃত করে ফেলল। কী এক বিকট হাহাকার ও আর্তনাদের ধ্বনি যেন তার কানে তালা লাগিয়ে দিল। চোখ তুলে এক মুহূর্ত এদিক ওদিক তাকিয়ে একেবারে আঁৎকে উঠল সে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল স্বৰ্গতােক্তি ঃ
এ কী! কিসের এ দুর্গন্ধ, মানুষপচা দুর্গন্ধ মনে হচ্ছে। চারিদিকে ও আকাশফাটা আর্তনাদ কিসের! শােকাহত বেদনার্ত নারীকণ্ঠশিশুকণ্ঠের আর্তনাদ নয় তাে! বৃদ্ধদের অস্ফুট আর্তনাদও তাে শােন যাচ্ছে!
এক মুহর্ত নীরব নিথর হয়ে এসব আর্তনাদ ও হাহাকারের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করল ঈদ। শুনতে পেল ।
হায়রে হায়, ঈদে এবার কী আনন্দ করব? কার জন্য নতুন জামা কাপড় কিনব? আমার ফারুক কোথায়? ফিরােজ কোথায়? | ওগাে আল্লা, আমার লায়লী কোথায়? লায়লীর আব্বা কোথায়? এবার ঈদের কাপড় কে এ দেবে? কার জন্যই বা আনবে?
হায় খােদা মেহেরবান, আমার কামাল, মজনু কোথায় হারিয়ে গেল । তােমার অন্ধ বান্দা এবার কার হাত ধরে ঈদের নামাজ আদায় করতে যাবে?
শুনতে শুনতে ঈদের বুকখানাও যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। কী একটা কালাে ছায়া তার মুখের জ্যোতিকে গ্রাস করে ফেলল।
ঈদ এতক্ষণ চোখ বুজে শুনছিল। এবার চোখ খুলল । চমকে উঠল। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। আবার খুলল । আবার আপন মনে বলতে লাগল। | একি! একি সেই বাংলা। সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা চিরসবুজ বাংলা! যদি সেই বাংলাই হয় তনে এর দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেতের উপরে লালের আস্তরণ কেন। একি সত্যিই সেই বাংলা! ভুল করি নি তাে! যদি সত্যিই সেই বাংলা হয় তবে এর মেঘনা, পদ্ম, যমুনায় সেই ঘােলা, নীল, কালে জলরাশি কোথায়? নদীমেখলা বাংলার সব নদীতেই দেখছি রক্তের বেগবতী স্রোত বইছে। বিল, বাওর সব ঠাই দেখছি রক্তের তুফান উঠছে। | ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলে ঈদ শহর বন্দর ঘুরে ঘুরে রাজধানী নগরীর দিকে। মৌন জিজ্ঞাসা ভেসে ওঠে মনে।
একি বাংলাদেশের সেই জনবহুল রাজধানী! হ্যা তাই তাে দেখছি। এই তাে সেই মসজিদ বহু ঢাকা। কিন্তু মাঝে মাঝে কতিপয় মসজিদ এমন করে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে কে? এই তাে সেই রমনা রেসকোর্স! ঈদের জামাতে হবে এখানে। কিন্তু রাজধানীর অলিতে গলিতে সে জনতার বহন
| কই? ঈদের জামাতে যারা ভীড় জমাবে! এতাে সেই বাংলাই বটে, কিন্তু দিকে দিকে তার সবুজ শ্যামলিমা কই! প্রাণচঞ্চল সজীবতা কই! | কিছুক্ষণের জন্য ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ে ঈদ। ধ্যাননেত্রে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় কোথাকার কোন্ রক্ত পিপাসু রক্তপায়ী দানবের দল কামূড়ে আঁচড়ে লাখাে লাখাে বাঙালীর মুণ্ডু ছিড়ে রক্ত ঝরিয়ে চলে গেছে। ধর্ষিতা বাংলা মা হচেতন অবস্থায় মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আর এখনাে যারা বাংলাদেশে প্রাণটুকুমাত্র নিয়ে বেঁচে আছে তারা প্রায় সকলেই প্রিয়জনের বিয়ােগব্যথায় শােকাতুর, ব্যথাতুর স্লানমুখ, জীবন্ত অবস্থায় ধুকছে। আমি কী করে এদের মুখে হাসি ফোটাব? কী করে এদের। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ খেলাব? এবার কি এরা আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে সাগ্রহে বরণ। করে নেবে?
| ধ্যানস্তব্ধ ঈদের এসব মৌন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সবুজ বাংলার রক্তভেজা মাটি যেন বলে। উঠল । | না ঈদ, তুমি ভেবাে না। স্বামীহারা স্ত্রী, স্ত্রীহারা স্বামী, পুত্রকন্যাহারা পিতামাতা মাতাপিতাহারা পুত্রকন্যা এবং এমনিতরাে হাজারাে স্বজনহারা সর্বহারা যারা এখনাে বাংলাদেশে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলেছে প্রতিবারের মতাে এবারেও তারা তােমাকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে আদরে বরণ করে নেবে। সশ্রদ্ধ সালাম জানাবে তােমার রূপালী চাদের বিজয় নিশানকে। জমায়েত হবে ঈদের জামাতে। তুমি এসাে ঈদ!
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৫ # ১৮ নভেম্বর ১৯৭১
অধিকৃত বাংলায় চাকমারা দমে গেছে বিদ্রোহী মিজো নেতা লালডেঙ্গা পাক ছাউনীতে
পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় উপজাতীয়দের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভেদ সৃষ্টির পাক চেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি। আমাদের সংবাদদাতা চট্টগ্রাম ঘুরে এসে জানিয়েছেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা উপজাতির প্রধান রাজা ত্রিদিব রায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য আউং শে প্র’র মাধ্যমে চাকমাদের অস্ত্রসজ্জিত করে মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার চেষ্টা হয়েছে। উপজাতীয় এলাকাকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে চাকমা নেতারা সে ফাদে পা-ও দিয়ে ছিলেন এবং সে অনুযায়ী কিছু সংখ্যক চাকমাকে সামরিক ট্রেনিংও দেওয়া হয়। | কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা একাধিক কারণে মােটেই কাজে আসেনি। প্রথমতঃ চাকমারা সংখ্যায় খুবই নগন্য। মধ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা উপজাতীয়দের সংখ্যা আশি হাজার। দক্ষিণের বেমং ও উত্তরের মং রাজার অনুগামীরা চাকমাদের কোনকালেই সুনজরে দেখেনি। কারণ, চাকমারা তুলনামূলকভাবে কিছুটা উন্নত এবং অন্যান্য উপজাতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখে থাকে। | এদিকে রামগড়ের মং রাজা মুক্তি বাহিনীর পক্ষ নিয়েছেন। এপ্রিল মে রামগড় যখন মুক্তিবাহিনীর দখলে তখন তিনি সর্বতােভাবে সহায়তা …প্রতিবন্ধতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা পাক বাহিনীর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। কারণ আজ হােক কাল হােক, মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক বিজয়ের মুহুর্ত ঘনিয়ে আসলে অস্ত্রধারী উপজাতীয়রা তাদের অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরবে নিজেদের প্রয়ােজনেই। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে তাদের পৃথক অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব। আর একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশেই উপজাতীয়রা তাদের পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার এবং উপজাতীয় স্বার্থে রক্ষা কবচ পেতে পারে, এ সত্য উপজাতীয় নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। এতদসত্ত্বেও যে দু’একজন উপজাতীয় নেতা বর্তমানে পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছে, তারা চিরদিনই স্রোতের শেওলার মত এধার ওধার করে এসেছে।
উপজাতীয় স্বাতন্ত্রৰােধ থেকে নয়, ব্যক্তিগত লােভ লালসা থেকেই এরা পাক-সরকারের পক্ষ নিয়েছে। বলাবাহুল্য সে জন্যই এদের ভূমিকার কোন রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই । চাকমা নেতা ত্রিদিব রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগের মন্ত্রী হয়েছিলেন। গতবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী | হিসাবে তিনি জয়ী হয়েছেন। জয়ী হবার পর আওয়ামী লীগের দুয়ারে ধর্ণা দিতে দেরী করেন নি। কিন্তু | ২৫শে মার্চের পর পুনরায় ভােল পাল্টে ফজলুল কাদের বৈঠকখানায় হাজিরা দিয়েছেন। সঙ্গতভাবেই বলা যায়, পাক বাহিনী এখন বাংলাদেশের ভেতরে পাক সামরিক ছাউনীতে বেশ কিছু সংখ্যক অনুগামী। সহ অবস্থান করছেন। মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামে হামলা পরিচালনার সময় পাক বাহিনী। কয়েকশত মিজো পরিবারকে কয়েকটিমাত্র বন্দুক হাতে নিয়ে অগ্রবর্তী বাহিনী হয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। তাদের গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগুতে বলা হয়, যাতে করে পাল্টা জবাব থেকে মুক্তিবাহিনীর | অবস্থান নির্ণয় করা যায়। তাদের পিছু পিছু পাক-বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে এগুতে থাকে। ফলে এই হতভাগ্যরা অধিকাংশই সপরিবারে ক্রস ফায়ারিং এর শিকার হয়।
ভারত সরকার কর্তৃক কেন্দ্র শাসিত মিজোরাম ষ্টেট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘােষিত হবার পর মিজোদের। মধ্যে বিদ্রোহী মনােভাব দূর হতে চলেছে। বিদ্রোহীদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দিয়েছে অনেক দিন। থেকে। স্বায়ত্বশাসিত মিজো ষ্টেট পেলেই তাদের অনেকেই খুশী। লালডেংগার সমর্থন তাই দিন দিনই। | কমে আসছে এবং তাকে নাগা নেতা ডঃ ফিজোর ভাগ্যই যে বরণ করে নিতে হচ্ছে, তাতে সন্দেহ | নেই। পাকিস্তানী ছাউনীতে পাক-বাহিনীর বর্বর নমুনা দেখে লালডেঙ্গার ঘনিষ্ঠ সহচরদের তিনজন
হতাশ হয়ে স্বদেশে ফিরে গেছেন। তাঁদের মধ্যে তথাকথিত স্বাধীন মিজোরাম সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী | লালমিনখাংগা ও অর্থমন্ত্রী লালখাওলিয়া রয়েছেন। মিজো জেলাকে ‘ইউনিয়ম টেরিটরি’ তে রূপান্ত| রিত করা এবং আসাম সরকার কর্তৃক গণ-ক্ষমা প্রদর্শনের ঘােষণায় তারা সন্তুষ্ট হয়েছেন। প্রসংগত উল্লেখযােগ্য যে, মিজো জাতীয় ফ্রন্টের সহ-সভাপতি লালনুনমাউইয়ার নেতৃত্বে চরমপন্থীদের একাংশ পূর্বেই বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছেন। | পাক-ছাউনীতে লালডেঙ্গাগামীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। পাক বাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে। মিজোদের ‘স্বাধীনতা প্রশ্নটি চাপা দিয়ে, পাক বাহিনীর ভারত ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। বৃত্তি ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের এ সব ব্যাপারে মতভেদ হওয়া ডেঙ্গা। তার আটজন কমাণ্ডার জনকে সম্প্রতি বরখাস্ত করেছে।
| কেন্দ্রশাসিত মিজোষ্টেটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সাথে সাথে লাল ডেংগার রাজনৈতিক মৃত্যু। ঘটবে তা এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সেই সাথে ঘটবে পূর্বাঞ্চলের উপজাতীয়দের নিয়ে পাকবাহিনীর দীর্ঘ দিনের ষড়যন্ত্রেরও অবসান ।
দেশে বাংলা ॥ ১:৪ | ১৮ নবেম্বর ১৯৭১
‘হামলােগ মুক্তি কা সাথ লড়াই করনে নেহী আয়া, উও সেপাই কা কাম হায় …….’
দখলীকৃত বাংলাদেশে পাঞ্জাবী পুলিশের বিদ্রোহ
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
পূর্বাঞ্চলের ১৩০০ মাইল সীমান্তব্যাপী পাক সামরিক জান্তা ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হানাদারদের রক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অথচ তারা নিজেই সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে, তাতে দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরের শক্তি | বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাড়াহুড়া করে ট্রেনিং দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসার অনভিজ্ঞ কিশাের সৈনিক, পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও
স্থানীয় রাজাকার দালালদের ওপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধাদের মােকাবেলা করা তাদের পক্ষে মােটেই সম্ভব হচ্ছে না। | শুধু তাই নয়, পাঞ্জাব থেকে ধার করে আনা পুলিশদের অনির্দিষ্টকালের জন্যে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় রেখে দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরাই প্রধানতঃ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। গত জুন মাসের প্রথম পক্ষে একমাত্র ঢাকা শহরের রমনা থানাতেই ৪০টি চীনা রাইফেল জমা পড়েছিল। এই চীনা রাইফেলগুলাে পাঞ্জাবী পুলিশদের ইস্যু করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে চল্লিশজন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হওয়ায় সেই রাইফেলগুলাে পুনরায় রমনা থানায় জমা পড়েছিল। | শুধু ঢাকাতেই নয়, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, নরসিংদী এবং অন্যান্য এলাকাতেও মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীদের আক্রমণে বহু পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ নিহত হওয়ায় তাদের মধ্যে ত্রাস ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী থেকে আমদানী করা পুলিশের মৃত্যুতে পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও ভীষণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তারা অবিলম্বে দখলীকৃত বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার দাবী জানাচ্ছে। তার ফলে সেখানকার পুলিশ ও সামরিক কর্তারা খুবই বেকায়দায় পড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে গত জুন মাসেই পাঞ্জাবের পুলিশ। বাহিনীকে ফিরিয়ে দেবার দাবী জানিয়ে ছিল।
গত জুন মাসেই ঢাকার জয়দেবপুরের একটি কৌতুকজনক ঘটনা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনীর ভীতি ও বিক্ষোভের পরিচয় পাওয়া যায়। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অভ্যন্তরে নিযুক্ত পাঞ্জাবী পুলিশরা মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে স্ব স্ব কর্মস্থল থেকে পালিয়ে জয়দেবপুরের ক্যাম্পে চলে আসে। তাদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যার যার কর্মস্থলে ফেরৎ পাঠাবার জন্যে সামরিক বাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেনকে পাঠানাে হলে পাঞ্জাবী পুলিশরা তাকে ঘেরাও করে বলে : “হামলােগ মুক্তি (মুক্তিবাহিনী) কা সাথ লড়াই করনে নেহি আয়া। উও সেপাহী কা কাম হায় । হামলেগকে পুলিশ কা ডিউটি দো, ডিউটি করে গা ।। | সর্বত্র এই একই অবস্থা। বরং ভীতি ও অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রয়ােজন অনুপাতে স্থানীয় পুলিশ সগ্রহ করতে না পারায় এদের স্বদেশে ফেরৎ পাঠানাে সম্ভব হচ্ছে না। বরং ইচ্ছার। বিরুদ্ধে সামরিক আইনের খড়গ উচিয়ে জোর করে নতুন নতুন পুলিশ আমদানী করা হচ্ছে। অথচ | শুরুতে মাত্র তিন মাসের করারে অস্থায়ীভাবে এদের পাঞ্জাব থেকে ধার করে আনা হয়েছিল। এখন এদের মৃত্যুর কোন কৈফিয়ত দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। | সম্প্রতি ঢাকা থেকে লণ্ডনের ডেলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি এক খবরে জানিয়েছেন যে, ৬,০০০ | পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশের মনােবল ভেঙে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাঙালী পুলিশদের শূন্যস্থান দখল করার জন্যে এদের আনা হয়েছিল। গােড়ায় তাদের সেপ্টেম্বরেই স্বদেশে ফেরৎ পাঠানাে হবে। বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দখলীকৃত বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। এখন তারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এবং অবিলম্বে ফিরে যাবার একটা পাকা তারিখের দাবী জানাচ্ছে।
এই ভাবেই একে একে পাক হানাদারদের সকল অবলম্বনই হারিয়ে যেতে বসেছে। ঘরে বাইরে নাজেহাল হয়ে তাদের এখন অবস্থা দাড়িয়েছে মাথার ঘায়ে কুকুর পাগলের মত।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৮ ॥ ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
ইয়াহিয়ার রাজত্বে বাঙালীদের বেতন নাই
মুজিবনগরে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার রেলওয়ের বাঙ্গালী কর্মচারীদের | এপ্রিল মাস থেকে এ পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়নি। কিন্তু রেলওয়ের পশ্চিম পাকিস্তানী ও উর্দুভাষী কর্মচারীরা রীতিমত বেতন পাচ্ছে।
বাঙ্গালী কর্মচারীদের … তাদের আরও বলে দেওয়া হয়েছে যে, রেলওয়ের আয় না হওয়া পর্যন্ত। কোন বাঙ্গালী রেল কর্মচারী বেতন পাবে না।
| এছাড়াও শত শত রেল কর্মচারীকে ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনী গ্রেফতার করে তাদের ওপর অবর্ণনীয় নিৰ্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। | বাঙালী রেলকর্মচারীদের অপরাধ হচ্ছে, তারা ১লা মার্চ থেকে বাঙ্গালী জাগৃতির মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষিত অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছিলেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৮ ! ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
গেরিলাদের আক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত পাকসৈন্য ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন
ঢাকা, ১৭ই নভেম্বর। ঢাকা নগরী দখল নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও পাক দখলদারদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকা নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে এক স্থানে জমায়েত হয়ে সম্মিলিত ভাবে হানাদারদের ঘাটি আক্রমণ করেছে বলে জানা গেছে। এর ফলে বহু পশ্চিমা সৈন্য হতাহত হয়েছে। এর সত্যতা পরােক্ষভাবে ঢাকা বেতার থেকে স্বীকার করা হয়েছে। | গেরিলাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পাক জঙ্গীশাহীর লেলিয়ে দেওয়া বর্বর সৈন্যরা টিকতে না পেরে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে সমস্ত ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারী করেছে। এ সংবাদ ঢাকা বেতার থেকেও প্রকাশ করা হয়েছে। জানা গেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে টহলরত সৈন্যের উপর বেশ কয়েকবার অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু সৈন্যকে হতাহত করেছে।
ঢাকা শহরে হানাদাররা সাজোয়া গাড়ী, ট্রাঙ্ক, দূর পাল্লার কামান নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে। এবং গেরিলাদের খোঁজার নাম করে জোর করে বাড়ী বাড়ী ঢুকে লুঠ, ধর্ষণ ও নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের বেতার এই অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে ২৫শে মার্চের সঙ্গে তুলনা। করেছে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১: ১৪ | ২১ নভেম্বর ১৯৭১
দিন যায় পাহারায় রাত যায় ধান কাটায়।
বাংলাদেশের ধান চাষীর অবস্থা দাড়াইয়াছে এই যে, তাহারা হানাদার পাক সৈন্যদের অত্যাচারের ভয়ে পাহারা দিয়া সারা দিন কাটায়। রাত্রিতে হানাদাররা নিজ নিজ শিবিরে চালিয়া যাইবার পর গ্রাম্যচাষীরা জমিতে নামিয়া ধান কাটিতে শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায় যে, পাক সৈন্যরা ধান্য জমিতে কর্মরত লােকদের দেখা মাত্রই মুক্তিফৌজ সন্দেহ করিয়া নিজেদের প্রাণের ভয়ে দূর হইতেই গুলি ছাড়া শুরু করে। যাহার ফলে চাষীরা দিনের বেলায় মাঠে নামিতে সাহস পায় না। সন্ধ্যার পর শত্রু সৈন্যেরা মুক্তি ফৌজের আক্রমণের ভয়ে নিজ নিজ শিবিরে চলিয়া যায়। এই সময়ে চাষীরা মাঠে নামিয়া ধান কাটিয়া ভাের হইবার পূর্বেই স্ব স্ব গৃহে ফিরিয়া আসে ।।
বাংলাদেশ (1) a১: ২২ ॥ ২২ নভেম্বর ১৯৭১
যে ঘটনার যুড়ি নেই
মৃত্যুপাগল
কয়েকদিন আগের কথা। ঢাকার উপকণ্ঠে কোন এক বস্তি এলাকা। পাক দস্যুদের দৌরাত্মের। ভয়ে কেউ তার বস্তিতে থাকেনি—চারদিকে শূন্যতার ছাপ; কোথাও জন-মানবের সাড়া শব্দ নেই। এক বৃদ্ধ বস্তীর কোনে পড়ে রয়েছেন; হােক সে বস্তী, তা তার মায়া কাটাতে পারেনি বৃদ্ধ অসীম উদ্দীন। ঐ বস্তীর কোন এক কোনে আশ্রয় নিয়েছিলেন বীর মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলাল । হঠাৎ একদিন পাক-সৈন্যরা গেরিলাদের আশ্রয়স্থলের দিকে এগুচ্ছে—অন্য প্রান্ত হতে দেখছে এই বৃদ্ধ লােকটি। ভাবলেন কি করা যায়? কালতিপাত না করে গেরিলাদের আশ্রয় স্থলের বিপরীত দিকে ছুটে গিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে হাঁফ ছাড়লেন—“জয়বাংলা। তারি সঙ্গে পাক সৈন্যরা গতি পাল্টালাে। আর ওদের কামানে, মেশিনগান হতে পতাকাকে লক্ষ্য করে উড়তে শুরু করলাে ঝকঝক বুলেট, বুলেটের পর বুলেট গিয়ে বৃদ্ধের হৃদপিণ্ডকে ঝাঝরা করে দিলাে । কিন্তু মরতে দিলেন না তরুণ। তাপস গেরিলা যােদ্ধাদেরকে। এর জুড়ি ইতিহাসেও খুঁজে হয়রান হতে হয়!
উত্তাল পদ্মা # ১; ১ ॥ ২৪ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় নিষ্প্রদীপ মহরা রৌমারী ॥ ২৩শে নভেম্বর
ঢাকার গায়েবী বাণী থেকে প্রচারিত সংবাদে প্রকাশ আগামী কল্য সন্ধ্যা থেকে ঢাকা শহরে নিষ্প্রদীপ মহরা অনুষ্ঠিত হবে। এই মহরার অন্তরালে চলবে পাক সামরিক জান্তাদের পুর্নাঙ্গ যুদ্ধের পায়তারা।
অগ্রদূত | ১: ১৩ ২৪ নভেম্বর ১৯৭১।
২৫শে মার্চের পুনরাবৃত্তি
| গত ১৭ই নভেম্বর অধিকৃত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে পাকিস্তানের জঙ্গীচক্র পুনরায় কাফিউ জারী করে। মুক্তিসংগ্রামীদের আক্রমণে নাজেহাল হয়ে জঙ্গীশাহী দুটো শহরেই ২৫শে মার্চের কায়দায় জনসাধারণের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। কোনাে একটি দালালী সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে মুক্তিসংগ্রামীদের নামের একটি তালিকা প্রস্তুত করে তারা বাড়ী বাড়ী তল্লাশী চালায়। প্রকাশ, তাদের না পেয়ে পাক সৈন্যরা বহুসংখ্যক নিরীহ লােককে হত্যা করে, অনেকের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং বেশ কিছু সংখ্যক নির্বিবােধ নাগরিক ও স্কুল কলেজের ছাত্রকেও ধরে নিয়ে যায়। ফলে কাফিউ তুলে দেবার পর পরই জনসাধারণ নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন। এবারকার অভিযানে শত্রুসেনা প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় । সরাসরি সংঘর্ষে দুপক্ষের প্রচুর হতাহত হয় বলে জানা যায় ।
প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে মুক্তিসংগ্রামীরা বহু এলাকাকেই শক্রকবলমুক্ত করেছেন। নােয়াখালীতে একটি এফ-৮৬ পাকিস্তানী জেট প্লেনও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে ।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে, জঙ্গীশাহী বিশ্বজনমতকে ধাপ্পা দেবার জন্যে ২৭শে ডিসেম্বর। ইসলামাবাদে জাতীয় পরিষদের যে গোঁজামিল অধিবেশন বসানাের প্রচেষ্টা চালিয়েছে সেটা পুরােপুরি বানচাল করে দিয়ে তার আগেই বাঙলাদেশের সর্বত্রই গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসন চালু
| করার জন্যে মুক্তিবাহিনী যে দুর্বার অভিযান চালিয়েছেন ঢাকার এই সরাসরি সংঘর্ষ তারই একটি
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১ : ৬ ২৫ নভেম্বর ১৯৭১
উপজাতীয়দের প্রাণে প্রাণে জাগরণের ছোঁয়া ঃ চট্টগ্রামের অন্যানী পাহারা দিচ্ছেন দুর্ধর্ষ ধনুর্ধর টিপরা বাহিনী (দক্ষিণ পূর্ব রণাঙ্গন থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি কর্তৃক প্রেরিত)
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূৰ্ব্ব রণাঙ্গনে বীর মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রচণ্ড মার খেয়ে ভীত সন্ত্রস্ত পাক-হানাদার বাহিনী তাদের ঘাঁটি ছেড়ে করে শুধুই পিছু হঠার চেষ্টা করছে। মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা শত্রুকে খেদিয়ে দিয়ে একের পর এক মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলছেন আর সেখানে অতন্দ্র প্রহরীর মতাে তীর ধনুক হাতে প্রহরা দিচ্ছেন পার্বত্য অঞ্চলের মং উপজাতীয় টিপরা বাহিনী। | বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের বীর সেনানী এই উপজাতীয়দের দীর্ঘ দিন ধরে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল জীবনের প্রতি পদক্ষেপে । শিক্ষা সংস্কৃতি, রাজনীতি, এমন কি অর্থনীতিতেও তারা ছিল অনেক পিছিয়ে । কিন্তু কে? আজ তাে আর তারা পিছিয়ে নেই? কোন প্রলােভন, কোন মােহই তাদের আজ সরিয়ে রাখতে পারেনি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরােভাগ থেকে। | অবশ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের এলাকার উপজাতীয়দের নানাভাবে প্রলুব্ধ করে তাদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টির অনেক অনেক প্রচেষ্টাই করেছিল পাক বাহিনী। আইয়ুবী আমলের লেজুর বৃত্তিকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী মংশাে প্রু এবং দাদার সুযােগ্য ভ্রাতা পরিষদ সদস্য আউং শাে কে লেলিয়ে দিয়ে ছিলাে চাকমাদেরকে মুক্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে। কিন্তু না, পারেনি। বহু সংখ্যক চাকমা মেয়েকে অপহরণ করে পশ্চিম পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করার পর সদলবলে রুখে দাঁড়ায় চাকমা উপজাতীয়রা। | অপর দিকে সংগ্রামের শুরু থেকেই রামগড়ের টিপরা বাহিনী ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে একাত্ম । মং রাজা এপ্রিল-মে মাসে শত্রু কবলিত রামগড় ছেড়ে মুক্তাঞ্চলে চলে গেলে তার সুযােগ্য অনুগামী টিপরারা ধনুক হাতে জঙ্গলে জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। আড়াল থেকে আক্রমণ চালিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে হানাদার সৈন্যদের। পরে মুক্তি বাহিনীর ক্রমবর্ধমাণ অগ্রগতির সাথে তারাও এগুতে থাকে তাদের ধনুক নিয়ে। এক একটি করে নূতন মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠে আর ধনুকধারী টিপরারা সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে। প্রস্তুত হয়ে থাকে পাক সেনাদের পরবর্তী আক্রমণের সম্মুখে প্রবল প্রতিরােধ গড়ে তােলার প্রবৃত্তি নিয়ে। | দিন যায়, রাত কাটে । উপজাতীয় টিপরাদের সেদিকে মাথা ঘামাবার জো নেই। অতন্দ্র প্রহরীর মতাে সর্বক্ষণ লেগে আছে তারা শত্রু নিধনের কাজে। কোথায় শত্রু, কতজন শত্রু, তাদের অবস্থান। প্রভৃতি জানাবার জন্য অহরহ তারা যােগসূত্র রক্ষা করে চলেছেন বাঙ্গালী মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে। পরবর্তী আক্রমণের জন্যে মুক্তি সেনাদের নিয়ে যাচ্ছে পথ দেখিয়ে।
সাপ্তাহিক বাংলা ৪ ১ : ৬ ॥ ২৫ নভেম্বর ১৯৭১
ঢাকায় আবার কারফিউ’র হিড়িক : ধ্বংসের তান্ডব শুরু
ঢাকা ২৪শে নভেম্বর – মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী গেরিলাদের ক্রমবর্ধমান বেপরােয়া আক্রমণ ও প্রতিদিন অফিস-আদালত, কলকারখানা এবং পাক সামরিক বাহিনীর টহলদার সৈন্যদের আড্ডাখানায়
বেসুমার বােমা ফাটার দরুন নাজেহাল পাক সমর নায়কেরা খাছ রাজধানী ঢাকায় আবার কারফিউ জারী করেছে। কিন্তু কার কারফিউ কে শােনে। মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী গেরিলারা কারফিউর মধ্যেও বিনা বাধায় জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিবিসি ও রয়টারের সংবাদদাতা জানান যে, ঢাকায় ইপি আর হেড কোয়ার্টাস-এ আক্রমণ চালিয়ে তিনজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে হত্যা করেন। এদিকে পশ্চিমা দালাল নরকের কীট হামিদুল হক চৌধুরীর কাজলাস্থ মােড়ক কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গেরিলারা কারখানাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন। আতঙ্কগ্রস্ত পাক সৈন্যরা ঢাকা শহরে আবার গেরিলা খোজার নামে নির্মম ও নৃশংস বর্বরতা শুরু করেছে বলে এ, এফ, পি জানিয়েছেন।
আমার দেশ ॥ ১৩ সংখ্যা ॥ ২৫ নভেম্বর ১৯৭১
রাতের বেলায় সারা বাংলাদেশে কায়েম হয় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ত্ব
ঢাকা থেকে মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজ ইউর্ক’-এর বিশেষ প্রতিনিধি সিনিয়র সম্পাদক আর ননা। দ্যা বােরচাগ্রাফ বাংলাদেশের অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা খুবই নির্ভরযােগ্য ও বিশ্ববাসীর কাছে তা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিশেষভাবে তুলে ধরবে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর এখন মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে। পাকসেনারা এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের পথে। সারা বাংলাদেশে এখন ১ লক্ষের উপর গেরিলা সৈন্য খান সেনাদের খতম করবার কাজে নিয়ােজিত। চরম আঘাত হেনে শত্রুকে ধরাসায়ী করবার সময় আজ সমাগত। সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ বলছে, আমরা প্রতিশােধ চাই। ঘরে ঘরে আজ সত্যই দুর্গ গড়ে উঠেছে। অবিচল বাঙ্গালী আজ যুদ্ধ করছে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের সত্ত্বাকে সু-প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। জয়ের চরম লগ্ন আজ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রান্তে। বাঙালী অনুভব করছে বিজয় লক্ষ্মির হাতছানি।
সাংবাদিক বােরা লিখেছেন। | “আমি ও লণ্ডন ডেলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ক্লার হােলিং ঢাকা থেকে ৫ মাইল দূরে মুক্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতা যােদ্ধাদের সদর দফতরে আমরা দেখতে পেলাম, যােদ্ধারা প্রকাশ্যেই তাদের আস্তানার চার ধারে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছে। ওদের কোন ভয় নেই পাক-ফেীজের জন্য। প্রত্যেকেই ওরা পরস্পরের সাথে কথা বলেছিল সাধারণ কণ্ঠস্বরে। গেরিলা নেতা আবদুল মান্নান আমাদের বলেন, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা তাই ভয় পাই না। পাক-ফৌজ আসছে এই খবর পৌছে যায় আমাদের কাছে। যথাসময়ে জনসাধারণ আমাদের হুশিয়ার করে দেয় পাক ফৌজের আগমন সম্পর্কে। আমরা কেউই এখন পাক-ফৌজের কোন আক্রমণের আশংকা করছিনা।’ মান্নানের বয়স ৪৩ বৎসর। এক সময় সরকারী চাকুরে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি এই মুক্ত এলাকার ১৫০০০ লােকের শাসন পরিচালক ও গেরিলা নেতা। মান্নান বলেন, পাক-সামরিক বাহিনীর এখানে আসবার। সাহস নেই। আমরা ইচ্ছা করলে যে কোন জায়গায় যেতে পারি। দিনের আলােতেই যেতে পারি।”
সন্ধ্যায় মান্নানের সাথে ভাত খেতে খেতে আমাদের আরাে অনেক কথা হয় । মান্নান বলেন, কদিন। আগে আমরা এক ট্রাক পাক-ফৌজকে খতম করেছি। ১৯ জন সৈন্য ছিল ট্রাকে। আমাদের ডুবুরিরা। ক্যাপ্টেন কে, এম, সাজাহানের নেতৃত্বে দুটি পাক-সামরিক জলযান ডুবিয়ে দিয়েছে। ২৫ বছর বয়সের কমাণ্ডে নেতা কথার মধ্যে পাক ফেীজকে বিদ্রুপ করে বলে ওঠেন, “ওরা কাপুরুষ। ওদের মত ভীতু সৈনিকের কথা কল্পনা করা যায় না। আমরা যদি নদীর এপার থেকে একটা ফাকা আওয়াজ করি তবে ওরা নদীর অপর পারে যেয়ে আশ্রয় নিতে চায়। আর তখনই ওরা গিয়ে পড়ে নদীর অপর পারে আমাদের লুকিয়ে থাকা অন্য গেরিলা দলের হাতে। সব খতম হয় ওরা … গেরিলারা গর্ব করে বলেন,
কদিন আগে ওরা ৩১ জন পাক-ফৌজ ও রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে ফেলেন এবং পরে তাদের গুলি করে মারেন। শত্রু সৈন্যকে বন্দি করে রাখবার মত কোন সংগতি নেই আমাদের। তাই গুলি করে মারতে হয় আমাদের যুদ্ধ বন্দিদের। তবু রাখতাম যদি ওরা আমাদের ধৃত বন্ধুদের অমনভাবে গুলী করে হত্য না করত।” | মান্নান আমাদের বুঝিয়ে বলেন, “গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই
ভােটের বিজয়কে করে পদদলিত। সামরিক বাহিনী আমাদের উপর চালায় অকথ্য অত্যাচার। আমরা | এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। শক্রর অত্যাচার আমাদের করে তুলেছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা যুদ্ধ করছি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি, একটি নতুন দেশ গড়বার জন্য”। নিউজ উইকের খ্যাতনামা সাংবাদিক আরাে লিখেছেন ? | “পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক সময় গােলাবারুদ ও অস্ত্রে গেরিলাদের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী ছিল। কিন্তু এখন এই শক্তি ক্ষয়ের পথে । তারা আর এদিক থেকে গেরিলাদের চাইতে উচ্চমান সম্পন্ন | নয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের ভরসা ছিল, আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাবে। তাই তার অস্ত্র ও গােলাবারুদের ঘাটতি হবে না। কিন্তু আমেরিকার সামরিক সাহায্য বন্ধ করায় পাক রণসজ্জায় দারুণ আঘাত লেগেছে। | বাংলাদেশের এখন সব সরকারী কর্মচারী, গ্রামে মােড়ল, সকলেই গােপনে সাহায্য করছে মুক্তিবাহিনীকে। কম পক্ষে বাংলাদেশের চারভাগের একভাগ অঞ্চলে এখন পুরাপুরি মুক্তিবাহিনীর প্রশাসন চালু হয়েছে। রাতে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায়ই চলে যায় গেরিলাদের অধিকারে। এখন খেয়া ঘাটে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে কদাচিৎ পাক-ফৌজ চোখে পড়ে। সহরগুলাের বাইরে সাধারণতঃ পাক ফৌজরা এখন খুব কমই টহল দিয়ে বেড়ায়। | পাক সামরিক বাহিনীর নানা অত্যাচারের কাহিনী আমি শুনেছি। একটি গ্রামে ১০ বছরের আরেকটি মেয়ের উপর বলৎকার করে ১২ জন পাক-সৈন্য। তার পর তাকে হত্যা করে তারা। এক | গ্রামে সৈন্যরা গিয়ে দুজন যুবতি মেয়ে দাবী করে। গ্রামবাসী জানায় ফৌজি বড় কর্তাকে। দু’জন | ফেীজকে ধরে নিয়ে যাবার আদেশ হয়। পরদিন সেনাবাহিনীর লােক এসে পুড়িয়ে দেয় সারা গ্রামটাকেই। ৩৮ জন লােক নিহত হয় এই ফৌজি হামলায় । | যেখানেই আমি গিয়েছি মুক্তিবাহিনীর লােক ও সমর্থকরা সর্বত্রই বলছে, শেষ চূড়ান্ত বিজয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। একটা নদীর খেয়া ঘাটে দেখতে পেলাম একজন পাক সামরিক কর্মচারী একজন | সাধারণ লােককে ছড়ি দিয়ে পিটাচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে, মার বন্ধ করেন অফিসারটি। পরে | সেই মার খাওয়া লােকটি আমাকে বলেছিল ; রােজ রােজ এমনি অনেক ঘটনাই ঘটে। কিন্তু | প্রতিশােধের দিন আসছে। আর সেদিনটা ওদের পক্ষে হবে ভয়ঙ্কর।” (নিউজ উইক, নভেম্বর ২২, ১৯৭১)
দয়বাংল! (1) !! ১ : ২৯ [ ২৬ নভেম্বর ১৯৭১
দুনিয়াকে বিভ্রান্ত করার পাকিস্তানী নির্দেশ
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারী মিঃ এম, এম, কাজিম সি, এস, পি এর বিগত ১৬/১০/৭১ ইং তারিখের এক সার্কুলার আমাদের হস্তগত হয়েছে। ঐ নির্দেশ নামায় স্বরাষ্ট্র | সেক্রেটারী তার অধীনস্ত সকল বিভাগকে ‘Rebels’ বিদ্রোহী, মুক্তিবাহিনী, মুক্তিফৌজ, মুক্তি সেনা শব্দগুলাের স্থলে (enemies) শত্রু’ নামে উল্লেখ করার এবং ভারত’ কথাটার স্থলে ‘হিন্দুস্থান’ শব্দ সকল ব্যাপারে ব্যবহার করার নির্দেশ জারি করিয়াছেন।
মুক্ত বাংলা (১) i ১: ১০ [ ২৭ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলা দেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশে ঈদ হয় নাই।
| | রিপাের্ট দুরমুজ আলী]।
| যে উৎসব যে আনন্দ, যে মহামিলনের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর ঈদের আবির্ভাব মানুষের ঘরে সে বার্তা অশ্রুসজল নয়নে ফিরে চলে গেছে। বাংলার ঘরে ঘরে বিষাদের ছায়া, প্রতি ঘরে কান্নার রােল, প্রতিটি মানুষের চোখের জলে এবারের ঈদ বেদনাহত হয়ে ফিরে গেছে। ঈদ উৎসবের ভাষা স্তব্ধ । আনন্দের ভাষা কণ্ঠরুদ্ধ। মহামিলনের বদলে মহাবেদনা নিয়ে ফিরে গেছে সবাই নিজ নিজ আশ্রয়ে। এবার আবার কিসের ঈদ? সমগ্র বাংলা জুড়ে নর কঙ্কালের মিছিল। শকুনি গৃধিনীর রাজত্ব। এখানে। পুত্রহারা মায়ের আকুল আৰ্তনাদ। মাতৃহারা শিশুর মর্মভেদী হাহাকার। গৃহহারা, সম্পদহারা, সৰ্বহারাদের দীর্ঘশ্বাসে আকাশ বাতাস ব্যথিত। বাংলার প্রকৃতি বেদনায় ক্ষত বিক্ষত । মানুষ লড়াই করছে মৃতুর সঙ্গে দারিদ্রের সঙ্গে, নিষ্ঠুর পাক ফৌজ ও তার অধস্তনদের সঙ্গে। শুধু ঈদ নয় বাংলার শরৎও এসেছিল কিন্তু শারদীয় উৎসব হয় নাই। আনন্দ হয় নাই। জনজ্জননী দূর্গা বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িতা লাঞ্ছিত হয়েছেন। বাংলায় মন্দিরও নাই দেবতাও নেই। আজ বাংলার কুলবধূ সান্ধ্যদ্বীপ জ্বালে না, বিগ্রহ দেবতাকে প্রণাম জানাবার কেউ নাই আজ বাংলায়। বাংলায় উলুধ্বনি আর হয় না, কাসার ঘণ্টাও বাজে না। মন্দিরের ঘরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার জন্য কোন ভক্ত পূজারী পাক অধিকৃত বাংলায় নাই। বাংলায় ফুল হয়ত আছে তার সৌন্দর্য্য উপভােগ করার কোন লােক নাই। বাঙ্গালী বাড়ীঘর চাকরী ব্যবসা সব ছেড়ে সর্বহারায় পরিণত হয়েছে, লাঞ্ছিত মানবতা কেঁদে ফিরে সৰ্ব্বত্র। বাংলায় সুখ শান্তি নির্মমভাবে নিহত । বাংলায় আজকে আছে পাক ফেীজের পাশবিক অত্যাচার আর। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের রাইফেল মেশিনগানের গােলাগুলি। আজ বাংলাদেশ এক বিশাল রণক্ষেত্র। ৭ মাস ধরে বাংলার মানুষ রাতে ঘুমুতে পারে নাই। আহারের কোন প্রেরণা পায় নাই। বাংলার চাষীরা। মেঠো গান ভুলে গেছে। রাখালেরা আর মাঠে মাঠে বাঁশী বাজায় না। শিশুদের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝিদের ভাটিয়ালী গানে নদী মাতৃক বাংলা আর মুখরিত হয়ে উঠে না। যাত্রা থিয়েটার বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছে। পল্লীগীতি, লােকগীতি, বাউল, মুর্শেদী কীর্তনের জন্মভূমি বাংলা আজ প্রতিহিংসা পরায়ণ। অত্যাচারী জালেমশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৈনিক। বাংলায় লুণ্ঠনকারী আর ডাকাতেরা বড়লােক হয়েছে, লক্ষপতি হয়েছে, আবার অনেক ধনী পথের কাঙ্গাল হয়েছে। নির্বিচারে নিরাপরাধ । জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, আর অপরাধীরা রাজাকার হয়েছে। এখনও বাংলায় গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ধলেশ্বরী, তিস্তা প্রবাহিত হয় কিন্তু তার পানি লাল । বাংলার শ্রমিকেরা চাকরী হারিয়েছে। কৃষকেরা জমি ছেড়ে চলে গেছে। ছাত্র সমাজ স্কুল কলেজ ছেড়ে দিয়েছে। বাঙালী দোকানদার দোকান ছেড়েছে। বাংলা আজ মুক্তি যােদ্ধা।
সংগ্রামী বাংলা (1) ১: ২ ॥ ২৭ নভেম্বর ১৯৭১।
কালিগঞ্জে জনসভা
খুলনা ২০শে নভেম্বর : আজ অপরাহ্নে সাতক্ষিরা মহকুমার কালিগঞ্জ থানার সম্মুখে এক বিরাট জনসমাবেশে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এম, এন, এ মুক্তিবাহিনীর সফল জওয়ান ও অফিসার এবং নাগরিকদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। জনাব মঞ্জুর বলেন যে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা এ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। তিনি পাক দস্যুদের হুশিয়ার করে বলেন যে আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে আটক করে রাখার শক্তি ইয়াহিয়া তথা পাক সরকারের। নেই। তিনি বলেন যে আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধারা খুব শীঘ্রই পাক দস্যুদের উচিত শিক্ষা দিতে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে নিয়ে আসবে।
জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ভারত সরকার ও ভারতের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন যে, তারা যেভাবে শরণার্থীদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগীতা করেছেন তার কোন তুলনা হয়না। এজন্য বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতবাসীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবেন।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১ : ১৫ ২৮ নভেম্বর ১৯৭১
সিলেটে হার্মাদেরা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ
(ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি)।
জকিগঞ্জ, ২৫শে নভেম্বর পাক তস্করদের তথাকথিত শক্তঘাটি জকিগঞ্জ আটগ্রাম থেকে হানাদার দস্যু এবং তাদের তাবেদার ও পদলেহী কুলাঙ্গারদের সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ করে দুদ্ধর্ষ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মুক্তি যােদ্ধারা (ফ্রিডম ফাইটার্স) প্রচণ্ড বেগে সিলেট শহর অভিমুখে এগিয়ে চলেছেন। বঙ্গশার্দুলদের দুর্বার অগ্রাভিযানের মুখে শক্রদের সমস্ত প্রতিরােধ ব্যর্থ হচ্ছে এবং তাদের আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত প্রতিরক্ষা বুহ্য ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
হানাদার বাহিনী সহরের অদূরে গােলাপগঞ্জের কাছে শক্তি সংহত করছে। এখানেই তারা মুক্তি বাহিনীর পথরােধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে মুক্তিবাহিনীর বীর জোয়ানেরা হানাদারদের দূরপাল্লার কামানের মুহুর্মুহু গােলা বর্ষণ এবং বিমান আক্রমণ প্রতিহত করে ছাগলিবাজার অতিক্রম করে চুড়খাই পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছে এবং হানাদারদের মুখােমুখি অবস্থান করেছে। এখানেও একটি প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটে যেতে পারে। উভয়পক্ষই মােকাবেলার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত।
অন্যদিকে তামাবিল হয়ে বঙ্গশার্দুলদের অপর একটি দল বিরাট শক্তি নিয়ে শালুটি কর অভিমুখে এগিয়ে আসছে দুর্বার বেগে। ছাতক, জৈন্তাপুর, কুলাউড়া প্রভৃতি অঞ্চলেও মুক্তিবাহিনী হানাদারদের কোনঠাসা করে রেখেছে। শক্ররা সর্বত্র অগ্রবর্ত্তী ঘাটি ছেড়ে পিছু হটে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তারা চতুর্দিক থেকে এমনভাবে অবরুদ্ধ হয়ে আছে যে, পিছনে হটে যাওয়ার কোন সুযােগও তাদের জুটছে না। লাতু, বড়লেখা ও বিয়ানীবাজারে হানাদার দস্যুরা এমনি ত্রিশঙ্কু অবস্থার সম্মুখীন।
শত্রুদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন
শমশেরনগর বিমান বন্দর ও তৎসংলগ্ন সামরিক ছাউনিতে হানাদার দস্যুরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। শত্রুরা অনবরত তাদের সদর দফতরে শক্তি বৃদ্ধির জন্য জরুরী বার্তা প্রেরণ করছে। কিন্তু নতুন সৈন্য প্রেরণের কোন পথই আর ভােলা নেই। রেলপথ বিচ্ছিন্ন সড়কপথ বিধ্বস্ত । জলপথ বিপদ সঙ্কুল। একমাত্র পথ উন্মুক্ত ছিল আকাশে। কিন্তু সে পথও এখন রুদ্ধ হয়েছে। শালুটিকর ও শমশেরনগরের বিমান ঘাঁটি দুইটিই মুক্তিবাহিনীর দূরপাল্লার কামানের আয়ত্বে এসে যাওয়ায়। তাই প্রকৃতপক্ষে সমগ্র সিলেটেই শক্ররা এখন অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। তাদের রসদ ও অস্ত্র-বারুদ সরবরাহ এবং লােকবল বৃদ্ধির সব পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাজেই সিলেট শহরের পতনও অনিবার্য এবং অত্যাসন্ন। তবে হানাদাররা যদি জনপদ ধ্বংশের ঝুঁকি নিয়ে ব্যাপক বিমান হামলার পথ বেছে নেয় তাহলে তাদের অবস্থান সাময়িকভাবে মজবুত হবে। কিন্তু তাতেও চরম বিপর্যয় রােধ করা সম্ভব হবে না। কেননা মুক্তি বাহিনী ইতিমধ্যে বিমান হামলা প্রতিরােধের ক্ষমতাও অর্জন করছে। চলতি অভিযানেই তার কয়েকদফা প্রমাণ মিলেছে।
মুক্তবাংলা (১) [ ১; ১০ | ২৯ নভেম্বর ১৯৭১।
য পলায়তি স জীবতি ॥ সংবাদ সমীক্ষক ॥
মুজিবনগর, ২৬শে নভেম্বর- বি, বি, সির এক খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশে অবস্থানরত বৃটেন, আমেরিকা ও পশ্চিম জার্মানীর সমস্ত নাগরিকদের কালবিলম্ব না করে স্বদেশে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটাই নাকি এরূপ নির্দেশের কারণ। যারা স্বদেশে ফিরতে চান তাদের ঢাকাস্থ নিজ নিজ রাষ্ট্রদূতের অফিসে যােগাযােগ করতে বলা হয়েছে।
এই খবরে আরাে বলা হয়েছে যে, যারা এখনও ফিরতে পারছেন না তারা যেন নিরাপদ স্থানে। আশ্রয় নেন এবং সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুত রাখেন। ( বিপদ দেখা দিলে সময় সুযােগ বুঝে যে পালাতে পারে সে-ই বেঁচে যায়। বৃটীশরা চিরকালই বুদ্ধিমান জাত। ওরা কালের গতি বুঝতে পারে। পলায়নের প্রয়ােজন দেখা দিলে, সে প্রয়ােজনটিকে ওরা তাসের ব্রে খেলায় ইসকাবনের বিবির মতােই ব্যবহার করে বসে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধ আরম্ভ হবার প্রাক্কালেও দেখা গিয়েছে, ঢাকা থেকে ওদের নাগরিকরা পালাচ্ছেন আর পালাচ্ছেন। আমেরিকা জার্মানী এবং অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ নাগরিকরাও তখন বৃটীশদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে থাকেন। | এবারের অবস্থাতাে আরাে সঙ্গীন। এবার বিপদ ঘরে বাইরে আনাচে কানাচে! খানসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংগ্রাম অচিরেই আরাে জটিল ও ভয়ঙ্কর রূপ গ্রহণ করবে। আবার ভারত-পাক যুদ্ধও নাকি অতি আসন্ন । এ অবস্থায় বিদেশীদের পক্ষে পলায়নই বীরত্বের পরিচয়।
তাইতাে বাংলাদেশ থেকে বিশেষতঃ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনা থেকে বৃটীশ, আমেরিকান, জার্মানী প্রভৃতি বিদেশী নাগরিকরা পালাই পালাই রবে ছুটছেন সবাই। কেউবা স্বদেশে, কেউবা ভিনদেশে বা আন্-বাংলাদেশে পালান, সবাই পালান, আত্মরক্ষার জন্য পালাতে দোষ নেই। ১৯৭১ সালটাই পলায়নের বছর হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাক্। এই বছরের প্রথম ৬ মাসেই প্রায় ১ কোটি শরণার্থী বাঙ্গালী পালিয়েছেন ভারতে, কিছু বিদেশী তাদের স্বাদেশে। বাদ বাকী বিদেশীরা এখন পালাচ্ছেন শেষ মুহূর্তে। | কিন্তু এখানেই বােধ হয় পলায়নের শেষ নয়। বাংলাদেশ থেকে এত যে পলায়ন, সেই পলায়নের যে মূল কারণ, সেই কারণটারই পলায়ন এখনাে বাকী। পালাবেন তিনিও, নির্ঘাত পালাবেন । হয়তাে পলায়নের শেষ মুহূর্তটা শেষ হয়ে যাবার পূর্বক্ষণটির অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। তবে পলায়নের জন্য সে, দু’ পা তুলেই বসে আছেন, তাতে বিচিত্র কী? সর্বপলায়নের সর্বকারণ-কারণ স্বয়ং জঙ্গীশাহী সদলবলে পালাবার প্রস্তুতি চালাচ্ছেন বােধ হয়। কারণ, “য পলায়তি স জীবতি”। এত বড় উপাদেয় উপদেশ বাক্যটা তিনিই কি আর জানেন না?
সাপ্তাহিক বাংলা # ১: ৭ ॥ ডিসেম্বর ১৯৭১
গভর্ণর মালিক আহত ঈদের দিন ঢাকায় প্রচণ্ড বােমা বিস্ফোরণ
বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা এবার অনারম্বর পরিবেশে ঈদ-উৎসব পালিত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। ঢাকায় কড়া সামরিক প্রহরাধীনে আউটার স্টেডিয়ামে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই জামাতে প্রতি বৎসর প্রচুর জনসাধারণ ঈদের নামাজ আদায় করতাে। কিন্তু এ বছর বাংলাদেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক সহস্র সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের কঠোর নিয়ন্ত্রণাধীনে
ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ডাঃ আবদুল মােত্তালিব এই নামাজে শরীক হয়েছিলেন ।
গভর্ণর মালিক ঈদের নামাজ আদায় করে যখন ফটক দিয়ে বের হয়ে গভর্ণর হাউসের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় প্রচণ্ড বােমা বিস্ফোরণের ফলে গভর্ণরের সফর নিয়ন্ত্রণকারী পাইলট গাড়ীটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে বলে ঢাকা থেকে আজ খবরে জানা গিয়েছে। এই বােমা বিস্ফোরণের ফলে গভর্ণর মালিক সামান্য আহত হয়েছে বলেও খবরে উল্লেখ এবং বর্তমানে তিনি চিকিৎসার জন্য পঃ পাকিস্তানে অবস্থান করছেন। | ডাঃ মালিক ইয়াহিয়ার এজেন্ট নিযুক্ত হয়ে ঢাকায় আসার পর দুই বার মুক্তিযােদ্ধাদের হাত থেকে অল্পের জন্য জীবন বাঁচাতে সক্ষম হলেন। মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা সে স্বত্বেও ইয়াহিয়ার পদলেহী কুত্তার দলকে শায়েস্তা করার জন্য সদা জাগ্রত।
রণাঙ্গণ (২) [ ২ ডিসেম্বর ১৯৭১ কঠোর প্রহরায় পরিষদ সদস্য।
(স্টাফ রিপাের্টার)
বাংলাদেশের শত্রুসেনা অধিকৃত অঞ্চলে যে সমস্ত নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা অবস্থান করছেন তাদের মুখ দিয়ে নতুন বােল” বলানাে হচ্ছে। খবরটা পাওয়া গেছে বাংলাদেশের এক মুক্তাঞ্চলে, সদ্য আগত এক পদস্ত সরকারী কর্মচারীর কাছে থেকে।
“রণাঙ্গণ’এর সাথে যােগাযােগ করে উক্ত সরকারী কর্মচারীটি বলেন “বর্বর ইয়াহিয়া শাহীর। তথাকথিত ক্ষমা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের কড়া সামরিক পাহারায় রাখা হয়েছে।”
তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের কথা বার বার উল্লেখ করেন এবং বিশ্বের মানব সমাজের কাছে সার্বিক সাহায্য ও সহযােগিতা করার জন্য আবেদন জানান।
রণাঙ্গণ (২) ২ ডিসেম্বর ১৯৭১
বিদেশীদের দৃষ্টিতে ঢাকা শহর ও মুক্তিবাহিনী
ঢাকা, ২৯শে নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধাদের সাফল্যজনক চোরাগােপ্তা আক্রমণে হানাদার সৈন্যরা আজ ভীত সন্ত্রস্ত ও দিশেহারা। দখলীকৃত ঢাকা শহরে সামরিক দফতরে প্রতিদিন যে টুকরাে টুকরাে খবর পৌছাচ্ছে তার ফলে হানাদার সৈন্যরা চূড়ান্তভাবে মুক্তিবাহিনীর হাতে চরম মার খাওয়ার সেই ভয়ঙ্কর দিনটির জন্য অসহায়ভাবে প্রতীক্ষায় আছে।
মুক্তিযােদ্ধাদের মারের চোটে জঙ্গী সরকার এক্ষণে মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। | গত ২৭শে নভেম্বর হানাদার বাহিনীর দখলীকৃত বাংলাদেশের সেনাধ্যক্ষ লেঃ জেনারেল এ, কে, নিয়াজী সর্বনাশা ঘটনা মাথায় নিয়ে সারা বাংলাদেশে ছুটোছুটি করতে করতে ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলন করে। | উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনের খবর দিয়ে বি বি সি জানাচ্ছে, সামরিক সরকার বলছে বর্তমানে ঢাকা শহরে ২ সহস্রাধিক মুক্তি যােদ্ধা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। | বি বি সি গত সপ্তাহব্যাপী মুক্তিবাহিনীর ঢাকা আক্রমণের খবর পরিবেশন করে বলছেন, মুক্তিবাহিনী ঢাকা-ময়মনসিংহের মধ্যবর্তী সড়কের ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস করে দিয়েছেন। ফলে এ পথে সড়ক যােগাযােগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে পড়েছে। এদিকে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণের
ফলে ঢাকা যশােরের মধ্যে সড়ক ও বিমান যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ঢাকাবাসী আটকে পড়ে গেছে। ফরিদপুর, বরিশাল ও অন্যান্য নদনদীতে লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে গ্রামের বাড়ীর সাথে যােগাযােগ হারিয়ে তারা এক অসহায় অবস্থায় পতিত হয়েছেন। | বি বি সি সংবাদ পর্যালােচনা করে বলছেন, যে ঢাকা শহর একদা মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কর্মচঞ্চল থাকতাে! আজ সেটা সন্ধ্যার পর মৃত নগরীর রূপ নেয়। এছাড়া স্কুল কলেজ বন্ধ রয়েছে। মুক্তিবাহিনী গত ২৭শে নবেম্বর জনৈক দালালদের একটি পেট্রোল পাম্প ধ্বংস করে দিয়েছেন। | বি বি সি-র খবরে প্রকাশ, মুক্তিবাহিনী গত ২৮শে নবেম্বর সেগুন বাগিচায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় জুট বাের্ডে বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, গত সপ্তাহের গােড়ার দিকে মুক্তি যােদ্ধারা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি ব্যাঙ্কে বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৭ জন দালালকে হত্যা করেছেন। | মুক্তি বাহিনীর প্রকাশ্য আক্রমনে ভীত ও সন্ত্রস্ত জঙ্গী সরকার গত ২৪শে নবেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত পুনরায় ঢাকায় কারফিউ জারী করে। পূর্ব ঘােষণা ছাড়াই এবারও কারফিউ জারী করা হয়। এখানে উল্লেখযােগ্য গত ১৭ই নবেম্বর ১৫ ঘণ্টা ব্যাপী কারফিউ জারী করে মুক্তিযােদ্ধাদের আটক করার অজুহাতে ব্যাপকভাবে হত্যা, লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণ করে। আমাদের দুঃসাহসিক যােদ্ধারা শহরের বিভিন্ন অংশে এ ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুসৈন্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন। | দ্বিতীয়বারের কারফিউ কালীন হানাদার পশুরা পূর্ব ঘটনার অনুরূপ অপচেষ্টায় মাতলে এবারও আমাদের স্বাধীনতাকামীরা তার প্রতিশােধ নেন। ফলে শত্রুরা মাত্র ৪ ঘণ্টা পরেই কারফিউ তুলে প্রাণ। বাঁচানাের জন্য শহর থেকে নিজেদের আস্তানায় অবস্থান নেয়। | মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা উক্ত দিন সকালে সমগ্র ঢাকা শহরে গােলাগুলী ও বােমা দ্বারা আক্রমণ চালিয়ে একজন মহিলা দালাল সহ ৩ জনকে খতম করেন। এসব আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যস্থান ছিল রাজাকারবাগ পুলিশ সদর দফতর, খিলগা শত্রু অবস্থান ও পাটের গুদাম। | মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা উক্ত দিন কয়েকটি পাট গুদামও ভস্মিভূত করেন। এ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় অন্ততঃ ২০টি পাটগুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছেন।
বি বি সি-র অপর এক খবরে প্রকাশ, মুক্তি বাহিনীর দুর্ধর্ষ গেরিলাযােদ্ধারা ঢাকা থেকে ১৭ মাইল। দূরে গত ২২শে নবেম্বর মুন্সীগঞ্জ থানায় আক্রমণ চালিয়ে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরকে নিহত এবং কয়েকজনকে গুরুতররূপে আহত করেন। এর আগে মুন্সীগঞ্জ থানা ফাড়ি ও জ্বালিয়ে দেন। | হরগঙ্গা কলেজে হানাদার সৈন্য ছাউনির পৌণে এক মাইল নিকট দিয়ে প্রকাশ্য রাজ পথে দেড় শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা কুচকাওয়াজ করে ঘাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। | মুক্তিবাহিনী গত ২৬শে নবেম্বর দখলীকৃত ঢাকায় হানাদার সৈন্যদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালান।
এ সম্পর্কে এ এফ পি’র একটি সংক্ষিপ্ত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়।
মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসিক গেরিলা যােদ্ধারা পূবাইল ও আড়িখােলার দু’টি রেল সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জুের মধ্যবর্তী হানাদারদের রেল যােগাযােগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গেরিলা যােদ্ধারা মীরপুর সড়কে হানাদার সৈন্যবাহী একটি বাসে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেন। | মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসিক আক্রমণে গুলীবিদ্ধ হয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ২৩ জন বেঈমান দালাল হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়। এদের মধ্যে ৩ জন পথে প্রাণ হারায়।
জয়বাংলা (১) ১: ৩০ ! ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
কারফিউর অন্তরালে
| জঙ্গীশাহী কর্তৃক গত ১৭ই নভেম্বর ঢাকা শহরে পূর্ব ঘােষণা ছাড়া কারফিউ জারি করে হানাদার সৈন্যরা সারা শহরে ২৫শে মার্চের স্টাইলে পুনরায় নারীধর্ষণ, হত্যা ও লুণ্ঠন চালায়। মুক্তিবাহিনীর সাহসী যােদ্ধারা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা রেখে টিকাটুলী, লালবাগ, রাজারবাগ, সূত্রাপুর এলাকায় জঙ্গীসৈন্যদের বিরুদ্ধে মুখােমুখী আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে শত্রুসৈন্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। | হানাদার সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে গেরিলাযােদ্ধাদের গ্রেফতারের নাম করে দেড়শতাধিক নিরীহ যুবককে ক্যান্টনমেন্টে আটক করে। পরে এ সকল তরুণদের হত্যা করা হয়। | এই সান্ধ্য আইনের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পরে মুক্তিবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে প্রচণ্ড মর্টার আক্রমণ চালিয়ে রামপুরার টেলিভিশন ট্রান্সমিশনের কাছে জামাতে ইসলামীর একজন কুখ্যাত নেতাকে নিশ্চিহ্ন করে। দেন। ঐদিনই গেরিলাযােদ্ধারা ঢাকা শহরে প্রচণ্ড গােলাগুলী ও বােমা বর্ষণ করে আরাে ২ জনকে খতম ও ২৪ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন বলে এপি-র খবরে জানা গেছে। | বিবিসির এক খবরে প্রকাশ, গত ২৯শে নভেম্বর হানাদার সৈন্যদের ব্যাপক প্রহরার মধ্যেই শান্তি | নগরে অবস্থিত কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র দফতরে প্রকাশ্য দিবালােকে গেরিলাযােদ্ধাদের বােমা বিস্ফোরণের ফলে খান সেনাদের পদলেহী দালাল কর্মচারী গুরুতররূপে আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা সম্প্রতি খান সেনাদের পদলেহী দুইজন ডাক্তারকে গুলী করে হত্যা করেছেন।
জয়বাংলা (১) ১: ৩০ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
দখলীকৃত ঢাকা অন্যান্য শহর থেকে বিচ্ছিন্ন
এ এফ পি’র এক খবরে প্রকাশ, বাঙালী গেরিলাদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতায় সম্প্রতি যশাের, সিলেট, চাটগা, ঈশ্বরদি ও সৈয়দপুরের সঙ্গে ঢাকার স্থলপথে কোন যােগাযােগই ছিল না। বিমান পথই একমাত্র সম্বল। এখন সে যােগাযােগও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঐসব শহরের সঙ্গে ঢাকার আর কোন সংযােগই রইলাে না।
জয়বাংলা (১) | ১: ৩০ ৪ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা শত্রু কবলমুক্ত
(রণাঙ্গন প্রতিনিধি)
মুক্তিবাহিনীর অপূর্ব রণকৌশল ও জয়গাঁথা প্রচারে আজ সারা বিশ্বের বেতার-টেলিভিশনপত্রপত্রিকা মুখর হয়ে উঠেছে। | গত ২১শে নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস্-এর ঢাকাস্থ সংবাদদাতা ম্যাক্লোন ব্রাউনের একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
উক্ত সংবাদদাতা বলছেন সারা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী দুই তৃতীয়াংশ এলাকা শত্রু কবল থেকে | ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছেন। মুক্তিযােদ্ধারা আজ শহরের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, হােটেল, ব্যাঙ্ক, বিদেশী দূতাবাস, দোকান-পাট প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে আছেন। স্বাধীনতার প্রতি বাংলাদেশের জনগণ ধীরে ধীরে এক অটল আত্মবিশ্বাসে রূপান্তরিত হচ্ছেন। | লণ্ডনের সাপ্তাহিক নিউজ উইকের সিনিয়ার এডিটর মিঃ ব্রর্সগ্রেভ ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা মিঃ হােলিং ওয়ার্থের সাথে বাংলাদেশে দখলীকৃত এলাকা এবং মুক্তাঞ্চল সফর করে সদর | দফতরে ফিরে গিয়ে এক বিস্তৃত রিপাের্ট পেশ করেন।
এ সম্পর্কে নিউজ উইকের এক সাম্প্রতিক সংখ্যায় (২২শে নভেম্বর) মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের একটি বিশেষ রিপাের্ট প্রকাশ পায়।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে এক লক্ষ বাঙালী গেরিলা দখলদার সৈন্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সগ্রাম করে যাচ্ছেন এবং এর মধ্যেই প্রায় এক চতুর্থাংশ এলাকা নিজেদের করায়ত্ত করে নিয়েছেন। … প্রতি সপ্তাহে গ্রামাঞ্চলে গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার পরিসর ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে ডেইলী টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা মিঃ হােলিংওয়ার্থ ঢাকা থেকে লিখেছেন বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৪০ হাজার গেরিলাযােদ্ধা খান সেনাদের ওপর আক্রমণ করে যাচ্ছেন।
ঢাকা শহরে এখন বােমা বিস্ফোরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। পুরাতন ঢাকায় প্রতি রাত্রে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে গুলি বিনিময় হচ্ছে। | একজন বিদেশী কূটনীতিবিদ সম্প্রতি ঢাকা থেকে কলকাতায় ফিরে গিয়ে বলেছেন ঢাকা শহর এখন সূর্যাস্তের পর সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর অধীনে চলে যায়।
বিবিসি থেকেও বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে অনেক শহর ও গ্রাম রাত্রিবেলায় মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকে।
জয়বাংলার (1) l ১: ৩০ [ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকার পতন আসন্ন।
৪ ডিসেম্বর আমাদের রণাঙ্গন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মুক্তিবাহিনীর অমিত বিক্রমী যােদ্ধারা ঢাকা নগরীর মহম্মদপুর আবাসিক মডেল স্কুলের মধ্যে মাইন বিস্ফেরণ করেছেন। ফলে বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি ও ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে পাঁচটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র বিধ্বস্ত হয়ে গেছে । ৪০ জন গুলিবিদ্ধ পাক সেনা ঢাকা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ঢাকা বিমান বন্দরের উপর মুক্তিফৌজের বীর সেনানীরা আক্রমণ চালিয়ে প্রভূত ক্ষতি সাধন করেছে। সহস্র সহস্র মুক্তিবাহিনী, পাক হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত মুক্তিবাহিনী, সর্বত্র বিজয়ের পথে বীর বিক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে।
| পাক হানাদারদের নেতা নিয়াজী স্বীকার করেছিলেন যে ঢাকায় দুই হাজার গেরিলা আছে। প্রকৃতপক্ষে আছে হাজার হাজার, এবং তারা শীঘ্রই ঢাকা মুক্ত করবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১ : ১৬ ! ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১
অধিকৃত এলাকায় বুদ্ধিজীবিদের উপর দমন নীতি অব্যাহত
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
দখলীকৃত এলাকার অসামরিক গভর্ণর ডাক্তার মালেকের সরকারকে শিখণ্ডী খাড়া করিয়া বর্বর। জঙ্গীশাহী সরকার বাঙালী শিক্ষাবিদ সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিদের উপর অব্যাহতভাবে দমননীতি চালাইয়া যাইতেছে। | সম্প্রতি জল্লাদী বর্বরতার শিকার হইয়াছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যক্ষ ডঃ হাবিবুল্লা, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মনিরুজ্জামান ও ইমিরিটাস অধ্যাপক ডঃ এনামুল হক। তাঁহাদিগকে চাকুরী হইতে বরখাস্ত করা হইয়াছে। ডঃ মনিরুজ্জামান আগামী ছয়মাস কোন সরকারী বা বেসরকারী চাকুরী করিতে পারিবেন না বলিয়া হুকুমজারী হইয়াছে।
ইহা ছাড়া রাষ্ট্র বিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকিবার অভিযােগে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডঃ কুদরত-ইখুদা, ডঃ নীলিমা ইব্রাহিমও ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে হুঁশিয়ার করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
ইতিপূর্বে ডঃ আবুল খায়ের, জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব শহীদুল্লাহ প্রমুখ বিশিষ্ট অধ্যাপক ও কয়েকজন বুদ্ধিজীবিকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। | অন্য এক সংবাদ প্রকাশ, বেশ কিছুদিন পূর্বে-জঙ্গীশাহীর বর্বর সৈন্যরা মর্নিং নিউজের চীফ। রিপাের্টার জনাব শহীদুল হক, ঢাকা বেতারের সাইফুল বারি ও এ, পি, পি’র জনাব মােজাম্মেল হক ও পি,পি, আই এর জনাব নাজমুল হক সহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে ধরিয়া লইয়া যায়। পরে তাহাদের কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই।
সামরিক সরকার বাঙালী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বিশ্বাস করিতে না পারিয়া পশ্চিম পাকিস্তান হইতে অবাঙ্গালী চীফ সুপারিটেনটেনডেন্ট অব পুলিশ ও চীফ সেক্রেটারী আমদানী করিয়াছে ।
বাংলার বাণী | ১৫ সংখ্যা # ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
ঢাকার অদূরে জানােয়ারদের নৃশংস হামলা কয়েকটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন : বিদেশী পত্রিকার রিপাের্ট
| মার্চ-এপ্রিল নয়, নভেম্বরের শেষের দিকে ঢাকার অদূরে কয়েকটি গ্রামে কসাই ইয়াহিয়ার জানােয়ার বাহিনীর লােমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের দু’একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
সুইডেনের ‘এক্সপ্রেশান’ সংবাদপত্রের দূরপ্রাচ্য সংবাদদাতা হারমান লিগুভিষ্ট বাংলাদেশের। হাজারাে মাই লাইর মধ্যে একটির আংশিক বিবরণ দিয়েছেন। | প্রকাশিত রিপাের্টে বলা হয়েছে, “যা কিছুই পােড়ানাে যায়, তাই পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। সর্বত্রই ধ্বংসলীলার চিহ্ন। গৃহে ব্যবহার্য তৈজসপত্র পর্যন্ত ধ্বংস করা হয়েছে। বেঁচে থাকা মানুষগুলি ধ্বংস স্তুপের মধ্যে বাঁচার উপকরণ খুঁজছিল…।”
বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ধানে দুটি গ্রামে পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর হানা দেওয়ার পর সমস্ত এলাকাকে তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে অসংখ্য বাঙালীকে পৈশাচিক আনন্দে হত্যা করে। সংবাদদাতা লিখেছেন যে, এই ধ্বংসযজ্ঞে কত বাঙ্গালী প্রাণ হারিয়েছে তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। | দুটি ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামের মধ্যে একটির নাম কালামূড়ি। এ গ্রামে জানােয়ার হানাদার বাহিনী কমপক্ষে ৭৫টি গৃহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে এবং ৫০ থেকে ৮০ জনের মতাে বাঙ্গালীকে হত্যা। করেছে।
সংবাদদাতা লিখেছেন যে, গ্রামবাসীরা তাঁকে ঘাস দ্বারা আচ্ছাদিত কয়েকটি মৃতদেহ দেখান। কিন্তু গন্ধ বেরুচ্ছে দেখে ঘাস উলটিয়ে মৃতদেহগুলি দেখতে সাহসী হননি। | সংবাদদাতা লিখেছেন যে, বাশ ঝাড় এবং সাদা শাপলা ফুলে আচ্ছাদিত একটি পুকুরে খান সেনারা তিন শতাধিক মৃতদেহ ফেলে দেয়।” | সংবাদদাতা বলেন, পাকিস্তানী সৈন্যরা কেন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালালাে তা কেউ বলতে। পারে না। কেউ বলেছেন, তারা বাঙ্গালীদের হত্যা করে আনন্দ পায় বলেই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। অন্য । আর একজন বলেছেন যে, হয়তাে ইয়াহিয়ার পশু সৈন্যরা মনে করেছে যে এ এলাকায় মুক্তি সেনানীরা। থাকে তাই এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন এখানে কোন মুক্তি সেনা নেই। কোন অস্ত্র। খান সেনারা পায়নি এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরােধও ছিল না।
ধ্বংসপ্রাপ্ত দু’টি গ্রামের একটিতে জনৈক যুবকের সাথে কথাবার্তার বিবরণও সুইডেনের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। যুবকটি সংবাদদাতাকে বলেছেন, নভেম্বরের গত সপ্তাহের বুধবারে সৈন্যরা আসে; পাঞ্জাবী সৈন্য। তারা গৃহে গৃহে তল্লাশী চালায় এবং টাকা পয়সা লুট করে। শুক্রবার তারা। আবার ফিরে আসে। তারা কয়েক শত ছিল। তখন সন্ধ্যা ছ’টা। হঠাৎ তারা কারফিউ জারী করে এবং কয়েকটি ফাকা আওয়াজ করে। আমাদের মধ্যে অনেকেই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে চেষ্টা করে। তারা। গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। তারপর সৈন্যরা গৃহে গৃহে তল্লাসী শুরু করে তারা হাতের কাছে যা। পেয়েছে—অলংকার নগদ টাকা, সব কিছু পকেটস্থ করে। তারা এ সময় আর বহু লােককে হত্যা। করে। কয়েকটি গৃহে তারা হাত বােমা নিক্ষেপ করে। এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সারা রাত ধরে চলে এ এক ভয়াবহ দৃশ্য। প্রাণ ভয়ে ভীত মানুষের সে সকরুণ কান্নার বিবরণ দান দুঃসাধ্য।
জয়বাংলা (১) ৪ ১: ৩১ ॥ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১।
বেগম মুজিবের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
| ঢাকা মুক্ত হবার পর বেগম মুজিবর রহমান অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের বাসভবন থেকে নিচে নেমে আসেন এবং বাংলার মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। প্রকাশ করেন। | বেগম রহমান জানান, পাক সৈন্য বাহিনী তাদের বাড়ির চতুর্দিক ঘিরে রেখেছিল। পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরেও খান সেনারা গুলি চালিয়ে একজন মহিলা সহ ছয় জন লােককে নিহত করেছে। দীর্ঘ আট মাসাধিক কালের অত্যাচার উৎপীড়নের কাহিনীও বেগম রহমান সাংবাদিকদের কাছে তুলে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ | ১; ১৮ ! ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১।
“বাংলাদেশের শাসন শােষণ পাক সামরিক সাধ্যের বাইরে “মুক্তিবাহিনী এখন সুসংগঠিত এবং গেরিলারা পাক সেনাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ঢাকা, যশােহর, এবং
চট্টগ্রাম প্রতিদিনই আক্রমণ করেছে”
সম্প্রতি বি বি সি’র প্রতিনিধি মার্টিন বেল প্রধান সংবাদ বুলেটিনে বাংলাদেশ সম্বন্ধে এক বিবৃতি । প্রদান করেছেন।
| মার্টিন বেলের সঙ্গে বক্তব্য সুস্পষ্ট, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ক্রমেই মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে। আসছে। মুক্তি বাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধারার আক্রমণে পাক সেনাবাহিনীদের নাজেহাল করে অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর অধীন যে সব গ্রাম রয়েছে সেগুলােতে যদিও পরিবহন অথবা যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন তবুও মুক্তিফৌজ পাকসেনাবাহিনীদের উপর বারংবার আঘাত হেনে এদের | ব্রিত করে তুলছে। উত্যক্ত পাকবাহিনী ক্রমেই মনােবল হারিয়ে ফেলছে, এমনও উদাহরণ আছে ভীত | সন্ত্রস্ত পাক সেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে অস্ত্রশস্ত্র এমন কি রসদ ফেলে পালিয়ে গেছে।”
সংগ্রাম আজ কেবলমাত্র বাংলা দেশের জনগণের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, এ সংগ্রামে বিশ্বের বিভিন্ন । অঞ্চলের জনগণ বিচলিত, বিক্ষুব্ধ । অনেকেই এ সংগ্রামে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক। আজ এ মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র । | অংশ গ্রহণে ইচ্ছুক ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক মাসয়ে অঁদ্রে মালরাে।
| ‘লা ফিগারাে’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের উপর জোর দিয়ে মশিয়ে মারাে লিখেছেন আবেদন নিবেদন দেয়া হইয়াছে। আজ ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর বর্বরতার একমাত্র জবাব সশস্ত্র সংগ্রাম। “বাংলার জনগণকে যদি কেউ সত্যিই সাহায্য করতে চান তবে তাকে সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙ্গালীর পাশে এসে দাঁড়াতে হবে” এই বৃদ্ধ লেখক ঘােষণা করেন “আমি বাংলাদেশের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিতে চাই, মানবতার সপক্ষে এই সংগ্রাম একটি মহান সংগ্রাম।” | মার্কিন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কেনেথ গলব্রেথ, বলেছেন, “বাংলাদেশে বলপূর্বক শাসন চালাবার চেষ্টা করলে পাকিস্তানের অর্থনীতির শােচনীয় পরিণতি হবে”। শেখ মুজিব সম্পর্কে এক মন্তব্যে তিনি বলেন “শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছেন। তার বিচারকে গণতান্ত্রিক বলে চালানাে হলে গণতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা হারাবে।”
সিরিয়ার এক সাংবাদিক স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন, “আমরা সিরিয়াবাসীরা আঞ্চলিক দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে এক সময় যুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের মিশর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি, সিরিয়া এবং মিসরের জনগণের ভাষা ও ধৰ্ম্ম এক, এ সত্বেও এ দুদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াতে যদি ইসলাম বিপন্ন
হয়, তা হলে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ভিন্ন ভাষাভাষী বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলে ইসলাম বিপন্ন হয় কেমন করে?
কায়রাের আল অহরাম পত্রিকার সম্পাদকীয় বাের্ডের একজন সদস্য বলেছেন “ইয়াহিয়া সরকার আরব দেশগুলিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে সম্পূর্ণ মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। | সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন অধ্যাপক বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি বিশেষ দলিল প্রকাশ করেছেন। এ তিনজন অধ্যাপকের নাম অধ্যাপক এ্যাডওয়ার্ড এম ম্যাসেন, অধ্যাপক রবার্ট ডফম্যান, এবং অধ্যাপক স্টীম্যান এ মারগলীন। তাদের প্রাথমিক বক্তব্য ছিল মাত্র কয়েকটি শহরে সেনাবাহিনী মােতায়েন করিয়া বন্ধুকের নলের মুখে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন মানুষ বাস করে গ্রামাঞ্চলে। ইহাদের উপর শাসন শােষণ অব্যাহত রাখা পাকিস্তান সামরিক জাৰ্ত্তার সাধ্যের বাইরে।”
এদের বক্তব্য একটি জাগ্রত দেশের জনগণকে বলপূৰ্ব্বক এবং অস্ত্র দ্বারা বন্দী করে রাখা যায় । স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ একটি বাস্তব। আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করিয়া মুক্তিযুদ্ধের কোন ক্ষতি করিতে পারিবে না।
| সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং আফগানিস্তান সম্প্রতি এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছে যে তারা আশা করেন বাংলাদেশে পাক জঙ্গী সরকার এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবেন যাতে শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরে আসতে পারেন। এ সংবাদ পরিবেশিত হয় তাস এ। | সােভিয়েত ইউনিয়নে বিভিন্ন সংগঠনের বিভিন্ন সম্মেলনে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশের জনগণকে গত বিশ বছরের বেশী সময় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে দাবিয়ে রাখা হয়েছিল, বাংলাদেশের জনগণের যুদ্ধ আজ এই বিশেষ ব্যবস্থার থেকে মুক্তির যুদ্ধ। | বৃটিশ পত্রিকা ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা এক বিশেষ নিবন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলােকে পাকিস্তানের উপর বাংলাদেশ সমস্যার উপর চাপ সৃষ্টি করতে এক অনুরােধ করে। পত্রিকাটির গত বুধবারের এক সম্পাদকীয়তে বলে। বাংলাদেশকে বিভিষিকার এরকম পর্যায়ে পাকবাহিনী নিয়ে যাচ্ছে। তাদের বাধ্য করা হউক আজকের এ মাতলামি বন্ধ করার জন্য।’
ঢাকার গেরিলা তৎপরতা সম্বন্ধে বিদেশী সাংবাদিক ফ্রেরার হলিংওয়ার্থের প্রায়ই এবং কোন কোনদিন একাধিক তােটিমারা তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে বিবৃতি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর
একজন প্রধান এই সাংবাদিকের কাছে মন্তব্য করেন ‘গেরিলা বাহিনী বিশেষ করে বিস্ফোরক ব্যবহারে। বিশেষ পারদর্শী।” | মুক্তি যােদ্ধাদের পারদর্শিতার অনেকেই ভেবেছিলেন বিশেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বিশ্বাস ধরণের দক্ষ এবং সাফল্য জনক প্রতিটি অভিযানের বিদেশীদের হাত আছে কিন্তু “দি টাইম” এর এক রিপাের্টার এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎ করে কর্ণেল খালেদ মােসাররফ মন্তব্য করেন | “এটা বড়ই হাস্যকর ব্যাপার। এধরণের বিস্ফোরকগুলি স্বভাবতঃই কোন সাধারণ নয় কিন্তু এগুলাে | আমাদের ইঞ্জিনীয়ার অথবা বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত লােকজনের সাথে আলাপ আলােচনা করেই করা
হয়। এরা সবাই বাংলাদেশেরই লােক।” | বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলীয় সদস্য এবং প্রাক্তন মন্ত্রী মিঃ পিটার শাের লণ্ডনে “নিউ ষ্টেসমান” | পত্রিকা লিখিত এক প্রবন্ধে দৃঢ়মত প্রকাশ করে বলেন যে, “বাংলাদেশকে স্বাধীনতা দিতে হবে। কারণ | পাকিস্তানের আর অস্তিত্ব নাই। মিঃ শাের বলেন ইয়াহিয়া খানের নির্বুদ্ধিতা ও তাহার জেনারেলদের | হিংস্রতা ও বর্বরতা এর জন্য দায়ী।
লড়াই (পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধ বুলেটিন)-১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩