You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.04.19 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগ | মার্শাল লননলের পদত্যাগ | ওদের নির্মূল করতে হবে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার, ৬ই বৈশাখ, ১৩৮০

শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগ

খবর দুটো উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বার্থহীন ঘোষণা। খবর দুটো পর পর এসেছে, ছাপা হয়েছে কালকের কাগজে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগ এবং তৎসম্পর্কিত ঘোষণা নয়াদিল্লির সুইস দূতাবাসের মাধ্যমে পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আশা করা হয়েছে যে এই মহৎ উদ্যোগে পাকিস্তান সাড়া দেবে।
বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকেই শান্তির সাথে বহিঃ বিষয়ক নীতিসমূহ প্রণয়ন করে আসছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সৎ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা তথা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আমাদের নীতি শুধু সর্বজনবিদিতই নয়, বরং সকল মহল কর্তৃক প্রশংসিতও বটে। বিশ্বশান্তি আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায় যারা বিরোধী তারা প্রথম থেকেই আমাদের পদক্ষেপসমূহ কে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। চলেছে ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তারা গ্রহণ করেছেন উট পাখীর নীতি। সে সকল দেশের সরকারি মহলে অশুভ চিন্তার প্রভূত আমাদের শান্তি নীতি থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
একশত পঁচানব্বই জন যুদ্ধাপরাধীর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিচার পদ্ধতিতে বিচার করবার যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেছেন তা এতদাঞ্চলের সমস্যাসমূহের জটিলতা নিরসনে সহায়তা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। গোপনীয়তা এবং অস্পষ্টতা সমস্যাকে জটিল করে তুলতে পারে, গ্রন্থি মোচনে কোন প্রকার সাহায্য করতে পারে না। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রশ্নের যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে অস্পষ্টতা অথবা গোপনীয়তার কোনো অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে, বাংলাদেশে বসবাসকারী যারা পাকিস্তানে চলে যেতে চান তাদের চলে যাবার অবাধ স্বাধীনতা দেয়া হবে আর সার্বভৌমত্ব ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে যেকোনো সময় উপমহাদেশে সমস্যা সমাধানে এতদঞ্চলের রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশ আলাপ আলোচনায় বসতে রাজি। পূর্বে যেমন ছিল আজকেও আমাদের নীতি তেমনি অপরিবর্তিত। প্রয়োজন শুধু অপরপক্ষের আন্তরিকতা ও বাস্তব বোধ।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আজ পর্যন্ত আমাদের শান্তির ডাকে নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া দিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, তারা নিজেরাও উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কম উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এই সেদিনও সিমলা বৈঠকের পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের যে চুক্তি সমূহ সম্পাদিত হয়েছিল, যা বাংলাদেশও আন্তরিকভাবে অভিনন্দন করেছিল, তার বিধান লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের প্রকৃতপক্ষে উপমহাদেশে উত্তেজনা জিইয়ে রাখার নীতি অনুসরণ করে চলেছে। আমরা আশা করি শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে পাকিস্তান আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া দেবে। সৎ সম্পর্ক স্থাপন এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই অঞ্চলের জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় এর কোন বিকল্প নেই।

মার্শাল লননলের পদত্যাগ

লননল সরকার পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের কারণ অবশ্য জানা যায়নি। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে বোমাবর্ষণ এরপর স্বৈরাচারী লননল নামপেন তথা যারা কম্বোডিয়ার বুকে যেভাবে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল তাতে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল লননল সরকারের দিন ঘনিয়ে এসেছে।
অষ্কস্মাত একদিন কম্বোডিয়ার রঙ্গমঞ্চে লননল উড়ে এসে জুড়ে বসে ছিল। অস্ত্র আর শক্তির দাপট দেখিয়ে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল জনতার আশা ও আকাঙ্ক্ষাকে। সেদিন কোন অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে কম্বোডিয়ার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল তা বুঝতে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের আদৌ অসুবিধা হয়নি। ভিয়েতনাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। বিশ্ববাসী উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হলেও ভিয়েতনামের মাটির থেকে মার্কিন সৈন্যরা বিদায় নিলেও তারা যেকোনো বাহানায় কম্বোডিয়ার মাটিতে থাকবে। সে কারণে থাইল্যান্ডের মার্কিন বোমারু বিমানের ঘাঁটিটিকেও সযত্নে সংরক্ষিত রাখা হলো। উদ্দেশ্য যে কোন সময় যেন কম্বোডিয়ার লননলের বিপর্যস্ত ও নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন সৈন্য বাহিনীকে সাহায্য করা যায়। বাস্তবে হচ্ছে ও তাই। লননল সরকারের পদত্যাগ কোনো আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভিয়েতনাম তথা কম্বোডিয়ার সামগ্রিক ঘটনা প্রবাহের সঙ্গেই তার যোগসূত্র রয়েছে। বাস্তবতার আঘাতে লননলের একথা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে ক্ষমতার ভরাডুবি অত্যাসন্ন। মার্কিন প্রভুরাও আর ডুবন্ত তরী কে টেনে তুলতে পারবে না। তরী ডুববেই। সুতরাং ডোবার আগে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই লননল সরে পড়েছে। অথবা এমনও হতে পারে মার্কিন প্রভুদের সন্তুষ্টি বিধানের সক্ষম হচ্ছে না বলেই বিদায় নিতে হচ্ছে লননলকে যেমনটি একদিন ভিয়েতনামের ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে থেকে মার্শাল কাউকি বিদায় নিয়েছিল। তারই জায়গায় এগিয়ে এসেছিল মিঃ থিউ। কম্বোডিয়াতে এমন ঘটনার জন্ম হতে পারে।
যে ঘটনার জন্যই হোক না কেন এটা নিশ্চিত যে, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড থেকে অচিরেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কে বিদায় নিতে হবে। সংবাদে প্রকাশ, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার বিভিন্ন প্রদেশের সরবরাহের প্রধান স্থল ও নদী পথগুলো মুক্তিযোদ্ধারা বন্ধ করে দিয়েছে। নমপেন ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে প্রধান সরবরাহ লাইন মেকং নদী গত দুসপ্তাহ ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কম্বোডিয়ার রাজধানীতে গেরিলাদের অর্থনৈতিক অবরোধ জোরদারের পরিপ্রেক্ষিতে নমপেনে তীব্র তেল সংকট দেখা দিয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। আর এর অনিবার্য ফলশ্রুতি মার্শাল লননল আজ এক তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। সংকটের ফলে দুচোখে সর্ষেফুল দেখেই শেষ পর্যন্ত মার্শালকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। স্বেচ্ছায় যে মার্শাল লননলকে পদত্যাগ করেছেন এমনটি মনে করার কোনো যুক্তি সংগত কারণ নেই। বাস্তব অবস্থার চাপে বাধ্য হয়েই আজ সরে দাঁড়াতে হচ্ছে মার্শাল লননলকে। এ ইতিহাসের অমোঘ বিধান। এ বিধান কে উড়িয়ে দেবার কোন উপায় নেই।

ওদের নির্মূল করতে হবে

বাণিজ্য মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান গত পরশু চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী সুষ্ঠুভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে অসাধু ব্যক্তিদের বাণিজ্যিক অঙ্গন থেকে বিতারণের জন্য সরকার কতিপয় বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিদেরও ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে।
এই ভাষণে মন্ত্রী আরো বলেন, চোরাকারবারি মুনাফাখোর, মজুতদার ও ফটকাবাজিদের খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে সরকারের সাথে সহযোগিতা করার জন্য সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।
আমরা জানি যে, একশ্রেণীর ঘৃণ্য ব্যবসায়ী ও ফটকাবাজিরা রক্তচোষার মতো দেশের সাধারণ লোকের রক্ত পান করে নিজেদের উদর পূরণ করছে নির্লজ্জের মতো। বহু ত্যাগ, তিতিক্ষা, ধৈর্য ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সংগ্রামী মানুষের সেই আদর্শবোধের উপর নির্মম কুঠারাঘাত হানছে। স্বাধীনতা উত্তর বিধ্বস্ত দেশের শত সহস্র সমস্যার চেহারাকে এরা ভয়াবহ করে তুলেছে। এরা যেন শ্মশানে বসে হাড়ের ব্যবসা শুরু করেছে। এ হাড় যে তার আত্মজ বা আত্মজার হতে পারে কিংবা একান্ত প্রিয় আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধু-বান্ধবের হতে পারে এমন চিন্তার অবকাশটুকুও এদের নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে লাইসেন্স নিয়েও চলে মুনাফাখোর এর খেলা।
লাইসেন্স বিক্রিকারী ঐসব অসাধু ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করতে পারলে এবং তাদের যথাযোগ্য শাস্তি বিধান করতে পারলে প্রকৃতপক্ষে তা জাতীয় কল্যাণ ডেকে আনবে। এছাড়াও এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ফঁড়িয়াদের মুনাফা অর্জন করা বন্ধ হয়ে যাবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যমান একটা স্থিতিশীলতায় আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সোনার বাংলা গড়ার কাজে দেশবাসীর সহযোগিতা সর্বাধিক প্রয়োজন একথা বলাই বাহুল্য। দুর্নীতি দমন ও সমাজ বিরোধী তৎপরতা দমনের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই দেশবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে বলে আমরা মনে করি। সকলের সমবেত চেষ্টাতেই ওদের নির্মূল করা সম্ভব হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন